১০. শঙ্খপত্র রাজ জাতক
“হায়, হায়, দেবগণই শ্রেষ্ঠ” এই গাথা শাস্তা শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে বাস করবার কালে যশোধরা দেবীকে উপলক্ষ্য করে বলেছিলেন–। এক দিবস ভিক্ষুগণ ধর্ম সভায় বসে এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা যশোধরা দেবীকে লাভ করবার জন্য মহাশিল্প প্রদর্শন করায়েছিলেন।” ভগবান দিব্যকর্ণে তা শ্রবণ করে তখনি গন্ধকুটি হতে এসে প্রজ্ঞাপ্ত বুদ্ধাসনে উপবিষ্ট হয়ে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখন কি কথার আলোচনা নিয়ে এখানে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয়গুলি ব্যক্ত করলে বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, যশোধরা দেবীকে লাভের জন্য শুধু এখন নয়, পূর্বেও আমি তাকে নিজের ভার্যারূপে লাভের জন্য রাজ্যশ্রী এবং পিতা-মাতাকেও ত্যাগ করে অন্য নগরে গিয়েছিলাম। এবলে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন। ভিক্ষুগণের অনুরোধে তিনি পূর্ব বৃত্তান্ত আরম্ভ করলেন–
“অতীতে অসকরাজ্যে পোতপুর নগরে “যশঃ” নামক এক রাজা ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। “লোম” নামক দ্বীপে “অঙ্কুর” নামক অপর এক রাজা রাজধর্ম রক্ষা করে রাজত্ব করতেন। উভয় ক্ষত্রিয় পরস্পর উপহারাদি প্রদান দ্বারা বন্ধুত্বসুত্রে আবদ্ধ হয়ে স্বীয় স্বীয় রাজ্যে বাস করতেন। অঙ্কুর রাজা বল-বাহন ও নানাবিধ ধনরত্নে সমৃদ্ধ ছিলেন। তার ভার্যা অগ্রমহিষীর নাম ছিল “অঙ্গুনসনা”। অঙ্কুর রাজার ভগ্নী “যশোকীর্তি” দেবী রূপবতী ও শীলবতী ছিলেন। তাঁকে উক্ত যশঃ রাজাকে প্রদানের জন্য ইচ্ছুক হয়ে মহার্ঘ্য বহু উপহার দ্রব্য, বহু ধনরত্ন। ও অযুত সংখ্যক সুন্দরী নারী সহ যশঃ-কীর্তি দেবীকে যশঃরাজের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। তখন হতে দেবী যশঃকীর্তি রাজার অত্যন্ত প্রিয়া ও মনোজ্ঞা হয়েছিলেন। যমঃরাজ তাঁর সহিত পরমসুখে রাজশ্রী পরিভোগ করতে লাগলেন। তখন বোধিসত্ত্ব দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে পোত নগরে যশঃরাজার অগ্রমহিষীর যশকীর্তি দেবীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করলেন। তখন দেবীর জঠর বজ্রপূর্ণের ন্যায় হয়েছিল। প্রত্যহ দান দেওয়ার জন্য তার তীব্র ইচ্ছা উৎপন্ন হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছার কথা রাজাকে জ্ঞাপন করলেন। রাজা প্রত্যুত্তরে বললেন–“ভদ্রে, তুমি কোন চিন্তা করবেনা। আমি তোমার মনোরথ পূর্ণ করব।” এবলে রাজাঙ্গনে একখানা নগরের চারদ্বারে চারখানা এবং নগরের মধ্যস্থলে একখানা, মোট ছ’খানা দানশালা নির্মাণ করে রাণীকে তা জানালেন। দেবী তদবধি প্রত্যহ প্রত্যেক দানশালায় একসহস্র ছয়শত টাকা ব্যয় করে ছ’খানা দানশালা হতে অন্ন-বস্ত্র দান করতেন। মহাসত্ব রাণীর গর্ভে প্রতিসন্ধি। গ্রহণের পর হতে যশঃরাজার মহালাভ সৎকার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল। জম্বুদ্বীপের রাজবৃন্দ যশঃরাজার জন্য বহুবিধ উপহার দ্রব্য পাঠিয়ে দিলেন। দেবী দশমাস পরে পুণ্যলক্ষণ সম্পন্ন এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। তখন যশঃরাজ স্বীয় পুত্রের হস্ততলে শঙ্খ পত্র চিহ্ন দেখে তাঁর নামকরণ করলেন “শঙ্খপত্র।” শঙ্খপত্র, ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে পরম রূপলাবণ্যে সুশোভিত হলেন। তিনি ছিলেন কল্যাণ ধর্ম পরায়ণ সমস্তদিন যাচক গণকে দান দিতেন। তিনি ছ’খানা দানশালায় বিপুল দানের ব্যবস্থা করলেন।
অঙ্কুর রাজার প্রধান মহিষী অনঙ্গসেনা দেবীর গর্ভজাত কন্যা “রতনবতী যেমন রূপবতী, তেমন শীলবতী ছিলেন। তিনি বয়স্কা হলে তাঁর অপর রূপলালিত্য দর্শন করে অঙ্কুর রাজা স্বীয় দৌহিত্র বোধিসত্ত্বের সাথে তার বিবাহ বন্ধনের ইচ্ছুক হলেন। রাজা কন্যা রতনবতীর নাম ও ছবি এক সুবর্ণপত্রে অঙ্কিত করালেন তারপর এ সুবর্ণপত্রের অপর পিঠে বোধিসত্নের নাম ও ছবি অঙ্কিত করলেন এবং একখানা পত্র লিখলেন, সে পত্রের মর্ম এই–“আপনার পুত্রকে আমার রাজ্যসহ কন্যা দান করব। শীঘ্রই আপনার পুত্রকে আমার নিকট প্রেরণ করুণ।” এরূপ পত্র লিখে এক থলিয়ায় ঐ সুবর্ণ পত্রসহ লিপি খানা আবদ্ধ করে শিলমোহর দিয়ে স্বীয় দূতকে বললেন–“এ পত্রখানি পোত পুর নগরে যশঃরাজাকে দিয়ে এস।” এবলে দূত প্রেরণ করলেন। দূত সহচরদের সাথে করে পোতনগরে যাত্রা করলেন। তথায় পৌছে যশঃরাজাকে উপহার সহ উক্ত থলিয়াটি প্রদান করলেন। তিনি তা খুলে পত্র পাঠ করলেন। রাণী যশঃকীর্তি দেবী পত্রোক্ত বিষয় জ্ঞাত হয়ে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, মহাসমুদ্র মহাভয়ঙ্কর। এতে প্রচণ্ড মৎস্য ও বিষধর জন্তু আছে। এখন আমার পুত্র শঙ্খপত্র কুমার অতি তরুণ। এমন অসীম ও ভয়ঙ্কর সমুদ্রে সে উৰ্ত্তীণ হতে পারবেনা। আপনি কি সমুদ্রের ভয়, গভীরতা ও বিস্তারের কথা। জানেন না?” ইহা শুনে রাজা তাঁকে বললেন–ভদ্রে, সমুদ্রে পতিত হলে কেহ কেহ বিনাশ প্রাপ্ত হয়। মহা নৌকাযোগে সমুদ্রে গমনকারী মানবগণ মহাভোগ সম্পদও লাভ করে। বহু বণিক সমুদ্রের বহু রৌপ্য, স্বর্ণ ও রত্নে সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যশালী হয়ে মনোরথ পরিপূর্ণ করে। আমাদের পুত্রও মহা নৌকাযোগে সমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত লোমদ্বীপে নানাবিধ রত্নে সমৃদ্ধ প্রকাণ্ড রাজ্যলাভ করবে। তদ্ধেতু আমাদের পুত্র এইরূপভাবে সমুদ্র পার হয়ে তথায় উপস্থিত হলে, উত্তম বীরের কাজ হবে এবং দিগবীজয়ে সমর্থ হবে।” দেবী রাজার এসব কথা শুনে বললেন–“মহারাজ মাতার হৃদয় পুত্রের প্রতি স্বভাবত অতিশয় কোমল। মাতাগণ পুত্রের বিচ্ছেদ কামনা করেনা। তাই আমি এরূপ বলছি। এখন আপনি যা কর্তব্য মনে করেন, তা শীঘ্রই করুন। অতঃপর যশঃরাজ কুমারকে আহ্বান করে মাঙ্গলিক অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করলেন, নানা শ্রেষ্ঠ রসময় খাদ্য ভোজন করালেন। তারপর কুমারকে সাবধান সূচক উপদেশ প্রদানান্তর বললেন–“বাবা লোমদ্বীপের অঙ্কুর রাজা তোমার মাতুল হয়। তিনি তোমাকে দেখতে একান্ত ইচ্ছুক। তাই তুমি মাতুল রাজার নিকট গিয়ে তোমার মাতৃকূলের সম্পদ রাজ্য গ্রহণ কর। প্রিয়পুত্র, অই রাজার নিকট বাসকরে অপ্রমত্তভাবে রাজ্য রক্ষা করবে এবং উক্ত মহাসম্পদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করবে।” এরূপ বলে পুত্রকে উপদেশ ও অনুশাসন করার পর তার শিচুম্বন করে মহা পরিবার সহ লোম দ্বীপে গমনের জন্য আদেশ দিলেন। মহাসত্ত্ব মাতা পিতাকে বন্দনা ও প্রদক্ষিণ করে মহাপরিবারে পরিবৃত হয়ে যাত্রা করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের মাতা যশঃদেবী পুত্রের অনুগমন করে তাঁর মস্তকে হস্ত রেখে সাশ্রু নয়নে বললেন–, “প্রাণাধিক পুত্র, আমি যেন অনাথিনী না হই, নিরাপদে গমন কর, তোমাতেই আমার জীবন প্রতিবদ্ধ, তুমি অচিরেই পুনঃ আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে” অতঃপর বোধিসত্ত্ব চক্ষুপথের অন্তরাল হলে দেবী প্রাসাদে ফিরে আসলেন। বোধিসত্ত্ব মহাপরিবার সহ পোতনগর হতে বের। হয়ে ক্রমে সমুদ্রতীরে এসে নৌকায় আরোহণ করলেন। নৌকা। সপ্তাহকাল চলার পর যখন সমুদ্রের মধ্যস্থলে এসে পড়ল, তখন। সামুদ্রিক প্রচণ্ড বায়ুর প্রাদুর্ভাব হল। নৌকা সে বাত্যাঘাতে সেখানেই ভগ্ন হল। নৌকা ক্রমে সমুদ্রে নিমগ্ন হতে লাগল। তখন নৌকাস্থ জনগণ রোদন ও বিলাপ পরায়ণ হয়ে দেবতাগণকে নিন্মোক্ত গাথায় বন্দনা করে বললেন–
১। হায়, হায়, হে শ্রেষ্ঠ দেবগণ, আপনারা সবাই আমাদের প্রতি অনুকম্পা করে মৃত্যুকবল হতে আমাদেরকে রক্ষা করুণ। আমাদের সবাইকে সমুদ্রতীরে তুলেদিন।” তন্মধ্যে একমাত্র বোধিসত্ত্বই রোদন-বিলাপ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে বন্দনা করলেন না। তিনি নৌকার ভগ্নাবস্থা জ্ঞাত হয়ে নিজের সারাদেহে গৃত মেখে, আর কতেক ঘৃত পান করলেন। নিজের পোষাক পরিচ্ছদ তৈলে সিক্ত করে দৃঢ়ভাবে বস্ত্র। পরিধান করার পর দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এক উৎকৃষ্টতর হস্তীর শক্তি ধারণ করতেন। তখন মহাসত্ব তথায় রোদন ও বিলাপ পরায়ণ এবং মৎস্য কচ্ছপাদি দ্বারা আক্রান্ত জনগণকে দেখে করুণাচিত্তে চিন্তা করলেন–“আমি এখানে বর্তমান থাকতে এমনুষ্যগনের মৃত্যু না হো” এচিন্তা করে, সমুদ্রে সন্তরণ করতে অসমর্থবান জনগণের জন্য নিজের হস্তগত তক্তাফলকখানি দিয়ে দিলেন। তখন বোধিসত্নের জয়দত্ত নামক এক শক্তিশালী অমাত্য নিজের প্রতি ও বোধিসত্নের প্রতি হেবশে তাঁকে নিবারণ করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২। “হে রাজপুত্র, আপনি যে ফলকখানা দিচ্ছেন, তা ধর্ম ও ন্যায় সঙ্গত নয়। কারণ সে ফলকদান হেতু আপনি শীঘ্রই মৃত্যু কবলে পতিত হবেন।” মহাসত্ত্ব তা শুনে নিন্মোক্ত গাথায়। বললেন–
৩। জগতে সর্বদা আর্যদের উৎসাহ ও করুণা সকল প্রাণীর প্রতিই হয়ে থাকে। ধীরগণ সর্বদা পরকে দুঃখ হতে ত্রাণ করেন। ইহা সবারই উত্তম কর্ম।” জয়দত্ত ইহা শুনে পুনঃ তাঁকে ঐফলক দান নিবারণ মানসে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪। “দেব, একখানা গৃহ লাভের জন্য নিশ্চয়ই একটা কুল ত্যাগ করে। একটা জনপদ লাভের জন্য সমস্ত পৃথিবী ত্যাগ করে। অহিতকামী পণ্ডিতগণ নিজকে রক্ষার জন্য সমস্তই ত্যাগ করে।” মহাসত্ত্ব একথা শুনে জয়দত্তকে নিতাক্ত গাথাত্ৰয়ে বললেন–
৫-৭। বিহঙ্গম সরোবরে বাস করে, মৃগকুল বনে বাস করে, পণ্ডিতেরা পরোপকার করেই বাস করেন এবং শান্তগণ সর্বদা পরহিতে রত থাকেন। তারা ধন, অঙ্গ ও জীবন পরের হিতের জন্য পরিত্যাগ করতে সমর্থ হন। সকৃত সুকর্মের ফল নিশ্চয়ই লাভ করব, তথা এউপায়ের দ্বারা ও নিশ্চয়ই সুফল। লাভ করব।” মহাসত্ত্ব জয়দত্তকে এরূপ বলে মহাসমুদ্রের মহাতরঙ্গ বিমর্দন করে সুবর্ণস্কন্ধের ন্যায় অত্যন্ত শক্তিশালী বোধিসত্ত্ব বাহুবলে সমুদ্রে সন্তরণ করতে লাগলেন।
কি কর্মের দ্বারা মহাসত্ত্ব সমুদ্র মধ্যে পড়ে মহাদুঃখ ভোগ করলেন? এটা তাঁর পূর্ব কর্মেরই ফল। এক অতীত জন্মে তিনি বারাণসীতে বাস করবার সময় একদা নদীতোন করবার কালে এক শ্রমণের ক্ষুদ্র একখানা নৌকায় আরোহণ করে সোনঘাটে আগমন করেন। তখন ঐ ব্যক্তি কৌতকবশে জল-তরঙ্গ উৎপন্ন করে ঐ নৌকাখানা নিমগ্ন করে দিলেন। ইহাতে শ্রামণের মহাদুঃখ উৎপন্ন হয়েছিল। তখন শ্রামণের নিমগ্ন হচ্ছেন দেখে ঐ লোকটি তাঁকে নদীতীরে তুলে রেখেছিলেন। বোধিসত্ত্ব এই একটি মাত্র কর্ম করে পঞ্চশত এরূপ মহাদুঃখ ভোগ করেছিলেন। সে কর্মেই এজন্মে তিনি সমুদ্রে পড়ে মহাদুঃখ ভোগ করছেন। সে বিষয় প্রকাশ করার মানসে। ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত ছটি গাথা ভাষণ করলেন–
৮-১৩। “একজন্মের কর্মনিবন্ধন বহুজন্ম সমুদ্রে পড়ে দুঃখ ভোগ করেছেন। সুকৃত দুস্কৃত কর্মের ফল কখনো ব্যর্থ হয় না। ক্ষুদ্র কর্ম হলেও তা ক্ষুদ্র বলে উপেক্ষা করা উচিৎ নয়। পূর্বজন্মের এবং ইহ জন্মের কৃতকর্ম ছোট হোক বা বড় হোক তা কখনো ব্যর্থ হয় না। ইহলোকে প্রাণীগণ পাপ বা পুণ্য কর্ম যাই করুকনা কেন, তাহা তাদের স্বকীয় হয়, তাহাই তাদের ছায়ার ন্যায় সাথে অনুগমন করে। তদ্ধেতু মুক্তিকামী পণ্ডিতগণ পাপে চিত্ত সংযোগ করেন না। পুণ্যকর্মই নিজকে নিয়োজিত করে শান্তির পন্থায়। সুগতিকামী পুণ্য কৰ্মই করা উচিৎ। পুণ্যকর্মই প্রাণীদের সুপ্রতিষ্ঠা হয়।
তখন জয়দত্ত অমাত্য সমুদ্রের মহাতরঙ্গাঘাতে মহাসত্তকে আর দেখলেন না। সুতরাং তিনি একাই তরঙ্গাঘাতে প্রােতপুর নগরে সপ্রাপ্ত হলেন। সাতদিন যাবৎ সমুদ্র জলে সন্তরণ করায় তদুপুরি অনাহারে ও তরঙ্গাঘাতে অত্যন্ত ক্লান্তদেহে সমুদ্রতীরে উঠলেন। অত্যধিক ক্ষুধার্ত অবস্থায় তিনি বস্ত্রের একাংশ পরিদান করে অপরাংশ গায়ে দিয়ে অতি ধীর পদবিক্ষেপে পথ চলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ গমনের পর রাজপথ প্রাপ্ত হলেন। বোধিসত্ত্বের নৌকা যে দিবসে নিমগ্ন হয়েছিল, সেদিন রাত্রির শেষমে তাঁর মাতা যশঃকীর্তি দেবী স্বপ্নে দেখলেন–“রক্তবস্ত্র পরিহিত কৃষ্ণবর্ণ ভীষণাকার এক পুরুষ আয়ুধহস্তে এসে রক্ত চক্ষু বিস্ফারিত করে তার হস্ত দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে এমন ভাবে আকর্ষণ করল যে, তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উত্তানবস্থায় ভূতলে পড়ে গেলেন। অই পুরুষ শস্ত্রের অগ্রভাগ দিয়ে তার চক্ষু উৎপাটন করল। অসির দারুণ আঘাতে দক্ষিণ বাহু ছেদন করল এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃদপিণ্ডটি নিয়ে গেল। দেবী ভীতত্রস্তে নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে চিন্তা করলেন–“আমি এমন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন কেন দেখলাম? এরূপ স্বপ্নত কখনো মঙ্গলজনক হতে পারে না। আমার অথবা রাজার কি কোনও অমঙ্গল ঘটবে? আমার পুত্র শঙ্খপত্রের কি কোনও বিপদ ঘটেছে কি? এরূপ স্বপ্ন দেখার কারণ কি?” রাণী শয্যা ত্যাগ করে রাজার নিকট উপস্থিত হলেন এবং স্বপ্নের (রোমাঞ্চকর ব্যাপারে ভীত কম্পিত হৃদয়ে প্রকাশ করলেন–। তা শুনে রাজা দেবীকে আশ্বাস বাক্যে বললেন–ভদ্রে, তুমি চিন্তা করোনা। তোমার কোনও অনিষ্ট হবেনা। বায়ু কুপিত হলেও এরূপ স্বপ্ন দৃষ্ট হয়” ইত্যাদি বলে রাণীকে আশ্বাস দিলেও কিন্তু রাজা পুত্রের জন্য চিন্তিত হলেন। রাজা রাণী উভয়ের চিত্তই শঙ্কিত হল। কুমারের কুশল সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত অতিশয় উৎকণ্ঠায় রইলেন। একদা রাজা দানকার্য সম্পাদন করার পর উপোসথশীল অধিষ্ঠান করে অমাত্যবৃন্দ পরিবেষ্টিত হয়ে মহাপ্রাসাদে উপবেশন করছেন, এমন সময় জয়দত্ত অমাত্য নগরে প্রবেশ করে রাজবাড়ীতে উপস্থিত হলেন। তথায় রাজাকে যথাযোগ্য সম্মানপূর্বক অপূর্ণ নেত্রে বোধিসত্নের সংবাদ বললেন–। তা শুনে রাজারাণী অত্যধিক শোক-দুঃখে সেখানেই সংজ্ঞা হারা হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তখন অমাত্য প্রভৃতি সবাই এ মর্মান্তিক করুণ দৃশ্য দেখে শোকবেগ সংবরণ করতে না পেরে তারাও সেখানে মূৰ্চিত হলেন। রাজপুরের মহিলাগণ শিরকেশ পৃষ্ঠদেশে আকীর্ণ করে আকুলভাবে বক্ষে করাঘাত করে রোদন ও বিলাপ করতে লাগলো। বোধিসত্ত্বের মাতা কিছুক্ষণ পরে সংজ্ঞা লাভ করে জয় দত্তকে সম্মুখে উপবিষ্টাবস্থায় দেখে নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞাসা করলেন–
১৪-১৫। হে জয়দত্ত, তুমি আমার পুত্রের মিত্র ও সেবক। তুমি তাকে তথায় ত্যাগ করে কেন এখানে এসেছ? হে অমাত্য। জয়দত্ত, তুমি আমার পুত্রের সাথে গিয়েছিলে। এখন তাকে জল-মধ্যে নিমগ্নবস্থায় রেখে কেন এখানে এসেছ?” অমাত্য জয়দত্ত রাণীর কথা শুণে সপ্তভাগে বিদীর্ণ হৃদয় হওয়ার ন্যায় শোকাশ্রু-মুখে নিতাক্ত গাথায় বললেন–
১৬-১৮। “হে দেবী, নৌকা ভগ্ন হলেও রাজপুত্র নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যেহেতুঃ–তিনি তথায় নৌকার ভগ্ন তক্তাফলক পেয়েছিলেন। আমি তাকে অনেক কারণ। দেখিয়ে নিবারণ করলেও তিনি তা গ্রাহ্য না করে তক্তাফলকখানি অন্যকে সমুদ্র-মধ্যে পরজন রক্ষার জন্য দিয়ে। দিলেন। তাই আপনার পুত্র একাকীই জলে নিমগ্ন হলেন। আর আমি তরঙ্গ বেগে নিক্ষিপ্ত হয়ে তীরে উঠে এখানে এসেছি।” অমাত্য জয়দত্ত ইহা বলার পর পুনঃ নিজকে ধিক্কার দিয়ে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১৯-২১। “দেবী, আমি সল্প পুণ্যবান ও নরাধম। যেহেতুঃ–স্বীয় প্রভূকে আমার বাক্যে বিশ্বাস উৎপাদন করাতে
পেরে তাঁকে দুঃখ হতে রক্ষা করতে পারলাম না। তিনি শুদ্ধ জ্ঞানী নরোত্তম নিজেই জলে গিয়েছেন। তিনি মহাশক্তিশালী, তাই মহাসমুদ্রে তার মৃত্যু ঘটবে না। আমি যেমন এখানে। এসেছি, তিনিও তেমন স্বীয় পুণ্য প্রভাবে এখানে আসবেন। তবে দুঃখের বিষয়, আমিই আপনার শোক-দুঃখ উৎপাদন। করলাম। তখন যশঃকীর্তি দেবী শঙ্খপত্র কুমারের জন্য অনুশোচনা করে নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা বলেন–
২২-২৬। হায়, হায়, “শঙ্খপত্র” আমাকে কেন অনাথিনী করলে? রাজ্য ও স্ত্রী-লোভে কেন মহাসমুদ্রে গমন করলে? বোধ হয় এ নগরে আমি আর সুখী হতে পারব না। তোমার অদর্শনে। সর্বদা দুঃখই ভোগ করব। আমি এরূপ চিন্তা করছি–“ইতিপূর্বে আমার পুত্র অমাত্যগণ পরিবৃত হয়ে রাজাসনে উপবিষ্টাবস্থায় দেখেছিলাম। সে শ্ৰীসম্পত্তি সমন্বিত পণ্ডিতের সাথে কখন আমার দেখা হবে? আমার আশা ও মনোরথ ভগ্ন হয়েছে। হে পুত্র, আমি অপুণ্যবতী। তোমার মুখ অদর্শনে ও তুমি বিনা আমার জীবিত থাকা কী প্রয়োজন?” দেবী এরূপে রোদন পরায়ণা হয়ে যশঃরাজাকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৭। “রাজন, আমি পূর্বেই আপনাকে একথা বলেছিলাম। সমুদ্র ভয়ানক।” ইহা শুনে যশঃরাজা অশ্রু মুছে জগত স্বভাব সম্বন্ধে নিতাক্ত গাথা বললেন–
২৮। “নানাভাব ও বিনাভাব হওয়া প্রাণীদের ধর্মতা। সমস্ত সংস্কারই অনিত্য। ইহা জগতের রীতি। অধিক রোদনবিলাপ করোনা। আমার নিকট সুখেই অবস্থান কর।” পুনঃ দেবী নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
২৯। “হে নরেন্দ্র, আমি পুত্র বিনা জীবন ধারণ করতে পারব না। রাজন, আমার পুত্রের খোঁজ করুন। ইহাই আমার কাতর প্রার্থনা।”
ইহা শুনে যশঃরাজ বললেন–“সাধু ভদ্রে, তুমি সমুদ্র রক্ষাকারী দেবতার নিকট কোন একটা সুখবর পাবে। তুমি যথা সুখে বাস কর।” এ বলে যশঃরাজ নিজের পুরোহিত পূর্ণ নামক ব্রাহ্মণকে ডাকায়ে বললেন–ভবৎ অদ্যই আপনি সমুদ্র তীরে গিয়ে দেবতাদের পূজা দিয়ে আরাধনা করুন এবং আমার পুত্রের অন্বেষণের জন্য তাঁদের নিকট প্রার্থনা করুন। এ বলে ব্রাহ্মণকে প্রেরণ করলেন। ব্রাহ্মণ তখন সমুদ্র তীরে দিয়ে পূজা প্রদানের পর রাত্রিকালে দেবতাদের আরাধনা আরম্ভ করলেন–। তখন সমুদ্র দেবতা দৃশ্যমানাবস্থায় তথায় এসে ব্রাহ্মণকে বললেন–ভবৎ, রাণী নিজের প্রিয় পুত্র শঙ্খপত্র কুমারের সাথে একত্রিত হয়ে শোকহীন হবেন। দেবতা আরো বললেন–“পুষ্পবিমানে বসিয়ে কুমারকে অঙ্কুর রাজার নিকট নিয়ে যাব। তথায় তার কার্য সম্পন্ন হলে পুনঃ অঙ্কুর রাজ কুমারকে পোতপুর নগরে এনে দেবেন।” পুরোহিত ব্রাহ্মণ দেবতার এবাক্য শুনে প্রভাতে রাজার নিকট গিয়ে দেববাক্যগুলি ব্যক্ত করলেন। যশঃরাজ তা শুনে সন্তুষ্ট চিত্তে নিন্মোক্ত গাথা বললেন–
৩০। “এখন আমার পুত্র শঙ্খপত্রের খবর জ্ঞাত হলাম। দেবতা পূজার প্রভাবে তাঁর অভিক্ষিত কর্ম সমর্যদায় সুসম্পন্ন হবে।”
এবলে রাজা যশঃকীর্তি দেবীকে আহ্বান করে বললেন–“ভদ্রে, তুমি চিন্তা করোনা। আমাদের পুত্র জীবিত আছে।” ইহা শুনে দেবী বললেন–“মহারাজ, পুত্র যে জীবিত আছে, তা আপনি কিরূপে জ্ঞাত হলেন?” রাজা বললেন–“ভদ্রে আমি পূর্ণ নামক ব্রাহ্মণকে সমুদ্রতীরে পাঠিয়ে দেবতার নিকট হতে শঙ্খপত্রের খবর নেওয়ার জন্য বলেছিলাম। দেবতা তথায় এসে ব্রাহ্মণকে এরূপ বলেছেন। ‘শঙ্খপত্র রাজকুমার এখন জীবিত আছেন। যশঃরাজ যেন তজ্জন্য চিন্তা না করেন। এরূপ বলেছেন।” এখন রাজা-রাণী উভয়ের পুত্রশোক অপনোদন হয়ে আনন্দমনে অবস্থান করতে লাগলেন। সে নৌকায় শঙ্খপত্র কুমারের এক ব্রাহ্মণ সহায়ক ছিলেন। তাঁর নাম “বদবা মুখ।” তিনিও সমুদ্রের তরঙ্গাঘাতে চালিত হয়ে প্রাতেই সমুদ্র তীরবর্তী লোমদ্বীপ সম্প্রপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সেখান হতে ক্রমান্বয়ে রাজপথে অগ্রসর হয়ে রাজোদ্যানে প্রবেশ করলেন। তত্রস্থ পুষ্করিণীতোন করলেন। তৎপর বাগান হতে ফল সংগ্রহ করে খেয়ে মঙ্গলশিলাপট্টে শয়ন করে নিদ্রিত হলেন। তৎকালে উদ্যানপাল উদ্যানে বিচরণকালে ঐ ব্রাহ্মণকে নিদ্রিতাবস্থায় দেখে তাকে জাগিয়ে বললেন–“হে ভদ্র, আপনি কি শ্ৰমণ?” তখন ব্রাহ্মণ স্বীয় পরিচয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললেন–“বন্ধো, আমি শঙ্খপত্র রাজপুত্রের সহায়ক “বদমুখ।” উদ্যানপাল তা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন–“এখানে শঙ্খপত্র রাজপুত্র এসেছেন কি? ব্রাহ্মণ বললেন–বন্ধো, রাজপুত্র সমুদ্রে নিমগ্ন হয়েছেন।” উদ্যানপাল তা শুনে “এখন আমাদের রাজা নষ্ট হয়েছেন। তিনি শঙ্খপত্ৰ কুমারকে আর দেখবেন না। “এবলে রোদন পরায়ণ হয়ে ব্রাহ্মণকে সাথে করে রাজার নিকট উপস্থিত হলেন। অঙ্কুর রাজা ব্রাহ্মণকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন–“কুমার কোথায়? তখন ব্রাহ্মণ রোদন করে করে বললেন–“মহারাজ নৌকা ভগ্ন হয়ে শঙ্খপত্র রাজকুমার সমুদ্রে নিমগ্ন হয়েছেন।” ইহা শুনে অঙ্কুর রাজা ও অনঙ্গসেনা দেবী উভয়ে অত্যন্ত শোকাকুল হয়ে সেখানেই মূৰ্ছিত হয়ে ভূশায়ী হলেন। অমাত্যবৃন্দেরাও শোকাভিভূত হয়ে রোদন করতে লাগলেন। অনঙ্গসেনা দেবী সংজ্ঞা লাভ করে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, রাজ কুমারের সমুদ্রে মৃত্যু হওয়াতে আমাদেরই মহা অনর্থ ঘটেছে।” ইহা শুনে রাজা দেবীকে আশ্বাস প্রদান মানসে বললেন–“ভদ্রে, কর্মবিপাক হতে মুক্ত, এমন কোন প্রাণী জগতে নেই। অপিচ, মহাপুরুষ। লক্ষণ সম্পন্ন পুণ্য পুরুষের অকালে মৃত্যু হয় না। ভদ্রে তুমি। কোনই চিন্তা করোনা।” এ বলে রাজা নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন—
৩১। “যিনি সুজাত, শীলবান, ধার্মিক ও সত্যবাদী সেরূপ ব্যক্তিকে সর্বদা দেবগণ সমুদ্রে উপস্থিত থেকে রক্ষা ও পালন করেন।”
তখন অঙ্কুর রাজা বদবামুখ ব্রাহ্মণের জন্য উত্তম আহারের ব্যবস্থা করালেন। আহার কৃত্যের অবসানে রাজা বললেন–“হে বদবামুখ আপনাদের রাজবাড়ী, আর এ রাজবাড়ী একই সদৃশ। তাই আপনি আমার নিকটই অবস্থান করুন।” বদবামুখ ব্রাহ্মণ একথা শুনে বললেন–“মহারাজ, আপনার নিকট অবস্থান করলেও আমি সুখে জীবিকা নির্বাহ করতে পারব।” এবলে মহাসত্বের কথা স্মরণ করে অশ্রু মুছলেন তদবধি তিনি তথায় যথাসুখে বাস করতে লাগলেন।
তখন অঙ্কুর রাজ-দুহিতা রতনবতী দেবী শঙ্খপত্র কুমারের সমুদ্রে নিমগ্ন বার্তা শুনে মর্মান্তিক দুঃখে অভিভূত হয়ে নিজের শ্রীপ্রকোষ্ঠে কিং কর্তব্য বিমুঢ় হয়ে বসে আছেন। তখন “ফলবিকা” নানী দাসী তাকে ব্যজন করছিল। তৎকালে রতনবতী শঙ্খপত্র রাজ কুমারের জন্য অনুশোচনা করে উষ্ণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। ফলবিকা দাসী রতনবতীর অবস্থা দেখে বলল–“মাত, অনুশোচনা করবেন না; সন্তপ্ত হবেন না।” রতনবতী বললেন–“হে ফলাবিকে, এখন আমি অধৈর্য হয়েছি।” ফলাবিকা দাসী বলল–“মাত, আপনি মুক্তাহার ও রক্তচন্দনের অনুলেপনে আপনার দেহের সন্তাপ নিবারিত হয় কিনা, তা পরীক্ষা করছেন কি?” রতনবতী বললেন–“হে ফলবিকে, তোমার কথা সত্য বটে, কিন্তু তুমি লোকের হৃদয়গতি জাননা। আমার হৃদয় অসহ দুঃখে কাঁপছে। আমি রাজপুত্রকে না দেলে, মুক্তাহার ও রক্ত চন্দনের অনুলেপনে আমার দেহ-সন্তাপ কিরূপে নিবারণ হবে? প্রিয়জন দর্শনই আমার সর্ব দুঃখ নির্বাপনের দিব্য মহৌষধ। অন্য কেহ আমার সে ঔষধ জানেনা।” ফলাবিকা বলল–“মাতঃ, আপনি কি সুবর্ণ ফলকে শঙ্খপত্র রাজকুমারের প্রতিরূপ দেখেননি?” দেবী বললেন–ফলবিকে, তোমার এবাক্য যুক্তিপ্রদ।” এবলে রাজকুমারী সে সুবর্ণপাট আনায়ে নিজের সম্মুখে রেখে রাজকুমারের রূপ দেখতে লাগলেন। তিনি কুমারের চিত্রপট একবার মাত্র দেখে পুনঃ দর্শনে অসমর্থ হলেন। তিনি একান্তভাবে রোদন করতে লাগলেন। তা দেখে ফলবিকা বলেন–“মাতঃ, রোদন করছেন কেন? রাজকুমারের প্রতিরূপ দেখছেন না কেন? হে ফলবিকে, নারীরা সাধারণতঃ অল্প পুণ্যবতী। তাদের পক্ষে ভোগসম্পদ লাভ অতি দুর্লভ। “মাতঃ, আপনি ওরূপ বল্বেননা। আপনি পুণ্যবতী মহাভোগসম্পদ শালিনী। ক্ষত্রিয়কূলে জন্ম নিয়েছেন এবং শ্রেষ্ঠ। রাজকন্যা হয়েছেন।” যদি আমি এরূপ পুণ্যবতী হই, তবে কেন আমি স্বামী দেখলাম না? স্বামীর বিয়োগ যন্ত্রণা কেন ভোগ করছি? এ রাজপুত্রই আমার স্বামী। আমাকে না দেখে কেন সমুদ্রে তার মৃত্যু ঘটুল। “মাতঃ, রাজা কি আপনাকে তার হস্তে সমপর্ণ করেছেন? তাঁর মৃত্যুতে কি আপনি বিধবা হয়েছেন?” “রাজা তাঁর হস্তেই আমাকে সমর্পণ করে দিয়েছেন।” আপনাকে রাজা কখন দিয়েছেন? যশঃরাজ পুত্রকে আমার কন্যা দেব” এরূপ প্রতিশ্রুতি আমার পিতা পূর্বে দিয়েছেন। মাতঃ প্রতিশ্রুতি দেওয়া, তা কথার কথামাত্র। সত্য নয়, রাজা আপনাকে অন্যস্থানে সম্প্রদান করবে।” একথা শুনে রতনবতী রাজনীতির স্বভাব ধর্ম প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৩২। “রাজা ব্রাহ্মণ ও কুমারী এক কথাই বলেন, ইহাই সনাতন ধর্ম।” মাতঃ, আপনাকে রাজা এবলে দিয়েছেন বটে; কিন্তু সে রাজ কুমারের সাথে আপনার দেখাও হয়নি। তার সাথে আমার সংবাস হয়েছে। তার সাথে আপনার সংবাস। কখন কোন স্থানে হয়েছে কি?” হাঁ স্বপ্নযোগে।” মাতঃ, আপনি সে রাজপুত্রের ভালবাসায় আবদ্ধ হয়েছেন। তাই আমার উপদেশ মেনে নিচ্ছেন না।” রতনবতী একথা শুনে মনে মনে বললেন–“এ দাসী আমার চিত্তগতি বিরূপ করছে। এখন আমাকে দমন নীতি উপদেশ দিচ্ছে।” এ চিন্তা করে ফলবিকা। দাসীকে বললেন–“হে ফলবিকে, এখন আমার হৃদয়ে দাহ উৎপন্ন হয়েছে। তুমি পদ্ম সরোবরে গিয়ে আমার জন্যি পদ্ম ও পদ্মের নাল নিয়ে এস। “আমি আপনাকে একাকিনী রেখে কিরূপে যাব?” আর্যপুত্র আমার সহায় আছেন। শীঘ্রই তুমি। যাও।” তখন দাসী সেখান হতে বিদায় নিয়ে পদ্ম নালের জন্য যাত্রা করল। গমন কালে রাজকুমারী রতনবতী সুবর্ণপত্রে বোধিসত্নের ছবি দেখে সাশ্রুনেত্রে বললেন–আর্যপুত্র, কি দোষে আমার সাথে কথা বলছেন না! এখন আপনি সমুদ্র দেবকন্যার প্রলোভনে পড়ে তার সাথে অভিরমিত হচ্ছেন। তাই এখানে আমাকে দেখতেও আসছেন না। আপনি আমার সংবাদ জ্ঞাত হয়ে দুঃখকে দুঃখ মনে না করে আমার জন্যই সমুদ্রে বিনষ্ট হয়েছেন। তাই আমার দুঃখ জানেন না। আমার আর জীবিত থাকা কি প্রয়োজন? এখন আপনার বিচ্ছেদেই আমার জীবন ত্যাগ করব।” এবলে একখানা পরিধানের বস্ত্র দ্বারা ফাঁসি তৈরী করে তা স্তম্ভে বন্ধন করলেন। তৎপর শঙ্খপত্রের ছবিকে লক্ষ্য করে বললেন–হে আর্যপুত্র এখন আমি আপনাকে বলছি যেআমার এ জীবন পরিত্যাগ দ্বারা পরলোকে যেন আপনার পদসেবিকা হতে পারি।”
তখন বিজনী নদী তার এক যাত্রী বৰ্হিদ্বারে দাঁড়িয়ে তার এসব কার্য দেখে ও কথা শুনে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। সে। সময় রতনবতী স্তম্ভসমীপে এসে ফাস বস্ত্র স্পর্শ করে বললেন–“হায়! হায়! হৃদয়, তুমি ভয় করোনা। তুমি এ দেহ পরিবর্তন করে পরলোকেই রাজপুত্রের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে নয় কি?” এরূপ বলে স্বীয় গ্রীবাদেশে ফাঁস পরলেন। সেক্ষণেই বিজনী ধাত্রী দৌড়ে এসে উভয় হস্তে জড়িয়ে ধরে বলল–“হে আর্যকন্যা, আপনি কেন এরূপ কার্য করছেন? আপনার এরূপ কর্ম করা উচিত নয়।” ধাত্রীর কথা শুনে রতনবর্তী বললেন–“হে মাত ধাত্রী, আমার কর্ম অযৌক্তিক হবে কেন? সে আর্যপুত্র আমার স্বামী, যেরূপ আমার জন্য নিজের জীবন ত্যাগ। করেছেন, সেরূপ আমিও তার সহধর্মিনী হওয়ার জন্য জীবন ত্যাগ করছি।” বিজনী ধাত্রী বলল–“মা, এখন আপনার দেহ ত্যাগে ফল কি? রতনবতী বললেন–“এ দেহ ত্যাগ করে পরলোকে হলেও আর্যপুত্রের সাথে আমার সাক্ষাৎ হবে।” ইহা। শুনে বিজনী ধাত্রী বলল–“আর্যে, আমি কখনো এমন কথা শুনিনি। এবলে রাজকুমারীকে নিন্মোক্ত গাথায় অনুশাসন করলেন
৩৩। যে নারী সজ্ঞানে সর্বদা পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে, সে পরলোক প্রিয় সংবাস লাভ করে।
রতনবতী এগাথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন–“আচ্ছা মাতঃ আমি সেরূপই করব। তখন ফলবিকা দাসী পদ্ম সরোবর হতে পদ্ম ও পদ্মনাল লয়ে রতনবতীর নিকট উপস্থিত হল। বিজনী ধাত্রী তাকে দেখে তর্জন গর্জন করে বলল–‘রে দাসী, তুমি আমার এ মেয়েকে একাকিনী রেখে কেন অন্যত্র গিয়েছ? ফলবিকা বলল মাতঃ, আমার এ স্বামিনীর নির্দেশে আমি পত্রের মৃলাল আনতে পদ্ম সরোবরে গিয়াছিলাম। ইহাতে আমার কোন দোষ নেই। রতনবতী বললেন– মাতঃ, তুমি দাসীর প্রতি রাগ। করবেনা। আমিই তাকে পাঠিয়েছি। এবলে দাসীর নির্দোষ প্রতিপন্ন করলেন। সেদিন হতে রতনবতী মহাসক্তের উদ্দেশ্যে দান প্রদান ও নিত্য পঞ্চশীল এবং উপোসথ শীল প্রতিপালন করতে আরম্ভ করে নানাবিধ পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন।
মহাসত্ব সমুদ্রে জনগণকে ফলক দানের প্রভাবে মৎস্য কচ্ছপ ও কুম্ভীরাদির ভয় হতে মুক্ত রয়েছেন, ‘ফলক দান আমার সুপ্রদত্ত হয়েছে। এসব চিন্তা করে লোনাজলে মুখ প্রক্ষালন পূর্বক উপোসথশীল অধিষ্ঠান করলেন। তৎপর স্বীয় বাহুবলে সমুদ্র সন্তরণ করে সপ্তম দিবসের সায়কালে লোমদ্বীপ সম্প্রপ্ত হলেন। তখন তিনি সমুদ্র হতে উঠে বস্ত্র হতে জল নিষ্কাশন করে একখানা পরিধান করলেন, অপর একখানা গায়ে দিয়ে এক বৃক্ষতলে উপবেশন করলেন। অতঃপর তার দক্ষিণ হস্তে ও বামহস্তে দক্ষিণ হস্ত এবং উভয়। হস্তে পদদ্বয় মর্দন করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন। শ্রান্তি বিনোদনের পর তিনি সমুদ্র তীরে রৌপ্য সদৃশ বালুকা পুলিনে। পায়চারি করতে লাগলেন। তখন চিন্তা করলেন–“আমার বহু উপকারী পিতা মাতাকে ত্যাগ করে স্ত্রীরত্ব ও রাজ ঐশ্বর্যের লোভে এখানে এসে অকৃতজ্ঞের কাজ করেছি। মহাসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করে নিজের পিতামাতার জন্য অনুশোচনায় অভিভূত হয়ে পড়লেন। তখন সেখানেই স্থিত হয়ে অজস্র ধারায় অশ্রু বর্ষণ করতে করতে নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৩৪-৩৯। আমি সমুদ্রে নিমগ্ন হয়েছি আমার মাতা এ খবর পেয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ পুত্র শোকে শোকার্ত হবেন। তাঁর চিত্ত সর্বদা মৃতবৎসা ধেনুর ন্যায় পুত্রশোকে শোকগ্রস্ত হবেন । পিতাও আমার নিমগ্নের সংবাদ পেয়ে মৃতবৎসা কুঞরীর ন্যায় পুত্রশোকে দীর্ঘকাল ধরে রোদন-বিলাপ করবেন ॥ আমার পিতা-মাতা পুত্রশোকে সর্বদা কম্পিত চিত্তে ম্রিয়মান হৃদয়ে অতি দুঃখে দিন যাপন করবেন নয় কি? বোধহয় এতে তাদের মৃত্যুও হবে ॥ আমি পূর্বে দানশালা তৈরী করে অন্ন এবং অন্যান্য যা কিছু দান করেছি, সে পুণ্যের অনুভাব বলে আমার পিতা-মাতার স্বস্তি হোক। অতঃপর বোধিসত্ত্ব আপন প্রতিভাবলে ধৈর্য ধারণ করলেন। সেদিন ছিল পূর্ণিমার উপোসথ দিন। সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথেই চন্দ্রোদ্বয় হল।
তৎকালে ‘দুর্বিতর্ক’ নামক এক ব্রাহ্মণ এক সহস্র টাকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় উত্তমর্ণ কর্তৃক অত্যধিক তিরস্কৃত হলেন। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সে ঋণ পরিশোধ করতে পারলেন না। অগত্যা হত্যার ইচ্ছায় অই পূর্ণিমার জোড়া ধবলিত রাত্রে একখানা রজ্জু লয়ে অরণ্যে প্রবেশ করলেন। তৎপর তিনি ফাঁস তৈরী করে এক বৃক্ষশালায় রজ্জু বন্ধন করলেন। গ্রীবায় ফাঁস সঠিক ভাবে বন্ধন করার সময় মহাসত্ব শঙ্খপত্র কুমারের নিষেধ বাণী শুনে স্তব্ধ হয়ে দেখলেন, তাঁর অনতিদূরে এক সৌম্য মূর্তি তাঁর দিকে বিস্ময় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন–ব্রাহ্মণ, আপনি কি হত্যা করেছেন? হত্যা মহাপাপ। অমন কাজ করবেন না। এরূপে তাঁকে নিবারণ করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪০। মনুষ্যত্ব লাভ বড়ই দুর্লভ। এ দুর্লভত্ত্ব লাভের জন্য দেবতারাও প্রার্থনা করে থাকেন। মহাপুণ্যের ফলেই ইহা লাভ হয়। কেন আপনি এমন সুদুর্লভ মানব জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছেন?
এরূপ অমূল্য উপদেশ বাণী শুনে ব্রাহ্মণ চিন্তা করলেনইনি একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ হবেন। তিনি নিশ্চয়ই আমার দুঃখ বিনোদন করতে সক্ষম হবেন। এখন আমি তাঁর নিকট যাওয়াই উচিত হবে। এমনে করে তিনি রজু ফাঁস নিক্ষেপ করে মহাসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হয়ে অ-কাহিনী ব্যক্ত করলেন। বোধিসত্ত্ব তা শুনে করুণার্ল চিত্তে স্বীয় অঙ্গুলী হতে এক রত্ন। অঙ্গুরীয়ক খুলে ব্রাহ্মণকে প্রদান করে বললেন–“ভবৎ, আপনি এ রত্ন অঙ্গুরীয়ক দ্বারা ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট দিয়ে স্ত্রীপুত্র সহ জীবন যাত্রা নির্বাহ করুন। খন আপনি যথাসুখে চলে যাউন।” এরূপ বলে নিন্মোক্ত গাথায় প্রার্থনা করলেন
৪১। এ দান প্রভাবে আমার সঙ্কল্প পূর্ণ হউক। এ সুক্ষেত্রে প্রদত্ত দান মহিমায় আমি যেন অনাগতে বোধিলাভ করে সুখী হই। বোধিলাভের জন্যই আমার এ দান।
ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলেন–‘মহাশয় আপনি কোথা হতে এখানে এসেছেন? ‘আমি সমুদ্র হতে এখানে উঠে এসেছি।’ আপনি অতিশয় ক্লান্ত হয়েছেন, সুতরাং আমার ক্রোড়েই শয়ন করুন। ইহাতে আপনার ক্লান্তি বিনোদন হবে ও সুখ শয়ন হবে।’ ব্রাহ্মণের কথা শুনে মহাসত্ত্ব চিন্তা করলেন–‘ইনি আমার দানের উপকার স্বীকার করেছেন, সুতরাং ইনি আমার কোনও অনর্থ করবেন না। এ চিন্তা করে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ সরলতায় নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণের ক্রোড়ে মস্তক রেখে শয়ন করলেন।
বোধিসত্ত্ব যখন গাঢ় দ্ৰিায় অভিভূত হলেন, তখন ব্রাহ্মণ চিন্তা করলেন–এখন আমি কি উপায়ে এ লোকটির দ্বিতীয় অঙ্গুরীয়কটি লাভ করতে পারি? তখন তার মনে এরূপ দুরভি সন্ধির উদয় হল–‘ইহার চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করে দ্বিতীয় অঙ্গুরীয়কটি অসাৎ করতে হবে। এমনে করে ব্রাহ্মণ সেক্ষণে স্বীয় অঙ্গুলী দ্বারা বোধিসত্তের চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করলে, তখন তিনি তীব্র বেদনাগ্রস্ত হয়ে নিজের উভয় হস্তে ব্রাহ্মণকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলেন। এ জন্মে বোধিসত্নের দেহে এক হস্তীর বল ছিল। এতে ব্রাহ্মণ যন্ত্রে ইক্ষু নিষ্পেষণের ন্যায় নিষ্পেষিত হয়ে মৃত্যু ভয়ে ভীত হল। তাই এ দুষ্ট ব্রাহ্মণ নিজের জীবন প্রার্থনা করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪২। তাত আমি দুর্মেধাঃ, এ অপরাধীকে অনুকম্পা করে ক্ষমা করুন, দুঃখ হতে রক্ষা করুন। এখানে আপনিই আমার একমাত্র আশ্রয়। আমার আয়ু ধ্বংস করবেন না।” মহাসত্ব বললেন–“হে দুর্বুদ্ধি পরায়ণ ব্রাহ্মণ, তুমি নিশ্চিন্ত হও। এরূপ আশ্বাস প্রদান মানসে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪৩। “তোমার কোন দোষ হয়নি। দুষ্টদের জন্য কোন সদ্ধর্ম নেই। অন্ধকার সূর্যমণ্ডলের বিপরীত। ব্রহ্মলোক সেরূপ অসতের প্রতিকুল। এবলে তিনি ব্রাহ্মণকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–“কি কারণে তুমি আমার দুঃখ উৎপাদন করলে? ব্রাহ্মণ বলল–“আপনার দ্বিতীয় অঙ্গুরীয়ক গ্রহণের জন্য।” ইহা শুনে তিনি চিন্তা করলেন–“আমার নিকট সর্বক্ষণ দান চেতনা আছে নয় কি? একে প্রথমে একটি অমূল্য রত্ন অঙ্গুরীয়ক দিয়েছি। পুনরায় যদি সে আরো একটি যাচ্ঞা করে তাও দেব। তার মনোরথ পূর্ণ করব।” এচিন্তা করে নিজের ত্যাগ চিত্ত প্রকাশের ইচ্ছায় নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
৪৪-৪৭। “হে ব্রাহ্মণ, যদি তুমি আমার মস্তক, রত্ন ও হৃদয়ও চাও, তাও আমি সানন্দে তোমায় দান করব। হে ব্রাহ্মণ তজ্জন্য আমার অন্তর ও অঙ্গ কম্পিত হবেনা। দান আমার। অতি প্রিয়। দানেই আমি রমিত হই ॥ ব্রাহ্মণ, তুমি আমার নিকট যা ইচ্ছা কর তা-ই তোমাকে দেব। বোধির জন্যই আমি দান দেওয়ার ইচ্ছা করি। সর্বদা আমি দান দিয়ে মনোরথ পূর্ণ করি। তুমি পুনঃ আমার নিকট হতে এ অঙ্গুরীয়ক গ্রহণ কর।”
মহাসত্ব এরূপ বলে চক্ষুবেদনা সহ্য করে, সাধু, সাধু বলে সিংহনাদ করতঃ সর্বজ্ঞ বুদ্ধ জ্ঞানকে হেতু করে দ্বিতীয় অমূল্য রত্ন অঙ্গুরীয়কটি ও ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন। ব্রাহ্মণ তা গ্রহণ করে প্রহৃষ্ট চিত্তে বললেন–আপনার এদান আপনাকে নিরাপদে পালন করুক।” এবলে চলে গেল। সে রাত্রে পঞ্চশত চোর পথিকের নিকট হতেও তৈজসপত্র ও অর্থ লুণ্ঠন করে ঝােপ ঝাড়ে পালিয়ে থাকত, অপর পথিক হতেও লুণ্ঠন করবার। আশায়। তারা ব্রাহ্মণকেও ধরে তার নিকট হতেও রত্ন অঙ্গুরীয়কদ্বয় কেড়ে নিল এবং নির্দয়ভাবে প্রহার করে সে। মিত্রদ্রোহীকে ‘মানধ্বজ’ নামক রাজার নিকট নিয়ে গেল। তখন সিংহ ও কুঞ্জার নামক দুজন বনচারী মানধ্বজ রাজার উদ্যান সমীপে বাস করত। সূর্য তেজ প্রখর হওয়ার পর ঐ বনচারীদ্বয় ধনুশর হস্তে মৃগয়ার উদ্দেশ্যে অরণ্যে প্রবেশ করল। তারা ক্রমান্বয়ে বিচরণ করতে করতে বোধিসত্ত্বের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল–“আর্য আপনি কি এখানেই বাস করেন? বোধিসত্ত্ব বললেন–“আমি গতকল্যই সমুদ্র হতে উঠে এখানে এসেছি।। বনচরদ্বয় বোধিসত্নের কথা শুনে বলল–‘অহো, লোকটির কথা বড়ই মধুর। ঈদৃশ সৎপুরুষের সাথে আমাদের দেখা হল। সুতরাং ইনির সেবা আমাদের একান্তই উচিত। এচিন্তা করে উভয়ে বলল–“আমরা আপনার সেবা শুশ্রুষা করব। আপনি আমাদের গৃহে যেতে পারবেন কি? বোধিসত্ত্ব বললেন– তোমরা উভয়েই আমার অবস্থা বোঝতে পারছ। তখন উভয়ে সাদরে তাঁর হস্ত ধরে তাদের গৃহে নিয়ে আসলেন। তথায় তার চক্ষুদ্বয় ধৌত করে ঔষধ প্রদান করল। তৎপর খাদ্য ভোজ্যে পরিতৃপ্ত করে শয়নের ব্যবস্থা করে দিল। তদবধি তারা মৈত্রী করুণা চিত্তে তাঁর সেবা করতে লাগল। তাদের সেবাগুণে কয়েকদিন পরে বোধিসত্ত্ব সুস্থ ও সবল হলেন। তখন তিনি তাদের ধর্মকথায় উপদেশ প্রদান করার ইচ্ছায় নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা বললেন–
৪৮-৫২। কর্মের হেতুতেই প্রাণীগণ সংসারে বিচরণ করে। প্রাণীদের কুশলাকুশল কর্ম পরলোকে তাদের সংগে ছায়ায় ন্যায় অনুগমন করে। সবাই দণ্ড ও মৃত্যুকে ভয় করে। নিজের উপমা গ্রহণ করে অন্য প্রাণীকে হত্যা বা আঘাত করো না। জগতে মনুষ্যত্ব, শ্রদ্ধাসম্পদ, সদ্ধর্ম ও সদ্ধর্মদেশক লাভ করা বড়ই দুর্লভ। তাই পণ্ডিতগণ সর্বদা সশ্রদ্ধ অন্তরে দানশীল ভাবনা ইত্যাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করেন। পণ্ডিত ও সুজনদের সংসর্গে অবস্থান কর এবং রাত্রিদিন সর্বদা পঞ্চশীল সযত্নে রক্ষা কর।” ইহা শুনে বনচরদ্বয় ‘সাধু বলে এ উপদেশ সমূহ গ্রহণ করল। বোধিসত্ত্ব তাদের পঞ্চশীল দান করলেন। তৎপর বনচরদ্বয় তার বাড়ীতে পৌছিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে একখানা মঞ্চে বহন করে রাজপথ সম্প্রপ্ত হল। জনগণ মহাপুরুষের রূপশ্রী দর্শনে সকলেই ঔৎসুক্য হয়ে তার পশ্চাৎ গমন করল। বনচরদ্বয় কিছুদুর গিয়ে এক ধর্মশালায় মঞ্চ রেখে বিশ্রাম করতে লাগলেন। তখন জনগণ মহাসড়কে পরিবেষ্টন করে। সোৎসাহে বললেন–‘অহো, এই মঞ্চ যে তৈয়ার করেছে, তার জীবন ধন্য। তখন মহাসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথা বলে তাদের ধর্মদেশনা করলেন
৫৩-৫৫। যে ব্যক্তি প্ৰদুষ্টমনে কিছু করে বা বলে, তা শকট-চক্র যেমন বলীবৰ্দের পশ্চাৎ অনুগমন করে, সেরূপ দুঃখও তার পচ্ছাধাবন করে। যে ব্যক্তি প্রসন্ন চিত্তে কোন কর্ম করে বা ভাষণ করে, তা ছায়ার ন্যায় সুখ তার অনুগামী হয়। দানের দ্বারা ধনবান ও শীলের দ্বারা রূপবান হয়। জগতে পণ্ডিতগণ ভাবনা দ্বারা শান্তচিত্ত ও উত্তম জ্ঞান লাভ করে নির্বাণ সাক্ষাৎ করেন।।
জনগণ এরূপ চমৎকার ধর্মদেশনা শুনে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে ধর্ম পূজার উদ্দেশ্যে বোধিসত্ত্বকে সাধুবাদ সহযোগে বহুবস্ত্র ও দ্রব্যসম্ভার দিয়ে পূজা করল। তৎপর বনচরদ্বয় সে পূজা-সামগ্রী। সহ মহাসত্ত্বকে লয়ে পথ চল্তে লাগল। তখন বনচরদ্বয়ের স্ত্রীদ্বয় পাপচিত্ত উৎপন্ন করে তীক্ষ্ণ সুরা ও পিষ্টক খাদ্যাদি লয়ে স্বামীদ্বয়কে ফিরিয়ে আনবার জন্য তাদের পশ্চাৎগামিনী হল। স্ত্রীর বারম্বার অনুরোধে বনচরদ্বয় পুনরায় বোধিসত্ত্ব সহ গৃহাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করল। তারা গৃহের সমীপস্থ হলে নারীদ্বয় বক্ষে বারবার করাঘাত করে বলল–“তোমরা আবার কেন এই অন্ধকে সাথে এনেছ? এঅন্ধ কোন্ কাজে লাগবে? অন্ধ নিয়ে তোমরা গৃহে প্রবেশ করো না।” স্ত্রীদের কথায় তারা ক্রুদ্ধ না হয়ে সহাস্যে গৃহে প্রবেশ করল। তখন নারীদ্বয় ও গৃহে প্রবেশ করে উক্ত তীক্ষ্ণ সুরা পান করল এবং পুনঃ পুনঃ বক্ষে করাঘাত করে হাসতে লাগল। বনচরদ্বয়ও নিজের গৃহে প্রজ্ঞাপ্তসনে বোধিসত্ত্বকে রেখে জনগণের প্রদত্ত বস্ত্রালঙ্কার সমূহ শৃঙ্খলভাবে যথাস্থানে রাখতে লাগল। রমনীদ্বয় বস্ত্র ও অলঙ্কার প্রভৃতি দেখে এক নারী অপর নারীকে বল্ল–“বোন, এসে দেখ, এঅন্ধ মহাধনশালী। এখন আমাদের স্বামীদ্বয় ওর নিকট হতে ধন নিয়ে নিশ্চয় তরুণী ভার্যা গ্রহণ করবে আমাদের ত্যাগ করে ইহা আমাদের পক্ষে বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে। অদ্য হতে আমরা তাদের পানীয় পরিভোগ্য জলদি এনে দেব।” স্ত্রীদ্বয় এরূপ পরামর্শ করে ভালরূপে কাজ করতে লাগল এবং স্বীয় স্বীয় স্বামীকে বন্দনা করে ক্ষমা প্রার্থনা করল। কিন্তু তারা তাদের দোষ ক্ষমা করল না। মহাসত্ত্ব তা জেনে তাদের বললেন–‘বন্ধো, তোমরা স্বীয় স্বীয় ভার্যার সহিত প্রসন্ন মনে বাস কর এবং তাদের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন হও” এরূপে তাদের উপদেশ দিয়ে পরে ঐ নারীদ্বয়কেও পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠাপিত করলেন।
কিছুদিন পরে বনচরদ্বয় বোধিসত্ত্বকে বলল–“আমাদের গৃহখানা ছোট আপনার পক্ষে অসুবিধা হয়েছে। তদ্ধেতু আপনি রাত্রিবাস ও ভোজন কৃত্যাদি সম্পাদন করে দিবাবিশ্রামের জন্য উদ্যানে গিয়ে নির্জনে মঙ্গলশিলাপট্টে উপবেশন করে থাকলেই ভাল হবে।” এ প্রস্তাব শুনে তিনি বললেন–“বন্ধোগণ, তোমাদের সুচিন্তিত প্রস্তাব বড়ই উত্তম। তাই হউক।” তখন হতে বনচরদ্বয় প্রত্যহ প্রাতেই বোধিসত্রোন ও ভোজনকৃত্যের অবসানে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে মঙ্গল শিলাপট্টে উপবেশন করিয়ে প্রত্যাবর্তন কালে বলত–“আর্য, সূর্যাস্তের সময় আমরা এসে আপনাকে নিয়ে যাব।” এরূপে কিছুদিন গত হওয়ার পর একদা রতনবতী রাজ কন্যা উৎকণ্ঠা বিনোদন মানসে উদ্যান ভ্রমণের ইচ্ছা করলেন। সুতরাং যথাকালে তিনি সহচারীদের সঙ্গে নিয়ে উদ্যানাভিমুখে যাত্রা করলেন। তখন রাজন্তঃপুরে রক্ষক ব্যক্তিগণ অগ্রবর্তী হয়ে রাস্তা হতে পথিক পুরুষদের উচ্চৈঃস্বরে সাবধানবাণী বলে সরিয়ে দিতে লাগল। তখন মঙ্গলশিলাপট্টে উপবিষ্ট বোধিসত্ত্ব সহায়ক বনচরদ্বয়কে বললেন–বন্ধোগণ, এখন এত উচ্চবাক্য কেন শোনা যাচ্ছে?” তারা বলল–“আর্য, আমাদের রাজকন্যা রতনবতী উদ্যান ভ্রমণ। উদ্দেশ্যে আসছেন, তাই এত কোলাহল। এখন আমরাও চলে। যাচ্ছি।” তিনি বললেন– তাহলে আমিও যাব। তারা বলল“আর্য, আপনি পুরুষ হলেও অন্ধ। তাই আপনি এখানে থাকতে পারবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–“এ দেশের নাম কি?” বনচর বলল–এ দেশের নাম ‘লোমদ্বীপ’। এবলে তারা মহাসত্ত্বকে বলে চলে গেল। রতনবতী দেখুঁলেন–নানাপ্রকার বৃক্ষ, কুঞ্জবন ফল ও ফুলে উদ্যান সুশোভিত। পঞ্চবর্ণ পদ্মে সমাছন্ন বালুকাময় পুস্করিণী, বিবিধ বিবিত্র বিহঙ্গমকুলের সুতান লহরী মনোরম, অতি মনোরম কিছুদূরে মঙ্গলশিলাপট্টে উপবিষ্ট দেখলেন বোধিসত্ত্বকে। তখন রাজকন্যা চমৎকৃত হলেন। চিন্তা করলেন–“এ সুন্দর যুবক কে? কোথাও যেন একে দেখেছি। মনে হচ্ছে”। দাসীকে বললেন–“ফলবিকে, ফলবিকে, কে এ যুবক, পরিচয় নিয়ে এস।” তখন দাসী বোধিসত্ত্বের নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করল–“ওগো, আপনি কে? কোথা হতে এসেছেন,” তিনি বললেন–“আমি সমুদ্র হতে উৰ্ত্তীণ হয়ে এখানে এসেছি।” দাসী গিয়ে রাজ দুহিতাকে একথা বলল। তা শুনামাত্র কুমারী চমকিত হয়ে উঠলেন। বুক দুরু দুরু করে উঠল। দাসী বলল–‘আর্যে কী বলব, এরূপ আর কোথাও দেখিনি। কিন্তু সে অন্ধ।” তা শুনে রাজকন্যার মুখ বিমর্ষ হল। তবুও আশা ত্যাগ করলেন না। চিন্তা করলেন–“সমুদ্র হতে উৰ্ত্তীণ ইনিই না আমার আর্য পুত্র?” এস দাসী, তাকে আমি দেখব। এ বলে দাসীকে সাথে নিয়ে মহাসত্ত্বের নিকট উপনীত হলেন। রাজকন্যা তাকে খুব লক্ষ্য করে দেখতে লাগলেন। তখন দাসী বলল–“আমাদের রাজকন্যা রতনবতী আপনার আগমন উদ্দেশ্য জানবার ইচ্ছায় এখানে এসেছেন।” বোধিসত্ত্ব বললেন–“রাজকন্যা যা জাতে চান, তা জিজ্ঞাসা করতে পারেন।” তখন রতনবতী জিজ্ঞাসা করলেন–‘আৰ্য আপনার চোখ কিভাবে নষ্ট হল? বোধিসত্ত্ব–‘ভদ্রে কর্মফল। এবলে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫৬-৫৭। একজন্মে আমি পাপ-পুণ্য উভয় বিধ কর্ম করেছিলাম। সে পাপের ফলেই এখন আমি অন্ধ হয়েছি। ভদ্রে, পূর্বে আমি এরূপ কর্ম করেছি। তাই আমার এ অবস্থা হয়েছে। কায়-বাক্য মনে যা করা হয়, তাই তাকে ছায়ার ন্যায় অনুসরণ করে। ইহা শুনে রাজকন্যা জিজ্ঞাসা করলেন–“আর্য, আপনার এ বিয়োগ কে ঘটালো?” তখন বোধিসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথায় বললেন
৫৮। সর্বদা বীজের ধর্মতানুযায়ীই ফল হয়। আমি পূর্বে বোধ হয় কারো বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেছিলাম।”
রতনবতী এ সল্পমাত্র ধর্মকথা শুনে অতিশয় প্রীতি সৌমনষ্য উৎপাদন করে “অহো, উনির বাক্যগুলি অত্যন্ত সুভাষিত।’ এরূপ চিন্তা করে দাসীকে বললেন–“হে দাসী, তুমি এখন আমার প্রকোষ্টে গিয়ে আমার নিজস্ব সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা শীঘ্রই নিয়ে এস।” দাসী এ নির্দেশ মতে সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা এনে দেবীকে প্রদান করল। তখন তিনি বোধিসত্ত্বকে বললেন–“আর্য, এখন আপনার সুভাষিত ধর্ম কথার পূজার জন্য সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা আপনাকে প্রদান করছি। ইহা আপনি গ্রহণ করুন।” ইহা শুনে তিনি চিন্তা করলেন–এ রাজকন্যা সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা আমাকে দান করছে। আমি ইহার দান গ্রহণ করব না।” এ চিন্তা করে তিনি এদান প্রত্যাখান করবার উদ্দেশ্যে বলেন“তুমিই ইহা পুনঃ গ্রহণ কর। আমি তোমাকে দিচ্ছি।” তিনি বলেন–আৰ্য, এ সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা আপনারই উপযোগী। আমার প্রতি অনুকম্পা করে এ মুদ্রা গ্রহণ করুন। মহাসত্ব তার কথা শুনে চিন্তা করলেন–“আমার বনচারী বন্ধুদ্বয় আমার বড়ই উপকারী। সুতরাং এখন আমি এ সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা গ্রহণ করে তাদের দেব।” এরূপ চিন্তা করে বললেন–“আচ্ছা ভদ্রে, তাহলে দাও।” এ বলে দেবীর সম্মুখে শঙ্খপত্র লাঞ্ছিত হস্ততল প্রসারণ করলেন। দাসী বোধিসত্ত্বের প্রসারিত শঙ্খপত্র অঙ্কিত হস্ততল দেখে দেবীকে কানে কানে বলল–“আর্য, আমি এর হস্ততলে শঙ্খপত্র অঙ্কিত আছে দেখলাম। রতনবতী একথা শুনে বোধিসত্ত্বকে অবলোকণ করে আমাকে জানাবে?’ এরূপ চিন্তা করে তাকে সুবর্ণ মুদ্রা সমূহ প্রদান করলেন। তিনিও তা গ্রহণ করে নিজের নিকট রেখে দিলেন। তৎপর রতনবতী সে স্থান হতে সামান্য দূরে গিয়ে দাসীকে বললেন–‘ফলবিকে, আমরা উভয়ে তাঁকে কি করে জানব?’ ফলবিকা বলল–“আৰ্য্যে, আপনার সুবর্ণ পত্রে অই ছবিখানি দেখা উচিত হবে।’ তিনি বলেন–হ্যা, তোমার প্রস্তাবই যুক্তিযুক্ত। এখন তুমি গিয়ে সে সুবৰ্ণ পাটুখানি নিয়ে এস। দাসী তখনিই গিয়ে সে সুবর্ণ পাটখানি এনে দেবীর হস্তে দিল। তিনি তা দেখে ‘আহা! এ ছবিখানি ইনির মতই অবিকল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ইনি অন্ধ এ চিন্তা করে দাসীকে বললেন–‘ফলবিকে, এব্যক্তি অন্ধ বিধায় সন্দেহ উৎপন্ন হচ্ছে। দাসী বলল–আর্যে, বদবা মুখ ব্রাহ্মণ আমাদের এ সংশয় বিনোদন করতে পারবে।’ তিনি বললেন–“হ্যাঁ, ঠিকই বছ। তুমি গিয়ে তাঁকে এখানে নিয়ে এস’ দাসী তখনি গিয়ে তাকে যথাশীঘ্র দেবীর নিকট এনে দিল। তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন–“দেখুন, অই শিলাপট্টে উপস্থিত পুরুষটি কে?’ তখন ‘বদবা মুখ’ ব্রাহ্মণ তাঁকে দেখে চিনতে পারলেন এবং দৌড়ে গিয়ে বোধিসত্ত্বকে জড়িয়ে ধরে দেবীকে বললেন–“আর্যে, এ কুমার আমাদের রাজপুত্র। ইনিই আমার প্রিয় সহায় শঙ্খপত্ৰ কুমার।” ইহা শুনে সপরিষদ রাজকন্যা এবং অন্তঃপুর নিবাসীনী নারিগণ বোধিসত্ত্বকে পরিবেষ্টন করে রোদন করতে লাগলেন। অতঃপর ব্রাহ্মণ কুমারের মুখাবলোক করে বললেন–হে রাজপুত্র, কিরূপে আপনার চক্ষু নষ্ট হল? তিনি বললেন–“ব্রাহ্মণ আপনি নীরব থাকুন। প্রাণী সমূহ সংসারে সংসরণ করবার কালে এতাদৃশ দুঃখ প্রাপ্ত হয়। মহাসত্ত্ব এবলে “কর্মেই সুখ-দুঃখ প্রবর্তিত হওয়ার কারণ ব্রাহ্মণকে দেখাবার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৫৯-৬০। প্রাণীসমূহ সংসারে সংসরণ করবার কালে পূর্বকৃত কর্মের হেতুতেই নিত্য সুখ-দুঃখ প্রাপ্ত হয়। সকল প্রাণীই কর্মের দ্বারা সংসারে যশঃর্কীতি ও প্রশংসা লাভ করে। জগতে ক্ষতি বৃদ্ধি লাভ হয় কর্মেরই হেতুতে।”
তখন রতনবতী ফলবিকাকে বললেন–হে, তুমি গিয়ে আমার পিতা মহারাজকে এ সংবাদ জ্ঞাপন কর। দাসী তখনি দেবীর আদেশে গিয়ে অঙ্কুর রাজাকে শঙ্খপত্র কুমারের আগমন বার্তা নিবেদন করলেন। তখন অঙ্কুর রাজা ও অনঙ্গসেনা দেবী উভয়ে এসংবাদ শুনে হৃষ্ট তুষ্ট হয়ে মহাসেনা বাহিনী পরিবৃত হয়ে তথায় আগমন করলেন। ব্রাহ্মণ তাঁহাদের দেখে “এখন আপনার মাতুল মহারাজ রাণীসহ এখানে এসেছেন। এবলে কুমারকে নিয়ে গিয়ে রাজরাণীকে বন্দনা করালেন। তৎপর অঙ্কুররাজা মহাসড়কে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। অমাত্যবৃন্দ জনগণ ও অনঙ্গসেনা দেবীও রোদন করতে লাগলেন। শোক বিনোদনের পর অঙ্কুররাজা বোধিসত্ত্বকে বললেন–“তোমার এদুঃখ কি কারণে উৎপন্ন হয়েছে?” বোধিসত্ত্ব বললেন–“মহারাজ আমার এদুঃখ পূর্বকর্ম বিপাক বশেই উৎপন্ন হয়েছে।”
বোধিসত্ত্বের মাতা যশঃকীর্তি দেবী মহাসেনা বাহিনী সহ স্বীয় রাজ্য হতে যাত্রা করে সে দিবসেই লোমদ্বীপে এসে উপস্থিত হলেন। তখন দৌবারিক অঙ্কুর রাজাকে যশঃকীর্তি দেবীর আগমন বার্তা নিবেদন করলেন। অঙ্কুর রাজা প্রহৃষ্ট হয়ে যশঃকীর্তি দেবীকে আগু বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মহাপরিবার সহ অনঙ্গসেনা দেবী ও রতনবতী দেবীকে প্রেরণ করলেন। মহাসত্ত্বও তখন স্বীয় মাতার আগমন বার্তা শুনে অঙ্কুর রাজাকে বললেন–মহারাজ, আমিও মাতাকে আগু বাড়িয়ে আনবার জন্য। যেতে ইচ্ছা করি রাজা তাঁকে নিবারণ কল্পে বললেন–কুমার, তুমি এখন রুগ্ন আমার সাথে এখানে উপবেশন কর। তিনি বললেন–‘মহারাজ, আমার মা আমাকে অন্বেষণ করবার জন্য নিজের জীবনের প্রতি লক্ষ্য না রেখে মৃত্যুমুখ সদৃশ অতি ভয়ঙ্কর মহাসমুদ্র পার হয়ে এখানে এসেছেন। তবে আমি জীবিত থেকেও আমার মাতাকে আগু বাড়িয়ে আনবনা কেন? আপনি আমাকে অনুমতি দিন। এরূপ বললেও রাজা তাঁকে উক্তরূপে বারয় নিবারণ করলেন। মাতৃগুণ স্মরণ করে মহাসত্ত্ব অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন রতনবতী সহ অনঙ্গসেনা সপরিষদ পরিবৃত হয়ে সমুদ্র তীরে উপনীত হলেন। সেখান হতে যশঃকীর্তি দেবীকে সুবর্ণ স্যন্দনে করে এনে যখন। তারা উদ্যানে পৌছিলেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–আমার পুত্র এখন কোথায় আছে? উত্তর হল–‘আর্যে, আপনার পুত্র এ উদ্যানে জনগণ পরিবৃত হয়ে মঙ্গল শিলাপট্টে উপবিষ্ট আছেন।” দেবী পুত্র দর্শনের প্রবল ইচ্ছায় “স্যন্দনে গমন গৌণ হচ্ছে মনে করে স্যন্দন হতে অবতরণ করে পদব্রজে চলতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে পুত্রকে দূরহতে দেখে হের প্রবলাকৰ্ষণে দ্রুত গিয়ে পুত্রের নিকট উপস্থিত হলেন। দেবীকে দেখে অঙ্কুররাজা বোধিসত্ত্বকে বললেন–রাজ কুমার, তোমার মাতা এখানে এসেছেন।” ইহা শুনে তিনি আসন হতে উঠে মাতার নিকট গিয়ে অভিবাদন করলেন। যশকীর্তি দেবী অঙ্কুর রাজাকে বন্দনা করে পুত্রকে আলিঙ্গন করলেন এবং শির চুম্বণের পর রোদন পরায়ণা হয়ে বললেন–
৬১-৬২। প্রণাধিক পুত্র, আমি তোমাকে দর্শনের জন্যই এসেছি। অদ্য তোমার দর্শন পেয়ে আমার সর্বশোক উপশম হয়েছে। অদ্যই আমি সুখী হলাম। তুমি সুখী হও। আমার বিচ্ছেদ দুঃখ এখন নিবৃত্ত হয়েছে। তোহার দুঃখও নিবৃত্ত হউক।” তাঁর এরূপ বিলাপ শুনে রাজ পরিষদও বিলাপ করলেন। শোক উপশম হওয়ার পর যশঃকীর্তি দেবী পুত্রের মুখ অবলোকন করে বললেন–প্রাণপ্রতিম পুত্র, তোমার চক্ষু কে নষ্ট করল? তিনি বললেন–মাত ‘দুর্বিতর্ক ব্রাহ্মণই আমার এ অনর্থকারী। এ বলে ব্রাহ্মণের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করলেন–। ইহা শুনে দেবী বিলাপ পরায়ণা হয়ে নিতাক্ত গাথাটি বললেন–
৬৩। অকৃতজ্ঞ পাপচিত্ত ও ধনলোভী ব্রাহ্মণই আমার প্রিয় পুত্রের এরূপ দুঃখ উৎপাদন করেছে।
এখন অঙ্কুর রাজা চিন্তা করলেন–‘এ রাজ কুমার আমার কন্যার জন্যই এরূপ দুঃখপ্রাপ্ত হয়েছে। একে আমার কন্যা সম্প্রদান করব বলে ইতি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এখন। এর চক্ষু নষ্ট হলেও তাকে আমার কন্যা সম্প্রদান করব।’ এরূপ চিন্তা করে রাজা যশঃকীর্তি দেবী সহ শঙ্খপত্র কুমারকে মহাপরিষদ সমভিব্যাহারে সুসজ্জিত স্বীয় নগরে নিয়ে এলেন এবং মহাসষ্কারের সহিত দেব বিমান সদৃশ সুসজ্জিত রাজ প্রাসাদে বোধিসত্নের সহিত রতনবতীর অবস্থানের ব্যবস্থা করলেন। এতে শঙ্খপত্র ও রতনবতী পরম সুখে সুখী হলেন। রাজকন্যা পতিকে দেবতার ন্যায় শ্রদ্ধা ও পরম যত্নে সেবা। করতে লাগলেন। তখন মানধ্বজ রাজা নিজের এক কর্মচারীকে আদেশ করলেন–“ওহে, তুমি ব্রাহ্মণকে সঙ্গে করে এ অঙ্গুরীয়ক যুগল উপহার স্বরূপ অঙ্কুর রাজাকে দিয়ে এস। তখন কর্মচারী রাজার আদেশমতে সে অঙ্গুরীয়ক সহ অই দুষ্ট ব্রাহ্মণকে শৃংখলাবদ্ধ করে লোমদ্বীপ নগরে প্রবেশ করল। তথায় মানুষেরা ব্রাহ্মণকে শৃংখলাবদ্ধ দেখে সংক্ষুব্ধ হলেন। রতনবতীর পদচারিণী বন্ধনদশা প্রাপ্ত ব্রাহ্মণকে দেখে রতনবতীকে তা জানাল। তখন তিনি প্রকোষ্ঠ হতে বের হয়ে দ্বিতল প্রাসাদে দাঁড়িয়ে কোলাহলের কারণ জানবার ইচ্ছায়। জিজ্ঞাসা করলেন– এ মহাশব্দ কিসের এবং কেনই বা কোলাহল হচ্ছে?’ তখন মহাসত্ব পত্নীকে আহ্বান করে বললেন–‘ভদ্রে আমি এখানে একাকী, তাই এ মহাশব্দ শুনে আমি ব্রাসিত হয়েছি। শীঘ্রই তুমি এখানে এস, তাঁর কথা শুনে দেবী ক্ষিপ্রগতিতে প্রবেশ করে সুবর্ণ পাত্রে গন্ধরস সহযোগে মিশ্রী সরবৎ তৈরী করে তাঁকে প্রদান করে বললেন–“রাজপুত্র, এখন আপনি তৃষিত হয়েছেন। এ পানীয় পান করুন”। ইহা শুনে রাজকুমার ক্ষত্রিয়াভিমানে বিমন হয়ে চিন্তা করলেন–‘এখন এ নারী ‘মিশ্রী সরবৎ পান করুন, এরূপ বাক্য প্রয়োগে আমাকে অবজ্ঞা করছে। স্ত্রীগণ আটটি কারণে নিজের স্বামীকে অবজ্ঞা। করে। যথা–স্বামীর রুগ্নাবস্থায়, চলতে অক্ষমতায়, জীর্ণ শীর্ণ হলে, সুরাদি নেশাসক্ত হলে, ঔদাসিন্যতায়, পর নারীর প্রতি অনুরক্ততায়, সর্বকর্মে প্রমত্ততায়, ধন উৎপাদনে অমনযোগীতায় এবং স্বর্ণ রৌপ্যাদিময় অলঙ্কার তৈরী করে না দেওয়ায়। এ কারণ সমূহের মধ্যে এর অবমাননায় একমাত্র কারণ হল ‘আমি অন্ধ। ইহাই আমার দোষ। এ চিন্তা করে বললেন–“ভদ্রে, তোমার এ পানীয় পান করা আমার নিষ্প্রয়োজন। এ বলে তিনি পানীয় পান করলেন না। তখন রাজকন্যা তাঁর বাক্য শুনে মর্মান্তিক দুঃখে হৃদয় যেন বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হল। তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন–হে স্বামিন, রাজপুত্র, আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। আমি অনিচ্ছায় প্রমত্ত হয়েছি। আপনার বাক্য উপলব্ধি করতে পারিনি। দেবী এরূপ তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেও ক্ষমা না পেয়ে পিতা মাতার নিকট গিয়ে অশ্রুসিক্ত বদনে এ বিষয় তাঁদের কর্ণগোচর করলেন। তা শুনে উভয়ে তাঁকে বললেন–“হে রতনবতি, তুমি অন্যায় করেছ। তোমার জন্ম রাজকুলে তুমি রাজকন্যা। সুতরাং স্বামীর কোন প্রকার অশান্তি উৎপাদন করা তোমার উচিৎ নয়। রতনবতী বললেন–“তাহলে অদ্যই আমি স্বামীর নিকট বিশিষ্টরূপে ক্ষমা প্রার্থনার ব্যবস্থা করব।’ এ বলে তখন তিনি ধার্মিক শ্ৰমণ ব্রাহ্মণদের একত্রিত করে দেববিমান সদৃশ অলঙ্কৃত মহাপ্রাসাদে বসলেন। তৎপর সপরিবারে অঙ্কুর রাজা ‘অনঙ্গসেনা দেবী ও যশঃকীর্তি দেবী এ জনত্রয়কে মহার্ঘ্য আসনে বসালেন। মহাসড়কে নিজে নানারত্নে সজ্জিত মহার্ঘ্য শয্যায় রাজপরিষদের মধ্যস্থলে বসালেন। তখন রতনবতীওন করে সর্বাভরণে প্রতিপণ্ডিতা হয়ে উত্তমরূপে মুখ প্রক্ষালনের পর সে মহাসম্মিলনীতে উপস্থিত হলেন। পদ্ম প্রভৃতি সুগদ্ধপুষ্পমাল্যে স্বামীকে পূজা করলেন। তৎপর তিনি পূর্বমুখী হয়ে জানুদ্বয় ভূতলে স্থাপন করতঃ মস্তকোপরি অঞ্জলীবদ্ধ করে সত্যক্রিয়া করার উদ্দেশ্যে নিন্মোক্ত গাথায় ভাষণ করলেন–
৬৪-৬৬। সমবেত সর্বজনমণ্ডলি, আপনারা সবাই আমার বাক্য শ্রবণ করুন। জগতে সর্বক্ষণ সত্যই পরম ও প্রধান। ইহা একান্তই সত্য যে যেকোন সময় স্বামী আমাকে আহ্বান করলে, তখন ঔৎসুকো সাড়া দিয়েছি। এ সত্যবাক্যের প্রভাবে তাঁর বামচক্ষু উৎপন্ন হয়ে তিনি সুখী হউক। আমি যেন সর্বদা অপ্রমত্তভাবে স্বামীর নিকট বাস করতে পারি। “এ সত্যবাক্যের প্রভাবে তাঁর বামচক্ষু উৎপন্ন হউক।” রতনবতী এ সত্যক্রিয়া করা মাত্রই মহাসত্বের বামচক্ষুর প্রাদুর্ভাব হল। সেক্ষণেই চুরানব্বই অযুত দ্বিসহস্র যোজন দলবিশিষ্ট মহা পৃথিবী উন্মত্ত গজেন্দ্রের ন্যায় সগর্জনে কম্পিত হল সুমেরু পর্বতরাজ নমিত হল বিদ্যুৎ বিকশিত হল। চন্দন পারিজাত প্রভৃতি দিব্যচুর্ণ ও দিব্যপুষ্প আকাশ হতে বর্ষিত হল। অন্তরীক্ষে দিব্য তুর্য দিব্য। সঙ্গীতের সুতান লহরী রণীত হল। সেক্ষণে দেবগণ মুহূর্মুহুঃ সাধুবাদ বিঘোষিত করলেন। তৎপর মহাসত্ব আসন হতে উঠে অঙ্কুর রাজাকে বললেন–“মহারাজ, এখন আমি সত্যক্রিয়া করব। রাজা তাঁর কথা অনুমোদন করে বললেন–“তাত, তুমিও এখন সত্যক্রিয়া কর।” তখন তিনি মুখ প্রক্ষালনের পর পূৰ্বাভিমুখী হয়ে দক্ষিণ জানু ভূতলে স্থাপন করে মস্তকোপরি অঞ্জলীবদ্ধ করত নিন্মোক্ত গাথায় সত্যক্রিয়া করলেন
৬৭-৭০। সমাগত ভদ্রগণ, আপনারা সবাই আমার বাক্য শ্রবণ করুন ব্রাহ্মণ দ্বারাই আমার চক্ষু নষ্ট হয়েছে। আমার অঙ্গুরীয়ক সাতের ইচ্ছায় সে আমার এরূপ দুঃখ সৃষ্টি করেছে। আমার চক্ষু উৎপাটন কালে আমি বহু দুঃখ বেদনা। অনুভব করেছিলাম। কিন্তু আমার অন্তরে কোন প্রকার ক্রোধভাব জাগ্রত হয়নি। এ সত্যবাক্যে আমার দক্ষিণ চক্ষু উৎপন্ন হউক। দানই আমার প্রিয়। তাই তাকে অঙ্গুরীয়ক দিয়েছি, বোধিলাভের জন্যই। আমি যদি সত্যিই ভবিষ্যতে বুদ্ধত্ব লাভ করি, তাহলে এ সত্যবাক্যের প্রভাবে আমার দক্ষিণ চক্ষুর প্রাদুর্ভাব হউক।” মহাসত্ত্ব সত্যক্রিয়া করা মাত্রই তাঁর দক্ষিণ চক্ষুর প্রাদুর্ভাব হল। সেক্ষণেও মহা পৃথিবী কম্পণ প্রভৃতি বহু আশ্চর্য বিষয়ের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। এই সময় দেবগণ সপুরোহিত যশরাজকে এক পুষ্পবিমানে বসিয়ে আকাশ পথে লোমদ্বীপে এনে নভোমণ্ডলে স্থিত হলেন। তখন ‘বদবামুখ’ তথায় দণ্ডায়মান হয়ে উর্ধদিকে অবলোকণ করে সে পুষ্পবিমানে আগত যশঃরাজা ও পুরোহিতকে দেখে জনগণকে বললেন–“সুধীবৃন্দ, দেখুন পুরোহিত সহ আমাদের রাজা এসে আকাশেই স্থিত হয়েছেন। তখন জনগণ আকাশের দিকে অবলোকন করে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হলেন। অতঃপর এ বিমান এসে সিংহদ্বারে স্থিত হল। ইহা দেখে জনগণ তাদের আগুবাড়িয়ে নেওয়ার জন্য উপস্থিত হলেন। বোধিসত্ত্বের পিতা যশরাজ তথায় স্থিত বোধিসত্ত্বকে দেখে, তাঁকে আলিঙ্গন করলেন ও তাঁর শিচুম্বন করে বললেন–আমার প্রিয় পুত্র তুমি, সহস্র বৎসর পরমায়ু লাভ কর।” এবলে পুত্র ও পুত্রবধু উভয়ের মধ্যে অতি প্রিয়ভাব জ্ঞাত হয়ে রাজা অত্যন্ত সন্তোষ লাভ করলেন। তখন দৌবারিক এসে অঙ্কুর রাজাকে বলল“মহারাজ, মানধ্বজ রাজার দূত এসে দ্বারে অপেক্ষা করছেন। রাজা বললেন–‘তাকে এখানে নিয়ে এস।’ তখন অমাত্য রাজদূতকে সাথে করে নিয়ে এলেন। তখন রাজদূত অঙ্কুররাজাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বললেন–“মহারাজ এ অঙ্গুরীয়কদ্ব্য আমাদের রাজা আপনার নিকট উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছেন। অঙ্কুররাজা সে অঙ্গুরীয়ক দেখে যশঃ রাজাকে বললেন–“রাজন দেখুন, এ অঙ্গুরীয়কদ্বয় রাজা মানধ্বজ আমার জন্য পাঠিয়াছেন। যশঃরাজা বললেন–‘তা বড়ই উত্তম হইয়াছে। অঙ্কুর রাজা অঙ্গুরীয়কদ্বয় গ্রহণ করে তা শঙ্খপত্রকে প্রদান করলেন। তারপর রাজা দূতকে জিজ্ঞাসা করলেন–‘দূত, তোমাদের রাজা এ অঙ্গুরীয়কদ্বয় কোথায় পেলেন?’ দূত বলল‘মহারাজ, এক ব্রাহ্মণের নিকটই পেয়েছেন। “সে ব্রাহ্মণ এখন কোথায় আছেন?” মহারাজ, তিনি এখন এখানে বহিরদ্বারে রয়েছেন। রাজা বললেন–“এখন তাকে এখানে নিয়ে এস।” দূত বলল–“মহারাজ সে ব্রাহ্মণ এখন বন্দী, শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাই এমাঙ্গল্য স্থানে তার প্রবেশ করা ন্যায় হবেনা।” ইহা শুনে মহাসত্ব করুণ চিত্তে অঙ্কুর রাজাকে বললেন–মহারাজ, এ ব্রাহ্মণকে মুক্তি দিন। অতপর রাজা দূতকে বললেন–“হে দূত, তুমি তাকে বন্ধন মুক্ত করে এখানে নিয়ে এস।” তখন দূত গিয়ে ব্রাহ্মণকে মুক্তি দিয়ে রাজার নিকট নিয়ে এলেন। অঙ্কুর রাজা ব্রাহ্মণকে দেখে বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করলেন–“বাবা, এ ব্রাহ্মণই কি তোমার চক্ষু উৎপাটক?” কুমার বললেন– হাঁ মহারাজ, ব্রাহ্মণ তা শুনে অত্যধিক ভীত হয়ে সেখানে ভূপতিত হল। তখনি মিত্রদ্রোহিতা কর্মের ধর্মতঃ অনুরূপ বিপাকবশে ব্রাহ্মণের চক্ষুদ্বয় চক্ষুকোটর হতে বের হয়ে পড়ল। বোধিসত্ত্বের চক্ষু উৎপাটন মহা গুরুকর্ম। এই দারুণ কর্মই ব্রাহ্মণের দৃষ্ট ধর্ম বেদনীয় কর্মে পরিণত হয়েছে। কর্মের এরূপ মহাবিপাক দান দর্শন করে সবাই আশ্চর্য হলেন। মহাসত্ত্ব যতদূর বিস্ময়াপন্ন হয়েছেন ততোধিক করুণায় ও কাতর হলেন। তিনি করুণার্ল অন্তরে আসন হতে উঠে তাকে আলিঙ্গন করে বললেন—হে ব্রাহ্মণগণ, ভয় করবেন না” এবলে আশ্বস্ত করে নিন্মোক্ত গাথায় সত্যক্রিয়া করলেন
৭১। হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার চক্ষুদ্বয় উৎপাটনকালে আমার অন্তরে কিঞ্চিৎআত্রও ক্রোধের সঞ্চার হয়নি। আমার এ সত্য বাক্যের প্রভাবে আপনার চক্ষু পূর্ববৎ হউক এবং আপনি সুখী হউন।”
বোধিসত্ত্বের সত্যক্রিয়া-প্রভাবে তখনি ব্রাহ্মণের চক্ষুদ্বয় প্রাদুর্ভাব হল। তৎপর ব্রাহ্মণ বোধিসত্ত্বকে দেখে, অহো! এ কল্যাণ মিত্রের দ্বারা আমার এরূপ কল্যাণ হল। এচিন্তা করে নিন্মোক্ত গাথায় আনন্দভাব প্রকাশ করলেন–
৭২। হে রাজপুত্র, আপনার দ্বারা আমি সুখী ও নির্ভয় হইলাম। আপনিই আমার সুখ উৎপাদন করলেন।”
ইহা শুনে তিনি তাকে উপদেশ প্রদান মানসে বললেন–হে ব্রাহ্মণ, এহতে আর মিত্রদ্রোহীর কাজ করবেন না।” ব্রাহ্মণ বললেন–রাজপুত্র আপনার উপদেশ বড়ই মঙ্গলদায়ক। এমিত্র দ্রোহিতার কর্মফল আমি ইহলোকেই ভোগ করলাম। আজ হতে এরূপ কর্ম আর করবনা।” অতঃপর মহাসত্ত্ব সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন। তখন ব্রাহ্মণ তা গ্রহণ করে সন্তুষ্টচিত্তে যথা সুখে চলে গেল। তারপর বোধিসত্ত্ব অঙ্কুর রাজাকে বললেন–“রাজন, এখন আমার বহু উপকারক সিংহ ও কুঞ্জর উভয়উদান পালকে দেখতে একান্ত ইচ্ছা করি।” ইহা শুনে রাজা জনৈক ব্যক্তিকে বললেন–“হে, তুমি যথাসত্বর সিংহ ও কুঞ্জরকে এখানে ডেকে নিয়ে এস।” সে তখনই ঐ উদ্যান পালদ্বয়কে আহ্বান করে রাজার সম্মুখে নিয়ে এল। রাজা। বোধিসত্ত্বকে উদ্যানপালের আগমন বার্তা জ্ঞাপন করলেন। তিনি প্রাসাদ হতে বের হয়ে নিজেই তাদের আলিঙ্গন করলেন এবং আগুবাড়িয়ে এনে রাজাকে বললেন–“মহারাজ, এ উভয় উদ্যানপাল আমার বহু উপকারী। আপনি এদের যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করুন। তা শুনে অঙ্কুররাজ তাদের উভয়কে শ্বেতছত্রসহ সহস্র গ্রাম প্রদান করলেন। তৎপর রাজা নানাবিধ মঙ্গলাচরণ সম্পাদন করে নানারত্নে সজ্জিত আসনে রাজকুমার শঙ্খপত্রকে বসালেন সুবাসিত জল পরিপূর্ণ ষোড়শ সুবর্ণ-ঘট ও দক্ষিণাবর্ত মঙ্গল শঙ্খ নিয়ে উক্ত মাঙ্গলিক জল সিঞ্চনে মঙ্গলাভিষেক করে তাঁকে লোমদ্বীপ নগরের রাজত্বভার প্রদান করলেন। বোধিসত্ত্বের রাজ্যোভিষেক–উৎসব সমাপ্তির পরদিবসেই দেবগণ পুষ্পবিমানে সপরিবার যশকীর্তি দেবী ও সপুরোহিত যশঃরাজাকে লয়ে আকাশপথে পোতপুর নগরে পৌছিয়ে দিলেন। বোধিসত্ত্বের পিতা মাতা সহস্র বৎসর জীবিত ছিলেন। তাঁরা পোতপুর নগরে রাজৈশ্বর্য পরিভোগ করে পরম সুখে অবস্থান করেছিলেন। যথাকালে তারা মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। মহাসত্ত্ব নিজের উপকারক। সিংহ ও কুঞ্জরকে উপদেশ দান করে পুনঃ তাদের বস্ত্রালঙ্কারাদি উপহার দিলেন এবং পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠাপিত করে তাদের বাসস্থানে পাঠিয়ে দিলেন। তৎপর মহাসত্ত্ব ধৰ্মত ও সাম্যত রাজত্ব করতে লাগলেন। সে হতে মহাসত্ত্ব স্বীয় অগ্রমহিষী রতনবতীর সাথে লোমদ্বীপ নগরে রাজ-সম্পদ পরিভোগ করতে লাগলেন এবং অর্থীদের দান দিয়ে পুণ্যার্জনে নিয়োগ করলেন। এরূপ সহস্র বৎসর পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে তাঁরা পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। শাস্তা এ ধর্ম দেশনার পর জাতক সমাপন করে নিন্মোক্ত আটটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–
৭৩-৮০। তখনকার দুঃশীল দুবিতর্ক বিনষ্ট পাপচিত্ত, আমার শত্রু এখন দেবদত্ত। সিংহ নামক পুরুষ এখন সারিপুত্র, কুঞ্জর নামক ব্যক্তি এখন মোগ্নল্লায়ণ। রাজ মাতা যশঃকীর্তি এখন মহামায়া। যশঃরাজ এখন শুদ্ধোদন। অঙ্কুররাজা এখন আনন্দ। মহিষী রতনবতী এখন যশোধরা। নগরের অমাত্যাদি দ্বিরাজ্যবাসী এখন আমার শাসন পুরক পরিষদবৃন্দ। শঙ্খপত্র মহারাজ এখন আমি লোকনাথ লোকজ্যেষ্ঠ অনুত্তর তথাগত সমুদ্ধ। ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারী তোমরা সবাই সর্বদা অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(শঙ্খপত্র রাজ জাতক সমাপ্ত।)
জাতক পঞ্চাশক ১ম দশক সমাপ্ত ॥
Leave a Reply