প্রথম অধ্যায়
যিনি প্রচণ্ড তাণ্ডবের আড়স্বরে দিগ্গজদিগকে দূরে নিক্ষেপ করেন, সেই পরমেশভবের পূজনীয় পাদ-পদ্ম, জনমণ্ডলীর বিঘ্ন বিনাশ করুন। যিনি মৎস্যাবতারে পাতালতল হইতে উৎপতিত হইবার উপক্রম করিলে, তদীয় পুচ্ছাভিঘাতে উর্দ্ধোৎক্ষিপ্ত জলধি সকল উর্দ্ধে ব্রহ্মাণ্ড-খণ্ডে ব্যাহত হইয়া বিপর্যস্তভাবে নিখিল মেদিনীমণ্ডল পরিব্যপ্ত করত আপতিত হইয়া থাকে, সেই ভগবান বিষ্ণুর মুখোচ্চারিত শ্রুতিসমূহের মঙ্গলধ্বনি তোমাদের সমস্ত অমঙ্গল অপহরণ করুন। নারায়ণ, নর, নরোত্তম, দেবী এবং সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া পরে জয় উচ্চারণ করিবে।
যাঁহার জন্ম নাই, অথচ যিনি ক্রিয়াযোগে নারায়ণ নামে প্রসিদ্ধ, সেই ত্রিগুণ, ত্রিদেব, স্বয়ম্ভূকে নমস্কার করি। ১
একদা নৈমিষারণ্যবাসী মুনিগণ এক দীর্ঘকালব্যাপী যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। সেই যজ্ঞের অবসানে তাঁহারা তথায় একাগ্রমনে সমাসীন সূতকে পৌরাণিক দীর্ঘসংহিতার বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন ধর্ম্মসঙ্গত সুললিত পুরাণকথার প্রস্তাব আরম্ভ হইলে, শৌনকাদি মহর্ষিগণ মুহুর্ম্মুহুঃ অভিনন্দিত করিয়া সূতনন্দনকে কহিলেন,–হে পবিত্র! তুমি যে সকল পুরাণ কথা কহিয়াছ, সেই সকল অমৃতোপম পুরাণপ্রস্তাবই পুনরায় আমরা শুনিতে ইচ্ছা করি। কিরূপে ভগবান লোকনাথ চরাচর জগৎ সৃজন করিলেন? কেমন করিয়া ভগবান বিষ্ণু মৎস্যরূপ ধারণ করিয়াছিলেন এবং ভগবান বৃষধ্বজ ভবের ভৈরবত্ব, পুরারিত্ব ও কপালিত্বই বা কেমন করিয়া হইয়াছিল? হে সূত! তুমি বিস্তৃতরূপে এই সমস্ত বার্ত্তা ক্রমশঃ প্রকাশ করিয়া বল। তোমার বাক্য যেন সুধার ন্যায়; সে সুধা পান করিয়া আমাদের আর তৃপ্তি হইতেছে না। ফলে যতই পান করি, পিপাসা কিছুতেই মিটে না। সূত বলিলেন,–হে দ্বিজগণ! স্বয়ং গদাধর যে পুরাণ কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, সেই মৎস্য-পুরাণ এক্ষণে আমার নিকট সম্পূর্ণরূপে শ্রবণ করুন। এই পুরাণ পুণ্য, পবিত্র, আয়ুষ্য এবং যশস্য। পুরাকালে রাবিনন্দন রাজা মনু, পুত্রের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণপূর্ব্বক মলয়াচলের একদেশে গিয়া বিপুল তপোনুষ্ঠান করেন। সুখে দুঃখে তাঁহার সমান ভাব ছিল; তিনি সর্ব্ববিধ আত্মগুণে অম্বিত হইয়া উত্তম যোগ লাভ করিয়াছিলেন। অনন্তর বহু অযুত বর্ষ অতীত হইলে, কমলাসন তাঁহার প্রতি প্রীত হইয়া বরদানে উদ্যত হইলেন এবং বলিলেন,–রাজন! বর গ্রহণ কর। ১-১১।
ব্রহ্মার কথায় রাজা তাঁহাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক কহিলেন,–হে পিতামহ! আমি আপনার নিকট হইতে একটি মাত্র পরমোত্তর বর প্রাপ্ত হইতে ইচ্ছা করি; আমার প্রার্থনা এই যে, যখন প্রলয় কাল উপস্থিত হইবে, তখন আমি যেন নিখিল ও চরাচর সমগ্র জগতের রক্ষা করিতে সমর্থ হই। বিশ্বাত্মা ব্রহ্মা মনুর প্রার্থনায় ‘তথাস্তু’ বলিয়া তৎক্ষণাৎ অন্তহিত হইলেন। তখন স্বর্গ হইতে সুরগণ-ক্ষিপ্ত সুমহতী পুষ্প-বৃষ্টি পতিত হইল। অনন্তর একদা মনু স্বীয় আশ্রমে বসিয়া পিতৃতর্পণ করিতেছিলেন, এই সময় একটা জলার্দ্র শফরী তদীয় পাণিদ্বয়ের উপরি পতিত হইল। শফরী দেখিয়া রাজা দয়ার্দ্রচিত্তে তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য যত্ন করিলেন। তিনি তাহাকে স্বীয় কমণ্ডলুমধ্যে রাখিলেন। পরে সেই শফরী এক অহোরাত্র মধ্যেই ষোড়শাঙ্গুল বিস্তৃত হইল এবং সে স্বীয় মৎস্যরূপেই রাজাকে বলিল,–রাজন! আমায় রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। মনু তখন তাহাকে কমণ্ডুল হইতে তুলিয়া লইয়া এক মণিক-মধ্যে রাখিলেন। মৎস্য তন্মধ্যে থাকিয়া একরাত্রেই তিন হস্তপরিমান বৃদ্ধি পাইল। তখন সেই মৎস্য পুনরায় আর্ত্তস্বরে রবিনন্দনকে কহিল,–রাজন! আমি আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি, আমাকে রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। মহীপতি মনু অনন্তর সেই মৎস্যকে এক কূপমধ্যে নিক্ষেপ করিলেন। যখন তাহাতেও তাহার স্থান সঙ্কুলন হইল না, তখন সেই মৎস্যকে মনু এক সরোবরে ছাড়িয়া দিলেন। সরোবরে নিক্ষিপ্ত হইয়া মৎস্য অতি বিশাল দেহ ধারণ করিল। তাহার দেহপরিমান যোজনপরিমিত হইল। তখন সে তন্মধ্যে থাকিয়া দীনভাবে বলিল,–নৃপবর! আমায় রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। এইবার মনু তাহাকে গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিলেন। সেখানেও সে অত্যধিক বৃদ্ধি পাইল। তখন মহীপতি সেই মৎস্যকে আনিয়া সমুদ্রজলে নিক্ষেপ করিলেন। সমুদ্রজলে নিক্ষিপ্ত হইয়াও যখন সে স্বীয় দেহে সমগ্র সমুদ্র পরিব্যাপ্ত করিল, তখন মনু ভীত হইয়া তাহাকে বলিলেন,–তুমি নিশ্চয়ই কোন অসুরেশ্বর হইবে; অথবা তুমি সাক্ষাৎ বাসুদেব। অন্যথা অপর কেহই এরূপ হইতে পারে কি? বস্তুতঃ এ হেন বিংশতি-অযুতযোজন বিস্তৃত কলেবর কাহার হইতে পারে? হে কেশব! আমি বুঝিয়াছি, তুমি মৎস্যরূপে অবতীর্ণ হইয়াছ। আর আমায় ক্লেশ দিও না। হে হৃষীকেশ! হে জগন্নাথ! জগদ্বাম! তমায় আমার নমস্কার। ১২-২৫।
মনু এই কথা কহিলে, মৎস্যরূপধারী ভগবান জনার্দ্দন কহিলেন,–হে নিষ্পাপ! সাধু সাধু, তুমি আমায় সম্যকরূপেই পরিজ্ঞাত হইয়াছ। হে মেদিনীপতে! এই সশৈলবনকাননা মেদিনী অচির কালমধ্যেই জলমগ্না হইবে। হে মহীমতে! আমি মহাজীবনিচয়ের রক্ষার জন্য নিখিল দেবগণদ্বারা এই এক নৌকা নির্ম্মাণ করাইয়াছি; সে সুব্রত! তুমিই ইহাতে যাবতীয় স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ ও জরায়ুজ প্রভৃতি অনাথ জীবদিগকে স্থাপন করিয়া এই আসন্ন জলপ্লাবন হইতে রক্ষা কর। হে নৃপ! এই নৌকা যৎকালে যুগান্ত-বাতে অভিহত হইবে, তখন তুমি আমার এই শৃঙ্গে উহাকে বাঁধিয়া রাখিবে। অনন্তর সমস্ত চরাচর জগতের লয় হইয়া গেলে, হে পৃথ্বীপতে! তুমিই সমস্ত জগতের প্রজাপতি হইবে। এইরূপে কৃতযুগের প্রারম্ভে তুমিই সর্ব্বজ্ঞ ধৃতিসম্পন্ন, মন্বন্তরধিপতি, নরপতি হইয়া সুরসমাজের সম্মানিত হইবে। ২৬-৩২।
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।
Leave a Reply