নারায়ণ, নর, নরোত্তম, দেবী এবং সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
ব্যাস বলিলেন,–যাঁহার আজ্ঞায় ব্রহ্মা জগৎসৃষ্টা, হরি জগৎপালক এবং কালরুদ্র জগতের সংহর্ত্তা, সেই দেব পিনাকপাণিকে নমস্কার করিয়া করি। নৈমিষারণ্য অতি পূণ্য স্থান; উহা সমস্ত ক্ষেত্র অপেক্ষা উত্তম ক্ষেত্র এবং সমুদায় তীর্থ অপেক্ষা উত্তম তীর্থ। শৌনকাদি কর্মনিষ্ঠ যাজ্ঞিক তপস্বীগণ ঐ নৈমিষারণ্যে দীর্ঘ যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছিলেন। তাহাদিগের দর্শন-বাসনায় একদা রামশিষ্য মহাতেজ মহাবুদ্ধি লোমশ মুনি সেই স্থানে আগমন করেন। দীর্ঘ যজ্ঞে ব্রতী মুনিগণ তাঁহাকে তথায় সমাগত দেখিয়া সকলেই যুগপৎ সমুৎসুক-চিত্তে হস্তে অর্ঘ্য লইয়া উত্থিত হইলেন। মহাভাগ নিষ্পাপ মুনিগণ পাদ্য এবং অর্ঘ্য দানে তাঁহার সৎকার করিয়া তৎসমীপে সুবিস্তৃত শিবধর্ম্ম জিজ্ঞাসা করিলেন। ১-৫।
ঋষিগণ কহিলেন,–হে মহাপ্রজ্ঞা! দেবদেব শূলপাণির ধ্যাণ এবং অর্চ্চনপ্রণালীসহ তদীয় মাহাত্ম্য-বার্ত্তা ব্যক্ত করুন। তাঁহার অঙ্গের মার্জ্জনে, রঙ্গাদি-যোগে উপলেপনে, তাঁহাকে দর্পন, চামর, চন্দ্রাতপ, ধারাগৃহ বা দীপদানে এবং তাঁহার অর্চ্চনায় কি কি ফল বা কি কি রূপ পূণ্য পুঞ্জ হইয়া থাকে, এ সকল আপনি আমাদের নিকট বলুন। শিবের সম্মুখে ইতিহাস, পুরাণ, বা বেদপাঠ করিলে অথবা করাইলে নরগণ কীদৃশ ফল প্রাপ্ত হয়, তাহাও আপনি সবিস্তর প্রকাশ করুন। হে মুনে! এ জগতে আপনা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শিবাখ্যান-তৎপর অন্য কেহই নাই। ভাবিতাত্মা মুনিগণের এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া সেই ব্যাস-শিষ্য উত্তম শিবমাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। লোমশ কহিলেন,–অষ্টাদশ পুরাণে শিবকেই পরম পুরুষ বলিয়া কীর্ত্তন করা হয়। অতএব সম্পূর্ণ শিবমাহাত্ম্য বলিবার শক্তি কাহারও নাই। যাহারা, “শিব” এই দ্ব্যক্ষর নাম কীর্ত্তন করে, তাহাদের স্বর্গ এবং মোক্ষ নিশ্চয়ই হইয়া থাকে। উদার-প্রকৃতি মহাদেব দেবগণের অধিপতি। এ জগতের সর্ব্ব বস্তুই তিনি দিয়াছেন; তাই তিনি ‘সর্ব্ব’নামে নিরূপিত। যাহারা সর্ব্বদা শিবের সেবা করে, তাহারাই ধন্য এবং তাহারাই মহাত্মা। সদাশিবের সেবা ব্যতীত যে নর সংসার হইতে উদ্ধার পাইবার চেষ্টা করে, সে নিশ্চয়ই মূঢ়, মহাপাপী ও শিবদ্বেষী। যিনি বিষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন, দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করিয়াছিলেন, যাহার প্রভাবে কাল দগ্ধ হইয়াছিল, এবং শ্বেত রাজাকে যিনি মোচন করিয়াছিলেন, তাঁহার সেবা করা সকলেরই কর্ত্তব্য। ঋষিগণ কহিলেন,–মহাদেব যেরূপে বিষ ভক্ষণ করিয়াছিলেন, তিনি যেরূপে দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করেন, তাহা আমাদের নিকট বলুন; শুনিবার জন্য আমাদের বড়ই কৌতুহল হইয়াছে। ৬-১৯।
সূত কহিলেন,–হে বিপ্রগণ! পুরাকালে পরমেষ্ঠী ব্রহ্মার কথানুসারে দক্ষ প্রজাপতি স্বীয় কন্যা দাক্ষায়ণীকে মহাত্মা শঙ্করের করে সম্প্রদান করেন। অনন্তর একদা দক্ষ প্রজাপতি যদৃচ্ছাক্রমে নৈমিষারণ্যে সমাগত হইলে ঋষিগণ ও অন্যান্য সুরাসুরগণ স্তুতি ও প্রণিপাত দ্বারা সকলেই তাঁহার অর্চ্চনা করিলেন। সেখানে মহাদেব অবস্থান করিতেছিলেন। কিন্তু তিনি দক্ষ প্রজাপতিকে দেখিয়া প্রত্যুত্থান বা অভিবাদন কিছুই করিলেন না। তখন দক্ষ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন,–সুর, অসুর ও প্রধান প্রধান বিপ্রগণ, সকলেই সর্ব্বত্র ব্যগ্রভাবে পুনঃপুনঃ আমার নমস্কার করিয়া থাকেন; কিন্তু এই ভূত-প্রেত-পিশাচ-পরিবৃত শ্মশানবাসী নির্লজ্জ শিব কেন আমায় এক্ষণে প্রণাম করিল না? এই শিব মহাত্মা হইয়াও আমার প্রতি দুর্জ্জনের ন্যায় ব্যবহার করিল কেন? যাহারা পাষণ্ডী, দুর্জ্জন, পাপশীল, গর্ব্বিত ও ব্রাহ্মণের প্রতি অসদ্ব্যবহারকারী, তাহাদিগকে বধ করা বা পরিত্যাগ করাই সাধুগণের কর্ত্তব্য। অতএব এই শিবকে আমি শাপদানে সকলের পরিত্যাজ্য করিতেই উদ্যত হইলাম। মহাতপা দক্ষ তখন ক্রুদ্ধ হইয়া এই সকল কথা বলিবার পর পুনরায় রুদ্রকে উদ্দেশ্য করিয়া ব্রাহ্মণদিগকে বলিলেন,–হে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ! আপনারা এক্ষণে আমার কথা শ্রবণ করুন এবং আমি যাহা বলি, তাহা করিতে প্রস্তুত হউন। এই রুদ্রকে আমি জামাতৃত্বে বরণ করিয়াছিলাম, কিন্তু এ বর্ণাতীত, ও বর্ণতৎপর বলিয়া উহাকে এখণে যজ্ঞবহির্ভূত করা হইল। তখন শৈলাদ নন্দী সেই কথা শ্রবণ করিয়া ক্রোধভরে সত্বর সেই শাপপ্রদ মহাপ্রাজ্ঞ দক্ষ প্রজাপতিকে বলিতে লাগিলেন।–নন্দী কহিলেন,–এই মদীয় প্রভু মহেশ্বরকে কি জন্য তুমি যজ্ঞভাগ হইতে বহির্ভূত করিলে? যাঁহার স্মরণমাত্রে সমস্ত যজ্ঞ সফল হয়, শুধু যজ্ঞ বলিয়া কথা কি, দান বল, তপস্যা বল, বিবিধ তীর্থ বল, এই সকলই যাঁহার নামমাত্রে পবিত্র হইয়া থাকে, এই সেই মহেশ্বর। ইহাঁকে অধুনা তুমি অভিশপ্ত করিলে কেন? হে দুর্ম্মতে! দক্ষ! বৃথা ব্রহ্ম-চাপল্যবশে তুমি ইহাঁকে অভিশাপ দিয়াছ। রে ব্রাহ্মণাধম! যে মহাত্মা শঙ্কর এই বিশ্ব পালন করেন, অন্তে যিনি রুদ্রমূর্ত্তি ধারণ করেন, তাঁহাকে তুই অভিশাল দিলি কেন? প্রজাপতি দক্ষ নন্দীর নিকট এই প্রকারে নির্ভৎর্সিত হইয়া রোষবশে নন্দীকেও অভিশাপ দিলেন; বলিলেন,–তোরা সকল এবং ঐ কলি প্রমুখ রুদ্রগণও বেদ হইতে বহির্ভুত হইসে। তোরা বেদ-বিধি দ্বারা অভিশপ্ত ও মহর্ষিগণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া পাষণ্ডবাদে নিরত, শিষ্টাচারবহির্ভূত, কপাল-পাণি ও পানশীল হইয়া রহিবি। দক্ষ এইরূপে তখন শিবানুচরদিগকে অভিশপ্ত করিলে নন্দী কুপিত হইয়া দক্ষকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হইলেন; বলিলেন,–হে বিপ্র! আমরা সাধুশীল শিবকিঙ্কর; বৃথা ব্রহ্মচাপল্যবশে তুমি আমাদিগকে অভিশপ্ত করিলে। অতএব আমিও তোমায় অভিশাপ দিতেছি–তুমি এবং তোমার সহযোগী ব্রাহ্মণেরা বেদবাদে নিরত হইবে। যাগাদি-সাধ্য স্বর্গ-ফলাদি ব্যতীত অন্য কোন সার ঈশ্বরতত্ত্ব নাই বলিয়া ঘোষণা করিবে এবং তাহারা কামাত্মা, স্বর্গতৎপর ও লোভমোহে অন্বিত হইবে; বৈদিক ধর্ম্ম পুরস্কৃত করিয়া শূদ্রযাজী হইবে এবং সতত দরিদ্র ও প্রতিগ্রহ-রত হইবে। হে দক্ষ! কতকগুলি ব্রাহ্মণ ব্রহ্মরাক্ষসও হইবে। ২০-৩৭।
লোমশ কহিলেন,–নন্দী কুপিত হইয়া এইরূপে ব্রাহ্মণদিগকে অভিশাপ দিলেন। অনন্তর, সদাশিব ঈশ্বর নন্দীর বাক্য শ্রবণ করিয়া প্রসন্ন-মুখে এই জ্ঞানগর্ভ মধুর বাক্য বলিতে লাগিলেন। মহাদেব বলিলেন,–হে নন্দিন্! তুমি কোন সময়ের জন্যই ব্রাহ্মণদিগের প্রতি কোপ করিও না। এই বেদবাদরত ব্রাহ্মণগণ সর্ব্বদা গুরুস্থানীয়। বেদ সাক্ষাৎ মন্ত্রময় এবং সূক্তময়, সূক্তে সর্ব্ব দেহীরই আত্মা প্রতিষ্ঠিত। অতএব আত্মবিদ্গণ কখনই নিন্দনীয় নহেন। ঐ আত্মা আমিই। আমি আত্মা ব্যতীত আর কেহই নহি। সুতরাং এ কে? তুমি কে এবং আমিই বা কে? কেন দ্বিজগণকে অভিশপ্ত করিলে? হে মহামতে! সমস্ত প্রপঞ্চ-রচনা পরিহার করিয়া শুদ্ধ বুদ্ধ হইয়া অবস্থান কর। তত্ত্বজ্ঞানবলে অন্য সমস্ত নিরস্ত করিয়া স্বস্থ হও এবং ক্রোধাদি হইতে নির্ম্মুক্ত হইয়া থাক। পরমাত্মা শম্ভুর বাক্যে এইরূপে প্রবোধিত হইয়া মহাতপা শৈলাদি একমাত্র বিবেকের আশ্রয় লইয়া শিব-সাযুজ্য লাভে পরমানন্দে পরিপ্লুত হইলেন। এদিকে দক্ষ ক্রোধভরে ঋষিগণ সমভিব্যাহারে স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। দক্ষ প্রজাপতি তখন হইতে শিবপূজকদিগের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাহীন হইলেন; তাঁহাদিগকে সর্ব্বদাই নিন্দা করিতে লাগিলেন। এমন কি তিনি ঋষিগণসহ সম্মিলিত হইয়া দেব শর্ব্বকেও নিন্দা করিলেন। তিনি শিবনিন্দা হইতে কদাপি বিরত হইলেন না। ৩৮-৪৬।
ইতি শ্রীস্কান্দে মহাপুরাণ একাশিতিসাহস্র্যাং সহিতায়াং প্রথমে মাহেশ্বরখণ্ডে কেদারখণ্ডে পুরাণপ্রস্তাব-দক্ষবৃত্তান্তবর্ণনং নাম প্রথমোহধ্যায়ঃ।।১।।
Amritendu Mukhopadhyay
দেবীভাগবত পুরাণ অনুবাদ দিন। শাক্তদের প্রধান পুরাণ।