০৫. সুম্ভ মিত্র জাতক
“রাজন আমাকে অবসর দিন” এ বিষয় বুদ্ধ জেতবনে অবস্থান কালে দেবদত্ত সম্পর্কে বলেছিলেন।
একদা ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় বসে এরূপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। “বন্ধুগণ, দেবদত্ত যখন বুদ্ধের প্রতি বৈরীচিত্ত পোষণ করে তীরন্দাজদের নিয়োজিত করে তথাগতের প্রাণ সংহারে চেষ্টা করেছিলেন, তখন বুদ্ধই উক্ত তীরন্দাজদের জীবন দান করেছিলেন। এমন সময় বুদ্ধ সেখানে এসে। প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবেশন করে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, এখন তোমরা এখানে কোন্ কথার আলোচনা করছিলে?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় ভগবানের নিকট প্রকাশ করলেন। তা শুনে ভগবান বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, দেবদত্ত শুধু এখন নয়, পূর্বেও আমার অনর্থ সাধন করেছিল। এতদূর বলে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন ভিক্ষুদের প্রার্থনায় তিনি পূর্ব বৃত্তান্ত বলতে আরম্ভ করলেন
“হে ভিক্ষুগণ, অতীতে চম্পক নামক নগরে এক রাজা রাজত্ব করতেন। ইনিই বুদ্ধাঙ্কুর। তাঁর কনিষ্টভ্রাতার নাম অসুমিত্র, অগ্রমহিষীর নাম ছিল “কেশিনী দুটি তাঁর পুত্র সন্তান। জ্যেষ্ঠের নাম ‘জয়সেন’, কনিষ্ঠের নাম জয়দত্ত। একদা অসুম্ভমিত্র চিন্তা করল–আমার ভ্রাতা এখন রাজা। তিনি যদি এখানে বাস করেন, তা হলে তাঁর পুত্রই এ রাজ্যের ভার প্রাপ্ত হবে। সুতরাং এ রাজ্য তাদের না দিয়ে আমি নিজেই যাতে রাজা হতে পারি, সে উপায় অবলম্বন করতে হবে।” এরূপ দুরভিসন্ধি পোষণ করে নিজের পক্ষ সমর্থনের জন্য বহু স্বর্ণ, রৌপ্য, বস্ত্র ও অলঙ্কার প্রভৃতি উচ্চপদস্থ অমাত্যগণকে উপটোকন দিতে আরম্ভ করল। অমাত্যগণ অসুমিত্রের উৎকোচ লাভ করে সকলেই তার পক্ষ গ্রহণ করল। অতঃপর একদিবস অসুম্ভমিত্র স্বীয় পক্ষ সমর্থনকারীদের পরিমাণ জানবার ইচ্ছায় নিজের গৃহে সমস্ত সেনাগণকে সমবেত করাল। সে সময়ে বোধিসত্ত্বের এক গুণ গ্রাহী অমাত্য তাঁর গুণ স্মরণ করে তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন এবং অসুম্ভমিত্রের দুরভিসন্ধির বিষয় যথাযথভাবে নিন্মোক্ত গাথায় ব্যক্ত করলেন
১। “হে রাজন, আমাকে অবকাশ দিন। আপনার নিকট গুপ্ত বিষয় প্রকাশের জন্যই এখানে এসেছি।
২। রাজন; আপনি শীঘ্রই সচেতন হউন। আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আপনাকে গুহ্য বিষয় বলব, যা একান্তই সত্য।”
ইহা শুনে রাজা তাকে অবকাশ প্রদান করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৩। অমাত্য প্রবর, শীঘ্রই আমাকে আপনার বক্তব্য বিষয় বলুন। যা আমার হিতসাধন করবে। প্রবঞ্চনা ত্যাগ করে যথাযথ বলুন।” রাজার অবকাশ পেয়ে অমাত্য নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
৪। “আমি অদ্যই আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে এরূপ কথা শুনেছি–সে আপনার রাজ্য লুণ্ঠন করবে, সুতরাং আপনি সতর্কতা অবলম্বন করুন।”
ইহা শুনে রাজা চিন্তা করলেন–“রাজাদের বহু অন্তরায়। এরাজ্য সর্ব সাধারণের ভোগ্য।” এ চিন্তা করে রাজার সংবেগ উৎপন্ন হল। জনগণের প্রতি করুণাবশে চিন্তা করলেন–“যদি আমার কনিষ্ঠের সাথে যুদ্ধ করি, এতে আমার বহু সেনা বিনষ্ট হবে। জনগণের বিনাশ সাধন করা করুণা হীনের কাজ। তাই আমি অদ্য রাত্রিতেই এনগর ত্যাগ করব।” এরূপ চিন্তা করে এ হিতৈষী মহা অমাত্যকে প্রচুর ধন দিয়ে বিদায় করলেন। অতঃপর রাজা অগ্র মহিষীর শয়ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে পুত্রদ্বয়কে বক্ষে ধারণ করলেন। তারপর রাণীর সঙ্গে এরূপ পরামর্শ করলেন–সে বিষয় প্রকাশ করার মানসে তথাগত বুদ্ধ। নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন
৫-৯। মহারাজ লাবণ্যময়ী কেশিণীকে সম্বোধন করে বললেন–“ভদ্রে আমি তোমাকে যে সব ধন-ধান্য দিয়েছি, হিরণ্য, সুবর্ণ, মুক্তা, মণি ও বৈদুর্য ইত্যাদি এবং পৈতৃক-ধন সমস্তই নিধান করে রাখ।” তখন সর্বশোভিনী রাণী কেশিণী রাজাকে বললেন–“দেব আমি সে ধন কোথায় নিধান করব? তা আমাকে বলুন ॥” তখন রাজা বললেন–“ভদ্রে, শীলবান শ্ৰমণ-ব্রাহ্মণকে যথা শক্তি দান দাও ॥ প্রাণীদের পক্ষে দানের ন্যায় প্রতিষ্ঠা আর কিছুই নেই। দানই ভোগ সম্পদের নিদান এবং দানই ভোগ সম্পদের প্রতিষ্ঠা।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব পুনঃ দেবীকে উপদেচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথায়ে বললেন–
১০-১২। পুত্রদ্বয়কে যেন পাপিষ্ঠ অসুম্ভমিত্র বধ না করে তেমনভাবেই তাদের রক্ষা করবে ॥ হে কল্যাণী, তুমি এখন অল্পবষ্কা, পুরুষ অভিলাষিণী। তুমি যাকে স্বামী রূপে মনোনীত করবে, তাকে সযত্নে পুষ্প মাল্যে বরণ করে সেবা করবে ॥ আমার অবর্তমানে বরণ করা স্বামী যদি তোমার অমনোজ্ঞ হয়, তবে অন্য স্বামী অন্বেষণ করে নিও। আমার বিচ্ছেদে তুমি। দুঃখিত হয়োনা।”
কেশিনী রাজার এবম্বিধ বাক্য শ্রবণে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিন্তা করলেন–“আমার স্বামী এরূপ অযৌক্তিক কথা কেন বলছেন?” তিনি সশ্রু নয়নে বললেন–“মহারাজ, আপনি এরূপ
অসংগত কথা কেন বলছেন?” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব দেবীকে তার। কারণ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে প্রকাশ করে বললেন–
১৩। আমি প্রচণ্ড হিংস্র জন্তু সমাকুল জীবন সংশয়কর ঘোর মহারণ্যে একাকীই গমন করব।
১৪। ব্যাঘ্র-দীপি সেবিত প্রচণ্ড হিংস্র প্রাণী সমাকুল বিজন অরণ্যে অবস্থান করব। তুমি এখানে সুখে বাস কর। ইহা শুনে কেশিনী মহা দুঃখে দুর্মনা হয়ে স্বীয় স্বামীর সাথে গমনের জন্য নানাবিধ বাক্যালাপে রত হলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত পঁয়তাল্লিশটি গাথা ভাষণ করলেন
১৫-৫৯। ইহা শুনে সর্বাঙ্গ শোভিনী কেশিনী বললেন–অবাঞ্ছিত হীন কথা কেন ভাষণ করছেন? ইহা আমার পক্ষে দুঃখ দায়ক বাক্য, সুখ দায়ক নয়। আমার সুখের জন্য এখন অন্য বাক্য ভাষণ করুন। মহারাজ, আপনি যে একাকী বনে যাবেন, তা ন্যায় সঙ্গত নয়। হে ক্ষত্রিয়, আপনি যেখানে যাবেন, আমিও আপনার সাথে তথায় যাব। আপনার নিকটই আমার মরণ। আপনা হতে বিচ্ছেদ হওয়ার চেয়ে এ অভাগিনীর মৃত্যুই শ্রেয়। আপনাকে ছেড়ে আমার এ জীবন চাই না। মহা অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে আমার মৃত্যুই বরং শ্রেয়। তবুও আপনি বিনা জীবন ধারণ করা আমার অভীস্পিত নয়। মহা অরণ্যে হস্তিনী যেমন হস্তির অন্বেষণে গিরি-গহ্বর, দুর্গম ও সম বিসম মহারণ্যে গমন করে, সেরূপই আমি পুত্রদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে সুপোষ্য হয়ে আপনার পশ্চাৎ অনুসরণ করব। ভার স্বরূপ দুষ্পেষ্য হয়ে নয়।” রাজা রাণীকে বললেন–“তথায় চন্দনাদি সুগন্ধি চূর্ণ ও ধূলি নিবারণকারী জল ও ব্যবহার করতে পারবে না। কৌশিক, খৌম ইত্যাদি মনোরম সূক্ষ্ম বস্ত্র ধারিনী কোমলাঙ্গিণী ভদ্রে, কিরূপে কুশ চীরাদি ধারণ করবে? তখন পুণ্যলক্ষণ মণ্ডিতা মহারাণী বললেন–“হে রথার্ষভ আপনার সঙ্গে থাকলে তা আমি পরম সুখ-কর মনে করব। রাজা বললেন–ভদ্রে, তুমি নিবৃত্ত হও। বনবাস তোমার দুঃসহ হবে। বনে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ-মশক ও মধুমক্ষিকাদি তোমায় হিংসা করবে। তা তোমার অসহ্য দুঃখকর হবে। আরো দেখা যায়তীক্ষ তীব্র সন্তাপে সন্তপ্ত হয়ে নদী সেবিত নির্বিষ মহাশক্তিশালী অজগর সর্প আছে। তারা মনুষ্য ও মৃগ সন্নিধানে হঠাৎ এসে আপন দেহ দ্বারা বেষ্টন করে নিজের বশে নিয়ে যায়। অন্য এক প্রকার অতিশয় ভয়ঙ্কর অচ্ছ নামক হিংস্র জন্তু আছে। তাদের নিকট হতে কোন পুরুষ বৃক্ষে উঠেও মুক্তি পায়না। সুতীক্ষ শৃঙ্গধারী ভয়ঙ্কর মহিষ বনে যত্রতত্র বিরচণ করে। প্রচণ্ড মৃগ ও গরু এবং বাছুর সহ ভয়ঙ্কর গাভী পাল সর্বদা বনে ইতঃস্তত বিচরণ করে। ভদ্রে, তুমি উহাদের সম্মুখে পড়লে কি করবে? ভদ্রে, তুমি দুর্গম পথে প্রচণ্ড হিংস্র জন্তুর সম্মুখীন হলে তখন; মহাবিপদ ও ভয়ে নিপতিত হবে। তুমি অন্তঃপুরে অবস্থান করেও শৃগালের শব্দ শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়, তবে তুমি বনে গিয়ে কিরূপে থাকবে? মহাবনে মধ্যাহ্ন কালে সুতীব্র উত্তাপের। যন্ত্রণায় পক্ষীকুল একত্রিত হয়ে আর্তনাদ করে। সেখানে কেন যেতে ইচ্ছা কর? তখন সুলক্ষণা দেবী রাণী কেশিণী বললেন–দেব, বনে যে ভয়ের কথা আমাকে বললেন–আমি তা সবই জ্ঞাত আছি। একমাত্র আপনার সাহচর্যই আমার পক্ষে পরম সুখ দায়ক। জগতে এর চেয়েও কটুতর দুঃখ, স্বামী বিচ্ছেদ যন্ত্রণা। হে রথার্ষভ, আপনার সাথেই আমি গমন করব। কাশ, কুশ তীক্ষ কণ্টক, উশির, দুঃখ সংস্পর্শ কর তৃণ ও কর্কশ মুঞ্জ তৃণ ইত্যাদি সানন্দে বক্ষের দ্বারা অতিক্রম করব। আমি আপনার বোঝা স্বরূপ হবনা। উদর পূর্তির কারণে বহুবিধ ব্রতাচরণ দ্বারা কুমারীগণ পতি লাভ করে। অগ্নিদগ্ধ ও জলে নিমগ্ন হওয়া এবং পতি বিরহ বা বৈধব্য জগতে এ তিনটি বড়ই যন্ত্রণা দায়ক। সুতরাং স্বামি, আমি আপনার সহগামীই হব। আপনার উচ্ছিষ্ট লাভে বঞ্চিত হলে যদি দুর্বল হয়ে পড়ি; আপনার হস্ত ধারণ করে ক্লান্তি বশতঃ যখন চলতে অক্ষম হব, তখন আপনার আকর্ষণে পথ অতিক্রম করতে পারব। আপনার হস্তে আমার কেশ কলাপ দিয়ে আমি দুর্বল শরীরে ভূপাতিত হলে ও আপনার আকর্ষণে বহু দুঃখ ভোগ করা সত্ত্বে ও আপনার সাথেই চলব। যদিও বা আমার সুকোমল চর্ম পৃথিবীর। ঘর্ষনে উলুক-বায়সের চর্মের ন্যায় উৎপাটিত হয়ে যায়, যাউক, অক্ষম হলেও তবুও আপনার সঙ্গে সঙ্গেই চলব। বিবিধ ধন সম্পদে সমৃদ্ধ জ্ঞাতিকুল এবং ভ্রাতা-ভগ্নি সখী প্রভৃতি শ্ৰীয় স্বজনের কোনও শান্তি দায়ক বাক্য লাভও না হলে তবুও আপনার সাথেই যাব। জল বিহীন নদী নগ্না, রাজা বিহীন রাজ্য নগ্ন এবং দশ ভ্রাতার বিদ্যমানেও বিধবা নারী নগ্না। ৪৫। ধ্বজাই রথের চিহ্ন। ধূমই অগ্নির চিহ্ন, রাজাই রাজ্যের চিহ্ন এবং স্বামীই নারীদের সৌভাগ্য-চিহ্ন। আমি সর্বদা কাষায় বসন ধারণ করে আপনার পশ্চাদ গামিনী হব। নারীদের পক্ষে স্বামী হীনা হয়ে থাকা বড়ই কটু-দুঃখময়। বহু বিত্তশালী নানা রতনে পরিপূর্ণ মহা পৃথিবীও আপনাকে ব্যতীত চাই না। স্বামীকে দুঃখে রেখে স্বীয় সুখ ইচ্ছাকারিনী নারীর হৃদয় কিরূপ? পরিপূর্ণ রাজ্য বর্ধনকারী ও আমার সর্বকামনা পূর্ণকারী স্বামীন; আপনি রাজ্য হতে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমি ও আপনার পশ্চাদ গামিনী হব।” তখন রাণী কেশিনীকে রাজা বললেন–“তোমার এ জয়সেন ও জয়দত্ত সমাংস শালী চাউলের অন্ন ভোজনে। অভ্যন্ত, তারা ফল মূল খেয়ে কিরূপে জীবন ধারণ করবে? তারা সর্বদা সুবর্ণাদি রত্নময় থালায় ভোজনে অভ্যস্ত। অরণ্যে তারা কিরূপে বৃক্ষ পত্রে ভোজন করবে? যে বালক সর্বদা কৌশিক ও রেশমী-পশমী বস্ত্র ধারণ করে থাকে, তারা অরণ্যে কিরূপে কুশচিরাদি ধারণ করবে? যারা সর্বদা রথ ও স্যন্দন যোগে গমনাগমন করে তারা অরণ্যে কিরূপে খানু-কন্টকময় পথে চলবে? যাদের জন্য সর্বদা মনোরম সুখময় ব্যবস্থা নির্ধারিত এবং যারা নির্বাধ অর্গল যুক্ত প্রাসাদে বাস করে থাকে, তারা কিরূপে অরণ্যে ও বৃক্ষমূলে শয়ন করবে? যারা সর্বদা মনোরম আরামপ্রদ পালঙ্কে শয়ন করে থাকে, তারা কিরূপে অরণ্যে তৃণ শয্যায় শয়ন করবে? যে বালকদ্বয় সর্বদা শ্রেষ্ঠ চন্দনাদি সুগন্ধি বিলেপনে মণ্ডিত হয়ে থাকে, তারা অরণ্যে কি প্রকারে ধূলি-বালি সমাকীর্ণ অবস্থায় দিন যাপন করবে? যারা চামরী চোমর ও ময়ুরপালক-ব্যজনীর বাতাসে বর্ধিত তারা অরণ্যে আঁশ, মশক ইত্যাদি দংশনে কিরূপে কাল যাপন করবে?” এরূপে তারা পরস্পর নানাবিধ কথা কথনের পর রাণী পুত্রদ্বয়কে তাদের সঙ্গে গ্রহণের ইচ্ছায় বললেন–
৬০। রাজন্ এ পুত্রদ্বয় আমাদের অতি প্রিয় ও মনোজ্ঞ। আমাদের যে অবস্থা হবে, তাদেরও সে অবস্থা হবে। আমি তাদের সঙ্গে করে আপনার পশ্চাদ গমন করব। আমি আপনার বোঝা স্বরূপ না হয়ে নির্ভরশীল হয়েই আপনার সহিত গমন করব।” রাজা গমনোদ্যাক্তা রাণীর কথা শুনে, তাকে বারণ করতে না পেরে বললেন–ভদ্রে, তা হলে তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে যাবে? এবলে নিন্মোক্ত গাথা বললেন–
৬২। “আমি দাস-দাসী পর্যন্ত সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করিনা। তাই বলছি তুমি আমার সাথে গেলে বড়ই দুঃখ পাবে।”
তখন দেবী রাজার সহিত যাওয়ার অনুমতি পেয়ে স্বীয় জীবন যাপননাপযোগী প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান বস্তু সমূহ এক থলিয়ায় পূর্ণ করে তা রাজাকে প্রদান করলেন। তৎপর নিজে জয়দত্তকে ক্রোড়ে নিলেন। রাজা পাথেয় পূর্ণ থলিয়াটি নিজের স্কন্ধদেশে সংলগ্ন করে জয়সেনকে ক্রোড়ে তুলে নিলেন। এরূপে উভয়ে রাজপুরী হতে বের হলেন। এ বিষয় প্রকাশ কল্পে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৬৩। ৬৪। তখন দেবী কেশিনী জয়দত্তকে ক্রোড়ে করে স্বীয় গ্রাম হতে বের হলেন। সুম্ভমিত্র রাজাও পাথেয় বলে স্কন্ধদেশে সংলগ্ন করে ও জয়সেনকে ক্রোড়ে করে স্বীয় নগর হতে বের হলেন।
তখন মহাসত্ব সপুত্ৰদার নিজের চম্পা নগর হতে বের হয়ে ক্রমান্বয়ে বহুদূর গমণের পর এক নদী-তীরে উপনীত হলেন তথায় এক ড়ুমুর বৃক্ষ মূলে বসে রাজা দেবীকে বললেন–“ভদ্রে এ নদী অত্যন্ত গভীর এবং তিনমাইলের মত প্রস্থ হবে। আমি তোমাদের সবাইকে একসাথে নিয়ে অপর তীরে যেতে সক্ষম হবনা। আমার এ শিশুদ্বয় ছােট ও হাল্কা। সুতরাং তাদের এক সঙ্গেই নিয়ে যেতে পারব। তুমি গুরুভার হেতু প্রথমে তোমাকে রেখে এসে তৎপর ছেলেদের নিয়ে যাব। দেবী রাজার প্রস্তাবে “সাধু” বলে অনুমোদন করে জয়দত্তকে স্তন্য পান করালেন। তারপর তথায় শিরবেষ্টন-বস্ত্র বিস্তার করে তাকে তথায় শয়ন করালেন। সে যখন নিদ্রিত হল, তখন তাড়াতাড়ি জয়সেনকে কিছু খাবার বস্তু দিয়ে রাজা-রাণী নদীতে অবতরণ করতে উদ্যোত হলেন। তখন জয়সেন সজল নেত্রে পিতা-মাতাকে সম্বোধন করে বলল–“মা, আমরা এখানে কি করে থাকব? বাবা, দুধের শিশু এ ছােট ভাইকে নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে নদীরতীরে অনাথ হয়ে কি করে থাকব? বাবা, আপনি দেরী করবেন না। সহসা এসে আমাদের নিয়ে যাবেন।” পুত্রের এরূপ হৃদয় বিদারক কাতর বাণী শুনে মাতা-পিতার চক্ষু সজল হয়ে উঠল। তারা তাকে আশ্বাসিত করে উভয়ে নদীতে অবতরণ করলেন। রাজা রানীকে তিনমাইল বিস্তৃত নদী বহু শ্রমে সন্তরণ করে পরতীরে এক বৃক্ষ-মূলে রেখে পুনঃ পুত্রদ্বয়কে নিয়ে আসার জন্য নদীতে নেমে সন্তরণ করতে লাগলেন। এমন সময় দুজন কৈবর্ত ছােট একখানা নৌকা নিয়ে নানা কথা বলতে বলতে ঐ রাজ পুত্রদ্বয়ের সমীপবর্তী হল। তখন জয়সেন সে আলাপ শব্দ শুনে নিজের পিতা মনে করে ‘বাবা, বাবা’ বলে আহ্বান করল। কৈবর্তদ্বয় বালকের কণ্ঠস্বর শুনেই তথায় এসে দেখল দুটি ছােট বালক। তাদের দেখে কৈবর্তদ্বয় করুনা পরাশ হয়ে প্রত্যেকে এক একটি বালক ক্রোড়ে করে নৌকায় তুলে নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে রাজা এসে দেখলেন–পুত্রদ্বয় তথায় নেই; তখন তিনি আতঙ্কিত ও শোকগ্রস্ত হয়ে ‘জয়সেন জয়সেন’ বলে ডাকতে লাগলেন, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। নদী-তীরে এদিক ওদিক দ্রুত গিয়ে দেখতে লাগলেন; কিন্তু কারো দেখা পেলেন না। এরূপে সারারাত্রি কেঁদে কেঁদে অতিক্রম করার পর যখন প্রভাত হল, তখন কুমারদ্বয়ের শয়ন স্থান শূন্য দেখে সাশ্রু নয়নে কম্পিত কলেবরে শোকাভিভূত কণ্ঠে কুমারদ্বয়কে সম্বোধন করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৬৫-৬৬। আমার প্রাণ প্রিয় পুত্র জয়সেন-জয়দত্ত, তোমরা এখন কোথায়? আমার নিকট এস। আমাকে প্রানান্তকর দুঃখ দিওনা। হায়! হায়! প্রিয় পুত্র, এখন তোমাদের মাতা অনাথিনী! সে এখন নদীর অপর তীরে একাকীণী। তোমাদের
দেখে সে যে কত মর্মাহত হবে, উন্মাদিনী হবে, তা আর কি বলব। বাবা, যেখানে গিয়েছ, সত্বর ফিরে এস” এবলে সুমিত্র উদ্রান্তের ন্যায় ইতস্ততঃ ঘুরা ফেরা করে ও পুত্রদের কোন ও সন্ধান না পেয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন।
৬৭। ৬৮। এখন এই বনগুল্ম নানাবিধ ফল-ফুলে শোভমান দেখছি। কিন্তু আমার পুত্রদের দেখছিনা। এখানে উদুম্বাদি নানাবিধ বৃক্ষ রাজি আমার দৃষ্টি গোচর হচ্ছে। কিন্তু আমার কুমারদ্বয়কে দেখছিনা।” এরূপে মহাসড় পুত্র শোকে অভিভূত হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি শোক বেগ সহ্য করতে না পেরে তথায় হঠাৎ মূচ্ছিত হয়ে ভূতলে পড়ে গেলেন। সে বিষয় প্রকাশ করার মানসে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৬৯। ৭০। সুম্ভমিত্র রাজা পুনঃ এতীরে এসে পুত্রদ্বয়কে না দেখে রোদন করতে করতে সংজ্ঞাহীন হয়ে ভূতলে পড়ে গেলেন। শয্যা বিহীন ভূমিতে চন্দ্র পতনের ন্যায়ই হল। পুনঃ তিনি সংজ্ঞা লাভ করে চিন্তা করলেন–“এযে আমাদের বিচ্ছেদ হল, ইহাই জগতের নিয়ম।” তা জ্ঞানের দ্বারা চিন্তা করে ধৈর্য ধারণ করে পরতীরে পত্নীর নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য নদীতে অবতরণ করলেন। এমন সময় নৌকা চালিয়ে এক নাবিক পঞ্চশত ব্যবসায়ী সহ রাণী কেশিণীর উপবিষ্ট স্থানের সমীপবর্তী হল। সেখানে-বৃক্ষমূলে একাকিনী উপবিষ্টা সুলক্ষণা রূপলাবণ্যবতী রাণীকে দেখে নাবিক তাঁকে বল প্রয়োগে নিজের নৌকায় তুলে নিল। এতে রাণী দুঃখীতা ও মর্মাহত হয়ে পুত্রদ্বয় ও স্বামীকে স্মরণ করে এবলে বিলাপ করতে লাগলেন
৭১। হায়! হায়! আমার স্বামী আর প্রিয় পুত্রগণ এখন কোথায়? আমাদের মধ্যে এমন বিচ্ছেদ ঘটল কেন? জন্মান্তরে আমরাও কি কাদের পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিলাম? সে কর্মের বিপাকেই কি আজ আমি এমন বিচ্ছেদ দুঃখ ভোগ করছি?”
এরূপ বিলাপ পরায়ণা রাজ মহিষীকে নাবিক যথারুচি স্থানে নিয়ে গেল। বোধিসত্ব নদী হতে উঠে বৃক্ষমূলে রাণীকে
দেখে চারদিকে অন্বেষণ করলেন। কোথাও তার খোঁজ না পেয়ে নিন্মোক্ত সাতটি বিলাপ গাথা ভাষণ করলেন
৭২-৭৮। আমি নদীতীরে তন্ন তন্ন করে অন্বেষণ করেও আমার স্ত্রী-পুত্র তিনজনকে কোথাও দেখলাম না। হায়! হায়! প্রাণপ্রতিম বাবাগণ, আমার একাকী বেচে থাকার আর প্রয়োজন কি? আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ । আমি একাকী বেঁচে থেকে কিই বা করব? আমি এখন গৃহ শূন্য। তোমাদের বিচ্ছেদ দুঃখ আমার। অসহ্য হচ্ছে। এরূপ রোদন করে ও কোন দিন বিচ্ছেদ দুঃখের অন্ত হবে কি? নারদ পর্বতবাসী হে দেবগণ, আমি আপনাদের স্মরণ করছি। আমায় রক্ষা করুন। সহসা যেন আমার হারানিধি স্ত্রী পুত্রদের প্রাপ্ত হই। কোন দেবমনুষ্য ও মহা ঋদ্ধিবান যক্ষ আমাকে এ দুঃখ হতে মুক্ত করুন। আপনারা আমার আশ্রয় হউন। মনুষ্য ও দেবগণ, শীঘ্রই আমার প্রাণপ্রিয় স্বজনদের আমায় এনে দিন। তাদিগকে আমার শরণাপন্ন করে দিন। এরাত্রির অবসানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আমার বাঞ্ছিত জনের যেন সন্ধান পাই।”
রাজা এরূপ বিলাপ করে সেখানেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথা ভাষণ করলেন
৭৯। প্রবল বাত্যাঘাতে যেমন মূল শূন্য বৃক্ষ নিপতিত হয়, সেরূপ রাজাও বিলাপ পরায়ণ হয়ে তথায় ভূতলে নিপতিত হলেন।
নৃপতি পুনরায় সংজ্ঞালাভ করে ভূমি শ্যা হতে উঠে রাণীর অন্বেষণে উন্মাদের ন্যায় চারদিকে দৌড়তে লাগলেন। তাকে কোথাও না পেয়ে পুনঃ ঐ বৃক্ষমূলে এসে স্ত্রী-পুত্রকে উপলক্ষ করে বিলাপ করতে লাগলেন
৮০-৮৪। তাদের দেখছিনা। তারা কোথায় গেল? বোধ হয় তাদের মৃত্যু হয়েছে। সকুণ ত কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। তবে কেন জনত্রয়কে দেখছিনা? এ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে নয় কি? আমার পুত্রদ্বয়কে দেখছিনা। তারা নিশ্চয়ই মারা গিয়েছে। কেশিণীকে দেখছিনা। সে নিশ্চয়ই মারা গিয়েছে। তাকে যথাস্থানে দেখছিনা। সে মারা গিয়াছে নয় কি? ইহা আমার দ্বিতীয় শল্য। পুত্রদারকে না দেখে আমার হৃদয় কাপছে। এখানে রাত্রির অবসানে সূর্যোদয় হলে স্ত্রী-পুত্রকে না। দেখলে তখন আমার জীবন ত্যাগ করবো। অথবা নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু হবে।” মহাসত্ত্ব এরূপ বিলাপ করে একাকীই এক দিকে চলে গেলেন। এ চারজন ক্ষত্রিয়ের কেন এভাবে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটল? এর একটা করুন কারণ আছে। তা এই
বহু অতীতে একজন্মে এচারজন কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক বৃক্ষমূলে পথশ্রান্তি বিনোদন-মানসে তাঁরা বসলেন। সে বৃক্ষের অগ্রভাগে এক শুকপাখীর বাসা। তথায় একটি শুক্ শাবক চেচাচ্ছিল। তখন বালকদ্বয় ক্রীড়া করবার ইচ্ছায় ঐ শুনা এনে দেবার জন্য মাতাকে বলতে লাগলো এবং ক্রন্দন করতে লাগলো। মা ছেলের কান্নায় অতিষ্ট হয়ে, শুকশাবক এনে দেবার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করলেন। তখন স্ত্রীর অনুরোধে ছেলের পিতা বৃক্ষে আরোহণ করে শুক্ শাবক এনে পুত্রদ্বয়ের হাতে দিলেন। তারা সানন্দে শু শাবক নিয়ে খেলা করতে লাগলো। এর ফলে ছানাটির তিনটি পালক উৎপাটিত হল। পরে ছেলের পিতা শাবকটিকে পুনঃ এদের বাসায় দিয়ে আসলেন। শুছানার তিনটি পালক উৎপাটন জনিত কৰ্ম্ম বিপাকে এ চারজন ক্ষত্রিয় পাঁচশত জন্ম যাবৎ পরস্পর পরস্পরের মধ্যে এরূপ বিচ্ছেদ ঘটে দুঃখভোগ করেছিলেন। এ জন্মেও অনুরূপ কর্মফল ভোগ করছেন। অতঃপর সুম্ভ মিত্র রাজা একাকীই পথ চলতে চলতে স্ত্রী-পুত্রের কথা স্মরণ করে অশ্রু বর্ষণ করতে লাগলেন এবং স্বগত বললেন–
৮৭-৮৮। অপ্রিয়ে সংযোগ এবং প্রিয়ের বিয়োগ কত যে মর্মান্তিক দুঃখদায়ক তা সম্যক উপলব্ধি করলাম। প্রিয় হতেই যথ সব ভয় ও শোক উৎপন্ন হয়। প্রিয় বিমুক্ত ব্যক্তিদের শোক-দুঃখ উৎপন্ন হয় না। তাদের আর ভয় কোথায়।
অতঃপর মহাসত্ত্ব নিজের জ্ঞান বলেই সমস্ত শোক বিনোদন করে অনুক্রমে তক্ষশিলায় উপস্থিত হলেন। তথায় এক উদ্যানে প্রবেশ করে কোনও বৃক্ষমূলে মঙ্গল শিলাপট্ট দেখে তথায় আপাদমস্তক বস্ত্ৰ ঢাকিয়ে শ্রান্তি বিনোদন মানসে শুয়ে পড়লেন। এর সপ্তাহকাল পূর্বে তথাকার রাজা পরলোক গমন করেছিলেন। অমাত্যবৃন্দ রাজার শবদেহের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পাদন করে সপ্তম দিবসে সকলেই রাজাঙ্গনে একত্রিত হয়ে পরামর্শ করলেন–“আমাদের রাজার কোন পুত্র কন্যা নেই। সুতরাং এ রাজ্য এখন অরাজক অবস্থায় উপগত। বর্তমান। আমাদের রাজা কে হবেন? এখন আমাদের কি কর্তব্য? তদুত্তরে পুরোহিত ব্রাহ্মণ বললেন–“ভবঙ্গণ, আপনারা চিন্তা করবেন না নিশ্চয়ই আমরা এ বিষয়ের সমাধান করতে পারবো। আমরা পুষ্পথ ছেড়ে দেব। পুষ্প রথ নির্বাচিত রাজা সমগ্র জম্বুদ্বীপে রাজত্ব করতে সমর্থ হবে।” এ প্রস্তাব সকলেই সাধু বাদের সহিত অনুমোদন করলেন। তক্ষশিলা নগর অপূর্ব সাজে সজ্জিত করা হল। মঙ্গল রথে কুমুদ বর্ণ চারটি অশ্ব যোজনা করা হল। ধ্বজা-পতাকা উড্ডীন করে এবং পুষ্পমাল্য ইত্যাদি দ্বারা সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ রূপে রথ সজ্জিত করে তথায় শ্বেতছত্র, রাজউষ্ণীষ, খড়গ, অসি, সুবর্ণ পাদুকা ইত্যাদি পঞ্চ রাজভাণ্ড এবং পঞ্চ অভিষেক দ্রব্য রথে তুলে দিলেন। তৎপর সুভাসিত জলে পরিপূর্ণ সুবর্ণ-গাড় হতে পুষ্পরথের শীর্ষদেশে জল ছিটিয়ে বললেন–“ভবৎ পুষ্পরথ, এরাজ্যে রাজত্ব করবার যার পুণ্যবল আছে, তুমি তাঁর নিকটই উপনীত হও। এবলে রথ ছেড়ে দিলেন। সত্যযুগের ধর্মতঃ রীতি অনুযায়ী তখন পুষ্পরথ চলতে আরম্ভ করল। রথ রাজপ্রাসাদ প্রদক্ষিণ করে নগরের পূর্বদ্বার দিয়েই বের হল। অমাত্যবৃন্দ সহ বহু লোক সর্ববিধ বাদ্য সহকারে রথের পশ্চাদৃগামী হলেন। তখন রথ রাজ্যোদ্যানে প্রবেশ করে সেই শাল বৃক্ষ মূলে উপস্থিত হয়ে মঙ্গল শিলাপট্ট প্রদক্ষিণ করে তথায় শায়িত বোধিসত্ত্বকে গ্রহণেচ্ছায় দাঁড়িয়ে রইল। তখন পুরোহিত ব্রাহ্মণ তথায় একাকী শায়িত মহাপুরুষকে দেখে অমাত্যগণকে সম্বোধন করে বললেন–“ ভবগণ, যে ব্যক্তিকে এ শিলাপট্টে শায়িত দেখছি, তিনি শ্বেত ছত্রের যোগ্য কিনা তাঁর সে পুণ্য আছে কিনা, পরীক্ষা করতে হবে। তিনি যদি রাজা হওয়ার মত পুণ্যবান হন, তবে এ শয্যা হতে হঠাৎ উঠবেন না। যদি অপুণ্যবান হয় তবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে কম্পিত কলেবরে পলায়নের সুযোগ খোঁজবে। এখন তাঁকে মীমাংসা করবার জন্য একসাথে সমস্ত বাদ্য-যন্ত্র ভীমনাদে ধ্বনিত করা হউক।” তখন আদেশ মাত্রই সমস্ত বাদ্য-যন্ত্র এক সাথেই ভীমনাদে বেজে উঠল। এ মহাশব্দে মহাসক্তের দ্রিা ভঙ্গ হল। নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে তিনি দেখলেন–বহু সেনা সামন্ত! তা দেখেও পার্শ্ব পরিবর্তন করে শায়িতাবস্থাতেই রইলেন। তখন পুরোহিত ব্রাহ্মণ তাঁর পাদতল হতে বস্ত্র উন্মোচন করে পদতলের লক্ষণ দেখে আশ্চার্য হয়ে বললেন–“ভবঙ্গণ, একদ্বীপের কথা কি বলব, চারমহাদ্বীপের রাজত্ব করতেই ইনি সমর্থবান।” এ কথা শুনে তখন অমাত্যবৃন্দ শিরে অঞ্জলি বদ্ধ হয়ে বললেন–“মহারাজ, আপনি এরাজ্য গ্রহণ করুন।” এবলে অনুরোধ করে নিতোক্ত গাথাটি বললেন–
৮৯। “দেব, এ রাজ্য সর্বদা অন্ন পাণীয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ, এ দেশ বড়ই মনোরম। আমরা সবাই উপস্থিত হয়ে এ রাজ্য আপনাকে প্রদান করছি।
বোধিসত্ত্ব ইহা শুনে শয়ন হতে উঠে উপবিষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–“ভবৎগণ, এখন আপনাদের রাজা কোথায়?” প্রত্যুত্তরে তারা বললেন–“দেব, আমাদের রাজা পরলোক গমণ করেছেন।” মহাসত্ত্ব প্রশ্ন করলেন–“আপনাদের রাজার কি কোনও পুত্র-কন্যা নেই”? “দেব, আমাদের রাজার কোন পুত্র কন্যা নেই।” “আচ্ছা, ভদ্রগণ, তাহলে তোমাদের প্রদত্ত রাজ্যে রাজত্ব করব।” তখনই অমাত্য প্রমুখ জনগণ উদ্যান সুসজ্জিত করে সেখানেই মহাসত্ত্বকে অভিষেক প্রদান করলেন এবং সে দিবসেই সঙ্কুমিত্র মঙ্গলরথে আরোহণ করে তক্ষশিলা নগরে উপনীত হলেন। তিনি মহাসমারোহে রাজ প্রাসাদে আরোহণ করে মহাশয্যার উপবেশন করলেন। সেদিন হতেই তিনি তথায়। রাজত্ব করতে লাগলেন। জনগণ যাতে দান শীলে নিযুক্ত হয় সেরূপ উপদেশ প্রদানে নিরত হলেন এবং ধর্মতঃ অনুশাসনের মাধ্যমে সুশৃঙ্খলায় রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। এদিকে কৈবর্তদ্বয় জয়সেন ও জয়দত্তকে নিজের পুত্ররূপে পোষণ করতেছিল। কুমারদ্বয় যখন বয়স্ক হল, তখন কৈবর্তদ্বয়ের সুমতি-সঞ্চার হল। একদিন বিবিধ উপহার সামগ্রী ও কুমারদের নিয়ে রাজার নিকট উপস্থিত হল। তারা রাজাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে উপহার সমূহ তাকে প্রদান করল এবং তাঁর পরিচর্যা করার জন্য বালকদ্বয়কে ও সমর্পন করল। তখন মহারাজ সুম্ভমিত্র বিচারাসনে উপবিষ্ট আছেন। তিনি বালকদ্বয়কে দেখে অমাত্যগণকে সম্বোধন করে বললেন–
৯০-৯২। “অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত জমুনদের বিশুদ্ধ স্বর্ণের ন্যায় সমুজ্জল ও সুপ্রসন্ন মুখমণ্ডল, এ উভয় বালকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও লক্ষণাদি একই প্রকার। একটি জয়সেনের ন্যায় এবং অপরটি জয়দত্তের ন্যায় ॥ মনে হয় যেন সিংহ-শাবক গর্ত হতে বের হয়েছে। উভয়ের প্রতিকৃতি একইরূপ। এ বালকদ্বয়কে বিশুদ্ধ স্বর্ণের ন্যায় দেখা যাচ্ছে।
রাজা কৈবর্তদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করলেন–“ওহে, কুমারদ্বয় কার পুত্র?” কৈবর্তদ্বয় বলল–“মহারাজ, আমাদেরই পুত্র।” রাজা বললেন–“তোমাদের আকৃতির সাথে এদের আকৃতির কোন ও সামঞ্জস্য দেখছিনা। কৈবর্তগণ বলল–“দেব, তারা তাদের মাতার ন্যায়ই হয়েছে।” মহাসত্ত্ব চিন্তা করলেন“এবালকদ্বয় আমারই পুত্রদ্বয়ের ন্যায়। এরা আমার নিকট সর্বদা বাস করলে, তাদের নিত্য দর্শন পাব। এদের চোখ, মুখ ও রূপ আমার পুত্রদের মতই। এ চিন্তা করে রাজা অন্যমনস্ক হলেন। কুমারদের প্রতি রাজার অন্তরে প্রগাঢ় পুত্রেেহর সঞ্চার হল। তখন উভয় কৈবর্ত কুমারদ্বয়কে রাজার হস্তে সমর্পণ করে চলে গেল। সেদিন হতে কুমারদ্বয় রাজপুত্রের মত রাজার হেমমতায় প্রতিপালিত হতে লাগল। এদিকে সে নাবিক নিজের গৃহে কেশিনী দেবীকে রেখে নিজের ভার্যারূপে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক হল। কিন্তু দেবীর শীল ও অধিষ্ঠান বলে নাবিক দেবীর দেহ প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মত অনুভব করল। তাই সে তার সমীপবর্তী হতে ও সক্ষম হলনা। তবুও সে নিজের গৃহে তাঁকে অনুরাগ ও মৈত্রীপূর্ণ অন্তরে পোষণ করছিল। এক সময় কোন সৎ দেবতার অনুভাব বলে নাবিক রাজাকে মূল্যবান দ্রব্য উপহার দেবার জন্য চিত্ত উৎপাদক করল। অতএব সে বনিকদের সঙ্গে করে উপহার সামগ্রী, স্বীয় পত্নী ও রাণী কেশিনী সহ তক্ষশিলা নগরে আগমন করল। সে রাজাকে উপহার প্রদান করে তিন মাস যাবৎ তথায় অবস্থান করার পর। রাজার নিকট এবার বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁকে বললেন–
৯৩। “দেব, এখানে এসেছি দীর্ঘকাল গত হয়ে গেল। এখন বাণিজ্যে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। তৎপূর্বে দেশে যেতে হবে। তাই আজ মহারাজের নিকট বিদায় নিতে ইচ্ছা করেছি।” ইহা শুনে রাজা বললেন–
৯৪। “নাবিক, তুমি অদ্য রাত্রি অপেক্ষা কর। নৃত্য-গীত শ্রবন করে প্রাতেই দেশে চলে যাবে।” নাবিক বললেন–
৯৫। “রাজ, রাত্রে চোরের জন্য ভয় করি। সুতরাং আপনি যদি সারা রাত্রি রক্ষার উপায় করেন।” রাজা বললেন–
৯৬। “বনিকগণ, গান-বাদ্যে তোমাদের পরিতৃপ্ত করবার ইচ্ছা করেছি, মাত্র এক রাত্রি এখানে বাস করে প্রাতেই চলে যাবে।” বনিক বলল
“মহারাজ, পাহারাদার যদি আমাদের নৌকা রক্ষা করে তবেই সম্ভব।” রাজা বললেন–“বনিকগণ, তোমরা তজ্জন্য কোনই চিন্তা করবেনা। আমিই তোমাদের নৌকা রক্ষার ব্যবস্থা করব।” এবলে কুমারদ্বয়কে আহ্বান করে রাজা আদেশ দিলেন–“হে কুমারদ্বয়, তোমরা নিজের লোকদের সঙ্গে নিয়ে নদীতে বনিকদের নৌকা খানা রক্ষা করবে।” কুমারদ্বয় রাজার এ আদেশ শিরোধার্য করে তখনি নিজের পঞ্চশত সহচর সহ নদীর নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হল। কুমারদ্বয় নৌকায় আরোহণ করে নৌকার মাথায় বসে রইল। সে রাত্রে কুমারদের মাতা কেশিণী দেবীর এক স্বপ্ন হল। স্বপ্নে দেখলেন–“প্রভাতে তিন ক্ষত্রিয়ের সংযোগ হয়েছে,। সে স্বপ্নের বিবরণ এই–“কোন। একজন পুরুষ তিনটি পদ্মফুল আহরণ করে দেবীর বক্ষে স্থাপন করলেন।” দেবী দ্রিা হতে জাগ্রত হয়ে স্বামী ও পুত্রদ্বয়ের কথা স্মরণ করে অশ্রু বর্ষণ করতে লাগলেন এবং বিলাপ করে করে শয্যায় বসে রইলেন। তখন গভীর রজনী, নৌকায় অপর লোকেরা নিদ্রিত। জয়দত্ত ও সেখানে বসেই নিদ্রিত হল। তখন জয়সেন কনিষ্ঠ জয়দত্তকে নিদ্রা হতে জাগাতে লাগল। জয়দত্ত নানা উপায়ে ও জেগে থাকতে না পেরে জয়সেনকে বল্ল“দাদা, বড় নিদ্রা পাচ্ছে। আপনার পাচ্ছেনা?” জয়সেন বলল“না ভাই, নিদ্রা আসবে কেন?” আমরা যে কর্তব্য পালন করতে এসেছি, নিদ্রা গেলে সে কর্তব্যের ত্রুটি হবে এবং রাজদণ্ডে ও দণ্ডিত হব। বিশেষতঃ আমাদের অতীত কথা ও মনে পড়ছে তাই মনেও শান্তি নেই।” তা শুনে জয়দত্ত উৎসুক হয়ে বলল–“দাদা, সে অতীত কথা কিরূপ? যা মনে পড়ায় অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে? কেনই বা আপনি এরূপ বলছেন?” জয়সেন বলল–“ভাই বড়ই মর্মান্তিক করুন কাহিনী, মাতাপিতা হতে আমাদের চির বিচ্ছেদ। তারা যে কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না তাও জানিনা। যে বিচ্ছেদের ফলে আজ কৈবর্ত হয়েছে আমাদের পিতা, আমরা হয়েছি কৈবর্তের সন্তান।” তখন জয়দত্ত বিস্ময় কণ্ঠে বলল–“কি বলছেন দাদা, এ কৈবর্ত কি আমাদের পিতা নয়!” জয়সেন বলল–“না ভাই, তাদের ঔরষ জাত সন্তান আমরা নই। তারা ছােটকাল হতে আমাদের পালন করেছে হে মমতার মাধ্যমে। তাই তারা আমাদের পালক পিতা হতে পারে, জন্মদাতা পিতা নয়।” ইহা শুনে জয়দত্ত সবিস্ময়ে বলল–“দাদা, কি অশ্রুত পূর্ব আশ্চর্য কথা শুনালেন, আমাদের পিতা কি কৈবর্ত নয়? তবে আমাদের বিচ্ছেদের কথা বলছেন কেন? দাদা, যদি আমাদের এরূপ বিচ্ছেদ কাহিনী থাকে, তা বলুন। তখন জয়সেন সে পুরাতন কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–“তাহলে ভাই শোন আমরা তখন ছােট ছিলাম। মাতা-পিতা আমাদের সঙ্গে করে চম্পানগর হতে বের হয়ে অনুক্রমে এক নদী তীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। তথায় তারা অল্পক্ষণ বিশ্রাম করে তোমাকে মাতা স্তন্য পান করালেন এবং তথায় শিরবেষ্টন বস্ত্র বিস্তৃত করে তোমাকে ঘুম পাড়াল। তার পর আমার হাতে কিছু খাদ্য দিয়ে মাতা-পিতা উভয়ে আমাকে আলিঙ্গন করে আমার মস্তক চুম্বন করলেন। তাঁদের গমন কালে আমি কেঁদে উঠলাম। তখন মাতা-পিতা আমাকে আশ্বাস প্রদান করে তাড়াতাড়ি চুপে চুপে নদীতে অবতরণ করে নদীর অপরতীরের দিকে যাত্রা করলেন। সে সময় দু’জন কৈবর্ত এসে আমাদের ক্রোড়ে করে তাদের বাড়ীতে নিয়ে গেল। তথায় তারা আমাদের স্বীয় পুত্রের ন্যায় আদর-যত্নে পোষণ করতে লাগল। জয়দত্ত একথা শুনে। সক্রোধে বলে উঠল–“দাদা, আমাদের পিতা মাতা যদি হেমমতাহীন হয়ে আমাদের ত্যাগ করে থাকেন, তাহলে পিতামাতা আছে বলে ও মনে করবনা।” এ বলে জয়দত্ত নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৯৭। “দাদা জগতে মানুষের পরম প্রিয় হল স্বীয় পুত্র। কিন্তু আমাদের পিতা-মাতার নিকট পুত্র-হে নেই।”
ইহা শুনে জয়সেন বলল–“ভাই, তুমি এরূপ বলবে না। যদি আমাদের পিতা-মাতা নদী পার হয়ে কোথাও বাস করে থাকে উত্তম। তাঁদের তথায় আমরা অন্বেষণ করে দেখব।” ইহা শুনে জয়দত্ত বলল–“দাদা, আমাদের জন্মস্থানের নাম কি? জয়সেন বলল আমাদের জন্মস্থানের নাম চম্পা নগর।” আমাদের পিতার নাম কি?” “সুম্ভমিত্র রাজা।” “আমাদের মাতার নাম কি”? “দেবী কেশিনী।” রানী কেশিনী এতক্ষণ ধরে বালকদ্বয়ের কথপোকথন উৎসুক অন্তরে শুনেছিলেন। এবার তিনি ধৈর্য ধারণ করতে পারলেন না। ফুকুরিয়ে কেঁদে উঠে দ্রুত গিয়ে “এস আমার বক্ষের ধন, বলে উভয় হস্তে পুত্রদ্বয়কে জড়িয়ে ধরলেন। তখন কুমারদ্বয় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নৌকা হতে পালিয়ে গেল। দেবী পুত্রদের আহ্বান করে বললেন–
৯৮-১০০। হে প্রাণ প্রতিম পুত্রদ্বয়, তোমরা কি মনে করে পালিয়ে গেলে? তোমরা আমার নিকট এস। আমি দীর্ঘকাল ধরে তোমাদের থেকে বিচ্ছেদ হয়েছি। এখন পলায়ণ করছ কেন? বাবা জয়সেন, জয়দত্ত, আমি তোমাদের মাতা কেশিনী। হে পুত্রদ্বয়, তোমরা ইহা জ্ঞাত হও। তোমাদের না দেখে আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। আমার বক্ষের ধন তোমরা পালিয়ে যেওনা, পূর্বে আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তোমাদের ক্রীড়া-ক্ষেত্র ছিল। এখন কেন আমার নিকট হতে দুরে সরে যাচ্ছ?”
কুমারদ্বয় কেশিনীর কথা শুনে বুঝতে পারল, ইনিই তাদের মাতা। তাই তারা দ্রুত বেগে এসে মাতার পাদমুলে পড়ে রোদন করতে লাগল। তখন নৌকাস্থ বনিকগণ এ রোদন শব্দ শুনে সবাই এসে তাদের সব বিষয় জ্ঞাত হল। তখন বনিকগণ দৌড়ে গিয়ে রাজ বাড়ীতে নাবিককে এসব বিষয় বলল।–তা শুনে ক্রোধাভিভূত হয়ে নাবিক রাজাকে বলল–“মহারাজ, আপনার প্রতিপালিত কুমারগণ নৌকায় আমার ভার্যার উপর অত্যাচার করবার জন্য উদ্যত হয়েছে।” ইহা শুনে রাজা ক্রোধান্ধ হয়ে কুমারদের শিরচ্ছেদ করবার জন্য ঘাতককে আদেশ দিলেন। ঘাতকও রাজাদেশ পাওয়া মাত্র নৌকায় গিয়ে কুমারদ্বয়কে অশেষ যন্ত্রনা দিয়ে রাজার নিকট নিয়ে এল। তখন রাজা পুনঃ ঘাতককে আদেশ দিলেন–“তাদের শিরচ্ছেদ কর।” তৎপর ঘাতক কুমারদ্বয়কে শ্মশানে নিয়ে গেল। তখন। পুরোহিত ব্রাহ্মণ রাজার নিকট এসে নিন্মোক্ত গাথা এয় যোগে বললেন–
১০১-১০৩। “রাজন, যে ব্যক্তি চিন্তা না করে কোন কাজ করে, সে ভুলের জন্য সে দুঃখগ্রস্ত হয়। রাজন, চিন্তা ও বিচার
করে কাজ করলে চিরকাল অনুতাপে দগ্ধ হয়। সে অপকর্ম তাকে দুর্গতি প্রাপ্ত করায়। বিচার ও চিন্তা না করে কাজ করা। ভাল নয়। বিচার করে কাজ করলে সুফল ও মঙ্গল দায়ক হয়। রাজন, সম্যরূপে বিচার চিন্তা করে কাজ করলে যশঃকীর্তি বর্ধিত হয়।”
রাজা একথা শুনে পুরোহিতকে বললেন–“তাহলে হে পুরোহিত মহাশয়, শীঘ্রই কুমারদ্বয়কে এখানে নিয়ে আসুন”। তখন পুরোহিত ব্রাহ্মণ রাজার আদেশ পাওয়া মাত্র ত্বরিত গমনে ঘাতকের নিকট হতে কুমারদ্বয়কে নিয়ে এসে তাদের। কর্ণে কর্ণ-দূল পরালেন এবং আপাদমস্তক বেদনা নিবারক তৈল। মর্দন করে মহাপ্রাসাদে রাজার সম্মুখে নিয়ে গেলেন। তখন। রাজা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে তোমরা এরূপ কর্ম কেন করেছ? তখন জয়সেন নৌকায় সংঘটিত সমস্ত বিষয় রাজার নিকট খুলে বলল। রাজা সমস্ত কথা শুনে সংবিগ্ন হৃদয়ে জয়সেনকে জিজ্ঞাসা করলেন–“তোমাদের জন্ম স্থানের নাম। কি?” “মহারাজ, আমাদের জন্মস্থানের নাম চম্পা নগর।” “তোমাদের মাতার নাম কি?” আমাদের মাতার নাম দেবী কেশিণী।” “তোমাদের পিতার নাম কি?” জয়সেন তখন পিতার নাম বলতে ভয় করল, সাহস হলনা নীরব হয়ে রইল। তখন রাজা পুনঃ তাকে নির্ভয় দিয়ে বললেন–“ভয় করোনা, যথাসত্য বল।” তখন জয়সেন বলল–“আমাদের পিতার নাম “সুমিত্র।” ইহা শুনে রাজা সজল নেত্রে তাড়াতাড়ি সিংহাসন হতে নেমে উভয় হস্তে কুমারদ্বয়কে বক্ষে ধারণ করে সেখানেই মূৰ্ছিত হয়ে ভূতলে পড়ে গেলেন। এসব অভূতপূর্ব ব্যাপার দর্শনে তথায় সমবেত অমাত্যগণ প্রমুখ মহাজনগণও সংজ্ঞা শূন্যের ন্যায় মাটিতে বসে পড়লেন। এ বিষয় প্রকাশ–মানসে তথাগত বুদ্ধ নিতাক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন
১০৪-১০৮। বনে কর্তিত শাল বৃক্ষ যেমন পতিত হয়, সেরূপ সুমিত্রের প্রাসাদেও সমাগত জনগণ ভূতলে পড়ে গেল। অমাত্য প্রমুখ নগরবাসী, বৈশ্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণ জাতি, নগর-গ্রাম–জনপদবাসী এবং উগ্রযোদ্ধা প্রভৃতিও সুম্ভমিত্রের বাসভবনে বাহু প্রসারিত করে বক্ষে করাঘাত করতে লাগল। সেরূপ হস্তারোহী, বিরাট সেনাদল, রথারোহী ও পদাতিকবৃন্দও সুম্ভমিত্রের প্রাসাদে বৃদ্ধ, যুবা, পৌঢ়, প্রভৃতি জনগণ বাহু প্রসারিত করে বক্ষে করাঘাত করতে লাগলেন। সুমিত্রের প্রাসাদের মহাজনগণ সমাগত হয়ে বাহু প্রসারণ করে মর্ম বেদনায় রোদন করেছিলেন।”
অতঃপর রাজা সংজ্ঞা লাভ করার পরও পুত্রদ্বয়কে নিজের হস্তচ্যুত করলেন না। ইহাতে কুমারদ্বয় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কম্পিত কলেবরে তথায় দাড়িয়ে রইল। তখন রাজা বীরস্বরে বললেন–“আমিই সুমিত্র রাজা।” এবলে স্বীয় পুত্রদ্বয়কে পরিচয় প্রদান-মানসে নিজে গাথাটি বললেন–।
১০৯। “বাবা প্রিয় পুত্র, তোমরা এস। তুমি আমার পুত্র জয়সেন, আর তুমি আমার কনিষ্ঠ পুত্র জয়দত্ত। আমিই তোমাদের পিতা সুম্ভমিত্র। তোমরা সর্বদাই আমার নিকট থাকবে।”
ইহা শুনে কুমারদ্বয় রাজার পাদমূলে পড়ে ক্রন্দন পরায়ণ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তৎপর রাজা জয়সেনকে জিজ্ঞাসা করলেন–“এখন তোমার মাতা কোথায় আছে? জয়সেন বলল–“দেব, আমার মাতা এখন নৌকায় আছেন।” ইহা শুনে রাজা মহাজনগণ পরিবৃত হয়ে নগর হতে বের হলেন। সকলেই নদী তীরে উপস্থিত হয়ে নৌকায় আরোহণ করলেন। রাজা নৌকার শিরদেশে স্থিত হয়ে নাবিককে সম্বোধন করে বললেন–
১১০। “হে নাবিক, আমার নিকট হতে বহু ধনরত্ন ও ভোগ সম্পদ গ্রহণ করে দেবীকে আমায় প্রদান কর। এ কেশিনী দেবী সর্বদা আমারই প্রিয় ও পতিব্রতা ভার্যা।” ইহা শুনে নাবিক বলল
১১১। “মহারাজ, আপনি এ দেবীরই স্বামী, তিনিই। আপনার ভার্যা। আপনি তাকে এখন গ্রহণ করুন। আপনি মহা পুণ্য প্রভাবেই তাঁকে লাভ করলেন।”
দেবী এসব বাক্য শুনে শয়ন স্থান হতে বের হয়ে রাজার পাদমূলে পড়ে সেখানেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। তখন রাজা দেবীর মস্তক নিজের ক্রোড়ে রক্ষা করলেন। কুমারদ্বয়ও মাতার পাদমূলে নিপতিত হয়ে অতিশয় রোদন করতে লাগলেন। তখন সুমিত্র রাজা শোকাশ্রু নেত্রে বিলাপ করতে করতে দেবীকে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–
১১২। “হে কেশিনী, তুমি উঠ। তোমার স্বামী আমি এখানে এসেছি তোমার পাদমূলে তোমার পুত্রদ্বয়ও দণ্ডায়মান। তুমি উঠে বস।” ইহা শুনে দেবী আশ্বাস লাভ করলেন। সেখান হতে উঠে পুনঃ রাজার পাদমূলে পড়ে বন্দনা করে তথায় বসলেন। তখন দেবী প্রীতিফুল্ল মনে নিন্মোক্ত গাথায় রাজাকে বললেন–
১১৩। “দেব, অদ্য আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়ায় আমার বিপুল শোক নিবারিত হল। এখন আমি সুখেই স্থিত আছি।”
তৎক্ষণেই সুমিত্র রাজা নগর হতে দুইখানা সুবর্ণ স্যন্দন আনয়ন করালেন। একখানায় রাজা-রাণী এবং অপর খানায় রাজকুমারদ্বয় আরোহণ করে মহাজনগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে মহাউল্লাস ধ্বনির মাধ্যমে তক্ষশিলা নগরে উপস্থিত হলেন। তখন রাজা কেশিনীকে অগ্রমহিষী পদে অভিষিক্ত করলেন। জয়সেনকে উপরাজা এবং জয়দত্তকে সেনাপতি পদে বরণ করলেন। তৎপর হতে এ চারজন ক্ষত্রিয় সপরিষদে দানাদি পুণ্যকর্ম করণান্তর যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। সুম্ভমিত্রের কণিষ্ঠ ভ্রাতা অসুম্ভমিত্র ও চম্পানগরে অধর্মতঃ ভাবেই রাজত্ব করে যথায়ুষ্কালে মৃত্যুর পর মহানিরয়ে উৎপন্ন হলেন। তথায় অনন্ত দুঃখে নিপতিত হলেন। শাস্তা এ ধর্মদেশনা সমাপ্ত করে উপসংহারে বলেন হে “ভিক্ষুগণ, দেবদত্ত শুধু এখন নয়, পূর্বেও সে আমাকে হত্যার জন্য চেষ্ঠা করেছিল। জাতক সমাপণ মানসে নিন্মোক্ত নয়টি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন
১১৪-১২২। “তখন সেই পাপিষ্ঠ, অধার্মিক, অনন্ত দুঃখময় নিরয়গত সে অসুমিত্র রাজা এখন দেবদত্ত। পুরোহিত ব্রাহ্মণ এখন সারিপুত্র। বণিক নাবিক এখন মোম্বুল্লায়ণ। সুমিত্রের পিতা এখন রাজা শুদ্ধোদন। মাতা এখন মহামায়াদেবী। জয়সেন এখন রাহুল নামক আমার পুত্র। জয়দত্ত নামক কনিষ্ঠ পুত্র এখন আমার উপস্থায়ক আনন্দ। কেশিনী নারী দেবী সুম্ভমিত্র রাজার ভার্যা এখন রাহুলমাতা যশোধরা। নগরবাসী সমস্ত জনগণ সুষুমিত্রের পরিষদমণ্ডলী সবাই এখন আমারই পরিষদ। তক্ষশিলার ঈশ্বর সুমিত্র মহারাজ এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। সর্বদা ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারী তোমরা সবাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।
(সুম্ভমিত্র জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply