১৯. শ্রী বিপুল কীর্তি রাজ জাতক
“এ সেনাগণ আস্ছে” শাস্তা এ ধর্মদেশনা জেতবনে অবস্থানকালে জনৈক পিতৃ-মাতৃ পোষক ভিক্ষু সম্পর্কে বলেছিলেন।
তখন উক্ত ভিক্ষু প্রত্যহ পিণ্ডচরণ করে যা অন্ন-ব্যঞ্জনাদি খাদ্যভোজ্য লাভ করতেন, তা পিতা-মাতাকে প্রদান করে পুনরায় আরো কিছু সংগ্রহ করবার ইচ্ছায় পিণ্ডাচরণ মানসে দ্বিতীয়বার গ্রামে প্রবেশ করতেন। খাদ্য ভোজ্য যা পেতেন, তাও পিতা-মাতাকে পরিবেশন করার পর যা অবশিষ্ট থাক্ত, তা মাত্র নিজে ভোজন করতেন। এ নিয়মে তিনি প্রত্যহ পিতামাতার সেবা করতেন। নিজের লব্ধ খাবার, পিণ্ডপাত, বর্ষাবাসিক খাদ্য বস্তু এবং আরো অন্যান্য বস্তু পিতা-মাতাকে দিতেন। এরূপে পিতা-মাতা পোষণের জন্য বহু উৎসাহ, প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে ক্ৰমশঃ তিনি কৃষ ও পাণ্ডু বর্ণ হলেন। তখন তার সুপরিচিত কয়েকজন ভিক্ষু তাকে দেখে তার এরূপ। স্বাস্থ্যহানির কারণ জিজ্ঞেস্ করলেন–। তখন প্রত্যুত্তরে তিনি। বললেন–“বন্ধো, আমার তেমন কোন ব্যাধি নেই। আমার। পিতা-মাতার পোষণের জন্য আমাকে বহু পরিশ্রম করতে হয়। এটাই আমার শরীর কৃশ হওয়ার কারণ। ইহা শুনে ভিক্ষুগণ বললেন–“বন্ধো দায়কদের শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু বিনষ্ট করা উচিত নয়। তা গৃহীকে দিয়ে বড়ই অন্যায় করছ।” ভিক্ষুদের এসব কথা শুনে তিনি অতিশয় লজ্জিত হয়ে শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে অগোপন করলেন। তখন ঐ ভিক্ষুগণ ভগবানের নিকট গিয়ে বললেন–“ভন্তে, অমুক ভিক্ষু গৃহীদের পোষণ করে শ্রদ্ধা প্রদত্ত বস্তু বিনষ্ট করছে।” তখন ভগবান উক্ত ভিক্ষুকে ডেকে জিজ্ঞেস্ করলেন–“সত্যই কি তুমি গৃহী পোষণ করছ?” ভিক্ষু বললেন–“হাঁ ভন্তে।” বুদ্ধ পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন–“সেই গৃহী তোমার কি হয়?” ভিক্ষু বললেন–“ভন্তে, তারা আমার পিতা-মাতা।” তা শুনে শাস্তা তাঁর উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য প্রশংসা করে বললেন–সাধু সাধু ভিক্ষু, তুমি আমার পূর্বাচরিত পথই অবলম্বন করছ। পিতা-মাতা পোষণকারীগণ পণ্ডিতবংশ’ বলে কথিত হয়। পুরাতন পণ্ডিতেরা পিতা-মাতার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন।” এবলে তিনি নীরব হলে, ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি পুনঃ নিজের অতীত ঘটনা বলতে আরম্ভ করলেন–
ভিক্ষুগণ, অতীতে চম্পা নগরে ‘যশঃকীর্তি’ নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর ঘোড়ষ সহস্র রাণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা রাণী শ্রীমতি দেবী ছিলেন অগ্রমহিষী। রাজা রাজধর্ম রক্ষা করে রাজত্ব করতেন বটে, কিন্তু তার কোনও পুত্র-কন্যা ছিল না। তাই একদা অমাত্যগণ ও নগরবাসী রাজাঙ্গণে একত্রিত হয়ে তাঁকে বললেন–“মহারাজ, আপনার অবর্তমানে এ রাজ্য বিনষ্ট হবে, যেহেতু আপনি অপুত্রক। তা শুনে রাজা প্রশ্ন করলেনতা হলে এখন আমাকে কি করতে হবে? তখন সবাই বললেন–“দেব, আপনি এখন পুত্র প্রার্থনা করুন।” রাজা বললেন–সাধু, তোমরা তজ্জন্য চিন্তা করোনা। এখন আমার মহিষীরা পুত্র প্রার্থনা করবে।” এ বলে রাজা সকলকে আশ্বাস দিয়ে অগ্রমহিষী প্রমুখ ঘষাড়শ সহস্র নারীকে বললেন–“এখন তোমরা প্রত্যেকেই পুত্র প্রার্থনা কর।” তা শুনে রাণীগণ চন্দ্র সূর্য ও অন্যান্য দেবতাদের বহু পূজা-সল্কার করে পুত্র প্রার্থনা করলেন বটে, কিন্তু কোন ফল হলনা। তৎপর রাজা শ্রীমতি দেবীকে বললেন–“ভদ্রে তুমি পুত্র প্রার্থনা করেছ কি? দেবী বললেন– “মহারাজ, আগামীকল্য উপোসথ শীল অধিষ্ঠান করে। পুত্র প্রার্থনা করব।” পরদিন দেবী প্রান্তুোনের পর ভোজন করে নীচাসনে উপবেশন করলেন এবং উপোসথ শীল অধিষ্ঠান করে পুত্র লাভের জন্য করজোড়ে এরূপ প্রার্থনা করলেন–“যদি অদ্য আমার অখণ্ড, সুবিশুদ্ধ উপোসথ শীল পালন করা হয়, তা হলে এ শীল পালন জনিত পুণ্যের প্রভাবে আমার জঠরে পুত্র উৎপন্ন হোক।” সেক্ষণেই প্রধানা মহিষীর শীলতেজানুভাবে দেবরাজের ভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দেবরাজ তখন চিন্তা করে জানতে পারলেন–“অদ্য শ্রীমতি দেবী পুত্র প্রার্থনা করেছেন। তাঁকে এক পুত্র দান করবো।” এ চিন্তা করে তার উপযুক্ত পুত্র নির্বাচন মানসে উৰ্দ্ধতন দেবলোকের সত্ত্বদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ। করলেন। তাঁর দিব্য দৃষ্টি-জালে পতিত হলেন পরিক্ষীণ আয়ু সম্পন্ন এক দেবতা, যিনি বোধিসত্ত্ব। তখন দেবরাজ উক্ত দেবতার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–“হে মারিষ, আপনি। মনুষ্য লোকের চম্পানগরে যশঃকীর্তি রাজার অগ্রমহিষী শ্রীমতি দেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করুন।” তা শুনে বোধিসত্ত্ব সাধুবলে সম্মত হলেন। তখন শ্রীমতি দেবী এরূপ এক স্বপ্ন দেখলেন–“সর্ব লক্ষণ সম্পন্ন এক তাপস বিপুল পর্বত হতে আকাশ পথে এসে নানাবিধ রত্ন রাণীর হস্তে প্রদান করলেন।” দেবী হঠাৎ নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে স্বপ্নের কথা রাজাকে বললেন–। রাজা স্বপ্নতত্ত্বে অভিজ্ঞ এক ব্রাহ্মণকে আহ্বান করে উক্ত স্বপ্নের ভাবীফল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন–। তখন ব্রাহ্মণ বললেন–“মহারাজ, এ স্বপ্নের দ্বারা বুঝা যায়, আপনি ধন্যপুণ্য লক্ষণ সম্পন্ন এক পুত্র লাভ করবেন।” তৎকালে শ্রীমতি দেবীর জঠরে বজ্র পরিপূর্তির ন্যায় হয়েছিল। দেবী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, তা জ্ঞাত হয়ে, সে বিষয় রাজাকে জানালেন। রাজাও সে গর্ভ যাতে নিরাময়ে ও সুষ্ঠুরূপে রক্ষিত হয়, সে ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন অপর এক রাজ্যের রাজমাত্যগণ তাদের রাজাকে বললেন–“মহারাজ, চম্পানগরের যশঃকীর্তি রাজা অপুত্রক। তিনি বড়ই ধার্মিক।” সে রাজা তা শুনে লাভের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে, লোভ-তৃষ্ণায় অভিভূত হয়ে চম্পা নগর নিজের আয়ত্বে আনবার ইচ্ছায় প্রশ্ন করলেন–“অমাত্যগণ, উক্ত চম্পানগর সম্বন্ধে কিরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা আমাদের প্রয়োজন?” তখন তাহারা বললেন–“মহারাজ, যশঃকীর্তি রাজা সকল সময় শীল রক্ষা করেন। প্রাণান্তেও শীল লঙ্ন করেন না। সুতরাং এখন মক্ষিকাবিহীন মধুপূর্ণ মৌচাকের ন্যায় সে চম্পা নগর অধিকার করতে আমাদের কোনই কষ্ট হবে না।” লব্ধ রাজা অমাত্যদের এ ভরসা পেয়ে চতুরঙ্গ সেনা পরিবৃত হয়ে চম্পা নগরের প্রান্ত সীমার সমীপবর্তী হলেন। সেখান হতে তাঁরা যশঃকীর্তি রাজার নিকট এ বলে এক দূত পাঠালেন“রাজা যশঃকীর্তি, আপনি যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ করবার ইচ্ছুক হন, তবে এখানে এসে আমাদের সাথে যুদ্ধ করুন।” দূত মুখে একথা শুনে চম্পা রাজের অমাত্য ও সহস্র সুরযোদ্ধাগণ ক্রোধাভিভূত হয়ে প্রহারদা’ নামক ভীষণ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজার নিকট উপস্থিত হলেন এবং রাজার সাথে যুদ্ধ করবার ইচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১। “আপনার শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য এসব সৈন্যসামন্ত এসেছে। হে রথার্ষভ, আপনার জন্য আমরা জীবন ত্যাগ করব।” ইহা শুনে চম্পকাধিপতি তাদের নিবারণ করার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২। “তাদের সাথে (তোমরা) অনর্থক যুদ্ধ করোনা। হে সৈন্যগণ, আমার জন্য তোমরা কিঞ্চিৎ পাপও করোনা।” এ বলে পুনঃ রাজা নিষেধ করার কারণে মনে দুঃখ না করবার জন্য নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন—
৩। “তোমরা তাদের সাথে বাক্য-যুদ্ধও করোনা। তাদের সহিত বিবাদ, প্রহার ও যুদ্ধ করে পাপ সঞ্চয় করোনা।” এ বলে রাজা পুনঃ উপদেশ দানেচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
৪-৫। “হে হিতৈষী অমাত্যবৃন্দ, বিপক্ষীয় সেনাগণ আমার নিকট উপস্থিত হবার জন্য তোমরা সবাই মৈত্রী চিন্তা কর। সে সব যোদ্ধাদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ করো না। এখানে তোমরা সবাই অন্ন পানীয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে স্বীয় স্বীয় নগরে চলে যাও।” তাদের এরূপ উপদেশ দিয়ে রাজা একাকীই শ্রীমতি দেবীর সাথে স্বীয় প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন এবং পালঙ্কে উপবেশন। করে দেবীকে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৬-৭। “ভদ্রে, আমি অরণ্যে গিয়ে প্রব্রজিত হব। আমার জন্য অনুশোচনা করো না। তোমার জঠরে যে সন্তান আছে, তা সুষ্ঠুরূপে রক্ষা কর। ভদ্রে, সে সন্তান কন্যা কি ছেলে তা জানি না।” ইহা শুনে দেবী শোকাকুলা হয়ে সাশ্রু নয়নে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৮। মহারাজ আপনার একাকী বনে গমন শোভনীয় নয়। আমিও আপনার সঙ্গে গমনেচ্ছা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায় বললেন–
৯-১৪। “হে রথাভ, আপনি বনে গেলে এখানে আমি আপনাকে ছেড়ে কিরূপে জীবন ধারণ করব? সুতরাং আমিও আপনার সাথে বনে যাব। জীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ গাভী যেমন একাকিনী হয়ে চিরকালই দুঃখের ভাগিনী হয়, আমিও সেরূপ স্বামী হীনা হয়ে চিরকালই দুঃখিনী হব। যেমন আরণ্যিক হস্তীরাজ দুরারোহ পর্বতে ও সমবিসম স্থানে গমন কালে হস্তিনীকে সঙ্গে নিয়ে যায়, মহারাজ, আমিও সেরূপ আপনার সাথে গমন করব। আপনার সঙ্গহীনা হয়ে আমি রাজত্ব সুখ ও ইচ্ছা করিনা। হে রাজন, আপনি প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু সমাকুল বনে গমন কালে আমিও আপনার পশ্চাদানুগমন করব। কিন্তু আপনার বোঝা স্বরূপ হব না। আপনার নিকটই আমার মৃত্যু হবে। জীবদ্দশায় আপনার সাথেই থাকব। আপনার নিকটই আমার মৃত্যু হওয়া বাঞ্ছনীয়। হে রাজন, আপনার নিকট হতে বিচ্ছেদ হয়ে আমার জীবনের ইচ্ছা করি না।”
রাজা অগত্যা দেবীর কথায় সম্মত হয়ে উভয়ে ছদ্মবেশে চম্পানগর হতে বের হলেন। তাঁরা ক্রমান্বয়ে বৈপুল্য পর্বতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তথায় এক মনোরম স্থানে কোনও ঋষির পরিত্যক্ত একখানা আশ্রম ছিল। রাজা ও রানী সেই আশ্রমখানা সংস্কার করে তথায় ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতঃ বাস করতে লাগলেন। তখন তাঁরা উভয়ে পথব্রত চর্যায় ব্রতী হয়ে অবস্থান করার সময় শ্রীমতি দেবী রাজাকে বললেন–“মহারাজ ফল-মূল আহরনের জন্য আপনি বনে যাবেন না। আমি তা সর্বদা সংগ্রহ করে এনে আপনার সেবা করব।” রাজা রাণীর কথায় সম্মত হলেন। তৎপর হতে শ্রীমতি দেবী দিবারাত্র ব্রত প্রতি সম্পাদন করে তথায় বাস করতে লাগলেন। রাণীর শীল ব্ৰতাচরণ দেখে রাজা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং নিন্মোক্ত প্রীতি গাথায় রাণীকে বললেন–
১৫-১৬। আমরা শীত আচরণ করে বনে বাস করছি। রাজ্য ত্যাগ করে যে দুঃখ বরণ করছি, তা এখন দুঃখ বলে মনে করি না। শত্রু রাজ্যের উপদ্রবে আমরা রাজ্য ত্যাগ করছি। এ কারণে আমরা নিরয়ে না গিয়ে স্বর্গেই গমন করব।”
এ দিকে উক্ত বিপক্ষীয় কুটিল ও লোভী রাজা চম্পানগর লুণ্ঠন করে রাজ-গৃহে প্রবেশ করল এবং যশঃকীর্তি রাজাকে অনেক অন্বেষণ করল। তাঁকে কোথাও না পেয়ে তিনি যে পলায়ন করেছেন তা বুঝতে পারল। তখন নগরে ভেরী শব্দে ঘোষণা করা হল “যে ব্যক্তি যশঃকীর্তি রাজার মস্তক এনে দেবে, সে লক্ষ মুদ্রা পুরস্কার পাবে।” পরে আরো ঘোষণা করল, “যারা উক্ত রাজার মস্তক এনে দেবে, তাদের বিশেষভাবে মর্যাদা দেওয়া যাবে।” এ বলে নানা স্থানে বহু লোক নিযুক্ত করা হল। দুষ্টবুদ্ধি পরায়ন রাজার এ ঘোষণা শুনে চম্পানগরবাসী এক বনচর লোভের বশবর্তী হয়ে যশঃকীর্তি রাজাকে অন্বেষণ করার মানসে বের হল। সে নানা দিকে পরিভ্রমনান্তর অরণ্যে প্রবেশ করল। তথায় সাতদিন যাবৎ অন্বেষণ করার পর পরিশেষে দিভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। তৎপর পথশ্রমে ও খাদ্যাভাবে কাতর হয়ে অসহ্যে দুঃখে চীৎকার করে রোদন করতে লাগল। এরূপে রোরুদ্যমান অবস্থান রাজর্ষির আশ্রমের নিকটবর্তী হল। রাজর্ষি তাকে দেখে বুঝতে পারলেনসে পথভ্রষ্ট হয়েছে। তখন তিনি তাকে নিজের আশ্রমে এনে বন্য ফল-মূলাদি খেতে দিলেন। সে তথায় ফল-মূলাদি খেয়ে সাতদিন অবস্থান করে এ আশ্রম স্থান ও গমনাগমনের পথ ইত্যাদি সব কিছুই পরিচয় করে নিল। তারপর চম্পানগরে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা রাজার নিকট ব্যক্ত করল। রাজা তার দেশে প্রত্যাবর্তনের কথা অনুমোদন করে বললেন–“এ পথ দিয়ে তুমি দেশে যাও। তবে আমি যে এখানে আছি, তা কাউকে ও বলবে না।” বনচর ও “হা দেব” বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চম্পানগরের দিকে যাত্রা করল। পথি পার্শ্বে বৃক্ষ-লতা পাষাণ ইত্যাদি চিহ্ন স্মৃতি পটে অঙ্কিত করে ক্রমান্বয়ে চম্পানগরে উপস্থিত হল। সে অকৃতজ্ঞ পাপ পুরুষ উপকারীর উপকার বিধ্বংসী নরাধমের অন্তরে রাজার নিষেধ বানীটি পদ্ম পত্রে অতিষ্ঠ শীল জল বিন্দুবৎ হল। মরণভয়ে ভীত হয়ে যার নিকট সাতদিন যাবৎ প্রিয় সম্ভাষায় সুখে অবস্থান করেছিল, তা লোভবশে বিস্মৃত হয়ে গেল। লক্ষ সুবর্ণ মুদ্রার লোভে পররাজ্য লুণ্ঠণকারী রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল–“মহারাজ আমিই যশঃকীর্তি রাজার বর্তমান বাসস্থান সম্বন্ধে জ্ঞাত আছি।” ইহা শুনে পাপ রাজা পাপিষ্ঠ ব্যাধকে লক্ষ মুদ্রা পুরস্কার দিয়ে চতুরঙ্গ সেনাসহ ব্যাধকে পথ প্রদর্শক রূপে সঙ্গে লয়ে অনুক্রমে অরণ্যে প্রবেশ করল এবং বিপুল পর্বতে রাজর্ষির বাসস্থানের সমীপবর্তী হল। তিনি সেনাদের কোলাহল শুনে সচকিতে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন, এসব তাঁর শত্রু। তিনি তখন শ্রীমতি দেবীকে বললেন–“ভদ্রে, ঐ ব্যাধ চম্পানগরে গিয়ে নিশ্চয়ই শত্রু রাজাকে আমাদের বাসস্থান জানিয়ে দিয়েছে। ভদ্রে, অদ্যই আমাদের বিচ্ছেদ হতে হবে। তুমি এখানেই বাস করে অপ্রমাদের সহিত তোমার গর্ভস্থ সন্তান রক্ষা কর। দেবী ইহা শুনে বললেন–“মহারাজ, এখন আপনি কোথায় যাবেন?” তদুত্তরে রাজা নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৭। “ভদ্রে, লব্ধ রাজা এখানে এসেছে। এ কম্বল ও অঙ্গুরীয়ক সহ আমার পুত্রকে রক্ষা করবে।” দেবী রাজার এ বাক্য শুনে হৃদয় বিদারক দুঃখে রোদন পায়না হয়ে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
১৮-১৯। “দেব, আপনার পাদপদ্মে বন্দনা করছি। আমাকে এ মহারণ্যে একাকিনী ত্যাগ করে যাবেন কি? আমার জীবন এখন বড় ভয়াকুল। এ ভয়াবহ নির্জন গহন বনেই এ অনাথিনীর নিশ্চয়ই মৃত্যু হবে। দেব আপনি অনুকম্পা পরবশ হয়ে আমার কৃত সর্বদোষ ক্ষমা করবেন। ইহা আমার শেষ বন্দনা ও শেষ প্রার্থনা।”
এরূপে দেবী স্বামীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও বন্দনা করে বিদায় দিলেন। রাজা রোদন পরায়না পত্নীর নিকট হতে বিদায় নিয়ে ঐ সেনাদের কোলাহলের দিকে নির্ভীক চিত্তে অগ্রসর হলেন। দেবীও রাজার পশ্চাৎ কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে রাজার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলেন। রাজা যখন দৃষ্টি পথের বাহিরে গেলেন, তখন দেবী সাশ্রু নেত্রে আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন যশঃকীর্তি রাজাও চোর রাজার সেনাগণকে দেখে কেশরী। সিংহের ন্যায় নির্ভীক চিত্তে বিপুল পর্বত হতে অবতরণ করে শত্রু সেনাদের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। তখন সেনাগণ তাদের রাজাকে বলল–“মহারাজ, এ যশঃকীর্তি রাজা মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে প্রব্রজিত বেশ ধারণ করে এখানে এসেছে।” দুল্লা রাজা তখনি তাঁকে বন্ধন করার আদেশ দিল। তখন নিরপরাধী রাজাকে সহস্র সেনাগণ বন্ধন করল। পাপিষ্ট রাজার কোন কোন অমাত্য “হে ভণ্ড প্রব্রজিত” ইত্যাদি দুর্বাক্য বর্ষণ করে তাঁকে দৃঢ় হস্তে প্রহার করল আর কোন কোন অমাত্য ও সেনাগণ ক্রোধাভিভূত হয়ে তাঁর পৃষ্ঠে সহস্র বেত্রাঘাত করল। তত্যলে পৃষ্ঠদেশ বিদীর্ণ হয়ে রক্ত নিঃসৃত হতে লাগল। তৎপর সেনাগণ তাঁকে পঞ্চ বন্ধনে বন্ধন করে চম্পানগরে এনে কারাগারে আবদ্ধ করে রাখল। এদিকে শ্রীমতি দেবী দশমাস পর বিপুল পর্বত আশ্রমে এক গভীর রাত্রে সুবর্ণ বর্ণ এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। দেবী শিশুকে বক্ষে ধারণ করলেন। অপত্য হেবশে সদ্যজাত শিশুর শির চুম্বন করে অনাথ ভাবে বিলাপ পরায়না হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় যোগে বললেন–।
২০-২২। হায় হায় তাত, এ মহাঅরণ্যে তোমাকে এখন শুভ পুত্র রূপে লাভ করলাম। এখানে তোমার পিতা নেই। তুমি অল্প পুণ্যবান। যেহেতু–তুমি স্বীয় রাজ্যে ভূমিষ্ট হতে পারনি। অদ্য রাত্রে একাকী তোমার জন্য কি করতে পারি? যদি তুমি রাজ প্রাসাদে ভূমিষ্ঠ হতে, তাহলে তথায় মনোজ্ঞ সেবা-যত্ন লাভ করতে। এখন আমি অগ্নি ও ইন্দন পাচ্ছি না, আমি খাদ্য সগ্রহ করতে ও অসমর্থ। এখানে তোমার পিতা ও তোমার মুখকমল দেখলেন না।”
এরূপে দেবী কান্না ও বিলাপ করার পর পুত্রকে স্বীয় বক্ষে লয়ে রাত্রি অতিক্রম করলেন। প্রভাত হওয়ার পর দেবী শিশুর প্রাথমিক কার্য সম্পাদনের পর স্তন্য দানে রত হলেন। তখন চিন্তা করলেন–“পুত্রের কি নাম রাখা হবে?” চিন্তা করে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন–“পুত্রের নামে যেন মাতার নাম, পিতার নাম এবং পর্বতের নাম জড়িত থাকে। তাই শ্রীমতি দেবীর নাম হতে ‘শ্রী বিপুল পর্বতের নাম হতে ‘বিপুল’ এবং যশঃ কীর্তির নাম হতে ‘কীর্তি’ এ শব্দ তিনটির সংযোগে প্রিয়পুত্রের নাম রাখলেন “শ্রী বিপুল কীর্তি কুমার।” কুমার অনুক্রমে পৰ্বত অরণ্যেই বৃদ্ধি ও বুদ্ধি প্রাপ্ত হতে লাগলেন। শ্রীমতি দেবী একরাত্রে স্বপ্ন যোগে দেখলেন স্বামী তার সঙ্গে আলাপ ও হাস্য করছেন।” দেবী দ্রিা হতে জাগ্রত হয়ে শয্যায় বসে স্বামীকে স্মরণ করে নিন্মোক্ত ছয়টি বিলাপ গাথা বললেন–
২৩-২৮। আমি পূর্বজন্মে পাপকর্ম করেছি। তার বিপাক স্বরূপ আমি এ দুঃখ ভোগ করছি। বহুদিন যাবৎ রাজাকে দেখছিনা। অদ্য স্বপ্নেই তার মুখ দেখলাম মাত্র। এখন আমি নিদ্রা হতে জেগে রাজাকে দেখছিনা। এখানে বিবিধ প্রকার অশান্তি ও শোকই আমার একমাত্র সম্বল। আমি পূর্বে অপরের নিশ্চয়ই বিয়োগ দুঃখের কারণ হয়েছিলাম। সে দোষেই আমি এখন প্রিয় পতির দর্শন লাভে বঞ্চিতা। যেমন পূর্বে পাপ ইচ্ছা নিয়ে অকুশল কর্ম করেছি, সেরূপ তার ফল স্বরূপ এ বনে আমার পতির দর্শনে বঞ্চিতা। পূর্বজন্মে আমি অপরের বিচ্ছেদের কারণ হয়েছিলাম, সে কর্মের বিপাকেই আমার স্বামী হতে বিচ্ছেদ হয়ে পড়েছি। কোনও পূর্ব জন্মে জগতে কোন শীলবান বহুশ্রুত শ্ৰমণ ব্রাহ্মণকে বিভেদ করে দিয়েছিলাম, সে কর্ম দোষেই স্বামী হতে আমি বিচ্ছেদ হয়ে পড়েছি, তার দর্শন। পাচ্ছিনা।”
বোধিসত্ত্ব মাতার এরূপ বিলাপ শব্দ শুনে তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বিলাপের কারণ নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞেস্ করলেন–
২৯। “মাত, আপনি কেন রোদন করছেন? আমি আপনার অমনোজ্ঞ কোন দোষ করেছি কি? মাতঃ, তা আমাকে বলুন” ইহা শুনে মাতা নিতাক্ত গাথায় বললেন–
৩০। “বাবা, পূর্বে আমি স্বামী সহ সর্বদা বনে বিচরণ করেছি। এখন আমি স্বামী হীনা হয়েই রোদন করছি।
ইহা শুনে মহাসত্ব পুনঃ স্বীয় মাতাকে বললেন–মাতঃ, আপনি কি কারণে রোদন করছেন, তা যথাযথ ভাবে বলুন। তখন শ্রীমতি দেবী পূর্ব বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলেন–“চম্পক রাজ্য আক্রমনের জন্য কূট রাজার আগমন, রাজা সহ নিজের পলায়ন, রাজ্য আক্রমনার্থ কুটিল রাজার সসৈন্যে এবনে আগমন, এখান হতে পুনঃ রাজার পলায়ন ইত্যাদি বিবরণ যথাযথ ভাবে বর্ণনা করে বললেন–“তোমার পিতা এখান হতে পলায়ন কালে চোর রাজার নির্দেশ ক্রমে তার সেনারা তাঁকে বন্ধন করে চম্পা রাজ্যে নিয়ে গিয়ে কারাগারে তাঁকে আবদ্ধ করে রেখেছে। তারপর হতে তিনি জীবিত আছেন কি না, এর কিছুই জানি না। আমি অদ্য রাত্রিতে তোমার পিতাকে স্বপ্নযোগে দেখেছি। তাই তাঁর দুঃখের কথা আমার চিত্তে উদিত হওয়ায় এরূপ রোদন করছি।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব মর্মান্তিক দুঃখানুভব করলেন। তখন তাঁর চিত্তে এরূপ ভাবের উদয় হল“আমার জীবিতাবস্থায় পিতাকে নষ্ট হতে দেব না। এখন আমার পিতা কোথায় আছেন, এ খবর আমি কোথায় কি প্রকারে পাব? অহো, আমি এত কাল যাবৎ প্রমাদিত ছিলাম। আমার পিতা-মাতার অরণ্য বাসের কারণ আমি জানি না। এখন আমার পিতাকে অন্বেষণ করব।” এ চিন্তা করে মাতার অনুমতি লাভের ইচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথায় মাতাকে বললেন–
৩১। “মাতঃ, পিতাকে আমি অন্বেষণ করতে যাব। এতে আপনার অনুমতি চাই। আমি বর্তমান থাকতে আমার পিতা বিনাশ না হোক” ইহা শুনে দেবী প্রিয় পুত্রকে নিবারণ করার মানসে নিন্মোক্ত গাথায় যোগে বললেন–
৩২-৩৪। “আমি এখন বনবাসিনী অনাথিনী। এখন তুমি কোথাও যেওনা। তোমার বিচ্ছেদ আমি সহ্য করতে পারব না। হে প্রিয়পুত্র, তোমার পিতার খোঁজে তুমি যেওনা। তোমরা উভয়ের অদর্শনে আমার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। তাত, তুমি যদি অদ্য এ বনে আমাকে ত্যাগ করে চলে যাও, তোমার অদর্শনে নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু হবে।” মহাসত্ত্ব মাতার এসব কথা শুনে চিন্তা করলেন–“মহাগুরু পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্য পালন করতে হবে। পিতার যদি কোনও উপকার করতে না পারি, তবে আমার এ জীবনের কি প্রয়োজন? অন্ততঃ তিনি জীবিত আছেন কিনা–সে খবরটা হলেও জানা প্রয়োজন।” এ চিন্তা করে পিতার অন্বেষণ করবার জন্য মাতার নিকট বারবার প্রার্থনা জানালেন। তখন দেবী পুত্রকে বারণ করতে না পেরে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩৫। “তোমার পিতার সম্পদ এ বজির অঙ্গুরীয়ক ও কম্বলখানা নিয়ে তোমার পিতাকে অন্বেষণ করতে যাও। এতেই তোমার নিরাপদ হবে।”
তখন তরুণ তাপস মহাসত্ব মাতার নিকট হতে বজ্র অঙ্গুরীয়ক ও কম্বলখানা লয়ে মাতাকে প্রদক্ষিণ এবং পঞ্চাঙ্গ লুটায়ে বন্দনান্তর হিমালয়ের বিপুল পর্বত হতে অবতরণ করলেন। তিনি হিমালয়ের মহারণ্য হতে বের হয়ে ক্রমান্বয়ে চম্পানগরের বর্হিদ্বার সমীপস্থ এক ধর্মশালায় একরাত্রি বাস করলেন। এদিকে সে রাত্রির অবসানে অতি প্রত্যুষে কূটবুদ্ধি পরায়ণ রাজা শয্যায় বসে চিন্তা করল–“এ সম্পত্তির অধিকারী যশঃকীর্তি রাজা যদি স্বপক্ষীয় লোক লাভ করে, তা হলে সে নিশ্চয়ই আমাকে আক্রমণ করে হত্যা করবে। সুতরাং অদ্য প্রাতেই তার শিরচ্ছেদ করাব।” যখন প্রভাত হল, তখন ঘাতককে আহ্বান করে বলল–“হে ঘাতক, তুমি যশঃকীর্তি রাজাকে চারপথের সংযোগ স্থলে নিয়ে গিয়ে তার পৃষ্ঠে সহস্র বেত্রাঘাত কর। তারপর তাকে বধ্যস্থানে নিয়ে শিরচ্ছেদ কর।” আদেশ মাত্র ঘাতক অতি তুষ্ট চিত্তে “হাঁ মহারাজ,” বলে সম্মতি দান করল। সে সময় কুমার শয্যা ত্যাগ করে শরীরকৃত্য সমাপণের পর পিতৃ অন্বেষণে চম্পানগরে প্রবেশ করলেন।
তথায় কারাগারে দুঃখগ্রস্ত নিরপরাধী পিতাকে শায়িতাবস্থায় দেখে কারাগার রক্ষীকে জিজ্ঞেস্ করলেন–“এ ব্যক্তি কে?” কারাগার রক্ষী তরুণ তাপসের বাক্য শুনে বলল–“তাপসবর, তিনি এ নগরের ভূতপূর্ব রাজা। কিন্তু এখন তিনি কারাবন্দী। বোধিসত্ত্ব এসব কথা শুনে বুঝতে পারলেন–বন্দী দশাপ্রাপ্ত এ দুঃখী জনই তাঁর পিতা। তখন এ পুণ্য পুরুষ তরুণ তাপসের দেহে সপ্ত হস্তীর শক্তি বিদ্যমান ছিল। তিনি চিন্তা করলেন“আমি নিজের দৈহিক শক্তিতে এ নগর বিধ্বংস করতে পারি বটে, কিন্তু ইহাতে আমার শীল ভঙ্গ হবে। সুতরাং আমি শীল লঙ্ঘন করবনা। এখন যদি আমি আমার তাপস-শীল ভগ্ন করি, তা হলে অনাগতে আমি চিরকালের মহাপ্রতিষ্ঠা সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রাপ্ত হবনা।” মহাসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করে নিজের পিতার অসহ্য দুঃখ দেখে হৃদয়ে মর্মান্তিক দুঃখ ও শোক উৎপন্ন হল। সে শোক-শল্যে বিদ্ধ হয়ে তথায় তখনই সংজ্ঞা শূন্য হয়ে ভূশায়ী হলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি সংজ্ঞা লাভ করে অতিকষ্টে পিতার নিকট উপস্থিত হয়ে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে পিতাকে বন্দনা করে দাঁড়ালেন। এ দৃশ্য দেখে তথায় উপস্থিত জনগণ বলল“অহো, দেখ এ রাজার কোন পুত্র কন্যা নেই। এ তাপস এ বন্দী রাজাকে বন্দনা করে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বোধ হয় ইনি সম্বন্ধে এর কিছু হতে পারেন।” জনগণের আলোচনা শুনে তিনি যে বন্দী রাজার পুত্র হন, সে বিষয় প্রকাশ করবার মানসে পিতাকে সম্বোধন করে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
৩৬। “বাবা, আমি আপনার পুত্র। পরিচয় করবার জন্য আমি এখানে এসেছি। আপনার মুক্তির জন্য আমার প্রাণ ত্যাগ করব।” রাজা মহাসত্বের এরূপ কথা শুনে, তাঁকে স্বীয় পুত্র বলে মনে করলেন। তবুও তিনি নিজে গাথা যোগে বললেন–।
৩৭। “বাবা, তুমি কার পুত্র? তুমি কোথা হতে এসেছ? তুমি আমার অনুজ বলে পরিচয় দিচ্ছ। আমার এ জিজ্ঞাসিত বিষয়গুলি খুলে বল।” তখন বোধিসত্ত্ব রাজাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩৮। “বাবা, আমি আপনার নিকট এসেছি। যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তবে আপনার কম্বল ও বজ্র অঙ্গুরীয়ক দেখুন।” রাজা এ চিহ্নদ্বয় দেখে, ইনি যে তাঁর পুত্র, সম্যক অবগত হয়ে নিজে গাথা যোগে বললেন–
৩৯। বাবা, আমি এখন জীর্ণ শীর্ণ দুর্বল হয়েছি। তুমি শক্তিশালী বালক। সুতরাং তুমি এখানে জীবন ত্যাগ কেন করবে?” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৪০। “এখানে আমার সম্মুখে আপনার মৃত্যু হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সুতরাং আমার সম্মুখে আপনার জীবন ত্যাগ করেন, তা কখনো সমীচীন মনে করি না।” ইহা শুনে যশঃকীর্তি রাজা নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
৪১। “তুমি তোমার মাতাকে ত্যাগ করবেনা। বরঞ্চ আমাকেই ত্যাগ কর। আমার বাক্য রক্ষা কর। তোমার মাতার নিকট চলে যাও।” বোধিসত্ত্ব ইহা শুনে নিন্মোক্ত তিনটি গাথাযোগে বললেন–
৪২-৪৪। “বাবা, আমি কেন পিতার দুঃখ মুক্তির চেষ্টা করবনা? আমি মাতৃ আদেশে এখানে এসেছি। জানবেন, আপনার মৃত্যুতে আমার মৃত্যু, আপনি জীবিত থাকলে আমিও জীবিত থাকব। আমার জীবিতাবস্থায় দুঃখগ্রস্ত পিতাকে ত্যাগ করবনা। আপনার সুখের জন্যই আমার জীবন দেব। ইহাতে দেবগণ ও আমার প্রশংসা করবেন এবং পরে স্বর্গে গিয়ে আনন্দিত হব।” রাজা প্রিয় পুত্রের এবম্বিধ দৃঢ় বাক্য শুনে, সাশ্রু নেত্রে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪৫। “হায় হায় বাবা, তুমি কূট রাজার নিকট যেওনা। এখানে এসে আমার জন্যে প্রাণ ত্যাগ করো না।” মহাসত্ত্ব ইহা শুনে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৪৬-৪৭। বাবা, আপনি রোদন করবেন না। এখন আমি সানন্দে উত্তম দান পরমার্থ দান–জীবন দান করব। অদ্য আমার এ জীবন দানের জন্য কোন চিন্তা করছিনা। এ দান একমাত্র বোধিজ্ঞান লাভের জন্য। বাবা, আমার জীবন দান আপনিও অনুমোদন করুন।” এরূপে মহাসত্ত্ব পিতার সঙ্গে এরূপ আলাপ করলেন। পিতার জন্যই জীবন ত্যাগ করে পরমার্থ পারমীর পূর্ণতা সাধন হবে, এ চিন্তা করে তার সৌমণস্য উৎপন্ন হল। এরূপ সৌমণস্য চিত্তভাব নিয়ে কেশরী সিংহের ন্যায় নির্ভীক চিত্তে কুচক্রী রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪৮-৪৯। “রাজন, আপনার নিকট আমার এ জীবন বিক্রি করতে এসেছি। অদ্য আমার এজীবন বিক্রয় লব্ধ মূল্যের বিনিময়ে আমার পিতার জীবন ক্রয় করব। আমি এখন তরুণ।। আমার পিতা জীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ। আপনি আমাকে গ্রহণ করে, আমার পিতাকে কারাগার হতে মুক্তি দিন।” ইহা শুনে কূট রাজা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় যোগে বললেন–
৫০-৫১। হে তরুণ তাপস, তোমার পিতার জীবন দানের জন্য কারাগার হতে তাকে মুক্তি দিলে, তৎ-পরিবর্তে তোমাকেই কারাগারে আবদ্ধ করা হবে। সুতরাং তোমার বিনিময়ে তোমার পিতা মুক্ত হয়ে যথেচ্ছা সুখে বাস করুক।” মহাসত্ত্ব দুরন্ত রাজার একথা শুনে “সাধু সাধু মহারাজ” বলে পিতার মুক্তির জন্য কারাগারে উপস্থিত হলেন। তথায় দেবগণকে এবিষয় জ্ঞাপনার্থ নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৫২-৫৩। পুণ্য ঋদ্ধি সম্পন্ন দেবগণ আপনারা সবাই আমার কথা শ্রবণ করুন। আমার জীবন ত্যাগ করে পিতাকে মুক্ত করছি। ভবিষ্যতে বোধিলাভের জন্যই পিতার উদ্দেশে আমার মস্তক, চক্ষু হৃদয় দেহ সমস্তই দিচ্ছি।
মহাসত্ত্ব এরূপে দেব বৃন্দকে বিজ্ঞাপিত করে পিতাকে কারাগার হতে মুক্ত করে বললেন–“পিতা আপনি এবার যথাসুখে বাস করুন।” এবলে তিনি কারাগারে আবদ্ধ হলেন। তখন দুর্বুদ্ধি পরায়ণ রাজার নির্দেশ প্রাপ্ত ঘাতক এসে মহাসত্ত্বকে পঞ্চবন্ধনে বেঁধে আমক শ্মশানে নিয়ে গেল। তথায় তাঁর গ্রীবাদেশ হতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে খড়ুগ উৎক্ষিপ্ত করল। তমুহূর্তে তাঁর শীল তেজানুপ্রভাবে উৎক্ষিপ্ত খড়গ চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ঘাতক এ আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে। সন্ত্রস্ত চিত্তে তখনই কূট রাজাকে এসে এবৃত্তান্ত জ্ঞাপন করল। পাপিষ্ঠ রাজা এ বিষয় দণ্ডাহত বিষধর সর্পের ন্যায় ক্রোধে গর্জন করে বলল–তাহলে তাকে মত্ত হস্তীর দ্বারা মর্দন করার জন্য শ্মশানে মত্তহস্তী ছেড়ে দাও।” ঘাতক তা করল। এবারও বোধিসত্ত্বের তেজানুভাবে মত্তহস্তী তাঁর সমীপস্থ হয়ে ক্রৌঞ্চনাদে পলায়ন করল। ঘাতক তখনই এব্যাপারেও রাজাকে জ্ঞাপন করল। রাজা পুনঃ আরো ক্রোধান্বিত হয়ে বলল–“তাকে সত্বর সজ্যোতিঃভূত প্রজ্জ্বলিত প্রকাণ্ড অঙ্গার গর্তে নিক্ষেপ কর।” ঘাতক তখনই তা করল। তৎক্ষণে বোধিসত্ত্বের শীলতেজে গো-শকট-চক্র প্রমাণ সহস্র দল বিশিষ্ট এক সোনার বরণ পদ্ম পৃথিবী ভেদ করে প্রজ্বলিত অঙ্গার রাশির উর্দ্ধে উখিত হল। এতে বোধিসত্ত্ব নিরাময়ে বসে আছেন। ঘাতক তা দেখে তাও কূট রাজাকে বলল–“মহারাজ, সে তাপস অগ্নি দ্বারা দগ্ধ না হয়ে তারকা রাজির মধ্যে পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় বিরোচিত হচ্ছে। কুট রাজা ইহা শুনে ততোধিক ক্রোধান্বিত হয়ে ঘাতককে বলল–“তাকে শীঘ্রই চোরপ্রপাতে নিক্ষেপ কর।” ঘাতক তাও করল। তত্মহূর্তে তার মৈত্রীর প্রভাবে নাগরাজ নাগভবন হতে এসে সুবৃহৎ পদ্মে তাকে গ্রহণ করে নাগলোকে নিয়ে গেলেন। তখন কুটরাজ নিরপরাধী মহাসত্ত্বের প্রতি পুনঃ পুনঃ দারুণ দণ্ডের আদেশ করে ও কোন ফল লাভ করতে না পেরে ক্রোধে অধীর হল। ক্রোধ সহ্য করতে না পেরে আসন হতে নেমে ভূতলে পাদ স্পর্শ মাত্রই পৃথিবী কূট রাজার পাপভার সহ্য করতে না পেরে দ্বিধা বিদীর্ণ হয়ে তাকে গ্রাস করল। অবীচী নরক হতে অগ্নিশিখা উখিত হয়ে পাপিষ্ঠ রাজা অবীচী নরকে নিপতিত মহা দুঃখ ভোগ করতে লাগল। নাগলোকে নাগরাজ বোধিসত্ত্বকে বিশেষভাবে পূজা-সল্কার করে তাকে সঙ্গে লয়ে চম্প নগরে উপস্থিত হলেন এবং তথায় তাকে রাজত্বে অভিষিক্ত করে নাগরাজ নাগভবনে চলে গেলেন সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৫৪-৫৫। তখন নাগরাজ মহাপুরুষকে নাগলোক হতে এনে দিব্যাভরণে মণ্ডিত করে দিব্যান্ন ভোজন করালেন। নাগরাজ তাঁকে এনে চম্পানগরে অভিষিক্ত করার পর তাঁর নিকট বিদায় নিয়ে নাগভবনে চলে গেলেন।”
তখন শ্রী বিপুল কীর্তি নিজের পিতার সাথে রাজ্যাভিষেক প্রাপ্ত হয়ে ধর্মতঃ রাজত্ব করতে লাগলেন। তখন বোধিসত্ত্ব মাতার গুণ স্মরণ করে তাঁকে আনবার ইচ্ছা পিতার নিকট প্রকাশ করলেন–। তখন পিতা-পুত্র বহু সৈন্য সামন্ত পরিবৃত হয়ে শ্রীমতি দেবীর বাসস্থানাভিমুখে যাত্রা করলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে অনুত্তর বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫৬। “শ্রীমতিকে আনবার জন্য উভয় ক্ষত্রিয় সসৈন্যে রাজ্য হতে বের হয়ে তাঁর আশ্রমের সমীপবর্তী হলেন।”
ইতি পূর্বে স্বামী ও পুত্রের বিচ্ছেদ দুঃখ অসহ্য হওয়াতে আশ্রমেই রাণী মৃত্যু বরণ করে ছিলেন। বোধিসত্ত্ব মাতৃ ভক্তির অপূর্ব আকর্ষণে পিতার পূর্বেই আশ্রম প্রাঙ্গণে এসে তথাকার অবস্থা নির্জনতা দেখে তাঁর সন্দেহ হল। তিনি পর্ণশালায় প্রবেশ করে তাঁর মাতার মৃতদেহ দেখে শোকবেগে কম্পিত কলেবরে “আমার মাতার মৃত্যু হয়েছে।” এবলে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন পরায়ণ হয়ে বিলাপ সুরে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৫৭। “মা-মা, আমি এসেছি, তোমার নিকট এসেছি।। মাগো, তুমি কোথায় গিয়েছ? হায় হায় মাতঃ কেন তুমি শুয়ে রয়েছ? মাগো, তুমি একাকিনী কোথায় গিয়েছ?” রাজা, তাঁর। সৈন্যগণ এবং অন্যান্য লোক তথাই উপস্থিত হয়ে সকলেই বহু রোদন করলেন। তখন মহাসত্ত্ব মাতার পূত শবদেহ স্বর্ণ খচিত থলিয়ায় আবদ্ধ করে রাজ শিবিকায় স্থাপন করে চম্পা নগরে এসে চিন্তা করলেন–“এখন আমার মাতার গুণের প্রতিগুণ দানের নিমিত্ত আমি জীবন ত্যাগ করব। অদ্য আমার মাতাকে। আমার বক্ষের উপর দগ্ধ করে অনাগতে সর্বজ্ঞতা, জ্ঞান লাভের উপায় করব।” মহাসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করে স্বীয় পিতার নিকট গিয়ে তাঁকে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করলেন। তারপর নিজের অনিত্য ও অসারতৃভাব উল্লেখ করে মাতার গুণ পরিশোধের জন্য স্বীয় জীবন পরিত্যাগের কথা পিতাকে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫৮। “হে রথার্ষভ, আপনার নিকট আমার বিনীত নিবেদন–আমি মাতার জন্য সজ্জিত চিতায় শয়ন করব। মাতার শবদেহ রক্ষিত সুবর্ণ থলিয়াটি আমার বক্ষোপরি রেখে দগ্ধ করবেন। মাতার সঙ্গেই আমার মৃত্যু বাঞ্ছনীয়।” যশঃকীর্তি রাজা প্রিয় পুত্রের এসব কথা শুনে তাঁকে আলিঙ্গন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫৯। “বাবা, তুমি এমন কর্ম করোনা। তুমি আমার একমাত্র পুত্র। আমাকে ত্যাগ করোনা। আমার কথা রক্ষা কর। তোমার জন্য যেন আমার অনুতাপ করতে না হয়।”
রাজা এরূপে নিবারণ করলেও বোধিসত্ত্ব পিতৃগুণ অজানার ন্যায় পিতৃবাক্য গ্রহণ না করে মাতৃ-শোকে বিমূঢ় হয়ে সজ্জিত চিতায় কাষ্ঠোপরি উত্তান অবস্থায় শায়িত হলেন। তখন তথায় সমাগত জনগণ দ্বারা স্বীয় মাতার শবদেহ রক্ষিত সুবর্ণ থলিয়া নিজের বক্ষোপরি লয়ে অগ্নি সংযোগ করলেন। বোধিসত্ত্বের কৃতজ্ঞতা গুণ প্রভাবে এবং বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব নিমিত্ত স্বরূপ সে প্রজ্বলিত অগ্নি অতি প্রবলভাবে প্রজ্বলিত হলেও, কিন্তু মহাসত্নের লোমকূপ মাত্র ও উত্তপ্ত হল না। তথায় সমাগত মহাজনতা প্রজ্বলিত অঙ্গার রাশির মধ্যভাগে বোধিসত্ত্বকে শায়িতাবস্থায় সুবর্ণ প্রতিমার ন্যায় বিরোচিত হতে দেখে সাধুবাদের সাথে প্রত্যেকের উত্তরীয় বস্ত্র ঊর্ধ্বে উৎক্ষেপন করে তাঁকে সগৌরবে পূজা করলেন। মহাসত্ব এরূপে বিপুল পূজা সৎকার সহযোগে মাতার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পাদন করলেন। তখন মহাসত্ত্বের তেজানুভাবে চার নিযুত দুই লক্ষ যোজন দল বিশিষ্ট এ মহাপৃথিবী মত্তহস্তীর ন্যায় গর্জন করে কম্পিত হল। সুমেরু পর্বতরাজ চম্পা নগরাভিমুখী হয়ে বীজারের ন্যায় নমিত হল। মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হল। আকাশে ঘন বিদ্যুৎ লহরী নিসৃতঃ হল। দেব-নরের সাধুবাদ শব্দে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত মুখরিত হল। সে সময় চম্পা নগরের সর্বস্থানে বহুবিধ আশ্চর্যজনক অলৌকিক ব্যাপারের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। মহাসত্ত্ব বিপুল পর্বতের পাদদেশে স্বীয় মাতার পর্ণশালার অনতিদূরে একগ্রাম পত্তন করলেন। সে গ্রামবাসী দ্বারা মাতার পূণ্য স্মৃতি স্মরণার্থ মাতার মৃত্যুস্থানে প্রত্যেক মাসে মহাসমারোহে পূজাসকার সম্পাদন করা হত। সে গ্রামখানি পর্ণশালা কর্মনিগ্রাম” নামে পরিচিত হয়েছিল। মহাসত্ত্ব চম্পানগরে স্বীয় মাতার অস্থি ও অঙ্গার সমূহ উত্তম সুবাসিত জলে ধৌত করলেন এবং তা সুবর্ণ পাত্রে গ্রহণ করে দেবীর চিতায় নিধান করলেন। তদুপরি একটি প্রকাণ্ড সুবর্ণ চৈত্য তৈরী করালেন। তিনি প্রতি অৰ্দ্ধমাসে উক্ত স্মৃতি চৈত্যে উপস্থিত হয়ে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করতেন এবং বিশিষ্টভাবে মহাপূজা সঙ্কার করতেন। তৎপর তথায় আগত জনগণকে মহাদান দিয়ে সবাইকে নিন্মোক্ত গাথাযোগে উপদেশ দিতেন–
৬০। “সজ্জন মণ্ডলী, আমি যেভাবে দান-কার্য সম্পাদন করছি, তোমরা ও অপ্রমাদের সহিত সেরূপ যথাশক্তি দানকর্মে ল্প নিয়োগ কর।” তদবধি জনগণ মহাসত্ত্বের উপদেশানুসারে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর সবাই দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। মহাসত্ত্ব ও পিতার সাথে চম্পানগরে রাজসম্পত্তি পরিভোগ করে আজীবন দানাদি পুণ্য কাৰ্য্য সম্পাদন করলেন এবং মৃত্যুর পর তুষিত দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ভগবান জেতবনে সম্মিলিত ভিক্ষুদের নিকট এ। জাতক কাহিনী সমাপ্ত করবার পর উক্ত মাতা-পিতা পোষক ভিক্ষুকে চতুর্বিধ আর্য সত্য দেশনা করবার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৬১-৬২। “দুঃখ সত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য এবং মার্গ সত্য, এ চতুর্বিধ আর্য সত্য সর্বদা আমি দেশনা করেছি। ত্রৈভূমিক দুঃখ সত্য, তৃষ্ণা সমুদয় সত্য, নির্বান নিরোধ সত্য
এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গকেই মার্গ সত্য বলা হয়।
এ চতুরার্য সত্য দেশনাবসানে মাতা-পিতা পোষক ভিক্ষু স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তৎপর শাস্তা এ জাতক উপসংহার করে ছয়টি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৬৩-৬৮। তখন রাজা লুণ্ঠনকারী অতি পাপিষ্ট, কূটরাজা এখন আমার প্রতি শত্রুতা আচরণকারী পাপ ধর্ম পরায়ণ দেবদত্ত। মহাতেজশালী নাগরাজা এখন ছন্ন অমাত্য। দেবরাজ ইন্দ্র এখন অনুরুদ্ধ। শ্রীমতি রাজ-মাতা এখন মহামায়া। পিতা যশঃকীর্তি রাজা এখন শুদ্ধোদন মহারাজ। অমাত্য ও নগরবাসী সবাই এখন আমার শাসন পুরক শ্রাবক সংঘ। ধর্মে স্থিত ধার্মিক রাজা শ্রী বিপুল কীর্তি এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। নিত্য ত্রিবিধ সুখকামী অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(শ্রী বিপুল কীর্তিরাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply