২০. সপ্তধনু জাতক
“হায় হায় পুত্র, এখানে ফিরে এস” এ বিষয় ভগবান বুদ্ধ জেতবন বিহারে বাস করবার কালে মারবল দমন বিষয় সম্পর্কে বলেছিলেন।
একদা ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় বসে এরূপ কথা উত্থাপন করলেন–“আমাদের তথাগত চক্রবর্তী রাজত্ব ত্যাগ করে প্রব্রজিত হলেন। তিনি দীর্ঘপ্রস্থে দ্বাদশ যোজন স্থান পরিব্যাপ্ত মার-সেনাকে পরাজয় করেছেন। আয়ুধাদি মারন অস্ত্র বিনা মারবল ধ্বংস বিধ্বংস করে মহাবিজয় লাভ করেছেন। ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুঠি হতে তাদের এ আলাপ শুনে উক্ত ধর্মসভায় উপস্থিত হয়ে প্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবেশন করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখন এখানে কি বিষয়ের আলোচনা করছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান সব বিষয় বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলেন। তখন বুদ্ধ বললেন–“তোমাদের আলোচ্যমান বিষয়টি তেমন অধিক আশ্চৰ্য্য নয়। পূর্বে আমি সমত্রিংশ পারমী ধর্ম পূর্ণ করার সময় কোন ও একজন্মে বোধিসত্ত্বাবস্থায় অপরিপক্ক জ্ঞানে আরণ্যিক যক্ষকে ও দমন করেছিলাম।” এরূপ বলে বুদ্ধ মৌনভাব অবলম্বন করলেন। তখন সভাস্থ ভিক্ষুগণ সে অতীত বিষয় প্রকাশ করে বলবার জন্য বুদ্ধকে অনুরোধ জ্ঞাপন করায় তিনি সেই অতীত বিষয়ের অবতারণা করে বললেন–
অতীতে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামক জনৈক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর রাণীর সংখ্যা ছিল মোল সহস্র। তন্মধ্যে কেসিনী নদী রাণীই ছিল অগ্রমহিষী। এ রাণীদের কারো নিকট পুত্র-কন্যা ছিল না। একদা নগরবাসী বৃন্দ রাজাঙ্গনে একত্রিত হয়ে রাজ্যরক্ষার বিষয় নিয়ে উচ্চশব্দে আলাপ করতে লাগলো। রাজা এসব উচ্চশব্দ শুনে সিংহদ্বারে এসে দেখলেন–বহুলোক সমবেত হয়েছে। তখন রাজা জনগণকে বললেন–‘ভদ্রগণ আপনারা এখানে সমবেত হয়েছেন কেন? জনতা করজোড়ে বললেন–“দেব, আপনার মৃত্যু হলে, আমাদের কীদশা হবে? সুতরাং এ রাজ্যভার পরিচালনা করতে পারে, এমন একটি পুত্র প্রার্থনা করুণ।” রাজা “সাধু” বলে তাদের বাক্যে সম্মত হয়ে রাণীদের ডেকে বললেন–“তোমরা সবাই পুত্র প্রার্থনা কর।। তোমাদের প্রার্থনায় প্রথমে যে পুত্র জন্মগ্রহণ করবে, তাকেই আমি রাজত্ব প্রদান করব।” একথা শুনে রাণীগণ স্বীয় স্বীয় পূজাৰ্হ দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম ও পূজা করে পুত্র প্রার্থনা করলেন। তাঁদের কামনা সফল হলনা। অগ্রমহিষী কেসিনী দেবী পূর্ণিমা দিবসে উপোসথ শীল গ্রহণ করে অযুত টাকার খাদ্য ভোজ্যাদি দানীয় বস্তু দরিদ্রকে দান দিয়ে সাধারণ শয্যায়। শয়ন করলেন এবং নিজের গৃহীত শীল বিষয় চিন্তা করে সঙ্কল্প করলেন–“যদি আমার শীল অখণ্ড থাকে, শীল রক্ষার প্রভাবেই আমার পুত্র লাভ হউক।” এরূপ সংকল্প করা মাত্রই দেবরাজ ইন্দ্রের রাজাসন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দেবরাজ ইহা অনুভব করে চিন্তা করতঃ দিব্যজ্ঞানে কেসিনী দেবীর উক্ত সংকল্প সম্বন্ধে জানতে পারলেন। তখন তিনিও মনস্থ করলেন–“উক্ত দেবীকে নিশ্চয়ই পুত্র লাভের উপায় করে দিতে হবে।” এচিন্তা করে দেবরাজ কেসিনীর উপযুক্ত পুত্র কাকে পাবেন চিন্তা করে দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন–দেবপুত্র বোধিসত্ত্বকে। তখন তিনি বোধিসত্ত্বকে বললেন–“হে মারিষ’ আপনি মনুষ্য লোকে গিয়ে কেসিনী দেবীর উদরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করুণ।” দেবরাজ তাঁকে এরূপ অনুরোধ করার পর অতি প্রত্যুষ কালে কেসিনীদেবীর শয়ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে দেবীর কর্ণমূলে বললেন–হে দেবী, অদ্য প্রাতে যথাযথভাবে সজ্জিতা হয়ে সিংহ পঞ্জরে গিয়ে বৰ্হিমুখী হয়ে দাঁড়াবেন। তখন এক শ্যেন পাখী আপনার সম্মুখে একটি ফল ফেলে দিবে। তা আপনি ভক্ষণ করবেন। এতে আপনার গর্ভে পুত্র সন্তান উৎপন্ন হবে।” এবলে দেবরাজ স্বীয় ভবনে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন দেবী নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে প্রানোদি করে স্বপ্নে দৃষ্ট নিয়মে সিংহদ্বার খুলে বৰ্হিমুখী হয়ে দাঁড়ালেন। এমন সময় দেবরাজ ইন্দ্র শ্যেন পাখীর রূপ ধারণ করে উড়ে এসে দেবীর সম্মুখে একটি ফল দিয়ে গেলেন। দেবী তা লয়ে ভক্ষণ করলেন এবং ফলের বীজটা ফেলে দিলেন। এমন সময় জীর্ণ শীর্ণ ঘোটকী এসে উক্ত ফলের বীজটি খেয়ে নিল। এতে তৎক্ষণাৎ ঘোটকীর গর্ভ সঞ্চার হল। কেসিনী দেবীর ও তাই হল। তখন দেবী রাজার নিকট গিয়ে প্রফুল্লচিত্তে রাজাকে বললেন–“মহারাজ আমার গর্ভ সঞ্চার হয়েছে। মনে হয় পুত্র সন্তানই হবে। আমার বহু শত্রু আছে। সুতরাং আমার সুরক্ষা বিধান করুন।” রাজা রাণীর একথা শুনে অতিশয় প্রীত হয়ে তাঁকে নিরাপদে রক্ষার জন্য কয়েক জন প্রহরী নিযুক্ত করলেন। এদিকে ঐ ঘোটকী দেবীর পূর্বেই এক শাবক প্রসব করল। শাবকের চক্ষুদ্বয় মনিগোলকের ন্যায় হয়েছিল। তাই এর নাম রাখা হয়েছিল “মনিকাক্ষা” রাণী ও দশমাস পরে সুবর্ণ কান্তি এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। তাঁর জন্মক্ষণে জম্বুদ্বীপের সমস্ত রাজা সপ্তবিধ রত্ন এবং সহস্র প্রকারের বহুমূল্যবান উপহারদ্রব্য তার জন্য পাঠালেন। রাজা এ । নবজাত পুত্রের নাম রাখলেন “সপ্ত ধনু কুমার।” এ বালক বয়স্ক হলে ধনু বিদ্যায় অসাধারণ দক্ষতা লাভ করেছিলেন। সে কারণে তার নাম সমগ্র জম্বুদ্বীপে “সপ্তধনু” নামে বিশেষভাবে প্রকট হল। তখন তাহার মাতুলের একটি পুত্র একটি কন্যা ছিল পুত্রের নাম সেবক কুমার। কন্যার নাম “করেনুবালা” কন্যাটি অতিশয় দর্শনীয়া মনোরমা ও রূপবতী ছিল। এরূপ লাবন্যময়ী কন্যা বোধিসত্ত্বেরই ভার্যা হবার উপযোগী।
এক সময় বোধিসত্ত্ব সেবক কুমারের সাথে ক্রীড়া করবার কালে এক স্ত্রীরূপ অঙ্গন করলেন তা সেবক কুমারকে দেখিয়ে বললেন–“এ ছবিটি তোমার ভগ্নীর ন্যায় হয়েছে কিনা দেখ।” সেবক কুমারকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–“আপনি তাকে কখনো দেখেছেন কি?” ইত্যাদি বলে উভয়ের মধ্যে অনেক কিছুর আলোচনা হল।
বোধিসত্ত্ব যখন ষোড়শ বর্ষে পদার্পন করলেন, তখন তাঁর পিতা ব্রহ্মদত্ত রাজা পরলোক গমন করলেন। নগর বাসীরা রাজার দাহ ক্রিয়া সমাপন করে রাজ পুত্রকে রাজ্যাভিষিক্ত করার দিন নির্ধারণ করলেন। উক্ত নির্ধারিত দিনে প্রধান অমাতা এক সৈন্ধক ঘোট্যক মনোরমভাবে সাজিয়ে বোধিসত্ত্বের নিকট নিয়া গেলেন। বোধিসত্ত্ব তা দেখে অমাত্যকে বললেন–“ভদ্রগণ, আমার জন্য ঐ “মনিকাক্ষ” অশ্বটি সর্বালঙ্কারে বিভূষিত করে নিয়ে আসুন!” তখন অমাত্যগণ তা করলেন। বোধিসত্ত্ব এর পৃষ্ঠে আরোহণ করা মাত্রই তুর্যভেরী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র আশ্চর্য ও মনোরম শব্দে ধ্বনীত হল। আর সাধুবাদ ও করতালী শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হল। অর্শ্ব উর্ধদিকে উল্লম্পল দিয়ে ক্রমশঃ সপ্ততাল বৃক্ষ প্রমাণ উর্ধ্বে উঠে একদিকে চলতে লাগল। অর্শ্বের এই রূপ আশ্চর্য গমন দর্শন করে জনগণ কেসিনী দেবীকে নিবেদন করলেন। তখন দেবী তথায় এসে বললেন–“পুত্র, শীঘ্রই এখানে ফিরে এস” তা শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন–“মা, এ অশ্ব আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।” পুনঃ দেবী বলেন “হে আমার একমাত্র প্রিয় পুত্র, তুমি অশ্বকে এদিকে ফিরে নিয়ে এস। আমাকে অনাথিনী করোনা।” এ বলে আলু থালু কেশে আর্দ্র বস্ত্রে গ্রাম দ্বারে গিয়ে দেখলেন–বোধিসত্ত্ব দূর দূরান্তরে চলে যাচ্ছেন। তিনি উর্ধ্বমুখী হয়ে বক্ষে বারম্বার করাঘাত করে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
১। “ওহে বক্ষের ধন পুত্র, এখানে ফিরে এস, আমাকে অনাথিনী করোনা। তোমায় না দেখলে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাবে।”
বোধিসত্ত্ব মাতার নির্দেশ রক্ষার ইচ্ছায় অশ্বের গতিবেগ নিবারনের জন্য বহু চেষ্টা করলেন। এতে বিফল মনোরথ হয়ে অশ্বের মস্তক ছেদনের জন্য কোষ হতে অসি বের করলেন। অশ্ব তা জ্ঞাতঃ হয়ে বলল–“দেব, আমাকে হত্যা করবেন না। যেহেতুঃ–আমি আপনার রাজ্যদায়ক।” রাজ কুমার বললেন–‘তা কি সত্য? অশ্ব বলল–হাঁ দেব সত্যই। তখন তিনি অসি কোষে রক্ষা করে মাতৃ গুণ স্মরণ করলেন এবং সাশ্রু নয়নে মাতার উদ্দেশ্যে বন্দনা করলেন। তখন অশ্ব অনুক্রমে মহাসত্বকে নিয়ে ‘শ্বেত’ নামক নগরে উপস্থিত হলেন। তখন সে রাজ্যে “সেদ” নামক রাজা রাজত্ব করতেন। তার অগ্রমহিষীর নাম ছিল “পদুম গর্ভা দেবী” তাঁর “চিরপ্রভা” নারী এক কন্যা ছিল। এ কন্যা অতিশয় রূপবতী, দর্শনীয়া ও মনোরমা। সে যেন দিব্য রূপবতী দেবকন্যা। এ অসাধারণ রূপবতীর ‘পদুমা নী এক কুজা পরিচারিকা ছিল। এ রাজকন্যাকে লাভ করবার ইচ্ছায় জম্বু দ্বীপের রাজন্য বর্গ বহু হস্তী, অশ্ব, গো, মহিষ, সপ্তরত্ন ও বহুবিধ বিলাস সামগ্রী। চিরপ্রভার পিতার নিকট পাঠিয়ে দিত। কিন্তু রাজা প্রত্যেকেরই উপহার প্রত্যাখ্যান করতেন। চির প্রভাকে সুরক্ষার জন্য সর্বক্ষণ প্রহরী নিযুক্ত থাক্ত। পরিচারিকা কুজা প্রহরিনি সকল সময় রাজ কন্যার সঙ্গেই অবস্থান করত সপ্ততল প্রাসাদের সপ্তমতলায়।
বোধিসত্ত্ব সে নগরে বর্হিভাগে স্বীয় আভরণাদি খুলে অশ্বকে বললেন–“মণিকাক্ষ” তুমি দূরে যেওনা। তোমাকে যখন স্মরণ করব, তখনই আমার নিকট আসবে।” অশ্বও ‘হ’ বলে প্রশ্রুত হয়ে রাজন্তপুরের মাঠে চরতে লাগল। তখন বোধিসত্ত্ব ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ করে নগরে প্রবেশ করলেন।
অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ তাঁকে দেখে সাগ্রহে অভ্যর্থনা করলেন। সে সময়ে, পথে, ঘাঠে, মাঠে সর্বত্র সবারই মুখে কেবল চিরপ্রভার রূপ বর্ণনাই চলছে। চিরপ্রভা অসামান্য রূপবতী হওয়ার একমাত্র কারণ হল, সে পূর্বজন্মে ভিক্ষু সংঘকে চর্তুপ্রত্যয় দান ও পূজা করার প্রভাবে এবং বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করিয়ে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে পূজা সকারেরই ফল।
বোধিসত্ত্ব এসব শুনে সঙ্কল্প করলেন–“আমি নিশ্চয়ই চিরপ্রভাকে দর্শন করব।” এরূপ চিন্তা করে বিবিধ সুরভি গন্ধে দেহ সুরভিত করে পুষ্পমাল্য ও সমুজ্জ্বল অলঙ্কারে মনোরমভাবে সজ্জিত হয়ে অশ্বকে স্মরণ করলেন। তৎক্ষণাৎ অশ্ব তাঁর নিকট এসে বলল–“দেব, কেন আমাকে স্মরণ করলেন?” কুমার বললেন–প্রিয় মণিকাক্ষ, আমি চিরপ্রভা দেবীকে দেখতে একান্ত ইচ্ছা করি।” অশ্ব ‘সাধু’ বলে তাঁর কথা অনুমোদন করল। তখন তিনি কতেক সুগন্ধি দ্রব্য ও মনোরম পুষ্পমালাদি লয়ে অশ্ব পৃষ্টে আরোহণ করতঃ চিরপ্রভার প্রকোষ্ঠ দ্বারে উপস্থিত হলেন। তথায় দরজার ছিদ্র পথে দেখলেন–পরিচারিকার সাথে সুবর্ণ প্রতিমার চেয়েও অনিন্দ্য সুন্দরী চিরপ্রভা দেবী মহার্য শৰ্য্যায় নিদ্রিতা। তখন কুমার তৃরিত গতিতে দ্বার খুলে চিরপ্রভার প্রকোষ্টে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। তখন তিনি রাজকন্যার মস্তক সুগন্ধিতে সুবাসিত করে বিবিধ মালায় বেণী অলঙ্কৃত করলেন। এরূপে যথেচ্ছা-ভাবে চিরপ্রভাবে সাজিয়ে অবশিষ্ট সুগন্ধি দ্রব্য ও সুগন্ধি পুস্পমাল্যে পদুম পরিচারিকাকে সজ্জিত করে তার পৃষ্টদেশের বস্ত্রে কুর্মরূপ অঙ্কণ করে দিলেন। তখন মণিকাক্ষ অশ্ব বোধিসত্ত্বকে বলল–“মহারাজ, রাত্রির মধ্যমযাম অতীত হয়েছে। এখন চলুন যাই।” একথা শুনে বোধিসত্ত্ব তখনই অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করে রাজবাড়ীর বর্হিভাগে এসে অশ্বকে বললেন–“হে মণিকাক্ষ, চিরপ্রভাকে না পেলে আমার নিশ্চয়ই মৃত্যু হবে। সুতরাং তুমি রাত্রি থাকতেই পুনঃ আমার নিকট উপস্থিত হবে। অশ্বও “হাঁ দেব” বলে যথাস্থানে চলে গেল।
প্রভাত হওয়ার সাথে সাথেই চিরপ্রভা দেবী গাত্রোত্থান করে পদুম পরিচারিকাকে সুসজ্জিত ও পুষ্পমাল্যে বিভূষিতা দেখে সহাস্যে বললেন–“হে পদুম, তুমি এ মাল্য কোথায় পেলে?” তখন সেও তাঁকে বলল–“আৰ্যে, আপনি এসব সাজ সজ্জা কোথায় পেয়েছেন?” ইহা শুনে চিরপ্রভা দর্পনে নিজের সজ্জা দেখে চিন্তা করলেন–“অদ্য বোধ হয় এখানে কোন দেবতা এসেছিলেন।” এরূপ সন্দেহ করে পরিচারিকাকে বললেন–“অদ্য রাত্রিতে তুমি এর পরীক্ষা করতে হবে।” পদুমা এতে সম্মত হল।
বোধিসত্ত্ব ও উক্তরূপে দ্বিতীয়, তৃতীয় রাত্রে ও রাজকুমারীর নিকট উপস্থিত হলেন। তখন কিন্তু তিনি নিদ্রিতাবস্থায় থাকতেন। তাই তিনি তার আগমন কিছুই জানতেন না। পদুমা বলল–“অদ্য রাত্রে ও এ লোকটা নিশ্চয়ই আসবে। সুতরাং সারারাত্রি জাগ্রত থেকে তাকে ধরতে হবে।” এ বলে উভয়ে সে রাত্রি বিদ্রিাবস্থায় রইলেন। এদিকে কুমার মধ্যরাত্রে অশ্বকে স্মরণ করলেন। তখনই অশ্ব তার সম্মুখে এসে পড়ল। তিনি অশ্বে আরোহণ করে চিরপ্রভার শয়ন প্রকোষ্টে উপস্থিত হয়ে অশ্বকে বললেন–“এখন তুমি চলে যাও। তোমার স্মরণ করা মাত্রই পুনঃ এখানে আসবে। মহাসত্ত্ব প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে দেখলেন–দাসীসহ চিরপ্রভা জাগ্রত আছেন। রাজকন্যা কুমারকে দেখে বিমুগ্ধ হলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকক্ষণ আলাপের পর রাজপুত্র নিজের পরিচয় দিলেন। রাজদুহিতা তার সম্যক পরিচয় পেয়ে মহানন্দে তাঁকে স্বামীরূপে বরণ করলেন। চিরপ্রভার পিতা তা জেনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন। তখন রাজ কুমারকে বধ করবার অভিপ্রায়ে অমাত্যকে বললেন–“অমাত্য প্রবর, এ হতে সপ্তম দিবসে বারাণসী রাজকুমারের ধনুবিদ্যা দেখতে ইচ্ছা করি। সুতরাং তুমি শীঘ্রই চার আঙ্গুল দল বিশিষ্ট ড়ুমুর বৃক্ষের ফলক সপ্তসারিতে শক্তভাবে স্থাপন করাও। এর পুরোভাগে চার আঙ্গুল দল বিশিষ্ট লৌহ ফলক, এর পর অনুক্রমে চার আঙ্গুল দল বিশিষ্ট অম্রফলক, বালুকা পূর্ণ সপ্ত শকট সপ্ত সারি করে তাল বৃক্ষ, এর পুরো ভাগে সারিবদ্ধ ভাবে বৃক্ষসারের খুঁটি শক্তভাবে স্থাপন কর।” অমাত্য ছয় দিনের মধ্যেই রাজার নির্দেশ অনুসারে কাজ সম্পাদন করে রাজাকে এ সমাপ্তি খবর জ্ঞাপন করলেন। তখন রাজা অমাত্যকে বললেন–“এখন তুমি গিয়ে সপ্তধনু কুমারকে বল“সে সভাস্থলে এসে ধনুবিদ্যা দেখিয়ে দক্ষতার পরিচয় প্রদান করুক।” অমাত্য তখনই এ খবর বোধিসত্ত্বকে জ্ঞাপন করলেন। তা শুনে তিনি সর্বালঙ্কারে বিভূষিত হয়ে রাজকন্যার হাত ধরে শ্রী সম্পন্ন রাজলীলায় সূজা সহ দেবরাজের ন্যায় প্রসাদ হতে অবতরণ করে অন্তিম সোপানে দাঁড়িয়ে অবলোকন করলেন। তখন তার প্রত্যেক দৃষ্ট স্থান কম্পিত হল। শ্বেত রাজা পদুমগর্ভা, সেনানি বৃন্দ, জম্বুদ্বীপের রাজন্য বর্গ, জনসাধারণ ও অমাত্যগণ সবাই বোধিসত্ত্বকে দেখে বিস্ময় বিমুগ্ধ হয়ে হর্ষধ্বনি সহ করতালি দিলেন এবং মস্তক অবনত করলেন। কুমার সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে রাজা ও তার অগ্রমহিষীকে বন্দনা করলেন। তখন রাজা বললেন–“হে ভদ্র যুবক, আমরা এখন তোমার ধনুর্বিদ্যা দেখতে চাই।” তিনি বললেন–“হে দেব” এরূপ বলে চাদরের অভ্যন্তর হতে ধনু ও শর বের করে আকাশের দিকে ক্ষেপন করলেন। শর সহ ধনু। তখনই সকলের সম্মুখে পতিত হল। এর পর বোধিসত্ত্ব সমবেত জন মণ্ডলীকে আহ্বান করে বললেন–“সমাগত ভদ্রগণ, এখানে জম্বুদ্বীপের রাজন্য বর্গ উপস্থিত আছেন। সুতরাং তাদের মধ্যে যিনি সমর্থ হন, তিনি এ ধনুগুণ যোজনা করুন।” এ ঘোষণা শুনে রাজগণের প্রত্যেকে চেষ্ঠা করলেন, কেনই এ ধনু কেশাগ্র মাত্রও বাঁকা করতে পারলেন না। তখন বোধিসত্ত্ব একমাত্র কণিষ্ঠালেই ধনুগুণ যোজনা করে শর কলাপ হাতে নিয়ে গজেন্দ্র গমনে চারিদিকে বিচরণ করে রাজাকে বললেন–মহারাজ, এখন কিসে লক্ষ্য ভেদ করব? তা বলুন।” রাজা বললেন–ঐ যে সপ্তস্থর করে উদুম্বর ফলক, লৌহফলক, তাম্রফলক স্থাপন করা হয়েছে, তা এবং কাষ্ঠনির্মিত মৃগের দক্ষিণ চক্ষু ভেদ কর।” তখন মহাসত্ব একটি মাত্র শরে সমস্ত ভেদ করার পর শরটি আকাশ পথে এসে বোধিসত্ত্বের সম্মুখে পড়ল। এ আশ্চর্য দৃশ্য দেখে মহাজনতা সহ শ্বেত রাজা বোধিসত্ত্বকে পরিবেষ্টন করে অজস্র বস্ত্রালঙ্কার উপহার দিলেন। তাঁদের হর্ষধ্বনিতে দিগুগুল মুখরিত হল। তৎক্ষণাৎ দেবব্ৰহ্ম ললাকে ও মহাশব্দ বিঘঘাষিত হল। দিব্য কুসুম, সুগন্ধি চুর্ণ ও পুষ্পমাল্য বিলেপনাদি বৃষ্টির ন্যায় বর্ষিত হল। বোধিসত্ত্বের তেজবলে এ মহা পৃথিবী কম্পিত হল। রাজা তখন অত্যন্ত সন্তোষ লাভ করে বোধিসত্ত্বকে বক্ষে ধারণ করলেন। তখনই মহাজন সমাগমে স্বীয়কন্যা চিরপ্রভার সাথে শুভ পরিণয় মঙ্গল সম্পাদন করলেন। উপস্থিত জনতা আনন্দিত হলেন। বাদ্য ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখর হয়ে উঠল। সপ্তাহ কাল ধরে মহাউৎসব প্রবর্তিত হল। বোধিসত্ত্ব পরম সুখে নিরাপদেই সস্ত্রীক শ্বশুরালয়ে অবস্থান করতে লাগলেন। অতঃপর এক রাত্রে কুমার মাতার বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হয়ে পড়লেন। রাত্রির অবসানে প্রত্যুষে তিনি শয্যা ত্যাগ করে বিচ্ছেদ বিধূর অন্তরে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২। “মাতার বিচ্ছেদ জ্বালা মম অসহ্য এখন, তার দর্শন আমি কবে পাব হায়, মাতাকে না দেখলে জীবন আমার, সংশয় হইবে নিশ্চয়।” এরূপ বলে তিনি রোদন করতে লাগলেন।
চিরপ্রভা দেবী জাগ্রত হয়ে স্বামীকে ক্রন্দনের কারণ বারয় জিজ্ঞেস করলেন–। চতুর্থবার জিজ্ঞেস করার পর মহাসত্ব বললেন–“মাতার জন্য আমার প্রাণ কাছে। আমার অভিষেক মঙ্গল দিবসেই “মনিকাক্ষ” অশ্ব তোমার জন্যই আমাকে নিয়ে এসেছে। এখন মাতার জন্যই আমি বিশেষ শোকগ্রস্ত। দেবী বললেন–“দেব, এখন কি করা যায়?” ভদ্রে, মাতার দর্শন পেলেই আমি শান্তি অনুভব করব। তুমি এখানে নিরাপদে বাস কর। আমি মাতার নিকট যাব।” দেবী বললেন–“দেব, আমিও আপনার সাথে যাব।” মহাসত্ত্ব তাহাতে বাধা দিলেন। এরূপে দেবী দু’তিন বার কাতর প্রার্থনা জানালেন বটে, কিন্তু মহাসত্ত্ব রাজী হলেন না। তিনি বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে শ্বাশুরের নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁকে বিনীতভাবে বন্দনা করে বললেন–“দেব এখন আমি মাতাকে দর্শন মানসে আমার রাজ্যে যাব।” তখন রাজা তাঁকে দেশে না যাওয়ার জন্য পুনঃ পুনঃ নিষেধ করা সত্বেও মহাসত্ত্ব তাতে রাজী হলেন না। অগত্যা রাজা তাঁকে বললেন–বাবা, তাহলে তোমার ভার্যা চিরপ্রভাকে ও সাথে নিয়ে যাও।” শ্বশুরের কথায় মহাসত্ত্ব সন্তুষ্ট হয়ে মাতৃ দর্শনে গমনের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। তৎপর রাজা ও রাণী পরামর্শ করে পর দিবস চিরপ্রভাকে উৎকৃষ্ট পোষক পরিচ্ছদ ও মূল্যবান অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে অশ্রুপূর্ণ নেত্রে। বললেন–“মাত, তুমি সর্বদা অপ্রমত্ত থাকিও।” ইত্যাদি উপদেশ প্রদান মানসে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৩। “মাত, তুমি প্রমত্ত হয়োনা। অপ্রমত্তভাবে অবস্থান করবে। গুরুজন ও স্বামীকে সর্বদা নির্ভুল ভাবে সেবা করবে।”
এরূপে রাজা রাণী কন্যাকে উপদেশ দিয়ে পাথেয়্যাদি সহ তাঁকে বোধিসত্ত্বের হাতে সমর্পণ করলেন। তিনি শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে ভক্তি সহকারে বন্দনা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার পর চিরপ্রভাকে সাথে করে প্রাসাদ হতে অবতরন করলেন। তথায় জনগণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪। “ভদ্রেগণ, আমি স্বজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে আপনাদের নিকট যদি কোন দোষ করে থাকি, তা সবাই আমায় ক্ষমা করবেন। আপনারা কোন প্রকার পাপ কর্ম করবেন না।” নগরবাসী জনগণ এদৃশ্য দর্শনে করযোড়ে রোদন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫। “আমরা এ যাবৎ আপনাকে দেখে আনন্দ পেয়েছি। এবার দীর্ঘকাল আপনার পুণ্যপ্রভাব দর্শনে বঞ্চিত থাকব। অহো, আপনার অভাব আমাদের অসহ্য হবে। হয়তঃ চিরকাল আর আপনার দেখাও পাব না।”
এবলে জনগণ রোরুদ্যমান হয়ে আকুল প্রাণে দাঁড়িয়ে রইল। তখন বোধিসত্ত্ব মনিকাক্ষ অশ্বকে স্মরণ করা মাত্র অশ্ব তথায় উপস্থিত হল। তখন তিনি সস্ত্রীক অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করার পর অশ্ব আকাশ পথে ধাবমান হল। এক দিবসে সাতশত যোজন পথ অতিক্রম করল। এরূপ তীব্রবেগে গমন। করাতে বোধ হল যেন আকাশে অত্যাশ্চর্য বিচিত্র এক সুদৃশ্য। স্বর্ণ মালিকা চলে যাচ্ছে। এরূপ তীব্র বেগে চলায় “চির প্রভা দেবীর কষ্ট হচ্ছে মনে করে বোধিসত্ত্ব মণিকাকে বললেন– মণিকা, তোমার তীব্র গতি বিধায় বায়ুতে চিরপ্রভাদেবীর কষ্ট হচ্ছে। এখন এখানে নেমে বিশ্রাম কর।” তখন অশ্ব বলল“এ অরণ্য একত্রুর যক্ষদ্বারা রক্ষিত। এ যক্ষটি তিন বৎসর যাবৎ বৈশ্রবণ রাজার জল আহরণের কাজে নিযুক্ত ছিল। নির্ভুলভাবে কাজ সম্পাদন করার পর বিদায়কালীন সে বৈশ্রবণ রাজাকে বল্ল–“দেব, আমি যেখানে বাস করব, সে স্থানের চতুর্দিকের সীমারেখার মধ্যে যে প্রাণী পাব, তাকে যেন আমি ভক্ষণ করতে পারি, এবরটি দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুণ। বৈশ্রবণ রাজা ও তার কাজে তুষ্ট বিধায় তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে বললেন–“তুমি যে স্থানের সীমা নির্দিষ্ট করে দিলে, সে সীমার মধ্যভাগে একখানা প্রাসাদ নির্মাণ কর। সে প্রাসাদে যে পথিক রাত্রি যাপনের জন্য প্রবেশ করবে, তুমি ঐ প্রাসাদ-দ্বারে গিয়ে তাদের তিনবার জিজ্ঞাসা করবে–“এঘরে তোমরা কে আছ?” প্রত্যেকবারে যদি “আমি আছি” বলে উত্তর পাও তবে তারা তোমার অভক্ষ্য। আর যারা একেবারে জবাব না দেয়, কিম্বা বারয়ের মধ্যে দুবার জবাব দিয়ে একবার দেয় না, একবার জবাব দিয়ে দুবার দেয় না, তাদৃশ ব্যক্তিকে ভক্ষণ করতে পারবে।” কান্তার যক্ষ এ অনুমতি পেয়ে সানন্দে তাকে বন্দনা পূর্বক স্বীয় স্থানে আগমণ করল এবং তথায় বৈশ্রবণ রাজার আদেশানুসারে প্রাসাদ তৈরী করে রাখল।
এ যক্ষের “অঞ্জনবতী” নী এক ভগ্নি ছিল। অঞ্জনবতী বাসের জন্য যক্ষ সমুদ্রের অনতিদূরে এক মনোরম প্রাসাদ তৈরী করে তাকে বাস করবার জন্য দান করল। তার সেবার জন্য জম্বুদ্বীপের মোলটি রাজার মহিষীকে অপহরণ করে এনে ওর পরিচারিকার কাজে নিযুক্ত করল। করেনুবতীকে উক্ত পরিচারিকাদের শ্রেষ্ঠ পদে বরণ করল। এবং নিজে ও তার অনতিদূরে প্রাসাদ নির্মাণ করে বাস করতে লাগল।” এসব। বৃত্তান্ত বলে মনিকা বোধিসত্ত্বকে নিবারণ করল। তথায় যেন বিশ্রাম না করেন। বোধিসত্ত্ব অরণ্যের মধ্যভাগে নির্মিত সুদৃশ্য। প্রাসাদ দেখে মনিকাকে বললেন–হে মনিকাক্ষ এই প্রাসাদখানি কার?” অশ্ব বলল–দেব, ইহা পূর্বোক্ত যক্ষের।” ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন–“এভাবে যদি আর কিছুদূর যাওয়া যায়, তবে চিরপ্রভার নিশ্চয়ই মৃত্যু হবে।” এ চিন্তা করে অশ্বকে তথায় অবতরণ করবার জন্য নির্দেশ দিলেন। অশ্বও নির্দেশ মাত্র অনিচ্ছাসত্বেও অবতরণ করে বোধিসত্ত্বকে জলপান করবার সুযোগ করে দিল এবং চিরপ্রভা দেবীকে উষ্ণজলোন করবার ব্যবস্থা করল। তারা তথায় জলপান ওনি কাজ সম্পন্ন করে প্রাসাদে প্রবেশ পূর্বক আনীত খাদ্যাদি ভোজন করলেন। তারপর মণিকাক্ষ বোধিসত্ত্বকে বলল–“আপনারা শয়ন করুন।। আমি পাহারা দেবো।” বোধিসত্ত্ব বললেন–“তুমি বড়ই ক্লান্ত। হয়েছ। সুতরাং তুমিও দেবী নিদ্রা যাও। আমিই পাহারা দেবো।” অশ্ব অনুনয় স্বরে বলল–“না দেব, আমিই পাহারা দেবো আপনারা শয়ন করুন।” তখন বোধিসত্ত্ব সম্মত হয়ে উভয়েই নিদ্রিত হলেন। তৎকালে আরণ্যিক যক্ষ এসে দ্বারকবাট নেড়ে জিজ্ঞেস করল–“এখানে কে আছ?” মনিকা উত্তর দিল “আমি আছি।” এ জবাব পেয়ে যক্ষ চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে পরে পুনঃ যক্ষ এসে উক্তরূপে জিজ্ঞেস করল। অশ্ব এবারও পূর্বের ন্যায় জবাব দিল। এরূপে যক্ষ তিনবার এসে জিজ্ঞেস করল, বারয় এরূপ উত্তর পেয়ে চলে গেল। তারপর বোধিসত্ত্ব জাগ্রত হয়ে মনিকাক্ষকে বললেন–“তুমি এখন কিছুক্ষণ নিদ্রা যাও। আমিই পাহারা দেবো” তখন মনিকাক্ষ “সাধু” বলে নিদ্রিত হল। যখন যক্ষ পূর্বের ন্যায় কিছুক্ষণ পরে এসে জিজ্ঞেস করল। বোধিসত্ত্ব ও উত্তর দিলেন। তৎপর চিরপ্রভা দেবী জাগ্রত হয়ে স্বামীকে বলল–“দেব এখন আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন, আমিই পাহারা দেবো।” মহাসত্ব “সাধু” বলে দেবীর কথা অনুমোদন করতঃ নিদ্রিত হলেন। তখন পূর্বের ন্যায় যক্ষ এসে জিজ্ঞেস করল–“এঘরে কে আছ? দেবীও পূর্বের ন্যায় দু’বার পর্যন্ত জবাব দিল “আমিই আছি।” তৃতীয়বার দেবীর হঠাৎ নিদ্রা আস্ল। নিদ্রার আবেশে তৃতীয়বার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। তন্মুহূর্তে যক্ষ দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতঃ ভয়ঙ্কর শব্দে বল্ল “তোমরা এখানে কে?” এ মহাশব্দে বোধিসত্ত্ব, দেবী ও অশ্ব জেগে উঠে দেখলেন বিভৎস চেহারা সম্পন্ন যক্ষ। বোধিসত্ত্ব ও দেবী ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। তখন অশ্ব ছিল দরজার সমীপে। অশ্ব জিজ্ঞেস্ করল–“তুমি কে?” যক্ষ বল্ল–“আমি কান্তার যক্ষ।” অশ্ব তাকে পুনঃ বল্ল–“হে যক্ষ, তুমি এঘর হতে বের হও। আমি তোমার সাথে যুদ্ধ করব।” যক্ষ ইহা শুনে চিন্তা করল–এ অশ্ব বহুদূর হতে এসেছে পরিশ্রান্ত হয়ে। সুতরাং গৌণ না করে এখনই যুদ্ধ আরম্ভ করলে ভাল হবে।” এ মনে করে বল্ল–“তুমিই প্রথমে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ কর।” অশ্ব তাতে সম্মত হয়ে উভয়ে প্রাসাদ হতে বের হল। অশ্ব আকাশে উল্লম্ফন করে তথায় নানা প্রকার ভয় দর্শায়ে পাদ দ্বারা যক্ষকে সজোরে বিদ্ধ করল। ইহাতে যক্ষের মুখ হতে রক্ত ধারা বের হয়ে তার উদর প্লাবিত করে ছুটল। সস্ত্রীক রাজকুমার প্রাসাদভ্যন্তর হতে বহির্ভাগে যুদ্ধশব্দ শুনে অশ্বকে বললেন–“মনিকা, তুমি নিজকে সাবধানে রক্ষা কর।” একথা শুনে যক্ষ পুনঃ ত্বরিতভাবে যুদ্ধ চালাতে লাগল। তখন অশ্ব ত্বরিত যুদ্ধ বিধায় যক্ষকে পরাজয় করতে না পেরে দুর্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন যক্ষ সুযোগ বুঝে অশ্বকে বন্ধন পূর্বক গুপ্তস্থানে নিয়ে গেল। বোধিসত্ত্ব রণক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে
দেখলেন–অশ্ব সেখানে নেই। তাই তিনি বাহিরে এসে অশ্বকে। কোথায় ও না দেখে উচ্চঃস্বরে ডান্স “হে মণিকা, হে মণিকাক্ষ” বলে। কিন্তু তার কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। যুদ্ধমাঠে দেখলেন রক্ত মাখা। ইহা দেখে বোধিসত্ত্ব অনুমান করলেন–“তাদের জীবন রক্ষাকারী অশ্বটি জীবিত নেই।” তখন তারা উভয়ে অশ্রুবিগলিত নেত্রে আমরা নষ্ট হয়েছি, আমরা বিনষ্ট হয়েছি এবলে রোদন করতে লাগলেন। চারিদিকে দৃষ্টিপাত পূর্বক পরস্পর হস্ত ধরে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৬-৭। অহো, আমরা উভয়েই হয়েছি নষ্ট। আমাদের জীবন এখন অনির্দিষ্ট। মণিকাক্ষ ব্যতীত আমাদের জীবন থাকবে কিরূপে? এখন আমরা কিরূপে করব গমন? আমরা যেতে না হব সক্ষম। ঐ অশ্ব ছাড়াও কোথাও পারবনা যেতে। এ মহারণ্যেই আমাদের হবে মৃত্যু।” তখন চিরপ্রভাদেবী স্বামীর পাদমূলে পড়ে ক্রন্দন পরায়ণা হয়ে গাথাযোগে বলল
৮। “হায়, হায়, এখন আমরা উভয়েই হলাম বিনষ্ট। এ জগতে আমরা দেবতার ন্যায় হয়েও রূপবর্ণশালী, মহাদুঃখে হয়েছি নিপতিত।” এরূপ করুণ রোদন পায়না দেবীকে মহাসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৯। “ভদ্রে, করোনা রোদন। জগতে সবকিছুই হয় বিনষ্ট। জগতে সুখ ও দুঃখ, এদুটি ধর্ম আছে বিদ্যমান।” এরূপ বলে দেবীকে সান্তনা দিয়ে অশ্রু মুছে বললেন–“ভদ্রে ঐ দিকে মেঘবর্ণ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় সে দিকে সমুদ্র আছে। চল সেদিকে গিয়ে দেশে যাওয়ার উপায় করতে পারি কিনা দেখি।” এবলে তাঁরা অগ্রসর হয়ে সমুদ্রতীরে উপস্থিত হলেন। তথায় বোধিসত্ত্ব এক বৃক্ষে আরোহন করে উত্তরীয় বস্ত্রের একখানা ধ্বজা ঝুলায়ে সে বৃক্ষ মূলে উভয়ে উপবেশন করলেন। তৎকালে পঞ্চশত বণিক নৌকাযোগে গমণ কালে বৃক্ষে ধ্বজা দেখে, অরণ্যে কেন ধ্বজা উড়ছে তা জানবার জন্যে তাদের কৌতুহল জাগল।
তাই তাদের নৌকা ধ্বজাভিমুখে চালিয়ে দিল। ক্রমে নৌকা ধ্বজার সমীপস্থ হল। তখন বোধিসত্ত্ব কাতর স্বরে সব বিপদ কাহিনী তাদের জ্ঞাপন করে বললেন–“আমরা আপনাদের নৌকায় আরোহণ করে সমুদ্রের অপর তীরে যেতে চাই। দয়া করে আমাদেরকে আপনাদের নৌকায় তুলে নিন।” তখন বণিকেরা দয়াপরবশ হয়ে উভয়কে নৌকায় তুলে যাত্রা করলেন। তখন নৌকা প্রচণ্ড বায়ুবেগে দিবসে শত যোজন জলপথ অতিক্রম করতে লাগলো। বণিকেরা বুঝতে পারল। “এ দ্রুতগতি বেগ নৌকায় সহ্য হবে না। তাই তারা দ্রুতগতি বেগ মন্দীভূত করবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। নৌকায় উপরিভাগে যা ফলকাদি আবদ্ধ ছিল, সব উড়ে গিয়ে সমুদ্রে ইতস্তঃত ভাসতে লাগল। বণিকগণ তা দেখে প্রমাদগণল এবং ভীত সন্ত্রস্থ ভাবে রোদন পরায়ণ হয়ে প্রত্যেকের ইষ্ট দেবতার নিকট প্রার্থনাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি বলল
১০। “চন্দ্রদেব, পরমেশ্বর, ব্রহ্মদেব, চন্দ্র, সূর্য ও সমুদ্র দেবতাদি সমাগত দেবতাবৃন্দ, আপনাদের করছি নমস্কার। হে দেবগণ, আপনারা হউন আমাদের শরণ আশ্রয়।”
এ দিকে বোধিসত্ত্ব ও দেবী ঘৃত-মধু-মিশ্রী যথেচ্ছা খেয়ে সারা দেহে ও বস্ত্রাদিতে প্রচুর পরিমাণে তৈল মেখে নিলেন এবং দেবীকে সূক্ষ বস্ত্রে নিজের দেহের সাথে বন্ধন করে ক্রমে নৌকায় মাস্তুলের মাথায় উঠলেন। নৌকা জলমগ্ন হওয়ার সাথে সাথেই মংস্য কুম্ভীরাদি এসে নৌকার জনগণকে ভক্ষণ করতে লাগল। তখন সমুদ্রের জল রক্তময় হয়েছিল। মহাসত্ব এসব দৃশ্য দেখে, যে দিকে বারাণসী, সেদিক লক্ষ্য করে মাতাকে স্মরণান্তর মাস্তুলের অগ্রভাগ হতে দেবী সহ লাফ দিয়ে রক্তময় জলের বহির্ভাগে পতিত হলেন। তবে পূর্ব জন্মের কর্মফলদোষে বন্ধন ছিন্ন হয়ে দু’জন দুস্থানে পৃথকভাবে পতিত হলেন। বোধিসত্ত্ব তখনই ভগ্ন নৌকার একখণ্ড তক্তা নিয়ে দেবীকে প্রদান করলেন। আর একখণ্ড তক্তা নিজে অবলম্বন পূর্বক দুজন দুইদিকে সমুদ্র সন্তরণ করতে লাগলেন। এরূপে তারা দুজনে খরস্রোতে দুইদিকে ড়ুবে ও ক্ষুধার মহাদুঃখ ভোগ করতে লাগলেন। পূর্বজন্মের কি কর্মের দোষে তারা এরূপ মহাদুঃখে পতিত হলেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে।
অতীতে বারাণসী নগরের অনতিদূরে একগ্রাম ছিল। তথায় এক পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজন একদা ভ্রমনের জন্য নদী-তীরে আগমন করল। তখন এক শ্রামণের একখানা ক্ষুদ্র নৌকায় আরোহণ করে জলক্রীড়া করছিল। তা দেখে ঐ দম্পতি যুগল ক্রীড়াচ্ছলে জলে তরঙ্গ উৎপাদন করে, ঐ ক্রীড়া পরায়ণ শ্রামণের নৌকা খানি জলে নিমগ্ন করল। ইহাতে শ্রামণেরও জলে ড়ুবে গিয়ে মহাদুঃখ প্রাপ্ত হল। তখন দম্পতিযুগল শ্রামণেরকে জল হতে উদ্ধার করে জীবন রক্ষা করলেন। এ কর্মের বিপাকেই তারা উভয়ে পঞ্চশত জন্ম এরূপ মহাদুঃখ ভোগ করেছিলেন। এ বিষয় প্রকাশের জন্য শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
১১। “ক্ষুদ্র পাপকর্মও না কর কখন। পাপকর্ম-বিপাকের মাত্রা কিছুই নেই। সামান্য পাপ কাজের ফল ও মহাদুঃখের কারণ হয়।” চিরপ্রভা দেবী ভেসে ড়ুবে কোন প্রকারে তীর প্রাপ্ত হল। তখন দেবী বোধিসত্ত্বকে স্মরণ করে শোকাকুলা হন এবং বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে নিন্মোক্ত বিলাপ গাথাগুলি ভাষণ করল–
১২-১৫। প্রাণ নাথের দেখা কিরূপেতে পাবো? তিনি বিনা আমি কিপ্রকারে থাকবো বেঁচে? এখানে কোথাও দেখছিনা তাকে। এখন আমার জীবন লীলা শেষ হয়ে যাবে, মনে হচ্ছে, ইহাই আমার। এখন দেখছি সবদিকে কেবল-নিঃসঙ্গ অন্ধকার জীবন। রাত দিন সদা কাঁপছে মম অন্তর খানি। এখন তাঁকে কেন দেখছিনা? মনে হয় তিনি নাহি এ অরণ্যে। হায়, হায়, বিন্দুদেবাদি কাউকে ও দেখছিনা এবে। এ জীবনে আমি তোমায় না পারবো ত্যাগ করতে। জলচর মৎস্যাদি কি তাঁকে করেছে ভক্ষণ? তার কি হয়েছে মরণ?”
দেবী এরূপে ক্রন্দন ও বিলাপ পরায়ণা হয়ে আঙ্গুল হতে অঙ্গুরীয়কত্রয় খুলে নিয়ে বস্ত্রাঞ্চলে বেঁধে নিল এবং দিকবিদিক জ্ঞান শূন্যা হয়ে একপদী অরণ্য পথে অনিদিষ্ট ভাবে চলতে লাগলো। সারাদিন চলার পর “ইন্দ্রপত্ত” নামক এক নগর প্রাপ্ত হল। তখন সে স্বীয়রূপ বিরূপ করে সে নগরে প্রবেশ করলেন। তথায় এক মহা শ্ৰেষ্ঠী ছিলেন। তিনি কর্মবিপাকে সর্বহারা হয়ে ভগ্নপাত্রে আহার অন্বেষণ করতঃ জীবিকা নির্বাহ করতেন। দেবী ক্রমে তার গৃহপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বলল–“আর্য, আমাকে দয়া করে আপনার গৃহে স্থান দিলে বড়ই কৃতার্থ হবো। শ্ৰেষ্ঠী বললেন–“মাতঃ আমি অতিশয় দরিদ্র। কি করে তুমি আমার গৃহে বাস করবে?” তদুত্তরে দেবী বলল–“আর্য আপনি দরিদ্র, তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। তবুও আমার প্রতি যদি আপনার অনুকম্পা থাকে, তবে একটু স্থান পেতে পারি।” তার বিনয় বাক্য শুনে শ্ৰেষ্ঠীতাকে স্থান দিতে রাজি হলেন। দেবীও স্থান পেয়ে তথায় অবস্থান করতে লাগলো। পরদিবস দেবী শ্রেষ্ঠীকে কহিল–“বাবা, আমার এ অঙ্গুরীয়কটি বিক্রি করতে ইচ্ছা করি।” শ্ৰেষ্ঠী তা হাতে নিয়ে দেখে বললেন–“মাতঃ, তোমার এ অঙ্গুরীয়কটি দেখছি মহামূল্যবান। দেবী কহিল–হাঁ বাবা, এ নগরের মূল্য চাইতেও ইহার মূল্য অধিক হবে। তবে চার শকটের বোেঝাই পরিমাণ। হিরন্ময় নিয়ে এটা বিক্রি করবেন। তখন শ্ৰেষ্ঠী তা নিয়ে কোনও সমৃদ্ধ কুলে চার শকট বোঝাই হিরন্ময়ের বিনিময়ে তা বিক্রি করলেন। সে চারশকট বোঝাই হিরন্ময় এনে দেবীকে প্রদান করলেন। দেবী তা হতে একশকট বোঝাই প্রমাণ হিরন্ময় শ্ৰেষ্ঠীকে দিয়ে অবশিষ্ট হিরন্ময় নিজ আয়ত্বে রেখে দিল। তৎপর তা হতে পাঁচ অযুত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দাস-দাসী ক্রয় করল এবং কাষ্ঠের দ্বারা প্রকাণ্ড এক গৃহ তৈরী করল। তথায় চিত্র কর্ম করবার জন্য এক চিত্রকারকে ডেকে কহিল–বাপু, তুমি আমার কথিত মতে এ গৃহে ক্রমিকভাবে চিত্রগুলি করে দাও। আমি ইহার পারিশ্রমিক তোমাকে যথেষ্টরূপে দেবো।” এবলে তার নিন্মোক্ত মনোভাব ব্যক্ত করল–(১) রাজা অশ্বপৃষ্টে আরোহণ করে প্রাসাদে প্রবেশ করা, (২) রাজা দ্বারা কুজার পৃষ্ট-বস্ত্রে কুর্মরূপ অঙ্কণ করা, (৩) নগর হতে বের হয়ে কান্তার যক্ষের শালায় বাস করার কাহিনী, (৪) মনিকাক্ষ অশ্ব কান্তার যক্ষের সাথে যুদ্ধ করার দৃশ্য (৫) মহাসমুদ্রে নৌকায় আরোহণ করে মাস্তুল মস্তক হতে সমুদ্রে পতন, (৬) দৃঢ়ভাবে বস্ত্র বন্ধন ছিন্ন হয়ে রাজার তক্তাফলক অবলম্বন করা, (৭) দেবীর তক্তা ফলক অবলম্বন করা ইত্যাদি ঘটনাবলীর, উৎপত্তি বিষয় বিচিত্রভাবে অঙ্কন করবে।” এরূপে দেবী সমস্ত ঘটনাবলী বিচিত্রভাবে অঙ্কন করায়ে শ্রমণ, সাধু ও সন্যাসীদের জন্য সেশালায় প্রচুর পরিমাণে খাদ্য-ভোজ্য যোগাড় রেখে পরিচর্যাকারীদের বলল–শ্ৰমণ সাধু ও সন্যাসীদের মধ্যে যারা এ শালায় প্রবেশ করবেন, তাদের পরিতৃপ্তভাবে ভোজনপর্ব শেষ করার পর এচিত্রগুলি দেখাবে এবং শালার উৎপত্তি সম্বন্ধে তাদের জানিয়ে দেবো। তাঁরা এসব দেখে কি মন্তব্য প্রকাশ করে, তা আমাকে বলবে। এশালার নাম রাখা হল “উন্মাদয়ন্তী” তৎকালে এ শালা পরিব্রাজকদের বাসস্থানের ন্যায় হয়েছিল। এটা “উন্মাদয়ন্তী” শালা নামে সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। একদা দেবী নিজের এক পরিচারিকাকে ঐ শালায় এ বলে প্রেরণ করল–“তুমি এখন শালায় গিয়ে আগন্তুক শ্ৰমণ ব্রাহ্মণগণকে ভোজন দানে পরিতৃপ্ত করিয়ে তথায় অঙ্কিত চিত্র সমূহ দেখাবে চিত্র দেখে প্রথমে যদি কেহ হাস্য করে এবং পরে ক্রন্দন করে তখন তা আমাকে এসে বল্বে।”
এখন মহাসত্ত্বের কি দশা হলো তা একবার পাঠকগণ দেখুন। মহাসত্ব মহাসমুদ্রে ভেসেড়ুবে অনুক্রমে “অঞ্জনবতী” নামক ঘাটে পৌছলেন। তিনি ক্লান্তদেহে তীরে উঠলেন। তথায় কদলী বন ছিল। তিনি চিরপ্রভা দেবীকে স্মরণ করে রোদন পরায়ন হয়ে ঐ কদলীবনে অবস্থান করতে লাগলেন। সে ঘাটের অনতিদূরে “অঞ্জনবতী” যক্ষিনীর বাসস্থান। প্রধানা। পারিচারিকা করেনুবতীকে ঐ যক্ষিনী বলিল–“আমিন করব। আমার জন্য জল নিয়ে এস।” তখন করেনুবতী মোজন। রাজমহিষীকে সাথে করে অঞ্জনা ঘাটের দিকে জল আনবার জন্য যাত্রা করল। তারা ঘাটে এসোনাদী করতঃ জল নিয়ে অঞ্জনাবতীর প্রসাদের দিকে যাত্রা করল। সর্ব পশ্চাতে ছিল। করেনুবতী পারিচারিকা। বোধিসত্ত্ব করেনুবতীকে চিনতে পেরে কদলীবন হতে বের হয়ে ‘হে করেনুবতী দাঁড়াও” বলিয়া ডাক দিলেন। করেনুবতী এশব্দ শুনে এদিক ওদিক চেয়ে বলল “তুমি কে?” তোমার নাম কি? বোধিসত্ত্ব বললেন–“আমার নাম সপ্ত ধনু। আমি তোমার মামাত ভ্রাতা ইত্যাদি বলে আদ্যন্ত সব বিষয় কহিলেন। ইহা শুনে করেনুবতী বোধিসত্ত্বের পায়ে পড়ি রোদন করল এবং সংজ্ঞাহারা হল। কিছুক্ষণ পরে সে সংজ্ঞা লাভ করে বোধিসত্ত্বের সাথে আলাপাদি করার পর নিন্মোক্ত গাথায় বলল–
১৬। দেব, আপনি কুশলে ও নিরাপদে আছেন ত? আপনার পিতা সুস্থ আছেন ত? আপনার সেনাবাহিনী ও রাজ্য নির্বিঘ্নে আছে ত?” মহাসত্ত্ব বললেন–
১৭। আমি আছি কুশলে ও নিরাপদে। সেনাবাহিনী আর রাজ্য নির্বিঘ্নে হতেছে পরিচালিত। পুনঃ করেনু কহিল
১৮। তব মাতা আছেন কেমন? শুনেছি তার চক্ষু হয়েছে দুর্বল। আপনি সুস্থ আছেন কিনা? আপনার বাহনাদি কুশলে আছেন কিনা? মহাসত্ব বলিলেন
১৯-২০। “মদীর মাতার চক্ষু দুর্বলাকারে আছেন সুস্থা। মম বাহনাদি আছে কুশলে।” করেনু পুনঃ জিজ্ঞেস্ করল“মহারাজ, আপনার সেনাবাহিনী ও রাজ্য কোথায়? অশ্ব রথ শূন্য অতি দূরে এসেছেন। মিত্র বান্ধবাদি কোথায় রেখে এদিকে এসেছেন? তখন বোধিসত্ত্ব নিজের আগমনের কারণ নিতাক্ত নয়টি গাথাযোগে প্রকাশ করলেন–
২১-২৯। আমার পিতার মুত্যু সময়ে তথায় যারা একত্রিত হয়েছিল, তারা এবং যোদ্ধা, বীর কুমার, বৈশ্য ব্রাহ্মন ও গ্রামবাসী সবাই আমাকে বারানসী রাজ্যের শুভ রাজপদে অভিষিক্ত করেছিলেন। তখন আমি অশ্বে আরোহণ করে বহু গ্রাম নগর অতিক্রম করে শ্বেত নগরে উপস্থিত হই। তথায়। ধনুবিদ্যাদি প্রদর্শন করি। এ শিল্প দেখে রাজা তুষ্ট হয়ে তাঁর কন্যার সাথে আমার শুভ বিবাহের কাজ সম্পন্ন করা হয়। তৎপর আমি সস্ত্রীক অশ্বে আরোহণ করে আকাশ পথে গিয়ে কান্তার যক্ষের শালায় প্রবেশ করি। তখন ঐ যক্ষ এসে। আমাদের আক্রমন করে। তখন মনিকাক্ষ অশ্ব যক্ষের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করে। সে যুদ্ধে অশ্বের পরাজয় হল। যক্ষ অশ্বকে আমাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেল। তৎপর দেবী সহ আমি সমুদ্রতীরে গিয়ে বণিকের নৌকায় আরোহণ করি। তখন যুগান্তকারী তীব্র বাত্যাঘাতে নৌকা ভগ্ন হল। তখন দেবী দিক্ বিদিক্ দিশাহারা হল। পূর্বকৃত পাপকর্মের বিপাকে দেবীর সাথে আমার বিচ্ছেদ ঘটল। সে হতে আমি একাকীই বিচরণ করছি।”
এবলে মহাসত্ত্ব চিন্তা করলেন–“যদি করেনুবতীকে কলুষ দ্বারা আবদ্ধ না করি, পরকে আমার কথা বলে দেবে।” করেনুবতী ও চিন্তা করল–“এ সপ্তধনু কুমারকে কলুষ দ্বারা আবদ্ধ করতে হবে। যদি তা না হয়, তবে আমার সাক্ষাতের কথা সবাইকে বলে দেবে।” এ বলে উভয়ে উভয়ের সাথে প্রিয় আলাপে সংবদ্ধ হল। অনেক্ষণ আলাপের পর করেনুবতী বোধিসত্ত্বকে বলল–স্বামী, আপনি এখানে পালিয়ে থাকুন। অন্য কাউকে ও দেখা দেবেন না।” এবলে করেনুবতী ও জল নিয়ে অঞ্জনাবতীর নিকট উপস্থিত হল। সে প্রাসাদে আরোহণ করা মাত্রই অঞ্জনাবতী বলল–“হে করেনুবতী এখানে মনুষ্যগন্ধ কেন প্রবাহিত হচ্ছে?” এ রূপে বারয় জিজ্ঞেস করল। করেনুবতী ও বারত্ৰয়ই বলল–“এখানে মনুষ্যগন্ধত আমরা অনুভব করছিনা। পর দিবস ও ঐ ষোলজন নারী জল আনবার জন্য যাওয়ার কালে করেনুবতীকে সঙ্গিনীরা বল্ল–হে করেনুবতী, তুমি যে পুরুষের সাথে আলাপ করেছ, তা সত্য। তৎবিষয় আমরা ও জানি। সঠিক কথা যদি আমাদের না বল, তাহলে আমরা যক্ষিনীকে বলে দেবো। তা শুনে করেনুবতী ভীতাত্রাসিতা হয়ে বল্ল–“তিনি সম্বন্ধে ভ্রাতা। তার নাম “সপ্তধনু কুমার।” তখন সবাই বল্ল–তাঁর রূপ সম্পদ কিরূপ? করেনু বল্ল–তার রূপ সম্পদের পরিমাণ নেই। তার রূপ বিলাস দেবরাজের চেয়ে ও সমধিক। সহস্র মুখে ও তার রূপ বর্ণনা করে শেষ করা হবে না।” তখন ঐ নারীরা বল্ল–তুমি তা সত্যই কি বছ? করেনুবতী বলল–হা সত্যই বছি” তখন। সবাই একমত হয়ে বোধিসত্ত্বের নিকট এসে দাঁড়াল। বোধিসত্ত্ব। তখন সবার সাথে প্রত্যালাপ করলেন। তারা প্রগাঢ় ভালবাসার আকর্ষণে বোধিসত্ত্ব সহ সবাই মিলে কিয়ৎক্ষণ খেলাধূলা করার পর নারিগণ জল নিয়ে চলে গেল। তারা প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই মনুষ্য গন্ধে প্রাসাদ ভরপুর হল। অঞ্জনাবতী যখন এ গন্ধ অনুভব করল, তখন জিজ্ঞেস করল–“ওহে, তোমরা এখানে। উপস্থিত হওয়া মাত্র মনুষ্যগন্ধ অনুভব হচ্ছে, কেন? তোমরা যদি এর প্রকৃত কারণ আমার নিকট ব্যক্ত না কর, তা হলে তোমাদের এখনই হত্যা করা হবে। এ বলে তর্জন গর্জন করতে লাগলো।
তখন তারা সবাই অভয় যাঞ্চা করে বল্ল–“আর্যে, আমরা বারাণসী রাজপুত্র সপ্তধনু কুমার করেনুবতীর ভ্রাতা এখানে এসেছেন। অঞ্জনাবতী যক্ষিনী সপ্তধনুর নাম শুনে প্রীতিফুল্ল মনে চিন্তা করল–“যদি সে রাজা পণ্ডিত হয়, আমার প্রদত্ত সংকেত নিশ্চয়ই বোঝবেন।” এমনে করে একখানা। কাগজে সপ্তধনু কুমারের ছবি এবং নিজের ছবি অঙ্কন করে, তা বক্ষে চেপে ধরে করেনুবতীকে বলল–এ পত্রখানা নিয়ে সপ্তধনু কুমারকে দাও। যদি তোমার ভ্রাতা এ পত্রের সংকেত বুঝতে পারে, তবে শীঘ্রই আমার নিকট আসবে। যদি না বুঝে, তবে সে আমার ভক্ষ্য হবে।” এবলে করেনুবতীকে মহাসত্বের নিকট পাঠালেন। করেনুবতী ও মনে করল–“এবার নিশ্চয়ই আমার ভ্রাতার মৃত্যু হবে।” এ চিন্তা করে পত্রখানি নিয়ে রোরুদ্যমানাবস্থায় মহাসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হল। তাকে বন্দনা করে পত্রখানি দিয়ে বলল–“এর মর্ম যদি আপনি বোঝেন, তা ভাল আর যদি না বোঝেন, তাহলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য।” বোধিসত্ত্ব সে পত্ৰখানা দেখে বোঝতে পারলেনঅঞ্জনাবতী তাঁর প্রতি অনুরক্তা।” তা জেনে করেনুবতীকে বলেন–“আমি পত্রের মর্ম বোঝেছি। ইহা শুনে করেনুবতী অত্যন্ত তুষ্ট হল। তখন মহাসত্ব একখানা পত্রে নিজের ও অঞ্জনাবতীর ছবি, একসাথে উপবিষ্টাবস্থায় অঙ্কন করে করেনুর হস্তে দিয়ে বললেন–“এ পত্রখানি অঞ্জনাবতীর হাতে দাও।” সে তখন গিয়ে পত্রখানি তাকে দিল। তা পেয়ে প্রেম প্রীতিতে তার সর্বদেহ পূর্ণ হয়ে গেল। তখন সে ত্বরিত গমনে প্রাসাদে ঢুকে উৎকৃষ্ট রেশমী পশমী বস্ত্র পরিধান করল, নানা অলংকার ও দিব্য মালা গন্ধ বিলেপনাদি করেনুর হাতে দিয়ে বল্ল“এগুলো সপ্তধনুকে দিয়ে এস। পারিচারিকা তখনই তার আদেশ পালন করল। মহাসত্ত্ব তা পেয়ে তুষ্ট হয়োনাদি করতঃ উক্ত অলঙ্কার ও সুগন্ধি মাল্যে বিভূষিত হলেন। তৎপর জাতি সিংহের ন্যায় বা দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় ধীর গমনে অঞ্জনাবতীর প্রাসাদে উপনীত হলেন। যক্ষিনী তাঁকে দেখে অতি প্রফুল্লিতা হয়ে বল্ল–“আসুন মন” এবলে বোধিসত্তের হস্তে ধরে নিজের শয়ন-প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেল। সে হতে তিনি যক্ষিনীর প্রিয় পাত্র হয়ে তথায় অত্যাধিক আদর যত্নের মাধ্যমে অবস্থান। করতে লাগলেন।
এরূপে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে কিছুদিন অতীত হওয়ার পর মহাসত্ব করেনুবতীকে বললেন–“ভদ্রে, এখানে আমার অশ্বটি আছে কি? করেনু বল্ল–“দেব, তা অঞ্জনাবতী হতে পেতে পারবেন। যেহেতু কান্তার যক্ষ শয়নে গমনে উপবেশনে সব সময়েই আপনার স্মরণ ও গুণপনা বর্ণনা করে থাকেন এবং অশ্বকে ও উত্তমরূপে রক্ষা করছে। তাই আমি মনে করি যে কোন একটা উপায়ে অঞ্জনাবতীর নিকট হতেই অশ্বটি পেতে পারেন।” বোধিসত্ত্ব তা শুনে আনন্দিত হলেন। একদা প্রত্যুষকালে বোধিসত্ত্বের মাতার কথা স্মৃতি পথে জাগ্রত হওয়ায় শয্যা হতে গাত্রোত্থান পূর্বক রোদন করতে লাগলেন। তাঁর রোদন-শব্দে অঞ্জনাবতীর দ্রিা ভেঙ্গে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে বল্ল–“দেব, আপনি রোদন করছেন কেন? আপনার প্রতিত আমি কোন দোষ করিনি। কেন রোদন করছেন? এরূপে অঞ্জনাবতী তিনবার জিজ্ঞাসা করার পর মহাসত্ত্ব বললেন–“ভদ্রে বারাণসীতে অবস্থান কালে সর্বদা হস্তী অশ্ব নিয়ে ক্রীড়া করতাম। এখানে কিছুই নেই। এখন আমার একান্তই ইচ্ছা হস্তী অশ্ব নিয়ে ক্রীড়া করি। এখন তুমি তোমার প্রিয় মনোজ্ঞ ভ্রাতার নিকট গিয়ে একটি অশ্ব যাঞ্চা কর। অশ্ব না পেলে আমার মৃত্যু অনিবার্য।” অঞ্জনাবতী একথায় ভীত হয়ে বলল“স্বামিন আপনি কোনই চিন্তা করবেন না।” এরূপ আশ্বাস দিয়ে করেনুবতীকে ডেকে বলল–মাতঃ, তুমি আমার ভ্রাতার নিকট গিয়ে আমার জন্য একটি অশ্ব যাঞ্চা করে নিয়ে এস।” তখনই করেনুবতী কান্তার যক্ষের নিকট গিয়ে বন্দনাদি করে বলল–“আপনার ভগ্নী অঞ্জনাবতী অশ্ব নিয়ে ক্রীড়া করতে একান্ত ইচ্ছা করেছে। তাই আপনার অশ্বটি নেওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।” ইহা শুনে কান্তার যক্ষ বলল–“হে করেনু এরূপ ইচ্ছা করোনা। সে অশ্ব বড়ই নিষ্ঠুর। যদি তুমি তা নিয়ে যাও, পথেই এ অশ্ব তোমায় বধ করবে। তাই তুমি গিয়ে এসব কথা আমার ভগ্নীকে বল।” এ বলে তাকে পাঠিয়ে দিল। সে ও মৃত্যুভয়ে ভীতা হয়ে ফিরে এসে অঞ্জনাবতীকে সব কথা খুলে বলল। তখন অঞ্জনাবতী বোধিসত্ত্বকে কান্তার যক্ষ কথিত সকল বিষয় বলল। তখন মহাসত্ত্ব করেনুবতীকে ডেকে বললেন–“পুনঃ তুমি তথায় যাও। অশ্বকে ভয় করোনা। সে অশ্ব আমার কথা ব্যতীত আর কারো কথা শোনবেনা। যক্ষ তাঁকে বেঁধে রাখলে ও সে দমিত হবে না। তুমি শিগগির গিয়ে নির্ভয়ে তার নিকট হতে অশ্বটি যাঞ্চা কর।” তা শুনে করেনুবতী তখনই কান্তার যক্ষের নিকট গিয়ে পুনঃ অশ্বটি প্রার্থনা করল। যক্ষ বলল–যদি তুমি তাকে দমন করতে পার তবে নিয়ে যাও।” তখন করেনুবতী অশ্বের নিকট গিয়ে বলল“হে মনিকা, তোমার প্রভু সপ্তধনু রাজা তোমাকে নেওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। এখন তোমার প্রভূ তোমাকে বারবার স্মরণ করে কান্তার যক্ষের ভগ্নী অঞ্জনাবতীর প্রাসাদেই বাস করছে। সুতরাং তুমি আমার সাথে তোমার প্রভুর নিকট আস। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। অশ্ব তা শুনে অপূর্ণ নেত্রে করেনুবতীর নিকট এসে অধোমুখী হয়ে ক্রন্দন করতে লাগলো। তখন তাকে সাথে করে করেনুবতী যক্ষের প্রাসাদে উপনীত হল। তথায় যক্ষকে বন্দনা করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। যক্ষ তখন করেনুকে সম্বোধন করে বল্ল–“হে করেনু। এ অশ্ব তুমি কি করে দমন করলে?” দেব, এ অশ্ব দমন করার আমার শক্তি নেই। আপনার ভগ্নী অঞ্জনাবতীর প্রভাবেই দমিত হয়েছে বলে মনে হয়। বোধ হয় তিনি অশ্ব দমনের কিছু মন্ত্র জানেন। এ বলে অশ্বটি নিয়ে বোধিসত্ত্বের নিকট গিয়ে উপস্থিত হল। অশ্বটি দেখে বোধিসত্ত্বের চক্ষু হতে অশ্রু ধারা প্রবাহিত হল। তা দেখে অশ্ব অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বলল–“দেব, আমি বিনা এতদিন আপনি সুখে ছিলেন ত? মহাসত্ত্ব বলেন–“মনিকাক্ষ, আমি চিরপ্রভা দেবীর বিরহে দেবীর বিরহে অতি দুঃখানুভব করছি। তুমি তা জান না? মনিকাক্ষ বলল–মহারাজ, আপনি এখানে গৌণ করবেন না। বোধিসত্ত্ব বললেন–“এখানে একদিন মাত্র বাস করেই চলে যাব।” তৎপর মহাসত্ত্ব অঞ্জনাবতীকে বললেন–“ভদ্রে, আমি উদ্যান ক্রীড়া করতে ইচ্ছা করি। যেহেতুঃ–এ অশ্বটি বড়ই নিষ্ঠুর। সে জলপান করতে ইচ্ছা করে। আমরা জলপান করে পরে উদ্যান ক্রীড়া করবো। অঞ্জনাবতী মহাসক্তের কথা বিশ্বাস করে বহু সুরা সাথে করে সমস্ত পারিচারিকা সহ বাগানে প্রবেশ করল। তথায় পারিচারিকা সহ অঞ্জনাবতীকে সুরা পান করিয়ে নেশাগ্রস্ত করলেন। তখন পরিচারিকাগণ সহ অঞ্জনাবতী প্রাসাদে এসে গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হল। ইত্যবসরে মহাসত্ব করেনুবতীকে আহ্বান করে বললেন–এখন আমি তোমাদের এখান হতে আমার গ্রামে চলে যাবো। তজ্জন্য তোমরা কোন চিন্তা ও অনুশোচনা করো না। অচিরেই তোমাদের ও আমার সেখানে নিয়ে যাবো। সুতরাং সম্প্রতি তোমরা এখানেই বাস কর।”
এবলে তিনি প্রাসাদ হতে বের হচ্ছে, এমন সময় অঞ্জনাবতী। নিদ্রা হতে জেগে বোধিসত্ত্বকে ফিরিয়ে আনল। এরূপে তিনবার যাওয়ার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু বিফল মনোরথ হলেন। চতুর্থ বারে সুযোগ বুঝে মনিকাক্ষকে আহ্বান করা মাত্র সম্মুখে এসে পড়ল। তখন মহাসত্ত্ব অশ্বে আরোহণ করা মাত্র অশ্ব তীরবেগে আকাশ পথে ছুটলো। তৎক্ষণে অঞ্জনাবতী ন্দ্রিা হতে জেগে মহাসত্ত্বকে কোথাও না দেখে উভয় হস্তে বক্ষে আঘাত করে ক্রন্দন করতে লাগলো এবং শোকাকুল হয়ে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বলল–
৩০-৩১। মদীয় স্বামী হে দেবরাজ, আপনি এখন কোথায় গিয়েছেন? আপনি ফিরে আসুন। আমাকে একাকিনী করে ত্যাগ করবেন না। এসে দাসী পরিচারিকা সহ আমাকে গ্রহণ করুণ। হে মহারাজ, আমাকে গ্রহণ করুন। আপনি বিনা আমি এক মুহূর্তও বাচঁবনা।” এ বলে অঞ্জনাবতী অতিশয় রোদন ও বিলাপ পরায়না হয়ে তথায় বসে পড়ল।
এ দিকে মহাসত্ব আকাশগামী অশ্বে আরোহণ করে অনুক্রমে “ইন্দ্রপত্ত” নামক গ্রামে পৌছলেন। তিনি নগরের বহিভাগে অশ্ব হতে অবতরণ করে অশ্বকে বললেন–“তুমি এখানে থাক। আমি এ নগরে প্রবেশ করে চিরপ্রভা দেবীকে অন্বেষণ করব।” এ বলে তিনি ব্রাহ্মণ বেশ ধারণ করে নগরে প্রবেশ করলেন। তথায় লোককে জিজ্ঞাসা করলেন–“মহাশয় এখানে শ্ৰমণ ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণের একত্রিত হওয়ার কোন স্থান আছে কি? তারা বললেন–হাঁ ব্রাহ্মণ মহোদয়, তেমন স্থান এখানে আছে। অমুক স্থানে “উন্মাদয়ন্তী” নামক এক ধর্মশালা আছে। তথায় বহু শ্ৰমণ, ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতগণ সর্বদা একত্রিত হন।” তখন বোধিসত্ত্ব ঐ ধর্মশালায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। শালায় পরিচারিকা তাঁকে সযত্নে ভোজ্য দ্রব্যাদি পরিবেশন করল এবং আহারের পর তাঁকে বলল“দেব, এ গৃহে আগত শ্ৰমণ, ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতগণ ভোজনের পর এখানে অঙ্কত ছবি সমূহ দর্শন করেন। এখন চলুন আপনিও ঐ নিয়মে ছবিগুলি দর্শন করুন। “তথাস্তু বলে তিনি পরিচারিকা। সহ ছবি দেখার জন্য তথায় প্রবেশ করলেন। এসে প্রথমে দেখলেন–সপ্তধনুরাজা প্রাসাদ হতে বের হচ্ছেন। এ ছবির নিভাগে ইহার সংক্ষিপ্ত বিবরণী লিখা আছে। তা দেখে তিনি সামান্য হাস্য করলেন। তৎপর দেখলেন–চিরপ্রভার ছবি। তা দেখেও সামান্য হাস্য করলেন। তারপর দেখলেন এক কুজী। তার পৃষ্ঠদেশের বস্ত্রে অঙ্কিত আছে এক কুর্মের ছবি। তা দেখেও তিনি হাসলেন। তৎপর ছবিতে দেখলেন–সপ্তধনু ও চিরপ্রভা নগর হতে বের হয়ে অশ্বে আরোহণ পূর্বক কান্তার যক্ষের প্রাসাদে গিয়ে শয়ন করছেন। মনিকাক্ষ অশ্ব যক্ষের সাথে যুদ্ধ করছে। আর দেখলেন মহাসমুদ্র-তীরে ধ্বজাপতাকার মূল দেশে সাশ্রু নয়নে উপবিষ্টাবস্থায় আছেন। সপ্তধনু ও চিরপ্রভা দেবী। আরো দেখলেন–মহাসমুদ্রে নৌকার মাস্তণের উপর মহাসত্ত্ব ও চিরপ্রভা দেবীর একবস্ত্রে বন্ধন, ঐ মাস্তল হতে উভয়ের ঝম্প দেওয়া, বন্ধন ছিন্ন হয়ে দু’জনের দুস্থানে পতন এবং সমুদ্রজলে ভেসে ড়ুবে দু’জন দুদিকে তরঙ্গাঘাতে চলে যাচ্ছেন। ছবিতে এসব দৃশ্য দেখে মহাসত্ত্ব মহাশব্দে রোদন করতে লাগলেন। শালায় পরিচারিকাগণ এ করুণ দৃশ্য দেখে দেবীর নিকট গিয়ে বলল–“আর্যে, ছবিগুলি দেখে এক যুবক ব্রাহ্মণ প্রথমে হাস্য করলেন, পরে উচ্চ শব্দে ক্রন্দন করতে লাগলেন।” দেবী তা শুনে জানালা খুলে দেখে জাতে পারলেন–ইনি তাঁর স্বামী সপ্তধনু কুমার। দেবী আর স্থির থাকতে পারলেন না। অশ্রু পূর্ণ নেত্রে মহাসত্ত্বের নিকট এসে তাঁর পাদযুগল জড়িয়ে ধরে নানাপ্রকার বিলাপ করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন—
৩২। অদ্য আমার হৃদয় শান্ত হয়েছে। শোক-শল্য উৎপাটন হয়েছে। আমি আপনাকে দেখে এখন শোক বিহীন হয়েছি।
তখন বোধিসত্ত্ব তাঁকে নানা প্রিয় বাক্যে সান্ত্বনা দিয়ে সুখী করলেন। নগরবাসীরা সবাই তাদের এসব বিষয় জেনে বিস্মিত হলেন এবং দয়া চিত্তে বহু উপহারাদি তাদের জন্য প্রেরণ করলেন। তৎপর নগরবাসীরা মহাসক্তের নিকট এসে বললেন–“আপনি এখানেই রাজত্ব করুণ। আমরা আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। বোধিসত্ত্ব বিনীত বাক্যে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে কতিপয় দিবস তথায় বাস করলেন। তারপর একদা তথাকার রাজা “মহাপ্রণাদের নিকট হতে বিদায় নিয়ে তথাকার মহাজন মণ্ডলীকে উপদেশাদি প্রদান করতঃ চিরপ্রভা দেবীসহ অশ্ব পৃষ্টে আরোহণ করে অনুক্রমে আকাশ পথে বারাণসী নগরে উপস্থিত হলেন।
বোধিসত্ত্ব গৃহ ত্যাগ করে যাওয়ার পর হতে তাঁর মাতা সারাক্ষণ সাশ্রু নয়নে রাজবাড়ীর বহিদ্বারে এসে পুত্রের গমন পথের দিকে অবলোকন করে থাকতেন। সে দিনও বোধিসত্ত্ব অশ্ব পৃষ্ঠ হতে নেমে রাজবাড়ীর বহিদ্বারে রোরুদ্যমান মাতাকে দেখলেন। তখন তিনি মাতার পায়ে পড়ে বহুক্ষণ রোদন করে বিরহ জ্বালার শান্তি করলেন। তখন মাতা পুত্রকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে মনের আবেগে বললেন–“হে প্রিয় পুত্র, অন্ধের নয়ন মণি, তুমি এখান হতে গমনাবধি আমি সারাক্ষণ সাশ্রু নয়নে গমন, উপবেশন, শয়ন ও ভোজন করেছি। দিবা রাত্র নিঝরের জলের মত অশ্রু বর্ষণ হয়েছে। অদ্য তোমাকে আমার বক্ষে পেয়ে বিপুল সুখ অনুভব করছি।” এরূপে নানা প্রিয় বাক্যে বলে পুত্রকে সাথে করে নগরে প্রবেশ করলেন। নগর বাসীরাও। তুর্যধ্বনি সহকারে মহোৎসবের সহিত সপ্তধনু কুমারকে পুনরায় রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।
একদা মহারাজের অন্তরে অঞ্জনাবতীর প্রতি অদম্য অনুরাগ উৎপন্ন হল। তাই তিনি মণিকাক্ষ অশ্বে আরোহণ করে আকাশ পথে কান্তার যক্ষের প্রাসাদের সম্মুখে গিয়ে আকাশে স্থিত হলেন এবং যক্ষকে সম্বোধন করে বললেন–“হে মহাযক্ষ, তোমার ভগ্নী অঞ্জনাবতী আমার স্ত্রী। এখন আমি তাকে নেওয়ার জন্য এসেছি। তাকে আমায় প্রদান কর। যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তোমার সাথে মহাযুদ্ধে আমায় নামতে হবে।” যক্ষ তা শুনে তখনই অঞ্জনাবতীর নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করল“হে অঞ্জনাবতী, সপ্তধনু রাজা কি সত্যই তোমার স্বামী?” তখন অঞ্জনাবতী কোন প্রকার দ্বিধা না করে বলল–হ দাদা, তিনিই আমার স্বামী। তা শুনে যক্ষ মহাসত্বের নিকট এসে বলল–“হে মহাপুরুষ, আপনি আসুন। আমার ভগ্নী আপনাকে প্রদান করব। “তা শুনে সপ্তধনু রাজা আকাশ হতে নেমে অঞ্জনাবতীর প্রাসাদে প্রবেশ করে উপবেশন করলেন। তখন কান্তার যক্ষ অন্যান্য বহু যক্ষকে সমবেত করে মহোৎসবের সহিত অঞ্জনবতীকে মহারাজের হস্তে সমর্পন করলেন। তারপর মহাসত্ত্ব কান্তার যক্ষকে বললেন–হে ভদ্র, তুমি সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করবে। পঞ্চশীল বলতে বুঝায়–প্রাণীহত্যা, চুরি, পরদার লঙ্ঘন, মিথ্যাভাষণ এবং নেশাদ্রব্য সেবন হতে বিরত হওয়া।”
হে মহাযক্ষ, প্রাণীহত্যা হতে বিরত হলে নিতাক্ত ফল লাভ হয়। যথা–নির্বান লাভ না হওয়া পর্যন্ত জন্মে জন্মে নিখুঁত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পন্ন হয়। যানবাহনাদি দ্বারা সুখে চলাফেরা করে। মরনাসন্নকালে স্মৃতি বিহবল হয় না। এ শীল হয় মহা পৃথিবীর ন্যায় প্রতিষ্ঠা দায়ক এবং আরো হয় অবধ্যা নির্ভীক দীর্ঘায়ু সম্পন্ন, সর্বজন প্রিয়, মহাশক্তিধর এবং সৌন্দৰ্য্য, লাবন্যময়, মৃদুতা অচ্ছেদ্য সুখী, পরিবারতা ও নীরোগীতা।।
চুরি না করার ফলে হয় জন্মান্তরে মহাধনশালী, অনুৎপন্ন সম্পদের উৎপত্তি, উৎপন্ন সম্পদের অভিবৃদ্ধি, নিরাপদ, সুখ বিহারী ও প্রিয়বস্তু লাভী।
ব্যভিচার বা পরদার লঙ্ঘন না করার ফলে নারীত্ব ঘুচে যায়, পুরুষত্ব লাভ হয়, নপুংসক ও দুরারোগ্য রোগগ্রস্ত হয়। না। হাঁপানী কুষ্ট রোগ হয় না। কমনীয় লাবণ্যময় চেহারা লাভ হয় ও সকলের প্রিয় হয়।
মিথ্যা বাক্য না বলার ফলে–পিক কণ্ঠ মধুর ভাষী, সু শ্ৰী সুখাকৃতি, সুন্দর অবিরল নিরোগ দন্তাবলী, মুখে দুর্গন্ধহীন ও সুখস্পর্শ হয়।।
মাদক দ্রব্য সেবন না করার ফলে স্মৃতিমান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অপ্রমত্ততা অক্রোধী, সুদক্ষ সূক্ষ্মদর্শী, প্রত্যুৎপন্ন মতিত্ব ইত্যাদি গুণ সম্পন্ন হয়। মহাযক্ষ সুষ্ঠুরূপে এ পঞ্চশীল রক্ষা কর। এ জগতে যারা পঞ্চশীল পালন না করে, তারা মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই অসুর তির্যগ, প্রেত ও নিরয়, এ চতুর্বিধ অপায়ে উৎপন্ন হয়। আর যারা এ পঞ্চশীল রক্ষা করে, মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়।
তখন কান্তার যক্ষ বোধিসত্ত্বের এবম্বিধ ধর্মবাক্য শুনে প্রীতিচিত্তে তাঁকে বলল–“হে মহারাজ, আপনার ভাষণ শুনে আমি পরম সন্তুষ্ট হয়েছি। এ হতে আমি আপনার বাক্য রক্ষা করব। আমি কোনও প্রাণী, অন্ততঃ ক্ষুদ্র পিপিলিকা পর্যন্ত বধ করবনা, পরের অন্ততঃ তৃণশলকা পর্যন্ত চুরি করবনা, পরদার লঙ্ঘন করবনা, মিথ্যা বাক্য বলবনা এবং পঞ্চবিধনেশা দ্রব্য সেবন করবনা। আমরণকাল আমি এ পঞ্চশীল রক্ষা করব।” বোধিসত্ত্ব এরূপে কান্তার যক্ষকে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত করে অঞ্জনাবতী ও করেনুবতী মহাঅশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে আকাশপথে স্বীয় নগরে নিরাপদে উপস্থিত হলেন। সে হতে মহাসত্বের পরিচালনায় বারাণসী ধনসম্পদে-মান-মর্যাদায় ও গুণ গরিমায় বিপুল সমৃদ্ধশালিনী হল। মহাসত্ত্ব কৃতজ্ঞতা প্রদর্শণ মানসে মনিকাক্ষ অশ্বকে পাঁচ অযুত টাকা উপহার প্রদান করিলেন। তদবধি মহাসত্ব দেবরাজের ন্যায় যশঃ কীর্তি ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে দেব-নরের প্রিয় ভাজন হয়ে রাজত্ব করতে লাগলেন।
ভগবান বুদ্ধ এপর্যন্ত বলার পর জাতকের নিন্মোক্ত সমাপ্তির গাথাগুলি ভাষণ কররেন
৩৩-৩৮। তখন ব্রহ্মদত্ত রাজা আমার পিতা শুদ্ধোদন। বর্তমানের মহামায়া দেবীই অতীতের কেশিনী। মহাতেজশালী। মহামোল্লায়ণ ছিল শ্বেত রাজা। দিব্য চক্ষুধারী অনুরুদ্ধ দেবরাজ ইন্দ্র। পদুম গর্ভাদেবী বর্তমানের গৌতমী আমার মাসীমাতা। চিরপ্রভাদেবী ছিল রাহুল মাতা যশোধরা। পদুম কুজা দাসী ছিল উৎপলবর্ণ থেরী, মনিকাক্ষ অশ্বরাজ বর্তমানের কন্থক অশ্ব, অঞ্জনাবতী যক্ষিনী বর্তমানের অজপাল যক্ষিনী, করেনুবতী বর্তমানের সুন্দরী ভিক্ষুণী। কান্তার যক্ষ বর্তমানের সাতগিরি যক্ষ। আমিই ছিলাম সপ্তধনু রাজা।” এ জাতক সবাই সুন্দর রূপে ধারণ কর।
(সপ্তধনু জাতক সমাপ্ত।)।
২য় দশক জাতক পঞ্চাশক সমাপ্ত।
Leave a Reply