আদিত্ত রাজ জাতক
“ভবৎ, আমার যখন স্বপ্ন” এ’গাথাটি ভগবান জেতবনে অবস্থান করবার সময় তাঁর জন্মান্তরের দান- পারমীকে উপলক্ষ করে বলেছিলেন।
একদিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে এরূপ কথা উত্থাপন করলেন। “আহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা দেব। মানবের লৌকিক লোকুত্তর সম্পদ দায়ক। অপিচ তিনি পূৰ্বজন্মে বোধিসত্বাবস্থায় পরকে দান করে কোন সময় তৃপ্ত হননি। তাই সর্বদা তিনি দানে রত থাকতেন। এ দানবলেই তিনি এখন সর্বজ্ঞতা প্ৰাপ্ত হয়ে দেব-মনুষ্যগণকে আর্যমাৰ্গ ধর্মফল প্ৰদান করছেন। “শাস্তা গন্ধকুটি থেকে ভিক্ষুগণের এসব আলোচনা দিব্য কৰ্ণে শুনে ধৰ্মসভায় এসে উপস্থিত হলেন। তথায় প্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবিষ্ট হয়ে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ, বর্তমান তোমরা এখানে কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসে আছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাঁদের আলোচ্যমান বিষয় বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলে, বুদ্ধ বললেন- “হে ভিক্ষুগণ, ইহা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় নহে-তথাগত যে শুধু এখন দেব-মানবের লৌকিক লোকুত্তর সম্পদ দায়ক হয়েছেন তা’ নয়, পূর্বেও বোধিসত্ত্বাবস্থায় পরকে দান দিয়ে তৃপ্তি লাভ করতে পারিনি। ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। এ ব’লে বুদ্ধ নীরব হলেন। তখন অতীতের সে বিষয় বলার জন্য ভিক্ষুগণ দ্বারা প্রার্থী হয়ে তিনি তা বলতে আরম্ভ করলেন ।
অতীতে জ্যোতিঃ নামক নগরে আদিত্ত নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর ষোড়শ সহস্ৰ নারীদের মধ্যে শঙ্খাদেবী নাম্নী এক পুন্যবতী নারী ছিলেন অগ্ৰমহেষী। রাজা ছিলেন। অতিশয় শ্রদ্ধাবান। সর্বদাই তিনি দানে রত থাকতেন। তাই নগরের চারি দ্বারে চার খানা, মধ্যে এক খানা এবং নিজের প্রাসাদের দ্বারে একখানা, এ ছয়খানা দান-শালা তৈরী করায়ে প্রত্যহ প্রত্যেক দানশালায় ছয় হাজার ছয় শত টাকার দানীয় বস্তু অর্থীদের দান করতেন। সময়ে সময়ে মহারাজ মহামেঘের ন্যায় মহাদান বর্ষণ করতেন। তিনি কোন এক রাত্রির অন্তিমযামে স্বপ্নযোগে দেখলেন “দুর্বল জীর্ণ শীর্ণ এক ব্ৰাহ্মণ তাঁর নিকট এসে অন্ন যাচ্ঞা করলেন।” তিনি এরূপ স্বপ্ন দেখার পর জাগ্রত হয়ে তা পুনঃ পুনঃ স্মরণ করে উপবেশন করলেন। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পর স্বীয় অমাত্যবৃন্দকে আহবান করে নিম্নোক্ত গাথাটি বললেন-
১। “হে ভবৎগণ, এক জীৰ্ণ ব্ৰাহ্মণকে স্বপ্নে দেখার পর নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে উপবিষ্ট হয়েছি।” অমাত্যবৃন্দের নিকট স্বীয় দৃষ্ট স্বপ্ন প্রকাশ করার পর রাজা চিন্তা করলেন- “অদ্য প্ৰাতে যদি কোন যাচক আমার নিকট এসে বাহ্যিক বা আধ্যাকি কোনও বস্তু যাচ্ঞা করে, তা নিশ্চয়ই তাকে দান করব।” যদি আমার নিকট কেহ মস্তক চায়, তাও ছেদন করে দান দেব। কেহ যদি আমার হৃদয় চায়, আমার বক্ষ ভেদ করে তাও বের করে দান দেব। যদি কেহ আমার দেহের মাংস-পিণ্ড চায়, অথবা অর্ধ শরীর বা সর্বশরীর চায়, তাকে তাও দান করব। আর কেহ যদি আমাকে বলে- তুমি আমার দাস হও, তখন আমি তাও হব। কেহ যদি রাজ্য চায়, তাও তাকে দান করব। আদিত্যরাজ এরূপ চিন্তা করে অমাত্যগণ পরিবৃত হয়ে বিচারালয়ে রত্ন পালঙ্কে উপবিষ্ট হয়ে যাচকের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। এমন সময় অমাত্যবৃন্দ রাজার দৃষ্ট স্বপ্ন জ্ঞাত হবার ইচ্ছায় রাজাকে নিম্নোক্ত গাথায় বললেন–
২। রাজন, আপনি রাত্ৰিতে যে স্বপ্ন দেখেছেন বলে প্ৰকাশ করছেন তা’ আমাদের বলুন।
আদিত্তরাজ তাদের বাক্য শুনে নিম্নোক্ত গাথা দ্বয়ে স্বপ্ন বিবরণ প্রকাশ করলেন-
৩। আমি স্বপ্নে দেখলাম, “এক জীৰ্ণ ব্ৰাহ্মণ আমার নিকট এসে অন্ন যাচ্ঞা করলেন।
৪ । অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও জীবন ইত্যাদি অন্য কিছুই যাচ্ঞা করলেন না।” আমি এরূপই স্বপ্ন দেখলাম। ভবৎগণ, তা’ আপনারা চিন্তা করে দেখুন।
এরূপে তিনি অমাত্যদের নিকট স্বপ্ন-বিবরণ প্ৰকাশ করার পর আধ্যাকি দান দেওয়ার ইচ্ছক হয়ে পুনঃ চিন্তা করলেন“কোন যাচক আমার নিকট এসে বাহ্যিক দান যাচ্ঞা করে। পরে আধ্যাকি দানই যাচ্ঞা করুক।” এরূপ চিন্তা করে। প্রীতিফুল্লমনে আধ্যাকি দানই দেওয়ার প্রণিধান করতঃ নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৫। আমি অদ্য তুষ্ট মনে আধ্যাকি দান প্রদান করব। যাচকগণ শীঘই আমার নিকট এ’সে আমার আধ্যকি ধন গ্ৰহণ করুন। আমার অঙ্গ ও জীবন দান করা হবে একমাত্ৰ বোধিজ্ঞান লাভ করবারই ইচ্ছায় ।
আদিত্তরাজ এরূপ দৃঢ় সংকল্প পোষণ করে নিজের প্রাসাদে আরোহণ করলেন। অতঃপর একদিবস রাজা প্ৰত্যুষকালে নিদ্রা হতে জাগিয়ে শয্যায় সুখাসনে উপবেশন করলেন এবং ছয় দানশালায় প্রদত্ত দান সম্বন্ধে চিন্তা করতে লাগলেন। এরূপ চিন্তা করার ফলে তাঁর অন্তরে স্থায়ী প্রীতির উদ্রেক হল। সেইক্ষণে রাজা এরূপ চিন্তা করলেন- অহো! যাচকগণ আমার নিকট এসে যদি বাহ্যিক দান যাচ্ঞা না করে আধ্যকি দানই যাচ্ঞা করে চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত, অৰ্দ্ধ দেহ বা সর্বদেহও যদি যাচ্ঞা করে, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের ইচ্ছায় তাদের ইচ্ছিত বস্তু নিশ্চয়ই দান করব। সে বিষয় প্রকাশ-মানসে শাস্তা নিম্নোক্ত গাথাত্রায় বললেন–।
৬। ধর্মতঃ রাজত্বকারী আদিত্ত নামক রাজা প্রাসাদে বসে দান দেওয়ার জন্য চিন্তা করলেন।
৭। কোন ব্যক্তি যদি আমার নিকট এসে আমার চক্ষু, হৃদয়, মাংস, রক্ত ও অৰ্দ্ধদেহ ইত্যাদি আধ্যাকি বস্তু দান চায়।
৮। আর যদি কোন যাচক আমাকে দাস রূপে চায়, আমি নিজকে তার দাস রূপে নিশ্চয়ই নিয়োজিত করব।
এরূপ ঐকান্তিক চেতনায় চিন্তাকারী রাজার তেজানুভাবে দ্বিলক্ষ চারিনিযুত যোজন দল বিশিষ্ট এ মহা-পৃথিবী মত্ত হন্তীর ন্যায়। সগর্জনে কম্পিত হল। মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হল, সুমেরু পর্বতরাজ সুম্বোধিত বেত্রের ন্যায় নমিত হয়ে জ্যোতিঃ নগরাভিমুখী হল। সশব্দে দেবগর্জন করে ক্ষণিক বর্ষণ হল। অকালে বিদ্যোৎলতা নিসৃঃত হল। দেবরাজ ইন্দ্র ও মহাব্ৰহ্মা সানন্দে সাধুবাদ প্ৰদান করলেন। তৎসঙ্গে সমস্ত দেবতা ও সাধুবাদ দান করলেন। মনুষ্যলোক হতে ব্ৰহ্মালোক পৰ্যন্ত মহাআনন্দ-কল্লোল উখিত হয়েছিল। সে সময় দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন ও রাজাসন উত্তপ্ত হয়েছিল। দেবরাজ এর কারণ চিন্তা করে নিম্নোক্ত গাথাটি ভাষণ করেছিলেন।
৯ । মনে হয়, কোন দেবতা বা মনুষ্য এমন দান ও ব্ৰহ্মচর্য আচরণ করছেন, যে পুণ্য প্রভাবে আমাকে এ আসন হতে চু্যত করবেন।
দেবরাজের এরূপ সন্দেহ উৎপন্ন হওয়ায় তিনি দিব্য নেত্ৰে জগতে অবলোকন করে প্রকৃত কারণ জ্ঞাত হয়ে সানন্দে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় ঘোষণা করলেন।
১০। মনুষ্যলোকে সমস্ত মনুষ্য কুশল কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন। সুসংঘতভাবে। তাই এবার নিরয় শূন্য হবে এবং দেবলোক পরিপূর্ণ হবে।
১১। আদিত্য নামক রাজা বুদ্ধান্ধুর দানে রত হয়ে পারমী ধর্ম পূর্ণ করে অনাগতে বুদ্ধ হবেন।
অতঃপর দেবরাজ এখনিই আমি গিয়ে বোধিসত্ত্ব আদিত্য রাজার পারমী ধর্ম পরিপূরণের সাহায্য করব। “এ চিন্তা করে। তখনই দেবলোক হতে মনুষ্যলোকে উপনীত হয়ে বৃদ্ধ, জীর্ণ শীর্ণ ব্ৰাহ্মণ-বেশ ধারণ করে পক্ক শিরকেশ ও কম্পমান দেহে দণ্ড পরায়ণ হয়ে রাজাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। তথায় জনগণ এ জীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণকে দেখে অতিশয় সংক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–“ভগৎগণ, এ জীর্ণ ব্ৰাহ্মণ ইতিপূর্বে এখানে আসতে দেখিনি, কিরূপে তিনি এখানে আসলেন? তখন বোধিসত্ত্ব প্রাসাদ হতে অবতরণ করে প্রাসাদ-দ্বারে প্রতিষ্ঠিত দানশালায় উপস্থিত হলেন। তখন সে বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ বোধিসত্বের নিকটবৰ্ত্ত হয়ে হস্ত প্রসারণ করে বললেন- “মহারাজের জয় হোক।” ইহা শুনে মহাসত্ব সে দণ্ড হস্তধারী জীৰ্ণ বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের প্রতি লক্ষ্য করে চিন্তা করলেন–
“এ ব্ৰাহ্মণের আগমন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন।” এ চিন্তা করে করুণাময় অন্তরে ব্রাহ্মণকে নিম্নোক্ত গাথাযোগে জিজ্ঞেস করলেন–
১২। “হে মহাব্ৰাহ্মণ, আপনি কোন প্রয়োজনে এসেছেন?” ইহা শুনে ব্ৰাহ্মণ হস্ত উত্তোলন করে বললেন- মহারাজ, আমি জীর্ণ দুর্বল, ব্যাধি-পীড়িত, অনাথ ও ক্ষুধাতুর। সুতরাং আমাকে অন্নদান করুন। এ বলে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
১৩। রাজন, আমাকে শ্রদ্ধার সহিত ভোজন দান করুন। তজন্য আমি এসেছি।
ইহা শুনে আদিত্ত্য রাজা প্রীতিফুল্ল হৃদয়ে নিম্নোক্ত গাথাটি বললেন–
১৪। হে ব্ৰাহ্মণ, আপনি যে অন্ন ভোজন যাচ্ঞা করলেন, তা’ আপনাকে দেবো। দানেই আমার মন রমিত হয়।
তখন রাজা প্রার্থনা করলেন- “অদ্য আমার এ যে অন্নদান, তা অনাগতে সর্বজ্ঞ বুদ্ধদের হেতু হোক। অতঃপর স্বর্ণ থালায় উৎকৃষ্টতর অন্ন ব্যঞ্জন পরিপূর্ণ করে তা নিজের মস্তকে ধারণ করে ব্ৰাহ্মণকে প্ৰদান করলেন। ব্ৰাহ্মণও তা রাজার হস্ত হতে গ্ৰহণ করে রাজার সম্মুখেই তা’ ত্যাগ করে চলে গেলেন। শাস্তা তা’ প্ৰকাশ উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত গাথা পঞ্চক ভাষণ করলেন–
১৫। তখন সে আদিত্ত রাজ সদা সুমন চিত্তে সমাদরে ব্ৰাহ্মণকে অন্নভোজন দান করেছিলেন।
১৬। শ্রদ্ধার সহিত রাজা ব্ৰাহ্মণকে শ্রেষ্ঠ অন্ন বোধিজ্ঞান লাভের মানসে দান করেছিলেন।
১৭। রাজা তথায় দেখলেন, তিনি যে অন্ন দান করেছেন, ব্ৰাহ্মণ তা ক্রোধাভরে ত্যাগ করে চলে গেলেন।
১৮। সদা প্ৰসন্ন চিত্ত রাজা এতে মনে কোন প্রকার ক্ৰোধভােব না। এনে বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করে সুমন সম্পন্ন হলেন।
১৯। তব্দ্ধেতু পণ্ডিত জন শ্রেষ্ঠ সুখ প্রার্থনা করে তুষ্ট চিত্তে দান দিয়ে ত্রিকালে প্রসন্ন চিত্তে অবস্থান করে দেব-মনুষ্যলোকে সর্বদা দুর্লভ শ্রেষ্ঠ সুখ লাভ করেন।
সেক্ষণেই দেবরাজ জীর্ণ ব্রাহ্মণবেশ ত্যাগ করে তরুণ দর্শনীয় অভিরূপ প্ৰসন্নতা ব্যঞ্জক ও সৌভাগ্যবান ব্ৰাহ্মণবেশ ধারণ করে পুনঃ রাজাঙ্গণে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আদিত্ত রাজার নিকট উপস্থিত হয়ে আলাপচ্ছলে নিম্নোক্ত গাথায় বললেন-
২০। দেব, কুশলে আছেন ত? ভবৎ, নিরাপদে আছেন ত? জনপদ সমৃদ্ধ আছে ত? সুবৃষ্টি হয় ত?
ইহা শুনে আদিত্ত রাজ সে ব্ৰাহ্মণকে সম্বোধন করে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
২১। ব্ৰাহ্মণ, আমি কুশলে ও নিরাপদে আছি। আমার জনপদ সমৃদ্ধ আছে, সুবৃষ্টি ও বর্ষণ হয়। ব্ৰাহ্মণ, বহুদূর হতে আপনার আগমন নিশ্চয়ই সু-আগমন হয়েছে।
এ’বলে মহাসত্ব চিন্তা করলেন- “এ ব্ৰাহ্মণ এ রাজাঙ্গণে অকারণে আসেননি। তার আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করব।” এ’মনে করে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
২২। আপনি কি কারণে, কীই বা প্রয়োজনে এ রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন? তা আমাকে বলুন।
ইহা শুনে তরুণ ব্ৰাহ্মণ বললেন- “মহারাজ, এখন আমি আপনার শঙ্খাদেবী ভাৰ্যাকে আমার ভাৰ্যারূপে বরণ করবার জন্য যাচ্ঞা করতে এসেছি। আমাকে আপনার ভার্য দান করুন।” এবলে নিম্নোক্ত গাথাযোগে বললেন–
২৩। বারিবহনকারী নদীর জলে যেমন কোন সময় ক্ষীরামান হয়না, আপনিও তেমন। তাই আপনার নিকট যাচ্ঞা করতে এসেছি। শীঘই আপনার ভার্য আমাকে দিন।
ইহা শুনে মহাসত্বের মন প্রীতি রসে সিক্ত হল। প্রসারিত হস্তে যেন সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রার থলি পতিত হল এবং দরিদ্র ব্যক্তি যেন সুবর্ণ-নিধি লাভ করল, সেরূপ আনন্দিত মনে বললেন–“সাধু সাধু মহাব্ৰাহ্মণ, আপনার সমস্ত মনোরথ পূর্ণ করব।” এ বলে তিনি সমগ্র জ্যোতিঃনগরে বিঘোষিত হয় মত প্ৰসন্ন মনে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন-
২৪। ব্ৰাহ্মণ, আপনি যা যাচ্ঞা করলেন, তা আপনাকে অকম্পিত হৃদয়েই প্ৰদান করব । যা আছে, তা গোপন করবনা। দানেই আমার মন রমিত হয়।
মহাসত্ব এরূপ বলে স্বীয় পত্নী শঙ্খা দেবীর মুখ-পানে চেয়ে বললেন– “ভদ্ৰে, এখন আমি তোমাকে দান দিয়ে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করব।” ইহা শুনে দেবী বললেন- মহারাজ, তা প্রার্থনা করুন, বড়ই উত্তম হবে।” এ বলে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় ভাষণ করলেন–
২৫। দেব, আপনি আমার অভিভু, স্বামী, ঈশ্বর এবং আমার প্রতিষ্ঠাপক দেবতা। আমাকে নিশ্চয়ই দান দিন।
২৬। আপনার প্রতি যাই অপরাধ করেছি, তা আমার প্রতি অনুকম্প করে ক্ষমা করুন। মহারাজ, আপনার শ্ৰী পাদপদ্মে বন্দনা জানাচ্ছি।
রাজা ইহা শুনে শীঘ্রই সুভাশিত জল পরিপূর্ণ সুবর্ণ গাডু গ্ৰহণ করে সে তরুণ ব্ৰাহ্মণের হস্তে জল ঢেলে বললেন- “হে ব্ৰাহ্মণ, এ শঙ্খাদেবী আমার অতি প্ৰিয়তমা । অপিচ এ দেবী হতেও শত-সহস্র ও লক্ষগুণে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই আমার প্রিয়তর। তদ্ধেতু আমার এ ভাৰ্যাদান সর্বজ্ঞ জ্ঞানের হেতু হোক।” এ বলে নিজের প্রিয়তমা ভার্যা শঙ্খাদেবীকে তাঁর হস্তে প্রদান করে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন-
২৭। মহাব্ৰাহ্মণ, বোধিলাভের ইচ্ছায় আপনাকে আমার ভাৰ্যা দান দিচ্ছি, আমার নিকট হতে তাকে গ্ৰহণ করুন।
এ বলে মহাসত্ব ব্ৰাহ্মণের সাথে দেবীকে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় বললেন—
২৮। মহাব্ৰাহ্মণ, আপনি আমার দানোত্তম দেবীদান গ্ৰহণ করুন। ব্ৰাহ্মণ, আমার প্রদত্ত এ দান গ্ৰহণ করে যথেচ্ছা গমন করুন।
২৯। এ নারী আমার অপ্ৰিয় নয়, কিন্তু ওর চেয়ে সর্বজ্ঞতাই আমার অতিপ্রিয়, তাই আমি আমার এ পতিব্ৰতা ভাৰ্যাকে দান দিচ্ছি।
সেক্ষণেই পৃথিবী কম্পনাদি সর্ববিধ আশ্চর্য বিষয়ের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। তদ্বিষয় প্রকাশ কার ইচ্ছায় শাস্তা নিম্নোক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন।
৩০। অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আদিত্ত রাজা জল। ঢেলে স্বীয় পত্নীকে ব্ৰাহ্মণের হস্তে দান দিয়েছিলেন।
৩১। এ দানের সময় ভীষণ লোমহর্ষ জনক পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল।
৩২। দেবীকে দান করার সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল ভৈরভ নাদ প্রবর্তিত হয়েছিল এবং মহাপৃথিবী কম্পিত হয়েছিল।
৩৩। দেবীকে দান করা হলে তখন সসাগরা মহানগর সহ পৃথিবী সংক্ষুব্ধ হয়েছিল।
৩৪। সাগরে তখন মহাগৰ্জনের সৃষ্টি হল। সুমেরু পর্বত নগরাভিমুখী হয়ে নমিত হয়েছিল। চিত্ৰবন অলঙ্কারের ন্যায়। হয়েছিল।
৩৫। পৃথিবীর সর্বদিক চালিত হল। সর্বদা ইক্ষু নিষ্পেষনীর ন্যায় পৃথিবী হতে মহা শব্দ নিঃসৃত হয়েছিল।
তখন ব্ৰাহ্মণ শঙ্খাদেবীর হস্ত ও কেশ-কলাপ নির্মমভাবে আকর্ষণ করে সে স্থানেই ভূপাতিত করলেন। ইহাতে বেদনা বিধুরা দেবী তখন রোদন করতে লাগলেন। মহাসত্ব এ ব্যাপার দেখে ব্ৰাহ্মণের প্রতি ক্রুব্ধ না হয়ে বললেন– “ভদ্র, তুমি অনুশোচনা ও রোদন করোনা। যেহেতুঃ- আমি তোমাকে ব্ৰাহ্মণের হস্তে দান করে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রার্থনা করছি। দেবী ইহা শুনে সিংহনাদে নিম্নোক্ত গাথা যোগে বললেন–
৩৬। দেব, আমি আপনার দাসী, আপনিই আমার স্বামী ও ঈশ্বর। ইচ্ছা করে আপনি আমাকে দান করেছেন। তব্দ্ধেতু তিনি আমাকে বিক্রী করুক বা বধ করুক, তাতে আমার কোনই আপত্তি থাকবে না।
তখন দেবী প্রীতিফুল্লমনা হয়ে ব্ৰাহ্মণের নিকট স্থিতা হলেন। সে বিষয় প্রকাশ করবার ইচ্ছায় শাস্তা বলেছিলেন।
৩৭। তখন সৰ্বকালের জন্য শঙ্খাদেবী ক্ৰোধ বিহীনা। হয়েছিলেন এবং রাজাও অনাগতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য ক্রোধ বিহীন হয়েছিলেন।
তৎপর দেবরাজ তাদের অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে তাঁদেরকে বহু স্তুতি করলেন। সে বিষয় প্রকাশ-মানসে শাস্তা নিম্নোক্ত গাথা পঞ্চক ভাষণ করলেন–
৩৮। দেবরাজ তাদের সংকল্প জ্ঞাত হয়ে এরূপ বললেনদিব্যমানবীয় যা কিছু আছে, সব কিছুতেই আপনার জয়।
৩৯। পৃথিবী যে নিনাদ করেছিল, তা দেবলোকে গিয়েছে। চারিদিকে যে বিদ্যুতের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, তদ্বারা গিরিগহবর পর্যন্ত আলোকিত হয়েছিল।
৪০। তা উভয় বিষয় নারদ পর্বত অনুমোদন করছে। তাঁরা সর্বদা স্বীয় বিমানের দ্বারে স্থিত হয়ে সন্তোষ লাভ করছিল।
৪১। আপনি যে স্বীয় ভাৰ্যা দান দিয়ে দুষ্কর কার্য করেছেন। তা ইন্দ্র, ব্ৰহ্মা, প্রজাপতি, সোম, যমও বৈশ্রবণাদি সবাই অনুমোদন করছেন।
৪২। আপনি যে ভাৰ্যা দান উত্তমদান দিয়েছেন, ইহাতে যম-শাসন অতিক্রম করে সুগতি লাভ করবেন।
মহাসত্ব দেবরাজের বাক্য শু’নে অত্যন্ত গ্ৰীত হয়ে পালঙ্কে উপবেশন করে বললেন- “আহা, আমার দান একান্তই সুদিন্ন হয়েছে।” এবলে নিজের দান বর্ণনা করছিলেন। তখন দেবরাজ আদিত্তরাজাকে বললেন- মহারাজ, আমি ব্ৰাহ্মণ নই। আমি দেবলোকের দেবরাজ। আমি আপনার পত্নী-দান সংক্রান্ত দানপারমী যাতে পূর্ণ হয়, সে উদ্দেশ্যেই এসেছি। এখন আমার দোষ ক্ষমা করুন। এ বলে দেবরাজ দানানুমোদন মানসে নিম্নোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–
৪৩। রাজন আমাকে আপনার প্রদত্ত দান আমি অনুমোদন করছি। প্ৰসন্নচিত্তে সর্বদা দান করুন।
৪৪ । দানের ন্যায় অন্য কোন জিনিস নেই। দানই একমাত্ৰ সুখাবহ। দানই সর্বদা পরলোকের প্রতিষ্ঠা হয়।
এরূপে দেবরাজ রাজার দানানুমোদন করে চিন্তা করলেন–“আমি রাণীকে আমার নিকট না রেখে রাজাকেই দিয়ে দেব।” অতঃপর শঙ্খাদেবীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নিুোক্ত গাথাত্রয় বললেন–
৪৭। “মহারাজ, রাণী শঙ্খাদেবীকে আপনার হস্তে প্ৰদান করছি। আপনারা পরস্পর পরস্পরের দ্বারা সুখী হউন। যেমন দুগ্ধ আর শঙ্খ একই বর্ণ সম্পন্ন, তেমন আপনিও দেবী সর্বদা সম মন সম্পন্ন। আপনার উভয়েই ক্ষত্ৰিয় গোত্র সভূত। মাতৃপিতৃকুল উভয় পক্ষে সুজাত। সুতরাং আপনারা উভয়েই সুখে বাস করুন।” ইহা শুনে মহাসত্ব দেবরাজকে বললেন–
৪৮-৫১ । দেবরাজ, আমি শ্রদ্ধার সহিত শঙ্খাদেবীকে দান করেছি। আমি তাকে আর গ্রহণ করবনা। আপনিই তাকে নিয়ে যান। সে আপনার সাথেই গমন করুক। এবং আপনার নিকটই বাস করুক। তথায় তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন এবং এক সাথেই অবস্থান করবেন। দেব, আমি যা দান করি, পুণরায় তা”ধান রত্ন ভোগ সম্পদ দিয়ে গ্ৰহণ করিনা এবং তজ্জন্য কোন সময় অনুতাপও করিনা।” ইহা শুনে দেবরাজ পুনঃ রাজহস্তে–
৫২। “রাজন, আপনাকে এ” নারী প্ৰদান করছি, শীঘ্রই গ্ৰহণ করুন। আমার প্রদত্ত নারী আপনার নিকটেই অবস্থান করুক।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব দেবরাজের অনুরোধে মহিষীকে পুনর্বার গ্রহণ করে বললেন-
৫৩। “দেব, আপনার প্রদত্ত দেবীকে আমি গ্ৰহণ করলাম এবং সর্বদা তাকে সুখে রক্ষা করব।” ইহা শুনে দেবরাজ জ্যোতির্ময় দিব্যদেহ ধারণ করে তরুণ সুর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে রাজাকে বললেন–
৫৪-৫৫। “রাজন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র, দেবলোক হতে আপনার নিকট এসেছি। আপনাকে আমি করজোড়ে নমস্কার করছি। রাজন, আপনি যে জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করেছেন, তা, অতি উত্তম প্রার্থনা। ভবিষ্যতে তা’ লাভ করে আপনি তথাগত বুদ্ধ হবেন।” অতঃপর দেবরাজ আদিত্ত রাজকে দশবিধ রাজধর্ম সম্বন্ধে এরূপ উপদেশ প্ৰদান করলেন–
৫৬-৫৮। “মহারাজ, সর্বদা মাতা-পিতার সেবা করুন স্ত্রীপুত্রের উপকার করুন, এবং মিত্ৰ-অমাত্যের প্রতি সর্বদা যথাধর্ম আচরণ করুন, ইহাতে স্বৰ্গে গমন করবেন।
৫৯-৬৫ । হে জনাধিপ, রথীর্ষভ জন্যেন্দ্র ক্ষত্রিয়, সর্বদা বল-বাহনের প্রতি, গ্রাম-নগরের প্রতি, রাজ্য-জনপদের প্রতি, শীলবান শ্রমণ-ব্ৰাক্ষণের প্রতি, সিংহ মৃগ হংসাদি পশু-পক্ষীর প্ৰতি যথাধর্ম আচরণ করুন। সর্বদা ধর্মাচরণ করে স্বৰ্গে গমন করুন ।
৬৬-৬৭। “রাজন, আপনি ধর্মাচরণ করুন। ধর্মচরণে সুখ উৎপন্ন হয়, ধর্মাচরণের ইহাই সন্দৃষ্টিক ফল। ধর্মাচরণকারীরা কখনো নরকে যায়না। সর্বদা ধর্মাচরণ দ্বারা ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ এবং অন্যান্য দেবগণও শ্রেষ্টতর স্বৰ্গ লাভ করে। রাজন, আপনি অপ্ৰমত্ত হউন। আপনি ধর্মাচরণ করুন, তবে নিশ্চয়ই স্বৰ্গে যাবেন।”
দেবরাজ মহাসত্বকে এরূপ উপদেশ দান করে স্বীয় বাসভবন দেবলোকেই প্ৰত্যাবর্তন করলেন। শাস্তা সেই বিষয় প্ৰকাশ করবার মানসে নিম্নোক্ত গাথা ভাষণ করলেন–
৬৮। “মঘব দেবরাজ সুজাম্পতি আদিত্ত রাজাকে এরূপ উপদেশ দিয়ে স্বৰ্গে প্ৰত্যাবর্তন করলেন।”
তখন হতে বোধিসত্ব অর্থীদের মহাদান দিয়ে স্বীয় মহিষী৷ শঙ্খাদেবীর সাথে যথাধর্মানুসারে রাজত্ব করছিলেন। তখন মহাসত্ব জনগণকে নানাবিধ বস্তুদান দিয়ে প্রতিদিন তাদেরকে নিম্নোক্ত উপদেশ প্রদান করতেন–
৬৯। “ভবৎগণ, আমি পূর্বজন্মে দান করেছিলাম। তাই এখন নানা বিষয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছি। তোমরাও সর্বদা অপ্ৰমত্ত হয়ে যথাশক্তি দান দাও।”
তখন হতে জনগণ মহাসত্বের উপদেশে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বোধিসত্ব রাজা আদিত্য শঙ্খাদেবী সহ সারাজীবন রাজৈশ্বর্য সুখ পরিভোগ করে দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদনান্তর পরিশেষে মৃত্যুর পর দেবলোকেই উৎপন্ন হলেন।”
শাস্তা অতঃপর এই জাতিক কাহিনী বর্ণনা করে বললেন–“ভিক্ষুগণ, ইহা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে- আমি পূর্বে বোধিসত্বাবস্থায় অর্থীকে দান করে কিছুতেই তৃপ্তি লাভ করিনি।” তৎপর শাস্তা নিম্নোক্ত পাঁচটি সমাপ্তি গাথা বললেন–
৭০-৭৪ । আমার শাসনে দিব্যচক্ষুলাভী অগ্র উপাধি প্রাপ্ত অনুরুদ্ধই ছিল তখনকার দেবরাজ, মহারাজ শুদ্ধোদন ও রাণী মহামায়া ছিলেন। বোধিসত্বের মাতা-পিতা, রাজার মনোবাসনা পূৰ্ণকারিণী রাজ-রাণী শঙ্খাদেবী এখন যশোধরা। সমস্ত অমাত্যবর্গ ও নগরবাসী জনগণ সবাই আমার শাসন পূর্ণকারী পরিষদ। আমি ছিলাম পুণ্যকামী আদিত্য রাজা। এখন আমি তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ। তোমরা গৌরব চিত্তে এই জাতক ধারণ কর ।
(আদিত্ত জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply