অরমাবিক্ষেপ বাদ
৬১। “ভিক্ষুগণ, এমনো কতিপয় অমরাবিক্ষেপী(১) শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ আছেন। যাহারা প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে চারিটী কারণে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্যবিক্ষেপ করিয়া থাকেন। সেই ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে চারি। কারণে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
৬২। “ভিক্ষুগণ, ইহলোকে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ ‘ইহা কুশল’ বলিয়া যথার্থরুপে জানেন না, ইহা ‘অকুশল’ বলিয়াও যথার্থরূপে জানেন না। তখন তাঁহার এইরূপ মনে হয়, আমিত ইহা ‘কুশল’ বলিয়া যথাভূত ভাবে জানি না, ইহা ‘অকুশল’ বলিয়াও যথাযথারূপে জানি না। আমি ইহা কুশল বা অকুশল বলিয়া সম্যকরূপে না জানিয়া যদি ইহা কুশল এবং ইহা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করি, তবে তাহা আমার মিথ্যা হইবে; যাহা আমার মিথ্যা হইবে, তাহা হইবে আমার বিঘাত (মনের অশান্তি); যাহা আমার অশান্তিকর তদ্বারা হইবে আমার স্বৰ্গমার্গের অন্তরায়। এই প্রকারে মিথ্যারি ভয়ে, মিথ্যাকথাকে। ঘৃণা করিয়া “ইহা কুশল’ এইরূপও প্রকাশ করেন না, “ইহা অকুশল’ এইরূপও প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে এরূপও আমি বলি না। (এইরূপ, ‘না’) ওরূপও আমি বলি না (ওরূপ, ‘না) অন্যথাও বলি না, নাও বলি না, না নাও বলি না। (এইরূপ উত্তর দিয়া) অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা প্রথম কারণ; কোনো কোনো অমরাবিক্ষেপী শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া জায়গায় জায়গায় জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপরদিপ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (১-১৩)
৬৩। “দ্বিতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হন এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ “ইহা কুশল” “ইহা অকুশল’ বলিয়া যথাযথারূপে জানেন না, তখন তাঁহার এইরূপ মনে হয়— “ইহা কুশল’, ‘ইহা অকুশল’ বলিয়াত আমি যথার্থরুপে জানি না। এইটি কুশল, এইটি অকুশল বলিয়া যথার্থভাবে না জানিয়া যদি এইটি কুশল আর এইটি অকুশল বলিয়া প্রচার করি, তবে উহাতে আমার ছন্দ বা রাগ অথবা দ্বেষ কিম্বা প্ৰতিঘ উৎপন্ন হইবে। যেখানে আমার ছন্দ বা রাগ অথবা দ্বেষ কিম্বা প্ৰতিঘ উৎপন্ন হইবে তাহা আমার উপাদানে(২) পরিণত হইবে। যাহা আমার উপাদান হইবে তদ্বারা হইবে আমার মনকষ্ট (বিঘাত); যাহা আমার অশান্তিকর তাহা আমার ধ্যানমার্গের অন্তরায়কর হইবে। এইরূপে উপাদান ভয়ে, উপাদান ঘৃণায় ইহা কুশল বা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে, ‘এইরূপও আমি বলি না, সেইরূপও আমি বলি না, অন্যথাও বলি না, না বলিয়াও বলি না, না নহে এমনো আমি বলি না’। এইরূপ উত্তর দিয়া অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা দ্বিতীয় কারণ; কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ যাহা অধিগত হইয়া এবং যাহা লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন, কুশলাকুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (২-১৪)
———–
১. অমরাবিকখেপিকা—আমরাবিক্ষেপী। মরে না বলিয়া অমর, স্ত্রী লিঙ্গে আমরা। গুড়চী, দুৰ্বাঘাসকেও আমরা বলে। গুড়চী যেমন মূলে বা উপমূলে প্রতিষ্ঠিত না হইয়া তরুশিখরে অনালম্বভাবে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়, তাদৃশ অপ্রতিষ্ঠবাক্যে বাক্য বিক্ষেপী
২. রাগ ও দ্বেষ উভয়ে সন্তপ্ত করিয়া নিজকে বিহনন করে বলিয়াই উপাদান এবং বিঘাত উক্ত হইয়াছে। ছন্দ ও রাগ উপাদান। দ্বেষ আর প্রতিঘ, বিঘাত, অথবা ছন্দ, রাগ, দ্বেষ, প্রতিঘ দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে বলিয়া উপাদান; বিহনন করে বলিয়া বিঘাত বলা ইহয়াছে।
———–
৬৪। “তৃতীয় শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হন, এবং কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ ইহা কুশল বা ইহা অকুশল তাহা যথাভূতভাবে জানেন না। (তখন) তাঁহার এইরূপ মনে হয়— “আমি ইহা কুশল। কিনা বা ইহা অকুশল। কিনা যথার্থরুপে জানি না। ইহা কুশল বা অকুশল তাহা সম্যকরূপে না জানিয়া যদি ইহা কুশল বলিয়া প্রকাশ করি বা ইহা অকুশল বলিয়া প্রকাশ করি, তাহা হইলে এমন অনেক পরশাস্ত্রবিদ্(১) নিপুণ, তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পনড়ব পণ্ডিত শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন, যাঁহারা স্বীয় প্রজ্ঞাবলে কেশগ্রবিদ্ধকারী(২) ধনুর্ধরের ন্যায়। পরবাদ বিমৰ্দন করিয়া বিচরণশীল। তাহারা যদি এ বিষয়ে আমার মত জিজ্ঞাসা করেন(৩), মতবাদের হেতু(৪) জিজ্ঞাসা করেন, আমার মতকে অবজ্ঞা করিয়া অনুশাসন করেন। আমিত সুন্দরীরূপে উত্তর প্রদান করিতে পারিব না। যদি না পারি তাহা হইবে আমার মনকষ্ট (মনের অশান্তি), যাহা আমার অশান্তিকর তাহা আমার স্বৰ্গমার্গের অন্তরায়কর হইবে। এই প্রকারে তিনি অনুযোগ ভয়ে অনুযোগকে ঘৃণা করিয়া ইহা কুশল বলিয়াও প্রকাশ করেন না, ইহা অকুশল বলিয়াও প্রকাশ করেন না। কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে, “এইরূপও আমি বলি না, সেইরূপও বলি না, অন্যথাও বলি না, না বলিয়াও বলি না, না। নহে এমনো বলি না”। এইরূপ উত্তর দিয়া অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। ভিক্ষুগণ, ইহা তৃতীয় কারণ; যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (৪-১৫)
৬৫। “চতুর্থ শ্রেণীর ভদন্ত শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ কী বিশেষাধিগমে, কী লক্ষ্য করিয়া অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন এবং কুশলাকুশলাদি বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন?”
“ভিক্ষুগণ, এই সংসারে কোনো শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ মন্দবুদ্ধি (নির্বোধ) হইয়া থাকেন। তিনি জড়তা এবং মুর্খতা প্রযুক্ত কোনো বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। পরলোক আছে? ইহা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা পরলোক আছে, ইহা যদি আমার ধারণা হইত। তবে পরলোক আছে, ইহা তোমায় বলিতাম; কিন্তু এরূপ ধারণাও আমার নাই। ‘নাই, এরূপও আমার ধারণা নাই। এরূপ ধারণাও নাই, সেরূপ ধারণাও নাই, অন্যথাও নাই, না কিম্বা হ্যা। ইহাও নহে। পরলোক নাই? ইহা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা . . . (পূর্ববৎ)। আছে ও নাই পরলোক? না আছে, না নাই পরলোক? (উপপাতিক) সত্ত্ব আছে? উপপাতিক(৫) সত্ত্ব নাই? আছে এবং নাই উপপাতিক সত্ত্ব? না আছে, না নাই উপপাতিক সত্ত্ব? সুকৃত্য-দুষ্কৃত কর্মের ফল আছে? সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল নাই? আছে এবং নাই সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল? না আছে, না নাই সুকৃত- দুষ্কৃত কর্মের ফল? সত্ত্ব (তথাগত) মৃত্যুর পর উৎপনড়ব হয়? (বিদ্যমান থাকে?) মৃত্যুর পর সত্ত্ব উৎপন্ন হয় না? (সত্ত্বের অস্তিত্ব থাকে না?) মৃত্যুর পর কাহারও উৎপত্তি হয়, কাহারও উৎপত্তি হয় না? (অস্তিত্ব থাকে এবং থাকে না?) মৃত্যুর পর না হয়, না হয় না? যদি আমাকে ইহা জিজ্ঞাসা কর, ‘মৃত্যুর পর সত্ত্ব না হয়, না হয় না। যদি এইরূপই আমার মনের ধারণা হইত, তাহা হইলে আমি তোমাকে বলিতাম মৃত্যুর পর সত্ত্ব না হয়, না হয় না। কিন্তু এইরূপ ধারণাও নাই, (এরূপও ‘না’) সেরূপও ‘না’, অন্যথাও ‘না,’ ‘না নহে’ এমনো নহে। ভিক্ষুগণ, ইহা চতুর্থ কারণ; যাহা অধিগত হইয়া, যাহা লক্ষ্য করিয়া কোনো কোনো শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণ অমরাবিক্ষেপী হইয়া থাকেন, স্থানে স্থানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” (৪-১৬)
৬৬। “ভিক্ষুগণ, অমরাবিক্ষেপী শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণগণ এই চারি কারণেই স্থানে স্থানে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে অমরাবিক্ষেপ তুল্য বাক্য বিক্ষেপ করিয়া থাকেন। শ্রমণ-ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে যাহারা অমরাবিক্ষেপী কুশলাকুশলাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে অমরাবিক্ষেপবৎ বাক্য বিক্ষেপ করেন, তাহারা সকলেই এই চারি কারণে বা ইহাদের যে কোনটি দ্বারা করেন। ইহা ছাড়া অন্য কোনো কারণ নাই। . . . যে সমুদয় দ্বারা প্রশংসা করিলে তথাগতের প্রকৃত প্রশংসা করা হইবে।”
———
১. কতপরপ্লবাদা—পরশাস্ত্ৰবিদ।
২. বাল বেধিরূপা—বালবোধীরূপে (যাহারা দূর হইতেও লক্ষ্য করিয়া কেশগ্রবেধ করিতে সমৰ্থ) ধনুর্ধর সদৃশ। বোভিন্দন্তামঞঞে—বালবোধীতুল্য পরের অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিগতসমূহও স্বীয় প্রজ্ঞায় বেধ (খণ্ডন) করিতে সমর্থ।
৩. সমনুযুঞজ্যে—কুশল কী, অকুশল কী? এইরূপে আমার মত জিজ্ঞাসা করিলে।
৪. সমনুগাহেয্যুং–কুশল বা অকুশল বলিয়া উত্তর দিলে কোন কারণে কুশল বা অকুশল বলিলাম তাহার হেতু জিজ্ঞাসা করিলে। সমনুভাসেয্যুং—আমি কারণ প্রদর্শন করিলে, আমার কথিত কারণের দোষ দেখাইয়া যদি বলেন যে তুমি ইহা জান না; ইহা ত্যাগ কর, উহাই গ্রহণ কর বলিয়া আমাকে অনুশাসন করিলে।
৫. ওপপাতিকা—ঔপপাদুক। উৎপত্তিক্ষণে অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদিসহ পূর্ণাবয়বে উৎপন্ন সত্ত্ব। যেমন—দেবতা, ব্ৰহ্মা, কোন কোন মনুষ্য প্রেত ও নারকী সত্ত্ব।
Leave a Reply