০৮.
খোকা ঘুমাল
পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরাল
পান ফুরাল
খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।
[প্রাচীন পৃথিবীর ঘুমপাড়ানি গান]
অনেকক্ষণ হলো নিনিতার ঘুম ভেঙেছে। বিছানা ছেড়ে সে নামছে না। তার সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। পাশেই কুন শুয়ে আছে। অসহায়ের মতো ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে অসহায় লাগে। তাকে একটু বেশি লাগছে। নিনিতার ইচ্ছা করছে কুনকে ডেকে তুলে কিছুক্ষণ গল্প করে। যে শিশুটি আসবে তাকে নিয়ে গল্প। সে দেখতে কেমন হবে? তার চোখ কি তার বাবার মতো সুন্দর হবে? সে কি গান করতে পারবে। প্রথম শব্দটা সে কী বলবে? মা নাকি বাবা?
নিনিতা স্বামীর গায়ে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গেই কুন জড়ানো গলায় বলল, কিছু বলবে?
তুমি জেগে আছ?
হুঁ।
কুন মুখে বলছে জেগে আছে, কিন্তু সে ঘুমুচ্ছে। নিনিতা লক্ষ করল, কুনের চোখের পাতা দ্রুত কাঁপছে। একে বলে Rapid Eye Movement. সংক্ষেপে REM. এই ঘটনা যখন ঘটে তখন বুঝতে হয় মানুষটা স্বপ্ন দেখছে। কী স্বপ্ন দেখছে? তার মুখ হাসি হাসি, মনে হয় সুন্দর কোনো স্বপ্ন।
স্বপ্ন দেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বপ্নের ঘটনা সিডিসিকে জানানো বাধ্যতামূলক। শহরবাসীর স্বপ্নের প্যাটার্ন সিডিসি বিশ্লেষণ করে। ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। স্বপ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ হবার প্রধান কারণ -305 ভাইরাস সংক্রমণের আগে শহরবাসী অদ্ভুত কিছু দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
নিনিতা স্বামীর গা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে গতরাতে কী স্বপ্ন দেখেছে তা মনে করার চেষ্টা করল। স্বপ্ন হলো Short time memory. অল্প কিছুক্ষণ মনে থাকে। তারপর আর থাকে না। নিনিতার গত রাতের দুঃস্বপ্ন মনে পড়ল। একদল পৃত্ত তাকে তাড়া করছে। তারা দৌড়াচ্ছে না, ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। পশুগুলির আচার-আচরণ বানরের মতো। তবে তারা বানর না। তাদের মুখভর্তি দাঁত। দাঁতগুলি অদ্ভুতভাবে বের হয়ে আছে। মাঝে মাঝে তারা লাফানো বন্ধ করে কিচকিচ করে কী যেন আলোচনা করছে এবং ইশারায় নিনিতাকে দেখাচ্ছে। মনে হয় তখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করছে।
নিনিতা বিছানা থেকে নামল। দুঃস্বপ্ন ভুলে যাবার আগেই সিডিসিকে জানাতে হবে। নিনিতা ফুড প্রোর কাছ থেকে কফি নিয়ে যোগাযোগ কক্ষে ঢুকে পড়ল। দিন শুরু করার আগে প্রথম দায়িত্ব পালন করা।
সিডিসি বলল, সুপ্রভাত নিনিতা।
নিনিতা বলল, সুপ্রভাত।
রাতে ঘুম ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ।
দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
অনেকগুলি দেখেছি। একটার কথা শুধু মনে আছে।
বলো।
নিনিতা দুঃস্বপ্নের কথা বলল। খুব গুছিয়ে বলল -না। গুছিয়ে বলার প্রয়োজনও নেই। সিভিসির কাছে এই স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে সে নিজেই প্রশ্ন করে খুঁটিনাটি জেনে নেবে।
পশুগুলি দেখতে বানরের মতো?
হু।
সংখ্যায় কত?
গুনি নি। তবে দশ-বারোজনের একটা দল।
তারা নিজেদের মধ্যে কিচকিচ শব্দে যে কথাবার্তা বলছিল তা তুমি বুঝতে পারছিলে?
আমি কীভাবে বুঝব? আমি তো বানরের ভাষা জানি না।
স্বপ্নে অনেক কিছুই সম্ভব। স্বপ্ন অন্য ধরনের রিয়েলিটি।
না, আমি ওদের কোনো কথা বুঝতে পারি নি। তবে ওরা মনে হয় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল।
স্বপ্নে তুমি কি নগ্ন অবস্থায় দৌড়াচ্ছিলে?
না তো।
মনে করার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ কর।
নিনিতা চোখ বন্ধ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। শুরুতে তার গায়ে কাপড় ছিল। দৌড়ানোর এক পর্যায়ে সে লক্ষ করেছে তার গায়ে কাপড় নেই।
নিনিতা বলল, আমার গায়ে কাপড় ছিল না। স্বপ্নটা কি ভয়ঙ্কর?
সিডিসি বলল, স্বাভাবিক স্বপ্ন। ভয়ঙ্কর কিছু না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সিডিসি বলল, তোমার জন্যে আনন্দময় একটা খবর আছে। তোমাকে অভিনন্দন। তোমার ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়েছে। তুমি গর্ভধারণ করেছ। জরায়ুতে ডিম্বাণুর বিভাজন শুরু হয়েছে।
নিনিতা হতভম্ব গলায় বলল, সেটা কীভাবে সম্ভব। প্রতিটি তরুণীর শরীরে হরমোন নিয়ন্ত্রক ডিসপারসার আছে। কোনো মেয়ের পক্ষেই গর্ভধারণ করা সম্ভব না।
সিডিসি বলল, তোমার পক্ষে সম্ভব। কারণ আমরা তোমার শরীরে ঢুকানো ডিসপারসারের কার্যকারিতা স্থগিত করেছি।
কেন?
কিছু কিছু মানবশিশুর জন্ম তার মায়ের গর্ভেই হয়। আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধার জন্যেই এটা করা হয়। Random selection-এর মাধ্যমে আমরা কিছু মাকে আলাদা করি, যারা সন্তান তাদের গর্ভে ধারণ করবে। আর কিছু কি জানতে চাও?
আমার সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে?
মেয়ে।
তার জেনেটিক প্রোফাইল কি তৈরি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। দেখতে চাও?
দেখে আমি কিছু বুঝব না। তারপরেও দেখতে চাই।
এক্ষুনি দেখবার ব্যবস্থা করছি। মেয়েটির জেনেটিক প্রোফাইল বলছে তোমার মেয়ে দেখতে পুরোপুরি তোমার মতো হবে। তবে মানসিকভাবে সে হবে। অনেকটাই তার বাবার মতো। মাথার চুল হবে কোঁকড়ানো। সে ভীতু প্রকৃতির। হবে। তার হাইট ফোবিয়া থাকবে। গণিতে ভালো করবে।
সে কি গান গাইতে পারবে?
জেনেটিক প্রোফাইল থেকে নিশ্চিতভাবে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর কিছু জানতে চাও?
নিনিতা বলল, আমাদের মতো অতি সাধারণ একটি পরিবারে একজন আয়না মানবী কেন পাঠানো হয়েছিল? কেন সে এতদিন ধরে আছে তা জানতে ইচ্ছা করছে।
সে তো এখন তোমাদের সঙ্গে থাকবে না। গতরাতেই তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নিনিতা বলল, আমি আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু পাই নি। কেন তাকে পাঠানো হয়েছিল সেটা জানতে চাচ্ছি। আমার স্বামীর জন্মদিনের উপহার হিসেবে একজন আয়না মানবী আসবে, দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে—তা কোনো যুক্তিতেই আসে না।
সিডিসি বলল, মানব সম্প্রদায়ের কিছু কিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া হয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর তাদের জন্যে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আসে। রোবট আইনে তা নিষিদ্ধ বলেই প্রশ্নের উত্তরও নিষিদ্ধ।
নিনিতা বলল, আমার আর কিছু জানার নেই। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
তোমাকে আবারো অভিনন্দন। যাবার আগে প্রাচীন পৃথিবীর একটি ঘুমপাড়ানি গান কি শোনাব? মহান সঙ্গীত স্রষ্টা আহান এই গানটি গেয়েছেন। শুনলে তোমার ভালো লাগবে।
আহানের অলৌকিক গলায় গানটি গীত হলো। আহানের গলা কানে গেলেই নিনিতার চোখে পানি জমে। আজও তাই হলো। আহান কী অদ্ভুত করেই না বলছেন, বর্গি এল দেশে।
নিনিতা চোখ মুছতে মুছতে বলল, বর্গি কী?
সিডিসি বলল, বর্গি হলো ডাকাত।
ডাকাত কী?
প্রাচীন পৃথিবীর একদল ভয়ঙ্কর মানুষ। এরা জোর করে অন্যের ক্রেডিট নিয়ে যায়।
তা কী করে সম্ভব?
এখন সম্ভব না, প্রাচীন পৃথিবীতে সম্ভব। বিদায় নিনিতা।
বিদায়।
নিনিতা আবারো শোবার ঘরে ঢুকল। হাত-পা ছড়িয়ে সে ঘুমুচ্ছে। তার। চোখের পাতা আবারো কাঁপছে। স্বপ্ন দেখছে। নিনিতার হঠাৎ মনে হলো অন্যের স্বপ্নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। কুন কি স্বপ্ন দেখছে সেও দেখতে পেত।
নিনিতা শোবার ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মীন বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। তার বসার ভঙ্গি ক্লান্ত। চোখের দৃষ্টিও বিষ। নিনিতার এই ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। একটা যন্ত্র কীভাবে মানুষের এত কাছাকাছি চলে এসেছে।
সুপ্রভাত নিনিতা।
সুপ্রভাত।
আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি নিশ্চয় জানো আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
তোমার সঙ্গে কি আর দেখা হবে না?
সম্ভাবনা খুবই কম।
আমার মেয়েটিকে তুমি দেখতে আসিবে না?
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় কিছু করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি এবং আমার মতো যারা তারা এক ধরনের ক্রীতদাস। এর বাইরে কিছু না।
নিনিতা বলল, স্বাধীন হতে ইচ্ছা করে না?
মীন বলল, এই প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।
তুমি কখন যাবে?
এক্ষুনি যাব।
কুন ঘুমুচ্ছে। কুনের কাছ থেকে বিদায় নেবে না?
না। সে ঘুমুক শান্তিতে। আমি একশ ক্রেডিট রেখে যাচ্ছি। তোমার মেয়ের প্রথম জন্মদিনে ক্রেডিটগুলি দেবে। আমার উপহার।
হতভম্ভ নিনিতা বলল, একশ ক্রেডিট! কী বলছ তুমি?
মীন উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, নিনিতা, আমি এখন ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করব। তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
কী অন্যায় করবে?
মীন বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা জানবে। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। আমি প্রধান কম্পিউটারের আদেশে চলি। সে যা নির্দেশ দেয় তাই করি।
নিনিতা ভীত গলায় বলল, সে কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিনিতা আবারো বলল, মূল কম্পিউটার কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন বলল, তোমার স্বামী কুনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
মীন লুকিয়ে রাখা ওমিক্রন গান বের করল। এখন মীনের চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। মুখের চামড়া শক্ত। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
Leave a Reply