সূত্রপিটকে দীর্ঘ নিকায় (প্রম খণ্ড) – শীলস্কন্ধ বর্গ
১. ব্রহ্মজাল সূত্র (১। ১)
১.১ পরিব্রাজক কথা
০১.০১ ব্রহ্মজাল সূত্র (১। ১) – পরিব্রাজক কথা
১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি১– একসময়২ ভগবান৩ মহানুভাব পঞ্চশত সংখ্যক ভিক্ষুসংঘ সমভিব্যাহারে রাজগৃহ৪ ও নালন্দার৫ অন্তর্বর্তী দীর্ঘ পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তখন সুপ্রিয়৬ পরিব্রাজকও তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্তের সহিত সেই রাস্তা দিয়া যাইতেছিল। তত্র সুপ্রিয় পরিব্রাজক অনেক প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছিল; কিন্তু তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বহুপ্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের গুণ সম্বন্ধে প্রশংসাবাদ করিতেছিল। এইরূপে আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে পরস্পর সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘের পশ্চাদানুবর্তী হইল।
১. সমগ্র বচনের উদ্দেশ্য–সূত্র নিহিত উপদেশসমূহকে ভগবদুক্তি রূপে নির্দেশ করা ও সূত্রের প্রামাণ্য বিষয়ে শ্রদ্ধা উৎপাদন করা। স্থবির আনন্দ স্বয়ং সূত্রের অকর্তা, তিনি ভগবানের মুখেই ইহা শুনিয়াছেন। (সু. বি.)
২. ইহা সূত্রের প্রস্তাবনা মাত্র। যখন ভগবানের হৃদয় করুণায় পরিপূর্ণ তখন সূত্রোক্ত উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে। (সু. বি.)
৩. ভগবান অর্থে গুরু, সর্বগুণ-বৈশিষ্টে যিনি সর্বসত্ত্বের গুরু, সর্বোত্তম গৌরব যুক্ত গুরু। ইহার বিশদ বর্ণনা মদানূদিত মহাপরিনিব্বান সূত্রের পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
৪. রাজগৃহ–মগধের পূর্ব রাজধানী, ইহার বর্তমান নাম রাজগির।
৫. নালন্দ–জিলা বড়গাঁও। বক্তিয়ারপুর রেলওয়ে স্টেশন হইতে মাত্র ২৪ মাইল ব্যবধান। ইহা অগ্রশ্রাবক শারিপুত্রের জন্ম ও পরিনির্বান প্রাপ্তির স্থান।
৬. সুপ্রিয় রাজগৃহের বিখ্যাত সঞ্জয় পরিব্রাজকের প্রধান শিষ্য। ধর্মসেনাপতি সারিপুত্র ও মহামোদ্গল্যায়ন প্রমে এই প্রখ্যাত নাম সঞ্জয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। বুদ্ধের উৎপত্তি হইলে সারিপুত্র অশ্বজিৎ স্থবিরের নিকট অমৃতের সন্ধান পাইয়া সঞ্জয়ের শিষ্য পরিষদ হইতে বহু সতীর্থের সহিত বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বুদ্ধোৎপত্তিতে তৈর্থিকগণের লাভ সৎকার পরিহীন হইয়াছিল। এই জন্যই পরিব্রাজকগণ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি ক্রোধাম্বিত হইয়াছিলেন। (সু.বি।)
———————
২। অতঃপর ভগবান (দিবাবসান দেখিয়া) একরাত্র যাপনের জন্য সসংঘ অম্বলট্ঠিকা১ নামক রাজার বাগানবাটীতে উপস্থিত হইলেন। সুপ্রিয় পরিব্রাজকও তাহার অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্তের সহিত তথায় রাত্রি যাপনার্থ প্রবিষ্ট হইল। সেখানেও সুপ্রিয় পরিব্রাজক নানা প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দা করিতে থাকে, কিন্তু অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বহুপ্রকারে ত্রিরতেড়বর গুণ সম্বন্ধীয় প্রশংসা করিতে থাকে। এইরূপে আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া রাত্রি যাপন করিতে লাগিল।
১. অম্বলট্ঠিকা–রাজার এক উদ্যান। এই উদ্যান দ্বারে আম্রতরু থাকায় ইহা অম্ব বা আম্রলট্ঠিকা নামে অভিহিত হয়। (২সু. বি.)
———————
৩। অতঃপর রাত্রির প্রত্যুষ সময় শয্যা হইতে উত্থিত বহু ভিক্ষু মণ্ডলমালে (বৈঠক খানায়) উপবেশন করিয়া এইরূপ কথাধর্ম আলোচনা করিতে লাগলেন− “বন্ধুগণ, বড়ই আশ্চর্য২ এবং অদ্ভূত যে সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ কর্তৃক সত্ত্বগণের আশয়-অনুশয় পর্যন্ত সুপরিজ্ঞাত। এই সুপ্রিয় পরিব্রাজক বহু প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছে; আর তাহারই অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রসংশাবাদ করিতেছে। এইরূপে ইহারা আচার্য ও অন্তেবাসী উভয়ে পরস্পর সোজা বিরুদ্ধবাদী হইয়া সসংঘ ভগবানের পশ্চাদানুবর্তী হইয়াছে।”
২. অন্ধের পর্বতারোহণের ন্যায় নিত্য ঘটেনা বলিয়া আশ্চর্য অথবা করতালি দেওয়ার উপযুক্ত বলিয়া আশ্চর্য। (সু. বি.)
———————
৪। অতঃপর ভগবান ভিক্ষুগণের আলোচ্যমান কথাধর্ম জ্ঞাত হইয়া৩ মণ্ডলমালে সমুপস্থিত হইলেন এবং নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করিয়া ভিক্ষুগণকে আহ্বান করিলেন—
“হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে কি কথা উত্থাপন করিয়া বসিয়া আছ? আমার আগমনে কর্মস্থান মনস্কার, উদ্দেশ ও পরিপৃচ্ছাদির মধ্যে তোমাদের কোন কথা সমাপ্ত হইল না? (কোন কথা বাধা প্রাপ্ত হইল?)”
এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে এইরূপ নিবেদন করিলেন :
“ভন্তে, রাত্রির প্রত্যুষসময় শয্যা হইতে উত্থিত হইয়া এই মণ্ডলমালে উপবেশন করিলে আমাদের মধ্যে এই ধর্মকথা উত্থিত হয়্ত‘বন্ধুগণ, বড়ই আশ্চর্য এবং অদ্ভূত যে সর্বদর্শী ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাণীগণের আশয়- অনুশয় পর্যন্ত সুপরিজ্ঞাত। এই সুপ্রিয় পরিব্রাজক বহু প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের নিন্দাবাদ করিতেছে, কিন্তু তাহারই অন্তেবাসী যুবক ব্রহ্মদত্ত অনেক প্রকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রশংসাবাদ করিতেছে। এইরূপে ইহারা আচার্য ও অন্তেবাসী ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত হইয়াও উভয়ে পরস্পর প্রত্যক্ষভাবে বিরুদ্ধবাদী হইয়া সসংঘ ভগবানের পশ্চাদানুবর্তী হইয়াছে।’—ভন্তে, এই আমাদের সর্বদর্শী ভগবানের সর্বজ্ঞতাজ্ঞানকথার আলোচনা হইতেছিল। অতঃপর ভগবান সমাগত। (অনুকম্পাপূর্বক এতৎ সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করুন।)”
৩. ভগবান কোন বিষয় মাংসচক্ষে কোন বিষয় দিব্যচক্ষে দেখিয়া বা দিব্য শ্রোত্রে শুনিয়া অবগত হন। এস্থলে সর্বজ্ঞতা জ্ঞানেই অবগত হইলেন। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
———————
৫। “ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের নিন্দাবাদ করিলে তাহাদের প্রতি তোমরা আঘাত (কোপ), অপ্রত্যয় (দৌর্মনস্য) এবং চিত্তের অপ্রসাদ উৎপাদন করিও না।”১
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের নিন্দাবাদ করিলে তাহাদের প্রতি যদি তোমরা কুপিত বা অসন্তুষ্ট হও তবে তদ্দ্বারা তোমাদেরই (ধ্যানাদির) অন্তরায় হইবে।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের অপবাদ করিলে যদি তোমরা কুপিত বা অসন্তুষ্ট হও, তবে পরের উক্তি সুভাষিত বা দুর্ভাষিত তাহা বুঝিতে পারিবে কি?”
“না, ভন্তে, (বুঝিতে পারিব না)।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের অথবা সংঘের অপবাদ করিলে তত্র অসত্যের অসত্যতা তোমরা এই বলিয়া প্রতিপনড়ব করিব্তেএই কারণে ইহা অসত্য, এই কারণেও ইহা মিথ্যা, আমাদিগের মধ্যে ইহার অস্তিত্ব নাই, আমাদিগের মধ্যে ইহা অবিদ্যমান।”২
১. নিন্দা এবং প্রশংসা লক্ষ্য করিয়াই ভগবান দেশনা আরম্ভ করিয়াছেন। সেই পঞ্চ শত ভিক্ষু মহানুভাব সম্পনড়ব বলিয়া নিন্দা শ্রবণে তাঁহাদের চিত্তে আঘাতাদি উৎপনড়ব হয় নাই। ভবিষ্যতেও এতদাবস্থায় কুলপুত্রদের অকুশলোৎপত্তি নিবারণ কল্পে বুদ্ধ ধর্ম-নীতি স্থাপন করিলেন। (সু. বি.)
২. যদি কেহ বলে যে, তোমাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ নহেন, ধর্মও সুব্যাখ্যাত নয়, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব নহেন তখন নীরব থাকা অনুচিত। ক্রুদ্ধ না হইয়া ইহার অসত্যতা প্রমাণিত করা আবশ্যক্ত‘আমাদের শাস্তা এই সমুদয় কারণে সর্বজ্ঞ, ধর্মও এই সমুদয় কারণে সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।’ তুমি বা তোমার আচার্য দুঃশীল, তোমাদিগ কর্তৃক অমুক দুষ্কার্য কৃত হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা দোষারোপ করিলে নীরবতায় আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। তদ্ধেতু ক্রুদ্ধ না হইয়া অপবাদ নিরাকৃত করা কর্তব্য। ‘তুমি গরু, গাধা’ ঈদৃশ উক্তিতে কেহ আক্রোশ করিলে তাহার প্রতি উপেক্ষাভাব আনয়নে ক্ষান্তি প্রদর্শন করা উচিত। (সু. বি.)
———————
৬। “ভিক্ষুগণ, অপরে আমার অথবা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে সেজন্য তোমরা আনন্দ, সৌমনস্য, চিত্তের উৎফুল্লতা (ঔদ্ধত্যবহপ্রীতি) উৎপাদন করিও না।”১
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে ইহাতে যদি তোমরা আনন্দিত, সুমন, উৎফুল্ল (প্রীতিবন্যায় প্রবাহিত) হও তদ্দ্বারা তোমাদেরই (চিত্তচঞ্চল্যহেতু ধ্যানাদির) অন্তরায় হইবে।”
“ভিক্ষুগণ, অপরে আমার বা ধর্মের কিম্বা সংঘের প্রশংসাবাদ করিলে তত্র সত্যের সত্যতা এই বলিয়া স্বীকার করিব্তেএই কারণে এইরূপ হইয়াছে এবং এই কারণেও ইহা সত্য, আমাদিগের মধ্যে ইহার অস্তিত্ব আছে, আমাদিগের মধ্যে ইহা বিদ্যমান।”২
১. এইরূপ কেন উক্ত হইল? অন্যত্র উক্ত হইয়াছ্তে“বুদ্ধোতি কিত্তযন্তস্স কাযে ভবতি যা পীতি, বরমেবাহি সা পীতি কসিনেনাপি জম্বুদীপস্স” অর্থাৎ বুদ্ধ এইশব্দ কীর্তনকারী সাধু সজ্জনের শরীরে যে প্রীতি সঞ্জাত হয় উহা জম্বুদীপ প্রমাণ কৃৎসড়ব পরিকর্মাদিতে উৎপনড়ব প্রীতি অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। ‘যাহারা বুদ্ধের প্রতি প্রসনড়ব তাহারা অগ্রে প্রসনড়ব’ ইত্যাদি রূপে যে প্রীতি সৌমনস্যকে প্রশংসা করা হইয়াছে, তাহা নৈষঙঊম্যযুক্ত। এস্থলে আমারই বুদ্ধ, আমারই ধর্ম, আমারই সঙ্ঘ এইরূপ মমত্ব উৎপাদন করিয়া আয়ুষ্মান ছনড়বভিক্ষুর ন্যায় উৎপনড়ব গৃহাশ্রিত প্রীতি সৌমনস্যকে লক্ষ্য করা হইয়াছে। এইরূপ প্রীতি সৌমনস্য ধ্যানাদি লাভের অন্তরায়কর। (সু. বি.)
২. যদি কেহ বলে য্তে“আপনাদের শাস্তা সর্বজ্ঞ, অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ; ধর্মও সুব্যাখ্যাত, সঙ্ঘও সুপ্রতিপনড়ব।” তখনও নীরব থাকা অকর্তব্য। উহার সত্যতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
Leave a Reply