০৪. অরিন্দম জাতক
“আমার মনোরথ পূর্ণ হয়েছে” এ গাথা বুদ্ধ জেতবনে অবস্থান কালে নিজের দানপারমী সম্পর্কে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এরূপ কথা উত্থাপন করলেন। “অহো বন্ধুগণ! আমাদের শাস্তা স্বীয় দানপারমীর অনুভাববলে সর্বজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়ে দেবমনুষ্যগণকে আমার্গে প্রতিষ্ঠাপিত করেছেন। তক্কালে শাস্তা গন্ধকুঠি হতে তথায় এসে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে বসে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, বর্তমানে তোমরা এখানে কোন্ বিষয়ের আলোচনা করে বসে আছ? তখন ভিক্ষুগণ বিনীতভাবে তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় প্রকাশ করলেন। ইহা শুনে বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, শুধু এখন নয়, পূর্বে ও আমি দান দিয়ে তৃপ্ত হয়নি।” এবলে মৌণভাব অবলম্বণ করলেন। তখন ভিক্ষুগণ সেই পূর্ব কাহিনী প্রকাশ করার জন্য প্রার্থনা করাতে বুদ্ধ তা বলতে আরম্ভ করলেন
“হে ভিক্ষুগণ, অতীতে সূচী নগরে অরিন্দম নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর অন্তঃপুরে ষোড়শ সহস্র ক্ষত্রিয় কন্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘সুবর্ণ গর্ভা’ নামী পুণ্যবতী নারী ছিলেন অগ্রমহিষী তক্কালে অরিন্দম রাজা নগরের চারিদ্বারে চারখানা মধ্যস্থলে একখানা ও রাজা প্রাসাদের দ্বারদেশে একখানা, মোট ছ’খানা দান শালা প্রস্তুত করিয়ে প্রত্যহ এক হাজার ছ’শত টাকার নানাবিধ দানীয় বস্তু আগত অর্থীকে দান দিতেন। তিনি একদিন প্রত্যুষকালে শয্যা ত্যাগ করে নিজের দানের বিষয় চিন্তা করে অনুপম প্রীতি অনুভব করলেন। তিনি প্রীতিতে ভরপূর হয়ে অপ্রমেয় উদার চিত্তে চিন্তা করলেন–আমি অদ্য আধ্যাকি দান দিতে ইচ্ছা করি। অহহ! অদ্য প্রাতেই যাচক আমার নিকট এসে বাহ্যিক বস্তু যাচ্ঞা না করে আধ্যাকি বস্তুই যদি যাচ্ঞা করে, তবে আমি তাকে তা-ই দেব। যদি কেহ এসে আমার মস্তক চায়, তাকে তা ছেদন করে দেব। যদি কেহ আমার হৃদপিণ্ড চায়, তাও বক্ষ বিদীর্ণ করে সরক্ত হৃদপিণ্ড তাকে দেব। অথবা কেহ এসে আমার চক্ষু, রক্ত, মাংস, অধদেহ অথবা সর্বদেহ যাচা করে তাও তাকে সানন্দে প্রদান। করব। আর কেহ এসে যদি বলে–“হে অরিন্দম, তুমি আমার দাস হও।” তাও হব। যদি কেহ রাজ্য চায়, তাও দেব। এরূপে তার ঐকান্তিক চিন্তা প্রভাবে দেবরাজের দিব্যরাজাসন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তখন দেবরাজ ইহার কারণ দিব্যনেত্রে দেখে রাজা অরিন্দমের দান-চেতনার বিষয় সম্যক অবগত হয়ে প্রসন্নমনে চিন্তা করলেন–“নিশ্চয়ই আমি তাঁর দানপারমীর পূর্ণতা লাভের ব্যবস্থা করব।” এচিন্তা করে জীর্ণ-শীর্ণ ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে দণ্ড হস্তে ও কম্পমান দেহে বোধিসত্ত্বের সম্মুখে এসে স্থিত হলেন–এবং দক্ষিণ হস্ত উঠিয়ে “মহারাজের জয় হোক,” এ আশীর্বাদ বাণী বারত্ৰয় ঘোষণা করলেন। রাজা ব্রাহ্মণকে দেখে অমাত্যকে গাথা যোগে বললেন–
১। “অমাত্য প্রবর, আমার মনোরথ পূর্ণ হয়েছে। এ যাবৎ সমাগত যাচকগণকে আশানুরূপ দান দিয়েছি।”
অতঃপর রাজা ব্রাহ্মণকে বললেন–“ভবৎ, আপনি এখানে কি মনে করে এসেছেন?” ব্রাহ্মণ বললেন–“মহারাজ, আমি জীর্ণ, বৃদ্ধ, দুর্বল ও দরিদ্র। সুতরাং আপনার নিকট একসহস্র স্বর্ণ মুদ্রা যাঞ্চা করতে এসেছি।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব প্রীতিফুল্ল মনে বললেন–“সাধু ব্রাহ্মণ, আপনাকে সুবর্ণ মুদ্রা দেব।” এবলে তার হস্তে সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা প্রদান করলেন। তৎপর ব্রাহ্মণের সাথে নিন্মোক্ত গাথায় আলাপ করলেন–
২। “হে ব্রাহ্মণ আমার এ দানের প্রভাবে যা পেতে ইচ্ছা করি তা যেন পাই।”
ব্রাহ্মণ সুবর্ণ গ্রহণ করে প্রাসাদ হতে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে পুনঃ প্রত্যাবর্তন করলেন এবং রাজাকে বললেন–“মহারাজ, আমার গৃহখানি অত্যান্ত জীর্ণ-শীর্ণ, ছাউনি ও নষ্টপ্রায় সুতরাং এরূপ গৃহে সুবর্ণ রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। তদ্ধেতু। এ সুবর্ণ আপনার নিকট জমা রাখতে প্রার্থনা করি। যখন সুবর্ণের প্রয়োজন হবে, তখনি নিয়ে যাব।” রাজা বললেন–“সাধু ব্রাহ্মণ, আপনার সুবর্ণ আমি রক্ষা করব। যখন ইচ্ছা, তখনি নিয়ে যাবেন।” তখন দেবরাজ সেখান হতে বের হয়ে তরুণ ব্রাহ্মণ বেশে পুনঃ রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন–
৩। “মহারাজ, জল পরিপূর্ণা নদী যেমন কোন কালেই জল শূন্য হয় না, আপনিও সেরূপ। আমি আপনার রাজ্য যাচা করতে এসেছি। তা আমাকে দান করুন।”
ইহা শুনে রাজা সন্তুষ্ট মনে বললেন–“সাধু ব্রাহ্মণ, আমি আপনার মনোরথ পূর্ণ করব।” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৪। “হে ব্রাহ্মণ, আপনি যা যাঞ্চা করলেন, তা আপনাকে অকম্পিত হৃদয়ে প্রদান করব। যা আছে, তা গোপন করবনা। দানেই আমার মন রমিত হয়”
এ বলে রাজা আরো হৃষ্ট তুষ্ট হয়ে বললেন–“মহাব্রাহ্মণ অদ্য আমি আধ্যাকি দানই দিতে ইচ্ছুক। কিন্তু, আপনি বাহ্যিক বস্তুই প্রার্থনা করছেন। অদ্য আপনার মনোরথ পূর্ণ করব।” এ বলে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
৫। “আমার নিকট সমাগত ধনার্থীকে দান দিয়েও আমি তৃপ্তি লাভ করিনি।
৬। সর্বজ্ঞতাই আমার অতি প্রিয় বিষয়। তজ্জন্য আমি রাজ্য দান করব। তা গ্রহণ করে যথা সুখে পরিভোগ করুন।
৭। যদি কেহ আমার মস্তক, চক্ষু, হৃদয়, জীবন, মাংস অথবা রক্ত চায় তাও আমি তাকে দেব।
৮। যদি কেহ আমার নিকট অর্ধ বা সম্পূর্ণ শরীরও চায়, তাও দিতে প্রস্তুত আছি।”
মহাসত্ত্ব এরূপ ঘোষণা করে তখনি অমাত্য প্রভৃতি নগরের জনগণকে সমবেত করিয়ে বললেন–“হে সর্বজন মণ্ডলি, এ ব্রাহ্মণ আমার রাজ্যটি প্রার্থনা করছেন সুতরাং তাকে আমার রাজ্য দান করব।” একথা শুনামাত্রই সমগ্র নগরে ভীষণ কোলাহলের সৃষ্টি হল। তখন সেনাপতি প্রভৃতি নগরবাসীগণ একসঙ্গে রাজার সমীপে উপস্থিত হয়ে নিজে গাথায় বললেন–
৯। “দেব, এ ব্রাহ্মণকে রাজ্য দেবেননা। আমাদের বিনাশ করবেন না। তাঁকে ধন ও মনিরত্ন দিলেই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট।’,
ইহা শুনে রাজা সবাইকে বললেন–ভদ্রগণ, এরূপ বলবেন । যে যাই আমার নিকট চায়, তাকে তাই প্রদান করব।” তখন জনগণ বললেন–“মহারাজ, যদি আমাদের প্রতি আপনার স্নেহ-মমতা থাকে, তবে এ ব্রাহ্মণকে সেনাপতি পদ প্রদান করুন।” রাজা তাদের এসব কথা গ্রাহ্য না করে সুবর্ণ পালঙ্ক হতে উঠে শীঘ্রই গন্ধোদকে পরিপূর্ণ সুবর্ণ গাড় গ্রহণ করে ব্রাহ্মণকে স্বীয় সুবর্ণ পালঙ্কে উপবেশন করিয়ে বললেন–“মহাব্রাহ্মণ, আমার দেবী ও অশ্ব যুক্ত রথ ব্যতীত সমস্ত ধন। সম্পদ আপনারই হোক্।” এবাক্যের দ্বারা তাঁর রাজ্য ব্রাহ্মণের হস্তে দান করে বললেন–“হে ব্রাহ্মণ, আমার রাজ্য অপেক্ষা ও শতসহস্র গুণে অধিক প্রিয় সর্বজ্ঞতা জ্ঞান। তাই আমার এ রাজ্য দান অনাগতে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভেরই হেতু হোক্।” এবলে ব্রাহ্মণের হস্তে জল ঢেলে রাজ্য দান করলেন। সে বিষয় বিশদভাবে প্রকাশ কল্পে বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন
১০। “তৎপর অরিন্দম রাজা দক্ষিণােদক সিঞ্চন করে বুদ্ধত্ব লাভের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণকে রাজ্য দান করেছিলেন।
১১। রাজ্য দান কালে ভীষণ লোম হর্ষকর ভাবে এ পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল।
১২। নগরবাসী জনগণের লোমহর্ষণ হয়েছিল এবং তারা ভীত ও সংক্ষুব্ধ হয়েছিল।”
এরূপে রাজা ব্রাহ্মণকে রাজ্যদান করে প্রীতিফুল্লমনে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন–“আমার এ দান অতি উত্তম দানই হয়েছে।” এ বলে রাজা নিতাক্ত প্রীতি গাথা ভাষণ করলেন
১৩। “এ রাজ্য দান-পুৰ্ণ-প্রভাবে অনাগতে আমি বুদ্ধ হয়ে বুদ্ধকৃত্য সমূহ সম্পাদন করব। আমার যেন এ প্রার্থনা পূর্ণ হয়।” রাজা এরূপ প্রার্থনা করে মহাজনগণকে উপদেশ প্রদান। করার পর দেবীসহ রথে আরোহণ করে পূর্বদ্বার দিয়ে নগর হতে বের হলেন। তৎবিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ বললেন–
১৪। “তখন অরিন্দম রাজা ব্রাহ্মণকে রাজ্য দান করে দেবীসহ রথারোহণে স্বীয় রাজ্য হতে বের হলেন।” তখন নগরবাসী সবাই বক্ষে করাঘাত করে রোদন করেছিল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় বললেন–
১৫। ১৬। ১৭। ১৮। “নগর, জনপদ ও গ্রামবাসী; বৈশ্য, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, যোদ্ধা, হস্ত্যারোহী, রথিক ও পদাতিক রাজকুমার, বৃদ্ধ, যুবা, প্রৌঢ় প্রজাবৃন্দও সমগ্র রাজ্যের সবাই বক্ষে করাঘাত করে রোদন পরায়ণ হয়ে রাজার পশ্চাদনুসরণ করলেন।”
তখন মহাসত্ত্ব নিজের পশ্চাদগামী মহাজনতা দেখে নিজের আভরণ সমূহ খুলে তাদের দিয়ে বললেন–“সজ্জন মণ্ডলি, আপনারা অনুতাপ ও রোদন করবেন না। সংসারে সবারই এরূপ স্বভাবতই বিয়োগ-বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। সমস্ত সৃষ্ট বস্তুই অনিত্য। যদি আমার প্রতি আপনাদের একান্তই শ্রদ্ধা থাকে, তা হলে প্রত্যেকেই দান দিন, শীল পালন ও মৈত্রী ভাবনা করুন।” এরূপে উপদেশ দিয়ে তিনি তাঁদের গমনে নিরস্ত করে রথ চালিয়ে অগ্রসর হলেন। সে বিষয় প্রকাশ করার ইচ্ছায় তথাগত বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১৯। “অরিন্দম রাজা তথায় জনগণকে উপদেশ দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এ ক্ষত্রিয় মা রথ চালিয়ে অগ্রসর হলেন।”
অতঃপর দেবরাজ তরুণ ব্রাহ্মণ-বেশ ত্যাগ করে পুনঃ অন্যরূপ ব্রাহ্মণ-বেশ ধারণ করে মহাসত্নের রথের সন্নিধানে উপস্থিত হয়ে বললেন–“মহারাজের জয় হোক্।” বলে রথ। যাঞ্চা করলেন। ইহাতে মহাসত্ত্ব প্রসন্নবদনে দেবীসহ রথ হতে অবতরণ করে রথখানা ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন। তদ্বিষয় প্রকাশ মানসে সম্বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
২০। অতঃপর ব্রাহ্মণ এসে অশ্বযুক্ত রথ যাচা করলেন, বোধিসত্ত্ব অরিন্দম রাজা তাও প্রহৃষ্ট অন্তরে ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন।।
২১। তৎপর অরিন্দম রাজা দেবী সহ রথ হতে নেমে অশ্বযুক্ত রথখানা ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন।”
তৎপর ক্ষত্রিয় কুলের গৌরব কেতন রাজা ও রাণী পদব্রজে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন। দেবরাজও রথ চালিয়ে যাওয়ার ন্যায় কিছুদূর গিয়ে অন্তর্হিত হয়ে বেশ পরিবর্তন করে পূর্বের। ন্যায় জীর্ণ ব্রাহ্মণ-বেশ ধারণ করলেন এবং পুনঃ রাজার পশ্চাদনুসরণ করে আহ্বান করলেন–মহারাজ! মহারাজ!” সে আহ্বান শুনে রাজা-রাণী পেছনে ফিরে দেখলেন–পূর্ব দৃষ্ট সে জীর্ণ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ বললেন–“মহারাজ আপনার নিকট আমার রক্ষিত সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা এখন আমাকে দিন। তা আমার প্রয়োজন হচ্ছে।” ইহা শুনে মহাসত্ত, বিনীতভাবে বললেন–“ভবৎ ব্রাহ্মণ, আপনি আমাদের প্রতি ক্রুব্ধ হবেন না। আমরা উভয়কে আপনার দাস-দাসী রূপে গ্রহণ করুন।” ব্রাহ্মণ বললেন–“মহারাজ, দাস-দাসীর আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে সুবর্ণ মুদ্রাই দিতে হবে।” রাজা বললেন—“ভবৎ ব্রাহ্মণ, তা হলে আপনি আমাদের উভয়কে বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করুন।” ব্রাহ্মণ বললেন–মহারাজ, আমি বিক্রি করার স্থান জানি না। আপনি নিজেই আপনাদের বিক্রি করে শীঘ্রই আমাকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিন। তখন মহাসত্ত্ব ব্রাহ্মণকে আশ্বাস প্রদানচ্ছলে গাথাছন্দে বললেন–
২২। “সাধু ব্রাহ্মণ, আমরা নিজেকে বিক্রি করে আপনাকে সুবৰ্ণ দেব। আমার নিকট হতে তা গ্রহণ করবেন।” তৎপর মহাসত্ত্ব দেবীর দিকে চেয়ে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২৩। হে দেবী, আমি বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করেছি। এখন তোমার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। ইহা শুনে দেবী অতিশয় প্রীতিফুল্ল চিত্তে বললেন–মহারাজ, প্রথমে আমাকেই বিক্রি করে সুবর্ণ সংগ্রহ করুন। তাতেই আপনার মনোরথ পূর্ণ হোক। এ বলে তিনি সিংহনাদে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
২৪। “হে ক্ষত্রিয়, আমি আপনার দাসী। আপনিই আমার ঈশ্বর। যাকে ইচ্ছা করেন, তার নিকটই আমাকে বিক্রি করুন। সে আমায় বিক্রি করুক বা হত্যা করুক।”
ইহা শুনে রাজা আনন্দিত হয়ে দেবীকে বিক্রয়ার্থ সঙ্গে করে ক্রমে ইন্দ্রপত্তন নগরে উপস্থিত হলেন। সেখানে এক সমৃদ্ধকুলে গিয়ে বললেন–“মহাশয়, আপনি কি দাসী ক্রয় করবেন?” তখন এক ব্রাহ্মণ তথায় এসে বললেন–সে দাসীর মূল্য কতটাকা হবে? মহাস, বললেন–তার মূল্য হবে পঞ্চশত সুবর্ণমুদ্রা। তখনই ব্রাহ্মণ পঞ্চশত সুবর্ণমুদ্রা দিয়ে দেবীকে ক্রয় করে নিলেন। মহাসত্ত্ব পত্নীকে বিদায় দেওয়ার কালীন বললেন–“ভদ্রে, তুমি এ হতে এ ব্রাহ্মণেরই দাসী হয়েছ; তাঁর সবকাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন করবে।” এরূপ উপদেশ দেওয়ার পর দেবী মহাসক্তের পাদমূলে নিপতিত হয়ে বললেন–স্বামী, আপনি আমার সর্বদোষ ক্ষমা করবেন।” এ বলে ক্রন্দন পরায়ণ হয়ে নিতাক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–
২৫। “দেব, আপনার সাথে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা। হে ক্ষত্রিয়, আমার সর্বদোষ ক্ষমা করবেন।
মহাসত্ত্ব এরূপে দেবীকে বিক্রয় করে’ পুনঃ নিজকে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে কোনও সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণকুলে গিয়ে বললেন–“ভবৎ ব্রাহ্মণ, আপনার দাসের প্রয়োজন হলে আমায় ক্রয় করুন।” ব্রাহ্মণ বললেন–মূল্য কি পরিমাণ হবে? মহাসত্ত্ব বললেন–“পঞ্চশত সুবর্ণ মুদ্রা।” ব্রাহ্মণ বললেন–“আপনি আমার কাজ করতে পারবেন কি?” মহাসত্ব বললেন–হাঁ পারব। ব্রাহ্মণ তখন তাঁকে পঞ্চশত সুবর্ণ মুদ্রা প্রদান করলেন। তৎপর মহাসত্ত্ব চিন্তা করলেন–“আমি নগর-দ্বার সমীপে বাস করলে আমার দেবীর সুখ-দুঃখের খবর জানতে পারব।” এ মনে করে ব্রাহ্মণকে বললেন–“ব্রাহ্মণ মহোদয়, আমি নগর-দ্বার রক্ষা করতে ইচ্ছা করি।” তা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁকে সঙ্গে করে দৌবারিকের নিকট গিয়ে বললেন–“তাত, আপনি এখন এ দৌবারিকের দাস হয়ে তার সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদন করবেন।” এ বলে বোধিসত্তকে দৌবারিকের হস্তে অর্পণ করলেন। তিনিও ব্রাহ্মণের কথা নীরবে মেনে নিয়ে বিক্রয় লব্ধ সমস্ত স্বর্ণ মুদ্রা হস্তে নিয়ে এরূপ প্রার্থনা করলেন–আমার এদানের প্রভাবে আমাদের মত অন্য কোন প্রাণীর যেন এরূপ বিচ্ছেদ না ঘটে।” অতঃপর এ সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা অই যাচক ব্রাহ্মণকে প্রদান করলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে তথাগত বুদ্ধ বললেন–
২৬। “তখন অরিন্দম রাজা স্বীয় ভার্যা ও নিজকে বিক্রয় করে সে অর্থ ব্রাহ্মণকে প্রদান করেছিলেন।”
দেবরাজ এ স্বর্ণ মুদ্রা লয়ে সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। তদবধি মহাসত্ত্ব একাকীই নগর-দ্বার রক্ষা করে ইন্দ্রপত্তন নগর সমীপেই বাস করতে লাগলেন। ইতিপূর্বে সুবর্ণ গর্ভা দেবী অরিন্দম রাজার সাথে অবস্থান করাতে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। সুতরাং তাঁকে ব্রাহ্মণের বাস গৃহের নিতলের এক প্রকোষ্ঠেই অবস্থান করতে দিলেন। দশমাস পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যায় অর্ধরাতে বৃষ্টি বর্ষণের সময়ে দেবীর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই শিশুর মৃত্যু হল। দেবী মৃতপুত্র সম্মুখে রেখে বোধিসত্ত্বকে স্মরণ করে গভীর দুঃখের সহিত বিলাপসুরে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন
২৭। “হায় হায়! আমি প্রথমে একটি পুত্র সন্তান লাভ করলাম বটে, তারও মৃত্যু হল। এ পুত্র, এখানে তোমার পিতা নেই। তোমার জন্ম তিনি জানেন না।।
২৮। যদি রাজা থাকতেন, কতই না সুখ লাভ করতাম। এখন আমি পরদাসী। হে পুত্র, এখন আমি কি করব?
২৯। হায়, তাত, আজ গভীর রাত্রে আমি একাকিনী তোমায় কি করতে পারি?”
দেবীর এরূপ বিলাপ শব্দ শুনে ব্রাহ্মণী এসে বলল–“রে দুষ্টা দাসী। তুই রোদন করছি কেন?” দেবী বললেন–“হে গৃহস্বামিনী, এখন আমার এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয়েই মৃত্যু হয়েছে।” ইহা শুনে ব্রাহ্মণী ক্রুদ্ধ হয়ে বলল—“হে দুষ্টা দাসী, তুই এখনি এখান থেকে বের হয়ে পড়।” দেবী বললেন–“মাতঃ স্বামিনী, এখন রাত্রি, তাতে আবার বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে, আমি একাকিনী ভীতসন্ত্রস্তা। সুতরাং রাত্রির অবশিষ্ট সময় এখানে অবস্থান করে প্রাতেই এখান থেকে চলে যাব।” ইহা শুনে ব্রাহ্মণী তর্জন করে বলল–“অরে চণ্ডালীনী, তুই এখনি। বের হয়ে পড়” বলে তাকে আক্রোশ ও ভৎর্সনা করতে লাগল। দেবী ক্ষত্রিয় কন্যা, তাই তিনি অতি সুকোমল। পরদাসী হয়ে তিনি এখন বড় দুঃখিনী। এমন বিপদের সময় এরূপ অপমান জনক কথা তার অসহ্য হল। হৃদয় অগ্নি দগ্ধ হওয়ার ন্যায় উষ্ণ হয়ে উঠল। অমুখে তিনি মৃত পুত্র ক্রোড়ে করে বের হয়ে পড়লেন; এবং শঙ্কিত অন্তরে অন্ধকারে এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করতে লাগলেন। এ বিষয় প্রকাশ করবার মানসে বুদ্ধ বললেন–
৩০। দগ্ধ হৃদয়ে একাকিনী রোদন পরায়ণা দেবী মৃতপুত্র বক্ষে নিয়ে এদিক সেদিক বিচরণ করতে লাগলেন।”
দেবী অন্ধকার রাত্রে বৃষ্টির জলে সিক্ত হয়ে অনুক্রমে বিচরণ করতে করতে বোধিসত্ত্ব আরক্ষিত দ্বারে প্রাপ্ত হলেন। তথায় রোদন পরায়ণা রাণী দারোয়ানকে দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য সানুনয় অনুরোধ করে বললেন–
৩১। “হে দ্বার পাল, আমার প্রতি অনুকম্পা করে দ্বার খুলে দিন। আমার মৃত পুত্রকে কবরস্থ করতে হবে।”
মহাসত্ত্ব দেবীর বিলাপ-শব্দ শুনে শয্যা ত্যাগ করে বললেন–ভদ্রে, এখন দ্বার খােলার সময় নয়। আমি অপরের দাস। সুতরাং আমার প্রভুর ভয়েই এতরাত্রে নগর-দ্বার খুলে দিতে পারবনা। এখন তুমি অন্যত্র যাও। দেবী জানেন না, তিনি যে তার স্বামীর সাথে কথা বলছেন। স্বামীর কণ্ঠস্বরও চিনতে পারলেন না। সে এখন জ্ঞান হারা উন্মাদিনীর মত। তিনি বক্ষে করাঘাত করে কেঁদে উঠলেন। বিলাপে বললেন–
৩২। “হায় হায়! হে অপুণ্যবান পুত্র”, আমি ছিলাম রাজরাণী। থাম সুখে রাজঅন্তঃপুরে। এখন আমি দাসী অবহেলার পাত্রী। হে পুত্র, তোমার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া কি করে করব?
৩৩। তোমার পিতা রাজা অরিন্দম যদি এখন রাজ-প্রসাদে থাকতেন, তা হলে কি আমি তোমাকে লয়ে শ্মশানে আসতাম?
৩৪। এখন আমি রাজা হতে ভিন্ন হয়েছি। আমি এখন বিধবার মত। আমি নগরের দ্বারও পাচ্ছিনা। এখন আমি এ মৃত পুত্রকে কি করব?
বোধিসত্ত, রাজা অরিন্দম এ বিলাপ শুনে সংবিগ্ন হৃদয়ে বললেন–“তুমি কে?” দেবী বললেন–“আমি সুবর্ণ গর্ভা দেবী রাজা অরিন্দমের পত্নি।” তখন মহাসত্ত্ব ছােট গুপ্ত দ্বার খুলে দিয়ে নিজকেও অরিন্দম রাজা বলে পরিচয় দিলেন। তখন দেবী রাজার পাদমূলে মূচ্ছিতা হয়ে পড়লেন। রাজা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–“ভদ্রে, তোমার রোদন করা উচিত নয়। সংযোগ-বিয়োগ জগতের ধর্ম। মানবের জীবনমরণ পর্যন্ত। তদ্ধেতু তুমি রোদন করোনা।” তৎপর দেব মহাসড়কে নিজের মৃত পুত্রটি প্রদান করে নিজের সব বিষয় প্রকাশ করে বললেন–। তখন রাজা নিজের পুত্রের দিকে দৃপাত করে বললেন–
৩৫। প্রাণীদের পরস্পর বিচ্ছেদ হওয়াই জাগতিক ধর্ম। সমস্ত সংস্কার অনিত্য। ইহা জগতের নিয়ম।”
এ বলে মহাসত্ত্ব মৃত পুত্র লয়ে দেবী সহ শ্মশানে নিয়ে গেলেন। শিশুটিকে দেবীর হস্তে দিয়ে বললেন–“ভদ্রে এখন আমি আমার এ পুত্রের জীবন দান করব।” দেবী বললেন–“স্বামী তা কিরূপে সম্ভব হবে?” মহাসত্ব বললেন–“ভদ্রে, জগতে সত্যক্রিয়া হতে অপর আর কোন মহাফলপ্রদ অধিষ্ঠান নেই। সুতরাং এখ নামি সত্যক্রিয়া করব।” এবলে পূর্বদিকাভিমুখী হয়ে করঘোড়ে নিন্মোক্ত নয়টি গাথাযোগে বললেন–
৩৬। “এখানে অবস্থানকারী ভবৎ দেবগণ এবং জগতে যত দেবব্ৰহ্ম আছেন, আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। আমার জীবনে বুদ্ধি প্রাপ্ত অবধি যতদূর স্মরণ হচ্ছে।
৩৭। কোন দিন ক্ষুদ্র পিপিলিকা পর্যন্ত হত্যা করিনি। এ সত্য বাক্যের প্রভাবে এখনই আমার পুত্র জীবিত হোক।
৩৮। পরের অদত্ত বস্তু এমন কি কড়া-ক্রান্তি পর্যন্ত কোনও বস্তু কখনো গ্রহণ করিনি। এ সত্যের প্রভাবে আমার পুত্র জীবিত হোক।
৩৯। কখনো পরদান লঙ্ঘন ও মিথ্যা ভাষণ করিনি। এ সত্যের প্রভাবে আমার পুত্র এখনি জীবিত হোক।
৪০। আমি জীবনে কোনদিন সুরা প্রভৃতি কোনও নেশাদ্রব্য সেবন করিনি। আমার সমস্ত শীল পরিশুদ্ধ আছে। এ সত্য বাক্যের প্রভাবে এখনি আমার পুত্র জীবিত হোক্।
৪১। যাচকদের আমি শ্রদ্ধা ও মৈত্রী করুণা চিত্তে দান দিয়েছি। এ সত্য বাক্যের প্রভাবেই আমার পুত্র এখন জীবিত
হোক।
৪২। দান দেখিয়া ও দিয়া আমার মন প্রসন্ন হয়। এ সত্য বাক্যের প্রভাবেই আমার পুত্র এখন জীবিত হোক।
৪৩। সর্বলোকের হিতের জন্যই আমি উত্তম বোধি প্রার্থনা করেছি। এ সত্যবাক্যের প্রভাবেই আমার পুত্র এখন জীবিত হোক।
৪৪। আমি নিজকে বিক্রি করে দাস হয়েছি। কোন ও সময় দানের কর্তব্য কর্মের ব্যতিক্রম করিনি। এ সত্য পারমী পূর্ণ করে অনাগতে বুদ্ধ হব। এ সত্যের প্রভাবে এখনি আমার পুত্র জীবিত হোক্।
মহাসত্ত্বের সত্যক্রিয়ার প্রভাবে তখনই দেবরাজ অমৃতোদক এনে। শিশুর দেহে সিঞ্চন করলেন। তন্মুহূর্তে শিশু পাশ পরিবর্তন করে শয়ন করল। ইহা দেখে দেবীর অনুপম আনন্দে প্রাণভরে উঠল। মনে করলেন–আমার স্বামীর দ্বারাই আমার পুত্রের জীবন লাভ হল। তিনিও সত্য ক্রিয়া করলেন–নিক্তে গাথাক্রয়যোগে–
৪৫। “হে ভবৎ দেবগণ ও সমস্ত বন, কন্দর, বৃক্ষ ও লতাদিতে অধিষ্ঠিত দেববৃন্দ, আমার বাক্য শ্রবণ করুন।।
৪৬। আমার স্বামী আমাকে পরদাসীর জন্য বিক্রি করে এখানে এসেছেন। স্বামীর কারণে আমি স্বীয় চিত্তকে কখনো বিকল করিনি।
৪৭। আমি এ সত্য অধিষ্ঠান করছি। পুত্রের জন্যই আমি এখানে এসেছি। এ সত্য বাক্যের প্রভাবে এখন আমার পুত্র উঠুক।”
দেবীর এ সত্য ক্রিয়া প্রভাবে শিশু পুনঃ পার্শ্ব পরিবর্তন করে চক্ষু উন্মীলণ করল এবং মাতৃস্তন্য পান করতে লাগল। সেক্ষনেই দেবরাজ ইন্দ্র এ ক্ষত্রিয়দ্বয়ের সত্যক্রিয়ানুভাবের এ আশ্চর্য ব্যাপার দর্শনে অতি প্রহৃষ্ট হয়ে দিব্যরূপ ধারণ করলেন। তখন তিনি তরুণ সূর্যের ন্যায় দিব্যরূপে প্রকাশিত হয়ে আকাশে স্থিত হলেন। তাঁর সে দিব্য প্রভাবে সমস্ত শ্মশান ভূমি দিবালোকে উদ্ভাসিত হল ও দিব্যপুষ্প বর্ষিত হল। তৎপর দেবরাজ মহাসত্ত্বকে নিজের আগমন বার্তা জ্ঞাপনার্থ নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৪৮। “আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আপনার বুদ্ধত্ব লাভের কামনায় পারমী ধর্মের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য আমি আপনার নিকট এসেছি।
৪৯। মহারাজ, আপনার সমস্ত পারমী পূর্ণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করুন।”
এ বলে দেবরাজ রাজা-রাণীকে নিজের দিব্যানুভাববলে পুনঃ শ্মশান হতে নিয়ে সূচী নগরে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠাপিত করলেন। তখন অরুণােদয় হয়েছে। দেবরাজ এমন সময় মহাসকে রাজ্য প্রদান করে বললেন–“মহারাজ, এখন
অপ্রমত্ত হয়ে রাজত্ব করুন।” এরূপ উপদেশ দিয়ে স্বীয় দেবলোকে প্রস্থান করলেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে তথাগত
বুদ্ধ নিন্মোক্ত নয়টি গাথা ভাষণ করলেন
৫০। তখন দেবরাজ তুষ্টচিত্তে আকাশে স্থিত হয়ে সর্বদিক আলোকিত করলেন এবং তাঁকে রাজ্য প্রদান করে বললেন–‘সাধু সাধু মহারাজ, আপনি উত্তম প্রার্থনাই করেছেন। এতেই অনাগতে ভদ্র কল্পে আপনি বুদ্ধ হবেন। সর্বলোকের হিতার্থে নিশ্চয় শ্রেষ্ঠ, উত্তম, জগত বরেণ্য বুদ্ধ, সুগত বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, বিমুক্তি দায়ক অরহত জগতে নাথের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাথ, বিমুক্ত, সম্বুদ্ধ, জ্যেষ্ঠ অপ্রতিপুঞ্চাল, দেবরের শিক্ষক শাস্তা, সুখদায়ক ত্রাণকারী, জগতের শরণ, সত্ত্বদের অনুকম্পাকারী, হিতৈষী চক্ষুষ্মণ, অর্থকুশল, ধর্মস্বামী, তথাগত চতুর্বিধ আর্যসত্য বিমোক্ষ সুখ ও শ্রেষ্ঠ ধর্মদায়ক বুদ্ধ হবেন।”
তদবধি বোধিসত্ত্ব অত্যন্ত প্রসন্ন মনে ধর্মতঃ ও সমদমের মাধ্যমে রাজত্ব করেছিলেন। অমাত্য প্রমুখ রাজ্যবাসী জনগণ আনন্দমনে প্রাতেই নানাবিধ উপহার দ্রব্য নিয়ে রাজার নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে বন্দনা করে তাঁর চতুর্দিকে উপবেশন করলেন। রাজা তখন সকলকে উপদেশ দিয়ে বিদায় করলেন। সে দিন হতে সবাই রাজার উপদেশানুসারে দানশীল-ভাবনাদি কুশলকর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। রাজাও রাণী অনুপম রাজৈশ্বর্য পরিভোগ করে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত দান-শীল-ভাবনাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদনে নিরত হয়ে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। পরিশেষে ভগবান বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, কেবল এখন নয়, পূর্বেও অপরিপক্ক জ্ঞানাবস্থায় এরূপ মহাদান দিয়েছিলাম। এবলে জাতক সমাপ্ত করে নিতে পাঁচটি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন
৫৯। তখনকার দেবরাজ ইন্দ্র এখন আমার সামনে দিব্যচক্ষুধারীদের শ্রেষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ অনুরুদ্ধ।
৬০। অরিন্দমের পিতা এখন শুদ্ধোধন মহারাজা। মাতা মহামায়া দেবী।
৬১। সুবর্ণ গর্ভা এখন যশোধরা। রাজপুত্র কুমার এখন রাহুল।
৬২। যোদ্ধা প্রভৃতি জনগণ এবং সমস্ত নগর-জনপদবাসী অরিন্দমের পরিষদবৃন্দ সবাই এখন আমারই পরিষদ।
৬৩। তখনকার সময়ে পুণ্যকামী দানেরত অরিন্দম মহারাজ এখন আমিই শাস্তা সম্যক সম্বুদ্ধ! এ জাতক এরূপ ধারণ কর।
(অরিন্দম জাতক সমাপ্ত)
Leave a Reply