মধ্যম শীল
১১। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদত্ত(১) ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন মূলবীজ, স্কন্ধ-বীজ, পর্ব-বীজ, অগ্র-বীজ, বীজ-বীজভেদে পঞ্চ-বীজ(২) অথবা এতাদৃশ অন্য বীজ ও তদুর্ভূত উদ্ভিদসমূহ ছেদন-ভেদন-দগ্ধী করণাদি বিনষ্টমূলক কার্যে নিয়োজিত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্রমণ গৌতম ঈদৃশ বীজ ও উদ্ভিদসমূহ ছেদন-ভেদন দন্ধী করণাদি বিনষ্টমূলক কার্য হইতে সম্পূর্ণ বিরত। হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্ৰশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১. শ্রদ্ধা—বিশ্বাস। কর্ম, কর্মফল, ইহলোক, পরলোক বিশ্বাস করিয়া যে দান দেওয়া হয়। তাহা শ্ৰদ্ধাদত্ত। ভোজনাদি—আহার্যসমূহ। এতদ্বারা বস্ত্ৰ, শয্যাসন ও রোগোপশমের ভৈষজ্যসম্ভার ইত্যাদিকেও বুঝিতে হইবে।
২. পঞ্চবিধ বীজ অপরিপক্কাবস্থায় বৃক্ষে সংলগ্ন থাকিলে উদ্ভিদরাপে গণ্য, তাহা নষ্ট করিলে ভিক্ষুদের “পাচিত্তিয় অপরাধ হয়। পরিপক্কাবস্থায় বিচু্যতাবস্থায় বীজরাপে গণ্য, তাহা নষ্ট করিলে “দুঙ্কট’ অপরাধ হয়।
—————
১২। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদে ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, শয্যা, গন্ধদ্রব্য ও আমিষ (ডাল চাউলাদি) সন্নিধি, ইত্যাদি বা এইরূপ অন্য বিবিধ দ্রব্য সন্নিধি করিয়া পরিভোগে রত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন সন্নিধি করিয়া পরিভোগ হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্ৰশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৩। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি উপভোগ করিয়া তাঁহারা যেমন নৃত্য, গীত বাদ্য, নটসমজ্যা (নাট্যাভিনয়) আখ্যান করতাল, বেতাল, (ঘনতল বা মন্ত্রদ্বারা শবে জীবন দান), কুম্ভতাল, নরনারীর কমনীয় চিত্র, লৌহগোলক ক্রীড়া, বংশ (বাঁশের) ক্রীড়া, ধোবন (মৃতব্যক্তির অস্থি ধৌত করিয়া সুরা পানক্রীড়া), হস্তী-যুদ্ধ, অশ্ব-যুদ্ধ, মহিষ, যুদ্ধ, মল্ল-যুদ্ধ, সংগ্রাম, সৈন্য-গণনা, সৈন্য-ব্যূহ, অলীক দর্শনাদি অথবা এইরূপ অন্য বিসূক দর্শনরত হইয়া বাস করেন; কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন বিসূক দর্শনে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৪। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া ঈদৃশ প্রমাদকর জুতা (জুয়া) ক্ৰীড়ারত হইয়া বাস করেন, যথা : আট পদ, দশ পদ (কড়িদ্বারা পাশা ক্রীড়া), আকাশ (আকাশে উক্ত রূপ ক্রীড়া), পরিহার পথ (ভূমিতে নানা মহল করিয়া তথায় ঘুরিয়া ফিরিয়া ক্রীড়া, পরখেলা), সন্তকিং (একত্রে-স্থিত গুলি বা প্রস্তর খণ্ড হইতে অন্যগুলি না নড়ে মত এক একটি গ্রহণ, নড়িলে পরাজয়), খলিক (হাড়দণ্ডের দ্বারা পাশা খেলা), ঘটিক (দণ্ড গোলা বা ভার খেলা), শলাকহস্ত (লাক্ষা বা পিঠলিজলে হাত ভিজাইয়া দেওয়ালে অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি রূপ নির্মাণ ক্রীড়া), অক্ষা (গুলি খেলা), পঙ্গচীর (পাতার সানাই বাজাইয়া ক্রীড়া), বঙ্কক (গ্ৰাম্য ছেলেদের ন্যায় নাঙ্গলে কর্ষণ ক্রীড়া), মোক্ষটাক (দণ্ডের উপর আকাশে ঘুরা ফেরা বা পা উপরদিকে মাথা নীচের দিকে করিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া ক্রীড়া), চিঙ্গুলিক (নানা প্রকার ফরফরী ঘুরােন), পত্রাড়ক (পাতার সেৱী আড়ি তৈয়ার করিয়া ধূলা বালি মাপা ক্রীড়া), রথক (ক্ষুদ্র রথাদির দ্বারা ক্রীড়া), ধনুক (ক্ষুদ্র ধনুরদ্বারা ক্রীড়া), আক্ষরিক (আকাশে বা পৃষ্ঠে লিখিত অক্ষর বোধ ক্রীড়া), মানসিক (মনের চিন্তিত বিষয় প্রকাশ ক্রীড়া), যথাবিদ্য (আঁধা, কানা, কুজাদির ছল ধরিয়া কৌতুক প্রদর্শন করা) ইত্যাদি বা এই রূপ অন্যবিধ ক্রীড়া। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম তেমন প্ৰমাদ জনক জুতা (জুয়া) ক্রীড়া হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৫। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদাত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা ব্যবহার করিয়া বাস করেন, যথা : আসন্দী (প্রমাণাতিক্রান্ত সুখাসন) পৰ্যাঙ্ক, দীর্ঘলোম গালিচা, বিচিত্র ঊর্ণাময় আস্তরণ, ঊর্ণময় শ্বেত-আস্তরণ, ঘনপুষ্পযুক্ত ঊর্ণাময় আসন, তুলাপূর্ণ আসন, সিংহ ব্যাঘাদির রূপ চিত্রিত উর্ণাময় আসন, উভয় দিকে ঝালারযুক্ত উর্ণাময় আসন, একদিকে ঝালারযুক্ত উর্ণাময় আসন, রত্নখচিত রেশমী আসন, রত্নখচিত রেশমী সূতায় সেলাই করা আসন, অতি বৃহৎ ঊর্ণাময় আস্তরণ, অজিন মৃগচর্ম দ্বারা মঞ্চ বা ঘাটের সমান করিয়া সেলাই করা আস্তরণ, অজিন মৃগচর্ম দ্বারা মঞ্চ বা খাটের সমান করিয়া সেলাই করা আস্তরণ, মস্তক ও পায়েরদিকে রক্তবর্ণ উপাধান ইত্যাদি, অথবা এইরূপ অন্যবিধ উচ্চশয্যা মহাশয্যা। কিন্তু শ্রমণ গৌতম তেমন উচ্চশয্যা মহাশয্যা ব্যবহারে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৬। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত ভোজনাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ মণ্ডণ বিভূষণকর দ্রব্যাদি ব্যবহার করিয়া থাকেন, যথা : উচ্ছাদন, পরিমর্দন, (শরীর সুগঠনের জন্য তৈলাদির দ্বারা শরীর মর্দন), সুস্থান (সুগন্ধি তৈল ও সাবানে সুস্থান), সম্বাহন (মল্লবৎ), আদর্শ অঞ্জন, মালা, (চন্দনাদি) বিলেপন, মুখচুর্ণ, মুখালেপি, হস্তাভরণ, শিখাবর্ধন, ছড়িধারণ, স্ত্রী-পুরুষের ছবি অঙ্কিত বোতল (নালি), অসি, বিচিত্রছাত্র, বিচিত্র জুতা, খড়ম, পাগড়ী, মণি, চামর, শ্বেতবস্ত্র, দীর্ঘ ঝালরযুক্ত বস্ত্র, ইত্যাদি অথবা এই প্রকার স্বতন্ত্র মণ্ডণ বিভূষণ বিষয়ক দ্রব্যসম্ভার। কিন্তু শ্রমণ গৌতম ঈদৃশ মণ্ডণ বিভূষণকর দ্রব্যানুরক্তি হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃথগজন এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৭। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অনড়ববস্ত্রাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ স্বর্গমোক্ষ মার্গের তিরশ্চান কথায় নিরত হইয়া বাস করেন, যথা : রাজ-কথা, চোর-কথা, মহামাত্য-কথা, সেনা-কথা, ভয়-কথা, যুদ্ধ-কথা, অনড়ব-কথা, পানীয়-কথা, বস্ত্র-কথা, শয্যা-কথা, মালা- কথা, গন্ধদ্রব্য-কথা, জ্ঞাতি-কথা, যান-কথা, গ্রাম-কথা, নিগম-কথা, নগর-কথা, জনপদ-কথা, স্ত্রী-পুরুষ-কথা, শূর-কথা, রথপত্তি (বিশিখা)-কথা, জল ঘাট বা জল আহরণকারিণী-কথা, পূর্বপ্ৰেত-কথা, নানাবিধ নিরর্থক-কথা, লোকাখ্যায়িকা, সমুদ্রখ্যায়িকা, বৃদ্ধি-হানি-কথা ইত্যাদি বা ঈদৃশ অন্যপ্রকার তিরশ্চন কথা। কিন্তু শ্রমণ গৌতম। এইরূপ তিরশ্চন কথা হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যগতের প্ৰশংসা করিবে।”
১৮। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্ৰাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অন্নবস্ত্ৰাদি পরিভোগ করিয়া এইরূপ বিগ্রাহিক (বিবাদকর।) কথায় লিপ্ত হইয়া বাস করেন, যথা : তুমি এই ধর্ম-বিনয় জান না, আমি এই ধর্মবিনয় জানি, তুমি এই ধর্মবিনয় কি জানিবে? তুমি মিথ্যাপথাবলম্বী, আমি সম্যক পথাবলম্বী, আমার বাক্য শ্লিষ্ট, তোমার বাক্য অশ্লিষ্ট, পূর্বের বক্তব্য পরে বলিয়াছ, পরের বক্তব্য পূর্বে বলিয়াছ, তোমার বহুদিনের সুঅভ্যস্ত বিষয় আমি এককথায় উল্টাইয়া দিলাম, তুমি কিছু জান না, আমি তোমার প্রতিবাদারোপন করিলাম। তুমি নিগৃহীত, দোষ মোচনার্থ বিচরণ কর, যদি পার দোষ খণ্ডন কর, ইত্যাদি অথবা এইরূপ অন্যপ্রকার বিগ্রাহিক কথা। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম। এইরূপ বিগ্রাহিক কথায় সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
১৯। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ পরের শ্রদ্ধাপ্রদত্ত অনড়ববস্ত্রাদি পরিভোগ করিয়া রাজাদের, রাজ মহামাত্যদের, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, কুমারদের—‘এখানে আস, ওখানে যাও, ইহা নিয়া যাও, অমুক স্থান হইতে অমুক দ্রব্য নিয়া আস’ ইত্যাদি বা এইরূপ অন্যবিধ ছোট বড় দৌত্যকার্যে নিযুক্ত হইয়া বাস করেন। কিন্তু শ্ৰমণ গৌতম এতাদৃশ ছােট বড় দৌত্যকাৰ্য হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, পৃথগজন প্রশংসা করিলে এইরূপ বলিয়াও তথ্যাগতের প্রশংসা করিবো।”
২০। “কোনো কোনো ভদন্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ অপরের শ্রদ্ধাদত্ত অনড়বাদি উপভোগ করিয়া কুহকী(১) লপক (লপকী)(২) নৈমিত্তিক(৩) নিষ্পেষিক(৪) এবং লাভে লাভ অন্বেষণকারী ইত্যাদি হইয়া থাকেন; কিন্তু শ্রমণ গৌতম এইরূপ কুহনালপন হইতে সম্পূর্ণ বিরত, হে ভিক্ষুগণ, প্রশংসা করিলে পৃগজন এই বলিয়াও তথাগতের প্রশংসা করিবে।”
[মধ্যম শীল সমাপ্ত]
১। কুহকা—কুহকিন। অর্থলোভে ও সম্মান প্রাপ্তির জন্য অধার্মিক হইয়াও ধার্মিকতা প্রদর্শন। স্বয়ং শীলবান ধ্যানপরায়ণ, মার্গফল লাভী না হইয়াও শীলবান, ধ্যানপরায়ণ ও মার্গফল লাভীর ভাণ করিয়া লোককে প্রতারণাকরী।
২। লপক—লাভ সৎকারার্থে ভাষণশীল। নিজকে বা দায়ককে উচ্চভাবে প্রশংসা করা যেন কিছু দান করে।
৩। নিমিত্ত দ্বারা বলে বা ঈঙ্গিত-ঈশারায় জানায় বলিয়া নৈমিত্তিক। শ্রদ্ধাদির বিষয় জানাইয়া দেওয়াও বটে।
৪। নিষ্পেষিক—কিছু আদায় করিতে নিপীড়নকারী।
Leave a Reply