১৫. কম্বল রাজ জাতক
“হে রাজন, যে দায়ক” ইহা শাস্তা জেতবনে অবস্থান কালে সাকেত রাজার কঠিন চীবর দান উপলক্ষে বলেছিলেন
বর্ষাবাসের কিছুদিন পূর্বে কোণ্ডণ্য স্থবির বুদ্ধের অনুমতি নিয়ে জেতবন হতে সপরিষদ সাকেত নগরে উপস্থিত হলেন। তখন সাকেত রাজা সপরিষদ স্থবিরকে দেখে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং অমাত্যকে ডেকে বললেন–“হে তাত, তুমি অবিলম্বে গিয়ে সপরিষদ কোণ্ডণ্য স্থবিরকে আমার বিহারে বর্ষাবাস গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ করে এখানে নিয়ে আস।” অমাত্য রাজার আদেশ অনুযায়ী স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে রাজার কথা নিবেদন করলেন এবং স্থবিরকে সপরিষদ নিমন্ত্রণ করলেন। স্থবির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং সপরিষদ রাজা বিহারে উপস্থিত হলেন। তখন রাজা বিহারে গিয়ে স্থবিরকে বন্দনা করে বিনম্র বাক্যে বললেন–“ভন্তে এবিহারে আপনি বাস করুন।” তখন স্থবির মৌনভাবে রাজার বাক্যে সম্মতি প্রদান করলেন। বর্ষাবাস সমাপ্তির পর স্থবির রাজাকে বললেন–“মহারাজ, এখন বর্ষাবাস শেষ হয়েছে। সুতরাং এখন আমরা অন্যত্র গমন করছি।” রাজা তা শুনে আরো কিছুদিন এবিহারে অবস্থান করবার জন্য কাতর অনুরোধ জ্ঞাপন করে স্বীয় প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করলেন। রাজা শয়ন প্রকোষ্ঠে শয্যায় বসে নিজের বিপুল সম্পত্তি সম্বন্ধে চিন্তা করে স্বগতঃ বললেন–“অহো আমার পিতা-মাতা এ অপরিমাণ ধন সম্পদ সংগ্রহ করে জীর্ণ ত্বক সর্পের ন্যায় মরণকালে জীর্ণ দেহ ত্যাগ করেছেন। পরলোক গমন কালে এক কপর্দকও সঙ্গে নিতে পারেননি। রিক্ত হস্তেই মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি কিন্তু সমস্ত ধন পরলোকে লয়ে যাব। আমার মৃত্যু কি অদ্য হবে, না আগামী কল্য হবে, নাকি তার পরে হবে, তা কিছুই জানিনা। এখন আমি স্থবিরকে কঠিন চীবর দান দেব।” এ মনে করে নিজের অগ্রমহিষী ও অমাত্যগণকে আহ্বান করে স্বীয় মনোভাব জ্ঞাপন করলেন। তারপর সেলাই কারক ডেকে উত্তম বস্ত্রের চীবর তৈরী করলেন। রঞ্জনাদি যাবতীয় কঠিন চীবরোপযুক্ত কাজ সম্পাদন করে মহাজনগণকে এরূপ আদেশ দিলেন “ভবৎগণ আপনারা ঘৃত, দধি, খীর, মাখন, পৃষ্ঠক যায়ূ ও অন্নাদি খাদ্য ভোজ্য সর্ব উপকরণ যোগাড় কর। আমরা স্থবিরকে কঠিন চীবর দান করবার জন্য বিহারে যাব। “এরূপ নির্দেশ পেয়ে জনগণ যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহ করে রাজার সহিত বিহারে উপস্থিত হলেন এবং শ্রদ্ধা সহকারে রাজা প্রমুখ সকলে কোণ্ডণ্য স্থবিরকে কঠিন চীবর দান করলেন। স্থবির বিনয় বিধি অনুসারে কার্য সম্পাদন করার পর কঠিন চীবর গায়ে দিয়ে আসনে উপবেশন করলেন। সেক্ষণে রাজা, সেনাপতি জনগণ অতিশয় প্রফুল্ল হলেন। অতঃপর স্থবির কঠিন চীবর সম্বন্ধে ধর্মদেশনা করলেন। এ কঠিন চীবর দানের কথা সমগ্র জম্বুদ্বীপে প্রচারিত হল। তখন ধর্মসভায় উপবিষ্ট ভিক্ষুগণের মধ্যে এরূপ কথার উত্থাপন হল। বন্ধোগণ, সাকেত রাজা একবার মাত্র মহা কোণ্ডণ্য স্থবিরকে কঠিন চীবর দান করেছেন। সে কথা সমগ্র জম্বুদ্বীপে প্রচারিত হয়েছে।” ভগবান বুদ্ধ দিব্যকর্ণে গন্ধকুটি হতে ভিক্ষুদের এ আলাপ শুনে সে সভায় উপস্থিত হলেন এবং প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে সমাসীন হয়ে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, বর্তমান তোমরা কি কথা নিয়ে উপবিষ্ট আছ?” তখন ভিক্ষুগণ, তাদের আলোচ্যমান বিষয় ব্যক্ত করলেন। বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ কেবল এখন নয় পূর্বেও আমি সংসারে সংসরণকালে শরণঙ্কর ভগবানকে কঠিন চীবর দান দিয়েছিলাম। সে দানের ফলেই এখন আমি সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করেছি। এবলে শাস্তা মৌনভাব অবলম্বন করলেন। সভায় উপস্থিত ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি সে অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
হে ভিক্ষুগণ, অতীতে কম্বল নামক নগরে কম্বল নামক একরাজা ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তখন বোধিসত্ত্ব এক গৃহপতি কুলে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় উক্ত শ্রদ্ধাসম্পন্ন শীলবান কুলপুত্র শরণঙ্কর বুদ্ধের ধর্মদেশনা শুনে প্রসন্ন হয়ে কঠিন চীবর দান করতে একান্ত ইচ্ছুক হলেন। তাই স্বীয় পরিষদ বর্গকে আহ্বান করে বললেন–“বাবাগণ আমি কঠিন চীবর দান দিতে ইচ্ছুক। তোমরা বস্তু ক্রয় করে নিয়ে আস।” তখন পরিষদ বর্গ বস্ত্র এনে দিল। গৃহপতি পুত্র বোধিসত্ত্ব কঠিন চীবর দানের সমস্ত উপকরণ সঙ্গে নিয়ে সপরিষদ বিহারে উপস্থিত হলেন। তথায় সউপকরণ কঠিন চীবর খানা শরণঙ্কর বুদ্ধকে দান দিয়ে বললেন–“ভন্তে, এ কঠিন চীবর দান সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের হেতু হোক।” এ বলে প্রার্থনা করলেন। তখন শরণঙ্কর বুদ্ধ বোধিসত্ত্বের প্রার্থনা অনুমোদন করলেন। অতঃপর বোধিসত্ত্ব যথায়ুষ্কাল জীবিত থেকে মৃত্যুর সময় উক্ত কঠিন চীবর দান স্মরণ করে আনন্দ চিত্তে চ্যুতির পর তুষিতপুরেই উৎপন্ন হলেন।
একদিবস সায়কালে কম্বল রাজা বিহারে গিয়ে শরণঙ্কর ভগবানকে বন্দনা করে একান্তে বসে বলেলন–“ভন্তে এখন আমরা কোন পুণ্যকর্ম সম্পাদন করব? এবং জগতবাসীদের সুখ বিপাক দায়ক কুশলকর্ম কিরূপ হওয়া উচিত? ভন্তে, বস্তু দানের মধ্যে যে দান সর্বোকৃষ্ট, সে দান সম্বন্ধে আমাদিগকে দেশনা করুন। তখন ভগবান বুদ্ধ রাজার প্রার্থনা শুনে কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১। “রাজন যে দায়ক সর্বদা সংঘদান করেন, জগতে তারা সকল সময় সুখ লাভ করে। এ দানই মহাফলপ্রদ হয়।” একথা বলে পুনরায় ধর্মদেশনাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
২-৫। “মহারাজ, যে ব্যক্তি সংঘকে কিছু দান দেয়, সে সর্বদা বিপুল সুখ লাভ করে। সে দান হতেও অধিক ফলপ্রদ দান হয় কঠিন চীবর দান। ইহা আমার দ্বারা বলা হয়েছে। তদ্ধেতু ঐ সংঘ দান হতেও কঠিন চীবর দানই মহাফলপ্রদ বলে আমি বছি। ভিক্ষুদের পঞ্চ আপত্তি নাশক ও পঞ্চফলপ্রদ এ কঠিন চীবর। সে কঠিন চীবর দায়ক মনুষ্যত্ব লাভ করলে মহাপরিবারশালী ও মহা ভোগ সম্পদশালী হয়। আর দুর্গতি কি, তা জানেনা। সর্বদা সুখ লাভ করে। মনুষ্যলোকে মনুষ্য সুখ এবং দেবলোকে দিব্যসুখ ও পরে নির্বাণ-সুখ প্রাপ্ত হয়।
ইহা শুনে কম্বল রাজ অতি প্রীতিফুল্ল মনে সাধু বলে প্রতিগ্রহণ করলেন। তৎপর বললেন–“ভন্তে এখন আমি আপনাকে মহাফলপ্রদ কঠিন চীবর দান করব।” সে হতে কম্বল রাজ প্রত্যেক বৎসর চীবরমাসে শরণঙ্কর বুদ্ধকে কঠিন চীবর দান দিয়েছেন। বুদ্ধ কঠিন চীবর দানের ফল বর্ণনাচ্ছলে নিলো চতুর্দশটি গাথা বললেন–
৬-১৯। “রাজন, স্বীয় সুখকামী বুদ্ধিমান যে দায়ক, সংঘকে কঠিন চীবর দান করে, সে বিপুল সুখ ভোগ করে। সে যদি মনুষ্য বা দেবলোকে উৎপন্ন হয়, সর্বদা সুখী হয়। তারা কৌশীক, কম্বল খােম ও কার্পাস বস্ত্রাদি অপরিমেয়ভাবে লাভ করে। কঠিন চীবর দায়ক যদি বৃক্ষাগে, পর্বতে আকাশে এবং ভূমিতে বস্ত্র ইচ্ছা করে, তার সমস্ত ইচ্ছা পরিপূর্ণ হয়। সে যদি সসাগরা মহাপৃথিবী বস্ত্রদ্বারা আচ্ছাদন করতে ইচ্ছা করে, তার সে ইচ্ছাও পূর্ণ হয়। সে সর্বদা স্বর্ণ, রৌপ্য, মণি ও লোহিতঙ্কময় থালায় সর্বদা সুবাসিত ভোজ্য ভোজন করে। সর্বদা বিচিত্র রতন খচিত শ্রেষ্ঠ যান-বাহন লাভ করে। তাঁর ভোজ্য সম্পদ কখনো বিনষ্ট হয়না। সুবর্ণ রত্নময়, দন্তসারময় ও মহার্ঘ শয্যা লাভ করে। দাস, দাসী ভার্যা ও অনুজীবিগণ সর্বদা প্রিয় আচরণ করে। এসব কঠিন চীবর দানেরই ফল। কঠিন চীবর দায়ক যা ইচ্ছা করে, তা তার ইচ্ছা মত উৎপন্ন। হয়। সর্বদা সে সুখী হয়। সর্বদা দেব-মনুষ্য লোকেই উৎপন্ন হয়, অপায় দুর্গতি কি তারা জানে না। সে পুণ্যবান ব্যক্তি হীন কুলে, চণ্ডাল কুলে, দরিদ্র কুলে ও দুঃখীকুলে কখনো উৎপন্ন হয় না। সে মনুষ্য লোকে উৎপন্ন হলে সর্বদা সমৃদ্ধ ও ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণ কুলে উৎপন্ন হয়। এসবও কঠিন চীবর দানেরই ফল। সে অন্তিম জন্মে সর্বদুঃখের অন্তসাধন করতঃ পুনঃ জন্মের। কারণ মূলচ্ছেদ করে নির্বাপিত হয়।” কম্বল রাজ এবম্বিধ অপূর্ব বাণী শুনে প্রীতিফুল্ল মনে শিরে অঞ্জলীবদ্ধ হয়ে সশ্রদ্ধ অন্তরে বুদ্ধকে বন্দনা করে বললেন–“ভন্তে যে ব্যক্তি বস্ত্র ক্রয় করে দিয়েছে, সে কিরূপ ফল লাভ করবে?” তখন বুদ্ধ তার ফল বর্ণনা প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২০। “যে ব্যক্তি সংঘকে কঠিন চীবর দানের জন্য বস্ত্র ক্রয় করে দিবে, সে ব্যক্তি সর্বদা দেব মনুষ্য লোকে মহাধনী, মহাযশস্বী ও মহাভোগ সম্পদ শালী হয়।” ইহা শুনে রাজা পুনঃ বুদ্ধকে বললেন–“যে ব্যক্তি শেলায়ের সূত্র সংগ্রহ করে দেয়, সে কিরূপ ফল লাভ করবে?” তদুত্তরে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২১। “কঠিন চীবর উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি সূত্র তৈরী করে দেয়, সে সর্বদা মনুষ্যলোকে সুখ ভোগ করে এবং সর্বদা সর্বকর্মে বিশারদ হয় ও কোনও জন্মে কুজ হয় না।” ইহা শুনে রাজা সানন্দে সাধুবাদ দিলেন এবং পুনঃ বিনীত বাক্যে বললেন–“ভন্তে কঠিন চীবরের বস্ত্র ছেদনকারী কিরূপ ফল লাভ করে?” তদুত্তরে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২২। “সংঘকে কঠিন চীবর দানের জন্য যে ব্যক্তি বস্ত্র ছেদন করে দেয়, সে জন্মে জন্মে ধমতঃ অর্থার্জনে পারদর্শী ও নিপুণ হয়।” রাজা ইহা সাধুবাদের সহিত গ্রহণ করে পুনঃ বললেন–যে ব্যক্তি কঠিন চীবর শেলাই করবার ব্যবস্থা করে সে কিদৃশ ফল লাভ করে?” তখন বুদ্ধ রাজার প্রশ্নের উত্তর
প্রদানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
২৩-২৪। “যে ব্যক্তি কঠিন চীবর শেলাইয়ের ব্যবস্থা করে দেয়, সে মনুষ্যলোকে ঐশ্বর্যশালী ও মহাপ্রভাবশালী রাজা হয়। সে মনুষ্যলোক হতে চ্যুত হয়ে দেবলোকে উৎপন্ন হয় এবং তথায় দেবগণের শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর ও ঐশ্বর্যশালী দেবতা হয়ে তথায় সর্বদা সুখ ভোগ করে।” রাজা ইহা শুনে সাধুবাদের সাথে তা গ্রহণ করে কহিলেন–“যে ব্যক্তি কঠিন চীবর শেলাই করে, সে কিদৃশ ফল লাভ করে?” বুদ্ধ তাঁর প্রশ্নের উত্তর প্রদানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায়ে বললেন–
২৫-২৭। “হে রাজন, সংঘকে কঠিন চীবর দেওয়ার জন্য যে ব্যক্তি কঠিন চীবর শেলাই করে, সে জন্মান্তরে সুরূপ হয়, মহাপ্রজ্ঞাবান হয় এবং সর্বদা সুখলাভ করে, সে ভবে ভবে চতুদ্বীপের ঈশ্বর চক্রবর্তী রাজা হয় এবং অসংখ্যবার প্রদেশের রাজত্ব প্রাপ্ত হয়। সেখান হতে চ্যুত হয়ে দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় সর্বদা দিব্য সুখ ভোগ করে। ইহা কঠিন চীবর শেলাই করার ফল।” রাজা পুনঃ ভগবানকে বললেন–“ভন্তে, যে ব্যক্তি বস্ত্র রঞ্জন করে, সে ব্যক্তি কিরূপ ফল লাভ করে?” প্রত্যুত্তরে বুদ্ধ নিন্মোক্ত তিনটি গাথায় বললেন–
২৮-৩০। “হে রাজন, যে ব্যক্তি সে চীবরের রঞ্জন ও ধৌত কর্ম করে, সে মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলে সর্বদা সুখী ও নিরোগী হয়। সে সুবর্ণ বর্ণ শরীর লাভ করে এবং সুরূপ, সর্বজনের চিত্ত প্রসাদকর প্রিয়দর্শন হয়। ইহা কঠিন চীবর রঞ্জনের ফল। সে দেবলোকে উৎপন্ন হলে তথায় সর্বদা দেবগণের প্রিয় হয় এবং দেবগণের মধ্যে বিশেষভাবে বিরোচিত হয়।” রাজা পুনঃ বুদ্ধকে বিনম্রবাক্যে বললেন–“ভন্তে, যে ব্যক্তি কঠিন চীবরে গ্রন্থী সূত্র দান করে, সে কি প্রকার ফল লাভ করে?” বুদ্ধ তদুত্তরে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৩১-৩২। যে ব্যক্তি কঠিন চীবরের গ্রন্থী সূত্র দান করে, সে সর্বদা পরিশুদ্ধ অবস্থা সম্পন্ন হয়ে সংসরণ করে। অপায়ে। উৎপন্ন হয় না। সে গ্রন্থী সূত্র দায়ক ব্যক্তি দেব-মনুষ্য লোকে উৎপন্ন হয় সর্বদাই সুখী হয়। ইহা কঠিন চীবরে গ্রন্থী সূত্র দানের ফল।” ইহা শুনে রাজা প্রীতিফুল্ল চিত্তে পুনঃ বুদ্ধকে বললেন–“ভন্তে, যে ব্যক্তি কঠিন চীবর ধৌত করে সে কিদৃশ ফল লাভ করে?” বুদ্ধ ইহার উত্তরে নিন্মোক্ত গাথায়ে বলেন–
৩৩-৩৫। “মহারাজ, সে ব্যক্তি শ্রদ্ধার সহিত কঠিন চীবর ধৌত করে, সে সুগতি প্রাপ্ত হয়। সর্বদা দেবনর লোকে সুখী হয়। সে সর্বদা সর্বত্র সগৌরবে পূজিত ও সত্ত্বার প্রাপ্ত হয় এবং মহাযশস্বী, মহাভোগ সম্পদশালী ও দীর্ঘায়ু সম্পন্ন হয়। সে সর্বদা দেবলোকে দেববৃন্দের এবং মনুষ্যলোকে মনুষ্যদের ঈশ্বর (শ্রেষ্ঠ) হয়। ইহা কঠিন চীবর ধৌতকারীর ফল।”
তদবধি কম্বল রাজা শরণঙ্কর বুদ্ধের শাসনে অত্যন্ত প্রসন্ন। হয়ে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। তদনন্তর তিনি যথাকালে মৃত্যুর পর তুষিত স্বর্গে উৎপন্ন হলেন। সমস্ত অমাত্য ও রাজপুরুষগণ ও দানাদি নানা পুণ্যক্রিয়া সম্পাদনান্তর যথাকালে মৃত্যুর পর বিভিন্ন দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। এখন গৌতম বুদ্ধ শরণঙ্কর সম্যক সমুদ্ধের দেশিত নিয়মে ধর্মসভায় উপবিষ্ট ভিক্ষুদের কঠিন চীবর দানের ফল প্রকাশ করবার মানসে নিন্মোক্ত বিংশতিটি কঠিন চীবর দানের পুণ্যফল দীপক গাথা ভাষণ করলেন–
৩৬-৫৫। সুখকামী জ্ঞাতিগণ কঠিন চীবর মাসে সংঘক্ষেত্রে দানোত্তম কঠিন চীবর দান করে, সে পুণ্য বৃদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি সর্বদা দেবমনুষ্যলোকে সুখানুভব করে। সে অপায়াদিতে উৎপন্ন না হয়ে দেবলোকে দেবসুখ এবং মনুষ্যলোকে মনুষ্যসুখই ভোগ করে। ইহা কঠিন চীবর দানের ফল। যে শ্রদ্ধাচিত্তে সংঘকে কঠিন চীবর দান দেয়, তার দানকে যারা অনুমোদন করে, তারা সর্বদা এক কল্প ব্যাপী সুখ লাভ করে। ইহা কঠিন চীবর অনুমোদনের ফল। যে ব্যক্তি সশ্রদ্ধা চিত্তে কঠিন চীবর দানকারী দায়ককে ছোট বড় বহু দ্রব্য ও বস্ত্র ক্রয়ের জন্য ধন। প্রদান করে, সে ধন দায়ক এক কল্পাবধি সুখ লাভ করে। ইহা । ধন দানের ফল। যে শ্রদ্ধা সম্পন্ন দায়ক কঠিন চীবর দানের জন্য শ্রেষ্ঠ শাসনে সংঘকে স্বীয় বস্ত্র দান করে, সে ষোড়শ কল্পাবধি বিপুল সুখ লাভ করে। ইহা কঠিন চীবর দানের ফল। বস্ত্র ছেদনকালে যে ব্যক্তি পরিশুদ্ধ চিত্তে সাহায্য করে ও শেলাই করে, সে অসংখ্য জন্ম সুখ লাভ করে। ইহা কঠিন চীবর নির্মাণকারীর ফল। অকনিষ্ঠ ব্রহ্মলোক সমান উচ্চ করে স্বর্ণ রৌপ্য ও নানা রত্ন রাশি সর্বদা সংঘকে দান করলে যে পুণ্য উৎপন্ন হবে, সে পুণ্য একখানা কঠিন চীবর দান পুণ্যের সোল ভাগের একভাগও হয় না। অযুত হস্তী, অযুত অশ্ব, অযুত অশ্বতর, অযুত সুসজ্জিত রথ এবং মণি মুক্তা কুণ্ডলে অলঙ্কৃত অযুত কন্যা দান করলেও একখানা কঠিন চীবর দান-পুণ্যের যোল ভাগের একভাগও হয় না। প্রত্যেক প্রকার অযুত অযুত ব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রী সর্বদা সংঘকে দান করলেও একখানা কঠিন চীবর দান-পুণ্যের ষোল ভাগের একভাগও হয় না। রত্নময় পালঙ্ক সহ চুরাশী সহস্র বিহার নির্মাণ করে সংঘকে দান দেওয়া হলেও সে দান মহাফলপ্রদ ও বিপুল সুখদায়ক হয় বটে, কিন্তু তা একখানা কঠিন চীবর দান-পুণ্যের মোলভাগের একভাগও হয় না। উচ্চতায় অকনিষ্ঠ ব্রহ্মলোক সম সুবর্ণময় প্রাসাদ সংঘকে দান করলে সে দান মহাফলপ্রদ এবং অফুরন্ত সুখের কারণ হয় বটে, কিন্তু একখানা কঠিন চীবর দান-পুণ্যের যোলভাগের একভাগও হয় না। যে হেতু কঠিন চীবর লাভী ভিক্ষুকে পাঁচটি আপত্তি হতে রক্ষা করে, তাই ইহা সর্বদান হতে শ্রেষ্ঠ বলে আমি বর্ণনা করেছি। তদ্ধেতু পণ্ডিতগণ নিজের ভবিষ্যৎ সুখ সম্বন্ধে চিন্তা করে চীবর মাসে সংঘকে কঠিন চীবর দান দিয়ে থাকে।” এরূপে শাস্তা তথায় ভিক্ষুগণকে কঠিন চীবর দানফল দেশনা করে পুনরায় নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৫৬-৫৭। “দুঃখসত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য এবং মার্গ সত্য এচতুর্বিধ সত্য সকল সময় আমি দেশনা করেছি। ত্রৈভূমিক দুঃখ সত্য, তৃষ্ণা সমুদয় সত্য, নির্বাণ নিরোধ সত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সত্য।” এরূপে চারি আর্যসত্য দেশনার পর কোন কোন ভিক্ষু স্রোতাপত্তি ফল, কেহ কেহ সকৃদাগামী ফল, কেহ অনাগামী ফল, আর কেহ অরহত্ব ফল প্রাপ্ত হলেন। তারপর শাস্তা বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, কঠিন চীবর দান শুধু এখন নহে, পূর্বেও এ কঠিন চীবর দান ছিল। এবলে এ। ধর্মদেশনা সমাপন করে জাতক সমাপ্তি গাথা বললেন–
৫৮-৭০। “তখনকার কম্বলরাজ বর্তমান মহাপ্রজ্ঞাবান সারিপুত্র। বস্ত্রক্রয়কারী এখনকার আনন্দ। তখনকার মাতা পিতাই বর্তমান আমার মাতা-পিতা। সে অতীতের মহাজন সংঘ এখনকার সবাই আমার পরিষদ মণ্ডলী। সে অতীত গৃহপতির পুত্র এখন আমি তোক জ্যেষ্ঠ নরাভ লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। অতি গৌরব চিত্তে এজাতক ধারণ কর।
(কম্বল রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply