মহাভাগবত পুরাণ
প্রথম খণ্ড । প্রথম অধ্যায়
নারায়ন এবং নরোত্তম নর (১) ও সরস্বতী দেবীকে নমস্কার করিয়া জয় কীর্ত্তন করিবে।
যাঁহার আরাধারনা করিয়া বিধাতা এই স্থুল সূক্ষ্ম জগতের সৃষ্টি, হরি পালন এবং শিবরূপী দেব সংহার করেন; যিনি যোগিগণের ধ্যেয় বস্তু; মুনিগণ যাঁহাকে মূল প্রকৃতি (২) বলেন, এবং যাঁহার স্তব করিতে করিতে তত্ত্বজ্ঞানী হইয়া নিজ নিজ কৃতার্থতাও সম্পাদন করেন; সেই বিশ্বজননীর চরণে শত শত প্রণাম।
যিনি স্বর্গ এবং মোক্ষরূপ অতুল্যফলদাত্রী, যিনি নিজ ইচ্ছায় এই জতৎ সংসার সৃষ্টি করিয়া তন্মধ্যে স্বয়ং জন্মলাভ করত শম্ভুকে পতিত্বরূপে বরণ করিয়াছেন, কঠোর তপস্যা দ্বারা শম্ভু যাঁহাকে পত্নী লাভ করিয়া চরণদ্বয় হৃদয়ে ধারণ করিয়াছেন, হে শ্রোতৃবর্গ! সেই দেবী তোমাদিগকে রক্ষা করুন।
————-
১। “নারায়ণ’ অর্থাৎ, অবিধ্যার সংশ্রবশূণ্য, ব্রহ্ম; “নরোত্তম,” অর্থাৎ, জড়াদি হইতে উৎকৃষ্টতর “নর” অর্থাৎ জীবাত্মা; “সরস্বতী,” ঐ উভয়ের জ্ঞাপিকা বানী “জয়,” অর্থাৎ, যদ্দ্বারা সংসার জয় করা যায়, সেই গ্রন্থ। ভারতকীকায় নীলকন্ঠ।
২। অর্থাৎ, সকলের আদি কারণ।
————-
সূত ঋষির নৈমিষারণ্যে গমন
পরম-ধার্ম্মিক, বেদার্থবেত্তার অগ্রগণ্য সূত গোস্বামী যদৃচ্ছাক্রমে একদা নৈমিষাতণ্য ক্ষেত্রে উপস্থিত হইলে শৌনকাদি ঋষি জিজ্ঞাসা করিলেন, হে মহাত্মন্ সূত! আপনি বেদব্যাসের প্রিয় শিষ্য, এবং সর্ব্ব বেদের যথার্থ তত্বজ্ঞ; অতএব সম্প্রতি এরূপ কোন পুরাণ কীর্ত্তন করুন, যাহাতে স্বর্গ ও মোক্ষ, উভয়ই লাভ হয়; এবং যাহাতে বিশ্বজননী দুর্গা দেবীর মাহাত্ম্য, উত্তমরূপে প্রকাশমান আছে, যাহা শ্রবণ করিলে জ্ঞানহীন ব্যক্তিরও দুর্গা দেবীতে দৃঢ়তর ভক্তি উত্তেজিতা হয়।
সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! আপনারা পবিত্রময় ব্রহ্মবংশে জন্মলাভ করিয়া অনুরূপ কার্যানুষ্ঠানে তপস্যার পরা কাষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব আপনাদিগের পবিত্রময় হৃদয় হইতে এই প্রশ্নসার আবিষ্কৃত হইল। এই প্রশ্নসুধা শ্রবণপুটে পান করিয়া আমি কৃতার্থ হইয়াছি। অতএব অবশ্যই আপনাদিগের আজ্ঞা সম্পাদনে সমর্থ হইব। পূর্ব্বকালে যোগীশ্বর মহাদেব নারদকে যে মহাভাগবত নামক পরম গুহ্য পুরাণ কহিয়াছিলেন, বেদব্যাস তপোবলে সেই পুরাণ প্রাপ্ত হইয়া প্রথমতঃ ভক্তিযুক্ত জৈমিনি ঋষির নিকট আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করেন। এক্ষণে আমি সেই পুরাণরত্ন আপনাদিগের নিকট আবিষ্কার করিব; কিন্তু জানিবেন ইহা পরম যত্নেই শ্রোতব্য। এই পুরাণ পাঠে, কি শ্রবণে যে পূণ্যপুঞ্জ জন্মে, মহেশ্বর শত বর্ষেও তাহার সংখ্যা করিতে সমর্থ হন না, আমি কি প্রকারেই বা তাহার পূণ্যসীমা কহিতে পারিব।
সূতের এই বাক্য শুনিয়া মহর্ষিগণ সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং আশ্চার্য্যাম্বিত হইয়া সকলে পুনর্ব্বার কহিতে লাগিলেন, হে মুনিশ্রেষ্ঠ সূত! যে প্রকারে এই মহা পুরাণ ধরাতলে প্রকাশ পাইল, তাহা সবিস্তারে কীর্ত্তন করুন।
সূত গোস্বামী তখন কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, মহর্ষিগণ! শ্রবণ করুন। যিনি বেদ সকলের অদ্বিতীয় তত্ত্বজ্ঞ; যিনি অশেষদ ধর্ম্ম-শাস্ত্রের পারদর্শী, অথচ সদ্বক্তা; যিনি সকল কলাভিজ্ঞ, মহাবুদ্ধিমান; এবং তত্ত্বজ্ঞানী; সেই ধর্ম্মবিৎ ভগবান বেদব্যাস একদা চিন্তা করিলেন, আমি সপ্তদশ মহাপুরাণ প্রস্তুত করিয়া আনন্দিত হইয়াছি; কিন্তু ইহাকে পূর্ণানন্দের উদয় বলা যায় না; (কারণ) তাহা হইলে হৃদয় পরিতৃপ্তি হইত; আর কোন বিষয়ে স্পৃহা থাকিত না। অতএক ভগবতীয় পরম তত্ত্বমাহাত্ম্য যাহাতে বিস্তীর্ণ আছে, পিতার নিকট শুনিয়াছি যার পর পরম মহাপুরাণ আর নাই, আমি কি প্রকারেই বা সেই পুরাণরত্ন সংগ্রহ করিব? মহাযোগী মহেশ্বরও অনায়াসে যাহার পরম তত্ত্ব জানিতে পারেন না, সেই পরমেশ্বরীর পরম তত্ত্ব আমার হৃদয়ে যে উদয় হইবে, ইহা অত্যন্ত অসম্ভব!
(ঋষি) এইরূপ চিন্তা করত নিতান্ত ক্ষুব্ধচেতা হইলেন; আবার বিবেচনা করিলেন, তপস্যা অসাধ্য কিছুই নাই; সর্ব্বশাস্ত্রেই ইহার প্রমাণ করিয়াছে।
এইপ্রকার অবধারণ করত তপস্যায় কৃতনিশ্চয় হইয়া, সেই মহানুভব বেদব্যাস হিমালয় পর্ব্বতে গমন করিয়া দুর্গা-ভক্তি-পরায়ণ হইয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন।
বেদব্যাসের প্রতি দৈববাণী
পরাশরসন্তান ব্যাসদেব বহুকাল কঠোর তপস্যা করিলে, ভক্তবৎসলা সর্ব্বাণী সন্তুষ্টা হইয়া অদৃশ্যরূপে আকাশপথে থাকিয়া বলিলেন, হে মহর্ষে! যে স্থানে বেদচতুষ্টয় আছেন, তুমি সেই ব্রহ্মলোকে গমন কর, আমার নির্ব্বিকার পরম তত্ত্ব জানিতে পারিবে। শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক স্তবপাঠে আমি দৃষ্টিগোচরা হইয়া তোমার অভিলাষ পরিপূর্ণ করিব।
বেদব্যাস এই প্রকার আকাশ বাণী শুনিয়া সত্বরেই ব্রহ্মলোকে গমন করিলেন। তথায় বিরাজমান বেদচতুষ্টয়্র অগ্রে বিনয়াম্বিত হইয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণামপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শ্রুতিগণ! ব্রহ্ম তত্ত্ব কি, তাহা প্রকাশ করিয়া এই শরণাগত শিষ্যের সংশয় ছেদ করত কৃতার্থ করুন।
মহর্ষির ঐপ্রকার বিনয় বাক্যে বেদচতুষ্টয় দয়ার্দ্র-হৃদয় হইয়া প্রত্যেকেই ব্রহ্মতত্ত্ব বলিতে লাগিলেন।
চতুর্ব্বেদের ব্রহ্মতত্ত্বকথন
ঋগ্বেদ বলতেছেন । স্থূল সূক্ষ্ম এই সমস্ত জগত প্রপঞ্চ যাঁহাতে সূক্ষণ রূপে বিলীন থাকে, আরবার ক্ষণকাল মাত্রেই যাঁহার ইচ্ছানুসারে সচরাচর জগৎ হইয়া প্রকাশমান হয়, যিনি স্বয়ং ভগবতী শব্দে কীর্ত্তিতা হন, সেই পরম তত্ত্ব।
যজুর্ব্বেদ বলিতেছেন । নিখল যজ্ঞ এবং যোগদ্বারা যিনি স্তূয়মান হন, এবং যাঁহাতে আমরা ধর্ম্ম বিষয়ে প্রমাণ স্বরূপ হইয়াছি, সেই অদ্বিতীয়া স্বয়ং ভগবতীই পরম ব্রহ্ম তত্ত্ব।
সামবেদ বলিতেছেন । যাহার দ্বারা এই বিশ্ব সংসার ভ্রমবিলষিত হইতেছে, যোগিগণের যোগচিন্তায় যিনি চিন্তনীয়া হন, যাঁহার তেজঃপ্রভাতেই সমস্ত জগৎ প্রকাশ পাইতেছে, সেই জগন্ময়ী দুর্গাই পরং তত্ত্ব।
অথর্ব্ব বেদ কহিতেছেন । ভক্তি দ্বারা যাঁহার অনুগ্রহাশ্রিত লোকেরাই যাঁহাকে বিশ্বেশ্বরী স্বরূপে দেখিতে পায়, যাঁহাকে ভগবতী দুর্গা-শব্দে বলে, সেই পরং ব্রহ্ম তত্ত্ব।
সূত কহিতেছেন শ্রুতিগণের এইপ্রকার বাক্য শ্রবণ করিয়া মহর্ষি ব্যাস ভগবতী দুর্গাকেই পরম ব্রহ্মরূপে নিশ্চয় করিলেন। শ্রুতিগণ পুনর্ব্বার মহর্ষিকে বলিলেন, হে তপোধন! আমরা যে প্রকার বলিলাম, তোমাকে অবিলম্বেই সেইপ্রকার রূপ দর্শন করাওতেছি। এই কথা বলিয়া দেবগণ সকলেই একবাক্য হইয়া সেই চিচানন্দরূপা সর্ব্বদেবময়ী পরমেশ্বরীর স্তব করিতে লাগিলেন।
শ্রুতিগণ কর্ত্তৃক ব্রহ্মময়ী দুর্গার স্তব
হে বিশ্বময়ি দুর্গে! অনিত্য সংসারমধ্যে আপনিই পরমা প্রকৃতি; ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি আপনার শক্তি দ্বারা এই অসীম জগতের সৃষ্টাদিকার্য্য সাধন করিতেছেন। মা! আপনি সকলের বিধাতা হইয়াও নির্বিধাতা; আপনার চরণ সেবা করিয়া হরি দুর্জ্জয় দানবদিগকে অবলীলাক্রমে সংহার করেন; এবং মহাদেব কালকূট হলাহল পান করিয়া আপনার কৃপাবলে জীবিত আছেন, আপনি জগতের অতীত এবং বাক্য মনের অগোচর; আর, পরম পবিত্র; আমাদিগের কি সাধ্য আপনার মহিমা কীর্ত্তন করি! পরম পুরুষ দেহাভিমানী ও অহংভাবাপন্ন হইলে আপনার মায়ায় বশীভূর হন। হে দেবী অম্বিকে! আপনাকে আমরা প্রণাম করি। জগতে স্ত্রী পুরুষ প্রভৃতি যত রূপ ও বস্তু আছে, সে সকল আপনার মূর্ত্তি; কিন্তু আপনি সে সকলেরই অতীতা, সমাধিভাবাপন্ন মনোমাত্রের গোচর পরং ব্রহ্মরূপিণী। হে জননি! যখন আপনার সৃষ্টির ইচ্ছা হয়, তখন শক্তি দ্বারা মূর্ত্তি পরিগ্রহ করেন; যেরূপ জল হইতে করকার উৎপত্তি হয়, সেই রূপ আপনার শক্তি হইতে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উদয় হয়; অতএব জ্ঞানী ব্যক্তি আপনার মায়াশক্তিকেই ব্রহ্ম বলিয়া নিরূপণ করেন। দেহের মধ্যে যে ষট্চক্র আছে, তাহাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি যে পরম দেবতাগণ বিরাজমান আছেন, তাঁহারাও আপনার শক্তিলাভ ব্যতীত, শবের ন্যায় অকর্ম্মণ্য। হে বিশ্বময়ি! দেবতার একান্ত-বন্দিত যে আপনার পদদ্বয়, তাহার শক্তিতেই নিখিল জগতের সমুদয় কার্য্য সাধিত হয়; অতএব, হে শক্তিরূপিণি দুর্গে দেবি! আমাদিগের প্রতি অনুকম্পা বিতরণ করুন।
ব্রহ্মময়ীর নানাপ্রকার রূপধারণ
ইত্যাদি প্রকারে দেবগণ বহুবিধ স্তব করিলে পর, জগতের আদিভূতা সেই ব্রহ্মসনাতনী প্রসন্না হইয়া বেদানুগৃহীত বেদব্যাসকে আপনার কতকগুলি রূপ দর্শন করাইলেন।
যে দেবী জ্যোতিঃ স্বরূপে সকল প্রাণীতে অবস্থিতি করেন, তিনিই বেদব্যাসের সংশয়চ্ছেদ করিএ স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আকৃতি ধারণ করিতে লাগিলেন;–প্রথমত দিব্য অস্ত্র দ্বারা বুভূষিত-সহস্র-বাহুযুক্ত; আভা সহস্র সূর্যের; কোটি চন্দ্রের সমান শান্ত জ্যোতির্ম্ময়ী; কখন সিংহ বাহনে, কখন শবাসনে; চতুর্ব্বাহু যুক্তা; নবীন মেঘ মালার ন্যায় নীলকান্তি। কখন দ্বিভুজা; কখন দশভূজা; কখন অষ্টাদশভুজা; কখন শতভুজা; কখন অনন্তবাহুযুক্তা দিব্যরূপধারিণী। কখন বিষ্ণুরূপা, বামভাগে কমলা। কখন কৃষ্ণরূপা, বামে গোপাঙ্গনা। কখন ব্রহ্মরূপা, বামাংশে সাবিত্রী। কখন শিবরূপা, সঙ্গে শিবানী।
এই প্রকারে সেই সর্ব্বরূপিণী ব্রহ্মময়ী অনেকপ্রকার রূপ ধারণ করিয়া বেদব্যাসের সন্দেহ দূর করিলেন।
বেদব্যাসের পুরাণ দর্শন
সূত কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! সেই পরাশরসন্তান বেদব্যাস জগদম্বার বিবিধ-বেশ-বিভূষিত, পরম সুন্দর রূপনিকর দর্শন করিয়া, ভগবতী দুর্গাকেই পরমব্রহ্ম্রূপে নিশ্চয় করিলেন; এবং সাক্ষাৎ ব্রহ্মময়ীকে দর্শন করিয়া, মহর্ষি জীবম্মুক্তও হইলেন। অনন্তর সেই অন্তর্যামিনী জগদম্বা, বেদব্যাসের অভিলাষপূরণের জন্য, একটি নির্ম্মল কমলোপরি মনোহর-কেলিযুক্ত রূপধারণ করিলে, বেদব্যাস সেই কমলের সহস্র দলে পরমাক্ষর-যুক্ত, মহাভাগবতনামক পুরাণ দর্শন করিলেন।
বেদব্যাস এইরূপে কৃতকৃত্য হইয়া, পরমদেবীকে নানাবিধ স্তব, এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়া, পরমাহ্লাদে স্বাশ্রমে আগমন করিলেন।
অনন্তর তিনি ক্রমে ক্রমে জৈমিনি প্রভৃতি তত্ববুভুৎস্য শিষ্যগণের নিকট সেই পরমাক্ষর-যুক্ত, মহা পুরাণ, পদ্মদলের মধ্যের যদ্রুপ দেখিয়াছিলেন, তদনুরূপ প্রকাশ করিয়াছেন। পরমকরুণিক বেদব্যাস দয়া করিয়া আমাকেও কহিয়াছিলেন; আমি শ্রবণ করিয়াছি, ও তাঁহার কৃপাবলে সমগ্রই স্মৃতিপথে রাখিয়াছি। অদ্যাবধি আপনাদিগের নিকট সেই পুরাণ সংকীর্ত্তন করিব; সহস্র অশ্বমেধ, শত শত বাজপেয়, এই মহাভাগবতের ষোড়ষাংশের তুল্যও নহে। মহাপাতকী পর্য্যন্ত লোক সকলের পরিত্রাণের নিমিত্ত এই মহাপুরাণ ক্ষিতিতলে প্রকাশ হইয়াছে।
প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।
Amritendu Mukhopadhyay
মহাভাগবত পুরাণ আর শ্রীমদ্ভাগবদ পুরাণ আলাদা আলাদা। মহাভাগবত পুরাণ একটি উপপুরাণ; শাক্তদের। শ্রীমদ্ভাগবদ মহাপুরাণ; এটা বৈষ্ণবদের।