১৩. সুবর্ণ কুমার জাতক
“একমাত্র অদ্বিতীয় রাজা” শাস্তা এ ধর্মদেশনা জেতবনে বাস করবার কালে দশবিধ প্রশ্নের উত্তরদান প্রসঙ্গে বলেছিলেন।
এক দিবস ভিক্ষুসংঘ ধর্ম সভায় উপবিষ্ট হয়ে পরস্পর বললেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা দশবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বহুজনের সন্দেহের নিরসন করেছেন।” তখন ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুটি হতে দিব্য কর্ণে ভিক্ষুদের এসব আলাপ আলোচনা শুনে ধর্ম সভায় উপস্থিত হলেন। তথায় ভিক্ষুগণ কি আলোচনা করছেন, তা জিজ্ঞেস করলেন–। তখন ভিক্ষুগণও তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় ভগবানের নিকট যথাযথভাবে ব্যক্ত করলেন। ভগবান তা শুনে বলেন–“হে ভিক্ষুগণ তথাগত বুদ্ধ যে মহাপ্রজ্ঞাবান, তা শুধু এখন নয়; পূর্বেও বোধিসত্ত্বাবস্থায় মহাপ্রজ্ঞাবান হয়ে নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মানুষের সন্দেহ বিনোদন করেছিলেন।” তখন ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় তিনি অতীত কথা বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে বারাণসীতে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। একদা তিনি কামাসক্ত হয়ে তার সেবিকা এক দাসীর সহিত কামাচারে রত হলেন। এমতাবস্থায় বোধিসত্ত্ব ঐ দাসীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। রাজার অগ্রমহিষী স্বামীর কুকার্য জ্ঞাত হয়ে উক্ত দাসীর প্রতি সর্বদা ক্রোধচিত্তে রুক্ষ ব্যবহার করতেন। ক্রমে যখন দাসীর গর্ভভাব প্রকাশ পেল, তখন অগ্রমহিষী রাজাকে বললেন–“মহারাজ, অমুক দাসী আপনার দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। এখন আপনার ঐ প্রিয়। ভার্যার গর্ভ রক্ষার ব্যবস্থা করুন।” রাজা এতে লজ্জিত হয়ে কপট চিত্তে বললেন–“ভদ্রে, এ দুষ্টা দাসী পাচকের দ্বারাই গর্ভিনী হয়েছে। সে এখন আমার সেবিকার অনুপযুক্তা।” রাজা রাণীকে এরূপ মিথ্যা বলেও কিন্তু স্বীয় কৃত দুষ্কর্মের জন্য অত্যধিক লজ্জাবোধ করলেন। তিনি কলঙ্ক মুক্ত হবার উদ্দেশ্যে রাত্রে ঘাতককে ডেকে আদেশ করলেন–এ দুষ্টা দাসীকে অদ্য রাত্রিতেই গ্রামের বাহিরে নিয়ে গিয়ে বধ কর।” রাজা-দেশে তখনি ঘাতক ঐ দাসীকে সাথে করে বাহির গ্রামের দিকে অগ্রসর হল। তন্মুহুর্তে উক্ত দাসীর গর্ভস্থ বোধিসত্ত্বের অনুভাববলে রাজার শ্বেতছত্রে অধিষ্ঠিত দেবতা ঘাতকের দেহে প্রবিষ্ট হলেন। দেবতার প্রভাবে দাসীর প্রতি ঘাতকের করুণার সঞ্চার হল। ঘাতক দাসীকে বধ না করে হে বশে নিজের গৃহে নিরাপদে বাসের ব্যবস্থা করে দিল। তারপর ঘাতক সে রাত্রেই রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বলল–মহারাজ, আপনার আদেশ। প্রতিপালন করেছি। দাসীকে হত্যা করেই এসেছি।” রাজা ঘাতককে বললেন–“বেশ করছ।” এ বলে ঘাতককে বহু ধন প্রদান করলেন। তখন হতে ঐ দাসী ঘাতকের গৃহেই নিরাপদে বাস করতে লাগল। দশমাস পরিপূর্ণ হলে সে দাসী সোনার বরণ এক পুত্র সন্তান প্রসব করল। ঘাতক ছেলের নাম রাখল “সুবর্ণ কুমার।” এ কুমার ক্রমে বর্ধিত হয়ে সাত বৎসরে পদার্পণ করলেন। তখন তাঁর রূপ লাবণ্য ও বুদ্ধিমত্তা দর্শনে জনগণ মুগ্ধ হল। এমতাবস্থায় সুবর্ণ কুমার মাতার সঙ্গে ঘাতকের গৃহেই বাস করতে লাগলেন। তখন রাজার শ্বেতছত্রে অধিষ্ঠিত দেবপুত্র মাতা সহ কুমারকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করবার মানসে আকাশে উপবিষ্টাবস্থায় রাজাকে দেখা দিয়ে বলেন“মহারাজ, আমি এখন আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি যদি এর সদুত্তর দিতে পারেন তবে মঙ্গল। আর যদি উত্তর দিতে না। পারেন, তা হলে এখনি আপনাকে লৌহ মুারের আঘাতে ভূশায়ী করে মস্তক সপ্তধা বিদীর্ণ করব।” এ বলে সে দেবপুত্র ব্রহ্মদত্ত রাজাকে নিন্মোক্ত গাথায় দশটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন–
১-৩। “মহারাজ, এক ব্যতীত দুই নেই, দুই ব্যতীত তিন নেই, তিন ব্যতীত চার নেই, চার ব্যতীত পাঁচ নেই, পাঁচ ব্যতীত ছয় নেই, ছয় ব্যতীত সাত নেই, সাত ব্যতীত আট নেই, আট ব্যতীত নয় নেই, নয় ব্যতীত দশ নেই এবং দশ ব্যতীত কিছুই নেই। এ দশবিধ প্রশ্নের উত্তর শীঘ্র আমাকে প্রদান করুন।”
এ বলে দেবপুত্র অন্তর্হিত হলেন। দেবপুত্রের এ প্রশ্ন শুনে। রাজা অতিশয় ভীত ও ত্রাসিত হয়ে দেহ কম্পিত ও ঘর্ম বের হতে লাগল। একটি প্রশ্নের উত্তর ঠিক করতে পারলেননা। অতঃপর রাজা রাজাঙ্গনে অমাত্য প্রভৃতি রাজ্যবাসী জনগণকে একত্রিত করে সবাইকে বললেন–
ভবৎগণ অদ্য রাত্রে এক দেবপুত্র আমাকে দশটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন। আমি তার কোনই উত্তর দিতে পারিনি। “তবে যে কোন ব্যক্তি যদি সেই প্রশ্ন সমূহের উত্তর আমার নিকট প্রকাশ করেন, আমি তাকে অতি বিপুল ভাবে মহা যশঃ ও ধন-সম্পদ প্রদান করব।” তৎকালে রাজার সেবার্থ আগত এক ঘাতক রাজার এ ঘোষণা শুনে তখনিই গৃহে গিয়ে স্বীয় পুত্র ও ভার্যাকে রাজার ঐ ঘোষণা প্রকাশ করল। বোধিসত্ত্ব ত্ৰিহেতুক প্রতিসন্ধি প্রজ্ঞা সম্পন্ন। তিনি ঘাতকের কথা শুনে বললেন–“বাবা, আমিই সে দশবিধ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করব। এ দশবিধ প্রশ্ন এবং আরো যদি কোন প্রশ্ন থাকে, তাও আমাকে বলবেন।” তখন ঘাতক পর দিবসেই ব্ৰহ্মদত্ত রাজার নিকট গিয়ে বললেন–“মহারাজ, আমার পুত্র আপনার প্রশ্নের ব্যাখ্যা করবে। “তা কি তুমি সত্যিই বছ?” ঘাতক বলল“মহারাজ, এখন আমি গৃহে গিয়ে পুত্রকে তা পুনঃ জিজ্ঞেস করব।” এ বলে ঘাতক ত্বরিত গমনে স্বীয় গৃহে গিয়ে বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞেস করল–বাবা, তুমি যে দশবিধ প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে পারবে, তা কি সত্যিই বলছ? মহাসত্ত্ব বললেন–হাঁ বাবা, আমি সত্যিই বলছি, রাজার সে প্রশ্ন সমূহের উত্তর প্রকাশ করব। শুধু সে প্রশ্নের উত্তর কেন, এরূপ অযুত প্রশ্নের উত্তর দানেও সক্ষম হব।” ঘাতক ইহা শুনে সানন্দে ত্বরিত গমনে রাজার নিকট গিয়ে বলল–“মহারাজ, আমার পুত্র এরূপ দশ প্রশ্ন কেন অযুত প্রশ্নের উত্তর প্রদানেও সক্ষম হবে।” তখন। ব্রহ্মদত্ত রাজা পরম প্রীত হয়ে বললেন–“বাবা, এখন তোমার। পুত্রের প্রতি কী ব্যবস্থা করতে হবে, তা আমাকে বল।” তখন ঘাতক পুনঃ স্বীয় গৃহে গিয়ে মহাসত্বকে রাজার ইচ্ছা জ্ঞাপন করল। তখন বোধিসত্ত্ব নিজের ইচ্ছিত সব বিষয় প্রকাশ মানসে বললেন–“বাবা, আপনি সমগ্র নগর সুসজ্জিত করায়ে আপনার গৃহ হতে রাজাঙ্গন পর্যন্ত সমতলভাবে রাস্তা তৈরী করান। তাও সুসজ্জিত করায়ে রাজাঙ্গনের মধ্যভাগে এক সুসজ্জিত মণ্ডপ তৈরী করান। তথায় মনোহর এক পালঙ্ক স্থাপন করে তাতে বিচিত্র সুসজ্জিত শয্যা পাতিয়ে রাখা হউক। সে মনোহর শয্যায় শ্বেতছত্র স্থাপন করে রাখা হউক। তৎপর একটা মঙ্গল হস্তী বিশেষ ভাবে অলঙ্কৃত করে আমার নিকট আনয়ন করা হউক। তখন আমি সে মঙ্গল হস্তীর স্কন্ধে আরোহণ করে তথায় যাব এবং সে পালঙ্ক শয্যায় উপবেশন করে রাজার ঐ দশবিধ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করব।’ তখন ঘাতকও রাজার নিকট গিয়ে বোধিসত্ত্বের কথিত কথা যথাযথভাবে বলল। রাজাও তখন। বোধিসত্ত্বের কথিতানুসারে নগর রাস্তাদি সব সজ্জিত করালেন। রাস্তার উভয় পার্শ্বে কদলী বৃক্ষ ও ইক্ষু রোপন করালেন। পূর্ণ ঘট, ধ্বজা, পতাকা, ফুল পল্লব ইত্যাদি রাস্তা শোভাকর বস্তু দ্বারা সজ্জিত করা হল। সুবর্ণ তারকা খচিত বিচিত্র বিতান রাস্তার উপরিভাগে টাঙ্গানো হল। রাস্তার উভয় পার্শ্বে ছত্র এবং চোমরাদি স্থাপন করে সারা রাস্তায় খই ও পুষ্প ছড়ানো হল। তৎপর বোধিসত্ত্বকে আগমনের জন্য মঙ্গল হস্তী পাঠিয়ে সাদরাহ্বান জ্ঞাপন করা হল। তখন বোধিসত্ত্ব নিজে সুসজ্জিত হয়ে রাজ প্রেরিত অলঙ্কৃত মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ পূর্বক অমাত্য, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি প্রভৃতি জনগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে যেই অলঙ্কৃত রাস্তায় রাজাঙ্গনে এসে মহাপালংকে শ্বেতছত্রতলে উপবেশন করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় সুশোভিত হলেন তৎক্ষণে ব্রহ্মদত্ত রাজা বোধিসত্নের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–“বাবা, আমার শ্বেতছত্রে অধিষ্ঠিত এক দেবপুত্ৰ নিজকে দৃশ্যমানাবস্থায় আকাশে উপবিষ্ট হয়ে দশটি প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন–। আমি সে প্রশ্ন সমূহের কোনই উত্তর দিতে পারিনি। এখন তুমিই সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কি? মহাসত্ত্ব বললেন–“সাধু মহারাজ এ প্রশ্ন সমূহের উত্তর আমিই আপনাকে প্রদান করব। তা কি কি প্রশ্ন আমাকে বলুন। তখন রাজা দেবপুত্রের কথিত নিয়মে সমস্ত প্রশ্নগুলি প্রকাশ করলেন–। বোধিসত্ত্ব নিজের প্রজ্ঞাবলেই এ প্রশ্নগুলির ভাবার্থ জ্ঞাত হলেন। তা আকাশ পথে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় প্রকট হল। তখন তিনি প্রজ্ঞাবলানুভাবেই সে প্রশ্নসমূহের মধ্যে প্রথম প্রশ্নের উত্তর প্রদানচ্ছলে নিক্ত গাথাটি বলেন–
৪। অদ্বিতীয় এক সত্ত্ব আছে মহারাজ, তিনি হলেন বুদ্ধ এই ধরামাঝ।।
তৎক্ষণে ব্রহ্মদত্ত রাজার শ্বেতছত্রে অধিষ্ঠিত দেবপুত্র বোধিসত্ত্বের প্রথম প্রশ্নের উত্তর শুনে সাধুবাদ দিয়ে আকাশ হতে সপ্তবিধ রত্ন বিকীর্ণ করে সেই ধর্মদেশন পূজা ও প্রশংসা করলেন। রাজাও সেই মঙ্গল হস্তী দ্বারা বোধিসত্ত্বের কথিত ধর্ম পূজা করলেন। তারপর মহাসতু দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দানচ্ছলে। নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেনঃ
৫। দ্বিতীয় ব্যতীত তৃতীয় নাই–অগ্রশ্রাবকদ্বয়,
ইহাই মহারাজ জানুন নিশ্চয়।
এবারও সে দেবপুত্র পূর্বের ন্যায় বোধিসরে ধর্মদেশন পূজা সৎকার করলেন। রাজাও নিজের মঙ্গল অশ্ব দ্বারা বোধিসত্নের ধর্মদেশনা পূজা সৎকার করলেন। তারপর বোধিসত্ত্ব তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর দানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেনঃ
৬। যে কোন বুদ্ধের শাসনে সদা ত্রিশরণ ছাড়া,
চতুর্থ শরণ কভু নাহি এ ধরায়।
বুদ্ধ ধর্ম সংঘ শরণ,
এ ত্রিশরণ সদা হয় অন্যথা না হয়।
দেবপুত্র পূর্বের ন্যায়ই বোধিসত্ত্বের পূজা সকার ও সাধুবাদ প্রদান করলেন। ব্রহ্মদত্ত রাজাও নিজের দাসী, দাস এবং গরু মহিষাদি প্রত্যেকটি এক একশত করে বোধিসত্ত্বের দেশিত ধর্ম পূজা করলেন। তৎপর মহাসত্ত্ব চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৭-৮। চার ব্যতীত পাঁচ কভূ নাহি মহারাজ চারি পরিশুদ্ধি শীল হয় পঞ্চ কভূ নয় বুদ্ধের শাসনে। প্রতিমোক্ষ, ইন্দ্রিয় সংবর শীল, আজীব পরিশুদ্ধ আর প্রত্যয় সন্মিশ্রিত শীল, এই হল চারি প্রকার শীল, বুদ্ধের দেশিত।
এবারেও দেবপুত্র পূর্ববৎ বোধিসত্ত্বকে পূজাসষ্কার সহকারে সাধুবাদ প্রদান করলেন। রাজাও নিজের বস্ত্রাগার বিবৃত করায়ে মনোরম বিচিত্র শ্রেষ্ঠ বহু বস্ত্ৰ লয়ে বোধিসত্ত্বের ধর্মদেশনা পূজার্থ প্রদান করলেন।
তৎপর বোধিসত্ত্ব পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর প্রদানচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৯। মহারাজ, পঞ্চবিধ শীল হয় নিত্য রক্ষিবার,
দৃষ্ট কভূ নাহি হয় এই বসুধায়। এবারও দেবপুত্র পূর্বের ন্যায় বোধিসত্ত্বকে পূজাসঙ্কার সহ সাধুবাদ প্রদান করলেন। রাজাও স্বীয় ষোল সহস্র নর্তকী প্রদান করলেন। তৎপর বোধিসত্ত্ব ষষ্ঠ প্রশ্নোত্তর প্রকাশ মানসে নিতাক্ত গাথাটি বললেন–।
১০। ছয় ব্যতীত সাত নাই দেবলোক কভু। কামাবচর দেবতোক ছয়টি মাত্র থাকে সদা অন্যথা না হয়।
এবারও দেবপুত্র পূর্বের ন্যায় পূজা সত্ত্বার পূর্বক সাধুবাদ প্রদান করলেন। রাজা কোটি সহস্র সুবর্ণ রৌপ্য দ্বারা বোধিসত্ত্বের দেশিত ধর্মের পূজা করলেন। বোধিসত্ত্ব সপ্তম প্রশ্নের উত্তর দান মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১১-১২। সপ্তবিধ বোজ়ঙ্গ আছে মহারাজ তা কভু অষ্টম না হয় নৃপবর। বুদ্ধ ভাষিত ইহা ধারণ কর সদা। স্মৃতি, ধর্মবিচয়, বীর্য, প্রীতি, প্রশ্রদ্ধিও আর, সমাধি, উপেক্ষা সহ হয় এসপ্তবিধ বোজ্বঙ্গ অপার।
দেবপুত্র তখনো পূর্বের ন্যায় বোধিসত্ত্বকে পূজাসষ্কার করে সাধুবাদ প্রদান করলেন। রাজা নিজের স্ত্রী পুত্র দান করে বোধিসত্নের দেশিত ধর্ম পূজা করলেন। তারপর মহাসত্ত্ব অষ্টম প্রশ্নের উত্তর প্রদান কল্পে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১৩। মহারাজ, অষ্টশীল আটটি ব্যতীত নবম কভু নাই। সেরূপ অষ্টাঙ্গিক মার্গ সদা দেখতে পাই।
১৪। সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য আর সম্যক জীবিকা, সম্যক চেষ্টা, সম্যক স্মৃতি সার। সমাধি আর সম্যক কর্মান্ত, এ অষ্টবিধ মার্গ, এসব নবম কভু না হয় কদাচন। তখনো দেবপুত্র পূর্বের ন্যায় বোধিসত্ত্বকে পূজা সকার করে সাধুবাদ প্রদান করলেন। তৎপর মহাসত্ত্ব নবম প্রশ্নের উত্তর প্রদান কল্পে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
১৫। নববিধ আছে রাজন দশ কভু নাই।
নববিধ লোকুত্তর ধর্ম জানহে সবাই।
১৬। চারি প্রকার মার্গচিত্ত চারি প্রকার ফলচিত্ত হয়।
এক প্রকার মাত্র নির্বাণ চিত্ত মোট নব প্রকার হয়।
এবারও দেবপুত্র পূর্বের ন্যায় বোধিসত্ত্বকে পূজা সঙ্কার করার পর সাধুবাদ প্রদান করলেন। রাজাও নিজেকে নিজে দান। করে ধর্ম দেশনা পূজা সকার মানসে সাধুবাদ প্রদান করলেন। তৎপর মহাসত্ত্ব ব্রহ্মদত্ত রাজার দশম প্রশ্নের উত্তর প্রদান কল্পে নিজে গাথাটি ভাষণ করলেন–
১৭। দশ ব্যতীত এগার নাই এধরায় রাজন,
দশবিধ শীল যতনে সদা করেন পালন।
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষ হইলে দেবপুত্র মহাসত্ত্বকে সাধুবাদ প্রদান পূর্বক আকাশ হতে সপ্তবিধ রত্ন বিকীর্ণ করে ধর্মদেশনার পূজা সকার করলেন। ব্রহ্মদত্ত রাজাও বোধিসত্ত্বের দশবিধ প্রশ্নের উত্তর শ্রবণ করে অত্যন্ত সন্তোষ হলেন। তাই তিনি সমগ্র বারাণসী নগর দ্বারা বোধিসত্ত্বকে পূজা সৎকার করলেন। তখন অমাত্য ব্রাহ্মণ ও গৃহপতি প্রভৃতি রাজাঙ্গনে সমবেত মহাজনগণ বোধিসত্ত্বের প্রশ্ন বিসর্জন শুনে অত্যন্ত তুষ্ট হলেন। তখন তারা শতশত সাধুবাদ প্রদান পূর্বক স্বীয় স্বীয় আভরণভাণ্ড বোধিসত্ত্বকে সাদরে প্রদান করলেন এবং অজস্র বস্ত্র উৎক্ষিপ্ত করে বাহবা প্রদান করলেন। তখন তথায় মহাসত্ত্বের বিরাট ধনরাশি ও বস্ত্র পুঞ্জ লাভ হল। দেবপুত্র পুনঃ। আকাশ হতে নানাবিধ দিব্য বস্ত্র, দিব্য পুষ্প ও দিব্য রত্ন সমূহ বিকীর্ণ করে বোধিসত্ত্বের প্রশংসা করে তথায় উপবিষ্ট রাজাকে বললেন–“মহারাজ, ইনি আপনারই পুত্র। অন্যের পুত্র নহে। এ সুবর্ণ কুমার মহাপ্রজ্ঞাবান ও বিশারদ এবং তিনি আপনারই প্রতিশরণ। স্বীয় প্রজ্ঞা প্রভাবে জগতে তিনি অতুলনীয় শ্রেষ্ঠ। আপনার ঔরষেই এ সুবর্ণ কুমারের জন্ম। মহারাজ এ কুমার সত্যই আপনার পুত্র। এ বিষয়ে আপনি কোন সন্দেহ করবেন না। এ বলে দেবপুত্র বোধিসত্ত্বের মহা প্রজ্ঞাগুণের কথা প্রকাশ করতঃ ব্রহ্মদত্ত রাজা ও মহাজন গণকে উপদেশ প্রদান করে সেস্থান হতে অন্তর্হিত হলেন। বোধিসত্ত্বের উপদেশ শুনে সে। ঘাতক নিজ কৃত সব বিষয় রাজাকে বলল। রাজা তা শুনে অতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বহু ধন প্রদান করলেন এবং বোধিসত্ত্বকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তাঁর মাতাকেও এনে নিজের অমহিষীর স্থান প্রদান করলেন। বোধিসত্ত্ব রাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার পর হতে পিতাকে ও রাজ্যবাসী মহাজন সঙ্ঘকে সর্বদা উপদেশ দিতেন। এখন বোধিসত্ত্ব স্বীয় পিতা ব্রহ্মদত্ত রাজাকে দশবিধ রাজ ধর্মকর্মাদি দেশনাচ্ছলে নিন্মোক্ত দ্বাদশটি গাথা ভাষণ করলেন–
১৮-২৯। দান শীল, ত্যাগ ধৰ্মত জীবিকা, দয়া, তপ, অক্রোধ, অহিংসা, ক্ষান্তি, সত্য। এ দশটি বিষয় বলা হয় রাজ ধর্ম সার। এ দশবিধ ধর্ম যার নিত্য সহচর, সে রাজা নিজকে নিজে দেখে তুষ্ঠে বারম্বার। অন্নদানে বলবান ধনদানে হয়। ধনবান, ভোগ্য বস্তু দানে হয় বর্ণবান। যান দানে সুখী হয়, যশঃ দানে হয় যশবান, দীপদানে চক্ষুম্মান, অগ্নি দানে তেজবান। পানীয় দানে তৃপ্তিবান, প্রীতি দানে হয় নিত্য প্রীতিবান ধর্মদানে প্রজ্ঞাবান, শীলবানগণ সদা হয় সুশ্রী রূপবান। দান দেওয়া উচিত সদা, তথা শীল রক্ষা করাও উচিত। ভাবনাও করা উচিত, এইসব নিত্য করণীয়। বিবিধ আমিষ দানে চক্রবাল যদি পূর্ণ করা হয়, মহাফল হয় বটে, কিন্তু মৈত্রী ভাবনার ফল সম কভু নাহি হয়। সপ্ত বর্ষ মৈত্রী চিত্ত করিলে ভাবন, মহাফল হয় বটে কিন্তু, বিলক্ষণ ভাবনার ফল তুল্য কভু নাহি হয়। বুদ্ধের প্রতি চিত্ত করি প্রসাদিত, মৈত্রী চিত্ত সাদরে করিলে ভাবনা, তাহা হয় অতি সুখাবহ জানিও নিশ্চয়। ধর্মে চিত্তে প্রসাদন বিপুল ভাবে মৈত্রী ভাবনা, সাগ্রহে ইহা। করিলে ভাবনা, মহাহিত হয় সদা জানহে সুমনা। সংঘের প্রতি সুপ্রসন্ন মনে, বহুল ভাবে মৈত্রী ভাবনা যদি করা হয়, তাহা স্বর্গ দায়ক জানিও নিশ্চয়। তদ্ধেতু পণ্ডিতগণ স্বীয় সুখ করিয়া কামনা, সাদরে সবাই করে দান শীল ভাবনা।।
সে হতে মহাসত্ব দেবলোকে গমনের উপায় দেশনা করতেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৩০। সুবর্ণ কুমার রাজধর্মে স্থিত থাকি অনুক্ষণ,
মহাজনতাকে পুনঃ পুনঃ উপদেশ করি সম্প্রদান,
স্বর্গ সুখের জন্য মহাজনগণ দিয়ে
অনুক্ষণ পুণ্যকর্ম করাতেন সাগ্রহ করিয়ে।
মহাসত্ত্বের উপদেশ শুনে সমস্ত জনগণ দেবলোকে উৎপন্ন হবার জন্য উৎসাহিত হয়ে পরকে দানাদি পুণ্যকর্ম সমূহ করতে লাগলেন। মহাসত্ত্বও অগাধ রাজ সম্পত্তি পরিভোগ করতঃ দানাদি পুণ্য কর্ম করতে লাগলেন। তিনি যথায়ুষ্কাল স্থিত থেকে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। শাস্তা ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করে বললেন–হে ভিক্ষুগণ তথাগত শুধু এখন যে প্রজ্ঞাবান, প্রত্যুৎপন্নমতি ও তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞা, তা নয়, পূর্বে তথাগত সংসারে সংসরণ করবার কালেও মহা প্রজ্ঞাবান ছিলেন। এবলে ধর্মদেশনার আদি-মধ্য শেষ পৰ্য্যায় উল্লেখ পূর্বক এজাতক সমাপন করে নিন্মোক্ত পাঁচটি পরিচিতি গাথা ভাষণ করলেন–
৩১-৩৫। তখনকারের সে ঘাতক ছিল এ আনন্দ যতি। তখনকারের মাতা ছিল মম মহামায়া সতী। তখনকারের ব্রহ্মদত্ত এখন মম পিতা শুদ্ধোদন হয়। দুষ্টচিত্ত রাজ কন্যা এখন হয় চিঞ্চা মানবিকা। অমাত্য প্রমুখ রাজ পরিষদ আর রাজ্যবাসী জনগণ, মম পরিষদ বৃন্দ, তারা আমার শাসন পূরক অনুক্ষণ। সুবর্ণ কুমার নামক সদ্ধর্মে স্থির মহারাজ বর, আমিই সম্বুদ্ধ তথাগত লোকনাথ এখন। সর্বভবের শ্রেষ্ঠ সুখ প্রার্থনাকারী নরগণ, অতীব গৌবর চিত্তে এজাতক করহ ধারণ।
(সুবর্ণ কুমার জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply