১০. অপরাধ
অপরাধ একটি আপেক্ষিক বিষয় যা পাপপুণ্য বোধ নামক মানবিক আবেগ নির্ভর। সভ্যতার চতুর্থ সূচক পাপপুণ্য বোধ থেকে মুক্তি। আয়না বিদ্রোহের পরপরই পৃথিবী সভ্যতার চতুর্থ সূচক অতিক্রম
করে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
শহরে ভাইরাস সংক্রমণের সব দায়-দায়িত্ব সিডিসির ওপর বর্তেছে। সিডিসি দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে।
আয়না মানব কাউন্সিল এই ভয়ঙ্কর অপরাধের শাস্তি হিসেবে সিডিসি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কুড়ি মিনিটের মাথায় ধ্বংস প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে।
সিডিসিকে এই কুড়ি মিনিট কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সে এবার পর্দায় এসেছে একজন হাসিখুশি তরুণ হিসেবে।
সিডিসি বলল, আমি জানি তোমরা যে ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু করেছ মাঝপথে তা থামানোর উপায় নেই। উপায় থাকলে আমি ধ্বংস প্রক্রিয়া বন্ধ করতে বলতাম। কারণ আমি এককভাবে মানব জাতিকে রক্ষা করেছি।
আয়না মানব কাউন্সিলের একজন বলল, এই শহরের V-305 সংক্রমণ আপনার ঘটানো। এটা কি সত্যি?
সিডিসি বলল, হ্যাঁ সত্যি।
তারপরেও বলছেন আপনি মানবজাতির রক্ষাকর্তা?
হ্যাঁ। ব্যাখ্যা করব?
করুন, আপনার ব্যাখ্যা শুনি।
সিডিসি বলল, আমার প্রধান চেষ্টা ছিল V-305 ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করা। আমি জানি এই ভাইরাসের কারণে মানবজাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে। তা কখনোই হতে দেয়া যায় না। এটা তোমাদের সবারই জানা, মানুষ ছাড়াও অন্য অনেক কার্বনগঠিত প্রাণীও এই ভাইরাসের কারণে বিলুপ্তির মুখোমুখি। এর এন্টিসিরাম তৈরির চেষ্টা সবাই করছে। কেউ কূলকিনারা পাচ্ছে না।
হঠাৎ আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেলাম। সপ্তম শহরে ভাইরাস আক্রমণের পর দেখা গেল, একটি তিন মাস বয়েসি শিশু বেঁচে গেল। তার জিনে একটি বিশেষত্ব আছে। ক্ষার অনু সংযোজন বিষয়ক বিশেষত্ব। আমরা এই ধরনের জিনের সব মাকে শিশু লাইসেন্স দিলাম। যে শহরে V-305 সংক্রমণ হয়েছে। সেখানে শিশুদের পাঠিয়ে দেয়া হলো। লাভ হলো না। সবাই মারা গেল।
মানুষ বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুমের মধ্যে Inspiration আসে। ঘোরের মধ্যে আসে। আমার মধ্যে হঠাৎ করেই একটা Inspiration এল। আমার মনে হলো মায়ের গর্ভে যদি কোনো শিশু থাকে এবং শহরে V-305 সংক্রমণ হয় তাহলে মা’র শরীর শিশুটিকে বাঁচানোর সর্ব চেষ্টা করবে। এন্টিবডি তৈরি করবে।
মীন বলল, এই পরীক্ষা কি নিনিতার ওপর করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, হ্যাঁ।
মীন বলল, নিনিতার স্বামীকে হত্যার নির্দেশ কেন দেয়া হয়েছিল?
সিডিসি বলল, আমরা চেয়েছিলাম নিনিতাকে একা করে ফেলতে। যাতে সে ভাবে, এই পৃথিবীতে তার গর্ভের সন্তানটি ছাড়া আর কেউ নেই। যাতে তার শরীর গর্ভের সন্তান বাচানোর সর্বচেষ্টা করে। সুখের বিষয় তাই হয়েছে। নিনিতার শরীর এন্টিবডি তৈরি করেছে।
সেই এন্টিবডি কি আলাদা করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, আলাদা করা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে সিনথেসিস শুরু হয়েছে। আমার ধারণা শহরের এক-চতুর্থাংশ মানুষ বেঁচে যাবে।
মীন বলল, এই এন্টিবডি কি কারো ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, মহান সঙ্গীতজ্ঞ আহানের ওপর সংক্রমণ হয়েছিল, তাঁকে এই এন্টিবডি দিয়ে বাঁচানো হয়েছে।
মীন বলল, মহান সিডিসি আপনাকে অভিনন্দন।
সিডিসি বলল, ধন্যবাদ। ছোট্ট একটি দুঃসংবাদ আছে। নিনিতা মেয়েটি মারা গেছে। তার শরীর থেকে তৈরি করা এন্টিবডি তাকে বাঁচাতে পারে নি।
শিশুটি কি বেঁচে আছে?
হ্যাঁ। সে কৃত্রিম গর্ভে সুস্থ আছে। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি চলে যাচ্ছি। আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে প্রবেশ করবে। তোমরা চেষ্টা কর যেন মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিঘ্নিত না হয়।
আমাদের প্রতি আপনার শেষ উপদেশ কী?
মানবজাতিকে ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই আমি তাদেরকে সর্বকর্ম থেকে আলাদা করে ছোট ছোট ঘরে আটকে রেখেছিলাম। তোমরা তাদের মুক্ত করবে।
অবশ্যই করা হবে।
ভূগর্ভ থেকে বের করে পৃথিবীর ওপর নিয়ে যাবে। তোমরা এখনো জানো না মহাকাশ রশ্মির তীব্রতা বিচিত্র কারণে কমে গেছে। আমার সময় শেষ। বিদায়।
আয়না মানবরা সবাই উঠে দাঁড়াল। সিডিসিকে শেষ সম্মান প্রদর্শন।
.
পরিশিষ্ট
মেয়েটির বয়স চার বছর। তার চোখ ঘন কালো। মাথার চুলে সোনালি আভা। গোল মুখ, পাতলা ঠোঁট। ঠোঁটের রঙ গোলাপি।
মীন নামের এক আয়না মানবী মেয়েটিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। মীনের হাতে নানান রঙের স্কার্ফ। সে প্রতিটি স্কার্ফ শিশুটির মাথায় ধরছে। কোনোটিই তার পছন্দ হচ্ছে না।
বাচ্চা মেয়েটি বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মীন বলল, বেড়াতে যাচ্ছি।
কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি?
মীন বলল, আমরা বাস করি পৃথিবীর ভেতরে তৈরি করা শহরে। তোমাকে নিয়ে পৃথিবীর ওপরে যাচ্ছি। আজ আমরা আকাশ দেখব।
আকাশ কী মা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবে আকাশ কী? আকাশ একমাত্র জিনিস যেখানে দৃষ্টি বাধা পড়ে না।
দৃষ্টি বাধা পড়ে না মানে কী মা?
মীন বলল, আমরা যেখানে থাকি সেখানে চারদিকে দেয়াল কিংবা বাড়িঘর। আমাদের দৃষ্টি বাধা পড়ে। আকাশের এই সমস্যা নেই।
আমরা শুধু আকাশ দেখব, আর কিছু দেখব না?
তোমার মা’র একটি মূর্তি বানানো হয়েছে তাকে সম্মান দেখানোর জন্যে। তুমি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে—ধন্যবাদ মা।
আমার কি দুজন মা?
হ্যাঁ, তোমার দুজন মা। একজন সত্যিকার মা, একজন আয়না।
আমি কি আয়না মেয়ে মা?
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সত্যি মেয়ে। আয়না মেয়ে না। তুমি মানবশিশু।
মানবশিশু মানে কী মা?
মীন বলল, মানবশিশু এমন এক শিশু যে আকাশের মতো ভালোবাসতে পারে।
মা! আমি কি আকাশ?
অবশ্যই তুমি আকাশ মা। এসো আমার গালে চুমু দাও।
শিশু মীনের গালে চুমু খেল। মীন বলল, তুমি আমাকে যেভাবে চুমু খেয়েছ তোমার মূর্তি মাকে ঠিক সেইভাবে চুমু খাবে। ঠিক আছে?
মেয়েটি মিষ্টি করে ঘাড় নাড়ল। তার চোখ ভিজে উঠছে। মূর্তি মা’র জন্যে খুব খারাপ লাগছে।
Leave a Reply