নারায়ণ, নরোত্তম, নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয়োচ্চারণ করিবে।
যে আদিপুরুষ স্বেচ্ছায় বরাহবিগ্রহ ধারণ করিয়া অনলীলাক্রমে পৃথিবীকে রসাতল হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন, গিরিশ্রেষ্ঠ সুমেরু যাঁহার খূর মধ্যে নিবন্ধ হইয়া ভগ্নপ্রায় হইয়াছিল, তাঁহাকে নমস্কার। সাগরপরিবেষ্টিতা ধরিত্রী নদ নদী ও পর্ব্বতাদির সহিত সামান্য মৃৎপিণ্ডবৎ যাঁহার দংষ্ট্রাগ্রে পাতালগর্ভ হইতে উদ্ধৃতা হইয়াছিল, সর্ব্বকল্যাণের নিকেতন, সেই মুরারি, মধুকৈটভহারী, নরকান্তকারী দশাননসংহারী কংসনিসূদন দেব-দেব জগন্ময় কৃষ্ণ আমার রিপুকুলকে সংহার করুন।
সূত কহিলেন, “ব্রহ্মণ্! বসুমতী বরাহরূপী ভগবান কর্ত্তৃক উদ্ধৃতা হইলে ভক্তিসহকারে বিভুর চরণে প্রণাম করিয়া সাদরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে প্রভো! প্রতিকল্পেই আপনি আমাকে উদ্ধার করিয়া থাকেন; কিন্তু হে কেশব, আদিসর্গে আমি আপনার বিষয় কিছুমাত্র অবগত নহি। আদিসর্গে বেদচতুষ্টয় নষ্ট হইলে আপনি মৎস্যরূপ ধারণপূর্ব্বক রসাতল হইতে তৎসমস্তই উদ্ধার করিয়া ভগবান ব্রহ্মাকে অর্পণ করিয়াছিলেন। তাহার পর দেবাসুর কর্ত্তৃক সাগরমন্থনকালে আপনি কূর্ম্মরূপে মন্দরকে পৃষ্ঠে ধারণ করিয়া অবস্থিত হইয়াছিলেন; হে মধুসূদন! পুনর্ব্বার আমি মহার্ণবে নিমগ্ন হইলে আপনি দংষ্ট্রা স্বারা আমাকে উদ্ধার করেন। দুরাচার দৈত্য হিরণ্যকশিপু কমলযোনি ব্রহ্মার বরদানে দর্পিত হইয়া পৃথিবীতে অশেষ উৎপার করিয়াছিল; ভগবন্! আপনি নারসিংহরূপ ধারণ করিয়া তাহাকে সংহার করিয়াছিলেন। তাহার পরে কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন প্রভৃতি দুরন্ত ক্ষত্রিয়গণের দৌরাত্মে বিশ্বসংসার নিরতিশয় নিপীড়িত হইলে আপনি জামদগ্ন্যরূপে অবতীর্ন হইয়া একবিংশতিবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিয়াছিলেন। প্রভো! আপনার মাহাত্ম্যের কথা কি বলিব? দুর্বৃত্ত দশাননের উৎপীড়নে জগৎ অতীব কাতর হইলে আপনি রামরূপ ধারণ পূর্ব্বক তাহাকে সবংশে সংহার করিয়া পৃথিবীর ভার লাঘব করেন। আপনি বামনরূপে ব্রাহ্মণগৃহে অবতীর্ণ হইয়া দৈত্যরাজ বলিকে পাতালে আবদ্ধ করিয়াছেন; আপনার মহিমা বুঝি–আমার এমন সাধ্য কৈ? আপনি নন্দগোষ্টে অবতীর্ণ হইয়া কংসাসুরকে সংহার করিয়াছেন; এক্ষণে লোকমোহণ বুদ্ধরূপে লীলা করিতেছেন; হে ভগবন্! আপনার চরণে বারম্বার নমস্কার করি।
“প্রভো! আমাকে রসাতল হইতে বারম্বার উদ্ধার করিয়া কেন সৃষ্টি করেন? সৃষ্টি করিয়া কেনই বা পালন করেন এবং পরিশেষে জগৎসংসার কেন ধ্বংস করিয়া থাকেন?–এই সকল কারণ কৃপা করিয়া আমার নিকট কীর্ত্তন করুন। জগন্নাথ! আপনার চরণযুগল ভবসাগর তরণের তরণীস্বরূপ; বলুন, প্রভো, কিসে ইহা সহজে লাভ করা যায়? কোন্ উপায়ে সেই অমরদুর্লভ পদারবিন্দের মকরন্দ-পানে সর্ব্বদা সুখী হইতে পারি? কিরূপে যুগচতুষ্টয়ের সৃষ্টি হয়? তাহাদের মধ্যে প্রভেদ কি? কোন্ কোন্ রাজা পৃথিবীতলে জন্মগ্রহণ করিয়া বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন? কাহারাই বা সিদ্ধিলাভ করিয়া পরম পদ প্রাপ্ত হইয়াছেন? কে কেশব! আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া এই সমস্ত বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বর্ণন করুন।”
বরাহরূপী ভূতভাবন ভগবান্ পরমেশ্বর ধরণীর এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন; তখন জগদ্বাত্রী সবিস্ময়ে দেখিলেন, ভগবানের কুক্ষি মধ্যে রুদ্রাদি দেবগণ, বসুগণ, সিদ্ধ, চারণ ও মহর্ষিবৃন্দ বিরাজ করিতেছেন। সূর্য্য, চন্দ্র, গ্রহ ও নক্ষত্রগণ এবং সপ্তলোকাদি ভূবন তাহার অন্তর্ণিহিত রহিয়াছে! এই অত্যাশ্চার্য্য ব্যাপার দর্শনে বসুন্ধরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলেন; তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইলে। বিস্ময়ে–সাশ্চর্য্যে তিনি নয়ন নিমীলন করিলেন; তাহার পর চক্ষুরুন্মীলন করিবামাত্র দেখিতে পাইলেন শঙ্খচক্র-গদাপাণি নারায়ণ চতুর্ভুজ-মূর্ত্তি ধারণ করিয়া অসীম অনন্ত মহাসাগরে শেষ-শয়নে শয়ান রহিয়াছেন! তদ্দর্শনে দেবী জগদ্বাত্রী কৃতাঞ্জলিপুটে ভক্তিগদ্গদ্স্বরে তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন–
হে পদ্মপলাশলোচন, পীতাম্বরধর নারায়ণ! তোমাকে নমস্কার। সুরারি-নিপাতকারিন্। পরমাত্মন্! হে শেষপর্য্যঙ্কশায়িন্! তোমাকে নমস্কার। হে মোক্ষকারিন্! দেব দেব দামোদর! হে শঙ্খচক্রগদাধারিন্! চতুর্ভুজ নারায়ণ! তুমি অজ ও অমর; তোমার নাভিকমলে বিরিঞ্চি ব্রহ্মা উৎপন্ন হইয়াছেন; তুমি সকলের ঈশ্বর, অতএব তোমাকে নমস্কার। হে শ্রীবৎসলাঞ্ছন! তোমার অধরৌষ্ঠ, পাণিপল্লব ও চরণ সরোজ বিদ্রুমবৎ আরক্ত; আমি তোমার সেই চরণতলে শরন লইলাম; আমাকে ত্রাণ কর। হে জগন্নাথ! তোমার পূর্ণ লীলাঞ্জন-বর্ণ বরাহরূপ দর্শন করিয়া ভীতা হইয়াছি; এক্ষনে আমার প্রতি কৃপা করিয়া আমারে পরিত্রাণ কর। আমি তোমার চরণে বারম্বার প্রণাম করিতেছি।”
Leave a Reply