প্রথম অধ্যায়
যোগিগণ ভক্তিপবিত্র হৃদয়ে যাহার বন্দনা করেন, যাহা আবির্ভূত হইয়াই বিক্ষেপ সহকারে ভূর্লোক, ভূবর্লোক ও স্বর্লোক অতিক্রম করিয়াছিল এবং যাহা নিশ্চয়ই ভবভয়ার্ত্তি বিনাশ করে, সেই হরিপদকমলযুগল তোমাদের পবিত্রতা বিধান করুন।
যিনি ক্ষীরসাগরগর্ভে অনন্তের ফণমণ্ডলে শয়ন করিয়া থাকেন, যিনি নিখিল পাপ তাপ একবারেই বিনাশ করিতে পারেন এবং যাঁহার নিশ্বাসে সলিলরাশি প্রবলবেগে আন্দোলিত ও তৎপ্রভাবে জলবিন্দু সকল উর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হওয়াতে, সরিৎপতি ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ধারণ করিয়া, যেন সবেগে নৃত্য করে, সেই ভগবান মধুসূদন তোমাদের সকলকে পালন করুন।
নারায়ণ, নর, নরোত্তম ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া, পরে জয় উচ্চারণ করিবে।
ব্যাসের শিষ্য পরমতেজস্বী জৈমিনি তপঃস্বাধ্যায়নিরত মহামুনি মার্কেণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্! মহাত্মা ব্যাস যে ভারতকথা কীর্ত্তন করিয়াছেন, উহা যেমন জাতিশুদ্ধসম্পন্ন ও সাধুশব্দসমূহে অলঙ্কৃত, সেইরূপ বিবিধ আমল শাস্ত্রসমুচ্চয়ে পরিপূর্ণ। উহাতে পূর্ব্বপক্ষে ও উত্তরপক্ষ উভয়ই আছে। বিষ্ণু যেমন দেবগণের ও ব্রাহ্মণ যেমন দ্বিপদসমূহের প্রধান এবং ভূষণের মধ্যে চূড়ামণি, আয়ুধের মধ্যে বজ্র ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মন যেমন শ্রেষ্ঠ, মহাভারতও তেমনি সমুদয় শাস্ত্রের মধ্যে উৎকৃষ্ট। উহাতে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এবং তাহাদের পরস্পরের অব্যাঘাতে যথাযথ প্রয়োগবিধিও বর্ণিত আছে। এইজন্য এই মহাভারতই উৎকৃষ্ট ধর্ম্মশাস্ত্র, অনুত্তম অর্থশাস্ত্র, অত্যুত্তম কামশাস্ত্র ও উৎকৃষ্ট মোক্ষশাস্ত্র। ফলতঃ ধীমান ব্যাসদেব ইহাকে চতুর্ব্বিধ আশ্রমধর্ম্মেরই আচার ও স্থিতির সাধনরূপে প্রণয়ন করিয়াছেন। এই মহাশাস্ত্র ভারত বহুল বিস্তৃত হইলেও, উদারবুদ্ধি বেদব্যাস ইহাকে এরূপে রচনা করিয়াছেন যে, কোনরূপ বিরোধ ইহাকে অভিভূত করিতে পারে না। বেদব্যাসের বাক্যরূপ সলিলরাশি বেদরূপ অত্যুচ্চ পর্ব্বত হইতে অবতরণ করিয়া, কুতর্করূপ পাদপপরম্পরা নির্মূলন করত সমগ্র বসুধার পবিত্রতা বিধান করিয়াছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রণীত এই পঞ্চম বেদ মহাহৃদ স্বরূপ। সুমধুর শব্দ সকল উহার মহাহংস, বিবিধ মহাখ্যান ইহার উৎকৃষ্ট পদ্ম এবং কথা সকল উহার বিপুল সলিলসংগ্রহ।
ভগবন্! আমি এই ভারতাখ্যান যথাযথ বিদিত হইবার মানসে আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। ভগবন্ জনর্দ্দন নির্গুণ হইলেও কিজন্যে মানুষরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন? সেই একা দ্রৌপদীই বা কিজন্য পঞ্চ পাণ্ডবের মহিষী হইয়াছিলেন? এ বিষয়ে আমার অতিমাত্র সন্দেহ জন্মিয়াছে। বলদেব স্বয়ং পাপের প্রশমন কর্ত্তা হইলেও, কিজন্য তীর্থাযাত্রাপ্রসঙ্গে ব্রহ্মহত্যাপাতকের পরিহার করিয়াছিলেন? পাণ্ডবগণ যাহাদের নাথ, সেই মহারথ দ্রৌপদীর পুত্রগণই বা কিজন্য অনাথের ন্যায় অবিবাহিত দশায় নিহত হইলেন? আপনারা মাদৃশমূঢ়বুদ্ধি জনগণের সর্ব্বদাই জ্ঞান বিজ্ঞান বিধান করেন। অতএব উল্লিখিত ঘটনা সকল বিস্তারপূর্বক কীর্ত্তন করুন।
অষ্টাদশদোষবিরহিত মহামুনি মার্কণ্ডেয় জৈমিনির এই কথা শুনিয়া বলিতে লাগিলেন, সম্প্রতি আমাদের ক্রিয়াকাল উপস্থিত। বিস্তারপূর্ব্বক বলিবার এ সময় নহে। যাহারা বিস্তারপূর্ব্বক বলিয়া তোমার সন্দেহ দূর করিবে, সেই পক্ষীগণের বৃত্তান্ত বলিতেছি, শ্রবণ কর। পিঙ্গাক্ষ, বিবোধ, সুপুত্র ও সুমুখ, দ্রোণের এই চারি পুত্রই শাস্ত্রচিন্তক ও তত্ত্বজ্ঞ। তুমি বিন্ধ্যপর্ব্বতের কন্দরমধ্যে তাহাদের নিকট গমন করিয়া উক্ত বিষয় জিজ্ঞাসা কর। মার্কণ্ডেয় এইরূপ কহিলে, জৈমিনি বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে প্রত্যুত্তর করিলেন, ব্রহ্মণ্! পক্ষী মানুষের ন্যায় কথা বলিতে পারে, ইহা নিরতিশয় বিস্ময়ের বিষয়। তাহারা পক্ষিযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াও কিরূপে ঐরূপ জ্ঞান সম্পন্ন হইল? তাহাদিগকে দ্রোণপুত্রই বা কিজন্যে কহিয়া থাকে? দ্রোণই বা কে, যাহার চারি পুত্রেরই ঐরূপ ধর্ম্মজ্ঞান সমুৎপন্ন হইয়াছে?
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, পূর্ব্বে নন্দনকাননে যাহা ঘটিয়াছিল, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।
দেবর্ষি নারন নন্দনে গমন করিয়া, অবলোকন করিলেন, দেবরাজ ইন্দ্র পুংশ্চলীগণের মধ্যবর্ত্তী হইয়া তাহাদের মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন। ঋষিএ দর্শনমাত্র শচীপতি তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান করিয়া স্বকীয় আসন তাঁহাকে প্রদান করিলেন। ইন্দ্রকে উঠিতে দেখিয়া সেই দেবাঙ্গনাগণও বিনয়াবশত হইয়া দেবর্ষিকে প্রণাম করিলেন। দেবর্ষি যথাযথ অভ্যর্চ্চিত হইয়া, দেবরাজ উপবেশন করিলে, মনোহারিণী কথা সকল বলিতে আরম্ভ করিলেন।
দেবরাজ কথান্তরে এই মহামুনিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এখানে রম্ভা, মিশ্রকেশী, উর্ব্বশী, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, মেনকা প্রভৃতি সকলেই উপস্থিত আছে। ইহাদের মধ্যে যাহাকে আপনার পছন্দ হয়, নৃত্য করিতে আজ্ঞা করুন।
দেবরাজের কথা শুনিয়া দেবর্ষি সবিশেষ চিন্তা করত অপ্সরাদিগের সকলকেই কহিলেন, তোমাদের মধ্যে আপনাকে সর্ব্বাপেক্ষা সমধিক রূপ, গুণ ও ঔদার্য্যশালিনী বলিয়া যাহার জ্ঞান আছে, সেই আমার সমক্ষে নৃত্য করুক। কেননা, গুণরূপবিহীনা রমণীর কোন বিষয়েই সিদ্ধিলাভ সম্ভব নহে। সুন্দর অনুষ্ঠান সম্পন্ন নৃত্যই নৃত্য বলিয়া পরিগণিত, তদিতর নৃত্য বিড়ম্বনা মাত্র।
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, দেবর্ষির বাক্যসমকালেই তাহারা সকলে পরস্পর বলিতে লাগিল, আমিই গুণাধিকা, তুমি নহ, তুমি নহ। তাহাদের এইপ্রকার সম্ভ্রম সন্দর্শন করিয়া ভগবান্ পাকশাসন বলিতে লাগিলেন, তোমরা এই দেবর্ষিকে জিজ্ঞাসা কর। ইনিই তোমাদের মধ্যে গুণাধিকার নির্ব্বাচন করিবে। অপ্সরারা ইন্দ্রের ছন্দোনুবর্ত্তিনী হইয়া, নারদকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, মহর্ষি দুর্ব্বাসা হিমাচলে তপস্যা করিতেছেন। তোমাদের মধ্যে যে তাঁহাকে বলপূর্ব্বক ক্ষুভিত করিতে পারিবে, সেই আমার মতে সকল অপেক্ষায় সমধিক গুণশালিনী।
তাহার এই কথা শুনিয়া, সকলেরই কলেরব কম্পিত হইয়া উঠিল। তখন সকলেই পরস্পর বলিতে লাগিল, আমাদের ইহা সাধ্য হইবে না। তাহাদের মধ্যে বপুনাম্নী অস্পরা পূর্বে বহুবার মনুগণের বিক্ষোভ সম্পাদন করিয়াছিল। তজ্জন্য গর্ব্বিতা হইয়া কহিল, আমি অদ্য সেই হিমাচলে গমন করিয়া, দেহরথের যন্তা দুর্ব্বাসাকে স্মররূপ শন্ত্রের আঘাত ছিন্নরশ্মি করিয়া, তদীয় বুদ্ধিরূপ সারথিকে বিপথে আনয়ন করিব। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা স্বয়ং মহাদেবই হউন অদ্য কামবাণে তাঁহার অন্তর ক্ষতাকুলিত করিব। এই বলিয়াই সে হিমাচলে প্রস্থান করিল। মহর্ষির তপঃপ্রভাবে সিংহ ব্যাঘ্রাদির হিংস্র জন্তু সকলও শান্তস্বভাব অবলম্বনপূর্ব্বক তত্রত্য আশ্রমে অবস্থিতি করিতেছে। বপু, মহর্ষির আশ্রম হইতে ক্রোশমাত্র ব্যবধানে অবস্থিতি করিয়া, পুংস্কোকিলের ন্যায়, সুমধুর স্বরলহরী বিস্তার সহকারে গান করিতে লাগিল। তাহা শুনিয়া মহর্ষির অন্তরে বিস্ময়রসের সঞ্চার হইলে, তিনি তাহার সমীপে গমন করিলেন। তাহা শুনিয়া মহর্ষির অন্তরে বিস্ময়রসের সঞ্চার হইলে, তিনি তাহার সমীপে গমন করিলেন। অনন্তর তাহাকে দর্শন করিয়াই, তাহার দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, আত্মাকে সংযত করত, রোষামর্ষের বশীভূত হইয়া কহিতে লাগিলেন, অয়ি আকাশবিহারিণি! তুমি মদোন্মত্তা হইয়াছ, সেইজন্যই আমার অতিকষ্টে অর্জ্জিত তপস্যার বিঘ্নসাধনপুরঃসর আমাকে দুঃখ দিতে আসিয়াছ। বুঝিলাম, তোমার মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছে। অতএব আমার ক্রোধে কলুষীকৃতা হইয়া, তোমাকে পক্ষিযোনিতে জন্মগ্রহণপূর্ব্বক ষোল বৎসর অতিবাহন করিতে হইবে। পক্ষিণীরূপধারিণী তোমার গর্ভে পুত্রচতুষ্টয়ের জন্ম হইবে। কিন্তু তাহাদের লালনপালনাদিজনিত কোনরূপ প্রীতি ভোগ না করিয়াই শস্ত্রপূতা হইয়া পুনরায় স্বর্গে সমাগতা হইবে। যাহা বলিলাম, ইহাতে আর দ্বিরুক্তি করিও না।
মহর্ষি দুর্ব্বাসার ক্রোধলোহিত লোচনে সেই মানিনীকে এই প্রকার অসহ্য বাক্য শ্রবণ করাইয়া সেইস্থল ত্যাগ করত মন্দাকিনীতে গমন করিলেন।
ইতি বপুশাপ নামক প্রথম অধ্যায়।
Leave a Reply