পদ্ম পুরাণ
ভুমি খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
সূতের প্রতি ঋষিগণের প্রহ্লাদচরিত্র জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন, সূত কর্ত্তৃক ঋষিগণের নিকট ব্রহ্ম-ব্যাস-সংবাদ বর্ণন
নারায়ণ, নর, নরোত্তম, দেবী এবং সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া, পরে জয় গ্রন্থ উচ্চারণ করিবে।
ঋষিগণ কহিলেন,–হে সর্ব্ব-তত্ত্বার্থকোবিদ মহভাগ সূত! শ্রবণ কর, আমাদের বুদ্ধি-বিলোপী এক বিষম সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে। হে বিদ্বন্! কোন কোন দ্বিজশ্রেষ্ঠ পুরাণে প্রহ্লাদপ্রসঙ্গে এইরূপ বলিয়া থাকেন যে, প্রহ্লাদ পঞ্চবর্ষ বয়সেই কেশবকে পরিতুষ্ট করিয়াছিলেন। কিন্তু দেবাসুর-সমর উপস্থিত হইলে, তিনি কেন হরির সহিত যুদ্ধ করেন এবং বাসুদেব কর্ত্তৃক নিহত হইয়া বৈষ্ণব দেহে প্রবিষ্ট হন? সূত কহিলেন,–দ্বিজগণ! পূর্ব্বে কশ্যপ এ বিষয় বিদিত ছিলেন। ব্রহ্মা স্বয়ং ইহা মহাত্মা ব্যাসের নিকট বর্ণন করেন। ধীমান ব্যাস পরে উহা প্রকাশ করিয়াছেন। আমি সেই ব্যাসবর্ণিত বিষয়ই আপনাদের নিকট বলিতেছি। বিধিদেব নিজেই এই সন্দেহ-নিদান ছেদন করিয়া দেন। ১-৫
ব্যাসদেব বলিয়াছিলেন,–হে মহাভাগ সূত! ব্রহ্মা প্রহ্লাদজন্ম যেরূপ বলিয়াছেন এবং পুরাণেও যাহা অন্য প্রকার শুনিয়াছি, তাহা শ্রবণ কর। দেব-পুজিত প্রহ্লাদ জন্মিবামাত্র সর্ব্বসুখাবহ বৈষ্ণবপথ অবলম্বন করিয়া মহাভাববতশ্রেষ্ঠ হইয়াছিলেন। তিনি বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধার্থ সপুত্র সমরে অবতীর্ণ হন। পরে বাসুদেব কর্ত্তৃক নিহত হইয়া বৈষ্ণবী তনু লাভ করেন। এই মহাত্মা প্রহ্লাদের উৎপত্তি-বিবরণ শ্রবণ কর। ইনি বীর্য্যশালী ছিলেন। স্বীয় পুত্রাদির সহিত সমরে অবতীর্ণ হইয়া বিষ্ণুর সহিত যুদ্ধ করেন এবং স্বীয় প্রভাবে বৈষ্ণব তেজে প্রবিষ্ট হন। সেই বীর্য্যবান প্রহ্লাদ পুরাকল্পে যেরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সংক্ষেপে সে বৃত্তান্ত তোমার নিকট বলিতেছি। পশ্চিম সাগরের প্রান্তে সকল ঋদ্ধি-সিদ্ধি-সমর্থিতা দ্বারকাপুরী বিরাজমান। তথায় বেদার্থকোবিদ যোগজ্ঞ যোগী বিখ্যা শিবশর্ম্মা বাস করেন। তাঁহার পাঁচ পুত্র; পাঁচ জনই শাস্ত্রজ্ঞ। পুত্রগণের নাম যজ্ঞশর্ম্মা, বেদশর্ম্মা, ধর্ম্মশর্ম্মা, বিষ্ণুশর্ম্মা এবং সোমশর্ম্মা। পঞ্চপুত্রই পিতৃভক্ত; পিতৃভক্তি ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম তাঁহারা জানিতেন না। সেই মহাত্মগণ সর্ব্বদা তদ্ভাবে ভাবিত হইয়াই থাকিতেন। ৬- ১৫
দ্বিজবর শিবশর্ম্মা পুত্রগণের পিতৃভক্তি দর্শনে চিন্তা করিলেন, আমি সুরবরদিগকে আকর্ষণ করিব; প্রকৃত পিতৃভক্তের ভাব আমার এই পুত্রগণের অন্তরে হয় তো নাই; যদি থাকে, তবে তাহা যেরূপে জানিতে পারি, সে চেষ্টা আমি বুদ্ধিবলে করিব। হে দ্বিজবরগণ! শিবশর্ম্মা বিষ্ণুর প্রসাদে সর্ব্বসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। তিনি ঐ বিষয় জানিবার জন্য সদুপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। বিশিষ্ট ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণ-শ্রেষ্ঠ উপায়জ্ঞ শিবশর্ম্মা চিন্তা করিতে করিতে মায়াবিস্তারে এক উপায় উদ্ভাবন করিলেন। তিনি পুত্রগণের সমক্ষে ছল প্রদর্শন করিয়া দেখাইলেন,–তাহাদের মাতা প্রবল জ্বর রোগে মৃত্যুগ্রস্ত হইয়াছেন। পুত্রগণ দেখিলেন,–মাতা মরিয়াছেন। তদ্দর্শনে তাঁহারা পিতার নিকটা গিয়া বলিলেন,–হে মহাভাগ! আমরা যাঁহার গর্ভোদরে প্রবর্দ্ধিত হইয়াছিলান, তিনি নিজ কলেবর পরিহার করিয়া স্বর্গে গিয়াছেন, আপনি এক্ষণে কি আদেশ করেন? শিবশর্ম্মা ভক্তিপরায়ণ জ্যেষ্ঠ পুত্র যজ্ঞশর্ম্মাকে আহ্বাব করিয়া আদেশ করিলেন,–পুত্র! তুমি সর্বাঙ্গ ছেদন করিয়া যত্র তত্র নিক্ষেপ কর। পুত্র পিতার সেরূপ আদেশ পাইলেন, তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদণ করিলেন এবং পুনরায় পিতার নিকটা আসিয়া বলিলেন,–পিতঃ। আপনি যে যে আদেশ করিয়াছিলেন, তৎসমস্তই আমি সম্পাদন করিয়াছি। এক্ষণে অন্য কার্য্যের জন্য আদেশ করুন, দুর্জ্জয় বা দুর্লভ হইলেও সে সকল আদেশ পালন করিব। দ্বিজবর শিবশর্ম্মা ইহাতে জ্যেষ্ঠপুত্র মহাভাগ যজ্ঞশর্ম্মাকে নিশ্চিত রূপে প্রশস্ত পিতৃভক্ত জানিয়া, স্বীয় পুত্র বেদশর্ম্মার পিতৃভক্তি পরীক্ষার জন্য তাঁহাকে আহ্বান করিয়া আদেশ করিলেন,–পুত্র। কামার্ত্ত আমি, স্ত্রী বনা তিষ্ঠিতে পারিতেছি না! এই বলিয়া তিনি মায়াবলে এক সর্ব্ব-সৌভাগ্যশালিনী নারী মূর্ত্তি প্রদর্শন করত বলিলেন,–বৎস! কৃতনিশ্চয় হইয়া তুমি আমারই জন্য এই নারীকে আনয়ন কর। ১৬-৩০
পুত্র আদিষ্ট হইয়া পিতাকে কহিলেন,–আপনার প্রিয়ানুষ্ঠান করিব। এই বলিয়া পিতৃপদে নমস্কারপূর্ব্বক বেদশর্ম্মা সেই নির্দ্দিষ্ট নারীর নিকট গিয়া কহিলেন,–দেবি! কামশরপীড়িত মদীয় পিতা আপনাকে প্রার্থনা করিতেছেন। অতএব আপনি আমার জরাযুক্ত পিতার প্রতি প্রসাদসুমুখী হউন। হে চারুগাত্রি সুন্দরি! আমার পিতাকে ভজনা করুন। শিবশর্ম্মার মায়া-নারী বেদশর্ম্মার উক্তি শ্রবণ করিলেন, কহিলেন,–পিতা তোমার জরাজীর্ণ, শ্লেষ্মযুক্ত, মুখরোগী, ব্যাধিগ্রস্ত, শিথিলেন্দ্রিয়, আর্ত্ত ও বৃদ্ধ। আমি তাহার সঙ্গ কখনই ইচ্ছা করি না, আমি রমনেচ্ছা করি তোমার সহিত; তোমারই আমি প্রিয়াচরণ করিব। তুমি রূপ-সৌভাগ্য-গুণ-রত্নালঙ্কৃত, দিব্য-লক্ষণ-লক্ষিত, মহাতেজা সুপুরুষ; সুতরাং মানদ! শ্রবণ কর, বৃদ্ধ পিতার প্রয়োজন কি? আমার অঙ্গভোগ-বৈভবেই তুমি সর্ব্ব সুদুর্লভ সামগ্রী প্রাপ্ত হইবে। হে বিপ্র! তুমি যাহা যাহা প্রার্থণা কর, আমি নিশ্চয়ই তাহা প্রদান করিব। বেদশর্ম্মা ঐ পাপযুক্ত অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,–দেবি! তোমার বাক্য অধর্ম্মযুক্ত, পাপসম্মিশ্র এবং অন্যায়, আমি পিতৃভক্ত নিরপরাধ ব্যক্তি, আমাকে এরূপ বাক্য তুমি বলিও না। হে শুভে! আমি পিতার জন্যই আসিয়াছি, এবং তাঁহারই জন্য তোমায় প্রার্থনা করিতেছি। তুমি অন্যথা বলিও না, আমার পিতাকেই আসিয়া ভজনা কর। হে সুন্দরি! এ ত্রৈলোক্যে তোমার যাহা যাহা প্রার্থনীয় আছে, তাহা দুর্লভ দেবরাজ্য অপেক্ষা অধিক হইলেও, আমি প্রদান করিব, একথা নিঃসন্দেহ। মায়া-নারী কহিলেন,–পিতার নিমিত্ত তুমি যখন আমায় এতদূর পর্য্যন্ত দিতে সমর্থ, তখন আমি ইচ্ছা করি, তুমি অদ্যই আমায় ইন্দ্র ও মহাদেবকে দর্শন করাও; এই দুর্লভ সামগ্রী নিশ্চয়ই সম্প্রতি তুমি প্রদান করিতে সমর্থ। হে মহাভাগ! তোমার কিরূপ আত্মপ্রভাব তাহা দেখাও। দেবশর্ম্মা কহিলেন,–দেবি! দেখ দেখ, আমার তপঃপ্রভাব! আমার আহ্বানে ইন্দ্রাদি সুরবরগণ সমাগত হইয়াছেন। তাঁহারা আসিয়া বেদশর্ম্মাকে বলিলেন,–হে দ্বিজোত্তম! আমরা কি করিব? তুমি যাহা ইচ্ছা করিবে, তাহাই নিশ্চয় প্রদান করিব। ৩১-৪৫
বেদশর্ম্মা বলিলেন,–দেবগণ! যদি মৎপ্রতি প্রসন্ন হইয়া প্রসাদসুমুখ হইয়া থাকেন, তবে প্রার্থনা–তাঁহারা আমায় অমল পিতৃপদভক্তি প্রদান করুন। সুরগণ বলিলেন,–তথাস্তু। এই বলিয়া তাঁহারা যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন। তদ্দর্শনে মায়া-নারী কহিল,–বিপ্র! তোমার তপোবল দেখিলাম, দেবগণে আমার প্রয়োজন নাই, আমায় যদি কিছু প্রদান করিতে ইচ্ছা করিয়া থাক, আমাকে যদি পিতার জন্য লইতে চাও, তবে আমার প্রিয়ানুষ্ঠান কর। হে বিপ্র! তুমি নিজ হস্তে স্বীয় মস্তক ছেদন করিয়া আমায় অপর্ণ কর। বেদশর্ম্মা করিলেন,–অদ্য আমি ধন্য হইলাম, ঋণত্রয় হইতে মুক্ত হইলাম। শুভে! আমি নিজ মস্তক প্রদান করিতেছি, ধর, গ্রহণ কর। এই বলিয়া তীক্ষ্ণধার শিত শস্ত্র দ্বারা স্বীয় শিরঃ কর্ত্তন করিয়া বেদশর্ম্মা সহাস্যবদনে তাঁহাকে অপর্ণ করিলেন। তখন মায়ানারী সেই শোনিতপ্লুত মস্তক লইয়া শিবশর্ম্মা মুনির নিকট গমনপূর্ব্বক বলিল,–বিপ্র! আপনার পুত্র বেদশর্ম্মা আপনার নিমিত্ত নিজেই নিজ মস্তক ছেদন করিয়া প্রেরণ করিয়াছেন, ইহা গ্রহণ করুন। আপনার সেই পিতৃভক্ত পুত্র আপনারই জন্য আমায় এই উত্তমাঙ্গ প্রদান করিয়াছিলেন, অতএব হে দ্বিজবর! আপনি আমায় উপভোগ করুন। বেদশর্ম্মার পুণ্যশীল ভ্রাতৃগণ বেদশর্ম্মার সেই সাহস দর্শনে কম্পিতগাত্র হইলেন এবং তাঁহারা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন,–আমাদের ধর্ম্মসাধ্বী মাতা সত্যসমাধিতলে প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছেন। এই মহাভাগ ভ্রাতা আমাদের পিতার জন্যই মরিলেন, অতএব পিতার নিমিত্ত এই শুভানুষ্ঠাতা ভ্রাতা আমাদের অশেষ ধন্যবাদার্হ। দ্বিজ শিবশর্ম্মা পুত্রগণের সেই বাক্য শুনিয়া বুঝিলেন,–বেদশর্ম্মা প্রকৃতই পিতৃভক্ত, এবং সেই ভক্তিবশেই সে আপন মস্তক কর্ত্তন করিয়াছে। ইহা বুঝিয়া তিনি তৃতীয় পুত্র ধর্ম্মশর্ম্মাকে বলিলেন,–তুমি এই মস্তক গ্রহণ কর। ৪৬-৫৮
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত ।১।
Leave a Reply