২৩. রতন পজ্জোত জাতক
“ইহা একান্তই আশ্চর্য দুঃখ” ইহা ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান কালীন এক মাতৃ পোষক ভিক্ষু সম্পর্কে বলেছিলেন।
তৎকালে জনৈক ভিক্ষু প্রত্যহ পিণ্ডাচরণ করে স্বীয় মাতাকে ভোজন করায়ে পরে অবশিষ্ট পিণ্ডপাত নিজে ভোজন করতেন। পর্বোপলক্ষেও পিণ্ডপাতাদি যা খাদ্য বস্তু লাভ করতেন তাও মাতাকে দিতেন। মাতা খাওয়ার পর অবশিষ্ট নিজে পরিভোগ করতেন। বস্ত্রাদি দানীয় সামগ্রী যা লাভ করতেন, তাও ব্যবহারের জন্য মাতাকে প্রদান করতেন। এরূপে মাতাকে পোষণ করবার জন্য শ্রম করাতে তিনি ক্রমে কৃশ ও রক্ত শূন্য হয়ে দুর্বল হলেন। একদা তার হিতৈষী পরিচিত ভিক্ষুগণ তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন– “বন্ধো, পূর্বে আপনার দেহ-বর্ণ বেশ সুন্দর ছিল। এখন আপনি কৃশ রক্তশূন্য এবং পীতবর্ণ হয়েছ কেন? আপনি কোনও রোগ ভোগ করছেন কি?” ইহা শুনে মাতৃ পোষক ভিক্ষু বললেন–“বন্ধো, আমার কোন রোগ নেই। তবে আমার মাতাকে পোষণের জন্য অতিরিক্ত শ্রম করতে হয়। ইহাই আমার কৃশ হওয়ার কারণ। তার একথা শুনে ভিক্ষুগণ। বললেন–“বন্ধো, শ্রদ্ধায় প্রদত্ত বস্তু নষ্ট করা নিষেধ। তবে আপনি শ্রদ্ধায় প্রদত্ত দানীয় বস্তু নারীকে দিয়ে বড়ই অন্যায় করেছেন। ভিক্ষুদের এসব আলাপ আলোচনা শুনে মাতৃ পোষক ভিক্ষু বিশেষভাবে লজ্জিত হয়ে স্বীয় প্রকোষ্ঠে গিয়ে নীরবে অবস্থান করতে লাগলেন। তখন ঐ আগন্তুক ভিক্ষুগণ ভগবান। তথাগতের নিকট গিয়ে বলেন–“ভন্তে ভগবন, অমুক ভিক্ষু শ্রদ্ধায় প্রদত্ত দানীয় বস্তু গ্রহণ করে নারী জাতি পোষণ করছেন।” ইহা শুনে তখনি বুদ্ধ মাতৃ পোষক ভিক্ষুকে আহ্বান করে জিজ্ঞাসা করলেন–সত্যই কি তুমি স্ত্রী পোষণ করছ? “হাঁ। ভন্তে, তা সত্যি। সে নারী সম্বন্ধে তোমার কি হয়? “তিনি আমার মাতা” ভগবান বলেন–“তা তোমার অতি সাধুকার্য” এরূপ বারয় সাধুবাদ দিয়ে পুনঃ বলেন–“হে ভিক্ষু, তুমি আমার আচরিত পথেই চছ।” মাতা-পিতা পোষণ কর্ম হয় পণ্ডিতদের বংশে। “শাস্তা এবলে ভিক্ষুগণকে বলেন–তোমরা এ ভিক্ষুকে নিন্দা করোনা। পুরাতন পণ্ডিতেরা প্রব্রজিত হয়েও স্বীয় মাতাকে পোষণ করেছিলেন। মাতৃ-পোষক মহাপুণ্য লাভ করে।” এবলে বুদ্ধ নীরব রইলেন। তখন ভিক্ষুদের প্রার্থনায় বুদ্ধ অতীত কাহিনী বল্তে লাগলেন
“অতীতে মেঘবর্তী নামক নগরে ‘মহারথ’ নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল “শ্রীরতন গর্ভা দেবী।” তখন বোধিসত্ত্ব তুষিত দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে ঐ রতন গর্ভার জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। গর্ভ পরিপূর্ণ হলে রাণীর ইচ্ছা হল উদ্যান ক্রীড়া করবার জন্য। রাজাকে দেবীর এ ইচ্ছা জ্ঞাপন করলেন। রাজা কাল বিলম্ব না করে তখনই উদ্যানপালকে উদ্যান সজ্জিত করবার জন্য আদেশ করলেন। উদ্যানপাল তখনই বাগান সুসজ্জিত করে রাজাকে বল্ল–“মহারাজ, উদ্যান সজ্জিত করা হয়েছে।” তখন রাজা মহাপরিষদে পরিবৃত হয়ে দেবী সহ সুবর্ণ সিবিকায় আরোহণ করে উদ্যানে প্রবেশ করলেন। তথায় সারাদিন মহানন্দে উদ্যান। ক্রীড়ায় অতিবাহিত করলেন। তখন সন্ধ্যা সমাগত। তাই রাজা প্রমুখ বিপুল জনতা নগরে না গিয়ে বাগানেই রাত্রি যাপন করলেন। রাজা-রাণী একস্থানে এবং পরিষদবৃন্দের স্বীয় স্বীয়। রুচি অনুযায়ী স্থানে শয়ন করে নিদ্রিত হল। শেষ রাত্রে রতনগর্ভা দেবী এক স্বপ্ন দেখলেন। তা এইঃ–“এক কালবর্ণ পুরুষ, চক্ষুদ্বয় তার রক্তবর্ণ, কেশরাজিও রক্তবর্ণ, পরিধানে রক্তবর্ণ বসন। তার হতে প্রকাণ্ড এক আয়ুধ। এরূপ ভীবৎস চেহারা সম্পন্ন একজন লোক পশ্চিমদিক হতে এসে দেবীর শয়ন প্রকোষ্ঠ-দ্বার খুলে প্রবেশ করল এবং দেবীর শিরকেশ ধরে আকর্ষণ করে দেবীকে উত্তানাবস্থায় ভূমিতে ফেল। বহু কান্না করা সত্ত্বেও দেবীর চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করল; বাহুদ্বয় ছেদন করল ও বক্ষ বিদীর্ণ করে সরক্ত হৃদয়টা নিয়ে পশ্চিমদিকে চলে গেল।
দেবী এরূপ স্বপ্ন দেখার পর নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে অত্যধিক ভীতা ও সন্ত্রস্তা হলেন। কম্পিত হৃদয়ে চিন্তা করলেন–“আমি এরূপ কুস্বপ্ন কেন দেখলাম? এতে আমার বা রাজার কোন প্রকার অন্তরায় হতে পারে। এমনে করে তিনি রাজাকে স্বপ্ন-বিবরণ বলেন। রাজাও এ স্বপ্নের কথা শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হলেন এবং হৃদয় থরথর কাঁপতে লাগল। তিনি চিন্তা করলেন–“এরূপ দুঃস্বপ্নের কথা আমি কখনো শুনেনি। ইহা রাণীর বা রাজ্যের কোন অন্তরায়ের ঈঙ্গিত বলে মনে হচ্ছে। এরূপ চিন্তা করে প্রভাত হওয়া মাত্র স্বপ্ন তত্ত্বজ্ঞ এক ব্রাহ্মণ আহ্বান করে উক্ত স্বপ্নের বিষয় তাঁকে বলেন। ব্রাহ্মণ তা সম্যরূপে অবধারণ করে স্বপ্নতত্ত্ব সম্যরূপে বিচার করে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, এ স্বপ্ন বড়ই মর্মান্তিক। রাণী আর আপনার মধ্যে পরস্পর পৃথক হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।” ইহা শুনে রাজা ব্রাহ্মণকে বললেন–“ভবৎ মহাব্রাহ্মণ, আমার যে পরস্পর পৃথক হব বলে কহিলেন, কোন্ কারণে আমরা পরস্পর পৃথক হব?” ব্রাহ্মণ বলেন–“মহারাজ, অদ্য সন্ধ্যার সময় আপনার সমস্ত রাজ্যে মুষল ধারে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। রাত্রির প্রথম যাম হতে বর্ষণের ফলে সারা রাজ্যে মহাজল প্লাবন হবে। ক্রমে জল প্লাবন বর্ধিত হয়ে প্রথমে পায়ের গোপ পরিমাণ, অনুক্রমে জানু, উদর, কটি, স্তন, মস্তক, এক তালবৃক্ষ, দু’তালবৃক্ষ এমনকি সপ্ততাল বৃক্ষ পরিমাণ জল বর্ধিত হবে। ইহাই আপনাদের বিচ্ছেদ হওয়ার প্রধান কারণ।” ইহা শুনে রাজা ব্রাহ্মণগণকে পুনঃ বলেন–“ভবৎগণ এখন আমাদের কি করা প্রয়োজন?” ব্রাহ্মণগণ বলেন–“দেব নৌকা ব্যতীত আর কোনই শণ দেখছিনা” রাজা তখনই বর্ধকী আহ্বান করে বলেন–“তুমি অদ্যই আমাকে একখানা নৌকা তৈরী করে দাও। বর্ধকী তা সন্ধ্যার পূর্বেই তৈরী করে দিল। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসল, তখন হতে আকাশে ঘনমেঘ উঠে ব্রাহ্মণদের কথিত মতে বৃষ্টি বর্ষণ আরম্ভ হল। ক্রমে সমগ্ররাজ্যে প্রবলভাবে জল-প্লাবন আরম্ভ হল। জনগণ এ মহা প্লাবন দেখে মহাভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সচীকারে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল। তির্যগ প্রাণীদের আর্তনাদে দিগুগুল নিনাদিত হল। তখন জলতরঙ্গে ভেসে ড়ুবে বহু প্রাণী মৃত্যু বরণ করল। এ বিপদকালে রাজা-রাণী নৌকায় আরোহণ করে উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে কোন্ দিকে যে চলে যাচ্ছে, এর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। দেবী ছিলেন তখন অন্তঃসত্ত্বা। রাণী তরঙ্গাঘাতে ভীতা ও ধৈর্য হীনা হয়ে অপূর্ণ নেত্রে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
১। “এ দুঃখ একান্তই আশ্চর্য জনক। এ দুঃখে সর্বদা তীব্র গতিতে বর্ধিত হচ্ছে। আমি নিত্য সুখেই বাস করে আছি।
এখন এ মহাজলপ্লাবনে কিরূপে জীবন ধারণ করবো?” দেবী এবলে রাজার সাথে আলাপচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২। “মহারাজ, এখন আমরা অত্যন্ত অনাথ। যেহেতু আমরা উভয়ে মহাজল রাশিতেই ভেসে যাচ্ছি। আমরা কি প্রকারে প্রতিষ্ঠা লাভ করবো? এ মহাজলরাশিতো প্রতিষ্ঠার বস্তু নহে।” দেবী ইহা বলে পুনঃ বিলাপচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৩। “মহারাজ, অদ্যই আমি আপনার মুখ দর্শন হতে বঞ্চিত হবো। নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু হবে। এ জীবনের জন্য আমরা বিচ্ছেদ হয়ে পড়ব।” দেবী এরূপে ক্রন্দন করলে, রাজা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন–“ভদ্রে, আমি সঙ্গে থাকতে তোমার আবার ভয় কিসের? তুমি রোদন করোনা। আমি সর্বদা তোমাকে এরূপ বতাম-” আমার এবং সব রাজাদের সম্পত্তি বিনষ্ট স্বভাব সম্পন্ন। জীবনও সেরূপ মরণও পরিক্ষীণ স্বভাবী ইত্যাদি বলে মহারথ রাজা প্রিয় ভার্যাকে আশ্বাস দিয়ে এবং নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বলেন–
৪-৫। তুমি বিলাপ ও ক্রন্দন করোনা। সংস্কার ধর্ম মাত্রই অনিত্য, উৎপন্ন ও ব্যয়শীল। ইহা জগতের ধর্ম। আমি এবং তুমি উভয়ে মিলে যে সব পুণ্য কর্ম করেছি সুখের জন্য, তা সর্বদাই চিন্তা করা উচিত।” রাজা ইত্যাদিরূপে দেবীকে সান্তনা। দিয়ে উভয়ে মহানৌকার আশ্রয়ে জীবন রক্ষার উপায় চিন্তা করে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময় উত্তাল তরঙ্গাঘাতে নৌকাখানি ভগ্ন হয়ে গেল। তৎক্ষণে দেবী মরণভয়ে ভীতা হলেন এবং অনন্যোপায় হয়ে মহাশব্দে বিলাপ পরায়ণা হয়ে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
৬। “মহারাজ, শীঘ্রই, আমাকে গ্রহণ করে দুঃখ হতে মুক্ত করুন। আপনি বিনা আমি বাঁচতে পারব না। এখানে আপনি আমাকে ত্যাগ করবেন না।” রাজা দেবীর বিলাপ শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে দুঃখের সহিত নিজের চাদর দ্বারা স্বীয় কটিদেশের সাথে দেবীর কটিদেশ শক্তভাবে বন্ধন করলেন। তারপর উভয়ে উপবেশন করলেন। তরঙ্গের তীব্র আঘাতে নৌকা ছিন্ন ভিন্ন। হয়ে গেল। রাজা-রাণী উভয়ে ভাসূতে ভাসতে পুরাতন কর্মের বিপাকে উভয়ের বস্ত্র-বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। ইহাতে দেবী অহোরাত্র যাবৎ একাকিনী জলে ভেসে ড়ুবে কষ্ট ভোগ করলেন।
এ রাজা অতীতে একজন্মে বারাণসী নগরের রাজা ছিলেন। তিনি রাণী সহ গঙ্গায়ন করবার কালে জলক্রীড়া করছিলেন। তখন এক সপ্তম বর্ষীয় শ্রামণের ক্ষুদ্র একখানা নৌকায় আরোহণ করে জলক্রীড়ারত রাজ-রাণীর সম্মুখ দিয়ে নদী পার হতে ছিলেন। তখন রাজ-রাণী উভয়ে ঐ ক্ষুদ্র নৌকাখানা ক্রীড়াচ্ছলে নাড়া দিল। এর ফলে শ্রামণের ভীত ত্রস্ত ও কম্পিত হৃদয়ে সে স্থানটা অতিক্রম করলেন। এমাত্র কর্মের বিপাকে রাজা-রাণী এজন্মে জল ঊর্মী দ্বারা মহাবিয়োগ-দুঃখ প্রাপ্ত হলেন। এখন পুরাতন কর্মবিপাক প্রকাশ করবার জন্য ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত তিনটি গাথায় বললেন–
৭-৯। “তোমরা অল্পমাত্র কৃতকর্মকেও অবহেলা করোনা। স্বল্প মাত্র কৃত পাপ পুণ্যও বিপুলভাবে দুঃখ সুখ বহন করে আনে। তদ্ধেতু তোমরা কখনো পাপকর্ম করো না। সর্বদা যথাসাধ্য পুণ্য কর্মই কর।” তখন দেবী-ভেসে-ড়ুবে চন্দন নামক পর্বত পাদদেশে উপস্থিত হলেন। তথায় উঠে ইতঃস্তত স্বীয় বস্ত্রখানা শুকিয়ে নিলেন। তা পরিধান করে এক বৃক্ষতলায় এসে বলেন। তিনি একাকিনী অসহায় অবস্থায় সাশ্রু নয়নে বিলাপ করতে করতে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–।
১০-১১। “পূর্বে আমাদের দ্বারা এরূপ বিয়োগ কর্ম সাধন করা হয়েছিল। সে কর্মবিপাকেই এখন আমি স্বামী হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। কখন আমি মহারাজ মহিপতি স্বামীকে দেখব? এখন অনাথিনী হয়ে একাকিনী এ মহারণ্যে উপস্থিত হয়েছি।”
তৎক্ষণেই সে দেবীর গর্ভস্থ মহাসত্ত্বের পুণ্য প্রভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল। তার কারণ চিন্তা করে দেবরাজ দেবীর অসহায় ভাব জানতে পারলেন। তখনই বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করে বলেন–“বাপু বিশ্বকর্মা, তুমি এখনই মনুষ্যলোকে গিয়ে চন্দন পর্বত পাদদেশে এক রমণীয় স্থানে পঞ্চবিধ পদ্ম সম্পন্ন মহাসরসীর নিকটবর্তী স্থানে এক পর্ণশালা তৈরী কর। তাতে প্রব্রজিতের সর্ববিধ উপকরণও দিয়ে এস।” তখন বিশ্বকর্মা দেবপুত্র দেবরাজের নির্দেশানুযায়ী পর্ণশালা তৈরী করে দ্বার-কবাটে লিখলেন–“যারা এখানে এসে প্রব্রজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা করেন, তারা এ প্রব্রজ্যার উপকরণ সমূহ গ্রহণ করুন। তারপর তথা হতে অমনুষ্য, উল্কট শব্দ ও মৃগপক্ষী ইত্যাদির উৎপাত রহিত করে স্বীয় স্থানে চলে গেলেন। দেবীও এদিক ওদিক পরিভ্রমণ করে একপদী রাস্তা দিয়ে ঐ পর্ণশালায় উপস্থিত হলেন। তথায় লিখা ও উপকরণাদি দেখে বুঝতে পারলেন, এসব দেবরাজ ইন্দ্রেরই অনুগ্রহ। তখন দেবী পর্ণশালায় প্রবেশ করে গৃহী বসন-ভূষণ ত্যাগ করলেন এবং ঋষি প্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়ে সুখে বাস করতে লাগলেন। একদা অর্ধরাত্রে দেবীর জঠরে কর্মজ বায়ু চালিত হল। তখন দেবী সুবৰ্ণ প্রতিমার ন্যায় এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। প্রভাতকালে দেবী সদ্যজাত শিশুকোনাদি কার্য সম্পাদন করে সেখানে নিরাপদে বাস করতে লাগলেন। মহাসত্ত্বের ভূমিষ্ঠকালে সেই চন্দন পর্বতে যা কিছু রত্ন ছিল, সব জ্যোতির্ময় হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল, তাই দেবী নিমিত্তানুসারে স্বীয় পুত্রের নাম রাখলেন “রতন পজ্জোত।” দেবী প্রত্যহ পুত্রকে পর্ণশালায় রেখে ফল-মূলের জন্য অরণ্যে প্রবেশ করে ফল-মূল নিয়ে যথাকালে স্বীয় পর্ণশালায় ফিরে আসতেন। এরূপে রতন পজ্জোত’ সহ দেবী দীর্ঘকাল যাবৎ মহারণ্যে বাস করছিলেন। বোধিসত্নের বয়স যখন পঞ্চ বর্ষ পরিপূর্ণ হল, তখন স্বীয় মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন–“মা আমার পিতা কোথায়?” দেবী বললেন–“প্রিয় পুত্র, তোমার পিতা মেঘবতী নগরের রাজা হন। আমি তারই ভার্যা, ইত্যাদি বলে, তাঁদের পূর্ববর্তী সমস্ত বৃত্তান্ত পুত্রের নিকট ব্যক্ত করলেন। বোধিসত্ত্ব তা শুনে বললেন–“মাত, অদ্য হতে আর আপনি ফল-মূলের জন্য অরণ্যে যাবেন না। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, তত দিনই আপনাকে সেবা করব।” পুত্রের এই বিস্ময়কর কথা শুনে দেবী শংকিত হৃদয়ে বললেন–“হের বাছা, তুমি অরণ্যে যেতে পারবে না। যেহেতুঃ–তুমি এখনো অতি ছোট আমার একমাত্র প্রিয় পুত্র। তুমি এখানে সুখে বাস কর।” ইহাতে বোধিসত্ত্ব আর কোন কথা না বলে নীরবতা অবলম্বন করলেন। একদা দেবী ফল-মূল আহরণের জন্য অরণ্যে প্রবেশ করলেন। তখন বোধিসত্ত্বও স্বীয় মাতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে অরণ্যে প্রবেশ করলেন এবং পথ জেনে নিলেন। একদা প্রাতে দেবী ফলমূলের নিমিত্ত অরণ্যে প্রবেশ করলেন। নানা ফল-মূলাদির দ্বারা খছি পূর্ণ করে পর্ণশালায় দিকে যাত্রা করলেন। কিয়দ্র এসে নিবিড় ছায়া সম্পন্ন এক মনোরম বটবৃক্ষ দেখে তথায় শ্রান্তি বিনোদনের জন্য উপবেশন করলেন। তথায় বিশ্রামান্তে পর্ণশালায় দিকে যাত্রা করলেন। তৎক্ষণে ‘বল্লাহ কো’ নামক এক যক্ষ তথায় এসে দেবীর হস্ত ধারণ করল। দেবী যক্ষের। অতি ভয়ানক বিরূপ চেহারা দেখে অতিশয় ভীতা, ব্রাসিতা হয়ে নিজের গমনের কথা ও বোধিসত্নের কথা স্মরণ পূর্বক নিন্মোক্ত তিনটি গাথায় বলেন–
১২-১৪। “আমার পুত্র অনাথাবস্থায় একাকীই বাস করছে। সে ফল-মূল না পেয়ে ক্ষুধায় দুঃখ ভোগ করছে। আমি এখন বিপদাপন্ন। এখন আমি অতি দরিদ্রাভাবে দুঃখীতাবস্থায় মহারণ্যে আছি। আমার পুত্রকে আর দেখবনা। এখানেই বোধ হয় আমার মৃত্যু হবে। আমার পুত্র দারিদ্রতা দুঃখ জানেনা। অপিচ আমার বিহনে সে দীর্ঘ দিন ধরে অনুশোচনা করবে। দিবারাত্রি দ্রিাশূন্য হয়ে সে স্বীয় দেহকে বিশুদ্ধ করবে।”
তখন রতন পজ্জোত’ পর্ণশালায় একাকী বসে বসে চিন্তা করলেন–সূর্য এখন অস্তাচলে গেল। আমার মাতা এখনো এখানে পৌঁছলেন না। এরূপ গৌণ করার বোধ হয় কোন একটা কারণ উপস্থিত হয়েছে।” ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করে পর্ণশালা হতে বের হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করলেন। পর্বগ্রে, নদীতীরে ও খােলাস্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে “মা-মা এখন তুমি কোথায় আছ?” এ বলে সচীকারে ডাতে লাগলেন। এতেও তিনি মাতার কোনই সাড়াশব্দ না পেয়ে সুবর্ণ হংসের ন্যায় শোভমান হয়ে স্থানে স্থানে গিয়ে মা-মা শব্দে অরণ্যানী ভেদ করে চল্তে লাগলেন। কোথাও মাতার কোন সাড়া না পেয়ে অনুক্রমে ঐ বটবৃক্ষের নিকটবর্তী হলেন। তখন দেবী স্বীয় পুত্র তথায় উপস্থিত হয়েছে দেখে বললেন–“বাবা, তুমি এখানে। এসোনা।” এবলে পুত্রকে তথায় উপস্থিত না হবার জন্য নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
১৫। “হে তাত, তুমি আমার নিকট এসোনা। এখানে একটি যক্ষ আছে। সে এখন ভক্ষণ করিবার জন্য আমাকে ধরেছে।” মহাসত্ত্ব মাতার একথা শুনে চিন্তা করলেন–“আমার জীবন ত্যাগ করেও মাতার জীবন রক্ষা করব।” এই চিন্তা করে আগামী কল্যই যেন তিনি বুদ্ধ হবেন, এ ভাবেই প্রসন্ন হয়ে যক্ষকে বললেন–“হে মহাযক্ষ, তুমি আমার রক্ত-মাংস ভক্ষণ কর। আমার মাতাকে শীঘ্রই ছেড়ে দাও।” এবলে নিমোক্ত গাথায় বললেন–
১৬। “ভবৎ মহাযক্ষ, তুমি এখন আমাকে ভক্ষণ কর। আমার মাতার জীবন দানার্থ আমার রক্ত, মাংস ও হৃদয় দান করছি। আমার মাতাকে শীগ্নির ছেড়ে দাও।”
এবলে মহাসত্ত্ব যক্ষের সমীপে গিয়ে বললেন–“হে মহাযক্ষ, এখন আমি তোমাকে আমার এদেহখানি দান। করলাম। তুমি শীগ্নির আমার মাতাকে ছেড়ে দাও। যক্ষ বল্লহে কুমার, তুমি এখন পঞ্চ বর্ষীয় বালক। তোমার হৃদয় ক্ষুদ্র কি বৃহৎ তা জানিনা। এখন আমি অতি ক্ষুধার্ত। সুতরাং এখন বড়হৃদয়ই খেতে ইচ্ছা করি। ছোট হৃদয় চাইনা। বোধিসত্ত্ব বলেন–হে মহাযক্ষ, সকলের হৃদয় সমান নহে। বড় দেহের হৃদয়ও ছোট হয়, আর কোন কোন ছোট দেহের হৃদয়ও বৃহৎ হয়। কারণ যারা পুণ্যার্থে উদ্যোগী নয়, শীল রক্ষা করেনা, দানাদি পুণ্য ক্রিয়া করে না, স্বর্গে-মোক্ষ মার্গ শোধন করেনা ও নির্বাণ অন্বেষণ করেনা, তারা মৃত্যুর পর অপায় দুঃখ প্রাপ্ত হয়। এসব ব্যক্তিরা প্রকাণ্ড দেহধারী হলেও তাদের হৃদয় অতি ক্ষুদ্র হয়। আর যারা পুণ্য কর্ম করবার জন্য উদ্যোগ করে, শীল রক্ষা করে, দানাদি পুণ্য কর্ম করে, স্বর্গ মোক্ষ মার্গ শোধন করে ও নির্বাণ অন্বেষণ করে, তারা মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ লাভ করে।
এতাদৃশ লোকের দেহ ক্ষুদ্র হলেও তাদের হৃদয় অত্যন্ত বৃহৎ হয়। হে মহাযক্ষ, আমার দেহ ক্ষুদ্র হলেও কিন্তু আমার হৃদয় অত্যন্ত বৃহৎ। যেহেতু আমি সর্বদা পুণ্যার্থে উদ্যোগ করি, শীল রক্ষা করি, ও পুণ্য কর্ম করি। বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক দান ভেদে দান দ্বিবিধ। বাহ্যিক দান বলতে বুঝায়–সোনা, রৌপ্যাদি জড় পদার্থ এবং হস্তী অশ্বাদি নানাবিধ জঙ্গম প্রাণী দান দেওয়াকে। বুঝায়। আর আধ্যাত্মিক দান বলতে বুঝায়–স্বীয় রক্ত মাংস ও হৃদয়াদি সমস্ত আধ্যাত্মিক বস্তু দানকে আধ্যাত্মিক দান বুঝায়। আমার দেহ ক্ষুদ্র হলেও আমি উক্ত দ্বিবিধ দান দিতে সক্ষম। হে মহাযক্ষ, তোমাকে এখন আমি আমার জীবনকে আধ্যাত্মিক দানরূপে দিচ্ছি। তুমি আমাকে ভক্ষণ কর। আমার মাতাকে শিল্পির ছেড়ে দাও। পুনঃ মহাসত্ত্ব যক্ষকে বলেন–সবারই দেহের একটা প্রমাণ আছে। কিন্তু হৃদয়ের কোন একটা প্রমাণ নেই। তুমি এখন আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে আমার হৃদয় মাংস। খাও। শিল্পির আমার মাতাকে ছেড়ে দাও। যক্ষ বোধিসত্ত্বকে বলল–হে কুমার, তুমি যদি তাই সত্যিই বল, তবে তোমার। হৃদয়-মাংস তুমিই এখন আমাকে দাও। আমি এখন অতি ক্ষুধার্ত। তোমার হৃদয়-মাংস খেয়েই তোমার মাতাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব। যক্ষের কথা শুনে মহাসত্ব চিন্তা করলেন–“এখন। আমি শস্ত্র কোথায় পাই? হঠাৎ স্মৃতি ঠিক করে আকাশ অবলোকন করে নিন্মোক্ত গাথায়ে বলেন–
১৭-১৯। “এ দান তেজে আমি অনাগতে বুদ্ধ হব; এ সত্যবাক্য প্রভাবে এখানেই শস্ত্র পতিত হউক। পারমী পূর্ণ করবার কালীন আমি কখনো কম্পিত হইনি। এ সত্য ক্রিয়াবলে এখানেই শস্ত্র পতিত হউক। আমি বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হয়ে জনগণকে উত্তীর্ণ করব; এ সত্য ক্রিয়া প্রভাবে এখানে শস্ত্র পতিত হউক।” এরূপ সত্যক্রিয়া করা মাত্রই আকাশ হতে তাঁর সম্মুখে শস্ত্র পতিত হল। ইহা দেখে মহাসত্ব পুনঃ নিতাক্ত গাথায় বললেন–
২০। “এসত্য তেজ দ্বারা আমি অনাগতে নিশ্চয়ই বুদ্ধ হব। অদ্যই এ মহারণ্যে আমার জীবন তোমাকে প্রদান করছি।” মহাসত্ত্বের মাতা পুত্রকে জীবন দান হতে বিরত করতে
পেরে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন—
২১। “হে প্রিয় পুত্র, আমি তোমার এ জীবন দান কামনা নিবারণ করছি। যদি তোমার এখানে মৃত্যু হয়, তবে আমার জীবনও এখানে ত্যাগ করব।” বোধিসত্ত্ব মাতার এবম্বিধ হৃদয় বিদারক কথা শুনে মাতাকে পুনঃ স্বীয় উৎসাহ প্রকাশার্থ নিন্মোক্ত তিনটি গাথায় বলেন–
২২-২৪। “আমি মাতার একমাত্র প্রিয় পুত্র হয়ে মাতার দুঃখ-উপদ্রব সহ্য করতে পারব না। মাতা প্রিয় পুত্রের বিয়োগ দুঃখ নিজ জ্ঞানবলে সহ্য করেন। আমার বর্তমানে তোমার জীবন নষ্ট হওয়া সমীচীন নহে। এখন আমি কি করলে আপনার সুখ হবে? তোমার সুখের জন্য আমি জীবন দান করব। ইহাতে দেবতারাও আমার প্রশংসা করবেন এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে প্রমোদিত হব।” এবলে বোধিসত্ত্ব মাতার পদে লুণ্ঠিত হয়ে বন্দনা করলেন এবং সত্যক্রিয়া প্রভাবে পতিত শস্ত্রখানা ভূমি হতে তুলে নিলেন। উক্ত শস্ত্রের দ্বারা স্বীয় বক্ষ বিদীর্ণ করে দক্ষিণ হস্তে স্বীয় হৃদয়-মাংস বের করে বাম হস্তে রাখলেন। পুনঃ উভয় হস্তে তা মস্তকে রেখে নিতাক্ত গাথায় বলেন–
২৫। “হৃদয় দান দ্বারা অনাগতে আমি বুদ্ধত্ব লাভ করব। ভবিষ্যতে বোধি লাভের জন্যই আমার এ হৃদয় ত্যাগ।”
এরূপে মহাসত্ত্ব স্বীয় হৃদয়-মাংস যক্ষকে দান করলেন। তৎক্ষণেই মহাপৃথিবী কম্পিত হল, সর্ববিধ ঋদ্ধির প্রাদুর্ভাব হল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে সর্বদর্শী বুদ্ধ নিন্মোক্ত চারটি গাথায় বললেন–
২৬-২৯। “তখন পঞ্চ বর্ষীয় বালক রতন পজ্জোত বোধির জন্যই যক্ষকে হৃদয়-মাংস দান করলেন। এদানকালে ভীষণ রোমাঞ্চকর মহা ভূমিকম্পন হয়েছিল। এবং রোমাঞ্চকরভাবে মহারণ্য সংক্ষুব্ধ হয়েছিল। যক্ষকে সে উত্তর হৃদয়-মাংস দানকালে সারা অরণ্যানীতে বিপুল নির্ঘোষ ধ্বনিত হয়েছিল।”
তখন বোধিসত্ত্ব স্বীয় হৃদয়-মাংস দান করে বলেন–হে মহাযক্ষ, আমার এ হৃদয়-মাংস দান দ্বারা চক্রবর্তী রাজাদি মনুষ্য সম্পত্তি ইন্দ্র রাজাদি দেবত্ব, পচেক বুদ্ধত্ব ও বুদ্ধ শ্রাবকত্বাদি আমার প্রার্থনার বিষয় নয়। আমি এ দানের দ্বারা অনাগতে সর্বজ্ঞ বুদ্ধত্বই লাভ করব। আমার এ হৃদয়-মাংস। হতে শত সহস্রগুণেই সর্বজ্ঞ বুদ্ধজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। সুতরাং ইহাতে সে জ্ঞান লাভের প্রত্যয় হউক।” এ বলে তথায়ই সে হৃদয়-মাংস যক্ষকে প্রদান করলেন। তৎপর বোধিসত্ত্ব স্বীয় দেহ হতেও শস্ত্র দ্বারা মাংস ছেদন করে দিয়ে বললেন–“যক্ষ, তুমি যথেচ্ছা রূপে ভক্ষণ কর।” যক্ষ ও যথেচ্ছারূপে খাওয়ার পর তাঁর মাতাকে ছেড়ে দিল। তখন বোধিসত্ত্ব মাতাকে লাভ করে প্রফুল্ল অন্তরে মাতার হস্ত অবলম্বন করে সেস্থান হতে অন্য এক বৃক্ষ মূলে গিয়ে উপবেশন করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব মাতাকে বলেন মাতঃ, আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হতে এযাবৎ আপনার প্রতি যা কিছু দোষ করেছি, তা আমাকে ক্ষমা করুন। এবলে মাতাকে বন্দনা করে তথায়ই সংজ্ঞাহীন হলেন। দেবী পুত্রের এদশা দেখে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো এবং ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কোলে নিয়ে বক্ষে করাঘাত করে করে বিলাপ করতঃ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয়ে বলেন–
৩০-৩৩। “আমার পুত্র বিছানাহীন ভূমিতে সূর্য ও চন্দ্রপতনের ন্যায় পতিত হয়েছে। হে প্রিয় পুত্র, তুমি উঠ, তোমার এ অবস্থা দেখে আমার হৃদয়ে অব্যক্ত দুঃখানুভব করছি। তোমার মৃত্যুতে আমারও মৃত্যু হবে। তুমি বিনা আমি কিরূপে বাঁচব? হে পুত্র, এখন আমি অনাথ, ভ্রান্ত মৃগীর ন্যায় হয়েছি। আমি পর্ণশালার একাকী কি করে থাকব? এবং বনেও বা কি করে বিচরণ করব? এখানে যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে আমি পর্ণশালায় যাবনা। এ রাত্রিতেই তোমার সাথে আমার এখানেই মৃত্যু হবে।”
দেবী এরূপে বিলাপ করতে করতে সে প্রিয় পুত্রকে আলিঙ্গন করে তথায়ই বসে র’লেন। তখন বোধিসত্ত্বের কৃতজ্ঞতার প্রভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দেবরাজ ইন্দ্র তার কারণ চিন্তা করে বোধিসত্তের এসব বিষয় জ্ঞাত হলেন। তখন দেবরাজ স্বর্গ হতে অবতরণ করে এসে আকাশে স্থিত হয়ে ঐ রুক্ষ প্রচণ্ড যক্ষকে বললেন–“হে প্রচণ্ড যক্ষ, তুমি এ বুদ্ধাঙ্কুরের প্রতি এরূপ দুঃসাহসিক কর্ম কেন করছ? এ মহাপুরুষ এখানেই বিনষ্ট হবে। তা যদি হয়, তবে আমার এ বজির অঙ্কুশ দ্বারা তোমার মস্তক সাত টুক্রা করব।” ইহা শুনে সে যক্ষ মরণ ভয়ে ভীত হয়ে তখনি মহাসক্তের নিকট গিয়ে তার সারা দেহে দিব্য ঔষধ মেখে দিল। এত ফলে মহাসত্ত্ব ব্যথাবিহীন হয়ে আরোগ্য লাভ করলেন। তৎপর দেবীও নিজের দৃঢ় অধিষ্ঠান সত্যক্রিয়াচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি বলেন–
আমার পুত্র বড়ই কৃতজ্ঞ। তাই অনাগতে সে নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবে। আমার এ অধিষ্ঠান-প্রভাবে আমার পুত্র জীবিত হউক।” পুনঃ দেবী অধিষ্ঠান সত্যক্রিয়া করে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৩৫। “আমি একমাত্র পুত্র লাভ করেছি। সে সর্বদাই আমার অতি প্রিয়। এ অধিষ্ঠান সত্যক্রিয়া প্রভাবে আমার পুত্র শীঘ্রই সুস্থ হউক।” দেবীর এই দ্বিতীয় বারের সত্যক্রিয়ার প্রভাবে বোধিসরে শ্বাস-প্রশ্বাস লাভ হল এবং পাশ পরিবর্তন করলেন। তৃতীয়বারও দেবী দৃঢ়ভাবে সত্যক্রিয়া করে নিন্মোক্ত গাথাটি বলেন–
৩৬। “আমি কোন দিন কাম মিথ্যাচার করিনি। পূর্বাপর কোন দিন পরের প্রতি আসক্তও হইনি। আমার এ অধিষ্ঠান। সত্যক্রিয়া প্রভাবে আমার পুত্র শীঘ্রই উঠুক।” দেবীর এ তৃতীয়বারের অধিষ্ঠান তেজবলে বোধিসত্ত্ব স্বীয় স্মৃতি লাভ করে। ভূমি শয্যা হতে উঠল এবং স্বীয় মাতাকে বন্দনা করে বলেন। এ বিষয় প্রসঙ্গে শাস্তা বুদ্ধ নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন–
৩৭-৪১। “অতঃপর রতন পজ্জোত সুস্থ হয়ে উঠে মাতাকে বন্দনা করে উপবিষ্ট হল। তখন সে মহাবনে ইন্দ্র সহ দেবতা বৃন্দ প্রমোদিত হয়ে নানাবিধ দিব্যপুষ্প বিকীর্ণ করল। নানা দিব্য পদ্মপুষ্প নিয়ে আকাশে আগত দেবগণও বনে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করল। তথায় দেবতাবৃন্দ সম্মিলীত হয়ে ঐ নরুত্তমকে দিব্য সুগন্ধি ও পুষ্প দ্বারা পূজা করেছিলেন। এবং তারা বলেছিলেন “হে মহাবীর, সাধু সাধু তুমি কৃতজ্ঞ ও উপকারীর উপকার স্বীকারকারী। তুমি এখন নরুত্তম। অচিরেই ভবিষ্যতে তুমি অপ্রতিপুাল বুদ্ধ হবেন।
তখন দেবরাজ ইন্দ্র আকাশেই স্থিত হয়ে যক্ষের দ্বারা বোধিসত্ত্বের নিকট সর্বদোষের ক্ষমা প্রার্থনা করালেন। তৎপর বোধিসত্ত্বও দেবীকে সুবর্ণ সিবিকায় আরোহণ করায়ে তাদের পর্ণশালায় রেখে দেবলোকে চলে গেলেন। বোধিসত্ত্ব পর্ণশালায় প্রবেশ করে ঋষি প্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়ে ঋষি উপকরণ সমূহ গ্রহণ করলেন। তৎপর মাতাকে বলেন–“মাতঃ, এহতে আমরা উভয়েই প্রব্রজিত। সুতরাং ফল-মূল সংগ্রহের জন্য আপনি আর অরণ্যে প্রবেশ করবেন না। আপনি এখানে সুখে বাস করুন। আমিই অরণ্যে গিয়ে ফলমূল আহরণ করে আন্ব। এহতে মহাসত্ব প্রত্যহ ফলমূল আরহণ করে মাতাকে সযত্নে সেবা ও পোষণ করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব মাতা সহ চন্দন পর্বত পাদদেশে দু’তিন বৎসর নিরাপদে বাস করতেছিলেন।
মেঘবতী রাজ্যের জলপ্লাবণ বিদূরীত হওয়ার পর বোধিসত্ত্বের পিতা মহারথ রাজা স্বীয় মেঘবতী নগরে এসে ধর্মতঃ রাজত্ব করতেছেন। তাঁর সে ধর্মতঃ ন্যায়তঃ রাজ্যশাসনের ফলে সে রাজ্য সমৃদ্ধ ও সুভিক্ষ হয়েছিল। তকালে বোধিসত্ত্বের মাতৃ-পোষণ কর্মতেজে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ একারণ চিন্তা করে বোধিসত্ত্বের মাতৃ-পোষণ বিষয় জানলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গ হতে এসে বোধিসত্ত্ব ও তাঁর মাতাকে সুবর্ণ সিবিকা যোগে অর্ধরাত্রে মেঘবতী রাজ বাড়ীর সপ্ততল প্রাসাদে রত্ন পালঙ্কে বসায়ে দেবরাজ স্বীয় ভবনে চলে গেলেন। তখন মহারথ রাজা দেবীও স্বীয় পুত্রের পরিচয় পেয়ে তাঁদিগকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তদবধি তাদিগকে নিয়ে নিরাপদে পঞ্চ কামগুণ পরিভোগ করে যথা সুখে বাস করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব রাজ্যাভিষিক্ত হয়েও পঞ্চ কামগুণ ভোগ না করে মহাজনগণকে দান ও উপদেশ দিতেন। কিছু দিন পরে পুনঃ পিতার উপর রাজ্যভার অর্পণ করলেন এবং পিতামাতাকে বন্দনা করে তাঁদের নিকট হতে সর্বদোষের ক্ষমা প্রার্থনার পর তার সংসার ত্যাগের কথা ব্যক্ত করলেন। তারপর জনগণকেও আশ্বাস ও উপদেশ দিয়ে তাদের। নিকট স্বীয় মনোভাব ব্যক্ত করার পর প্রাসাদ হতে বের হয়ে হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের সংকল্পের তেজানুভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ তার কারণ চিন্তা করে বোধিসত্নের সংসার ত্যাগের বিষয় জানতে পারলেন। “এখন বোধিসত্ত্ব হিমালয়ে প্রবেশ করবেন। সুতরাং আমরাও তাঁর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া একান্তই উচিত।” এ মনে করে বিশ্বকর্মা দেবপুত্রকে আহ্বান করে বলেন–“বাবা, তুমি এখন হিমালয়ে গিয়ে কোন এক রমণীয় স্থানে প্রব্রজিতদের উপকরণ সহ আশ্রম তৈরী করে দিয়ে আস।” এ আদেশমাত্র বিশ্বকর্মা তখনই স্বর্গ হতে এসে এক রমণীয় স্থানে দেবঋদ্ধি প্রভাবে আশ্রম তৈরী করলেন। আশ্রমে। দিবা ও রাত্রি-বাসস্থান এবং চংক্রমণ শালা ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে। সুব্যবস্থা করলেন। প্রব্রজিতদের যাবতীয় উপকরণ একস্থানে। রেখে, একখানা ফলকে লিখে দিলেন–“এ আশ্রমে এসে যারা প্রব্রজিত হতে ইচ্ছা করেন, তারা এসব উপকরণ নিয়ে ঋষি প্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়ে এখানে বাস করুক।” তারপর অমনুষ্যের উৎপাত, ভৈরব উকট শব্দাদির উৎপাত এবং মৃগ পক্ষীর যাবতীয় উপদ্রব দূরীভূত করে স্বীয় স্থানে চলে গেলেন। মহাসত্ত্ব হিমালয়ে প্রবেশ করে পথ চলতে চল্তে অনুক্রমে একপদী পথ প্রাপ্ত হলেন। সে পথে বহুদূর চলার পর বিশ্বকর্মা দেবপুত্র নির্মিত ঐ মনোরম আশ্রম দেখলেন। তাতে প্রবেশ করে লিখাগুলি পাঠ করে আনন্দ সহকারে গৃহীবসন ত্যাগ করে রক্তবর্ণ বাকল চীবর পরিধান করলেন, অজিন মৃগচর্ম দেহের একাংশভাবে গায়ে দিয়ে নিজে ঋষি প্রব্রজিত হয়ে তথায় বাস করতে লাগলেন। মহাসত্ত্ব তথায় নিরাপদে ভাবনা করে অচিরেই পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপাদন করলেন। এ লোকুত্তর জ্ঞান লাভের আনন্দে নিত্য বিভোর থেকে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হলেন, এ বিষয় প্রকাশ মানসে লোকজ্ঞ ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথায় বলেন–
৪২-৪৬। “তখন ‘রতন পজ্জোত অভিষেক লাভ করে ধর্মতঃ রাজত্ব করে করে জনগণকে মহাদান প্রদান করলেন” তিনি জনগণকে মাসেককাল মাত্র দান দিয়ে পরে পিতার উপর রাজ্যভার ন্যস্ত করে নগর হতে বের হলেন। তিনি একাকীই হিমালয়ে প্রবেশ করে দেখলেন–মনোরম আশ্রম। তিনি তাতে প্রবেশ করে গৃহী বেশভূষা ত্যাগ করলেন। তথায় ঋষি প্রব্রজ্যায় প্রব্রজিত হয়ে ভাবনা করে পঞ্চঅভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি উৎপাদন করেন। যথায়ুষ্কাল যাবৎ ভাবনায় নিয়ত থেকে মনুষ্যলোক হতে চ্যুত হয়ে ব্রহ্মলোক পরায়ণ হলেন।” তখন রাজাও মহাজনগণ বোধিসত্ত্বের উপদেশে স্থিত থেকে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতেন। তারাও যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর নানা দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ভগবান এ ধর্মদেশনার পর বলেন–হে ভিক্ষুগণ, এ পিতামাতা পোষণ করার কর্ম হল পণ্ডিত বংশেরই কর্ম। তোমরা এ ভিক্ষুকে নিন্দা করে লজ্জিত করোনা।” এবলে জাতক সমাপন করে নিন্মোক্ত চারটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৪৭-৫০। “বর্তমানের অনুরুদ্ধই তখনকারের দেবরাজ ইন্দ্র। তকালের বাল্লহক নামক প্রচণ্ড যক্ষ বর্তমানের অঙ্গুলিমাল। শ্রী রতন গর্ভা দেবী ছিল বর্তমান কালের আমার মাতা মহামায়া। মহারথ রাজা ছিলেন বর্তমান পিতা শুদ্ধোদন মহারাজা। মেঘবতী রাজ্যবাসী অবশিষ্ট মহাজনগণ বর্তমানকালের শাসন পুরক আমার শ্রাবকসঙ্ মাতৃ-পোষক। রতন পজ্জোত কুমার এখন লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ আমি। অতি গৌরব চিত্তে সবাই এ জাতক ধারণ কর।
(রতন পজ্জোত জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply