০৭. দান ত্যাগ জাতক
“এখন আমার প্রদত্ত দান” ইহা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে অবস্থান–সময় তাঁর পূর্বজন্মের দান বিষয় সম্পর্কে বলেছিলেন।
একসময় বর্ষাবাস পরিসমাপ্তির পর বুদ্ধ একদিন মহামোল্লায়ণ, কোণ্ডাঞো ও আনন্দ এতিনজন মহাশ্রাবক সঙ্গে করে নানাস্থানে ধর্ম প্রচারের পর অনুক্রমে ‘অজিত’ রাজ্যে উপস্থিত হলেন। তথায় অজিত নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ‘কাঞ্চন দেবী’ রাজার বহু মহিষীর মধ্যে কাঞ্চন দেবীই জ্যেষ্ঠ। তিনি ছিলেন রাজার অতিশয় প্রিয়া-মনোজ্ঞা। রাজা কাঞ্চন দেবীকে অযুত টাকা মূল্যের কুসুম্ভ পুষ্পের মত রক্তিমবর্ণ একখানা বস্ত্র দিয়ে অবশিষ্ট মহিষীদের সহস্র টাকা মূল্যের একখানা রক্তিমবর্ণ কুসুম্ভ বস্ত্র প্রদান করে বললেন–“তোমরা অদ্য হতে এবস্ত্র ব্যবহার কর। অতঃপর একদিবস রাজা চতুরঙ্গ সেনা সহ স্বীয় রাজ্য-সীমা দর্শনের জন্য বের হলেন। তখন শাস্তা মহামোগ্নল্লায়ণকে বললেন–মোগ্নল্লায়ণ, তুমি অজিত নগরে পিণ্ডাচরণ কর। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। তখন স্থবিরও পাত্র চীবর ধারণ করে নগরে গিয়ে রাজাঙ্গনে দাঁড়ালেন। সে সময় কাঞ্চন দেবী অপরাপর ছোট রাণী পরিবৃতা হয়ে সিংহদ্বার বিবৃত করে বাহিরদিকে দৃষ্টিপাত করতেই বুদ্ধের দ্বিতীয় শ্রাবককে দেখলেন। ইহাতে তিনি প্রসন্ন হয়ে স্বীয় প্রাসাদে আগমনের জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। তিনিও সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। এবং এসে সজ্জিত প্রকোষ্ঠে শ্রেষ্ঠ আসনে উপবেশন করলেন। তখন রাণী বিবিধ উত্তম রসাল খাদ্য ভোজ্যে স্থবিরের পাত্র পূর্ণ করে দিলেন। তৎপর রাণী স্থবিরকে ধর্মদেশনা করবার জন্য প্রার্থনা করলেন। তখন স্থবির দান কথা, শীল কথা, স্বর্গ কথা ও বুদ্ধগুণ এবং সঙ্গুণ বিষয়ক ধর্মদেশনা করলেন। স্থবিরের ধর্মদেশনা শুনে মহারাণী অত্যধিক শ্রদ্ধাশীলা ও প্রসন্না হলেন। তখন তিনি চিন্তা করলেন–‘রাজা আমার শিরচ্ছেদ করুক বা রাজবাড়ী হতে বিতাড়িত করুক অথবা যা ইচ্ছা তা-ই করুক, আমি বস্ত্রদান করিব।’ এ চিন্তা করে ধর্ম পূজা উদ্দেশ্যে অযুত টাকার মূল্যের কুসুম্ভ পুষ্প বরণ বস্ত্রখানা স্থবিরকে দান করলেন। তখন সহস্র রাণীও প্রসন্ন চিত্তে তাঁদের বস্ত্রও স্থবিরকে দান করলেন। রাণীদের বস্ত্রদানের ফল বর্ণনা করে স্থবির আকাশ মার্গে গমন করলেন। স্থবিরের প্রভাব বলে সমস্ত বস্ত্র তাঁর সঙ্গেই গমন করল। তখন কাঞ্চনদেবী প্রমুখ সমস্ত রাণী আকাশের দিকে স্থবিরের প্রতি বন্দনা নিবেদন করতে লাগলেন। স্থবির এসে ভগবান বুদ্ধকে পাত্রটি প্রদান করলেন। ভগবান তা গ্রহণ করে আহার্য দ্রব্য ভোজন করলেন। তদবধি কাঞ্চনদেবী প্রমুখ রাণীগণ সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করতে লাগলেন। তখন অজিত রাজা সন্ধ্যাকালে সীমান্ত প্রদেশ হতে প্রত্যাবর্তন করে স্বীয় নগর প্রাসাদে আরোহণ করলেন। এমন সময় কাঞ্চনদেবী প্রমুখ সহস্র রাণী রাজাকে পরিবেষ্টন করে বসলেন। রাজা তখন। তাঁদের নিকট স্বীয় প্রদত্ত কুসুম্ভ রক্তবর্ণ বস্ত্র না দেখে বললেন–আমার প্রদত্ত বস্ত্র তোমরা পরিধান করছ না কেন? ইহা শুনে তাঁরা বললেন–“মহারাজ তা আমরা মহামোগ্নল্লায়ণ স্থবিরকে ধর্মপূজা উপলক্ষে দান দিয়েছি। তাদের একথা শুনে রাজা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে একজন কর্মচারীকে আদেশ করলেন–“ওহে, তুমি এখনি গিয়ে যথা সত্বর সে শ্রমণকে ডেকে নিয়ে এস। আদিষ্ট হয়ে কর্মচারী তখনি বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে বন্দনান্তর রাজবাড়ী যাওয়ার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন। তখন বুদ্ধ স্থবিরগণ সহ রাজবাড়ীতে উপস্থিত হয়ে শ্রেষ্ট বুদ্ধাসনে উপবেশন করলেন। অজিত রাজা তখন ভগবানকে অভিবাদনের পর একান্তে উপবেশন করে বললেন–“ভন্তে, দায়ককে বস্ত্রদানের ফল বর্ণনা করে ধর্মদেশনা করতে স্থবিরদের আদেশ করেছেন। আমাকেও বস্ত্রদানের ফল সম্বন্ধে বলুন।” রাজার এ উক্তির প্রত্যুত্তরে ভগবান বললেন–“মহারাজ, স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি ধন-রত্ন ও নানা প্রকার বস্ত্র প্রভৃতি যে কোন দানীয় বস্তু দান দেওয়া দায়কদের একান্তই কর্তব্য।” মহারাজ, অতীতে উৎপন্ন সম্যক সম্বুদ্ধের পরিমাণ মহাসমুদ্রের বালুকাচরের বালুকারাশি হতেও সমধিক, এর চেয়ে বহু গুণে সমধিক বুদ্ধগণের শ্রাবক সংঘ। তাঁরা দানের হেতুতেই বোধিলাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। বর্তমান সময় আমি যে বুদ্ধত্ব লাভ করেছি, তাও মহাদানের হেতুতে এবং অনাগতে যে সব বুদ্ধ উৎপন্ন হবেন তাও মহাদানের হেতুতেই।। মহারাজ যে কোন চক্রবর্তী রাজা মহাদানের প্রভাবেই হয়ে থাকেন।
মহারাজ যাঁরা দেবলোকে দিব্য ঐশ্বর্য পরিভোগ করছেন, তাও দানের প্রভাবে। যারা সুশ্রী, অভিরূপ, প্রসন্নতা ব্যঞ্জক ও পরম রূপ লাবণ্যশালী হয়ে থাকেন, তাও দানের প্রভাবে। যারা মহামূল্যবান, বিচিত্র ও রত্ন মণ্ডিত নানাবিধ বস্ত্র পরিভোগ করছেন, বস্ত্রদানের হেতুতেই তাঁরা এরূপ বস্ত্র লাভ করেছেন। যারা দ্বিরাজ্যের অধিশ্বর, দাস-দাসী, স্ত্রী, পুত্র ও কর্মচারী পরিবৃত হয়ে সুন্দর হস্তী, অশ্ব, রথ, গো, মহিষ ও ক্ষেত্র ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ রূপে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন; এ সৌভাগ্য তাঁরা পূর্বকালে বস্ত্রাদি দানের হেতুতেই লাভ করেছেন।”
রাজা ভগবানের এরূপ ধর্মদেশনা শ্রবণ করে অতিশয় প্রসন্ন হয়ে স্বীয় কোষ্ঠাগার হতে প্রত্যেক বস্ত্র অযুত টাকা মূল্যের যোড়া অতি সুক্ষ্ম বস্ত্ৰ আনিয়ে ভগবানকে পূজা করলেন। স্থবির এয়কেও এক এক যোড়া বস্ত্র দান করলেন। তারপর প্রধান মহিষী প্রমুখ রাণীদের প্রত্যেকে অযুত টাকা মূল্যের সুক্ষ্ম বস্ত্র এক এক যোড়া ভগবানকে দান করলেন। পুনরায় কাঞ্চনদেবী প্রমুখ সহস্র রাণী ভগবানের অমৃততাপম ধর্ম শুনে বিবিধ প্রকার বস্তু দিয়ে ধর্ম পূজা করলেন। এরূপে রাজা প্রদত্ত সহস্র যোড়া এবং কাঞ্চন দেবী প্রমূখ রাণীগণ প্রদত্ত সহস্র যোড়া, দ্বি-সহস্র যোড়া বস্ত্র ভগবানের সম্মুখে পুঞ্জিভূত করা হল। তৎপর ভগবান অজিত রাজাকে ধর্ম কথার মহাফল সন্দর্শন করিয়া আসন হতে উঠে স্থবিরত্রয় সহ আকাশ পথে জেতবনের দিকে অগ্রসর হলেন। উক্ত বস্ত্র রাশিও বুদ্ধের অনুপম প্রভাবে তার সঙ্গেই গমন করল। ভগবান আকাশে পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় বিরোচিত হলেন। স্থবিরত্রয়ও অলৌকিক শোভায় সুশোভিত হয়ে আকাশ হতে জেতবনে অবতরণ করলেন। বস্ত্ররাশি ভগবানের পুরোভাগে গিয়ে গন্ধ কুটিতে সুসজ্জিত হয়ে রইল।
একদা ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিস্ত হয়ে এরূপ কথার উত্থাপন করলেন–“আহা বন্ধুগণ, বুদ্ধানুভাব বড়ই আশ্চর্য বড়ই অদ্ভুত। যেহেতুঃ ভগবানের সঙ্গে এসে তাঁর পুরোভাগে গিয়ে গন্ধ কুটিতে সজ্জিত পুজোপচার সদৃশ হয়ে রইল। তক্কালে শাস্তা বুদ্ধ তথায় উপস্থিত হয়ে প্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ট বুদ্ধাসনে উপবিস্থ হয়ে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে কি কথা নিয়ে উপবিষ্ট আছ? তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করে বলার পর বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, শুধু এখন নয়, পূর্বেও আমি বোধিসত্বাবস্থায় নিজের পরিধেয় বস্ত্র দান দিয়ে বহু বস্ত্র লাভ করেছিলাম।” এ বলে তিনি নীরব হলেন। তখন ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় তিনি অতীত বিষয় বলতে আরম্ভ করলেন অতীতে কম্বল নামক রাজ্যে কম্বল নামক রাজা রাজত্ব করতেন। তখন বোধিসত্ব সে নগরে এক দরিদ্রকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পরের কাজ করে যে অর্থ প্রাপ্ত হতেন তা নিজের পিতা-মাতাকে দান করতেন। তাই পিতা-মাতা পুত্রের নাম রাখলেন “দানত্যাগ কুমার”। কুমার নিজের পিতামাতাকে পোষণ করে এ কম্বল নগরে বাস করতেন। একদা তিনি কার্যব্যাপদেশে অরণ্যে গেলেন। তখন কোন এক চোর এক পচেক বুদ্ধের চীবর অপহরণ করেছিল। অগত্যা তিনি একখানা দুবর্ণানবস্ত্র গায়ে দিয়ে অরণ্যে অবস্থান করছিলেন। তখন দান ত্যাগ পচেক বুদ্ধকে দেখে এখন আমার পুণ্য কর্ম সাধনের উপযুক্ত সময়।” এরূপ চিন্তা করে তিনি পচেক বুদ্ধের নিকট গিয়ে তাকে বন্দনা করে বললেন–
১। “আপনাকে আমার বস্ত্র দান করব। করুণাপরবশ হয়ে আপনি তা গ্রহণ করে আশীর্বাদ করবেন। এ দান যেন সর্বতোভাবে মহাফলদায়ক ও সুখাবহ হয়।”
এবলে বোধিসত্ব বৃক্ষপত্র পরিধান করে নিজের ব্যবহৃত বস্ত্রদ্বয় তথায় ধৌত ও শুষ্ক করে পচ্চেক বুদ্ধকে দান করলেন। পকে বুদ্ধও তা কাষায় রং এ রঞ্জিত করে একখানা পরিধান করলেন, আর একখানা গায়ে দিয়ে বসলেন। তখন বোধিসত্ব তাঁকে বন্দনা করে “ভন্তে এ দানের ফলে ইহলোকে ও পরলোকে যেন আমার অনেক বস্ত্র লাভ হয়।” এরূপ প্রার্থনা করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২। “ভন্তে অদ্য আপনাকে আমার এ বস্ত্র দানের ফলে ইহলোকে ও পরলোকে সকল সময় নিশ্চই যেন আমার বহুবিধ বস্ত্র লাভ হয়।”
তখন বোধিসত্ত্বের দান তেজে সে অরণ্যে একবৃক্ষ-বাসী দেবপুত্র-বৃক্ষের শাখা সঞ্চালন করলেন। তৎক্ষণাৎ বোধিসত্ত্বের দান প্রভাবে বৃক্ষের পত্রসমূহ দিব্য বস্ত্রে পরিণত হয়ে বোধিসত্ত্বের পাদমূলে নিপতিত হল। তারপর দেবপুত্র আকাশ হতে দিব্যরত্ন বিকীর্ণ করলেন। সে রত্নও বোধিসত্ত্বের পাদমূলে নিপতিত হল। তখন মহাসত্ব এ দুর্লভ বহু-সহস্র দিব্য-বস্ত্র ও দিব্য-রত্ন সমূহ হতে একখানা বস্ত্র ও একটি রত্ন রেখে অবশিষ্ট দিয়ে পচেচক বুদ্ধকে পূজা করলেন। তখনই এ সমস্ত দিব্য বস্ত্র ও দিব্য রত্ন পচ্চেক বুদ্ধকে পুজা করলেন। তখনিই এ সমস্ত দিব্য বস্ত্র ও দিব্য রত্ন পচেক বুদ্ধের অনুভাব বলে নানা রঙ্গে সুশোভিত এক সুবর্ণ পালঙ্কে পরিণত হল। তৎপর পচেক বুদ্ধ সে পালঙ্কে উপবেশন করলেন। তখন বোধিসত্ত্বের দানপূণ্যের প্রভাবে দেবরাজের বাসভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দেবরাজ তার কারণ চিন্তা করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৩। কোন দেবমনুষ্য অসাধারণ দান ও ব্রহ্মচর্য পূর্ণ করে আমাকে আসন হতে চ্যুত করতে ইচ্ছুক হয়েছেন নাকি। দেবরাজ দিব্য নেত্রে সম্যক কারণ দর্শন করে তখনি দেবলোক হতে এসে বোধিসত্ত্বের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে ধন্যবাদ প্রদান করে একখানা দিব্য বস্ত্র নিয়ে আকাশে নিক্ষেপ করলেন। তৎক্ষণাৎ সে বস্ত্রখানি দেবরাজের অনুভাব বলে। আকাশে দু’খানা হল। সে দু’খানা আবার চারখানা হল।
এরূপে দ্বিগুণ দ্বিগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে শত সহস্র ঘোড়ায় পরিণত হয়ে তা বোধিসত্ত্বের পাদমূলে নিপতিত হল। তৎপর দেবরাজ সে অমূল্য দিব্য বস্ত্রের দ্বারা বোধিসত্ত্বকে পূজা করে স্বীয় স্থানে চলে গেলেন। তৎবিষয় প্রকাশ করবার মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত সাতটি গাথা বললেন–
৪-১০। তথায় দেবরাজ ইন্দ্র ‘দান ত্যাগ’কে দিব্যবস্ত্র দ্বারা পূজা করে তাঁর নিকট হতে বিদায় নিয়ে, দিব্য দেহ ধারণ করে দেবলোকে চলে গেলেন এবং দীর্ঘকাল তিনি সুখ ভোগ করলেন। স্বর্ণ, রৌপ্য, বস্ত্রাদি যা কিছু দান দেওয়া হয়, তা প্রসন্ন চিত্তে ও সাদরে দিলে সল্পমাত্র দানও শ্রেষ্ঠ সুখের কারণ হয়। বস্ত্রদান অতিশয় শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর দান। প্রসন্ন চিত্তে অল্পমাত্র দান দিলেও তা শ্রেষ্ঠ ফল প্রদান করে। দায়কগণ সর্বদা মনুষ্য ও দেবলোকে অপ্রমাণ সুখ লাভ করে। যে ব্যক্তি পরিভোগ্য বস্ত্রদান করে, এর ফল অপ্রমেয়। সর্বদা এ বিপাক নানা প্রকারে সুখ দান করে। তদ্ধেতু নিজের সুখ সন্দর্শনকারী পণ্ডিত ব্যক্তিগণ সর্বদা প্রসন্ন চিত্তে দান দিবে। জগতে সুখকামী ব্যক্তিগণ শ্ৰেষ্ঠ অগ্ৰসুখ প্রার্থনা করে। এরূপ নানাবিধ দ্রব্য সাদরে দান দিবে।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব সমস্ত দিব্য বস্ত্র ও রত্ন সমূহ এক স্থানে রাশি করে পচ্চেক বুদ্ধকে বন্দনা করার পর স্বীয় গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। সেখানে দেবতা প্রদত্ত রাশিকৃত বস্ত্র ও রত্ন সমূহে বোধিসত্ত্বের তেজানুভাবে আকাশে উখিত হল এবং তা আকাশ পথে এসে বোধিসত্নের গৃহের চতুর্দিকে পতিত হয়ে বিরাটভাবে রাশিকৃত হয়ে র’ল। সে দিন হতেই বোধিসত্ত্বের গৃহে নানাবিধ মহার্ঘ্য বস্ত্র ও রত্ন সমূহ উৎপন্ন হল। তখন কম্বল রাজা, দেবী ও অমাত্য প্রমুখ জনগণ বোধিসত্ত্বকে দর্শনের প্রবলেচ্ছা সংবরণ করতে না পেরে হস্তী, অশ্ব রথ, দাস, দাসী, রৌপ্য, স্বর্ণ এবং স্বীয় স্বীয় যথাসাধ্য ধন গ্রহণ করে বোধিসত্ত্বের সাথে প্রীত্যলাপে প্রসন্ন হলেন এবং স্বীয় স্বীয় রুচিমত ধন দ্বারা তাঁকে পূজা করে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১১-১২। তখন কম্বল রাজা তুষ্ট চিত্তে সভার্যা অমাত্যগণ পরিবেষ্টিত হয়ে দান ত্যাগের নিকট উপস্থিত হলেন। রাজা প্রমোদিত চিত্তে দান ত্যাগের নিকট উপস্থিত হওয়ার পর মহাসত্ত্বের দান তেজে সমস্ত ধন তাঁকে দিলেন এবং তাঁর নিকট হতে বিদায় নিয়ে স্বীয় প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করলেন।
তদবধি বোধিসত্ত্বের যশকীর্তি বিপুলভাবে বর্ধিত হল। তিনি নিজের গ্রামদ্বারে একখানা দানশালা প্রস্তুত করে তথায় প্রত্যহ আগত যাচকগণকে অন্ন বস্ত্রাদি দানীয় বস্তু দান করতে লাগলেন। এরূপে তিনি জনগণকে মহাদান দিয়ে তাঁদের নিন্মোক্ত গাথায় উপদেশ দিতেন
১৩। ভবঙ্গণ, আমি যেমন পূর্বজন্মে দান দিয়ে এখন সর্ববিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, তোমরাও আমার ন্যায় সেরূপ অপ্রমত্ত হয়ে যথাশক্তি দান দাও।
সে হতে জনসাধারণ বোধিসত্ত্বের উপদেশ পালনে নিরত হয়ে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। উক্ত পচ্চেক বুদ্ধও কম্বল নগরবাসী জনগণের হিতকামী হয়ে কিছুকাল অরণ্যে অবস্থান করে সেখান হতে আকাশ পথে গন্ধমাদন পর্বতে চলে গেলেন। তথায় পরমায়ুর অবসানে অনুপাদিশেষ নির্বাণ ধাতুতে পরিনির্বাপিত হলেন। তৎবিষয় প্রকাশ মানসে তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
১৪-১৫। তখন জনগণের লৌকিক সম্পত্তি দায়ক অনাসব পকে সম্বুদ্ধ গন্ধমাদন পর্বতে দীর্ঘকাল অবস্থান করে পরিশেষে অনুপাদিশেষ নির্বাণ ধাতুতে নির্বাপিত হলেন।
তখন বোধিসত্ত্ব কম্বল নগরে সারাজীবন পিতামাতাসহ উক্ত সম্পত্তি পরিভোগ করলেন এবং দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন। শাস্তা এ ধর্ম দেশনা আহরণ করে জাতক সমাপ্ত করার পর নিন্মোক্ত ছ’টি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন
১৬-২১। তখনকার দেবরাজ ইন্দ্র আমার শাসনে এখন দিব্য চক্ষুধারীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ অনুরুদ্ধ। তথায় অরণ্যবাসী বন-বৃক্ষ দেবপুত্র এখন আমার সেবক আনন্দ। কম্বলরাজ্যশ্রীবর্ধনকারী কম্বল নামক রাজা এখন আমার শাসনে মহাঋদ্ধিবান মোল্লায়ণ। রাজ মহিষী এখন গৌতমী। রাজার সেনাপতি পরিষদ এখন আমারই পরিষদ। দান ত্যাগের মাতাপিতা এখন মহামায়া ও শুদ্ধোদন। দান ত্যাগ এখন আমিই লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। শ্রেষ্ঠ ও উত্তম সুখকামিগণ অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক এরূপ বলে ধারণ কর।
(দান ত্যাগ জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply