১৭. শ্রী সুধামণি রাজ জাতক
“যে জন যা যা করে” এ গাথা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে বাস করবার সময় স্বীয় দান পারমী সম্পর্কে বলেছিলেন।
একদা ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এ কথা উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ! আমাদের ভগবান বুদ্ধ দান দিয়ে তৃপ্ত হন না। আরো ততোধিক দান দিতে ইচ্ছা করেন। পূর্বে ও বোধিসত্ত্বাবস্থায় দানে সর্বদা অভিরত থাকতেন। এখন বুদ্ধত্ব লাভ করেও মনুষ্যদিগকে লৌকিক লোকোত্তর সম্পত্তি দান করছেন।” তৎকালে বুদ্ধ গন্ধকুঠি হতে দিব্য কর্ণে তাঁদের। আলোচ্যমান বিষয় জ্ঞাত হয়ে ধর্মসভায় উপস্থিত হলেন এবং প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে উপবিষ্ট হয়ে বললেন–“তোমরা এখন কোন্ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাদের আলোচ্যমান বিষয়গুলি বুদ্ধকে যথাযথ ভাবে বিবৃত করলেন। তখন বুদ্ধ সবাইকে সম্বোধন করে বললেন–“ভিক্ষুগণ, আমি শুধু এখন সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে মনুষ্যদের লৌকিক লোকোত্তর সম্পত্তি দান করছি তা নয় পূর্বেও আমি দানে অভিরত চিত্ত হয়ে সমাগত যাচকগণকে মহাদান দিয়েছিলাম। এক সময় নিজের জীবনাশা ত্যাগ করে এক ব্রাহ্মণকে নিজের অর্ধদেহ দান করেছিলাম। এবলে বুদ্ধ মৌণভাব অবলম্বন করলেন। তখন তথায় উপবিষ্ট ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–।
অতীতে বারাণসী নগরে “শ্রী সুধামণি” নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তার অগ্রমহিষীর নাম ছিল “পদ্মবতী” তিনি অতিশয় শীলবতী রমণী ছিলেন। পূর্বজন্মার্জিত পুণ্যের প্রভাবে তিনি অতিশয় রূপ-লাবণ্যবতী, প্রসাদিকা ও দর্শনীয়া ছিলেন এবং রাজার অতি মনোজ্ঞ ও প্রিয়া ছিলেন। “চন্দ্রকুমার” নামক তাঁর এক পুত্র ছিলেন। রাজা সাম্যভাবে ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তিনি নগরের চার দ্বারে চারখানা, নগরের মধ্যস্থানে একখানা এবং প্রাসাদের দ্বার দেশে এক খানা এ ছখানা দানশালা তৈরী করে প্রতি দান শালায় সমাগত যাচকগণকে মহাদান দিতেন। যথোপযুক্ত কালে রাজা মহামেঘের ন্যায় দান বর্ষণ করেছিলেন। মহারাজ প্রত্যহ পূর্বাহ্ন ও সায়াহ্ন কালে অমাত্য ও জনগণকে উপদেশ প্রদানচ্ছলে বলতেন–“ভবৎগণ, তোমরা সবাই যথাসাধ্য দান দেবে এবং শীল রক্ষা ও উপোসথ পালন করবে।” একদা প্রাতঃকালে রাজানান্তে রাজ অলঙ্কারে বিভূষিত হয়ে পুণ্ডরিক’ নামক মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ করে অমাত্য সহ দান শালায় উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি প্রত্যেক দান শালায় উপস্থিত যাচকগণকে স্বহস্তে দান প্রদান করে নিন্মোক্ত উপদেশ প্রদান করতেন
১। “ধন-ধান্য পরিভোগ্য বস্তু ও বস্ত্রাদির মধ্যে যে যা আমার নিকট যাঞ্চা করবে, তা-ই তাকে প্রদান করব।” রাজা স্বয়ং দানশালা সমূহে আশানুরূপ দান দিয়ে দান কার্য সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য কর্মচারীদের নির্দেশ প্রদানকালে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২। “সর্বদা তোমরা যাচকদের এ নিয়মে দান দেবে, অন্নপানীয় দানে সবাইকে সর্বদা পরিতৃপ্ত কর।”
এবলে রাজা স্বীয় প্রাসাদে চলে গেলেন। একদা তিনি প্রত্যুষে নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে শয্যায় সুখাসনে বসে স্বীয় দান সম্বন্ধে চিন্তা করলেন। ইহাতে তাঁর চিত্ত প্রীতি-সৌমণস্যে ভরপুর হল। তন্মুহুর্তে রাজা আরো চিন্তা করলেন–এযাবৎ আমি যাচকগণকে বাহ্যিক বস্তু দান দিয়েই সন্তোষ করেছি। এখন আধ্যাত্মিক বস্তু ও দান দিতে ইচ্ছুক। অহো! অদ্য যদি কেহ আমার নিকট এসে আধ্যাত্মিক বস্তুর মধ্যে চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত, অর্ধ দেহ কিম্বা সর্ব দেহ যাঞ্চা করে, তা দান দিয়ে পরমার্থ পারমী পূর্ণ করব এবং সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের অধিকারী হব। সে বিষয় প্রকাশ করবার ইচ্ছায় সর্বজ্ঞ বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় ভাষণ করলেন–
৩-৬। রাজা শ্রী সুধামণি’ ছটি শ্রেষ্ঠ দানশালা নির্মাণ করার পর প্রসন্ন চিত্তে মহাদান প্রদান করতেন। রাজা ধর্মতঃ রাজ্য শাসন করে প্রাসাদে বসে দান দেওয়ার জন্য এরূপ চিন্তা করলেন–যাচক যদি আমার নিকট এসে চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত অথবা অর্ধ দেহ এ আধ্যাত্মিক মহাধন যাঞ্চা করে, উপরন্তু কেহ যদি আমার প্রিয় সর্ব দেহও যাঞ্চা করে, দাসের মত হয়ে তার ইচ্ছা সাদরে পরিপূর্ণ করব।”
রাজা এরূপ চিন্তা করা মাত্রই চুরান্নব্বই অযুত দ্বিলক্ষ যোজন দল বিশিষ্ট এ মহা পৃথিবী মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় সগর্জনে কম্পিত হল। সাগর মহাতরঙ্গে তরঙ্গায়িত হয়ে ভৈরভ নাদে নিনাদিত হল। পর্বতরাজ সুমেরু বীজাঙ্কুরের ন্যায় বারানসী অভিমুখে অবনমিত হল, ভীষণ মেঘগর্জন সহ ক্ষণিক বৃষ্টি বর্ষণ হল, আকাশে বিদ্যুৎ লহরী বিকশিত হল, দেবরাজ ইন্দ্র করতালী ও মহাব্রহ্মা সাধুবাদ দিলেন। দেবতাবৃন্দ সাধুবাদ প্রদানে চতুর্দিক মুখরিত করলেন। মনুষ্যলোক হতে ব্ৰহ্মলোক পর্যন্ত একই কোলাহলে মুখর হয়ে উঠল। রাজার এরূপ চিন্তা প্রভাবে জগতে এরূপ অভূতপূর্ব বিস্ময়কর ব্যাপার সংঘটিত হয়েছিল। তখনি দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দেবরাজ সে কারণ চিন্তা করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৭। “আমাকে আসন-চ্যুত করবার ইচ্ছায় কোনও মনুষ্য বা দেবতা দানাদি মহা কুশল কর্মে ব্রতী হয়েছে মনে হয়।”
দেবেন্দ্র রাজা সুধামণির পরমার্থ পারমী সম্পূরণের চিত্তভাব সম্যক জ্ঞাত হয়ে প্রসন্ন মনে চিন্তা করলেন–“আমি এখন গিয়ে এ বুদ্ধঙ্কুরের মনোরথ পূর্ণ করব।” তখনই তিনি স্বর্গ হতে অবতরণ করলেন এবং স্বীয় দেহকে দিব্য ঋদ্ধি প্রভাবে কেবল বাম অর্ধ দেহ সম্পন্ন হয়ে ব্রাহ্মণ বেশে দণ্ড হস্তে রাজাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। এরূপ অদৃষ্টপূর্ব আশ্চর্য লোক দর্শনে তথাকার জনগণ অতিশয় চমৎকৃত হয়ে বললেন–“অহো দেখ, একি আশ্চর্য ও অদ্ভুত ব্যাপার! অর্ধ দেহধারী এ ব্রাহ্মণ দণ্ড হস্তে এখানে এসেছেন। এমন অর্ধ ত পূর্বে কোথাও দেখিনি। তখন বোধিসত্ত্ব প্রাসাদ হতে নেমে বাসগৃহের সম্মুখে দানশালায় উপস্থিত হলেন। এ অর্ধ দেহধারী ব্রাহ্মণ তখন মহাসত্ত্বের নিকট এসে বামহস্ত প্রসারিত করে বললেন–“মহারাজ, আপনার জয় হোক।” রাজা এ অপূর্ব দেহধারী ব্রাহ্মণকে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাঁর চক্ষে অশ্রুধারা প্রবাহিত হল। তিনি করুনার্দ্র চিত্তে নিতাক্ত গাথায় জিজ্ঞাসা করলেন–
৮। “কি কারণে কোন উদ্দেশ্যে আপনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন? তা আমাকে বলুন।”
অসহ দুঃখ বেদনার কম্পমানের ন্যায় বাম দেহ ধারী দেবরাজ বাম হস্ত তুলে বললেন–“মহারাজ, এখন আমি। জরাজীর্ণ বৃদ্ধ, অনাথও অর্ধ দেহধারী। তাই আপনার দক্ষিণ দেহখানা যাঞ্চা করতে এসেছি। এখন আমার দেহ স্বাভাবিক করবার ইচ্ছায় আপনার দক্ষিণ দেহখানা আমাকে দান। করুন।” এ বলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৯। “নদী যেমন কোন কালেও শুষ্ক হয় না, সেরূপ যাচকগণও আপনার নিকট নিরাশ হয় না। আমি যাজ্ঞা করছি, আপনার অর্ধ দেহ আমাকে দান করুন।”
একথা শুনে মহাসত্ত্ব আনন্দে অধীর হলেন। তাঁর মনে আগামীকল্যই যেন বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। প্রীতি ফুল্ল চিত্তে তিনি বললেন–“সাধু মহা ব্রাহ্মণ, এখনি আমি আপনার মনোরথ পূর্ণ করব।” এ বলে অতি সরল প্রাণে নিঃসঙ্কোচে জগত বিস্ময়কর নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১০। “ব্রাহ্মণ আমার নিকট যা যাঞ্চা করলেন, অকম্পিত হৃদয়ে তা আপনাকে দেব। যা আছে, তা গোপন করব না বা দিতে অনিচ্ছুক হব না। দানেই আমার মন রমিত হয়।” এ বলে মহাসত্ব ত্যুহূর্তে সুগন্ধি জল পরিপূর্ণ সুবর্ণ গাড় হতে ব্রাহ্মণের হস্তে জল ঢেলে স্বীয় অর্ধ দেহ দান করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১১-১২। “হে মহাব্রাহ্মণ, আমি আপনাকে আমার অর্ধ দেহ দান করব। আমি বুদ্ধ হবার জন্য আমার অর্ধ দেহ দান। করব। আমি বুদ্ধ হবার জন্য আমার অর্ধ দেহ গ্রহণ করুন। আমি বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আপনাকে শির, চক্ষু, কর্ণ, ঘ্রাণেন্দ্রিয়, জিহ্বা ও হৃদয় ইত্যাদি প্রত্যেকটিরই অর্ধাংশ করে দিচ্ছি।
এরূপে তাকে অর্ধ দেহ দানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজা শ্রী সুধামণি রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তথায় অমাত্য নগরবাসী প্রধানগণ নিজের অগ্রমহিষী পদুমবতী দেবী ও পুত্র চন্দ্র কুমারকে আহ্বান করলেন। সে সম্মিলনে চন্দ্র কুমারকে আলিঙ্গন ও শির চুম্বন করে এরূপ বললেন–“বাবা প্রিয় পুত্র, এ হতে তুমি অপ্রমত্ত হয়ে দান দাও, শীল রক্ষা কর ও অনুস্মৃতি ভাবনা কর। এখন আমার অর্ধ দেহ এ ব্রাহ্মণকে দান দেব।” এ বলে রাজা পুত্রকে রত্ন পালঙ্কে উপবেশন করিয়ে সুগন্ধি জলপূর্ণ সুবর্ণ গাড় হতে কুমারের হস্তে জল ঢেলে রাজাভিষেক মাঙ্গলিক কার্য সম্পাদনের পর উক্ত ব্রাহ্মণের নিকট
এসে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৩। “হে মহাব্রাহ্মণ, চিন্তা করবেন না। আপনার মনোরথ পূর্ণ করব। অনাগতে আমার বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আপনার প্রার্থীত বিষয় আমি দান করলাম। আপনি গ্রহণ করুন।” “ইহা শুনে ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্বকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–।
১৪। “মহারাজ, শীঘ্রই আমাকে আপনার অর্ধ দেহ দান। করুন। বোধিলাভের জন্য আপনি দিচ্ছেন।” তা শুনে রাজা “সাধু মহাব্রাহ্মণ,” এরূপ বলে দেববৃন্দকে জ্ঞাপন উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে অবলোকন করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৫। এখানে সমাগত দেবগণ, আমার বাক্য শ্রবণ করুন। বোধিলাভ মানসে আমি অর্ধ দেহ দান করলেও, বোধ হয় আমি জীবিত থাকব।” এ বলে বোধিসত্ত্ব নিজের ব্রত অধিষ্ঠান করে সত্য পারমী পূর্ণ করবার ইচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৬। বোধিসত্ত্বগণ পারমী সমূহ পূর্ণ করে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করেন। এ সত্য বাক্য প্রভাবে শীঘ্রই আমার নিকট করাত উপস্থিত হউক। মহাসত্নের এ সত্য ক্রিয়ার প্রভাবে তন্মুহুর্তেই সে স্থানে প্রজ্জ্বলিত অগ্নির ন্যায় রক্তবর্ণ দেহধারী, রক্ত চক্ষু বিস্ফোরিত ও রক্ত বর্ণ কেশ-শশ্রু-লোম বিশিষ্ট ভীষণ দর্শন দুটি যক্ষ তীক্ষ্ণ করাত হস্তে পৃথিবী ভেদ করে বিকট শব্দে প্রাদুর্ভূত হল। তখন তথায় উপস্থিত জনগণ এভয়ঙ্কর যক্ষদ্বয়কে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণভয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করলেন। মহাসত্ব এ যক্ষদ্বয়কে দেখে বললেন–“সাধু সাধু ভবৎ যক্ষগণ, আপনারা এখানে আসুন।” তীক্ষ্ণ করাত ধারী যক্ষদ্বয় বোধিসত্নের নিকট এসে যথাস্থানে স্থিত হল। তখন বোধিসত্ত্ব যক্ষদের আনীত তীক্ষ্ণ করাত স্বহস্তে স্পর্শ করে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বললেন–“দেবগণ, আমার এ অর্ধ দেহ দান চক্রবর্তী, মাররাজ, বা দেব ব্রহ্ম সম্পত্তি লাভের জন্য নয়, এমন কি পচেক বুদ্ধত্ব লাভের জন্য নয়, এ দান পুণ্যের প্রভাবে আমি যেন অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করতে পারি, এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা।” “শ্রী সুধামণি’ রাজা এরূপ বলার পর পুনঃ নগরে প্রতিষ্ঠিত দানাশালার দান অনুমোদন করার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
১৭-১৯। ভবৎগণ, এখানে সমাগত সকলেই আমার প্রদত্ত সমস্ত দান, আমার এ অর্ধ দেহ দান অনাগতে বোধি লাভের জন্যই হোক। আমার এ দান সবাই অনুমোদন করুন। আমার এ দান সর্বজ্ঞতা লাভের সহায় হোক। তা সবাই অনুমোদন করুন।”
তখন তথায় সমবেত দেবমনুষ্যগণ সংবিগ্ন অন্তরে সে দান অনুমোদন করে মুহূর্মুহুঃ সাধুবাদ প্রদান করলেন। তৎক্ষণাৎ বোধিসত্ত্ব পালঙ্ক হতে অবতরণ করে যক্ষদ্বয়কে ডেকে বললেন–“ভবৎগণ আপনারা শীঘ্রই আপনাদের করাত দ্বারা আমার মস্তকের অর্ধভাগ হতে আরম্ভ করে সর্বদেহের অর্ধভাগ ছেদন করুন। তখন যক্ষদ্বয় রাজার আদেশ পেয়ে তাঁর মস্তকের অর্ধভাগে করাত চালাতে লাগল। তথায় সমবেত অমাত্য ও মহাজনগণ একসাথেই বক্ষে করাঘাত করে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করে উঠলেন। পদুমবর্তী দেবী সে রোদন-শব্দ শুনে পুত্র চন্দ্রকুমারকে সঙ্গে লয়ে বোধিসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হলেন। যক্ষদ্বয় রাজার মস্তক ছেদন করছে দেখে দেবী আলু থালু কেশে। বক্ষে করাঘাত করতে করতে রাজ পদে নিপতিত হলেন। চন্দ্রকুমারও পিতার নিকট এসে তার পদপ্রান্তে পড়ে রোদন করতে লাগলেন। তারপর রাজাকে আলিঙ্গন করে সাশ্রু গদ গদ কণ্ঠে বললেন–
২০। হায়! হায়! বাবা! আপনি আমাকে অনাথ করবেন । আমি এখনো তরুণ। বাব, এরূপ করবেন না। রাজার মস্তক ছেদন করে করাত ললাট সপ্রাপ্ত হল এবং রক্তধারা প্রবাহিত হয়ে সর্ব দেহ ও পৃথিবী রঞ্জিত হল। তখন দেবগণ বোধিসত্ত্বকে দিব্যপুষ্পে পূজা করলেন এবং সাধুবাদ প্রদান করলেন। অকালে বিদ্যুৎ লহরী প্রাদুর্ভূত হল। করাত যখন মুখদেশ সম্প্রাপ্ত হল তখন মহাসত্ব জনগণকে বললেন–হে সজ্জন মণ্ডলী, আপনারা অনুশোচনা ও রোদন করবেন না। প্রত্যেকেই শীল পালন করবেন। এ বলে মহাজনগণকে উপদেশ প্রদানচ্ছলে নিতাক্ত গাথাটি বললেন–
২১। ভবৎগণ, আপনারা শীলবানদের যথাসাধ্য দান দেবেন। দানের ন্যায় প্রতিষ্ঠা আর কিছুই নেই। করাত যখন বোধিসত্ত্বের গ্রীবাদেশ সম্প্রপ্ত হল, তখন অতিশয় তীব্র দুঃখ বেদনা উৎপন্ন হল। বোধিসত্ত্ব সে অসহ দুঃখ সহ্য করলেন। এবং প্রসন্ন-চিত্ত উৎপন্ন করে নিজকে আশ্বাস মানসে স্বগত বললেন–“হে সুধামণি, তুমি নিজের অঙ্গ, অর্ধদেহ ও জীবন না। দিয়ে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হবে না। এখন তুমি এ অর্ধ দেহ দানে চিত্ত প্রসন্ন কর। অর্ধদেহ দানের পর আর কোনও দুঃখ অনুভব করবেনা,” এ বলে চিত্তে দৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠান করে ধৈর্য সহকারে তথায় দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর যক্ষদ্বয় করাত দ্বারা ক্রমে রাজার উদর ও হৃদয় পর্যন্ত ছেদন করল। তখন রাজা নিজের দক্ষিণ অর্ধ দেহ, বাম অর্ধ দেহধারী ব্রাহ্মণকে জল ঢেলে প্রদান করবার সময় নিন্মোক্ত গাথা বলে মনোভাব ব্যক্ত করলেন
২২। “হে মহাব্রাহ্মণ, দান আমার অতি প্রিয়। অনাগতে বোধিলাভের উদগ্র কামনায় আমার দেহের অর্ধাংশ প্রসন্ন চিত্তে আপনাকে দান করছি, আপনি তা গ্রহণ করুন।”
তখন দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্নের অর্ধাংশ দেহ গ্রহণ করে। নিজের অর্ধাংশে সংযোগ করে দিলেন। এতে ব্রাহ্মণ পরিপূর্ণ দেহধারী হয়ে রাজার সম্মুখে এদিক ওদিক পদচারণায় রত হয়ে স্তুতি বাক্য উচ্চারণ করলেন। শাস্তা সে বিষয় প্রকাশের ইচ্ছায় নিন্মোক্ত সাতটি গাথা ভাষণ করলেন–
২৩-২৯। “তাঁর সঙ্কল্প জ্ঞাত হয়ে দেবরাজ বললেন–“জগতে যত দেব মানব আছে, সকলের চেয়ে আপনারই জয়। আপনার দান-প্রভাবে এ মহা পৃথিবী সগর্জনে কম্পিত হয়েছিল। চতুর্দিকে বিদ্যুৎ মালার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সুমেরু পর্বত নমিত হয়েছিল। সুমেরু ও নারদ পর্বত আপনার সে দান অনুমোদন করেছিল। ইন্দ্র, ব্রহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যাম, বৈশ্রবণ, প্রভৃতি দেবগণ সন্তুষ্ট চিত্তে স্বীয় স্বীয় বিমান হতে আপনার এ দুষ্কর দান অনুমোদন করেছিলেন। দুস্পরিত্যজ্য দান, দুর্দমনীয় চিত্ত সংযম, দুষ্কর সকর্ম আপনি করেছেন। সদ্ধর্ম হতে দূরে সরে থাকা বড়ই অন্যায়। তদ্ধেতু সত্ব্যক্তি স্বর্গ পরায়ণ হয় এবং অসৎলোক নিরয় গমন করে। আমাকে যে আপনি দানোত্তম অর্ধ দেহ দান করেছেন, এতে আপনি ব্রহ্মাকে ও অতিক্রম করেছেন। এখন আপনি স্বর্গেও পূজিত হবেন।”
এরূপে দেবরাজ তাঁর দান অনুমোদন করে চিন্তা করলেনরাজাকে আর কষ্ট দেওয়া উচিৎ হবে না। তাঁর অর্ধ দেহ তাঁকে প্রত্যপর্ণ করে দেবলোকেই প্রত্যাবর্তন করব।” তৎপর দেবরাজ নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৩০। “হে রাজ শ্রেষ্ঠ, আপনার প্রদত্ত এ অর্ধ দেহ পুনঃ আপনাকেই দান করছি। আমা হতে এ দান গ্রহণ করুন।”
তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের বাম অঙ্গের সাথে দক্ষিণ অঙ্গ সংযোজন করে অমৃতোদক সিঞ্চন করলেন এবং নিজের ইন্দ্ৰত্ব ভাব প্রকাশের জন্য নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–।
৩১। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার মনোরথ পূর্ণ করবার জন্যই এখানে এসেছি। আপনার এ দান বোধিলাভের হেতু হয়েছে।”
দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের সাথে এরূপ আলাপ করে স্বীয় দিব্য ঋদ্ধি প্রভাবে তরুণ সূর্যের ন্যায় জ্যোতির্ময় হয়ে গগন মণ্ডল আলোকিত করে বললেন–“এ হতে দানাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করুন। আপনি সারা জীবন নানাবিধ দান করুন”। এরূপ উপদেশ দিয়ে রাজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করে দেবলোকে প্রস্থান করলেন। সে বিষয় প্রকাশ করবার মানসে বুদ্ধ বললেন–
৩২। “দেবরাজ সুজাম্পতি মঘবা রাজার এরূপ স্তুতি করে স্বর্গে চলে গেলেন।”
তখন বোধিসত্ত্ব দেবরাজের দিব্য প্রভাবে সুদীর্ঘ পরমায়ু লাভ করেন। তৎপর তাঁর অমাত্যগণ ও নগরবাসী ইন্দ্রের অনুভাব বলে পুনঃ তাঁকে মহা উৎসবের সহিত রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তদবধি শ্রী সুধামণি রাজা স্বীয় আশানুরূপ মহা দান দিতেন। এরূপে তিনি আজীবন দানাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। রাজার উপদেশানুযায়ী আচরণ করে নগরবাসী জনগণও মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। বুদ্ধ এ ধর্মদেশনা উপসংহার করে জাতকের সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৩৩-৩৬। তখনকার দেবরাজ ইন্দ্র বর্তমানের অনুরুদ্ধ। পদুমবতী রাণী বর্তমানের যশোধরা। চন্দ্রকুমার বর্তমান রাহুল। নগরবাসী জনগণ বর্তমান আমার পরিষদ মণ্ডলী। জনাধিপ শ্রী সুধামণি এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। তোমরা সবাই নিত্য ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনা করে অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(শ্রী সুধামণি রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply