জাতক পঞ্চাশক
৩য় দশক
২১. চন্দ্র কুমার জাতক
“হায় হায় বাছা একমাত্র” এবিষয়টি বুদ্ধ জেতবন বিহারে বাস করবার সময় প্রাণীদিগকে মুক্তিদান-বিষয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় বসে বললেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের ভগবান বুদ্ধ প্রাণীদের সমস্ত দুঃখ ও ভয় হতে মুক্ত করেছেন” ইত্যাদি বলে আলাপ আলোচনা করছিলেন। তখন সর্বজ্ঞ বুদ্ধ ভগবান গন্ধ কুঠির হতে ভিক্ষুগণের আলোচনা দিব্য কর্ণে শোনলেন–তখন তিনি সভাস্থলে এসে জিজ্ঞেস করলেন–হে ভিক্ষুগণ, তোমরা কি আলোচনা নিয়ে এখানে বসে আছ? তখন ভিক্ষুগণ তাদের আলোচিত বিষয় বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করলেন–। তা শুনে ভগবান বললেন–“আমি এখন সমত্রিংশৎ পারমী ধর্ম পূর্ণ করে সর্বজ্ঞ বুদ্ধ হয়েছি। তাই আমার পক্ষে তা তেমন আশ্চর্যের বিষয় নয়। পূর্বে আমার অপরিপক্ক জ্ঞানাবস্থায় ও আমি নানাবিধ প্রাণীকে বিভিন্ন ভয় ও দুঃখ হতে মুক্ত করেছিলাম। তাহাই হয়েছিল আমার আশ্চর্য কর্ম।” এবলে বুদ্ধ মৌণভাব অবলম্বন করলেন। ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় পুনঃ স্বীয় পূর্ব কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
হে ভিক্ষুগণ, অতীতে বারাণসী নগরে ‘ধনক’ নামক এক ব্যবসায়ী বাস করতেন। তাঁর পত্নীর নাম “না।” পঞ্চশত ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান ব্যবসায়ী। তখন বোধিসত্ত্ব তাবতিংশ স্বর্গে অবস্থান করছিলেন। তাঁর দিব্যায়ু নিঃশেষ হলে, তখন তিনি এ মর্তলোকে অই নন্দার গর্ভেই প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। তৎকালে ধনক বণিক এক স্বপ্ন দেখলেন। তা এরূপ–“এক তাপস আকাশ-পথে গিয়ে চন্দ্রমণ্ডলটি নিজের হস্তে স্থাপন করলেন।” এস্বপ্ন দর্শন দিবসের শুভলগ্নে নন্দা সোনার বরণ এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। ধনক বণিক চিন্তা করলেন–“অদ্য আমার এরূপ আশ্চর্য চন্দ্রমণ্ডল স্বপ্ন দর্শনের সাথে সাথেই আমার পুত্র লাভ হল। তাই এ পুত্রের নাম রাখবো চন্দ্রকুমার।” চন্দ্রকুমার বয়স্ক হলে রূপ লাবণ্যে উজ্জ্বল স্বর্ণ বর্ণের ন্যায় শোভামান হলেন। তিনি সবারই প্রিয় মনোজ্ঞ হয়েছিলেন। তিনি ষোল বৎসর বয়স কালে সর্বশিল্পে নিপুণ হলেন। তৎকালে উক্ত পঞ্চশত বণিক অর্থ সংগ্রহের মানসে ব্যবসা উপলক্ষে সমুদ্রপথে সুবর্ণ ভূমিতে যাত্রা করবার জন্য মনস্থ করলেন। মহাসত্ব চন্দ্রকুমার এবিষয় শুনে পিতা-মাতাকে বললেন–“বাবা, অদ্য আমিও ধন। উপার্জনের জন্য পঞ্চশত বণিকের সাথে সুবর্ণ ভূমিতে যাব”। কুমারের কথা শুনে পিতা-মাতা বললেন–“বাবা, ভূমি তথায় যেতে পারবেনা। যেহেতু কোন কোন সময় মহাসমুদ্রে নৌকা নষ্ট হয়, সুতরাং বিপদ সঙ্কুল সমুদ্রে তোমার গমন আমরা ইচ্ছা করিনা। আমাদের ত্যাগ করে তোমার কোথাও যাওয়া আমাদের ইচ্ছা নয়। তুমি আমাদের একমাত্র প্রাণাধিক পুত্র। এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১। “অহো বাছা! তুমি আমাদের প্রিয় মনোজ্ঞ এক মাত্র পুত্র। আমাদের ত্যাগ করে যেওনা। ইহা তোমার পক্ষে উচিত হবেনা।”
মহাসত্ত্ব পিতা-মাতার এবম্বিধ কথা শুনে বললেন–পিতঃ মাতঃ আপনারা আমাকে ব্যবসায়ে যেতে বারণ করবেন না।
“অদ্য আমি বণিকদের সাথে যাব।” পিতা-মাতা অনেক বলেও পুত্রকে বারণ করতে পারলেন না। যথাকালে চন্দ্রকুমার পিতামাতাকে পঞ্চাঙ্গ লুঠিয়ে বন্দনা করে অভিষ্ট স্থান অভিমুখে যাত্রা করে বণিকদের সঙ্গে মহানৌকায় আরোহণ করলেন। মহা নৌকা অনুকুল বায়ুবেগে ইচ্ছিত স্থানে গিয়ে পৌছল। তখন চন্দ্রকুমার নৌকা হতে অবতরণ করে সমুদ্রের তীরবর্তী কোনও দোকানে উপস্থিত হলেন। সে দোকানে দেখলেন–বহুবিধ সজীব প্রাণী বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে। তখন তিনি সে দোকান হতে মুষিক, বিড়াল ও শুকাদি কয়েকটি পাখী এবং মৎস্যাদি কয়েকটি জলজ প্রাণী ক্রয় করে মহানৌকায় একস্থানে এনে রাখলেন। বণিকেরা নৌকায় এসব সজীব প্রাণী দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন–“হে বাছা চন্দ্রকুমার তুমি এসব পাখী কেন ক্রয় করে এনেছ?” তিনি বললেন–বাবু, এ প্রাণীগুলি ছেড়ে দেওয়ার জন্যই ক্রয় করে এনেছি। তখন বণিকগণ বললেন–“বাছা” ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে বিদেশে আসে ধন লাভের আশায়। কেন তুমি এসব প্রাণী ক্রয় করে অনর্থক অর্থ নষ্ট করলে? তুমি ত দেখছি ভারী অজ্ঞ বালক। ধন উৎপাদন করতে জাননা।” তিনি বললেন–“বাবুগণ, আপনারা আমাকে অজ্ঞ বলছেন। কিন্তু আমি দেখছি আপনারাই বড় অজ্ঞ।” এবলে বণিকগণকে স্বীয় অভিপ্রায় পরিজ্ঞাপনার্থ নিটোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
২-৩। “যারা সুখকামী ও প্রাণীদের হিতকামী, তাঁরা সর্বদাই প্রাণীদের দুঃখ হতে মুক্ত করেন। তারা সর্বদা মানবকুলে উৎপন্ন হয়ে দীর্ঘায়ু, সুখী; যশস্বী ও ধনবান হয়ে থাকেন।”
বণিকগণ তাঁকে প্রাণীমুক্তির সঙ্কাজ হতে বারণ করতে পারলেন না। তিনি তখন জলজ প্রাণীকে মহাসমুদ্রে ছেড়ে দিলেন এবং স্থলজ প্রাণী সমূহকে সমুদ্রের তীরবর্তী এক পর্বতে নিয়ে গিয়ে চিন্তা করলেন–এ পর্বতটি রমণীয় ও শোভনীয়। এখানে নিশ্চয়ই কোন প্রব্রজিত বাস করবেন। এখন আমি প্রাণী সমূহকে এ পর্বতের শিখর দেশে ছেড়ে দিয়ে পুণ্যার্জন করব। তখন এক স্থবির ভিক্ষু সে পর্বতের শিখর দেশে মুক্তি কামনায় এক বৃক্ষ মূলে ধ্যানে নিবিষ্ট আছেন। মহাসত্ত্ব পর্বতের শিখর দেশে উঠে স্থবিরকে ধ্যানাবস্থায় দেখলেন। এতে তিনি প্রীত হয়ে স্থবিরের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করে জিজ্ঞেস করলেন–“ভন্তে, আপনি এখানে কি জন্য এসেছেন?” স্থবির বললেন–“উপাসক, বিবেক সুখ লাভের আশায় আমি অদ্যই এখানে এসেছি।” মহাসত্ত্ব দেখলেন স্থবিরের দেহ হতে অত্যধিক ঘর্ম বের হচ্ছে। তা দেখে তিনি বললেন–“ভন্তে, আপনাকে অবলম্বন করে আমি কিছু পুণ্য কর্ম করতে ইচ্ছা করি। স্থবির বললেন–“উপাসক, তোমার শক্তি অনুযায়ী পুণ্যকর্ম করতে পার। পুণ্যকর্ম সমস্ত প্রাণীরই প্রতিষ্ঠা স্বরূপ।” তিনি তা শুনে সমুদ্র হতে জল এনে স্থবিরকেন করিয়ে সরবৎ, তাম্বুল ও ঔষধাদি দান করে একটা দীপ জ্বালিয়ে স্থবিরকে শ্রদ্ধাচিত্তে পূজা করলেন। তৎপর স্থবিরের সম্মুখেই তাঁর আনীত প্রাণী সমূহ ছেড়ে দিয়ে অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে স্থবিরকে পুনঃ বন্দনা করলেন এবং নিন্মোক্ত গাথায় প্রার্থনা করলেন
৪। “ভন্তে আপনি এখন আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আমি এ প্রাণী সমূহ ছেড়ে দিয়ে মহাপুণ্য অর্জন করেছি। এ পুণ্য কর্মে আমি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হয়ে সদেব মানবকে জন্ম-জরা-ব্যাধি হতে উত্তীর্ণ করব।” স্থবির বোধিসত্ত্বের এবাক্য শুনে তা অনুমোদন মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৬-৭। “তুমি যে এপ্রাণী সমূহকে দুঃখ হতে মুক্ত করলে, তোমার এপুণ্য কর্ম আমি সর্বান্তঃকরণে অনুমোদন করছি। এর সুখ বিপাক বিপুল হবে। তুমি এখানে যে প্রার্থনা করলে, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হউক এপুণ্য কর্মের প্রভাবে ভবিষ্যতে তুমি। নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবে।”
তখন মহাসত্ত্ব প্রসন্ন মনে স্থবিরকে বারক্রয় প্রদক্ষিণ ও পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করলেন। অতঃপর তিনি এসব পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে স্থবিরের নিকট বিদায় নিয়ে পর্বত হতে অবতরণ করে নৌকায় উপস্থিত হলেন। তখন নাবিকেরা গন্তব্য স্থান। লক্ষ্য করে নৌকা ছেড়ে দিলেন। নৌকা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ভেদ করে নাচতে নাচতে সমুদ্রের অপর পাড়ের দিকে চলল।। ক্রমান্বয়ে নৌকা সমুদ্রের মধ্যভাগে পৌছলে তখনই বায়ুবেগ। তীব্র হল। এতে মহাসত্ত্ব বোঝতে পারলেন–এখনই নৌকা ভগ্ন হবে। তাই তিনি ঘৃত-মধু-চিনি-মিশ্রী দ্বারা উদর পূর্তি করে দেহে বহু পরিমানে তৈল মাখলেন। স্বীয় পোষাকাদি সমস্ত তৈলে সিক্ত করে নিলেন। তারপর তিনি নৌকার মাস্তুলে উঠে বসে রইলেন। বায়ু বেগ সহ্য করতে না পেরে সমুদ্রের মধ্যদেশেই নৌকা ভগ্ন হল। তখন নৌকার মাঝি-মল্লা-কর্ম চারিগণ এবং বণিকগণ সামুদ্রিক মৎস্য কচ্ছপ ও কুম্ভীর দ্বারা ভক্ষিত হতে লাগল। নৌকা ড়ুবে যখন নৌকার মাস্তুলও অর্ধেক জল-মগ্ন হল, তখন মহাসত্ত্ব মাস্তুল মস্তক হতে বারাণসী দিকে লাফ দিয়ে অই হিংস্র মৎস্য কচ্ছপাদি সম্মিলিত স্থানের বহু দূরে গিয়ে পতিত হলেন। সে দিবস ছিল। পূর্ণিমার উপোসথ। তিনি আকাশের দিকে অবলোকন করে দেখলেন চন্দ্রমণ্ডল পরিপূর্ণ।
এতে তিনি সে দিন যে পূর্ণিমার উপোসথ, তা জ্ঞাত হয়ে লোণাজলে কুলকুচা করে অষ্টাঙ্গ উপোসথশীল অধিষ্ঠান করলেন এবং বারাণসীর দিক লক্ষ্য করে সমুদ্রে সন্তরণ করতে লাগলেন। এরূপে মহাসত্ত্ব ভেসে-ড়ুবে সপ্তধনু কুমারের ন্যায় পূর্বজন্মের কর্মবিপাকে মহাদুঃখ ভোগ করতে লাগলেন। এখন সে পাপ কর্মের বিপাক প্রকাশচ্ছলে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৮। “অল্প মাত্র পাপকেও তোমরা হেলা করবে না। স্বল্পমাত্র পাপ কর্মও বিপুলাকার ধারণ করে মহাদুঃখ বহন করে আনে।”
মহাসত্ত্ব যেদিন হতে সমুদ্রবক্ষে ভাসতে লাগলেন, সেদিন হতেই সুবর্ণ ভূমি নামক নগরের রাজা ভীষণ রোগাক্রান্ত হয়ে মানব লীলা সংবরণ করলেন। সে সময়ে সমুদ্র রক্ষার ভার পড়েছিলো মণিমেখলা নদী এক দেবকন্যার উপর। ইনি সাতজন্ম পূর্বে বোধিসত্ত্বের মাতা ছিলেন। তিনি একদা সমুদ্র, দর্শন করবেন, এচিন্তা করে আকাশ-পথে সমুদ্র দর্শন করতে লাগলেন। সমুদ্রের মধ্যে তরুণ সূর্যের ন্যায় ভাসমান চন্দ্রকুমারকে দেখলেন। তখন দেবী আকাশে স্থিতা হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞেস করলেন—
৯। “এ অপার সমুদ্র মধ্যে তুমি কে? কোন্ অর্থ সন্দর্শন করে এ অসম্ভবকে সম্ভব করবার চেষ্টা করছ।” বোধিসত্ত্ব দেবকন্যার কথা শুনে তার সাথে আলাপ করবার ইচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১০-১১। “হে দেববালা, আমার কথা শ্রবণ করুন। এখানে বাণিজ্যাদি কিছুই নেই, যাতে পাপ সঞ্চয় হয়। আমি স্বীয় আম্মাকে তুচ্ছ করে কোন পাপ কর্ম করিনি। হে দেব দুহিতা, তদ্ধেতু আমার বিশ্বাস নিরাপদে আমি সমুদ্র পার হয়ে তীর প্রাপ্ত হব।
দেবকন্যা বোধিসত্ত্বের বাক্য শুনে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে পুষ্প মুষ্টির ন্যায় গ্রহণ করে “সুবর্ণভূমি” নগরে রাজোদ্যানে শিলাসনে রেখে অন্তর্হিত হলেন। তখন সুবর্ণভূমির অমাত্যগণ সহ নগরবাসীরা রাজার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পাদনের পর সপ্তম দিবসে অমাত্য পুরোহিত প্রমুখ রাজ্যের প্রধানগণ একত্রিত হয়ে পরামর্শ করার জন্য এক পরামর্শ সম্মিলনীর আয়োজন করলেন। সেই সম্মিলনে এরূপ কথার উত্থাপন হল। “আমাদের রাজার একমাত্র কন্যা “সিবলি কুমারী।” তাঁর স্বামীর উপযুক্ত পুরুষ এখানে কোথাও দেখছিনা।” একথা শুনে এক ব্রাহ্মণ বললেন–“ভদ্রগণ একখানা পুষ্পরথ সাজিয়ে ছেড়ে দিন। এ রথ যার নিকট উপস্থিত হবে, তাকেই রাজত্ব দেওয়া উচিত হবে। সে পুরুষই ধর্মতঃ রাজত্ব করবে এবং তাঁর হস্তেই সিবলী কুমারীকে সমর্পণ করা হবে। বৈঠকের সবাই এ প্রস্তাব সানন্দে সাধুবাদের সহিত সমর্থন করলেন। তখন অমাত্যগণ। পুষ্পথ সজ্জিত করে তাতে রাজ-পূজোপযোগী সর্ববিধ সামগ্রী পরিপূর্ণ করে স্থাপন করলেন। সে রথের পশ্চাতে সর্ববিধ মননামুগ্ধকর বাদ্য নিয়োজিত করা হল। তৎপর ধার্মিক রাজা অন্বেষনে অভিজ্ঞ পুরোহিত সহ পুষ্পরথ ছেড়ে দেওয়া হল। সুসজ্জিত পুস্পথ অনির্বচনীয় উৎসব সহকারে রাজবাড়ী হতে বের হয়ে নগরকে তিনবার প্রদক্ষিণ করল। তারপর ক্রমে রাজোদ্যানে গিয়ে উপস্থিত হল। তখন মহাসত্ব ক্লান্ত দেহে সে উদ্যানে শিলাপটে সর্বাঙ্গে চাদর ঢাকা দিয়ে শয়ন করে নিদ্রিতাবস্থায় ছিলেন। পুষ্পরথ ক্রমান্বয়ে গিয়ে বোধিসত্ত্বের পাদ-প্রান্তে গিয়ে তাঁর আরোহণ কামনায় দাঁড়িয়ে রল। তখন পুষ্পরথের পশ্চাদগামী জনগণ বোধিসত্ত্বকে তথায় শায়িতাবস্থায় দেখে চিন্তা করলেন–“এ পুরুষের নিকট রাজত্ব করবার তেমন পুণ্য আছে কিনা, তা পরীক্ষা করতে হবে।” এ চিন্তা করে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র এক সাথেই ভীম প্রহারে বাদ্য করতে আদেশ দেওয়া হল। তন্মুহূর্তে বাদ্য যন্ত্রের ভীম নাদ আরম্ভ হল। জনগণ চিন্তা করলেন–“এপুরুষ যদি পুণ্যবান হন, তবে স্থিত থাকবেন। আর যদি তেমন পুণ্যবান না হন, তা হলে এ ভীষণ বাদ্য নির্ঘোষ-শব্দ শুনে পলায়ন করবেন।” যখন বাদ্য একসাথে বেজে উঠল, তখন মহাসত্ত্ব মস্তক হতে বস্ত্র অপসারিত করে দেখলেন এবং জনতার অভিপ্রায় বোঝতে পারলেন। তারপর পুনরায় মস্তকে বস্ত্র ঢেকে শুয়ে র’লেন। তখন লক্ষণজ্ঞ এক ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্বের পদতল–লক্ষণ দেখে বললেন–“সমাগত সজ্জন মণ্ডলি, এ মহাপুরুষ একান্তই মহাপুন্যবান। ইনি এক দ্বীপ কেন চার মহাদ্বীপেরই ঈশ্বর হবার উপযোগী পুণ্যবান।” এ কথা শুনে অমাত্য প্রমুখ উপস্থিত জনগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–“হে মহাপুরুষ, আমরা সকলেই আপনার নিকট এসেছি, এ রাজ্যের রাজত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাতে। হে মহাপুণ্যবান, আপনি এ বিপুল, ঐশ্বর্য সম্পন্ন রাজ্যের রাজত্ব ভার গ্রহণ করুন।” মহাসত্ত্ব তাদের এ অনুরোধ বাক্য শুনে উঠে বসলেন এবং অমাত্যকে জিজ্ঞেস্ করলেন–অমাত্য প্রবর আপনাদের রাজা কোথায়?” অমাত্য বললেন–আমাদের রাজা এখন পরলোক প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন–“ভদ্রগণ আপনাদের রাজার কোন পুত্র-কন্যা নেই কি?” অমাত্য বললেন–আমাদের রাজার পুত্র নেই।” ‘সিবলী’ নদী একটি মাত্র কন্যা আছে।” তা শুনে মহাসত্ত্ব তাদের অনুরোধে রাজত্ব গ্রহণের জন্য সম্মত হলেন। তখন অমাত্য প্রমুখ জনগণ তাঁকে অনুরোধ করলেন–স্বামিন, আপনি মহাপুণ্যবান মহাপুরুষ। আপনি এ পুস্পরথে আরোহণ করুন। আপনাকে নগরে নিয়ে। যাব। তাদের অনুরোধে মহাসত্ত্ব যখন রথে আরোহণ করলেন, তখন রথের আগে পাছে সর্ববিধ বাদ্য মধুর নাদে বেজে উঠল। মহাপরিষদ বৃন্দে সুশোভিত হয়ে মহোৎসাহের সহিত রথ নগরে প্রবেশ করল। ক্রমে পুষ্পরথ রাজপ্রাসাদের দ্বারদেশে উপস্থিত হল। মহাসত্ত্ব রথ হতে অবতরণ করে প্রাসাদের উপরিতলে শ্বেতছত্রের নিতে মহা আসনে রাজলীলায় গিয়ে সমাসীন হলেন। তখন অমাত্য প্রমুখ জনগণ তাঁকে মাঙ্গলিক ধ্বনি সহকারে অভিষেক প্রদান করলেন। চন্দ্রকুমার সুবর্ণভূমির রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। তখন তিনি সিবলী দেবীকে অগ্রমহিষী পদে অভিষিক্ত করে ধর্মতঃ রাজত্ব করতে লাগলেন। সিবলীদেবী চন্দ্ররাজের প্রিয়া ও মনোজ্ঞা হয়েছিলেন। পতিভক্তি ও বিনীত আচরণ তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। চন্দ্রকুমার রাজা দশবিধ রাজধর্ম উত্তমরূপে রক্ষা করে উপদেশের মাধ্যমে বিনাদণ্ডে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। স্বীয়পুণ্যার্জন মানসে ও পর সুখের নিমিত্ত প্রত্যহ জনগণের উদ্দেশ্যে মহাদানের প্রবর্তন করেছিলেন। তখন চন্দ্ররাজা নিজে যে প্রাণীদের জীবন দান করেছিলেন, সে বিষয় স্মরণ করলেন। তা প্রকাশের ইচ্ছায় তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত তিনটি গাথা ভাষণ করলেন–
১২-১৩। “তখন চন্দ্ররাজা পুণ্য চেতনায় মৈত্রী পরায়ণ হয়ে স্থলজ ও জলজ প্রাণীদের যে জীবন দান করেছিলেন, সে বিষয় প্রীতিচিত্তে স্মরণ করলেন। অহো, আমার সে পুণ্য। বিপাক এখন সর্বদা বহু সুখদায়ক, নির্ভয় ও নিরুপদ্রবময় মহাসম্পদ লাভের কারণ হয়েছে। জগতে পুণ্য কৰ্মই প্রাণীদের একমাত্র প্রতিষ্ঠা। উদ্যোগী পণ্ডিতগণ সর্বদাই সুখ প্রাপ্ত হন।”
তদবধি চন্দ্র কুমার রাজা পূর্বকৃত পুণ্যকর্ম স্মরণ করে সংযমের সহিত সমদৃষ্টিতে ধর্মতঃ রাজত্ব করতে লাগলেন। তিনি যে পর্বত শিখরে স্থবিরকে এক কলস জল দ্বারানি করিয়েছিলেন, তৎপুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ দেবতারা অনোবতপ্ত হ্রদ হতে অশীতি সহস্র কলস জল চন্দ্ররাজেরন ও পানাৰ্থ এনে দিতেন। লন করার পর স্থবিরকে যে তাম্বুল, সরবৎ ও ভৈষজ্যাদি দান দিয়েছিলেন, সে পুণ্য প্রভাবে দেবগণ হিমালয় পর্বত হতে দিব্য তাম্বুল, নানাবিধ ঔষধ, শ্রেষ্ঠ ফল, মূল ও পুষ্প প্রত্যহ এনে দিতেন। স্থবিরকে যে দীপ-পূজা করেছিলেন সে পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ দেবতাগণ অশীতি সহস্র সুবর্ণ প্রদীপ রাত্রে রাজবাড়ীতে যথাস্থানে জ্বালিয়ে দিয়ে চন্দ্রকুমার রাজাকে পূজা করতেন। পর্বত শিখরে পাখীদের ছেড়ে দেওয়ার পুণ্যপ্রভাবে প্রত্যহ অশীতি সহস্র পাখীরা হিমালয় পর্বত হতে চন্দন-পুষ্পদি এনে বোধিসত্ত্বকে পূজা করত। শুপাখী ছেড়ে দেওয়ার পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ হিমালয় হতে অশীতি সহস্র শুকপাখী জাতিশালী ধান্যের শীষ এনে বোধিসত্ত্বকে তা দিয়ে পূজা করে যেত। মূষিক ছেড়ে দেওয়ার পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ হিমালয় হতে অশীতি সহস্র মূষিক এসে শুকপাখী প্রদত্ত ধান্যগুলি কু’টে বিশুদ্ধ চাউলে পরিণত করে দিয়ে যেত। বানর ছেড়ে দেওয়ার পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ হিমালয় হতে অশীতি সহস্র বানর স্বর্ণ রৌপ্য নিয়ে এসে চন্দ্ররাজকে দিয়ে যেত। জলচর প্রাণী মৎস্য-কচ্ছপাদি ছেড়ে দেওয়ার পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ অশীতি হাজার মৎস্য-কচ্ছপ প্রত্যেকে সমুদ্র হতে নানাবিধ রত্ন এনে মহাসত্ত্বকে দিয়ে যেত। কাঠবিড়াল ছেড়ে দেওয়ার পুণ্য প্রভাবে প্রত্যহ অশীতি সহস্র কাঠবিড়াল হিমালয় হতে সুস্বাদু ড়ুমুর ফল এনে দিয়ে যেত। আর রাজ্যবাসী প্রত্যকে সপরিবারে নানাবিধ উপহার নিয়ে এসে চন্দ্ররাজকে সগৌরবে পূজা করে যেতেন। সে রূপ জম্বুদ্বীপের সকল রাজা তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করে যেতেন। বোধিসত্ত্ব এরূপে সুবর্ণভূমি নগরে রাজত্ব করবার সময় মহাযশঃ পরিবার সম্পন্ন হয়ে সকল প্রকার সুখ সমৃদ্ধিতে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। যথাকালে তিনি সিবলী দেবীর গর্ভজাত একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। মাতা পুত্রের নাম রাখলেন ‘মহিলা কুমার। বোধিসত্ত্ব দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব করবার পর চিন্তা করলেন–“আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি। কখন মৃত্যু হয়, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই কল্য আমি সপ্ত শতিক মহাদান দেব।” এরূপ প্রতিচিত্ত উৎপাদন করে ‘সেনগুপ্ত’ নামক অমাত্যকে বললেন–“বাপু আমি আগামীকল্য সপ্তশতিক মহাদান দেব। সুতরাং তুমি অতি শীগগীর হস্তী, অশ্ব, ঘোড়া, শকট, রথ, নারী, দুগ্ধবতী গাভী, দাস ও দাসী প্রভৃতি প্রত্যেকটি সাতশত করে যোগাড় কর। নানা প্রকার বস্ত্র, অন্ন পানীয়, খাদ্য, ভোজ্য ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে একস্থানে পুঞ্জীভূত কর।” এবলে অমাত্যকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি শ্রীশয্যায় উপবেশন করলেন। উক্ত অমাত্য বোধিসত্ত্বের নির্দেশ মত মহাদানের নিমিত্ত উল্লেখিত দানীয় বস্তু প্রত্যেকটি সাতশত করে রাজাঙ্গণে এনে সজ্জিত করলেন। তখন দশদিকের জনগণ, যাচকগণ ও জম্বুদ্বীপের রাজাগণকে দেবতারা এ সপ্তশতিক মহাদানের খবর এরূপ ঘোষণা করলেন–ভবৎগণ, আগামী কল্য চন্দ্রকুমার রাজা স্বীয় রাজ্য সুবর্ণভূমি নগরে সপ্তশতিক মহাদান করবেন।” দেবতাদের এ ঘোষণা শুনে, দেব প্রভাবে সারা জম্বুদ্বীপের রাজাগণ সুবর্ণভূমি নগরের রাজাঙ্গণে এসে নারী দান গ্রহণ করে স্বীয় স্বীয় দেশে চলে গেলেন। অমাত্যগণও ধনী ব্যক্তিগণ হস্তী, অশ্ব রথাদি যার যা প্রয়োজন, তা যথাভিরুচি গ্রহণ করে স্বীয় স্বীয় দেশে প্রস্থান করলেন। যাচকগণ নিজের প্রয়োজনীয় বস্তু যথাভিরুচি গ্রহণ করে নিয়ে গেল। রুগ্ন ব্যক্তি যথাপ্রয়োজনীয় ঔষধ পথ্যাদি যথেচ্ছা লাভ করে সানন্দে নিয়ে গেল। এ সপ্ত শতিক দান জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে মহাসত্ত্ব অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। এ সপ্ত শতিক দান প্রভাবে চার অযুত দু’লক্ষ দল বিশিষ্ট এ মহাপৃথিবী মত্তহস্তীর ন্যায় সগর্জনে কম্পিত হল। সুমেরু পর্বতরাজ সুবর্ণ ভুমি নগরের দিকে মস্তক অবনমিত করল। পৃথিবীতে সশব্দে দেবগর্জন সৃষ্টি হয়ে অকালে ক্ষণিক বর্ষণ ও বিদ্যুৎ লহরীর সৃষ্টি হল। সাগর উত্তাল তরঙ্গে তরঙ্গায়িত হল। দেবরাজ ইন্দ্র করতালি যোগে আনন্দ জানালেন। মহাব্রহ্মাগণ সাধুবাদ ধ্বনিত করলেন। মনুষ্যলোক হতে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত আনন্দময় মহাকোলাহলের প্রাদুর্ভাব হল। সে বিষয় প্রকাশের ইচ্ছায় ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত তিনটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৪-১৬। “এ মহাদান দেওয়ার সময় এ মহাপৃথিবী রোমাঞ্চকর ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। সুবর্ণভূমি নগর সংক্ষোভিত হয়েছিল। সপ্তশতিক দান দেওয়ার সময় ‘অহো’ এশব্দটি ভৈরব শব্দে প্রবর্তিত হয়েছিল।”
তখন বোধিসত্ত্বের দান তেজে দেবরাজ ইন্দ্রের বিমান উত্তপ্ত হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্র দিব্য জ্ঞানে ইহার কারণ চিন্তা করে জাতে পারলেন–“এখন এ চন্দ্রকুমার রাজা মনুষ্য লোকে সপ্তশতিক মহাদান দিচ্ছেন। এ উপলক্ষে আমারও তথায় যাওয়া উচিত।” এ চিন্তা করে নানা দিব্য পুষ্পে বিচিত্রিত এক সুবর্ণ বিমানে আরোহণ করে আকাশ পথে বোধিসত্ত্বের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। চন্দ্রকুমার রাজা এ বিমান। দেখে নিন্মোক্ত গাথায় পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন–।
১৭। “এখন আমার সম্মুখে যে বিমান স্থিত আছে, এর কোনও কারণ আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আপনি কোন দেবতা। এখানে এসেছেন তা আমাকে বলুন।” তা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র নিতাক্ত দুটি গাথায় বললেন–
১৮-১৯। “হে রাজন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার নিকটই এসেছি। আপনার মহাদান দর্শন করে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনার সে মহাদান আমিও অনুমোদন করছি। আপনার মহাদানের হেতুতে অনাগতে আপনি জগতে নিশ্চই বুদ্ধ হবেন।” দেবরাজ ইন্দ্র এবলে চন্দ্রকুমার রাজের শ্রেষ্ঠ অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে তাঁর বহুবিধ স্তুতি করলেন। সে বিষয়। প্রকাশ কল্পে অনুত্তর বুদ্ধ নিন্মোক্ত সাতটি গাথা ভাষণ করলেন–
২০-২৬। “তাঁর সঙ্কল্প জ্ঞাত হয়ে দেবরাজ বললেন–“দেব-মনুষ্য সবাই আপনার জীবন সদৃশ জীবন লাভের জন্য প্রার্থনা করছে। আপনার মহাদানে মহাপৃথিবী ভৈরবনাদে গর্জন করছে। সর্বদিক বিদ্যোৎ লহরী দ্বারা শোভিত হয়েছে। সুমেরু পর্বতরাজ আপনার দানপ্রভাবে নমিত হয়েছিল। আপনার দান নারদ পর্বত ও সুমেরু পর্বত অনুমোদন করছে। বিমান-দ্বারে স্থিত হয়ে আপনার মহাদান দেখে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়েছি। ইন্দ্র ব্ৰহ্ম, প্রজাপতি, সোম, যম ও বৈশ্রবণ প্রভৃতি দেবতারা আপনার দুঙ্কর সপ্তশতিক মহাদান সানন্দে অনুমোদন করছে। সর্বসাধারণের অদেয় বস্তু আপনি দান দিয়েছেন। সর্বসাধারণের অকৃত কর্ম করেছেন। অশান্তেরা এরূপ করতে পারেনা। তা সৎ লোকেরই কর্ম। তদ্ধেতু সৎ এবং অসতের গতি এক নহে। অসতেরা নিরয়ে গমন করে। সৎ ব্যক্তিগণ স্বর্গ পরায়ণ হয়। হে রাজন, আপনি এখন যে দান দিচ্ছেন তদ্বারা আপনি স্বর্গেই যাবেন এবং অনুক্রমে ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হবেন।”
এবলে দেবরাজ ইন্দ্র চন্দ্রকুমার রাজের পুণ্যকর্ম অনুমোদন করে বললেন–““মহারাজ এ হতে আপনি অপ্রমত্ত হয়ে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করুন।” এবলে দেবরাজ ইন্দ্র স্থানে চলে গেলেন। এবিষয় প্রকাশের ইচ্ছায় তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
২৭। দ্বি দেবলোকের ঈশ্বর দেবরাজ ইন্দ্র এবলে চন্দ্ররাজাকে উপদেশ দিয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন।” সে হতে বোধিসত্ত্ব দান শীলাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর তুষিত দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ ভগবান নিতাক্ত গাথাটি বললেন—
২৮। “এ চন্দ্র রাজা মনুষ্যগণকে সর্ববিধ মহাদান দিয়ে যথায়ুষ্কাল মনুষ্যলোকে অবস্থান করে মৃত্যুর পর স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছেন।” ভগবান এ ধর্মদেশনা সমাপ্ত করে বললেন–আমি শুধু বুদ্ধত্ব লাভ করে যে সর্ব প্রাণীকে সমস্ত ভয় ও দুঃখ হতে মুক্ত করেছি তা নয়, পূর্বেও অপরিপক্ক জ্ঞানে পুথুজনাবস্থায় বহু প্রাণীকে সর্ববিধ ভয় ও দুঃখ হতে মুক্ত করেছি। এবলে জাতক কথা সমাধান করে নিন্মোক্ত অবসান গাথা ভাষণ করলেন–
২৯-৩৫। “তখন যে শীলবান স্থবির পর্বত শিখরে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, সে এখন সারিপুত্র। আমার বর্তমান সেবক আনন্দ ছিল তখন চন্দ্র কুমার রাজার সেনগুপ্ত অমাত্য, শক্র দেবরাজ ছিলেন বর্তমান অনুরুদ্ধ মহাস্থবির। তখনকারের মহাসমুদ্র রক্ষিতা মণিমেখলা নদী দেবকন্যা হল এখন উৎপল বর্ণা। তখনকার মহিলা কুমার এখন আমার পুত্র রাহুল কুমার। সিবলী দেবী এখন যশোধরা। নন্দা ছিলেন আমার মাতা। তখনকার ধনক নামক আমার পিতা বণিক এখন শুদ্ধেদন মহারাজ। তখনকার অমাত্য প্রমুখ সহ সুবর্ণ নগরবাসী বর্তমানকালের সুশীল ও শাসনে নিরত আমার শ্রাবক মণ্ডলী। বর্তমানের সম্যক সম্বুদ্ধ তথাগত লোকনাথ আমিই ছিলাম তখনকার সম্যক্ রূপে পুণ্য কর্মে রত নরাধিপ চন্দ্রকুমার রাজ। তোমরা সবাই স্বীয় সুখকামী অতি গৌরবের সহিত এ জাতক ধারণ কর।
(চন্দ্রকুমার জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply