১৪. সুরূপ রাজ জাতক
“মরিচ তুল্য” শাস্তা জেতবনে বাস করবার সময় ইহা নিজের দান পারমী সম্পর্কে বলেছিলেন। একদা ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ আমাদের শাস্তা দান করে তৃপ্তি লাভ করেন না। এখনো। পরকে বিমুক্তি সুখ দান করতঃ মহাকারুণিক ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন।” শাস্তা গন্ধকুটি হতে ভিক্ষুগণের উক্ত আলোচনা দিব্য কর্ণে শ্রবণ করলেন। তখন তিনি ধর্মসভায় এসে প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে উপবেশন করে জিজ্ঞেস করলেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখন কি কথা নিয়ে এখানে উপবেশন করছ?” তখন। ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় যথাযথ ভাবে প্রকাশ করলেন–। শুনে বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, এখন আমি বুদ্ধভাবে স্থিত হয়ে পরকে বিমুক্ত সুখ দান করছি দেখে তোমরা আশ্চর্য মনে করছ। আমি পূর্বেও বোধিসত্ত্বকালে পুথুজ্জনাবস্থায় পরের নিকট ধর্ম শ্রবণের জন্য নিজের স্ত্রী পুত্র ও নিজকে দান করেছি। এবলে শাস্তা নীবর রহিলেন। তখন ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থিত হয়ে সে অতীত কাহিনী বলতে লাগলেন–
অতীতে ইন্দ্রপত্ত নামক নগরে সুরূপ নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি শীলবান ও দশ রাজ ধর্মে পরিপূর্ণ। রাজ্যবাসী প্রজাবৃন্দ প্রমুখ রাজ কর্মচারিগণ সর্বদা বলতেন–
“আমাদের প্রভু বড়ই ধার্মিক রাজা।” এ প্রশংসা বাক্যটি সমগ্র রাজ্যে প্রকট হয়েছিল। সে রাজার প্রিয়ভার্যা অগ্রমহিষীর নাম ছিল সুন্দরা দেবী। তাঁদের পুত্রের নাম ছিল “সুন্দর কুমার।” এক দিবস তিনি সাদরে শ্রেষ্ঠ উপরিতম তলে শ্রী শয্যায় শায়িত হলেন। রাত্রির অবসানে প্রত্যুষকালে গাত্রোখান করে পালঙ্কে উপবেশন পূর্বক স্বীয় দেহের অনিত্যভাব লক্ষ্য করলেন। তখন নিজের সাথে আলাপচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
১-২। মারিচি সংযুক্ত আর জলবুদ্বুদ সম,
কদলী সারের ন্যায় বহু দুঃখময় এদেহ ॥
অশুচী সমাচ্ছন্ন এদেহ রোগাগার সদা,
শরীর অনিত্য ধ্রুব,
অদ্যই মম হতে পারে পতন নিশ্চয় ॥
তিনি এরূপ নিজের সাথে আলাপ করে পুনঃ চিত্তে তা বিশেষ ভাবে প্রকট করার নিমিত্ত সউপমায় নিতাক্ত ছয়টি গাথা যোগে বললেন–
৩-৮। বৃক্ষের পক্কফল যথা ধ্রুব ভূমে পড়ে
সেইরূপ সত্ত্বগণ নিত্য যায় মরণের তীরে ॥
অপক্ক ফল যথা বৃক্ষে থাকে স্থির,
সেরূপ প্রাণী কুল রহে যথায়ুষ্কাল পর।
এভবে জরা যদ্দিন না আসে তাহার ॥
ছোট নদীর জল থাকে যথা বর্ষাকালে
অবর্ষায় জল তার শীঘ্রই শুকায় ॥
সেইরূপ ভবে মৃত্যু, মৃত্যুর আশ্রয়ে জীবন
স্কন্ধের ভিন্নতায় অনিত্য হয়, আয়ু হয় ক্ষয়।
ছোট নদীর জল যথা বর্ষাকালে থাকে
জলের অভাবে তা শুষ্ক হয়ে মরে।
সেরূপ ভবেতে প্রাণী জন্ম লভিয়া।
যথায়ুষ্কাল জীবিত থাকে, জরা মরণ না হয় যত দিন।
তৃণাগ্রে শিশির বিন্দু যথা স্থিত হয়,
সূর্যের উদয়ে তাহা ক্ষিপ্র হয় বিলয়।
সেরূপ প্রাণীর আয়ু ক্ষিপ্র বেগে ধায়
মৃত্যুর আঘাতে নিশ্চয় হায় ॥
এরূপে বোধিসত্ত্ব উক্ত ছয়টি সউপমা দ্বারা স্বীয় চিত্তে প্রকট ভাব আনয়ন পূর্বক পুনঃ চিত্ত-সংবেগ প্রাপ্ত হয়ে চিন্তা করলেন“এখন আমি কার নিকট ধর্ম শ্রবণ করব? কে আমাকে ধর্ম দেশনা করবেন? এ চিন্তা করে প্রাসাদ হতে অবতরণ পূর্বক প্রাতেই-ান করলেন। তারপর শ্রেষ্ঠ রাজ ভোজ্যে ভোজন কৃত সমাপন করে বিচারালয়ে রতন পালঙ্কে অমাত্যগণ সহ উপবেশন পূর্বক নিন্মোক্ত গাথায় অমাত্যগণকে জিজ্ঞেস করলেন–
৯। ভবৎগণ, আমি শ্রেষ্ঠ ধর্মকথা করিব শ্রবণ,
চিত্তবিশুদ্ধিকর সে ধর্মকে করবে দেশন?
ইহা শুনে অমাত্যবৃন্দ সুরূপ রাজাকে উত্তর দানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–
১০। বুদ্ধোত্পত্তি কাল নহে রাজন, কে জানিবে উত্তম ধরন? ধর্ম শ্রবণে ইচ্ছুক রাজন, কে পূর্ণিবে ইচ্ছা তব ভাবিয়া না পাই।
মহাসত্ত্ব বললেন– “ভবৎগণ, এখন আমি এক উপায়ে কাহারো নিকট হইতে ধর্ম শ্রবণ লাভ করব।” এবলে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–
১১। ভবৎগণ, এক উপায়ে শোনব আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম সার।
মম বাক্য শোন এবে আগত তোমরা এবার ॥
আমাত্যগণ বোধিসত্ত্বের চিন্তিত উপায় জানবার জন্য নিন্মোক্ত গাথা যোগে জিজ্ঞেস করলেন–
১২। কি প্রকারে কি উপায়ে রাজন আপনি,
শ্রেষ্ঠ ধর্ম শুনিবেন, জিজ্ঞাসি এখনি।
তখন বোধিসত্ত্ব অমাত্যগণকে বললেন–“ভবৎগণ তোমরা আমারই সম্পদ দশ সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা রত্ন করণ্ড পূর্ণ করে হস্তী পৃষ্ঠে তা রেখে দাও। এবং সারা রাজ্যে ভেরী ঘোষণা করে বল–“ভবৎগণ, এরাজ্যবাসী যারা “সুরূপ রাজাকে” শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশন বলতে সক্ষম হবেন, সেই সেই ব্যক্তি এদশ সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা সহ রত্ন করণ্ড এবং হস্তী নাগ লাভ করতে পারবেন। এবং সুরূপ রাজা সেই ধর্ম দেশককে মহা পূজা সকার করেন।” এবলে রাজা অমাত্যগণকে আদেশ করলেন। তখনই অমাত্যবৃন্দ রাজার কথিতানুসারে সারা ইন্দ্রপত্ত নগরে সপ্তদিন ব্যাপী ভেরী শব্দে ঘোষণা করলেন বটে, কিন্তু কাকেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশনাকারী পেলেন না। এরূপে অমাত্যগণ যারা ইন্দ্রিপত্ত নগরে সাত বত্সর সাত মাস পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেও শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশক না পেয়ে রাজার নিকট এসে বললেন– “মহারাজ আপনার এরাজ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশক নেই।” রাজা তা শুনে দৌর্মনস্যভাব গ্রস্ত হয়ে অবনত মস্তকে ঝিমিতে ঝিমিতে চিন্তা করলেন “এখন আমি অল্প পুণ্যবান। যেহেতুঃ–শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশক কাকেও পাওয়া গেলনা। তখন বোধিসত্ত্ব অমাত্যবৃন্দ পরিবৃত হয়ে তথায়ই উপবিষ্টাবস্থায় চিন্তা করতে লাগলেন “যারা আমাকে এরূপ বলবে” মহারাজ এখন আমি আপনাকে ধর্মকথা বলবার জন্য এখানে এসেছি। আমি ধর্ম কথক।” তখন আমি সেই ধর্মদেশকে আমার ভার্যা, পুত্র, দাস, দাসী, হস্তী, অশ্ব, গো, মহিষ প্রভৃতি সবিজ্ঞান, ধন, রাজ্য, সুবর্ণ, রৌপ্য সপ্তবিধ রত্ন ও নানাবিধ বস্তু ইত্যাদি অবিজ্ঞান ধন, মস্তক হৃদয়, মাংস রক্ত, এমন কি সব দেহ বা অর্ধ দেহ, ইত্যাদি আধ্যাত্মিক ধনের মধ্যে যে যেই ধন ইচ্ছা করেন, আমি সেই শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশককে সে ধন প্রদান করব।” এরূপ চিন্তা করে মহাসত্ত্ব অমাত্যবৃন্দের সাথে আলাপচ্ছলে নিন্মোক্ত তিনটি গাথাযোগে বললেন–
১৩-১৫। পুত্র দার সবিজ্ঞান অবিজ্ঞান ধন দুর্লভ্য কভু নয়,
ধন ধান্য বস্ত্ৰ সুখ জগতেতে দুর্লভ কভূ নয়।
বুদ্ধের উৎপত্তি আর সদ্ধর্ম কথা বড় দুর্লভ হয়,
সংঘ বন্দনাও দুর্লভ হয় তথা সদ্ধর্ম শ্রবণও দুর্লভ।
নিরয়ে উৎপন্নকায়ী মহাদুঃখ ভোগে অনুক্ষণ,
সুখ মম নাহি কভু। ধর্ম কোথায় করিব শ্রবণ?
তখন এরূপ চিন্তায় রত বোধিসত্ত্বের তেজানুভাবেই দুইলক্ষ চুরান্নব্বই যোজন দল বিশিষ্ট এই মহাপৃথিবী উন্মত্ত গজরাজের ন্যায় সগর্জনে কম্পিত হল। মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হল। সুমেরু পর্বত ইন্দ্রপত্ত নগরাভিমুখী হয়ে নমিত হল। তক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ ইহার কারণ চিন্তা করতঃ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৬। কোন্ দেব বা মনুষ্য বুঝি সম্যকরূপে পুর্ণিছে পুণ্যের সম্পদ, আমাকে আসন হতে চ্যুতির মানসে দান ব্রহ্মচর্য করিছে পালন।
দেবরাজ এরূপে চিন্তা করার পর কারণ সম্যকরূপে জ্ঞাত হয়ে চিন্তা করলেন–“এখন বুদ্ধাঙ্কুর সুরূপ রাজা পরের নিকট হতে ধর্ম শ্রবণার্থ নিজের ভার্যা, পুত্ৰ নিজকে এবং অন্যধন ত্যাগ করতে ইচ্ছুক হয়েছে। সুতরাং আমিই এরাজার সর্বকামনা পরিপূর্ণ করব” এরূপ চিন্তা করে দেবরাজ ইন্দ্র ইন্দ্ৰত্বভাব ত্যাগ করে যক্ষতৃ ভাবে নিজকে পরিবর্তন করলেন। তখন তার চেহারা ভয়ঙ্কররূপ ধারণ করল। চক্ষুদ্বয় জলন্ত অগ্নির ন্যায় হল। লোম কেশ অতিশয় দীর্ঘ এবং শব্দ হল। ভয়সঙ্কুল। এরূপ অবস্থায় দেবরাজ বোধিসত্ত্বের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এ বীভৎসরূপ দেহ দেখে সমবেত জনগণ ভীত ত্রাসিত হয়ে তথায় সে পলায়ন করলেন। তখন মহাসত্ত্ব সে। যক্ষকে দেখে তার আগমন কারণ জিজ্ঞাসাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৭। কি জন্য মহাযক্ষ মম নিকট এসেছ এথায়?
তার কারণ জিজ্ঞেস করি বলহে আমায়।
ইহা শুনে যক্ষবেশধারী দেবরাজ বললেন–“মহারাজ, আপনাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশনার জন্য এখানে এসেছি। এ বলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৮। এখানে এসেছি রাজন শ্রেষ্ঠ ধর্ম করিতে দেশন,
সাদরে আমার নিকট তাহা করুন শ্রবণ।
মহাসত্ত্ব যক্ষের ভাষণ শুনে হস্তে শত সহস্র টাকার থলি যেন বিদ্যমান আছে, নিধিকুম্ভ যেন লাভ হল সেরূপ প্রীতি বিস্ফারিত হৃদয়ে বললেন–সাধু সাধু মহাযক্ষ এখন আমাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশনা করুন। তখন যক্ষ রাজাকে বললেন–মহারাজ, এখন আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত পীড়িত ও পিপাসিত। তাই আপনাকে এখন ধর্ম দেশনা শোনাতে পাচ্ছিনা তা শুনে রাজা নিজের জন্য তৈরীকৃত শ্ৰেষ্ঠ আহার্য বস্তু এক স্বর্ণ থালায় সজ্জিত করে যক্ষকে প্রদান করলেন। যক্ষ তা রাজার হস্ত হতে গ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু তা ভোজন না করে রেখে দিলেন। রাজা তা দেখে যক্ষকে বললেন–আপনি ইহা ভোজন করছেন কেন? যক্ষ বললেন–মহারাজ, আমার ভোজ্য বস্তু কি, তা আপনি জানেন কি? রাজা বললেন–তা আমি জানিনা। তখন যক্ষ বললেন– “মহারাজ, জীবিত মানুষের রক্ত মাংসই আমার প্রিয় খাদ্য। এবলে নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করতঃ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
১৯। মহারাজ নিত্য আমি সজীব মানব দেহে বিদ্যমান,
মাংস রক্ত ভোজন করি তাই মম প্রিয়তম ভোজন।
২০। ভোজন কারণে আমায় তোমাকেই দাও ভোজন করিতে
পূর্বেই তোমাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিব ওহে ক্ষত্রিয় রাজন।
তখন বোধিসত্ত্ব বললেন–“সাধু সাধু ভবৎ যক্ষ, আপনি পূর্বেই আমাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলুন। আমি তা শ্রবণ করে আমার স্বীয় দেহ পরে আপনাকে দান করব।” এবলে নিজকে প্রদান মানসে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২১। দেহরূপী ধন মম যাহা করিতেছ ইচ্ছন এখন,
দিতেছি তা গ্রহী এবে শ্রেষ্ঠ ধর্ম করুন দেশনা।
তখন সুন্দরী নারী রাজকন্যা শ্রেষ্ঠ প্রকোষ্ঠে শ্রীশয্যায় উপাবিষ্টাবস্থায় রাজা ও যক্ষের আলাপ শুনে সংকল্প করলেন“অদ্যই আমার স্বামী রাজার মনোবাসনা পূর্ণ করবো।” এমনে করে শ্রেষ্ঠ প্রকোষ্ঠ হতে বের হয়ে রাজার নিকট এসে করযোড়ে বন্দনা পূর্বক নিজের অভিপ্রায় প্রকাশচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–
২২। আমি তব দাসী রাজন, পূর্ণিব তব মনের সাধ,
শ্রেষ্ঠ ধর্ম শ্রবণার্থ যক্ষে আমায় কর সম্প্রদান।
সে মম মাংস করিয়া ভোজন চিত্ত আশা করুক পূরণ ॥
মম ঈশ্বর রাজন তুমি যক্ষে দানি মোরে করুন ধর্ম শ্রবণ।
এবলে দেবী পুনঃ স্বীয় দোষ ক্ষমা প্রার্থনাচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৩। অমনোজ্ঞ কোন কৰ্ম্ম তব প্রতি যদি
কায় বাক্য মনে করে থাকি আমি।
সদয় হইয়া ক্ষমা করহ রাজন মোরে ॥
বোধিসত্ত্ব রাণীর প্রাণ স্পর্শী কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে রাণীকে বক্ষে জড়ায়ে ধরে তার শির চুম্বন করলেন। তারপর যক্ষকে দানোত্তম সে ভার্যা দান কল্পে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
২৪। হে যক্ষ, কামাবচর ধর্ম ভার্যা মম দিতেছি তোমায়,
স্বর্গ লাভ হেতু মম প্রিয় ভার্যা দান আমার ॥
২৫। দীর্ঘদিন স্বর্গসুখ ভোগ করার পর, মনুষ্য জন্ম নিয়া
এদানে অনাগত বোধি লাভ করি, সদেব নরে যেন
বিমুক্তিতে পারি।
পুনঃ রাজা যক্ষকে সম্বোধন করে বললেন–“হে যক্ষ, এখন আপনার নিকট শ্রেষ্ঠ ধর্ম শ্রবণের জন্য এবং অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের জন্য আমার প্রিয় ভার্যা আপনাকে দান দিচ্ছি” এবলে দেবীকে যক্ষের হস্তে দান দিলেন। তখন যক্ষ দেবীকে ভক্ষণ করার ন্যায় ভাণ করে মূড় মূড় শব্দ করতে লাগলেন। হস্তদ্বয় রক্তে ক্ষিত হল। অন্যেরা যেন দেবীকে দর্শন না করে, সেরূপভাবে তথায় দেবরাজ ইন্দ্রের বৌদ্ধান্তভাবে আচ্ছাদন করে রাখলেন। এরূপ দেবীকে যক্ষ ভক্ষণ করছে দেখে সমবেত জনগণ তথায় বক্ষ চাপড়াতে চাপড়াতে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তখন বোধিসত্ত্ব বললেন–“হে যক্ষ, আপনি আমার ভার্যাকে ভক্ষণ করে শীঘ্রই আমাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশনা করুন। যক্ষ বললেন–“মহারাজ আমি আপনার ভার্যাকে ভক্ষণ করে ক্ষুধার উপশম করতে পারিনি। সুতরাং এরূপ ক্ষুধার্তাবস্থায় সে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশন করতে পারবনা।” এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৬। ভার্যা তব খেয়ে রাজন কর্মক্ষম হই নাই এখন,
এরূপ ক্ষুধার্থ অবস্থায় আমি ধর্ম দেশিতে অক্ষম।
পুত্র যদি দাও রাজন, তাকে করিয়া ভক্ষণ
উত্তম ধর্ম তোমাকে তখন করিব দেশন।
তখন সুন্দর রাজপুত্র তাদের আলাপ শুনে “অদ্যই আমার পিতার ধর্ম শ্রবণের ইচ্ছা পরিপূর্ণ করব” এ চিন্তা করে আসন হতে উঠে পিতাকে বন্দনা করে করযোড়ে বললেন–“আমি আপনার ঔরসজাত পুত্র। এখন আপনি যক্ষের নিকট ধর্ম শ্রবণের জন্য আমাকে যক্ষের হস্তে দান করুন।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
২৭। সাধু দেব রথার্ষভ, তব মনষ্কাম পূরণের তরে,
মম জীবন দানিতেছি তব উত্তম ধর্ম শ্রবণের তরে।
রাজা স্বীয় পুত্রের এ উদার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং স্বীয় পুত্রকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে তার শির চুম্বন করতঃ তার দক্ষিণ হস্ত ধরে বললেন–“হে যক্ষ, আপনাকে যে আমার এ পুত্র দান করছি, তা এ মনুষ্যলোকের বিমানের জন্য নয়, চক্রবর্তী রাজভাবাদি মনুষ্য সম্পত্তির জন্য নয় যে কোন বুদ্ধের শ্রাবক ভাবের জন্য নয়, এমন কি পচ্চেক বুদ্ধত্বভাবও প্রার্থনা করছিনা। অপিচ আমার এ পুত্র দান দ্বারা অনাগতে সর্বজগতের হিতার্থ সর্বজ্ঞ বুদ্ধ হব। এবলে সমস্ত দেবতা দ্বারা নিজের পুত্র দান অনুমোদন করান উদ্দেশ্যে এ গাথাটি বললেন–
২৮। এখানে স্বাগত সকল দেবগণ তোমরা
মনুষ্য গন্ধর্ব সহ মম পুত্র দান অনুমোদন করুন এখন।
এবলে সে রাজা স্বীয় পুত্র সুন্দর কুমার যক্ষকে প্রদান করলেন। যক্ষ রাজার হস্ত হতে সুন্দর কুমারকে গ্রহণ করে, কুমারকে অন্য কেহ না দেখে মত নিজের ইন্দ্রত্ব ঋদ্ধি প্রভাবে আচ্ছাদন করে রাখলেন। তার পর রাজার সম্মুখেই কুমারকে ভক্ষণ করার ন্যায় মূড় মূড় শব্দ করতে লাগলেন। এবং স্বীয় দন্ত মুখ হতে রক্ত বিন্দু পতনের ন্যায় দৃশ্য প্রকাশ করলেন–। তখন তথায় সমবেত জনমণ্ডলী ভীবৎস দৃশ্য দেখে ভীত ত্রাসিতবস্থায় বক্ষ চাপড়াতে চাপড়াতে করুণ বিলাপ করতঃ সুরূপ রাজার নিকট এসে বন্দনা করার পর বললেন–মহারাজ এযক্ষ আপনার রাণীকে ভক্ষণ করে এখন আপনার পুত্রকে ও ভক্ষণ করে এখানেই আছে। এবার আমাদিগকেও ভক্ষণ করবে নয় কি?” এরূপ বলে আরো নিতাক্ত পাঁচটি গাথা যোগে বললেন–
২৯। যেইরূপে তবভার্যা যক্ষ ভক্ষিল রাজন
সেইরূপে প্রিয় পুত্র তব পুনঃ সে করিল ভক্ষণ।
৩০। এ যক্ষ এখানে ত্রাস বহু অনর্থ ঘটাল তোমার।
আমাদেরও না খাইবে আছে কি প্রমাণ তার?
৩১। তাহা দেখি জনগণ এখন রাজন।
বাহু প্রসারিত করে করিয়া রোদন
চারিদিকে পালাইছে দেব তোমার ভবনে।
৩২। যোদ্ধা কুমার বৈশ্য ব্রাহ্মণ জনগণ
বাহু প্রসারিত করে পলায় তোমার ভবন।
৩৩। শালায় কভু তিষ্ঠিতে না পারি জনগণ
বায়ু বেগে ধায় দেব তোমার ভবন।
সুরূপ রাজা এরূপে মহাজনতার কোলাহল শুনেও তাঁদের সাথে কোন কথাই না বলে যক্ষকে বললেন–“হে যক্ষ, আপনি এখন শীঘ্রই “শ্রেষ্ঠ ধর্মকথা’ বলুন। যক্ষ বললেন–“মহারাজ, আপনি পুনঃ আপনার দেহটি আমায় দান করুন। তা হলে আমি আপনাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম কথা বলব। মহাসত্ত্ব যক্ষের একথা শুনে সানন্দে বললেন–“সাধু সাধু মহাযক্ষ পূর্বেই আমাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশনা করুন, তা শুনে নিশ্চয়ই পুনঃ আমি নিজকে আপনার নিকট দান করব।’
তখন যক্ষ বেশধারী দেবরাজ বললেন–“মহারাজ, আপনাকে ভক্ষণ করবার জন্যই এখন আপনাকে শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশনা করব।” সুরূপ রাজ তা তথাস্তু বলে অনুমোদন করতঃ শ্রেষ্ঠ ধর্মের প্রতি গৌরবার্থ তথায় যক্ষকে রত্ন পালঙ্কে উপবেশন করালেন, সুগন্ধি পুষ্প চুর্ণাদি দ্বারা তাঁকে পূজা করলেন। তার পর নিজেও তার সম্মুখে মস্তকে কৃতাঞ্জলি করপুটে নীচাসনে উপবেশন করালেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম শ্রবণের জন্য।
দেবরাজ ইহার পূর্বের অর্থাৎ কশ্যপ বুদ্ধের স্বীয় মুখ নিঃসৃত যেই চারটি “শ্রেষ্ঠ ধর্ম” গাথা শুনে ছিলেন, এখন তা সুরূপ রাজার নিকট কশ্যপ বুদ্ধের দেশনা বিলাসে বুদ্ধলীলায়
সে গাথা চতুষ্টয় বললেন–
৩৪। প্রেম হতে শোক-ভয় সমুৎপন্ন হয়,
প্রেম হতে বিপ্রমুক্তদের শোক ভয় জাত নাহি হয়।
৩৫। তৃষ্ণা হতে শোক-ভয় সমুৎপন্ন হয়,
তৃষ্ণা হতে বিমুক্তদের শোক-ভয় জাত নাহি হয়।।
৩৬। কাম ইচ্ছায় শোক-ভয় সমুৎপন্ন হয়,
কাম ইচ্ছা বিমুক্তদের শোক-ভয় জাত নাহি হয়।
৩৭। কাম হতে শোক-ভয় সমুৎপন্ন হয়,
কাম হতে বিমুক্তদের শোক-ভয় জাত নাহি হয়।
মহাসত্ত্ব এইরূপে দেবরাজের নিকট শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশন শুনে অতিশয় প্রীত হলেন। তিনি যেন বুদ্ধের শ্রী মুখ হতে শ্রবণের ন্যায় মনে করে সপ্তবিধ রত্নে তাঁকে পূজা করলেন। তারপর নিজকে নিজে দান করতঃ বললেন–“ভবৎ যক্ষ, আমার দেহ আমার বড়ই প্রিয় ও মনোজ্ঞ। অপিচ এর চেয়েও লক্ষাদিকগুণে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই প্রিয় ও মনোজ্ঞতর। সুতরাং আমার এ দান সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভেরই হেতু হউক।” এবলে মহাসত্ত্ব সে দেবরাজকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৩৮। হে যক্ষ, ধর্মকামী হয়ে আমি নিজকে করি দান,
এ ত্যাগে না করি চিন্তন, অনাগতে বোধি লাভের কারণ।
৩৯। মম এদেহ নহে মম বিদ্বেষ কারণ, অপ্রিয়ও নহে,
যক্ষ, জানহ নিশ্চয়। সর্বজ্ঞতাই মম হয় অতি
প্রিয়তর। তাই দান করিলাম সাদরে তোমায়।
এবলে মহাসত্ব নিজকে নিজে দেবরাজকে দান করলেন। তৎক্ষণেই পৃথিবী কম্পনাদি বহু আশ্চর্য ব্যাপার সংঘটিত হল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথায় যোগে বললেন–
৪০। বোধিসত্ত্বের সুদানে ভীষণ ভাবেতে,
রোমাঞ্চকর ভাবে নগর সংক্ষুব্ধ হল বর্ণনা না যায়।
৪১। সাধুবাদ সারাকুল পরিপূর্ণ হল বিপুল ভাবেতে
কোলাহলময় হল আদান প্রভায় তখন।
৪২। বিপুল ও ভৈরব ভাবে শব্দ প্রবর্তিত হল
মহাঘোষ বিপুল ভাবে আকাশ ব্যাপীল।
তৎপর যক্ষবেশ ধারী দেবরাজ ইন্দ্র সুরূপ রাজার এ আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হয়ে স্তুতি করতঃ বললেন–“মহারাজ, আপনি বুদ্ধাঙ্কুর। অনাগতে আপনি নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবেন। আমি দেবরাজ ইন্দ্র, যক্ষ নহি। আপনার পারমী ধর্ম পরিপূরণের নিমিত্ত আমি এখানে এসেছি। এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বলেন–
৪৩। দেবরাজ ইন্দ্র আমি, এসেছি তোমার সদন
সুদানে অনাগতে বুদ্ধ হবেন নিশ্চয় রাজন।
এবলে দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বকে স্বীয় ইন্দ্ৰত্বভাব জ্ঞাপন করে রাজার ভার্যা ও পুত্রদান অনুমোদন করে বললেন–আপনার দেবী ও পুত্র আছে তারা এখন আপনারই হউক। এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪৪। হে জনেন্দ্র, এখন আমি তব পুত্র দার সহ
তোমাকেও দানিতেছি আনন্দ অপার।
তুমি তা গ্রহণ করিয়ে, আনন্দে করহ বাস
সঙ্গেতে রাখিয়ে।
এবলে দেবরাজ সুরূপ রাজার পুত্র দারকে দিব্যালঙ্কারে সুসজ্জিত করতঃ তাঁকে প্রদান করলেন। তখন রাজা প্রমোদিত চিত্তে এরূপ চিন্তা করলেন–অহো আমার এদান ইহলোকেই অত্যন্ত সুখপ্রদ হল, পরলোকেও এরচেয়ে অধিক সুখাবহ হবে। এবলে আনন্দ ধ্বনি করে তথায়ই উপবেশন করলেন। তখন দেবরাজ স্বাভাবিক ভাবে প্রজ্জ্বলিত দিব্য অগ্নির ন্যায় জ্বলিতে জ্বলিতে তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে বললেন–মহারাজ, আপনি অপ্রমত্ত ভাবে দানাদি পুণ্যকর্ম সমূহ করুন। এবলে স্বীয় স্থানে চলে গেলেন। তা প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪৫। ইহা বলে দেবরাজ উত্তম ধর্ম দেশনা করিয়া,
রাজাকে উপদেশ দিয়া দেবলোকে গেলেন চলিয়া।
সে হতে বোধিসত্ত্ব নিজের ইন্দ্রপত্ত নগরে রাজ সম্পত্তি নিরাপদে পরিভোগ করতঃ দেবরাজের উপদেশে সুস্থিত থেকে মহাজনগণকে দানাদি পুণ্যকর্ম করতে লাগলেন। তিনি যথায়ুষ্কাল জীবিত থেকে মৃত্যুর পর দেবলোকে দিব্য প্রাসাদে উৎপন্ন হলেন। তাঁর উপদেশে স্থিত মহাজনগণও পরকে দানাদি পুণ্যকর্ম করে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। শাস্তা এ ধর্মদেশন আহরণ করতঃ নিন্মোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৪৬। তদকালে দেবী রাজমাতা মহামায়া এখন,
সুরূপ রাজার পিতা এখন রাজা শুদ্ধোধন।
৪৭। সুন্দরী নামিকা নারী এখন হল যশোধরা যিনি
সুন্দর রাজপুত্র এবে রাহুল কুমার তিনি।
৪৮। দেবরাজ ইন্দ্র এখন অনুরুদ্ধ খ্যাত,
পরিষদের সর্বজন মম পরিষদ এবে
সবাই হও জ্ঞাত।
৪৯। সুরূপ নামক রাজা আমি সম্বুদ্ধ তথাগত এবে
লোকনাথ অনুত্তর লোক জ্যৈষ্ঠ এখন ভবে।।
৫০। ত্রিবিধ সুখ সম্পদ ইচ্ছাকারী তোমরা সর্বজন
অতীব গৌরব চিত্তে এজাতক করহ ধারণ।
(সুরূপ রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply