০৮. ধার্মিক পণ্ডিত-রাজ জাতক
‘ভবৎ’ ইহা আমার মণ্ডপ’ এ গাথা শাস্তা মেঘবতী নামক নগরস্থ মেঘবনারামে অবস্থান কালে সর্বপরিভোগ্য পরিখার দান প্রসঙ্গে বলেছিলেন।
তখন মেঘবতী নগরবাসী জনৈক মহাধনশালী কুটুম্বিক স্বীয় গ্রামে একখানা মহামণ্ডপ প্রস্তুত করেছিলেন। তাহা বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে নিমন্ত্রণ করে ছ’দিন যাবৎ মহাদান দিয়ে সপ্তম দিবসে প্রসন্ন চিত্তে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে অষ্টপরিখার দান দিয়ে ছিলেন। তখন উক্ত মণ্ডপে শাস্তা কুটুম্বিকের দান অনুমোদন উপলক্ষে বললেন–“এখন আমার শাসনে আপনি মহাদান প্রদান করলেন।” পূর্বেও পুরাতন পণ্ডিতগণ এরূপ মহাদান প্রদান করেছিলেন।” এরূপ বলে মৌণভাব অবলম্বণ করলেন। তখন বুদ্ধ ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় সে অতীত বিষয় বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে বারাণসী নগরে “ধার্মিক পণ্ডিত” নামক এক রাজা ধর্মতঃ সাম্যভাবে রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্র মহিষীর নাম “সুধর্মা।” সে শ্রদ্ধাবান ধার্মিক পণ্ডিত রাজ মহাদান দেওয়ার ইচ্ছায় এক সুত্রধরকে আহ্বান করে গ্রাম মধ্যে প্রকাণ্ড এক মণ্ডপ প্রস্তুত করলেন। মণ্ডপ নির্মাণ কার্যের পরিসমাপ্তির পর সূত্রধরকে বিবিধ বস্তু, বস্ত্রালঙ্কার ও অর্থ প্রদান করে বিদায় করলেন। ধার্মিক পণ্ডিত রাজ প্রাসাদ হতে বের হয়ে মহামণ্ডপ অবলোকন করে অত্যধিক প্রীত হলেন। তখন তিনি সে মণ্ডপে স্থিত হয়ে অমাত্যবৃন্দকে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–
১। “ভদ্রগণ, আমার এ মণ্ডপ অতিশয় শ্রেষ্ঠ উপযুক্ত ও দর্শনীয় হয়েছে। এখানে জনগণকে সপ্তাহকাল ব্যাপী মহাদান দেব।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব সে মণ্ডপে প্রত্যহ জনগণকে মহাদান দিয়ে নিন্মোক্ত গাথাটি বলতেন–
২। “আমি জনসাধারণকে মহাদান দিচ্ছি, অনাগতে আমার বোধি লাভের জন্য তোমরা আমার দান গ্রহণ কর।”
ইহা শুনে জনগণ সে মহামণ্ডপ হতে নিত্যই বোধিসত্ত্বের দান গ্রহণ করতে লাগলেন। রাজা সপ্তম দিবসে সর্ব পরিখার ও ভোজ্য বস্তু সজ্জিত করে মহাদান দিলেন। তৎক্ষণাৎ সে দান তেজানুভাবে চার নিযুত দ্বিশত সহস্র যোজন দল বিশিষ্ট মহাপৃথিবী মত্ত হস্তীর ন্যায় গর্জন করে কম্পিত হল। মহাসমুদ্র উদ্বেলিত হল, সুমেরু পর্বতরাজ ও সুস্বেদিত বেত্রের ন্যায় অবনমিত হয়ে বারাণসী অভিমুখী হল। বজ্রনির্ঘোষ ও মেঘগর্জন সহ ক্ষণিক অকাল বৃষ্টি বর্ষণ ও বিদ্যোৎ লহরী। প্রাদুর্ভূত হল। দেবরাজ ইন্দ্র করতালি দিলেন। মহাব্রহ্মা সাধুবাদ প্রদান করলেন। ব্রহ্মলোক পর্যন্ত মহাকোলাহল উখিত হল। এ বিষয় প্রকাশ করার মানসে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৩। “সে মহাদান প্রদত্ত হলে তখনি ভীষন রোমাঞ্চকর ভাবে পৃথিবী কম্পিত হল।
৪। এবং সে ভাবে নগরও সংক্ষুব্ধ হল।” তৎকালে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হল। ইহাতে দেবরাজ তত্ত্বারণ চিন্তা করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৫। “আমাকে এ দেবাসন হতে চ্যুত করবার ইচ্ছায় কোন দেব-মনুষ্য দান ব্রহ্মচর্য প্রভৃতি পুণ্য কর্ম বিশেষভাবে পরিপূর্ণ করছেন কি?
তখন দেবরাজ দিব্যজ্ঞানে তৎবিষয় সম্যক্ জ্ঞাত হয়ে চিন্তা করলেন–“এ ধার্মিক পণ্ডিত রাজা বুদ্ধাঙ্কুরই জনগণকে দান দিচ্ছেন, অনাগতে ইনি নিশ্চয়ই বুদ্ধ হবেন। এখন আমি মনুষ্য লোকে গিয়ে মহাপুণ্যবান রাজাকে দেবলোকে নিয়ে আসব।”
এ চিন্তা করে দেবরাজ দিব্য শক্তি প্রভাবে সপ্তরত্ন প্রতিমণ্ডিত এক রত্ন বিমান প্রস্তুত করলেন এবং উহাতে আরোহণ করে দেবলোক হতে ধার্মিক পণ্ডিত রাজার সম্মুখে অবতরণ করার পর মণ্ডপের পূর্ব-পার্শ্বে স্থিত হলেন। রাজা এরূপ অপূর্ব বিমান। দেখে নিন্মোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞাসা করলেন–
৬। “ইনি কে? দেবপুত্রের মত বিমানযোগে এসে আমার সম্মুখে স্থিত হলেন? তাঁর নাম কি তাও জানি না। জিজ্ঞেস্ করলেন–“এখানে স্থিত হয়েছেন আপনি কে?” দেবরাজ বললেন–
৭। “রাজন, আমি দেবরাজ! পূর্বজন্মের কৃত পুণ্যের প্রভাবে ইন্দ্রত্ব লাভ করেছি। আপনাকে নিমন্ত্রণ করবার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। সুতরাং এখন আপনাকে দেবলোকে গমন করতে হবে।”
এ বলে দেবরাজ পুনঃ রাজাকে বললেন–“হে পুণ্য পুরুষ, আপনি বুদ্ধাঙ্কুর। আপনি যে মহা পৃথিবী কম্পিত করে মহাদান দিয়েছেন, এর ফলে আপনি অনাগতে বুদ্ধ হবেন। তাই আমি আপনার দানে তুষ্ট হয়ে এখানে এসেছি। এখন আপনি এসে। আমার সাথে এ বিমান সদৃশ রথে আরোহণ করুন।” এ বলে দেবরাজ পুনঃ রাজাকে নিমন্ত্রণ জ্ঞাপক নিতাক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৮। “রাজন, আমার সাথে দেবলোক গমণের জন্য শীঘ্রই রথে আরোহণ করুন এবং দেবলোকে রমিত হউন।” ইহা শুনে মহাসত্ব “সাধু দোজ” বলে তাঁর বাক্যে সম্মতি প্রদানের পর বিমানে উঠে বসলেন। তখন দেবরাজ সবিমান আকাশে উখিত। হয়ে দেবলোক অভিমুখে অগ্রসর হলেন। দেবলোক গমন কালে বিস্ময়কর সুদৃশ্য বিমান সমূহ দেখে দেবরাজকে নিন্মোক্ত গাথায় জিজ্ঞাসা করলেন–
৯। দেবরাজ, আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, “কোন্ পুণ্যের প্রভাবে এসব দেবতা সপ্তরত্নে সুশোভিত বিচিত্র সুবর্ণ বিমান সমূহ লাভ করেছেন?” বোধিসত্ত্বের প্রশ্ন শুনে দেবরাজ দেবগণের পূর্বকৃত পুণ্যকর্ম সমূহ নিন্মোক্ত আটটি গাথায় প্রকাশ করলেন–
১০-১৭। “বিহার বুদ্ধ মুর্তি, চৈত্য নির্মাণ ও বোধিবৃক্ষ রোপণ ইত্যাদি পুণ্যকর্মের প্রভাবে এসব দেবতা ঈদৃশ বিমান লাভ করেছেন। যে ব্যক্তি ধর্মশালা ও সেতু নির্মাণ করে দান করেন তিনি সে পুণ্যের প্রভাবে এরূপ বিমান লাভ করেন। যে ব্যক্তি অন্ন, পানীয়, বস্ত্র ও শয়নাসন দান করেন, তিনি সর্বদা এরূপ বিমান লাভ করেন। যে ব্যক্তি ধ্বজা, পতাকা, ছত্র ও প্রদীপ দণ্ড দান করেন, তিনি সর্বদা এরূপ শ্রেষ্ঠ বিমান লাভ করেন। যে ব্যক্তি চাটাই, কাষ্ট, দন্ত কাষ্ট ও জলদান করেন, তিনি স্বর্গে বিমান-রথ লাভ করেন। যিনি প্রদীপ, ধূপ-ধুম, মালা, সুগন্ধি ও বিলেপন দান করেন তিনি স্বর্গে বিমান-রথ লাভ করেন। যিনি ভিক্ষুগণের ব্যবহার্য-বস্তু দান করেন, বালুকা চৈত্য দান করেন এবং পরের দান দেখে প্রসন্ন হন, তিনি সর্বদা শ্রেষ্ঠ বিমান লাভ করেন। যিনি পাদুকা, মঞ্চ, পীঠ, পালঙ্ক, ধনধান্য ও আহার্য বস্তু দান করেন, তিনি সর্বদা শ্রেষ্ঠ বিমান লাভ করেন।”
অতঃপর দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে বললেন–
১৮। “হে নরেন্দ্র, আপনি এ নয়নাভিরাম বিমানে বাস করুন। আপনাকে চিরদিনের জন্য এ বিমান দেবো। আপনি আমার নিকট অবস্থান করুন।” তদুত্তরে বোধিসত্ত্ব নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
১৯-২২। “দেবেন্দ্র ধার করা যান-বাহন বা ধন সম্পদ নিজস্ব হয় না। তা পরের ধন। আপনি তা দান-পুণ্যের প্রভাবেই লাভ করেছেন। সুতরাং সেরূপ ধন আমি ইচ্ছা। করিনা। নিজের কৃত পুণ্য বলে লব্ধ সম্পদই স্থায়ী সম্পদ। তাই আমি মনুষ্যকুলে গিয়ে দান, সদাচার, সংযম চিত্ত দমন ইত্যাদি বিবিধ কুশল কর্ম সম্পাদন করে নির্ভীক ও সুখী হতে চাই। ভবিষ্যতে যেন কোনদিন আর অনুতাপ করতে না হয়।”
এ বলে মহাসত্ব দেবলোক হতে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে গাথাযোগে বললেন–
২৩। “দেবরাজ, এখন আমি এখান থেকে যেতে ইচ্ছা করি। মনুষ্যলোকে অবস্থান করে সর্বদা দানশীল ভাবনাদি সর্ববিধ পুণ্যকর্ম করতে ইচ্ছা করি। সে পুণ্য কর্মের প্রভাবেই আপনার নিকট উৎপন্ন হব।”
তারপর দেবরাজ নিজের রথ-বিমানে বোধিসত্ত্বকে লয়ে স্বর্গ হতে অবতরণ করলেন এবং বারাণসীতে পৌছিয়ে দিয়ে তাঁর নিকট হতে বিদায় নিয়ে স্বীয় বাসস্থানে চলে গেলেন। বুদ্ধ সে বিষয় প্রকাশ করবার ইচ্ছায় নিজে গাথাযোগে বললেন–
২৪। “দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক হতে ধার্মিক পণ্ডিতকে মনুষ্যলোকে পৌছিয়ে দিয়ে তাকে উপদেশ প্রদানান্তর স্বস্থানে চলে গেলেন।”
তৎপর অমাত্য প্রমুখ জনসাধারণ ধার্মিক পণ্ডিত রাজার আগমন বার্তা শুনে সবাই রাজাঙ্গনে সমবেত হলেন। তখন মহাসত্ত্ব সবাইকে দেবরাজের দিব্য সম্পদের বিষয় নিন্মোক্ত গাথায় বর্ণনা করলেন–
২৫-৩০। “দেবলোক সর্বদা স্বর্ণ রৌপ্যময় দিব্য সম্পদে দেদীপ্যমান ও নৃত্য-গীতে মুখরিত হচ্ছে। দেবগণ তথায় নিরন্তর মহা-পুণ্যবতী দেব ললনাগণ পরিবৃত হয়ে বিরোচিত হচ্ছেন। তথায় তারা দিব্য ভোগ-সম্পদে সৌভাগ্যশালী হয়ে শোভা বর্ধন করছে। দিব্য উদ্যেন, পুষ্করিণী ও প্রাসাদ সমূহ দিব্য সৌন্দর্যে শোভা পাচ্ছে। কল্পবৃক্ষ পরিশোভিত দেবলোকে পুণ্যবান দেবতাগণ অভিরমিত হচ্ছেন। তথায় কার্পাসাদি দিব্য বস্ত্র সমূহ দেবতাদের পুণ্য প্রভাবে কল্পবৃক্ষে উৎপন্ন হয়ে পরিশোভিত হচ্ছে। দেবনগর সর্বদা মৃদঙ্গ, করতাল, শংখ, তুর্য, ঢাক, ঢােল ইত্যাদি নানাবিধ শ্রুতিমধুর মনোরম বাদ্যধ্বনিতে মুখরিত। মুক্তা, মণি ও বৈদুর্যময় অলঙ্কার সুশোভিত দেবলোকে সর্বদা দিব্য খাদ্য ভোজ্য উৎপন্ন হয়।”
এরূপে মহাসত্ব তথায় সমবেত জনগণকে দেবসম্পত্তির বিষয় বর্ণনা করলেন–। তখন জনগণ মহাসত্তের কথা শুনে প্রসন্নচিত্তে দানাদি পুণ্যকর্ম করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। মহাসত্ত্বও দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন। করে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। এরূপে সে ধনাঢ্য ব্যক্তিকে এ ধর্ম দেশনা করে পুনঃ ভগবান তাঁকে নিন্মোক্ত গাথায় চারি আর্যসত্য দেশনা করলেন
৩১-৩২। “দুঃখ সত্য, দুঃখ সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য; এ চতুর্বিধ আর্যসত্য আমি সর্বদাই দেশনা করি। দুঃখ সত্য ত্রৈভূমিক, তৃষ্ণাই সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য নির্বাণ এবং মার্গ সত্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
এরূপে চতুর্বিধ আর্য সত্য দেশনার অবসানে সে ধনাঢ্য ব্যক্তি স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। বুদ্ধ এরূপে তাঁকে চতুরার্য সত্য দেশনা করে পাঁচটি গাথা বলে জাতক সমাপ্ত করলেন
৩৩-৩৭। তখন যে দেবরাজ ইন্দ্র ধার্মিক পণ্ডিত রাজাকে স্বর্গে লয়ে গিয়েছিলেন, সে এখন দিব্য চক্ষু ধারীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ অনুরুদ্ধ। ধার্মিক পণ্ডিতের পিতা এখন শুদ্ধোদন, মাতা মহামায়া দেবী। ধার্মিকের ভার্যা এখন রাহুল মাতা যশোধরা। অমাত্য প্রভৃতি জনগণ ও অবশিষ্ট জনগণ এখন আমার শাসন পূরক সমস্ত শ্রাবক। ধর্মে স্থিত ধার্মিক পণ্ডিত নামক মহারাজ আমিই এখন লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(ধার্মিক পণ্ডিত রাজ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply