২২. সাধিত রাজ জাতক
“ভবৎ আমি পুণ্য কর্মে বিশেষভাবে” ইহা ভগবান জেতবনে বাস করবার সময় নিজের দান পারমী সম্পর্কে বলেছিলেন।
এক দিবস ভিক্ষুগণ ধর্ম সভায় উপবিষ্টকালে এরূপ কথার উত্থাপন হয়েছিল–অহো বন্ধুগণ, আমাদের অনুত্তর বুদ্ধ এখন দেব-মনুষ্যদের লৌকিক লোকোত্তর-সুখদায়ক হয়েছে। তখন ভগবান গন্ধকুঠি হতে ভিক্ষুদের এ আলোচনা দিব্যকর্ণে শুনে তথায় উপস্থিত হলেন এবং সজ্জিত বুদ্ধাসনে উপবেশন করে বলেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা বর্তমান কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ ভগবানকে অভিবাদনান্তর করজোড়ে তাদের আলোচিত বিষয় প্রকাশ করলে ভগবান। বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, আমি সমত্রিংশৎ পারমী পূর্ণ করে। বুদ্ধত্বাবস্থায় যে এখন দেব-মনুষ্যদের লৌকিক লোকোত্তর সুখদান করছি, তা নয়, অতীতে আমার বোধিসত্ত্বাবস্থায় সংসারে বিচরণকালে এক জন্মে প্রত্যহ মহাজনগণকে নানাবিধ বস্তু দান দিয়ে সুখের কারণ করেছিলাম। তখন ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি তাঁর পূর্ব জন্মের কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–।
পূর্বে ‘সাধিত’ নামক এক রাজা মিথিলা নামক নগরে রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল সমুলা দেবী। তিনি রাজার অতি প্রিয়া ও মনোজ্ঞা এবং ষোড়শ সহস্র রাণীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। তখন বোধিসত্ত্ব সাধিতরাজ মিথিলা নগরে স্বীয় জ্ঞানবলে অগ্রমহিষী সহ রাজ-সুখ ভোগ করেছিলেন। একদিবস তিনি শ্বেতছত্রের নিতে শ্রীশয্যায় উপবেশন করার পর শ্বেতছত্র অবলোকন করে চিন্তা করলেনআমার এ রাজাসম্পদ কোন্ কর্মের দ্বারা লাভ হয়েছে? আমি পূর্বে দান না দিয়ে এবং পুণ্যকর্ম না করে এ রাজসম্পদ লাভ করছি তা নয়। অপিচ পূর্বে দান দিয়ে এবং বিবিধ পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে এ রাজসম্পদ লাভ করেছি।” এ বিষয় জ্ঞাত হয়ে স্বীয় চিত্তে প্রীতি-সৌমনস্য উৎপাদন করলেন। অতঃপর নিজের সারথিকে আহ্বান করে বলেন–“তুমি শীঘ্রই গোশকট এবং অশ্বশকট যোজনা করে রাজঙ্গণে এনে রাখ। এবলে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
১। “হে সারথি আমি পুণ্যকর্মে বিশেষভাবে আনন্দ লাভ করে থাকি। শীঘ্রই আমার গো-শকট ও অশ্বরথ যোজনা কর।
তখন সারথি রাজাদেশে গোপাল হতে বলশালী বৃষ ও অশ্বপাল হতে উত্তম বলিষ্ঠ অশ্বলয়ে গো-শকট ও অশ্বরথ যোজনা করে রাজাঙ্গণে এনে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, আপনার কথিত গো-শকট ও অশ্বরথ যোজনা করে রাজাঙ্গণে রেখেছি।” তা শুনে রাজা প্রাসাদ হতে অবতরণ করে রাজাঙ্গণে এসে রথে আরোহণ করলেন এবং সারথিকে নিন্মোক্ত গাথায় এরূপ আদেশ করলেন
২। “হে সারথি, তোমরা শীঘ্রই শালবন-অভিমুখে শকট সমূহ চালনা কর। আমিও তথায় আগমন করব।”
সারথি রাজার আদেশ অনুযায়ী শকট চালিয়ে ক্রমে শালবনে উপস্থিত হল। তথায় রাজার নির্দেশানুসারে সারবান শালবৃক্ষ ছেদন করে শকটযোগে নগরে নিয়ে আসল। এসব। বৃক্ষের দ্বারা নগরের চার দ্বারে চারখানা, নগরের মধ্যভাগে। একখানা এবং রাজপ্রাসাদের দ্বারে একখানা এ ছখানা প্রকাণ্ড দানশালা নির্মিত হল। রাজা, অমাত্য ও জনগণ পরিবৃত হয়ে দানশালা দর্শনের জন্য আগমন করলেন। তা দেখে রাজা সন্তুষ্ট হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৩। “আমার এদানশালা একান্তই মনোরম ও সুন্দর হয়েছে। দেবতারাই যেন এসব নির্মাণ করেছেন।”
তখন রাজা নিজের সেনাপতিকে আহ্বান করে দানশালাগুলি দেব-বিমানের ন্যায় সুসজ্জিত করে প্রত্যেক দানশালা হতে প্রত্যহ ছয়সহস্র টাকার দানীয় বস্তু অর্থীদের দান দিতেন। মহাসত্বের অনুভাববলে সমগ্র মিথিলা নগর সর্ববিষয়ে সুভিক্ষ হয়েছিল। অন্নপানীয়াদি নানাবস্তু সুলব্ধ হয়েছিল। সমগ্র নগরখানা রমণীয়ভাব ধারণ করেছিল। মিথিলারাজ্যবাসী জনগণ কৃষিকার্য ও গৃহকর্মাদি কিছুই না করে মহাসত্ত্বের দানশালা হতে ইচ্ছামত দান গ্রহণ করে যথাসুখে পরিভোগ করতেন। রাজা প্রত্যহ প্রাতে গান করে শ্রেষ্ঠ রাজভোগ্য ভোজনান্তর সুবর্ণ সিবিকায় আরোহণ করে মহাযশঃ পরিবার সহ দানশালা পরিদর্শনের জন্য উপস্থিত হতেন। প্রত্যেক দানশালায় কিয়ৎক্ষণ ধরে স্বহস্তে যাচকদের সানন্দে দান করে অমাত্যকে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বলেন–
৪-৫। “যে যাই ইচ্ছা করে, তাদের বস্ত্র ও খাদ্যাদি দানীয় বস্তু প্রদান করবে। ধনার্থীকে ধন, ভোজন ইচ্ছাকারীকে ভোজ্যদ্রব্য দিয়ে তোমরা সর্বদা সম্যরূপে দানকার্য পরিচালনা করবে। এখানে আগত জনগণকে অপ্রমত্তভাবে অন্নপানীয় দান দ্বারা পরিতৃপ্ত করবে। তারা দান গ্রহণ করে যথেচ্ছা গমন করুক।
মহাসত্ব প্রত্যেক দানশালায় স্বহস্তে কিছুক্ষণ এরূপে দান দিয়ে ও আদেশ উপদেশ দিয়ে নিজপ্রাসাদে গিয়ে রাজকার্যে মনোনিবেশ করতেন। তিনি সন্ধ্যার সময় সুবাসিত জলোন করে শ্রেষ্ঠ রসাল রাজভোগ্য ভোজনের পর নানাবিধ রাজ অলঙ্কারে বিমণ্ডিত হয়ে অমাত্যবৃন্ধ সহ যাচকদের দান দেওয়ার জন্য দানশালায় উপস্থিত হতেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে সর্বজ্ঞবুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৬। “সে রাজা সায়াহ্নকালে সর্বদা প্রীতি ও সুমনচিত্তে যাচকের দান দেওয়ার জন্য দানশালায় উপস্থিত হতেন।” রাজা স্বয়ং দানশালায় উপস্থিত হয়ে মহাদান দেওয়ার পর অমাত্যকে বলতেন
৭। “এনিয়মে আমার দান মহাজনগণকে সর্বদা দেবে। তারা তা নিয়ে যথেচ্ছা গমন করুক।” এরূপে মহাসত্ত্ব প্রত্যহ প্রাতঃ সন্ধ্যায় দুবার প্রত্যেক দানশালায় গিয়ে নিজহস্তে দান দিতেন। তাঁর এদান পুণ্য প্রভাবে মহাপৃথিবী কম্পনাদি বহুবিধ আশ্চর্য জনক ঘটনাদির মাধ্যমে সমগ্র মিথিলা নগরে আনন্দ দায়ক এক কোলাহলের সৃষ্টি হয়েছিল। এ বিষয় প্রকাশ-মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথায় বললেন–
৮-১২। “তখন সে মিথিলা রাজ্য বর্ধনকারী” মনুষ্যগণকে মহাদান দিয়েছেন। তাঁর সে দান-পুণ্য-প্রভাবে এমহাপৃথিবী কম্পিত হয়ে ভীষণ লোমহর্ষণকর ব্যাপার সংঘটিত হয়েছিল। এমহাদান প্রভাবে তখন ভীষণ লোমহষর্ণকর ব্যাপারে সমগ্র মিথিলানগর সংক্ষুদ্ধ হয়েছিল। স্বীয়দানশালা হতে নানা দ্রব্যাদি দান দেওয়ার সময় রাজবাড়ী সর্বদা বিপুলাকারে লোকসমাগমে পরিপূর্ণ থাকত। রাজার এ নানা দ্রব্যাদি দান-গ্রহীতা মানবদের শব্দে সর্বদা সারা মিথিলানগরে ভৈরব শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল।” মহাসত্বের এমহাদান বস্তু গ্রহীতা জনগণ অতিশয় সন্তুষ্ট বিধায় সবাই প্রিয়বাদী হয়েছিল। অপ্রিয় ও কটুকথা তারা ভূলে গিয়েছিল। এ বিষয় প্রকাশ-মানসে সম্যক সম্বুদ্ধ নিন্মোক্ত চারটি গাথায় বললেন–
১৩-১৬। ‘উন্ন’ নামক সারথি এবং ‘বেসিয়’ নামক শ্ৰেষ্ঠী সর্বদা বলতেন–“এরাজাই আমাদের ধনউৎপাদক। হস্তী চালক, অশ্বচালক, সেনাচালক, রথ-চালক ও সেনাপতিবৃন্দ সর্বদাই বত–এরাজা আমাদের যশঃ কীৰ্ত্তি দাতা” জনপদ, নগর ও গ্রামবাসী সর্বদা একত্রিত হয়ে মন্ত্রণা করত যে-এরাজা আমাদের সুখদায়ক। দরিদ্র, যাচক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও পুরোহিতগণ সর্বদা বলতেন–“এরাজাই আমাদের সর্ববস্তু দায়ক।” তখন মহাসত্ত্ব নিজের প্রদত্ত দানীয় সামগ্রী পুনঃ পুনঃ স্মরণ করে চিত্তে প্রতি উৎপাদন করলেন। এমন সময় স্বর্গে দেবরাজের ভবনউত্তপ্ত হল। দেবরাজ তা অনুভব করে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
১৭। “যে দেব বা মনুষ্য সর্বদা দান-শীলাদি পুণ্য কর্ম সম্যক্ রূপে সম্পাদন করেন, তাদের প্রার্থনাই পরিপূর্ণ হয়।” এবলে দেবরাজ তত্ত্বারণ জ্ঞাত হয়ে বলেন–“অহো, এ ‘সাধিত রাজা বুদ্ধাঙ্কুর। ইনি স্বীয় প্রদত্ত দান সামগ্রী সম্বন্ধে পুনঃ পুনঃ চিন্তা করে চিত্তে প্রীতি উৎপাদন করছেন। এখন আমিও মিথিলা নগরে গিয়ে তাঁর দান-বিষয় অনুমোদন করব। এরূপ চিন্তা করে নানাবিধ রতনে বিচিত্রিত সুবর্ণময় এক প্রাসাদে আরোহণ করলেন। সে প্রাসাদ সহ দশদিক্ উদ্ভাসিত করে মিথিলা নগরে সাধিত রাজার প্রাসাদের সম্মুখে এসে আকাশে স্থিত হলেন। তখন রাজা শ্রীশয্যায় উপবিষ্টাবস্থায় ঐ দিব্য জ্যোর্তিময় প্রাসাদ দেখে জিজ্ঞাসাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বলেন–
১৮-১৯। “দিব্য জ্যোতিতে অভিরূপবর্ণে চারদিক আলোকিত করে আমার প্রাসাদের সম্মুখে এটা কোন্ প্রাসাদ বিরোচিত হচ্ছে? এখানে আগত এ প্রাসাদের কর্তা কে? আমি এর কোন বিষয় জানিনা। তা আমাকে বলুন।” দেবরাজ রাজাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত তিনটি গাথায় বলেন–
২০-২২। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনি মহাদান দিয়ে যে মহানন্দ অনুভব করছেন, আমিও তা অনুমোদন করবার জন্য আপনার নিকট এসেছি। আমি দেবলোকে স্বীয় পুণ্যকর্ম দ্বারা দেবগণ পরিবৃত হয়ে দিব্য সুখে সর্বদা রমিত হই ও আপনার দান অনুমোদন করি। কৃতাঞ্জলী হয়ে বছি আপনি এ মহাদানের দ্বারা অনাগতে লোকনাথ সম্বুদ্ধ হবেন।” এবলে। দেবরাজ পুনঃ রাজার পুণ্যানুমোদন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে। বললেন–
২৩-২৪। “মহারাজ, আপনি সর্বদা ছয় দানশালায় যে সর্বদা মানবগণকে মহাদান দিচ্ছেন, আমি তা অনুমোদন করছি। মহারাজ আপনি নানাবিধ বস্তু দান করছেন। আমিও তা করব। দানই প্রাণীদের পরলোকের প্রতিষ্ঠা।” মহাসত্ত্ব দেবরাজের কথা শুনে, তাঁকে সম্বোধন পূর্বক নিতাক্ত গাথায় বলেন–
২৫। “দেবরাজ আমি সর্বদাই মহাদান দেব। দানীয় বস্তু থাকতে, তা গোপন করবনা। দানেই আমার মন রমিত হয়” পুনঃ দেবরাজকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
২৬। “দেবরাজ, এখানে আপনার শুভাগমন হয়েছে। ইহা আপনার পক্ষে দীর্ঘপথ নহে। আপনি সর্বদা রমণীয় দেবলোকে চিরসুখী হউন। আমার দান অনুমোদনে আপনি রমিত হউন।” দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্তের এরূপ জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে অত্যধিক প্রীত হয়ে বহুবিধ স্তুতি করলেন এবং সে বিষয় প্রকাশার্থ অমিতাভ বুদ্ধ পাঁচটি গাথায় বলেন–
২৭-৩১। “দেবরাজ তার জ্ঞানময় কথা শুনে বলেনআপনি দৈবিক মানুষিক সর্ববিধ উপহার সঞ্চয় করেছেন। আপনার এ দানের কীর্তি শব্দ পৃথিবী হতে দেবলোক পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়েছে। সে পুণ্য-পূত যশঃ কীর্তি বিদ্যুৎবেগে চতুর্দিকে পর্বত-কন্দরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আপনার দান নারদ পর্বতও অনুমোদন করছে। দেবগণ প্রসন্নমনে আপনার দানানুমোদন করে বিমান-দ্বারে স্থিত রয়েছেন। ইন্দ্র, ব্রহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যম ও বৈশ্রবণাদি সমস্ত দেবগণ আপনার এ মহাদান অনুমোদন করূছে। স্বীয় দানশালায় প্রদত্ত মহাদান হচ্ছে আপনার মহাযান। অই যানই আপনাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে।” দেবরাজ সহস্র দেবলোকে চলে যাওয়ার মনস্থ করে পুনঃ রাজাকে বলেন–“মহারাজ, এ হতে আপনি সর্বদা অপ্রমত্তভাবে যথায়ুষ্কালাবধি দানশীলাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করুন।” মহাসত্বকে এরূপে উপদেশ দিয়ে দেবেন্দ্র স্বকীয় স্থানে চলে গেলেন। এবিষয় প্রকাশার্থ সম্যক্ সম্বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৩২-৩৩। “তখন দ্বিলোকের ঈশ্বর দেবরাজ ইন্দ্র সাধিত রাজাকে উপদেশ দিয়ে দেবলোকে চলে গেলেন। দেবরাজ ইন্দ্র পুণ্যকর্ম দ্বারা জগতের উপকার করার দরুণ দুটি দেবলোকের রাজত্ব করে সর্বদা দিব্য সুখ পরিভোগ করছেন।”
দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোকে যাওয়ার সময় সে দিবসেই সাধিত রাজার সমগ্র বাস্তুভিঠায়, গৃহের সর্বত্র অপরিমাণভাবে ঘনমেঘে বারিবর্ষণের ন্যায় নানাবিধ ধনরত্ন ও ধান্যাদি বর্ষিত হল। সমগ্র নগরেও উক্তরূপ ধনরত্ন ও ধান্যাদি জানুপরিমাণে বর্ষিত হল। তৎপর দেবরাজ বোধিসম্ভার পরিপূরণের সাহায্যার্থ সপ্তম দিবসে পুনঃ সাধিত রাজার সমগ্র রাজ্যে নানাবিধ মনোরম সূক্ষ্ম দিব্য বস্ত্র ও দিব্য অলঙ্কার বর্ষণ করালেন। তৎপর সপ্তম দিবসে স্বর্ণ রৌপ্য, তারপর সপ্তম দিবসে লোহিতঙ্গ রত্ন, তারপর সপ্তম দিবসে ইন্দ্রনীল রত্ন, তারপর সপ্তম দিবসে মণি জ্যোতিঃ রত্ব, এরপর সপ্তম দিবসে বৈদুর্যরত্ব, তারপর সপ্তম দিবসে সপ্তবিধরত্ন বর্ষণ করলেন। তখন মহাসত্ত্ব দেবরাজ বর্ষিত সমস্ত ধনরত্ন রাজবাড়ীতে আনবার জন্য অমাত্যমণ্ডলিকে আদেশ দিলেন। অমাত্যগণ তা সংগ্রহ করে এনে পূর্বরক্ষিত ধন-রত্নের সহিত ধন-কোষ্ঠাগার ও ঐ ছয়টি প্রকাণ্ড দানশালা পরিপূর্ণ করে রাখলেন। এরূপে আরো অন্যান্য প্রাসাদ প্রকোষ্ঠও পূর্তি করে রাখলেন। এদিকে সানন্দে বিপুলভাবে দান কাজ সম্পাদন করতে লাগলেন। তখন সাধিত রাজা মহাবিভব সম্পন্ন, মহাযশঃ কীর্তিশালী ও মহাপরিবার সম্পন্ন হয়ে দশ রাজধর্ম রক্ষা করে রাজত্ব করতে লাগলেন এবং নববৃষ্টির ধারার ন্যায় সর্ববিধ পুণ্যকর্ম নিজেও করতেন এবং অপরকেও নিয়োজিত করতেন। ছয়টি দানশালা হতে প্রত্যহ রাজ্যবাসীদিগকে নানাবিধ দানীয় বস্তু দান করতেন। তিনি স্বীয় দান সামগ্রীর বিষয় স্মরণ করে চিত্তে প্রীতি উৎপাদন করেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে সর্বজ্ঞ বুদ্ধ নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায় বলেন–
৩৪-৩৯। “সে নরাধিপ সাধিত রাজা প্রীতি ও সুমন চিত্তে সর্বদা মানবদিগকে বস্ত্র দানাদি মহাদান দিয়ে অনুক্ষণ প্রসন্ন চিত্তে তা স্মরণ করেন। অহো সে দান বিপাক সর্বদা বহুবিধ শুভফল দায়ক। এভাবে সর্বদা সে নির্ভয় ও নিরুপদ্রবে দান। দেওয়ার জন্য ইচ্ছা করে। পরলোকে প্রাণীদের দানই একমাত্র প্রতিষ্ঠা। ধনদায়ক পণ্ডিতগণ সর্বদা সুখপ্রাপ্ত হয়। তদ্ধেতু ‘আমি ধনবান এমনে করে শ্রদ্ধার সহিত ধনদান করে। ইহাতে দেব-মনুষ্যলোকে সুখের হেতু বর্ধিত হয়। আমি জনগণকে শ্রেষ্ঠ দান দিয়ে দেব-মনুষ্যলোকে অগ্ৰস্থান লাভ করে প্রমোদিত হব।” মহাসত্ব এরূপে প্রত্যহ মহাজনগণকে প্রচুর পরিমাণে ধন দান দিয়ে প্রত্যহ প্রদত্ত উপদেশ পুনঃ প্রদানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বলেন–
৪০-৪১। “ভবৎগণ, পূর্বজন্মের দান-হেতু আমি যেমন বর্তমান ধনরত্ন সম্পদে সমৃদ্ধ রাজা হয়েছি, তোমরাও তেমন অপ্রমাদের সহিত সর্বদা দান দাও। তোমরা শ্রদ্ধায় যথাশক্তি দান দিলে দেব-মনুষ্যলোকে সর্বদা সুখী হবে।” সে হতে মহাজনসংঘ মহাসত্ত্বের উপদেশে স্থিত থেকে দানাদি পুণ্যকর্ম করে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। মহাসত্ব ও অগ্রমহিষী সমূলা দেবীর সাথে মিথিলা নগরে রাজ-সম্পত্তি পরিভোগ করে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদনান্তর যথায়ুষ্কালে মৃত্যুরপর তুষিত দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। এরূপে ভগবান। বুদ্ধ জেতবনে সমাবেশ ভিক্ষুদের মধ্যে এ জাতক দেশনা সমাপন করে চারিআর্যসত্য দেশনা সম্পর্কে সম্যক্সষুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বলেন
৪২-৪৩। দুঃখসত্য, সমুদয়সত্য, নিরোধসত্য ও মার্গসত্যসহ এ চারসত্য সর্বদা সকল স্থানে আমাদ্বারা প্রকাশিত। ত্রৈভূমিক দুঃখসত্য তৃষ্ণা সমুদয় সত্য নির্বাণ নিরোধসত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গকে মার্গসত্য বলে।” এরূপে ভগবান চার আর্যসত্য দেশনার অবসানে কোন কোন ভিক্ষু স্রোতাপত্তি ফল, কেহ সকৃদাগামীফল আর কেহ অরহত্বফল লাভ করলেন।
ভগবানের চার আর্যসত্য দেশনা দেবমনুষ্যদের লৌকিয় লোকোত্তর সুখসম্পত্তি দায়ক এবং সর্ববিধ মঙ্গল দায়ক হয়। এরূপে ভগবান জেতবনে সমবেত ভিক্ষুদের নিকট এ চার আর্যসত্য দেশনা করে বলেন–আমি শুধু এখন সমত্রিংশ পারমী পূর্ণ করে বুদ্ধভাবে স্থিত দেবমনুষ্যদের লৌকিক লোকোত্তর সুখ প্রদান করছি, তা নয়। পূর্বেও আমি সংসারে। সংসরণ করবার কালে পুথুজনাবস্থায় স্থিত হয়েও প্রত্যহ মহাজন সংঘের নানাবিধ সামগ্রী দান করে সুখ প্রদান করেছি। এবলে জাতক সমাপ্ত করে পুনঃ নিন্মোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৪৪-৪৮। তখন দ্বিলোকের ঈশ্বর দেবরাজ এখন দিব্য চক্ষু লাভীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ “অনুরুদ্ধ।” সাধিত রাজার মহাদান বিভাজক সেনারক্ষক এখন আমার উপস্থায়ক ‘আনন্দ।’ সাধিত রাজার মাতা এখন মহামায়া এবং পিতা রাজা শুদ্ধোদন।। ‘সমুলা’ এখন যশোধরা; অমাত্য প্রমুখ নগরবাসী এখন আমার শ্রাবক সংঘ। তখনকারের সাধিতরাজা এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। তোমরা সর্বদাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(সাধিত রাজ-জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply