জাতক পঞ্চাশক – ২য় দশক
১১. সুধনকুমার জাতক
“হে মহাব্যাধ, তুমি কোথা হতে আছ?” এ বিষয় শাস্তা জেতবনে বাস করবার সময় জনৈক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুকে উপলক্ষ্য করে বলেছিলেন–।
একদা এক ভিক্ষু ভিক্ষাচরণ কালে অপরূপ রূপলাবণ্যবতী এক নারী তাঁর দৃষ্টিপথে পতিত হল। তিনি এ নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পিণ্ডাচরণ হতে প্রত্যাবর্তন করে পাত্রটি একস্থানে রেখে অধধামুখী হয়ে বসে রইলেন। তার এক বন্ধু ভিক্ষু তাঁকে এরূপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস্ করলেন–“বন্ধু, আপনার কি অসুখ বোধ হচ্ছে?” প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন–“বন্ধু, আমার তেমন কোন অসুখ বোধ হচ্ছে না। তবে অদ্য আমি গ্রামে পিণ্ডাচরণ করবার কালে অভিরূপা এক নারী দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছি।” তাঁর একথা শুনে বন্ধু ভিক্ষু তাঁকে বহু প্রকার উপদেশ দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর উপদেশ কোনই কার্যকরী হল না। তখন বন্ধু ভিক্ষু তাকে সঙ্গে করে ধর্মস্বামী শাস্তার নিকট উপনীত হয়ে বললেন–“ভন্তে ভগবান, এ ভিক্ষু উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। ইনি যাতে আপনার শাসনে অভিরমিত হন, করুণা করে তাঁকে সেরূপ উপদেশ প্রদান করুন। তখন ভগবান সেই উত্তষ্ঠিত ভিক্ষুকে জিজ্ঞেস্ করলেন–“সত্যই কি তুমি উৎকণ্ঠিত হয়েছ?” ভিক্ষু বললেন–“হাঁ ভন্তে সত্য।” কি কারণে উকষ্ঠিত হয়েছ? আমি মাতৃজাতির কারণে উল্কণ্ঠিত হয়েছি।” তৎপর শাস্তা বললেন–“ভিক্ষু, চিত্তকে এরূপ ক্লিষ্ট করা উচিত নয়। তুমি একান্তই শ্রদ্ধায় ভোগেশ্বর্য ও জ্ঞাতিগণ ত্যাগ করে নৈবার্ণিক ধর্মের আশ্রয়ে পবিত্র শাসনে প্রব্রজিত হয়েছ। কলুষ ক্ষয়কর শমথবিদর্শন ভাবনা ত্যাগ করা তোমার একান্তই অনুচিত। ভিক্ষু, তুমি অশুভ কর্মস্থান ভাবনা কর। এ ভাবনা দ্বারা তোমার অনুরাগচিত্ত প্রহীণ হবে। শাস্তা এরূপে সেই ভিক্ষুকে অনেক প্রকার উপদেশ দেওয়ার পর তথায় সমবেত ভিক্ষুদের নিকট স্বীয় পূর্বচরিত প্রকাশ করবার ইচ্ছায় বললেন–হে ভিক্ষুগণ, নারীর রূপ পুরুষের চিত্তকে পরিগ্রহণ করে স্থিত হয়। তদ্ধেতু তোমার মত পৃথগৃজনের চিত্তে নারী-রূপের প্রতি উৎপন্ন আসক্তি ভাবনা ব্যতীত ত্যাগ করা বড়ই দুষ্কর। পূর্বেও পুরাতণ পণ্ডিতগণ নারীর জন্য নিজের বিশাল রাজ্যশ্রী, পিতা-মাতা এমন কি স্বীয় জীবনের প্রতিও দৃক্পাত না করে নারীর। অন্বেষণে ভ্রমণ করেছিলেন।” এ বলে ভগবান নীরব হলেন। তখন ভিক্ষুদের প্রার্থনায় বুদ্ধ সে অতীত বিষয় বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে উত্তর পঞ্চাল নগরে “আদিত্যবংশ” নামক এক নৃপতি ধর্মতঃ সাম্যভাবে রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল “চন্দ্রাদেবী।” ইনি শীলবতী ও দান পরায়ণা ছিলেন। সে সময় বোধিসত্ত্ব তাবতিংশ স্বর্গ হতে চন্দ্রাদেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর প্রতিসন্ধিক্ষণেই মহাপৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। পর্বতরাজ সুমেরু নমিত ও মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং বহুবিধ আশ্চর্য ঘটনার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। মহাসত্ত্বের অনুভাববলে রাজ প্রাসাদের চার পার্শ্বে চারটি নিধিকুম্ভ উৎপন্ন হয়ে বালুকার নিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাণী চন্দ্রাদেবী দশ মাস পরে সুবর্ণ প্রতিমার ন্যায় এক পুত্র সন্তান। প্রসব করলেন। বোধিসত্ত্বের ভূমিষ্ঠ দিবসেই উক্ত নিধিকুম্ভ চতুষ্টয় ভূমিতল হতে উখিত হয়ে দৃশ্যমানাবস্থায় সংস্থিত হয়েছিল। আদিত্যবংশ রাজা এ সব আশ্চর্য বিষয় দেখে “আমার পুত্র নিশ্চয়ই মহানুভাব সম্পন্ন হবে।” এমনে করে পুত্রের নামকরণ করা হল “সুধনকুমার।” ইনি ক্রমে বয়ষ্ক হলে অতি রূপ লাবণ্যে বিমণ্ডিত অপূর্ব শ্রীধর এবং মানবাতীত কামাবচর দেবপুত্রের ন্যায়ই হয়েছিলেন। সুধনকুমার ক্রমশঃ ধনুবিদ্যাদি সব শিল্প শিক্ষা করে পিতা-মাতাকে তাঁর শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় দিলেন। পুত্রের এ সব আশ্চর্য গুণে মুগ্ধ হয়ে পিতা তাঁকে রাজ্যভার অর্পণ করলেন। বোধিসত্ত্ব পিতার মর্যদা রক্ষার নিমিত্ত রাজ্যভার গ্রহণ করে পুনঃ তা পিতৃ-হস্তে সমর্পণ করলেন।
তখন উত্তর পঞ্চাল নগরের পশ্চিম ভাগে একটি সরোবর ছিল। তথায় “জমুচিত্ত” নামক এক নাগরাজ বাস করত। প্রত্যেক বসর উত্তর পঞ্চালবাসী সবাই পুষ্প গন্ধাদি পূজোপচার নিয়ে ঐ সরোবর তীরে উপস্থিত হয়ে পূজা দিয়ে করজোড়ে প্রার্থনা করতেন–“প্রভু নাগরাজ, আমাদের নগর যেন শস্য সম্পন্ন ও সুভিক্ষ হয়, আপনি সেরূপই ব্যবস্থা করবেন।” সে নাগরাজ গ্রামবাসীদের এরূপ সশ্রদ্ধ পূজাসঙ্কার লাভ করে তাদের প্রার্থনা পূর্ণ করতেন। নাগরাজের প্রভাবে সে নগরে সর্বদা সুবৃষ্টি বর্ষণ হত। তপ্রভাবে সর্বদা এ উত্তর পঞ্চাল রাজ্য সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা হয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল। তখন এ রাজ্যের পশ্চিম ভাগে ‘মহাপঞ্চাল’ নামক আর একটি নগর ছিল। একসময় সে নগরে মহাদুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হয়। তন্নিবন্ধন সে নগরবাসী জনগণ অতি দুঃখে-কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগল। কেহ কেহ ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে সেই দেশ হতে পালিয়ে উক্ত উত্তর পঞ্চাল নগরে এসে বাস করতে লাগল। কিছুদিন পরে মহাপঞ্চাল রাজা দেখলেন তাঁর সৈন্য-সামন্তের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস হয়ে যাচ্ছে। পূর্বে রাজা যাদেরকে সর্বদা দেখতেন, এখন তারা কেহ নেই। তাই তিনি স্বীয় অমাত্যবৃন্দকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন–“অমাত্যগণ, আমার রাজ্যে কেন মানুষের সংখ্যা কমিয়ে গিয়েছে? কেন বা জনবিরল বোধ হচ্ছে?” অমাত্যগণ বললেন–“দেব, বহু লোক এ রাজ্য হতে উত্তর পঞ্চাল রাজ্যে চলে গিয়েছে।” “কি কারণে তারা এ দেশ ত্যাগ করল?” “মহারাজ, সে নগরে এখন সুভিক্ষ। এ কারণে অনেক লোক এখান হতে তথায় চলে গিয়েছে। রাজা পুনঃ জিজ্ঞেস্ করলেন–“কি কারণে সে রাজ্যটি এখন অতিশয় সুভিক্ষ হয়েছে?” মহারাজ, ‘জমুচিত্ত’ নামক এক নাগরাজ সেই নগরে অধিষ্ঠিত আছে। নাগরাজের প্রভাবে তথায় সর্বদা সুবৃষ্টি বর্ষিত হয়। তাই ঐ রাজ্যটি সর্বদা শ্ৰীসম্পন্ন ও সুভিক্ষ দিব্য নগরের ন্যায় প্রতিভাত হচ্ছে বলে শুনা যায়।” রাজা একথা শুনা মাত্রেই তাঁর শিরে যেন বজ্রাঘাত হল। ক্রোধে তিনি অগ্নিশর্মা হলেন। চিন্তা করলেন–“আমার সেনাগণ কেন অপরের অধীনে থাকবে? এরূপ ঈর্ষা মাৎসর্যের বশীভূত হয়ে উক্ত রাজ্য ও নাগরাজের ধ্বংস সাধনের জন্য কুর চিত্ত উৎপাদন করলেন। অমাত্য পরিষদে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করে পুনঃ অমাত্যগণকে বললেন–“আপনারা বলুন দেখি–কোন উপায়ে সেই রাজার শক্তি-সম্পদ বিনাশ সাধন। করতে পারি এবং নগরের সম্পদ বিধায়ক নাগরাজকে হত্যা করতে পারি?”
অমাত্যগণ বললেন–“মহারাজ, সেই নাগরাজ মহাঋদ্ধিবান ও মহানুভব সম্পন্ন। শস্ত্রের দ্বারা তাকে হত্যা করা সম্ভব হবে না। তবে তাকে মন্ত্র বলেই হত্যা করা যেতে পারে।” রাজা বললেন–“এরূপ মন্ত্র কে জানে?” অমাত্য বললেন–“মহারাজ, যে সব ব্রাহ্মণ মন্ত্র সাধ্যায়ণকারী, মন্ত্রধর, তারাই সে মন্ত্র জানবেন।” ইহা শুনে মহাপাল রাজা স্বীয় রাজ্যে ভেরী বাদ্যে ঘোষণা করে সাধ্যায়ণকারী মন্ত্রধর সহস্র ব্রাহ্মণ রাজাঙ্গণে সমবেত করালেন। সেই সহস্র ব্রাহ্মণ হতে প্রথম একশ ব্রাহ্মণ নির্বাচন করলেন। সেই একশ ব্রাহ্মণ হতে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ হতে দশজন, তা হতেও মাত্র একজন উত্তম বেদজ্ঞ মন্ত্রধর ব্রাহ্মণকে নির্বাচন করে রাজা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন–“হে মহাব্রাহ্মণ, আপনি “জমুচিত্ত” নামক নাগরাজের গ্রীবাদেশ বন্ধন করে অথবা হত্যা করে এখানে আনতে পারবেন কি? একাজে যদি সফলকাম হতে পারেন, তা হলে আপনাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দান করব।”
ব্রাহ্মণ রাজার কথা শুনে নিজের দক্ষতা দেখাবার ইচ্ছায় ও ঐশ্বর্য লোভে মত্ত হয়ে বললেন–“সাধু দেব, একে আমি এনে দেব।” ইহা শুনে রাজা তাকে কিছু অর্থ দিয়ে বললেন–“মহাব্রাহ্মণ, আপনি গৌণ করবেন না।” ব্রাহ্মণ বললেন–“দেব, আমি গিয়ে তাকে বেঁধে দুর্বল ও নিশ্চল করে আপনার নিকট শীঘ্রই নিয়ে আসছি। এবলে ব্রাহ্মণ স্বীয় গৃহে এসে চিন্তা করলেন–“এবার তাকে ধরব, সরোবর তীরে আমি অদ্য রাত্রি যাপন করে আগামী কল্য ঔষধ অন্বেষণ করব এবং প্রভাবে তাকে নিশ্চল ও দুর্বল করে বেঁধে রাজ-সমীপে এনে দিয়ে পুরস্কৃত হব।” এরূপ চিন্তা করে সূর্যাস্তের সময় মুখ প্রক্ষালণ করে শ্বেতবস্ত্র পরিধান করলেন এবং এক খণ্ড শ্বেতবস্ত্র একাংস করে উক্ত সরসী তীরে উপনীত হলেন। তথায় বাম হস্তে পুষ্প ও পূজা লয়ে দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে সুপর্ণরাজ ব্যবহৃত অলম্পায় নামক মন্ত্র জপ করতে আরম্ভ করলেন–। মন্ত্র তেজে নাগরাজের দেহে ভীষণ দাহ উৎপন্ন হল। দাহ-জ্বালা অসহ্য হওয়ায় নাগরাজ বাস-ভবন ছেড়ে জলের উপর ভেসে উঠল। সরোবর ভীষণ ঘন ধুমে অন্ধকারাচ্ছন্ন হল। মন্ত্রের এসব ক্রিয়া। দেখে ব্রাহ্মণ চিন্তা করলেন–“এখনি তাকে ধরতে পারব মনে। করিয়া অতিশয় আনন্দিত হলেন। তারপর তিনি মন্ত্র জপ সমাপন করে একস্থানে শয়ন করলেন। রাত্রির অবসানে প্রভাতেই ব্রাহ্মণ নাগরাজ গ্রহণের উপযোগী ঔষধ বৃক্ষ-লতাপাতা প্রভৃতি অন্বষণার্থ অরণ্যে প্রবেশ করলেন। এদিকে নাগরাজ সরোবরের তীরে উঠে ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করল। উদ্দেশ্য–“ওর উপকার লাভ হয়, তেমন কোন মানবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কিনা।” তখন ‘পুন্নরিক নামক জনৈক বনচর ব্যক্তি কোন কারণে উক্ত সরসীর তীরে আগমন করল। নাগরাজ তাকে দেখে চিন্তা করল–“এ ব্যক্তিই নিশ্চয় আমার বিপদ মুক্তির উপায় হবে।” এ মনে করে তাকে আহ্বান করে, সেখানে তার আগমনের কারণ নিন্মোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস করলেন–
১। হে মহাবল ব্যাধ, তোমায় জিজ্ঞেস করছি–আয়ুধ হস্তে কি কারণে এখানে এসেছ?” তা শুনে পুন্নরিক প্রত্যুত্তরে প্রদান ইচ্ছায় নিজে গাথায় বলল–
২। “হে মহাব্রাহ্মণ, আমি একাকী এ মহাশক্তিশালী আয়ুধহস্তে মৃগের অন্বেষণে বনে বনে বিচরণ করে কোন কোন সময় এখানে আগমন করি।”
নাগরাজ ব্যাধের পরিচয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আপনাদের উত্তর পঞ্চাল নগরে বর্তমান সুভিক্ষ না দুর্ভিক্ষ চলছে?’ তদুত্তরে ব্যাধ বলল–আমাদের নগর এখন বেশ সুভিক্ষে সমৃদ্ধ? নাগরাজ পুনঃ জিজ্ঞেস করল–“কি কারণে আপনাদের রাজ্য সুভিক্ষে সমৃদ্ধ? ব্যাধ বলল–‘মহাব্রাহ্মণ, এরাজ্যে ‘জমুচিত্ত নামক এক নাগরাজ বাস করেন। সে নাগরাজই আমাদের এ । রাজ্য রক্ষা করেন। তার প্রভাবেই আমাদের এ রাজ্য সুভিক্ষ ও সৌভাগ্যপূর্ণ হয়েছে। ইহা শুনে নাগরাজ জিজ্ঞেস করল–‘এ সৌভাগ্য দায়ক নাগরাজকে যদি কেহ নিস্পীড়ন করে অথবা হত্যা করে, তা হলে তাকে আপনি কি করবেন?” তখন ব্যাধ বীরস্বরে বলল–“কি বলেন ব্রাহ্মণ ঠাকুর! আমি ওর সাক্ষাৎ পেলে এখনি তার গ্রীবা হতে মস্তক বিচ্যুত করব। নাগরাজ বলল–‘ব্যাধ, আপনি তা কি সত্যই বলছেন? ব্যাধ বলল–হাঁ মহাব্রাহ্মণ, সত্যই বলছি।” তখন নাগরাজ বলল–‘বন্ধু, আমিই সে ‘জমুচিত্ত নাগরাজ। আপনি আমাকে রক্ষা করতে পারবেন কি? যদি না পারেন, তা হলে আমার মৃত্যু অনিবার্য।” ব্যাধ বলল–“কি কারণে আপনার মৃত্যু হবে? তখন নাগরাজ ব্যাধকে উক্ত মন্ত্র জপকারী ব্রাহ্মণের বৃত্তান্ত বলল। “ব্যাধ এ সব বিবরণ শুনে নাগরাজকে জিজ্ঞেস করল–“তবে এখন আমাকে কি করতে হবে?” নাগরাজ বলল–প্রিয় শিকারী, আপনি বৃক্ষের অন্তরালে ধনুতে শরযোজনা করে স্থিত থাকবেন। ব্রাহ্মণ যখন এ সরসী তীরে এসে মন্ত্র জপতে আরম্ভ করবে, তখন আপনি তাকে শরবিদ্ধ করবেন। তৎপর এসে তার মস্তকটি শক্ত ভাবে ধরে মস্তকোপরি খড়গধারণ করে এবলে তর্জন গর্জন করবেন–“রে দুষ্ট ব্রাহ্মণ, শীঘ্রই তোমার মন্ত্র তুলে নাও। যদি তা না কর, তবে এখানেই এ খড়গাঘাতে তোমাকে হত্যা করব।”
আপনার কথায় রাজী হয়ে সে যদি মন্ত্র তুলে লয়, এ সরোবরের জলও যদি প্রাকৃতিক নীলবর্ণ ধারণ করে, তখন। তাকে আপনার ইচ্ছানুযায়ী যা করণীয় তা করবেন।” এ বলে নাগরাজ স্বীয় বাসভবনে চলে গেল। তখন ব্যাধও পরামর্শ মতে আয়ুধে শর যোজনা করে বৃক্ষের অন্তরালে লুকিয়ে রইল। এমন সময় ঐ ব্রাহ্মণ পূজোপকরণ লয়ে সরসীর তীরে এসে পূজা করে মন্ত্র জপতে আরম্ভ করল। তখনই সরসীতে সধুম অগ্নি জ্বলে উঠল। তখন ব্যাধ এ সব ব্যাপার দেখে মন্ত্র পাঠে রত ব্রাহ্মণকে শরবিদ্ধ করে তন্মুহুর্তেই ব্রাহ্মণের সমীপে গিয়ে তার মস্তক দৃঢ়ভাবে ধরল এবং খড়গ উত্তোলন পূর্বক তর্জন গর্জন করে বলল–“রে দুষ্ট ব্রাহ্মণ, এ ‘জমুচিত্ত, নাগরাজ আমাদের দেবতা। কেন তুই তাঁকে এরূপ উৎপীড়ন করছিস্? তুই কার দূত, এরূপ জঘন্য কাজে তোকে কে নিয়োজিত করল? শীঘ্রই তোর মন্ত্র তুলে নে। না হয় এ খড়ুগাঘাতে তোর শিরচ্ছেদ করব।” ব্রাহ্মণ এ কথা শুনে মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে বলল–“প্রভু, একটু অপেক্ষা করুন। এখনি আমি মন্ত্র তুলে নিচ্ছি।” তারপর ব্যাধ দেখল–ব্রাহ্মণ মন্ত্র তুলে নেওয়ার সাথে সাথে সরোবরের জল প্রসন্ন ও প্রাকৃতিক ভাব ধারণ করল। তখন ব্যাধ চিন্তা করল–“এ পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণ জীবিত থাকলে, যে। কোনও সময়ে নাগরাজের অনিষ্ট করতে পারে।”এ চিন্তা করে খড়ুগাঘাতে ব্রাহ্মণের শিরচ্ছেদ করে এক প্রান্তে নিক্ষেপ করল। তখন নাগরাজ নির্ভীক চিত্তে স্বীয় ভবন হতে বের হয়ে বনচারী বেশে অই ব্যাধের নিকট উপস্থিত হল এবং থাকে স্বীয় ভবনে নিয়ে গেল। “এ ব্যাধ আমার বহু উপকারী, জীবনদাতা” এ চিন্তা করে নাগভবনে সাতদিন যাবৎ তার বিপুলভাবে পূজাসৎকার করল। অতঃপর ব্যাধ বেশে প্রত্যাবর্তন সময় নাগরাজ তাকে বহু মহার্ঘ রত্ন প্রদান করল এবং বলল–“বন্ধু, আপনি কোনদিন আমার প্রয়োজন মনে করলে, এ দ্বারপালের নিকট উপস্থিত হবেন। তখন আমার সাক্ষাৎ পাবেন।” এ বলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করে বিদায় দিন।
৩। “বন্ধু, আপনার গৃহে সোজা চলে যান। তথায় গিয়ে জ্ঞাতিদের সহিত চিরজীবি হয়ে থাকুন।”
এরূপে নাগরাজ ব্যাধকে বিদায় দিয়ে নিজে স্বীয় ভবনে প্রত্যাগমন করল। কিছুদিন পরে উক্ত ব্যাধ মৃগয়া উদ্দেশ্যে বনে প্রবেশ করে বন হতে বনান্তরে ঘুরাফেরা করে ক্রমে হিমালয়ের পাদদেশে উপস্থিত হল। তথায় এক আশ্রম দেখল। সে। আশ্রমে তখন বাস করছেন “কশ্যপ” নামক এক ঋষি। ব্যাধ ধনু-তুণ এক স্থানে রেখে আশ্রমে প্রবেশ করল এবং ঋষিকে বন্দনা করে একান্তে উপবেশন করল। তখন তাপস ব্যাধকে গাথায় জিজ্ঞেস করলেন—
৪। “তুমি অতি দূরদেশ হতে একাকী অসহায় অবস্থায় এ মহা অরণ্যে কোন্ উদ্দেশ্যে এসেছ?” ব্যাধ নিন্মোক্ত গাথাযোগে বলল
৫। “প্রভূ, আমি মৃগয়ার্থ এ মহাবনে সিংহের ন্যায় নির্ভীকভাবে একাকী বিচরণ করছি।” ব্যাধ তাপসকে এ বলে মৃগয়ার উদ্দেশ্যে পুনঃ অরণ্যে প্রবেশ করল। কিছুদূর গিয়ে দেখল–সুন্দর বিবিধ তরুলতা সজ্জিত এক মনোরম উদ্যান। তার মধ্যভাগে পঞ্চবিধ পদ্ম সুশোভিত এক সরোবর। এর তীরে চম্পক-মল্লিকাদি বিবিধ পুষ্প বৃক্ষে পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়ে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। এ চমক্কার দৃশ্য দেখে ব্যাধ পুনরায় তাপসের নিকট উপনীত হয়ে বন্দনান্তর নিন্মোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস করল
৬। “প্রভূ, আমি অনতিদূরে এক মনোরম বাগান। দেখলাম। এর মধ্যস্থলে চম্পকাদি নানা সুগন্ধি পুষ্প বৃক্ষে সুশোভিত এক মনোরম পুষ্করিণী। এ মহারণ্যে এরূপ মনোরম দৃশ্য দেখে কৌতুহলাক্রান্ত হয়ে আপনার নিকট জানতে এসেছি–কাদের দ্বারা সেবিত হয় এ মনোরম উদ্যান ও পুষ্করিণী?” তাপস নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
৭। “এ সব নিষ্প্রয়োজন বিষয় কেন তুমি জিজ্ঞেস করছ” তুমি এখনই এখান হতে চলে যাও। এ সব বিষয় আমাকে জিজ্ঞেস্ করা তোমার পক্ষে অযৌক্তিক।”
তাপসের কথা শুনে ব্যাধ উক্ত পুষ্করিণী তীরে এসে এক ঝােপে গোপন করল। সেদিন ছিল পূর্ণিমার উপোসথ। এ দিবস কৈলাস পর্বত শিখরবাসী কিন্নররাজ “দুমের” সপ্তকন্যা সহস্য কিন্নরী পরিবৃতা হয়ে আকাশ পথে এসে ঐ পুষ্করিণী তীরে অবতরণ করল। তথায় তারা বীণা-বাদ্যে সুতান লহরীর সমতালে নীত্য-গীতে রমিত হয়োন ও জলক্রীড়ার পর পুনরায় আকাশ পথে কৈলাস পর্বত মস্তকে চলে গেল। তখন বনচর ব্যাধ তাদের অভূতপূর্ব রূপ-লাবণ্য সম্পদ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চিন্তা করল–“অহো, এমন রূপবতী কুমারীদের মধ্যে যে সবচেয়ে সুন্দরী, তাকে যে কোন উপায়ে ধরে নিয়ে আমার প্রভু সুধন কুমারকে উপহার দিতে পারলে বড়ই উত্তম। কাজ হতো।” এ চিন্তা করে পুনরায় সে উক্ত তাপসের নিকট গিয়ে বন্দনান্তে তাঁকে নিন্মোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস্ করল
৮। “আমি অত্যন্ত রূপবতী বহু কিন্নরী দেখেছি। তা হতে একটি সেরা সুন্দরী কিন্নরী আমি চাই। তা কিরূপে লাভ করব, আমায় বলুন।” তাপস বললেন–
৯। “হে ব্যাধবর, এদের শ্রেষ্ঠ রূপবতী কিন্নরী লাভ করতে হলে তোমায় ‘নাগপাশ’ আনতে হবে।”
১০। “নাগপাশ বিনা কিন্নরী লাভ করা সম্ভব হবে না। তুমি প্রথম নাগপাশ নিয়ে আস, তারপর বলবে কিন্নরী লাভের কথা।” ব্যাধ পুনঃ নিন্মোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস করল
১১। “ভদন্ত, সে নাগপাশ কি, কোথায় পাওয়া যায় কিরূপে তা জানব? এর সন্ধান আমাকে শীঘ্রই বলুন, যাতে
আমি লাভ করতে পারি।” তাপস বললেন–
১২। “হে ব্যাধ, নাগপাশ হল সর্পরূপ বন্ধন করবার পাশ। এ নাগাকার পাশ আড়াই পাঁচের গ্রন্থি। ইহা নাগলোকেই পাওয়া যায়। যদি সেখান হতে তা আনতে পার, তবেই পাবে সেই শ্রেষ্ঠ রূপবতী কিন্নরী।”
ইহা শুনে ব্যাধের স্মরণ হল, তার বন্ধু নাগরাজের কথা। সে সন্তোষ মনে তাপসকে বন্দনা জানিয়ে বিদায় নিল এবং ঐ বন্ধু নাগরাজের নিকট উপনীত হল। নাগরাজের পূর্ব ঈঙ্গিত মতে প্রথম নাগভবনের দ্বারপালের নিকটই উপস্থিত হয়েছিল। দ্বারপাল তখনই ব্যাধকে নাগরাজের নিকট নিয়ে গেল। নাগরাজ তাকে দেখে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৩। “হে বন্ধু, কি জন্য আমার নিকট এসেছেন? তা বলুন। আমি আপনার মনোরথ পূর্ণ করব।” বনচর বলল
১৪। “আমি আপনার নিকট ‘নাগপাশ’ প্রার্থনা করতে এসেছি। হে মহের্ধি নাগরাজ, আমাকে শীঘ্রই তা প্রদান করুণ। তা শুনে নাগরাজ বিমর্ষ হয়ে বলল
১৫। ১৬। “বন্ধু আপনি আমার নিকট অন্য ধন যাঞ্চা করুন। নাগপাশ আমার জীবন রক্ষার আয়ুধ। যখন গরুড় পক্ষী এসে আমাকে ধরতে চায়, তখন আমি নাগপাশ গ্রহণ করি। তা দেখে গরুড় ত্রাসিত হয়ে পলায়ন করে।”
তা শুনে ব্যাধ বলল–“বন্ধু, আপনি আমাকে বঞ্চনা না করে নাগপাশ দিয়ে দিন।” তখন নাগরাজ চিন্তা করল–“এ ব্যাধ আমার মহা উপকারী, জীবনদাতা। সুতরাং আমার জীবিতাবস্থায় এর প্রার্থিত দ্রব্য না দেওয়া উচিত হবে না।” ইত্যাদি চিন্তা করে নিজের ‘নাগ-পাশ’ প্রাণ রক্ষার আয়ুধ ব্যাধকে প্রদান করল। এতে ব্যাধ অত্যধিক সন্তুষ্ট হয়ে সে। নাগরাজকে স্তুতি বাক্যে বলল
১৭। “হে জম্বুচিত্ত, আমি মিত্রতার সন্বিষ্টিক ফল লাভ করলাম। আপনি উপকারীর উপকার স্বীকার করলেন।”
তৎপর নাগেন্দ্র তাকে সঙ্গে করে মনুষ্য-পথে এসে বলল‘বন্ধুবর, আপনার অন্য কোনও বিষয়ের প্রয়োজন হলে আমার নিকট আসবেন। যদি আমার অসাধ্য নয়, নিশ্চয়ই আপনার উপকার করব।” এবলে উভয় বন্ধু পরস্পর বিদায় নিয়ে প্রস্থান করল। ব্যাধ আনন্দ মনে কশ্যপ তাপসের আশ্রমে উপস্তিত হয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করল এবং উক্ত পুষ্করিণীর তীরে পূর্বের ন্যায় দ্য গোপন করে অপেক্ষা করতে লাগল। সে রাত্রেও দুমরাজের সপ্তকন্যা দিব্য বস্ত্রালঙ্কারে সুসজ্জিতা হয়ে সহচরী কিন্নরীদের সঙ্গে লয়ে আকাশ পথে এসে উক্ত সরসী তীরে অবতরণ করল। তখন তারা পূর্বের ন্যায় বীণা বাদন ও নৃত্য গীতের পর দুমরাজের সপ্ত রাজ-দুহিতা স্বীয় স্বীয় অলংকার সমুহ উন্মোচন করে পুকুরে অবতরণ করল এবং জলক্রীড়া সমাপণ করার পর তীরে উঠে সবাই বেশ ভুষায়। সুসজ্জিতা হল। তনুহূর্তে ব্যাধ অন্তরাল হতে বের হয়ে নাগপাশ নিক্ষেপ করল। দুমরাজের জ্যেষ্ঠ কন্যা “মনো-হরাই এ পাশে বন্দিনী হল। তখন ব্যাধকে দেখেই অবশিষ্ট রাজকন্যা সহ সমস্ত কিন্নরীগণ আকাশ পথে পলায়ন করল। তারা কিছু দূর গিয়ে মনোহরাকে না দেখে সন্দিগ্ধ চিত্তে আবার প্রত্যাগত হয়ে দেখল–মনোহরা নাগ-পাশে আবদ্ধ হয়েছে। এতে তারা। রোদন বিধুর অন্তরে রোদন ও বিলাপ করতে করতে পলায়ন করল। এবিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
১৮। “মনোহরা দেবী নাগ-পাশে আবদ্ধ হয়েছে দেখে কিন্নরীগণ ভীতা ও সন্ত্রস্ত হয়ে রোদন ও বিলাপে নিরত হল এবং মর্মান্তিক দুঃখানুভব করতে লাগল।” কিন্নরিগণ এবলে তাদের মনোবেদনা নিন্মোক্ত গাথায় ব্যক্ত করল–
১৯-২২। এখানে পূর্বে আমরা নিরাপদে ক্রীড়া করতাম। এতদিন কোনও প্রকার ভয়ের কারণ দেখিনি। কোন্ কারণে, কোন্ হেতুতে এখন এখানে ভয় উৎপন্ন হল? এখানে সমাগতা কিন্নরিদের দুঃখে হৃদয় বিদির্ণ হচ্ছে। পিতাকে কি প্রকারে বলব যে, ব্যাধের দ্বারা মোেহরা পাশবদ্ধ হয়েছে। মাতা যখন মনোহরার কথা আমাদের জিজ্ঞেস্ করবেন, তখন তাঁকে কি ব? এখানেই আমাদের মরণ শ্রেয়ঃ হবে। তাকে ব্যতীত আমরা কিরূপে গমন করব? অহো, আমাদের এ বিয়োগ বড়ই দুঃখ দায়ক ও মর্মন্তুদ। এখানে তোমার সাথে আমাদেরও যদি মৃত্যু হয়, তাও শ্রেয়ঃ। এবলে তাদের সর্ববিধ অলঙ্কার স্বীয় স্বীয় দেহ হতে উন্মোচন করে পৃষ্ঠদেশে শিরকেশ বিকীর্ণ করে কৈলাস-শিখরে গিয়ে দুমরাজের নিকট উপস্থিত হল এবং সবাই তাঁর পাদমূলে লুঠে বিলাপ করতে করতে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করল–—
২৩। দেব, আমাদের বধ করুন। যেহেতু ভগ্নি মনোহরাকে ব্যাঘ্র গ্রহণের ন্যায় এক ব্যাধ ধরে রেখেছে।” মনোহরার মাতা একথা শুনে কম্পিত হৃদয়ে বিলাপ করকে করতে নিন্মোক্ত গাথায় বলল–
২৪-২৬। হায়! হায়! হে মনোহরা, তুমি আমার অতি প্রিয় কন্যা। অদ্য তোমার অদর্শনে আমি দুঃখে অভিভূতা। ব্যাধ আমার কন্যা মনোহরাকে কেন ধরে রেখেছে? তাকে এখন দেখছিনা। তার বিচ্ছেদে আমার জীবন ধারণ বৃথা এবং আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ ॥ হায়! হায়! আমার প্রিয় কন্যা, তোমার অদর্শনে। শীঘ্রই আমার মৃত্যু হবে।”
মনোহরার মাতা দুমরাজের নিকট গিয়ে সাশ্রু নেত্রে বলল“মহারাজ, মেয়েকে দেখবার জন্য আমি তথায় যাব।” দুমরাজ শোকার্ত হৃদয়ে বললেন–”হাঁ ভদ্রে, তোমার যথাভিরুচি।” তখন দেবী পৃষ্ঠদেশে শিরকেশ বিকীর্ণ করে সহচরী সঙ্গিনিগণ আকাশ পথে যেতে লাগল। ব্যাধ মনোহরার হস্ত ধারণের ইচ্ছায় তার সমীপস্থ হল। দেবী তা দেখে ব্যাধকে বলল“ওহে ব্যাধ, তুমি আমাকে স্পর্শ করা মাত্রই মৃত্যু হবে। তা না করে আমার হস্ত হতে নাগপাশ খুলে নাও।” তখন ব্যাধ দেবীর হস্ত হতে নাগপাশ খুলে নিয়ে বলল–“দেবী, তোমার সমস্ত অলঙ্কার আমাকে দাও। ব্যাধের কথামত তার সমস্ত অলঙ্কার তাকে দিল। অতঃপর উত্তরাভিমুখী নতজানু হয়ে পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে অভিবাদন করে তিনটি গাথা ভাষণ করল–
২৭-২৯। “হে মাত, আজ আপনাদের সাথে আমার শেষ দেখা। আমার কৃত দোষ ক্ষমা করবেন। আমি ব্যাধের সাথেই গমন করছি ॥ মাতঃ আমাকে যখন দেখতে ইচ্ছা করবেন, তখন নানা রত্নে খচিত আমার সমুজ্জ্বল কুণ্ডলটি দেখবেন। মাতঃ, নিজের পাপ কর্ম হেতু পরহস্তগত হয়েছি। তাই তার সাথেই আমাকে যেতে হচ্ছে।”
এরূপ বলে মনোহরা ব্যাধের সাথে পর্বতের সন্নিকটে উপস্থিত হল। তথায় দেবী স্বীয় মণি মেখল হার গ্রীবা হতে উন্মোচন করার পর হিমালয়কে সম্বোধন করে বলল–“হে পর্বত রাজ, যদি আমার মাতা এখানে আসেন, তুমি তাকে এ’হারখানি দিয়ে বলবে–“ইহা তোমার কন্যার মণিমেখল হার।” এবলে পিতা-মাতাকে উদ্দেশ করে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করল–
৩০-৩২। পিতঃ-মাতঃ, আপনাদের পদে বন্দনা জানাচ্ছি। আপনারা শীঘ্রই এখানে এসে আমার সাথে অন্তিম সাক্ষাৎ করুন। সর্বদা আপনাদের দর্শন দুর্লভ হবে। অনিত্য ও বিয়োগ এটা জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। সংযোগের পর বিয়োগই সংসারের ধর্মর্তা। জগতে নিত্য স্বভাব সম্পন্ন কিছুই নেই। প্রাণী জগত এরূপ বিপরীত ধর্মী।” এরূপ বলে মনোহরা ব্যাধের সাথে চলে গেল। এবিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা বললেন–
৩৩-৩৪। “তখন রোদন পরায়ণা মনোহরা দেবী সেখান হতে উঠে ব্যাধের সাথে চলতে লাগল। অনুক্রমে ব্যাধের সাথে দীর্ঘপথ অতিক্রমের পর পঞ্চাল নগরে গিয়ে পৌছল।
এ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার কালে মনোহরার প্রতি ব্যাধের চিত্তে কোন প্রকার কুভাব উৎপন্ন হয়নি। এর একমাত্র কারণ হল সতী-সাধ্বী পুণ্যবতীর পুণ্যের প্রভাব। ব্যাধ চিন্তা করল“নিশ্চয়ই আমি একুমারীকে আর্যপুত্র সুধন কুমারকে উপহার দেব।” সে দিবস বোধিসত্ত্ব সর্বলক্ষণ সম্পন্ন “কুমারিক” নামক মঙ্গল হস্তীতে আরোহণ করে সপরিষদ উদ্যানে গিয়েছিলেন। এমন সময় রাজকুমার দূর হতে দেখলেন উক্ত ব্যাধকে; আরো দেখলেন তার পশ্চাতে এক সুন্দরী নারী। রাজকুমার এসুলক্ষণা রমণীকে দেখেই তার প্রতি প্রগাঢ় হে উৎপন্ন হল। তন্মুহূর্তে লোক পাঠিয়ে ব্যাধ ও কুমারীকে ডেকে আনা হল। তখন রাজকুমার ব্যাধকে জিজ্ঞেস করলেন–“বাপু তোমার নাম কি?” ব্যাধ বলল–দেব, আমার নাম “পুন্নরিক।” তুমি কোথা হতে আসছ?” “আমি হিমালয় প্রদেশ হতে আসছি।” “তুমি এখানে কেন এসেছ?” “রাজকুমার, আপনার সেবিকা রূপে এবিদ্যাধর। কন্যা মনোহরা নান্মী দেবীকে উপহার দেওয়ার নিমিত্ত আপনার নিকট এনেছি।” তা শুনে মহাসত্ত্ব প্রীতিচিত্ত হয়ে মনোহরা দেবীকে প্রথমে অযুত টাকা মূল্যের বজির অঙ্গুরীয়ক প্রদান। করলেন। তৎপর ব্যাধকেও মহাসকারের সহিত পুরস্কৃত করলেন। তারপর মহাসত্ত্ব মনোহরা দেবীকে লাভ করার খবর লয়ে জনৈক ব্যক্তিকে পিতা-মাতার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। পিতা-মাতা তা’শুনে অতিশয় আশ্চর্য ও সন্তুষ্ট হলেন। তখন রাজা সবিস্ময়ে ও সানন্দে অগ্রমহিষী চন্দ্রাদেবীকে বললেন–“আশ্চর্য ভদ্রে, আমাদের পুত্র সুধন কুমার কেমন পুণ্যবান! মানব হয়েও নিজের পুণ্য প্রভাবেই বিদ্যাধর রাজার দেবারার ন্যায় কন্যাকে ভার্যারূপে লাভ করল। অতঃপর রাজধানী। দেবনগর সদৃশ অলঙ্কৃত করে ভেরী দ্বারা ঘোষণা করা হলো যে। এ নগরবাসী সবাই যেন নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য সঙ্গে লয়ে আমার পুত্রবধু বিদ্যাধর রাজের কন্যা মনোহরা দেবীকে আগু বাড়িয়ে আনবার জন্য বাগানে উপস্থিত হয়।” তখন নগরবাসী সবাই উত্তম বেশ ভূষায় সজ্জিত হয়ে বহু মূল্যবান মনোজ্ঞ উপহার দ্রব্য হস্তে রাজ-প্রাঙ্গণে সমবেত হলেন। আদিচ্চবংশ মহারাজ ও চতুরঙ্গিনী সেনা ও নগরবাসী পরিবৃত হয়ে বিবিধ বাদ্যে মুখরিত করে জাৰ্জমকে বাগানে উপস্থিত হলেন। তথা হতে মহোৎসব সহকারে মনোেহরা দেবীকে সমর্যাদায় রাজভবনে এনে প্রাসাদ মঙ্গল, আবাহ মঙ্গল ও অভিষেক মঙ্গল, এ। ত্রিবিধ মঙ্গল এক সাথেই সম্পাদন করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব মনোহরা দেবীকে অগ্রমহিষী পদে বরন করলেন। নতুন রাজা সুধন দেবাঙ্গনা সদৃশ মনোহরা দেবীকে পেয়ে পঞ্চকামগুণ সুখে অভিভূত হয়ে অন্যান্য স্ত্রীদের কথা ভুলে গেলেন। এদিকে মনোহরা দেবীর মাতা স্বীয় কন্যাকে অন্বেষণ মানসে আকাশ পথে এসে পূর্বোক্ত সরসীর তীরে অবতরণ করল। তথায় দেখল কন্যাদের ক্রীড়াস্থলে আকীর্ণ নানাবিধ পুষ্পের মধ্যে মনোহরার মণিকুণ্ডল পড়ে রয়েছে। তা দেখে তথায় ছিন্ন পাদপের ন্যায় ভূতলে লুঠে পড়ে বিলাপ করে করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করল–
৩৫-৩৬। আমি দেখছি সরসীতীরে সপুষ্প মণিকুণ্ডল ভূমি চুম্বন করে রয়েছে। প্রাণ প্রতিম কন্যা, আমার নিকট হতে বিচ্ছেদ হয়ে গেল। তাই তোমার দর্শন লাভে এখন আমি বঞ্চিতা। আমার মনোহরা কন্যা চন্দ্রবদনা।” সে এরূপে বিলাপ ও বক্ষে করাঘাত করতে লাগল এবং অসহ শোক-বেগে সংজ্ঞাহারা হয়ে ভূতলে লোটায়ে পড়ল। এ বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত সাতটি গাথা ভাষণ করলেন–
৩৭-৪৩। “এই দেবী উন্মাদিনীমত একবার উঠে আবার ভূতলে লোটিয়ে পড়ে, অশ্রু ধারায় ওর বক্ষ সিক্ত হল। সে বক্ষে করাঘাত করে বিকীর্ণ কেশে হিমালয়ের দিকে ধাবিত হল। হিমালয়ের প্রবেশ পথে সে দেখল কন্যার মণিমেখল হার। তা দেখেই সে তথায় ছিন্ন তরুর ন্যায় ভূতলে পড়ে গেল। পুনঃ সে সংজ্ঞা লাভ করে এবলে রোদন করতে লাগল। ‘হায়! হায়! আমার প্রিয় কন্যা, এ পথেই গিয়েছে। আমার মেয়েকে কোথাও দেখছিনা। কিন্তু দেখছি তার মণিমেখল হারখানা। এ হার পেয়েছি কেবল দুঃখিনীর রোদনের জন্যই। বেদনা বিধুরা মাতা মেয়ের হারখানা বক্ষে ধারণ করে রোদন করতে লাগল। এরূপে সে কেঁদে কেঁদে ক্রমশঃ হিমালয়ের দিকে অগ্রসর হল। দেবী তথায় নানাবিধ বৃক্ষ দেখল। বৃক্ষের পর বৃক্ষ দেখে বিলাপ সুরে বলল–“প্রাণীদেরও এরূপ সংযোগ এবং বিয়োগ সংঘটিত হয়।” কন্যার দেখা না পেয়ে বিলাপ। পরায়ণ দেবী প্রত্যাবর্তন করে কৈলাস পর্বতের শিখর দেশে দুমরাজের নিকট উপনীত হল। তখন রাজা রাণীকে জিজ্ঞেস করল
৪৪। ভদ্রে তুমি এখান হতে গিয়ে অরণ্য পর্বতাদি বিচরণ করে দেখছ কি?” দেবী বলল
৪৫। হাঁ দেব, সর্বত্র খুজেছি, কোথাও তাকে দেখিনি। কিন্তু তার মণি মেখল হারটি মাত্র হিমালয়ের এক স্থানে দেখেছি।” তখন সমস্ত কিন্নরী তথায় দেবীকে পরিবেষ্টন করে রোদন করতে লাগল। তা প্রকাশ করার ইচ্ছায় শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৪৬। “দুমরাজের রাণী তথায় উপস্থিত হলে সমস্ত কিন্নরী দেবীকে পরিবেষ্টন করে রোদন করতে লাগল।”
কুশল নামক সুদক্ষ বেদজ্ঞ এক ব্রাহ্মণ প্রত্যহ বোধিসত্বের কুশলাকুশল জানবার জন্য তাঁর নিকট উপস্থিত হতেন। একদা মহাসত্ব ব্রাহ্মণের গমনামগন কষ্ট হচ্ছে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলেন–ব্রাহ্মণ, আপনি সর্বদা আমার নিকট কি কারণে আসেন? ব্রাহ্মণ, বললেন–“আপনার পিতার মৃত্যুর পর যাতে আমিই আপনার পুরোহিত হতে পারি, সে আশা নিয়েই প্রত্যহ আসি। সুতরাং আমার পিতার পুরোহিত পদটা আমাকেই দান করুন। মহাসত্ব ও সাধুবাদের সহিত ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় সম্মত হলেন। তখন ব্রাহ্মণের পিতা রাজপুরোহিত এবিষয় জ্ঞাত হয়ে কুমারের প্রতি রুষ্ট হলেন। এক সময় বৃদ্ধ রাজপুরোহিত আদিচ্চবংশ মহারাজের সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করে বললেন–। “মহারাজ, আপনার পুত্র সুধন কুমার আপনাকে বধ করে সে রাজা হবার ইচ্ছুক হয়েছে!” রাজা এসব বিশ্বাস করলেন না
এবং এর কোন প্রত্যুত্তরও দিলেন না। ব্রাহ্মণ রাজার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে দুঃখীত হলেন এবং অধোমুখী হয়ে চলে গেলেন। এক সময় সে রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশে শত্রুগণ দ্বারা গোলযোগের সৃষ্টি হল। রাজা আদিচ্চবংশ তা দমন করবার ইচ্ছায় তথায় নিজেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। রাজপুরোহিত তা শুনে পরম হিতৈষীরূপে রাজাকে বললেন–“মহারাজ এ সামান্য কাজে আপনি না গিয়ে আপনার পুত্রকে পাঠালেই হবে।” রাজা বললেন–“আমার পুত্র এখনো অল্প বয়ষ্ক। যুদ্ধ বিদ্যায় সুদক্ষ নয়।” পুরোহিত বললেন–“মহারাজ, সুধন কুমার শক্তিশালী ও তরুণ মহাপুণ্যবান। যে কোন উপায়কৌশলে বিশেষ দক্ষ। সে নিশ্চয়ই এসব শত্রু দমনে সমর্থ হবে। সুতরাং তাকেই তথায় পাঠিয়ে আপনি এখানে নিঃসন্দেহে অবস্থান করুন।” তখন মহারাজ পুরোহিতের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে সুধন কুমারকে ডেকে বললেন–“বাবা, প্রত্যন্ত গ্রামে দস্যুর দ্বারা উপদ্রুত হচ্ছে। তুমি তা দমন করবার জন্য তথায় যাও।” বোধিসত্ব এতে সম্মত হয়ে বলেন“দেব, আপনার প্রভাবে নিশ্চয়ই দমন করে আসবো।” এবলে মাতার নিকট উপস্থিত হয়ে পিতার নির্দেশে প্রত্যন্ত প্রদেশে গমন সম্বন্ধে বলে তাঁকে বন্দনান্তর স্বীয় বাসভবনে উপস্থিত হলেন। তথায় মনোহরা দেবীকে এ বিষয় বললেন–ইহা শুনে দেবীর হৃদয় যেন শতধা বিদীর্ণ হবার উপক্রম হল। সে বোধিসত্বের পাদমূলে ললাটে পড়ে এবলে রোদন করতে লাগল। “স্বামিন, আপনার বিরহে আমার যদি এখানে মৃত্যুও হয়, আপনি তা কিছুই জানবেন না।” তা শুনে মহাসত্ব বললেন–“ভদ্রে, তুমি এজন্য অনুশোচনা বা রোদন করোনা। আমি অচিরেই ফিরে আসছি।” এ বলে তাকে আশ্বস্ত করে চতুরঙ্গিনী সেনা পরিবৃত হয়ে শ্বেত ছত্র ধারণ করে শ্রেষ্ঠ হস্তী-স্কন্ধে আরূঢ় হয়ে রণবাদ্যে দশদিক কম্পিত করে নগর হতে বের হলেন। তখনি নগর রক্ষাকারী দেবগণ তাঁদের মধ্যে পরস্পর একথা ঘোষণা করে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৪৭-৪৮। “এখানে বাসকারী দেবগণ, অদ্য সুধন কুমার যুদ্ধার্থ বের হয়েছেন। আপনারা সবাই সসৈন্য তাকে রক্ষা করবার জন্য তাঁর সাথে গমন করুন।” এরূপে সমস্ত দেবতা পরস্পর পরস্পরকে বলে সসৈন্যে অভিযানকারী মহাসত্বের সঙ্গে গমন করতে লাগলেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিতাক্ত গাথাগুলি বললেন–
৪৯-৫৪। “সর্বদা সর্বস্থানে সুধন কুমারকে পশ্চাতে রেখে দেবগণ পূর্বগামী হয়ে তাঁকে রক্ষা করতে লাগলেন। একারণে। তাদের কোথাও কোনও বিঘ্ন-বিপদ হয়নি। সুধন কুমারের রক্ষাৰ্থ কেহ কেহ খড়গ হস্তে আর কেহ কেহ ধনু হস্তে পূর্বগামী হয়ে চলতে লাগল। সুধন কুমারের সেনাবাহিনীর সুরক্ষার জন্য। পরসেনা মদনকারী হস্তী-অশ্বরথ পদাতিক অগ্রগামী হয়ে দেবগণ চলতে লাগল। বিচিত্র ধ্বজা-পতাকাধারী তাঁর সৈন্য সামন্ত অনুপম। এই অগণিত সেনা যেন পৃথিবীর বক্ষ ভগ্ন করে চলছে। সেনাদের মধ্যে কেহ কেহ কবচধারী, কেহ বর্মধারী, আর কেহ নানাবিধ মারণাস্ত্র ধারী। তাদের পুরোভাগে মেঘচন্দ্র গর্জনে রত বীর সেনাগণ। তথায় মৃদঙ্গ, করতাল, ঢাক, ঢােল, শঙ্খ, শানাই, সারঙ্গ, ভেরী ইত্যাদির ভৈরব শব্দ সমুদ্র গর্জনের ন্যায় প্রতীয়মান হতে লাগল। এ অভিযানের পুরোভাগে ও পশ্চাদভাগে খড়গ তরবারীর উজ্জ্বল প্রভায় দশদিক বিদ্যুৎ প্রভার ন্যায় জ্যোতিঃ বিচ্ছুরিত হতে লাগল।”
মহাসত্ব এরূপে মহারাজ–বিভূতিতে মহাসেনা মণ্ডলী পরিবৃত হয়ে বিদ্রোহ-স্থানে উপস্থিত হলেন। তখন তথায় মহাসত্বের প্রভাবে ও দেবতাদের অনুভাবে কোনও শত্রু তাঁর সম্মুখে অগ্রসর হতে পারল না। শত্রুগণ পরাজিত হয়ে সেখান হতে পলায়ন করল।
সে দিবস বোধিসত্বের পিতা রাজা আদিচ্চবংশ ভোর বেলায় স্বপ্নে দেখলেন যে–“রাজার উদর হতে এক অন্ত্র বের হয়ে সারা জম্বুদ্বীপকে বারত্রয় বেষ্টন করে পুনঃ উদরে ঢুকে গেল।” তখন রাজা এ আশ্চর্য স্বপ্ন দর্শনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শয্যায় বসে পড়লেন। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পর পুরোহিত যখন তথায় উপস্থিত হলেন, তখন ঐ স্বপ্নের বিবরণ পুরোহিতের নিকট বললেন–। পুরোহিত ইহা শুনে মনে মনে ভাবলেন“এতদিনে আমার মনোরথ পূর্ণ হয়েছে। আমার প্রতি শত্রুতার প্রতিশোধ নেওয়ার এই সুযোগ” এ চিন্তা করে সন্তুষ্ট চিত্তে রাজাকে বললেন–এটা আপনার বড়ই দুঃস্বপ্ন। এস্বপ্নে বুঝাযায়–ত্রিবিধ অমঙ্গলের কারণ নিহিত আছে। আপনার এবং আপনার অগ্রমহিষীর কিম্বা রাজ্যের বিনাশ সাধন যে হবে, এটা সুনিশ্চিত। ইহা শুনে রাজার দেহ হতে ঘর্ম নির্গত হতে লাগল। তখন তিনি আকুলভাবে পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেন–“এখন কী উপায় করব।” পুরোহিত বলল–“দেব, শীঘ্রই আপনি যজ্ঞপূজা আরম্ভ করুন।” সে যজ্ঞ পূজায় কি কি উপকরণের প্রয়োজন হবে, তা প্রদর্শনার্থ ব্রাহ্মণ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–
৫৬-৫৭। “আমার বেদের উক্তিতে দেখা যায়–এ স্বপ্নটা অত্যন্ত কুফল দায়ক। এ যজ্ঞ প্রাণীর দ্বারা যৰ্জিত হলে শীঘ্রই এ কুস্বপ্নের কুফল বিনষ্ট হবে। মহারাজ জগতে আপনার বলতে কেহ নেই। শীঘ্রই যজ্ঞের আয়োজন করে দিন। এতে আপনি নিরুপদ্রবে রাজত্ব করতে পারবেন।” তা’শুনে রাজা। অমাত্যকে আহ্বান করে বললেন–ওহে, তুমি শীঘ্রই এ রাজ্যের বনচর ব্যাধগণকে আহ্বান করে রাজাঙ্গণে সমবেত কর।” ত্যুহূর্তে রাজাদেশ কার্যে পরিণত করে রাজাকে গাথায় বললেন–
৫৮। “মহারাজ, আপনার নির্দেশ মতে বলবান ধনুর্ধর বীরপুঙ্গব সমস্ত বনচর ব্যাধকে রাজাঙ্গণে সমবেত করা হয়েছে।” তা শুনে রাজা নিতাক্ত গাথাদ্বয়ে নির্দেশ দিলেন
৫৯-৬০। “তোমরা এখানে যে সব বনচর ব্যাধ সমবেত হয়েছ, প্রত্যেকেই আমার জীবনের নিরাপত্তার জন্য সর্বজাতীয় এক একটা বন্যপ্রাণী এখানে যজ্ঞার্থ নিয়ে আস। দ্বিপদ, চতুষ্পদ, অপদী ও বহুপদী যে কোন প্রাণী পুরুষ জাতীয় হোক বা নারী জাতীয় হোক, তদ্বারা আমি যজ্ঞের আহুতি প্রদান করব।” ব্যাধগণ রাজার নির্দেশ পাওয়া মাত্র নানাদিকে নিয়ে বন্যপ্রাণী সমূহ সংগ্রহ করে যজ্ঞস্থানে নিয়ে এসে রাজাকে নিন্মোক্ত গাথায় নিবেদন করল
৬১। “দেব, আপনার পাদে বন্দনা সহকারে আমাদের নিবেদন এই–‘আপনার সমস্ত নির্দেশ আমরা প্রতিপালন করেছি। বন্য প্রাণীসমূহ আপনার আদেশানুযায়ী যজ্ঞস্থানে এনেছি।” তা শুনে রাজা অতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে পুরোহিতের সহিত কথা উত্থাপন করলেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৬২-৬৩। “রাজা তাদের কথা শুনে আনন্দমনে পুরোহিতকে বললেন–“হে পুরোহিত শীঘ্রই আপনি যজ্ঞ আরম্ভ করুন। সমস্ত বস্তু সংগৃহীত হয়েছে। আমি সর্বদা নির্ভয়েই কামনা করছি। আপনি আমার মঙ্গল সাধন করুন।”
তা’শুনে পুরোহিত ব্রাহ্মণ যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হয়ে পূজোপকরণাদি দেখার পর রাজাকে বললেন–“মহারাজ একটা ব্যতীত সবকিছু এখানে পরিপূর্ণ হয়েছে; সেটা হল বিদ্যাধর কন্যা।” রাজা বললেন–“পুরোহিত ঠাকুর, বিদ্যাধর-কন্যা এখানে কোথায় পাব? তা-ত আমাদের পক্ষে বড়ই দুর্লভ।” পুরোহিত কহিল–“মহারাজ, আপনার পুত্রবধু মনোহরা দেবী বিদ্যাধর কন্যা।” ইহা শুনে রাজা বিস্ময় কণ্ঠে বললেন–“ব্রাহ্মণ ঠাকুর, আপনি এরূপ কথা বলবেন না। সে মনোহরা দেবী আমার, পুত্রের জীবন সমা। তাকে ব্যতীত আমার পুত্র এক মুহূর্তও প্রাণ ধারণ করবেনা। আমার পুত্রবধু ব্যতীত যদি যজ্ঞ পূজা না হয়, তবুও ভাল। সে যজ্ঞ পূজার আমার কোনই প্রয়োজন নাই। তা যুক্তিযুক্ত নয়। একথা শুনে পুরোহিত বললেন–মহারাজ, আপনি যুক্তি অযুক্তি কোন কথা বলবেন না। আপনি নিজের, দেবীর ও রাজশ্রীর প্রতিই লক্ষ্য করুন।” রাজা বললেন–বিদ্যাধর কন্যা ব্যতীত আপনি আমার যজ্ঞ পূজা করুন। আমার পুত্রের অগ্রমহিষী মনোহরা দেবীকে কি প্রকারে আমি হত্যা করব? যজ্ঞ পূজার জন্য তা করতে পারব না।” তা শুনে পুরোহিত ব্রাহ্মণ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় ভাষণ করলেন–
৬৪-৬৭। “দেবা, আমার কথা শ্রবণ করুন। পণ্ডিতেরা পরকে রক্ষা করার চেয়ে নিজকে রক্ষা করাই শ্রেয়ঃ মনে করেন। স্বীয় মস্তকে যখন অগ্নি বর্ষণ হয়, তখন আপন পুত্রকেও ত্যাগ করতে হয়। আপনি পর দুঃখ মোচন না করে স্বীয় সুখই অন্বেষণ করুন। নিজকে রক্ষা করুন। মনোহরা দেবী দ্বারা কি করবেন। প্রথমে নিজকে রক্ষা করতে হবে। তা পণ্ডিতদের প্রশংসিত। ভাল মন্দ যে কোন প্রকার কর্মের দ্বারা স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করা কর্তব্য। তারপর ধর্মাচরণ করা প্রয়োজন।”
পুরোহিতের একথা শুনে আদিচ্চবংশ মহারাজ নীরব হয়ে রইলেন। রাজার এ মৌনভাব দর্শনে তার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে যজ্ঞস্থান সজ্জিত করে মনোহরা দেবীকে তথায় আনয়নের জন্য। স্বয়ং গমন করলেন। তখন এ ব্যাপারে সারা নগর সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তখন মনোহরা দেবীকে জনগণ এবিষয় জ্ঞাপন করলেন। ইহা শ্রবণ করা মাত্রই তার হৃদয় যেন শতধা বিদীর্ণ হল। তন্মুহূর্তে ভগ্ন হৃদয়ে মনোহরা দেবী বোধিসত্ত্বের মাতার নিকট গিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে বন্দনা করলেন এবং কেঁদে কেঁদে বললেন–আর্য মা, আমার শ্বশুর মহারাজ পুরোহিতের পরামর্শে আমাকে নিয়ে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের আহুতি প্রদান করবেন বলে সংকল্প নিয়েছেন। তবে মা, আমার প্রতি অনুকম্পা করে আমার স্বামী এখানে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে প্রার্থনা করুন। যখন আমার স্বামী এখানে উপস্থিত হবেন, তখন আমি তাঁর পায়ে পড়ে আমার কোন দোষ থাকলে তা মার্জনা করার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাহিব। তার পর আমাকে সাতভাগে হলেও ছেদন করুক।” তার একথা শুনে চন্দ্রাদেবী তন্মুহুর্তে সপরিষদ। মহারাজের নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। রাজ পুরোহিত এ বিষয় জ্ঞাত হয়ে নিজের লোক দ্বারা চন্দ্রাদেবীর নিকট খবর দিলেন–“রাজার আদেশ “এখন আমার সঙ্গে কোন রাণীদেরই দেখা হবে না।” এটা ব্রাহ্মণেরই চক্রান্ত। এখবর পেয়ে রাণী ভগ্ন মনোরথ হয়ে প্রাসাদে গিয়ে মনোহরা দেবীকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললেন–“বধুমা, আমি রাজার সাথে সাক্ষাৎ করবার জন্য অনেক চেষ্টা করা। সত্বেও কোন অবকাশ লাভ করতে পারিনি। কিছুদূর অগ্রসর হয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমি তোমার কোনই উপকার করতে সমর্থ হলাম না। ইহা শুনে মনোহরা দেবী বলল–“মা তা হলে এখন আমার মৃত্যু অনিবার্য। এবলে বিলাপ সুরে নিন্মোক্ত তিনটি গাথা বললেন–
৬৮-৭০। “হায়! হায়! মাতঃ এখন আমাকে যজ্ঞার্থে নিয়ে যাবে। অন্যের দ্বারা আমার মৃত্যু হবে। পতির অবর্তমানে এখন অনাথিনীর ন্যায় আমাকে মৃত্যু বরণ করতে হবে। এখানে যদি আমার স্বামী থাকতেন, তা হলে আমার এভাবে কখনো মৃত্যু হতনা। হায়! হায়! মাতঃ, এখন আমার পতি শূন্য অবস্থায় আমার মৃত্যু হবে। আমার পরিত্রাণকারী কি কেহ নেই? অনাথিনীভাবেই কি আমাকে মৃত্যু বরণ করতে হবে?”
তারপর মনোহরা দেবী বিলাপ করে বললেন–“মাতঃ, আমার অলঙ্কার ভাণ্ডটি আমাকে দিন। পূজার জন্য সে সব এখানে ধারণ করব। তখন চন্দ্রাদেবী তার অলঙ্কার ভাণ্ড দিয়ে তাকে আলিঙ্গণ করে রোরুদ্যমনা হয়ে নিজে গাথাদ্বয়ে বললেন–
৭১-৭২। “বধু মা, আমার পুত্র যখন এখানে এসে শুন্য প্রাসাদ দেখে তোমার কথা জিজ্ঞেস্ করে, তখন আমি তাকে কি বলব? বৌমা,–আমার সুধন যদি বেঁচে থাকে, তা হলে তুমি এখানে আসবে। সুধন জীবিত না থাকলেও শীঘ্রই তুমি এখানে ফিরে আসবে। আমার সুধন আমাকে সর্বদা দেখবে।” তা শুনে মনোহরা দেবী স্বীয় ললাটে অঞ্জলীবদ্ধ করে চন্দ্রাদেবীকে বন্দনা করল এবং অলঙ্কারগুলি পরিধান করল। তারপর একখানা নীচাসনে উপবেশন করে “মাত, যদি আপনার পুত্র এখানে আসেন, আপনি তাকে বলবেন–“তোমার স্ত্রী মনোহরা গমনকালে সাতবার তোমার পাদে বন্দনা করে তার অপরাধের ক্ষমা চেয়েছে। তুমি তার দোষ ক্ষমা কর।” আমার এ’শেষ কথা আপনার পুত্রকে বলবেন। এবলে মনোহরা দেবী পূর্বমুখী হয়ে স্বীয় স্বামীর উদ্দেশ্যে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করে “আমাদের ন্যায় বিয়োগ দুঃখ কারো যেন না হয়” এবলে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৭৩-৭৪। “মাত, আপনার ও আমার স্বামীর পায়ে নতশীরে বন্দনা করছি। আমার এ বন্দনার কথা আমার স্বামীকে বলবেন। এখন আপনার সাথে আমার শেষ দেখা। পুনঃ যে দেখা হবে, তা সম্ভব নয়। সংযোগ এবং বিয়োগ এদুটা লোক ধর্ম।” এবলে পুনঃ মনোহরা দেবী শ্বাশুড়ীর পাদমূলে পড়ে বন্দনা করে স্বীয় দোষের ক্ষমা প্রার্থনা করল। তখন চন্দ্রাদেবী ও মনোহরা দেবীকে আলিঙ্গণ করে বিলাপের। সুরে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
৭৫-৭৮। “তুমি পূর্বজন্মে মনে হয় মনুষ্য বা মৃগপক্ষীদের মধ্যে কারো ভেদ সৃষ্টি করেছিলে। সে বিপাকবশেই। অদ্য তোমার পতির সাথে এ বিয়োগ সংঘটিত হয়েছে। হে বন্ধু মা, এখন আমি অনাথিনী হয়ে সর্বদা রাজ্যে বিচরণ করব: যেমন বনে-পর্বতে বনচরগণ একাকী বিচরণ করে। বৃক্ষে, পর্বতে-বনে, সমুদ্রে ও জলে-স্থলে যে রক্ষাকারী দেবগণ আছেন, তারা আমার পুত্রকে শীঘ্রই এনে দিন। আমার পুত্রবধুর বিদ্যমানে এপুরী সর্বদা সুরপুরীর ন্যায় শোভা পেত, সে পুত্রবধু এখন নেই। কুরঙ্গণী যেমন স্বীয় শূন্য বাসা দেখে দুঃখিতা হয়, আমার ও এখন সে দশা।”
চন্দ্রাদেবী যখন এরূপ বিলাপ করছেন, তখন রাজপুরুষগণ মনোহরা দেবীকে যজ্ঞস্থানে নেয়ার জন্য প্রাসাদে এসে উপস্থিত হল। মনোহরা দেবী তা দেখে চন্দ্রাদেবীকে বন্দনা করে “আর্যে, এখন আমি চললাম, “একথা বলে আকাশ-পথে হিমালয়ের দিকে যাত্রা করল। ক্রমে হিমালয়ে গিয়ে ঐ কশ্যপ তাপসের আশ্রমে অবতরণ করল। তাপসকে বন্দনা করে তথায় তার আগমনের সমস্ত বিবরণ বলল। পুনঃ তাপসকে সবিনয়ে বলল–“প্রভু যদি আমার স্বামী সুধন কুমার আমাকে অন্বেষণ করতে এখানে আসেন, তবে তাকে আমার এ বস্ত্র, কম্বল এবং বজির অঙ্গুরীয়কটি দেবেন। আর বলবেন–“আপনার পত্নী মনোহরা আপনার পাদে বন্দনা জানাচ্ছে।” আমার স্বামী এখান হতে উত্তর দিকে গমন করলে সেদিকে অমনুষ্য পরিগৃহীত দুটি পথ আছে। সেখান হতে তাঁকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এরূপ বলবেন।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৭৯। “যদি আমি কায়বাক্যমনে পূর্বে কোন দুশ্চরিতাচরণ করে থাকি, হে শুদ্ধন, তা সব আমাকে ক্ষমা করবেন।” মনোহরা দেবী এবলে “আমার স্বামী এদিকেই আছেন।” চিন্তা করে দক্ষিণমুখী হয়ে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে। বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৮০-৮১। “হে আর্য পুত্র, আপনার প্রতি আমার সাদর প্রণাম রইল। বিয়োগে আজীবন দুঃখ পেতে হয়। পূর্বে বোধ হয় আমার কোনই প্রার্থনা ছিল না। আমি পূর্ব জন্মে কোনও সময় পরের বিয়োগের কারণ হয়েছিলাম। সে কর্মেই বোধ হয় আমাদের বিয়োগ ঘটেছে।”
মনোহরা দেবী এবলে পুনঃ তাপসকে বললেন–“প্রভু আমার স্বামী সুধন কুমার যদি এখানে আসেন, তিনি যেতে ইচ্ছা করলে, যথেচ্ছা যেতে পারেন। তাঁর প্রতি অনুকম্পা করে আমার প্রদত্ত এ মন্ত্র ও “সপ্তকুলিক” নামক ঔষধ তাকে প্রদান করবেন। তিনি সেখান হতে যোজন পরিমাণ কুশবন অতিক্রম করার পর উশির বন ও বেণুবন অতিক্রম করে, তারপর ত্রিশ যোজন প্রমাণ দ্রবতৃণ বন, তৃণবন, তুলসী বন, কণ্টক বন, বেত্র গহন, মিশ্রত গহন, তরুশূন্য গহন, সর্পগহন, বিষফল গহন, রাক্ষস গহন, কাল গহন ও পর্বত গহন ভেদে নববিধ গহন বা দুর্গম মহারণ্য প্রাপ্ত হবেন। এরূপে অষ্টাদশ বনগহন অনুক্রমে অতিক্রম করে তিনি যদি পূর্বদিকের পথে গমন করেন, সে পথে দুটি হস্তী অবিরত যুদ্ধ করে বাস করে। তথায় এমন্ত্র সাধ্যায়ণ করে এবং এ সপ্তকুলিক ঔষধ সেবন করে হস্তীদ্বয়ের মধ্যবর্তী পথেই গমন করতে পারবেন। তারপর দেখবেন দু’টি অত্যুচ্চ প্রকাণ্ড পর্বত পরস্পর সংলগ্নভাবে স্থিত। তথায় এ মন্ত্র সাধ্যায়ণ ও সপ্তকুলিক ঔষধ সেবন করবেন। মন্ত্রও ঔষধের প্রভাবে তখন উক্ত পর্বত দুটির মধ্যভাগে ছিদ্র হয়ে যাবে। সে ছিদ্র পথে তিনি গমন করবেন। সে পথ অতিক্রম করার পর এক যক্ষের বাসস্থান প্রাপ্ত হবেন। সেখানে রাস্তায় সপ্ততাল বৃক্ষ প্রমাণ উচ্চ বিরাট দেহধারী এক যক্ষ দেখবেন। তখন তথায় এ মন্ত্র সাধ্যায়ণ করে ও সপ্তকুলিক ঔষধ সেবন করবেন আর। কতেক ঔষধ দণ্ডের অগ্রভাগে মালিশ করে যক্ষের বক্ষদেশে বিদ্ধ করবেন। এতে যক্ষ নিপতিত হবে। তখন যক্ষের দেহ অতিক্রম করে গমন করবেন। তারপর সেখান হতে শতযোজন পথ অতিক্রম করে একনদী প্রাপ্ত হবেন। তাঁকে সাবধান করবেন, সে নদীর জল যেন স্পর্শ না করেন। তা স্পর্শ করা মাত্রই জীবন ধ্বংস হবে। যদি তা বিশ্বাস না হয়, তবে পরীক্ষা স্বরূপ খড়গ বা শস্ত্র কিম্বা যে কোন বস্তু দ্বারা সেই নদীর জল স্পর্শ করে দেখবেন–তখনি সে বস্তু বিলীন হয়ে যাবে। সে। নদীর অপরতীর হতে এক অজাগর সর্প বের হয়ে এপারে মস্তক রেখে সেতুর ন্যায় হয়ে থাকবে। তখন তিনি এ মন্ত্র সাধ্যায়ণ করে এ ঔষধ কতক সেবন করবেন এবং আর কতেক পায়ের তলায় মেখে ঐ সর্পের পৃষ্ঠে আরোহণ করে নদী পার হবেন। সে নদীর বিস্তৃতি হবে এক যোজন। তাই সে সর্পের শিরদেশে প্রাতে আরোহণ করে সারাদিন চলার পর সন্ধ্যার সময় সর্পের লাঙ্গুল দেশ প্রাপ্ত হয়ে নদীর পরতীরে অবতরণ করবেন। সেখান হতে পূর্বদিকে শত যোজন পথ অতিক্রম করার পর পুনঃ শত যোজন বিস্তৃত বেত্রবন প্রাপ্ত হবেন। এ বন অতিক্রম করার পর কোন দিকে যাওয়ার ছিদ্রমাত্র পথও পাওয়া যাবেনা। তখন তথায় গৃহ প্রমাণ হস্তীলিঙ্গ পক্ষী এসে উপস্থিত হবে। তখন তিনি এ কম্বল খানা সারা দেহে জড়িয়ে এই পাখীর পাখান্তরে নিজকে বন্ধন করে শুয়ে থাকবেন। তখন হস্তী লিঙ্গ পাখী আহার অন্বেষণের জন্য আকাশ-পথে বেত্রবন অতিক্রম করে কৈলাস পর্বতশিখরে প্রতিষ্ঠিত নগরে এসে পড়বে।” এবলে একখানা পত্রে এসব বিবরণ লিখে, তা তাপসকে দিয়ে বন্দনা করে আকাশ পথে কৈলাস পবর্ত-শিখরে প্রতিষ্ঠিত স্বীয় পিতৃ-নগরে এসে উপনীত হল। দুমরাজ মনোহরার আগমন-বার্তা পেয়ে চিন্তা করলেন–“আমার কন্যা এত দীর্ঘকাল ধরে মনুষ্য লোকে মানবের সাথে বাস করেছে। সুতরাং সে এখন আমার ভবনে প্রবেশ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।” এ চিন্তা করে অন্য একটি রমণীয় স্থানে ওর জন্য দিব্য প্রাসাদ তৈরী করিয়ে বহু কিন্নরী তার পদচারিকা রূপে দিয়ে সে প্রাসাদখানি তাকে প্রদান করলেন।
এদিকে বোধিসত্ব প্রত্যন্ত প্রদেশের শত্রুদের দমন করে সসৈন্যে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং পিতৃপদে বিনীতভাবে বন্দনা করে শত্রু দমন বিষয় জ্ঞাপন করলেন। চন্দ্রাদেবী বোধিসত্বকে আসতে দেখে নিজের প্রাসাদে আসবার জন্য আহ্বান জানিয়ে পুত্রকে আগুবাড়িয়ে লয়ে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। তখন বোধিসত্ব বললেন–“মাতঃ, আপনি এখানে রোদন করছেন কেন? মাতা বললেন–“বাবা সুধন, তোমার পত্নী মনোহরা তোমার ভবনে নেই।” তখন মহাসত্ব তার কারণ জিজ্ঞেস করায় চন্দ্রাদেবী সব বিষয় বিস্তৃত ভাবে বললেন–। বোধিসত্ব ইহা শুনে তখনি ভগ্ন হৃদয়ে সংজ্ঞা শূন্য হয়ে ধরাশায়ী হলেন। পুত্রের এ অবস্থা দেখে চন্দ্রাদেবী ব্যাকুল হয়ে তাঁর মস্তকে সুবাসিত জল ও তৈল সিঞ্চন করলেন। এতে তিনি সংজ্ঞা লাভ করলেন। তারপর মহাসত্ব স্বীয় শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন–শয্যাও আসনে পুষ্পমালাগুলি শুকিয়ে রয়েছে। সপ্তরত্ন খচিত অলঙ্কারগুলি ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে। এসব দৃশ্য তাঁর অন্তর্দাহ উপস্থিত হল। অসীম শোকাতুর হৃদয়ে রোদন পরায়ণ হয়ে নিন্মোক্ত গাথায়ে বললেন–
৮২-৮৪। “হায়! হায়! মাতঃ, আপনার বন্ধুমাতা মনোহরা এখন কোথায়? আমার হৃদয় এখন অসহ শোক শৈল্যে বিদ্ধ হচ্ছে। মাতঃ, এখন আমি তার চন্দ্রানন দেখছিনা। আপনাকে বলছি, আমি তাকে অন্বেষণ করতে যাবো। আমাকে আদেশ দিন। আমি রাত্রিদিন তাকে মহারণ্যে অন্বেষণ করব। যদি তাকে বনে পাই, তবে আমরা উভয়ে আপনার নিকট ফিরে আসব। যদি তার দেখা না পাই, তবে সেখানেই আমার মৃত্যু অনিবার্য, একথা জানবেন।
ইহা শুনে চন্দ্রাদেবী শোক-দুঃখে ম্রিয়মানা হয়ে পুত্রকে আশ্বাসবাণী প্রদান মানসে বললেন– “বাবা সুধন, তুমি শোক ও বিলাপ করোনা। তোমার জন্য অন্য একজন দেবরানিভ রূপবতী ক্ষত্রিয় কন্যা আনব। তুমি তার সাথে সংসার যাত্রা নির্বাহ করে আমাদের এরাজ্য শাসন করবে। কোথাও যেওনা।” তা শুনে মহাসত্ব নিন্মোক্ত গাথায় বললেন—
৮৫। “যদি আমি মনোহরাকে না দেখি, তা হলে আমি বেঁচে থেকেও মৃতের সমতুল্য। তার অদর্শন অবস্থায় থাকার চেয়ে আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ।”
মাতা চন্দ্রাদেবী পুত্রকে কোন প্রকারে প্রবোধ দিতে না পেরে নীরব হলেন। তৎপর মহাসত্ব মাতাকে বন্দনা করে প্রাসাদ হতে অবতরণ করলেন। মাতাও শোকার্ত হয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন–“হে সুধন, তুমি আমার একমাত্র প্রাণপ্রতিম পুত্র। তোমাকে আর দেখতে পাবনা। আমাকে অনাথিনী করোনা। তোমার উপরই আমার জীবন রক্ষা নির্ভর করে।” এরূপ বলে নিন্মোক্ত গাথাটি বলে বলে তার পশ্চাদানুবর্তিনী হলেন।
৮৬। “হে প্রাণ পুত্র, ফিরে এস। আমাকে অনাথিনী করোনা। তোমাকে না দেখলে নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু হবে।”
এবলে চন্দ্রাদেবী পুত্রের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রাসাদে রোরুদ্যমানাবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন। মহাসত্ব ও নগর হতে বের হয়ে মনোহরাকে যে ব্যাধ এনেছিল, তার গৃহে গিয়ে তাকে বললেন–প্রিয় ব্যাধ, মনোহরার বাসস্থানের পথ তোমার জানা আছে কি? ব্যাধ বলল–“দেব, তা আমি জানি না। তিনি মহের্ধি সম্পন্না দেবী। তিনি বোধ হয় আকাশ-পথে বিদ্যাধর রাজার নিকট গিয়েছেন। তাকে যদি দেখতে ইচ্ছা করেন, তবে হিমালয়ে বাসকারী কশ্যপ নামক ঋষির নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন।” তখন মহাসত্ত্ব বললেন–“তা হলে বাপু, তুমি আমার পথ প্রদর্শক হয়ে আমার সাথে চল।” তখন বনচর আনন্দের সহিত বলল–“দেব, আপনি না বললেও আমি আপনার সাথে যাব।” ব্যাধের কথা শুনে মহাসেত্ব তীক্ষ্ণ ধার। খড়গ কোষাবদ্ধ করে অব্যর্থ ধনু-শর সঙ্গে নিলেন এবং পথ। প্রদর্শক পুন্নরিক ব্যাধকে সঙ্গে লয়ে গমন করলেন। অনুক্রমে নগরের বহিসীমায় যাওয়ার পর রাজপুত্র নগরের দিকে ফিরে, এবলে সত্যক্রিয়া করলেন নিতাক্ত গাথাযোগে।।
৮৭। “যদি আমার প্রিয় পত্নীকে পাই, তবে পুনঃ এ নগরে প্রত্যাবর্তন করব। যদি না পাই, তবে এ নগরে আর আসবনা।” এবলে মহাসত্ব সিংহের ন্যায় নির্ভীক বাক্যে সিংহনাদ করে ঐ বনচরের সাথে হিমালয় অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারা অনুক্রমে গিয়ে কশ্যপ তাপসের বাসস্থানে উপস্থিত হলেন। সেখান হতে বনচরকে দেশের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কশ্যপ ঋষির আশ্রমে একাকী প্রবেশ করলেন। তাকে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞেস করলেন–
৮৮। “তপোধন, আপনাকে বন্দনা করে জিজ্ঞেস করছি যে–আমার মনোহরাকে দেখেছেন কি? যদি সে এখানে এসে থাকে। তাকে আমি দেখতে ইচ্ছা করি।” তা শুনে তাপস নিতাক্ত গাথায় বললেন–
৮৯-৯০। হে রাজপুত্র, আমি তোমার ভার্যা মনোহরাকে দেখেছি। এ বস্ত্রাদি তার। পূর্বদিকের রাস্তাটা দুর্গমনীয়। এ রাস্তা অমনুষ্যগণ পরিগৃহীত। তদ্ধেতু আপনাকে এখান হতে ফিরে যাবার জন্য বলছি।
এরূপে তাপস রাজপুত্রের সাথে আলাপ প্রত্যালাপ করার পর তাপস বললেন–“এবজির অঙ্গুরীয়ক ও রক্ত কম্বল তোমারই সম্পদ।” এবলে তা মহাসত্বের হাতে দিলেন। মহাসত্ব তা পেয়ে ও দেখে যেন মনোহরা দেবীকে তার। সম্মুখেই দেখলেন। তিনি তা বক্ষে চেপে ধরে রোদন করতে লাগলেন। তা দেখে তাপস বললেন–“কুমার আপনি কি আরো যেতে ইচ্ছা করেন?” মহাসত্ব বললেন–হাঁ আমি এখান হতে প্রত্যাবর্তন করবার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়ঃ মনে করি। সুতরাং আমি এখান হতে ফিরে যেতে পারব না। ঋষিবর মহাসত্বের দৃঢ়তা জ্ঞাত হয়ে কৈলাস পর্বতে যাওয়ার বিধি বিধান মনোহরা দেবীর কথিত সমস্ত বিষয় তাঁকে বললেন–। মহাসত্ব তা শুনে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৯১-৯২। “যদি আমার ভার্যা লাভ করতে পারি, তাহলে আমি নগরে ফিরে যাব। যদি তাকে না দেখি, সেখানেই আমার মৃত্যু হবে। মনোহরা বিনা আমার জীবন এ মহারণ্যে ত্যাগই শ্রেয়স্কর। যদি আমার ভার্যাকে লাভ করতে পারি, তবে পুনঃ মাতাকে দর্শন দিব।”
এবলে বোধিসত্ব তাপসকে বন্দনা করে নিজের পথ প্রদর্শক এক বানর-বাচ্ছা সাথে করে পথ অতিক্রম করতে আরম্ভ করলেন–। তাপস তা দেখে মনোহরা দেবী প্রদত্ত সপ্তকুলিক ঔষধ তাকে দিলেন এবং মন্ত্রও শিক্ষা দিলেন। তারপর মনোহরা দেবীর কথিত মতে পথের বিবরণ যথাযথভাবে বলে দিলেন। মহাসত্ব তা শুনে মহোৎসাহের সহিত সাত বৎসর সাতমাস ও সাতদিন যাবৎ সমস্ত বনগহন ও মহাপর্বতাদি অতিক্রম করে মহাযক্ষ বাসস্থান প্রাপ্ত হলেন। সেখানে দেখলেন ভয়ঙ্কররূপ সপ্ততালে বৃক্ষ প্রমাণ উচ্চ প্রজ্জ্বলিত অগ্নির ন্যায় নয়নদ্বয় অঞ্জন পর্বতের ন্যায় বিরাট দেহ, বাম হস্তে প্রকাণ্ড এক মুর দক্ষিণ হস্তে বিরাটকায় এক কুড়ালী লয়ে যক্ষ দণ্ডায়মান রয়েছে। তা দেখে বোধিসত্ব অসন্ত্রস্ত ও নির্ভীকভাবে তথায় দাঁড়িয়ে সপ্তকুলিক ঔষধ কতেক সেবন করলেন এবং কতেক দণ্ডের অগ্রভাগে মালিশ করে ঐ মন্ত্র সধ্যায়নের পর ঔষধ মক্ষিত দণ্ড যক্ষের বক্ষস্থলে বিদ্ধ করলেন। এতে যক্ষ তখনি তথায় ভূতলশায়ী হল। তখন মহাসত্ব তার দেহের উপর আরোহণ করে সে পথ অতিক্রম। করলেন। তার পর ক্রমে মহানদী প্রাপ্ত হলেন। সে নদীও অজাগর-পৃষ্ঠে আরোহণ করে উত্তীর্ণ হয়ে বেত্রবন পেলেন। তখন সূর্যদেব অস্তাচলে গেল। এমন সময়ে মহাসত্ব বেত্র আশ্রয়ে এক উচ্চ বৃক্ষে আরোহণ করে রক্ত কম্বল গায়ে দিয়ে বৃক্ষাগ্রে বেত্রাচ্ছাদনে শায়িত হলেন। সেখান হতে কোথাও যাওয়ার পথ না দেখে এবলে রোদন করতে লাগলেন–“হে সুধন, তুমি স্ত্রীর জন্য বহু উপকারী পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে বহু দুঃখের মাধ্যমে এখানে এসে অসহ্য কষ্ট ভোগ করছ। তোমার পক্ষে এটা অকরণীয় কাজ, এবলে নিজকে ভৎসনা। করে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
৯৩। “হে সুধন, তুমি স্ত্রীর জন্য পূর্বোপকারীকে ত্যাগ করে অকারণে বহু দুঃখ ভোগ করছ।”
সে সময় বহু হস্তী লিঙ্গ পক্ষী সে বেত্রবনে এসে পরস্পর বলতে লাগলে–“আহার অন্বেষণের জন্য কে কোথায় যাবে? তাদের মধ্যে কেহ কেহ স্বীয় রুচি অনুযায়ী স্থান নির্দেশ করে বলল–“অমুক অমুক স্থানে যাব।” তত্মধ্যে আবার কেহ কেহ বলল–“আমরা কৈলাস-কুটে বাসকারী দুমরাজের কন্যা মনোহরাকে মানুষেরা ধরে নিয়েছিল। সে কন্যা পুনঃ দুমরাজের নিকট ফিরে এসেছে। তার দেহ হতে মনুষ্যগন্ধ দূরীকরনার্থ আগামীকল্য মহোত্সবের অনুষ্ঠান করবে। আমরা সবাই তথায় গিয়ে মঙ্গলার্থ কৃত অতি মহান পূজা আহার করব।” মহাসত্ব পাখীদের এসব কথা শুনে এক পাখীর পক্ষ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিজকে শক্ত করে খড়গের রজ্জুদ্বারা পাখীর পাখার সাথে বন্ধন করে নিল। প্রাতে সে পক্ষীগুলি পরস্পর পরস্পরকে আহ্বান করে আকাশ-পথে বেত্রবন অতিক্রম করবার পর সুবর্ণ নামক এক নগর সমীপে প্রকাণ্ড এক পুষ্করিনী-তীরে অবতরণ করল। তখন মহাসত্ব অতি সন্তর্পণে বন্ধন খুলে সেই পুষ্করিনীর তীরে এক পার্শ্বে অগোপন করলেন তৎকালে বিদ্যাধর পরিচারিকা যোজন কিন্নরী সেই পুষ্করিনী-তীরে এসে পরস্পর এরূপ আলাপ করতে লাগল–“অদ্য আমরা এ পুষ্করিনীর জল দ্বারা আমাদের মনোহরাকেনি করাব।” মহাসত্ব একথা শুনে অতি প্রহৃষ্ট হয়ে মনে মনে চিন্তা করলেন–“আমার চেষ্টা সার্থক হয়েছে। এখন মনোহরার খবর শুনলাম। আহা! সমস্ত গহন, বনানী, পর্বত ও বিবিধ বিঘ্ন সঙ্কুল পথ অতিক্রম করে আমার আগমন সার্থক হয়েছে।” এরূপ চিন্তা করে “কি প্রকারে মনোহরা আমার এখানে আগমন-বার্তা জানবে?” এ চিন্তা করে ঠিক করলেন–“সত্যাধিষ্ঠান দ্বারাই আমার মনোরথ সিদ্ধ হবে।” এ মনে করে অধিষ্ঠান করলেন–“যদি মনোহরার সাথে আমার পুনঃ সংবাস হয়, তা হলে এ কিন্নরীগণ যেন কলসী উঠাতে না পারে।” এরূপ সত্যাধিষ্ঠান করে পুকুরের তীরেই বসে র’লেন। এদিকে কিন্নরিগণ কলসী পূর্ণ করে তা কেহ উঠাতে পারলনা। তাতে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক অবলোকন করতে লাগল। তারা মহাসত্বকে এক বৃক্ষ মূলে দেখে তার নিকট সবাই উপস্থিত হয়ে বলল–“ওগো সুজন, আপনি অনুকম্পা করে এ ঘটগুলি আমাদের তুলে দিন। তখন বোধিসত্ব তাদের নিকটস্থ হয়ে বললেন–“তোমরা এ জল দ্বারা কি করবে?” তখন তারা সব বৃত্তান্ত বোধিসত্বকে বলল। তখন মহাসত্ব ঘটগুলি তুলে দিয়ে শেষের সুবর্ণঘটে স্বীয় বজির অঙ্গুরীয়কটি দিলেন। প্রথমে আগত কিন্নরিগণ মনোহরাকোন করিয়ে কলসের জল নিঃশেষ করার পর শেষের কলসীটি লয়ে কিন্নরী ত্বরিত গমনে মনোহরার মস্তকে জল ঢেলে দিল। তখন জলধারার সাথে ঐ বজির অঙ্গুরীয়কটি পতিত হয়ে কনিষ্ঠাঙ্গুলীতে ঢুকে গেল। বোধিসত্বের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এ অঙ্গুরীয়কটি দেখে মনোহরা দেবী বুঝতে পারলেন–“তাঁর স্বামী সুধন কুমার এখানে এসেছেন।” ইহা জ্ঞাত হয়ে কাউকেও কিছু
বলে নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। তথায় গোপনে সর্বপশ্চাৎ জল নিয়ে আগত কিন্নরীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন–“জল আনতে তোমার এত গৌণ হল কেন? তখন সে উক্ত ঘটনা বিস্তৃত ভাবে বলল। তখন মনোহরা দেবী তাঁকে বললেন–“তুমি যারকথা বললে, তিনি আমার স্বামী সুধন কুমার রাজ পুত্র। তুমি এ বিষয় কাউকেও বলবে না। বলে “পুষ্পমাল্য, সুগন্ধি, বিলেপন, দিব্য বস্ত্র ও আভরণ ভাণ্ড” তার হাতে দিয়ে বললেন–“এ সব সামগ্রী তাঁর হস্তে প্রদান করে বলিও–“তিনি যেন সে পুষ্করিণীতেন করে এদিব্য পোষাক ধারণ করতঃ এদিব্য মাল্য ও সুগন্ধি দ্বারা বিভূষিত হন। তারপর অলঙ্কার ভাণ্ড হতে অলঙ্কার ধারণ করে যেন প্রস্তুত থাকেন। আমি তথায় উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই অপেক্ষা করেন। তখন সেই কিন্নরীও তা নিয়ে বোধিসত্বকে দিয়ে উক্ত কথাগুলি বলল। বোধিসত্ত্বও তখন তার নিকট হতে ঐসব অলঙ্কারাদি গ্রহণ করে মনোহরা দেবীর কথা মতে বস্ত্র পরিধান এবং অলঙ্কার ও সুগন্ধি দ্বারা সজ্জিত হয়ে পুকুরতীরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এদিকে মনোহরা দেবী স্বীয় সহচরী সহ পিতা মাতার নিকট উপস্থিত হল। তখন দুমরাজা মনোহরাকে দেখে বললেন–“মাত, তুমি এতকাল যাবৎ মনুষ্যের সাথে বাস করেছ। তোমার স্বামী কে? তার বর্ণ কি প্রকার, তিনি কি ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য না দ্র?” ইহা শুনে মনোহরা শিরে অঞ্জলি বদ্ধ হয়ে পিতাকে বললেন–বাবা, আমার প্রিয় স্বামী হীন ব্যক্তি নন। অথবা যে সে নন। তিনি মহাপুরুষ। সমগ্র জম্বুদ্বীপের অগ্ররাজা, সপ্তহস্তী-বলধারী উত্তম বীরপুরুষ। তখন দুমরাজা বললেন–তাহলে মাত, তুমি তাকে ত্যাগ করে কেন এখানে এসেছ? তখন মনোহরা দেবী সেখানে ফিরে আসার সমস্ত বৃত্তান্ত পিতাকে বললেন–। তা শুনে দুমরাজা বললেন–তোমার স্বামী যদি এরূপ শক্তি সম্পন্ন বীরপুরুষ হন, তবে এদিকে তোমার পশ্চাদানুবর্তী হলনা কেন? তদুত্তরে মনোহরা বললেন–“বাবা, তিনি যদি এখানে উপস্থিত হন, তবে তাঁর সঙ্গে আপনি কিরূপ ব্যবহার করবেন? রাজা বললেন–“তিনি যদি এখানে আসেন, তার শক্তি পরাক্রমাদি জ্ঞাত হয়ে পুনঃ তাঁর হাতে তোমাকে সমর্পণ করব।” পিতার বাক্য শুনে মনোহরা প্রীতিফুল্ল মনে বললেন–“বাবা, ইহা কি আপনার সত্য বাক্য না ক্রীড়া বাক্য?” দুমরাজ বললেন–“ধীতে, ইহা আমি সর্বান্তঃকরণে সত্য বাক্যই বলছি।” তখন মনোহরা বললেন–“বাবা, আমার স্বামী এখন এখানে এসেছেন।” ইহা শুনে রাজা অতি বিস্মিত হয়ে চিন্তা করলেন“অহো! এরূপ আশ্চর্য শক্তি ও পরাক্রমশালী পুরুষ এখানে এসেছেন, বড়ই আশ্চর্য।” এরূপ চিন্তা করে অতি তাড়াতাড়ি বললেন–“ধীতে, এখন তোমার স্বামী কোথায় আছেন?” মনোহরা বললেন–“বাবা, এখন তিনি নগরের বাহিরেই আছেন। রাজা তখন কন্যাকে আদেশ দিলেন। এখন তাঁকে এখানে আসতে বল। তখন স্বামীকে সাদর আহ্বান করে আনবার জন্যে মনোহরা স্বীয় পরিচারিকাকে মহাসত্বের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। তখন সুধন কুমার হর্যোফুল্লমনে এসে নির্ভীক চিত্তে সিংহরাজের ন্যায় রাজ প্রাসাদে আরোহণ করে নানারত্নে সুখচিত সুচারু বিচিত্র সিংহাসনে উপবিষ্ট দুমরাজকে বন্দনা করার পর এক পার্শ্বে গিয়ে উপবেশন করলেন। তখন কিন্নরিগণ স্বীয় অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে মহাসত্বের দৈহিক সৌন্দর্য ও সৌভাগ্য শ্রীদর্শন করে সংজ্ঞা হারার ন্যায় দাঁড়িয়ে র’ল। দুমরাজ ও মহাসত্বকে দেখে তাঁর প্রতি বলবৎ হে উৎপন্ন হল। দুমরাজ সুহে বোধিসত্বকে জিজ্ঞেস করলেন–“বাবা, তুমি কতদিনে এসব সঙ্কটময় দুর্গম বনগহন, পর্বত কন্দর এবং ভীষণ বিপদসঙ্কুল স্থান অতিক্রম করে এখানে এসেছ?” মহাসত্ব বললেন–“মহারাজ, আমি অদ্য সাতবত্বর সাতমাস সাতদিনে নির্ভীকভাবে পথ অতিক্রম করে বিরাটকায় যক্ষকে বিদ্ধ করে অজাগর পৃষ্ঠে নদী পার হয়ে এক হস্তীলিঙ্গ পক্ষীর ডানার আশ্রয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি।” একথা শুনে দুমরাজ চিন্তা করলেন–“অহো! বড়ই আশ্চর্য, বড়ই অদ্ভুত কথা।” একথা চিন্তা করে পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন—“বাবা, তুমি কি সুধন কুমার? বোধিসত্ব বললেন–হ দেব, আমার নাম সুধন কুমার। রাজা পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন–“তুমি ধনুবিদ্যার পারদর্শী কি? মহাসত্ব বললেন–হাঁ দেব। সে বিষয়ে ও যথেষ্ট আয়ত্ত্ব আছে। তখন দুমরাজা ধন্যবাদের সাথে তা অনুমোদন করে বললেন–বাবা, তা হলে অদ্য তোমার ধনুবিদ্যা শিল্প দেখব। এবলে একস্থানে শ্রেণীবদ্ধভাবে সাতটি তালবৃক্ষ, তার পূর্বভাগে সাতখানি ড়ুমুর তক্তা, তার পুরোভাগে সাতখানি লৌহফলক, তারপর সাতটি শিলাস্তম্ভ, তারপর সাতখানা তাম্র ফলক, তারপর সাতখানা বালুকাপূর্ণ শকট ও তারপর সাতটি জ্বলন্ত অঙ্গার চক্রের ন্যায় যন্ত্র পাটি স্থাপন করে সুধন কুমারকে বললেন–“বাবা, তুমি এসবকে একটি মাত্র শর নিক্ষেপে বিদ্ধ করতে পারবে কি?” সুধন কুমার বললেন–মহারাজ, আমি এসব একটি মাত্র শর নিক্ষেপে বিদ্ধ করতে পারব।” এবলে নির্ভীক চিত্তে আসন হতে উঠে স্বীয় ধনুতে তীক্ষ্ণ শর যোজনা করে নিক্ষেপ করলেন। সে শর ধনুগুণ হতে মুক্ত হয়ে আলাত চক্র যন্ত্র পর্যন্ত সব বস্তু বিদ্ধ করে চক্রবাল-পর্বত-বক্ষ ভেদ করে পুনঃ তা মহাসত্ব হস্তে ফিরে এল। বিদ্যাধরগণ এসব আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে বিস্মিত হয়ে অজস্র করতালী ও উদাত্ত কণ্ঠে সাধুবাদ প্রদান করে দিগুণ্ডল মুখরিত করে তুলল। তখন দুমরাজাও আসন হতে উঠে মহাস্যুকে আলিঙ্গন করে বললেন–“সাধু সাধু মহাপুরুষ,” এবলে বহু প্রশংসা করে পুনঃ বললেন–এ নীল বর্ণ মহাপাষাণ ফলক হাজার হাজার বীরেরা ও উঠাতে পারে না। তা তুমি উঠাতে পারবে কি? মহাসত্ব বললেন–মহারাজ, আপনাদের পুন্যপ্রভাবে ও তেজানুভাবে তা উঠাতে সক্ষম হব। এবলে মহাসত্ব মহাপরাক্রান্ত কেশরী সিংহের ন্যায় আসন হতে উঠে উক্ত নীলবর্ণ মহাপাষাণের সমীপস্থ হলেন। সে পাষাণ-ফলক বারক্রয় প্রদক্ষিণ করে দক্ষিণ হস্তে তা স্পর্শ করে বললেন–“যদি আমি অনাগতে বোধিবৃক্ষমূলে বোধিপালঙ্কে সমাসীন হয়ে মার-বল বিধ্বংস করে অনুত্তর সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারি এবং বিরাট পর্বতরূপী ‘মারকে অতিক্রম করতে যদি সমর্থ হই, তা হলে এ বৃহৎ ও ভারী পাষাণ খণ্ড ও আমার পক্ষে অতি হালকা হোক।” এরূপে সত্যাধিষ্ঠান করে তা তোললেন। মহাসত্বের এ সত্যাধিষ্ঠানের প্রভাবে ঐ পাষাণ খণ্ড খড়ের বোঝার ন্যায় হালকা হয়ে গেল। মহাসত্ব তা তুলে নিজের স্কন্ধদেশে রেখে এদিক ওদিক চলতে লাগলেন। দুমরাজ এ অদৃষ্ঠপূর্ব ব্যাপার দর্শনে অত্যন্ত পরিতুষ্ট চিত্তে আসন হতে নেমে এসে বোধিসত্বকে আলিঙ্গন করে নিজের বাক্য দোষ-বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিদ্যাধরেরা বাঃ বাঃ শব্দকরে অজস্র দিব্য বস্ত্র উর্ধে উৎক্ষেপ করলেন। তখন দুমরাজ বললেন–বাবা, তোমার ভার্যাকে তুমি চিনতে পারবে তো? বোধিসত্ব বললেন–মহারাজ, তা আমি চিনতে পিরবো। তৎপর দুমরাজ নিজের সপ্তকন্যাকে পোষাক পরিচ্ছেদে ও অলঙ্কারাদিতে একইভাবে সজ্জিত করে একস্থানে। বসায়ে মহাসত্বকে বললেন–“আমার সপ্তকন্যার মধ্যে তোমার ভার্যা কোনটি, তা বেচে নাও। তখন মহাসত্ব অনেকক্ষণ দেখলেন বটে, কিন্তু স্বীয় ভার্যা চিনতে পারলেন না। বোধিসত্বেরা সত্যাধিষ্ঠান ত্যাগ করেন না। এখন আমি সত্যাধিষ্ঠান করব।” এ চিন্তা, করে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ। করলেন
৯৩। “আমি পূর্ব হতে এখনো সত্যে প্রতিষ্ঠিত। এ হতে সর্বদা আমি জগত হিতার্থে রত আছি। আমি সর্বদা পরহিতার্থে যে কোন স্থানে গমন করি। এ সত্যের প্রভাবে আমার মনোরথ পূর্ণ হোক।
মহাসত্বের এ সত্যক্রিয়ার প্রভাবে তৎক্ষণেই দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ স্বীয় ভবনের অবস্থা লক্ষ্য করে দিব্য জ্ঞানে জানতে পারলেন–বোধিসত্বের সত্যাধিষ্ঠান পারমীর বিষয়। তন্মুহুর্তে তিনি স্বর্ণ মক্ষিকার বেশ ধারণ করে বোধিসত্বের কর্ণ সমীপে এসে বললেন–“হে সুধন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আমি সঞ্চরণশীল মক্ষিকা হয়ে তোমার স্ত্রীর হস্তে বসব? তখন তুমি তার সে হস্তটা ধারণ করে বলবেএটাই আমার ভার্যা” তখন ইন্দ্ররূপী মক্ষিকা উড়ে গিয়ে মনোহরা দেবীর হস্তে বসল। তখন বোধিসত্ব ও দেবরাজের সঙ্কেতানুসারে মনোহরা দেবীর হস্তে ধারণ করে বললেন–দেব, এটাই আমার ভার্যা মনোহরা দেবী। তখন দেবরাজ ইন্দ্র সেখান হতে অন্তর্হিত হয়ে স্বস্থানে চলে গেলেন। দুমরাজ বোধিসত্বের এরূপ অচিন্তনীয় গুণ ও প্রভাব দর্শনে অতিশয় আশ্চৰ্য্যন্বিত হলেন। তিনি যে মহাপুন্যবান পুরুষ তা জ্ঞাত হয়ে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তন্মুহুর্তে রাজাঙ্গণ বহু রত্ন খচিত সুচারু মণ্ডপ তৈরী করিয়ে তথায় সর্ববিধ রত্ন রাশিকৃত করা হল। তদূপরি মহাসত্ব ও মনোহরা দেবীকে বসিয়ে যথা বিধান মতে অভিষেক দান করলেন এবং সমস্ত রাজত্ব-ভার তাদের হস্তে সমর্পণ করলেন। তখন বোধিসত্ব স্বীয় মনস্কাম পূর্ণ করে। মনোহরা দেবীসহ কৈলাস পর্বতের শিখর দেশে দীর্ঘকাল যাবৎ অতুলনীয় দিব্য সুখ ভোগ করতে লাগলেন। একরাত্রে বোধিসত্ব নিজেরপিতা মাতার কথা স্মরণ করে শোকার্ত হয়ে বোরুদ্যমান অবস্থায় বলতে লাগলেন–এ মহা পৃথিবী যেমন সর্ব প্রাণীদের পক্ষে মহাউপকারী, সেরূপ সন্তানের পক্ষেও পিতা-মাতা সর্ববিষয়ে উপকারী। পিতামাতার গুণ অচিন্তনীয়। তা জেনেও এখন না জানার মত অকৃতজ্ঞ সন্তানের ন্যায় স্বীয় মাতা-পিতার প্রতি উপেক্ষাভাব আনয়ন করা উচিত নয় এবং নিজের দেশগ্রাম ত্যাগ করে এখানে বাস করাও সমীচীন নয়, এবলে নিজকে নিজে ভৎসনা করলেন। তিনি শোকাহত হৃদয়ে কেঁদে কেঁদে পত্নীকে নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–
৯৪। “প্রিয়ে মনোহরা, এখন আমি মোহপরায়ণ হয়ে এখানেই বাস করছি। কখন যে স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করব, তাও জানি না। বোধ হচ্ছে এখানেই আমার জীবন পাত
হবে।”
মনোহরা দেবী মহাসত্বের এরোদন শব্দে হঠাৎ জাগ্রত হয়ে বললেন–স্বামিন, আপনি রোদন করছেন কেন? মনোহরা প্রথম ও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে কোনও উত্তর না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলে তিনি শোক-বেগ সংবরণ করে অরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–“ভদ্রে, আমার মাতা পিতার কথা স্মরণ করে আমি রোদন করছি। আমি এদিকে আসবার সময় আমার মাতা অত্যধিক রোদন করেছিলেন। এখন আমার। মাতাকে না দেখলে নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু হবে। সুতরাং অদ্যই আমি মাতৃদর্শনে গমন করব।” তখন মনোহরা ও বললেন–স্বামিন, আপনার সাথে আমিও যাবো। আপনার যা গতি হবে, আমারও তাই হবে। মহাসত্ব বললেন–ভদ্রে, তুমি আমার সাথে যেওনা। পথ মহা সঙ্কট পূর্ণ। এরূপে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও মনোহরা দেবীকে নিবৃত্ত করতে পারলেন না। অগত্যা তার কাতর প্রার্থনায় সম্মত হলেন। রাত্রি অবসানে মহাসত্ব স্বীয় শ্বশুরের নিকট গিয়ে তাঁকে বন্দনা করার পর স্বীয় মনোভাব ব্যক্ত করলেন। তা শুনে দুমরাজ প্রীতিফুল্ল চিত্তে চিন্তা। করলেন–“এ পুরুষ আবর্জনা রাশির ন্যায় বা থুথু পিণ্ডের ন্যায় স্বীয় মহারাজ্য-স্ত্রীর প্রতি অনপেক্ষ হয়ে এখানে এসে পিতামাতার অতি প্রশংসা করছে। অহো! এ পুরুষ অতিশয় কৃতজ্ঞ।” এ চিন্তা করে মহাসড়কে বললেন–“বাবা সুধন, এখন আমিও তোমার সহিত তোমাদের রাজ্যে যাব।” এবলে তখনই মহাবিদ্যাধর সুধন কুমারও মনোহরা দেবীকে সাথে করে মহাপরিষদ পরিবৃত হয়ে সৈন্য সামন্ত সহ কৈলাস শিখর হতে স্বীয় পুণ্য প্রভাবে আকাশ-পথে এসে উত্তর পঞ্চাল নগরের অনতিদূরে অবতরন করলেন। তথায় দিব্য শিবির স্থাপন করে বাস করতে লাগলেন। তৎপর বোধিসত্বের পিতা আৰ্দিচ্চবংশ রাজা প্রাতেঃ সিংহদ্বার বিবৃত হলে প্রাকার তোরণ প্রতিমণ্ডিত ঐ দিব্য শিবির দর্শন করে সশঙ্কচিত্তে চিন্তা করলেন–“সুধন কুমার বর্তমানে এখানে নেই,” একথা জেনে বোধ হয় অদ্যই আমার রাজ্য অধিকার করবার জন্যে অন্যকোন রাজা এসেছেন।” এ চিন্তা করে আশঙ্কিত হলেন, এমন সময় মহাসত্ব বিদ্যাধরগণ পরিবৃত হয়ে পিত্রালয়ে প্রবেশ করে পিতা-মাতার পাদে মস্তক রেখে বন্দনা করলেন। এবং নিরাপদে নিজের আগমন-বার্তা নিবেদন করলেন। চন্দ্রাদেবী প্রিয়পুত্র সুধন কুমার নিরাপদে প্রত্যাগমন করেছেন দেখে তাঁকে আলিঙ্গন করে শির চুম্বন করলেন এবং বললেন–“প্রাণপ্রতিম পুত্র, তোমার এখান হতে গমনাবিধি দিবারাত্র কেবল কেঁদে কেঁদে অতিবাহিত করেছি। এখন তোমাকে পেয়ে আমার শোকাশ্রু বন্ধ হল। এবলে মাতা-পুত্র বহু সুখ-দুঃখের কথা বললেন–। তখন আৰ্দিচ্চবংশ মহারাজ অতি প্রীতি চিত্তে মহাপরিষদ সহ রাজ প্রাসাদ হতে বের হয়ে দুমরাজের শিবির অভিমুখে অগ্রসর হলেন। দুমরাজ দূর হতে দেখে বিদ্যাধর পরিষদ সহ আর্দিচ্চবংশ মহারাজকে আগু বাড়িয়ে নিলেন। উভয়ে হস্ত প্রসারণ করে সহাস্য বদনে প্রীতি সম্ভাষণ করলেন। তখন উভয়ে শিবিরে প্রবেশ করে মহোৎসব ও আনন্দে সাতদিন অতিবাহিত করলেন। তৎপর দুমরাজ মহাসত্বের মাতা। পিতাকে নানাপ্রকার ধনরত্ন দিয়ে প্রীতিভরে বহু আলাপ করে স্বীয় নগরের দিকে যাত্রা করলেন। মনোহরা দেবী ও স্বামীর সাথে উত্তর পঞ্চাল নগরে বাস করতে লাগলেন। রাজা আর্দিচ্চবংশ রাজাঙ্গণে নানাবিধ রত্ন খচিত সুচারু এক প্রকাণ্ড অভিষেক মণ্ডপ তৈরী করিয়ে তাতে সপ্তরত্নের একটা রাশি করালেন। সে রত্ন পুঞ্জে শ্বেতছত্র-তলে বোধিসত্বকে বসিয়ে পঞ্চবিধ রাজ চিহ্ন সহ রাজাভিষেক প্রদান করলেন। তখন। মনোহরা দেবীকে অগ্র মহিষী পদে অভিষিক্ত করে ধর্মতঃ সাম্যভাবে রাজত্ব করতে লাগলেন। স্বীয় পিতা-মাতাকে সযত্নে পোষণ করে দানাদি পুণ্য ক্রিয়া ও পরোপকারে রত হলেন। তিনি আজীবন ধর্মরক্ষা করে যথাকালে মৃত্যুর পর তুষিত ভবনে উৎপন্ন হলেন। রাজ্যবাসী মহাজন সংঘ বোধিসত্বের উপদেশানুযায়ী জীবিকা নির্বাহ করে দানশীলাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করে যথাকালে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। এরূপে ভগবান বুদ্ধ বিস্তৃত ভাবে ধর্মদেশনা না করে উপসংহারে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, পূর্বেও পণ্ডিত ব্যক্তি মাতৃ জাতীর জন্য নিজের বিশাল রাজ্যশ্রী, পিতা-মাতা এমনকি নিজের জীবনকে পর্যন্ত উপেক্ষা করে মানবের দুর্গমনীয় স্থানে গিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি সে সভায় সংক্ষেপে চারি আর্যসত্য প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
৯৫-৯৬। “দুঃখ সত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধসত্য ও মার্গসত্য, এ চতুর্বিধ সত্য আমিই আবিষ্কার করেছি। ত্রৈভূমিক দুঃখ তৃষ্ণার দ্বারাই উৎপন্ন হয়। নির্বান নিরোধ সত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গসত্য দ্বারাই লভ্য।”
ভগবান এ ধর্মদেশনার পর পূর্বোক্ত উৎকণ্ঠিত ভিক্ষু নিষ্কলুষ, নির্ভয়প্রদ অরহত্ব ফল এবং উপস্থিত বহু ভিক্ষু স্রোতাপত্তি ফলাদি প্রাপ্ত হলেন। শাস্তা এ জাতকের সমাপ্তি ঘোষণা মানসে নিন্মোক্ত আটটি গাথা ভাষণ করলেন–
৯৭-১০৩। “তখন পাপ ও প্ৰদুষ্ট চিত্ত সম্পন্ন, যজ্ঞের পুরোহিত ব্রাহ্মণ ছিল বর্তমানের দেবদত্ত। মহাঋদ্ধিবান মহামোগ্নল্লায়ণ ছিল তখনকার জম্বুচিত্ত নাগরাজ। মহাপ্রজ্ঞাবান সারিপুত্র ছিল তখন কিন্নরেন্দ্র দুমরাজ। কশ্যপ তাপস ছিল আমার বর্তমান শ্রাবক মহাকশ্যপ। পুন্নরিক নামক ব্যাধ এখন। আমার উপস্থায়ক আনন্দ। তখনকার পথপ্রদর্শক বানর এখন কালুদায়ী। দেবরাজ ইন্দ্র এখন আমার শ্রাবক অনুরুদ্ধ। আর্দিচ্চবংশ রাজা এখন আমার পিতা শুদ্ধোদন আমার মাতা মহামায়া দেবীই তখনকারের চন্দ্রাদেবী। মনোহরা দেবী বর্তমানের রাহুল মাতা যশোধরা। আর মহাজনগণ এখন আমার পরিষদ। সে সুধন রাজা এখন আমিই সম্যক্সষুদ্ধ। অতি গৌরবচিত্তে এজাতক ধারণ কর।
(সুধন কুমার জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply