০৫. ক্রেজি টিটান
বৃহস্পতির উপগ্রহ টিটানের বিশেষ এক ধরনের
গুলোর শিকড় থেকে প্রস্তুত
পানীয়। বিশ্বব্রহ্মারে তিনটি সেরা পানীয়র একটি। এই পানীয় আনন্দময় মাদকতা, স্বপ্নাচ্ছন্নতা তৈরি করে। কিছু মাত্রার হেলুসিনেশনও তৈরি হয়। বলা হয়ে থাকে, ক্রেজি টিটান পানের
অভিজ্ঞতা বর্ণনার অতীত।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
পৃষ্ঠা ৭০০০ (খাদ্য ও পানীয়)
বড় ধরনের দুর্ঘটনার সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। কুন মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে পারছে না। সে ভেবেই পাচ্ছে না নিনিতা কীভাবে পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপস্থিত হলো। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করতে পারছে না। পুনর্বাসন কেন্দ্র যোগাযোগের বাইরে। কেউ চেষ্টা করলে বড় ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তারপরেও সে শহরের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। শহরের মেয়র (রোবট, টাইপ T3} অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বলেছেন, পুনর্বাসন কেন্দ্র মেয়রের এলাকার বাইরে। আমি কোনো সাহায্যই করতে পারছি না। আপনার অস্থিরতা বুঝতে পারছি, তবে অস্থিরতা দূর করার ব্যবস্থা করতে না পেরে লজ্জিত বোধ করছি।
মীনকে নির্বিকার মনে হচ্ছে। সে দশ রঙের লিপস্টিক নিয়ে বসেছে। ঠোঁটে দিচ্ছে এবং মুছে ফেলছে। আয়নায় দেখছে। তার আচার-আচরণ মোটেই রোবটের মতো না। আর দশটা মেয়ের মতো। যেন এই মুহূর্তে সাজ করাটা জরুরি। বড় কোনো উৎসবে যাবার পূর্বপ্রস্তুতি।
কুন বলল, তোমার রূপচর্চায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
মীন তার দিকে না তাকিয়েই বলল, হ্যাঁ।
আমি খুবই অস্থির বোধ করছি। আমার অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করতে পার?
মীন এবার তার দিকে তাকাল। স্পষ্ট গলায় বলল, না। কারণ তোমাকে অস্থির করার জন্যেই ঘটনা সাজানো হয়েছে।
তার মানে?
সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত।
বুঝিয়ে বলো।
তোমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হবে। মা-কেন্দ্রে যাবে। তার ডিম্বাণু দিয়ে আসবে। পথ হারিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপস্থিত হবে। সবই সাজানো।
কে সাজিয়েছে?
মূল কম্পিউটার সিডিসি।
কেন সাজিয়েছে?
এই অংশটি আমার কাছে পরিষ্কার না। তবে আমি চিন্তা করছি। কিছু বের করতে পারলেই তোমাকে বলব। আমার উপদেশ হচ্ছে—তুমি সাজানো একটি ঘটনার একজন। এখানে অস্থির হওয়া কোনো কাজের কথা না। আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ঠোঁটে এই নীল রঙটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?
কুৎসিত লাগছে। তোমাকে মাছ মাছ মনে হচ্ছে।
মাছের ঠোঁট নীল না, আমাকে মাছ মাছ কেন লাগবে?
কেন লাগবে এই উত্তর আমার কাছে নেই। আমার কাছে মাছ মাছ লাগছে।
মেয়েরা ঠোঁটে কেন রঙ লাগায় জানো?
না।
ঠোঁটকে বিশেষভাবে আলাদা করতে চায়। যেন ঠোঁটকে মনে হয় শরীরের বাইরের একটি অংশ।
আমাকে এইসব কেন শোনাচ্ছ?
তোমার অস্থিরতা কমানোর জন্যে শোনাচ্ছি।
আমার অস্থিরতা কমছে না।
মীন একটু ঝুঁকে এল কুনের দিকে। সে গলা নামিয়ে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, এই মুহূর্তে তোমার স্ত্রী আশেপাশে নেই। একজন অতি রূপবতী তোমার পাশে বসে আছে। একজন বুদ্ধিমান পুরুষ হিসেবে সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত না?
আমি বুদ্ধিমান না।
মীন হালকা গলায় বলল, তুমি বুদ্ধিমান কিনা এক্ষুনি টের পাব! আচ্ছা বলো, আগের কথাগুলি আমি ফিসফিস করে কেন বলেছি? আর কেউ পাশে নেই। ফিসফিসানি অপ্রয়োজনীয়। তারপরেও কেন ফিসফিস করে কথা বললাম?
জানি না।
অতি প্রাচীনকালে মানুষ যখন বনেজঙ্গলে ঘুরত, তখন কোনো বিপদ দেখলেই একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে সতর্ক করত। এই ঐতিহাসিক ব্যাপারটি মানুষ তার জিনে করে নিয়ে এসেছে। এখনো কেউ যখন ফিসফিস করে, তখন পাশের জন সতর্ক হয়ে যায়। তার চিন্তাভাবনা স্থির হয়ে যায়। সময় তার কাছে থেমে যায়।
কেন এইসব আমাকে শোনাচ্ছি?
আমার প্রতি তোমাকে কৌতূহলী করার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা সাজানো ঘটনার এটাও একটা অংশ। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তুমি আমার প্রতি কৌতূহলী হবে। হয়তো অতি ঘনিষ্ঠ কিছু সময় আমার সঙ্গে কাটাবে।
এই কাজ আমি কখনো করব না। একটা যন্ত্রকে আমি ভালোবাসব না, তাকে বিছানায় নিয়ে যাব না।
তোমার স্ত্রী এবং তুমি তোমরাও কিন্তু যন্ত্র। খুব যে নিখুঁত যন্ত্র তাও না। তোমাদের তুলনায় আমি প্রায় নিখুঁত একজন। তোমাকে ভুলানো আমার জন্যে কোনো ব্যাপারই না। পুরুষ সবচেয়ে সহজে ভোলে তার প্রশংসায়। আমি তোমার। প্রশংসা শুরু করলেই কিন্তু সিনারিও বদলে যাবে।
আমার প্রশংসা করার কিছু নেই।
স্ত্রীর প্রতি তোমার আনুগত্যকে তুমি ছোট করে দেখছ কেন? তোমার স্ত্রীও তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কাজেই তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসার কিছু তোমার মধ্যে আছে।
সেটা কী?
আমার ধারণা তোমার সারল্য। তুমি রূপবান একজন মানুষ। কিন্তু মেয়েরা পুরুষের রূপকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না। তারা পুরুষের রূপকে তার দুর্বলতা ভাবে। তারা গুরুত্ব দেয় পুরুষের অনুভূতি প্রবণতাকে। যার অনুভূতি যত প্রবল সে ততই আকর্ষণীয়।
কুন বলল, আমার অনুভূতি প্রবল?
অবশ্যই। আরেকটা বিষয় বলব?
বলো।
সেন্ট্রাল কম্পিউটার সেইসব পুরুষ এবং রমণীকে সন্তান নেয়ার সুযোগ দেয় যারা শ্রেষ্ঠ। যাদের সন্তানরা আরো শ্রেষ্ঠ হবে। বলা হয়ে থাকে বিষয়টা লটারিতে ঠিক করা হয়। তা কিন্তু না।
তুমি জানলে কী করে লটারি হয় না?
লটারিতে হলে তোমরা শুরুতেই বাদ পড়তে। তোমার স্ত্রী বয়সের কারণে বাদ পড়ত।
কুন বলল, হয়তো কোনো একটা ভুল হয়েছে। বয়সের ব্যাপারটা সেন্ট্রাল কম্পিউটার খেয়াল করে নি।
সেন্ট্রাল কম্পিউটার কখনো ভুল করে না। তার সবকিছুই হিসাবের মধ্যে। এখন কি একটা দুঃসংবাদ শুনবে?
হঠাৎ দুঃসংবাদ দিতে চাচ্ছ কেন?
অন্যের দুর্ভাগ্যের কথা শুনলে নিজের দুর্ভাগ্যর যন্ত্রণা অনেকখানি কমে।
কুন বলল, দুঃসংবাদটি কী বলো।
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চতুর্থ শহরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে V-305 ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে।
সর্বনাশ!
মীন বলল, সেই শহরের সমস্ত মানুষকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হয়তো এর মধ্যে সেই নির্দেশ কার্যকরও হয়েছে।
তুমি জানলে কীভাবে?
অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ সব SF রোবটকে জানানো হয়। চতুর্থ শহরে মেটি নয়টা SF রোবট আছে। তাদের ভাগ্যও মানুষের মতোই।
তাদেরকে কি ধ্বংস করে ফেলা হবে।
না। SF রোবট ধ্বংস করা সম্ভব না। তবে তারা সেই শহর ছেড়ে কখনো বের হতে পারবে না। তাদেরকে থাকতে হবে সিল করা শহরের ভেতরই। যদি কখনো V-305 ভাইরাস দূর করা সম্ভব হয়, তাহলেই সেই শহরে আবার বসবাস শুরু হবে। SF রোবটরা তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করবে। তবে…
কুন বিরক্ত গলায় বলল, তবে বলে থামলে কেন?
মীন বলল, এখন পর্যন্ত কোনো শহরকে ভাইরাসমুক্ত করা যায় নি। একবার ভাইরাসের আক্রমণ হওয়া মানে শহরের মৃত্যু।
কুন বলল, ভাইরাসমুক্ত করার চেষ্টা কি কখনো হয়েছে?
মীন বলল, জানি না। তবে চেষ্টা নিশ্চয়ই হয়। তা না হলে SF রোবটগুলিকে সরিয়ে আনা হতো। একটা SF রোবট তৈরি করা আর একটা আস্ত শহর তৈরি করার খরচ একই। SF রোবটের এনার্জি কনভার্টারে হিলিয়াম থ্রি পরমাণু ব্যবহার করা হয়। হিলিয়াম থ্রি আনতে হয় বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ থেকে।
তুমি হিলিয়াম থ্রি-তে চলো?
হুঁ। তবে আমরা তোমাদের মতো খাদ্য গ্রহণ করেও এনার্জি কনভার্টারে খাদ্য থেকে এনার্জি তৈরি করতে পারি। এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তুমি কি থ্রি-ডি পর্দাটা চালু করবে? বিশেষ ঘোষণা আসার কথা।
কী ঘোষণা?
চতুর্থ শহর সিল করা হয়েছে, এই উপলক্ষে এই শহরে আনন্দ দিন ঘোষণা করা হতে পারে। এই শহর তো এখনো টিকে আছে। কাজেই আনন্দ দিন। উৎসবের দিন।
কুন থ্রি-ডি পর্দা চালু করল। সেখানে নতুন আবিষ্কার করা সিরাম নক্ষত্রের একটি গ্রহে পাওয়া প্রাচীন সভ্যতার ওপর অনুষ্ঠান হচ্ছে। অতি সুসভ্য কোনো এক প্রাণী একসময় মহান সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। তারা নেই, রেখে গেছে সভ্যতার সামান্য কিছু নমুনা। যা দেখে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাদের তৈরি ক্রিস্টাল কিউব থেকে বিরতিহীন সঙ্গীত তৈরি হয়। যার একটি সুরের সঙ্গে অন্য সুরের কোনো মিল নেই। সঙ্গীতের সঙ্গে ক্রিস্টাল কিউবের বর্ণ পরিবর্তিত হয়। পালসারের মতো নির্দিষ্ট সময় পর সেখান থেকে শক্তিশালী গামা রেডিয়েশন হয়।
কুন আগ্রহ নিয়ে প্রোগ্রাম দেখছে। ভিনগ্রহের সভ্যতা নিয়ে প্রোগ্রামগুলি এমনভাবে তৈরি যে কিছুক্ষণ দেখলেই আটকা পড়ে যেতে হয়। হঠাৎ প্রোগ্রাম প্রচার বন্ধ হলো। হাস্যমুখী একজন তরুণী (হয়তো সেও একজন SF রোবট) জানাল–
কিছুক্ষণ আগে এই শহরকে সম্মান দেখানোর জন্যে আজকের
দিনটিকে আনন্দ দিন ঘোষণা
করা হয়েছে। কারণ এই শহর এখন
পর্যন্ত V-305 ভাইরাস মুক্ত। আজ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত শহরের
চন্দ্রোদ্যান সবার জন্যে উন্মুক্ত। সেখানে পানীয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
বৃহস্পতির উপগ্রহ টিটানের বিখ্যাত পানীয় ক্রেজি টিটান থাকবে।
সবাইকে পনেরো মিলিলিটারের দুটি করে বোতল দেয়া হবে। এর বেশি নয়।
মহান সঙ্গীতকার আহান আনন্দ দিবস উপলক্ষে
চন্দ্রগীতি শোনাবেন,
এমনটি আমরা আশা করছি। যদিও নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো হচ্ছে, চতুর্থ শহর সিল করে দেয়া
হয়েছে। সেই শহরবাসীদের জন্যে আমাদের গভীর সমবেদনা। আমরা
আনন্দ দিনে তাদের স্মরণ করছি।
মীন বলল, তুমি কি চন্দ্রগীতি শুনতে যাবে?
হুঁ।
ক্রেজি টিটান পানীয়টা তুমি কি আগে কখনো খেয়েছ?
দুবার খেয়েছি।
খেতে কেমন?
কুন জবাব দিল না। মীন বলল, টিটানের পানীয় শব্দটা শোনার পরপরই তোমার চোখ চকচক করা শুরু করেছে। এ থেকেই বুঝতে পারছি খেতে কেমন। আমরা SF রোবটরা এই স্বাদ কখনোই বুঝব না। সামান্য দুঃখিত বোধ করছি।
কুন বলল, কিছু দুঃখবোধ থাকা ভালো।
.
নাম এবং পিন নাম্বার দিয়ে কুন দু’টা পনেরো মিলিলিটারের বোতল পেয়েছে। মীন নিয়েছে আরো দু’টা। একজন মানুষ যা যা নিতে পারে একজন SF রোবটও পারে। তাদেরকে মানুষ থেকে আলাদা করার কোনো নিয়ম নেই।
পানীয় যে দিচ্ছে (সাধারণ s টাইপ রোবট) মীন তাকে বলল, আমার বন্ধুর স্ত্রীর জন্যে কি আমি আরো দু’টা বোতল নিতে পারি?
তিনি কোথায়?
তিনি বিশেষ কারণে আসতে পারেন নি। বিশেষ কারণ কি ব্যাখ্যা করতে
না।
আরো দু’টা বোতল পাওয়া গেল। কুন আনন্দিত গলায় বলল, মীন ধন্যবাদ।
মীন বলল, আমি আরো দু’টা বোতলের ব্যবস্থা করব। তুমি আনন্দ দিবস উদযাপন কর।
আরো দুবোতল কীভাবে পাবে?
গাধাটাইপ রোবটের সঙ্গে কিছু Tricks করব। কী Tricks তোমার না জানলেও চলবে।
কুন আবারো বলল, ধন্যবাদ। নিনিতার কথা এখন আর তার মনে আসছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার জীবনটা খারাপ কাটে নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রগীতি শুরু হবে। পকেটে ছয় বোতল স্বর্গীয় পানীয়। এরচেয়ে বেশি একজন মানুষের আর কী-ই বা চাইবার আছে?
মহান আহান চলে এসেছেন। আজ তাঁকে বিষণ্ণ এবং অস্থির লাগছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার আজকের সুর চতুর্থ শহরের হতভাগ্য মানুষদের জন্যে। যদিও সেই সুর তাদেরকে স্পর্শ করবে না। এখনো গান শুরু করেন নি। সামান্য কিছু কথা, এতেই পরিবেশ বদলে গেছে। আহান তার কণ্ঠের জাদুকরী বিষাদ ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। বিষাদ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে। আহান গান শুরু করেছেন।
হে চন্দ্র! তুমি আমাকে
তোমার কাছে টেনে নাও।
তোমার শীতল শরীর স্পর্শ করতে দাও।
আমি তোমার স্পর্শের বাইরে কখনো থাকব না।
তোমাকে ভিজিয়ে রাখব অশ্রুজলে।
কুনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মীন কুনের একটা হাত টেনে তার কোলে রাখল। কোমল গলায় বলল, তোমাদের মানুষদের প্রধান সমস্যা কী জানো? তোমাদের প্রধান সমস্যা, তোমরা গভীর আবেগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পার না। তোমাদের সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।
তাই বুঝি?
হ্যা তাই। এবং তোমরা একটা আবেগের সঙ্গে অন্য আবেগের যোগসূত্র তৈরি করতে পারি না।
তোমরা পার?
হা পারি। তোমরা লজিক পছন্দ কর, কিন্তু লজিক ব্যবহার করতে পছন্দ কর না।
এইখানেই আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। আমরা রোবট না।
যে জিনিস তোমরা পছন্দ কর তার চর্চা না করাটা হাস্যকর না?
আমি গান শুনছি। তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
মীন বলল, আমি এখন এমন একটা কথা বলব যে গান শুনতে ভালো লাগবে না। মহান আহান-সঙ্গীত আর কোনোদিনই তুমি শুনবে না।
কুন বলল, কথাটা কী?
মীন বলল, কথাটা হচ্ছে মহান আহান মনুষ্য সমাজের কেউ না। তিনি আমাদের একজন। একটি বিশেষ ধরনের SF রোবট।
কী বলছ এইসব?
তুমি যদি লজিক ব্যবহার করতে তাহলে অনেক আগেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে। পৃথিবীর সব কটি শহরে আহানের মতো একজন আছে যে শহরবাসীদের মাতিয়ে রাখে। তাদের গলার ব্যাপ্তি মনুষ্য সমাজের কারোর নেই। থাকার কথাও না। তুমি লক্ষ কর নি, আহান গান করতে করতে একসময় মানুষের শ্রুতি সীমা’র বাইরে চলে যান। তখন কিন্তু তিনি থামেন না। গান গেয়েই চলেন।
সব শহরে একজন আইন আছেন?
অবশ্যই, তবে তাদের সবার নাম আহান না। চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তার নাম—প্রপার। তিনি গাইতেন সিরাম নক্ষত্রগীতি। তার সুর কিন্তু অবিকল চন্দ্রগীতির মতোই। তুমি কি আহানের সঙ্গে কথা বলতে চাও? আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
কথা বলতে চাই না।
অহান দ্বিতীয় গান শুরু করেছেন। এই গান কুনকে স্পর্শ করছে না। প্রচণ্ড রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রাগটা কার ওপর তাও সে ধরতে পারছে না।
মীন বলল, টিটানের পানীয় বোতলটা খুলে দেব? খাবে?
না।
মীন বলল, অতি অপূর্ব এই সুর তোমার গুনতে ভালো লাগছে। ভালো লাগাটাই প্রধান। অন্যসব কিছুই অপ্রধান। সুরটা কে তৈরি করছে তা প্রধান হতে পারে না।
আমার কাছে প্রধান। আমার খুবই খারাপ লাগছে। এত খারাপ কেন লাগছে তাও বুঝতে পারছি না।
মীন বলল, তোমরা মানুষরা মনে কর তোমরাই শ্রেষ্ঠ। যখন দেখ তা-না তখনি অস্থির হয়ে পড়। SF রোবটদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলে জীবন সহনীয় হবে।
জীবন সহনীয় করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
বাসায় চলে যেতে চাও?
হ্যা চাই।
আমরা দুজন হেঁটে চলে যাব। সবাই কিন্তু আমাদের দিকে তাকাবে। মহান। আহানও তাকাবেন। কারণ তার সুর তুচ্ছ করে কেউ চলে যায় না।
আমি যাব।
কুন উঠে দাঁড়াল। সে বাসার দিকে রওনা হয়েছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে মীন। সবাই অবাক হয়ে এই দুজনকে দেখছে। মহান আহানও তাকিয়ে আছেন। তার চোখে বিস্ময়।
ছয় বোতল ক্রেজি টিটান তার পকেটে, অথচ সে একটির মুখও খোলে নি। কুনের নিজের কাছেই অবাক লাগছে। এখন মনে হচ্ছে নিনিতা যেদিন ফিরবে সেদিন। উৎসব করে বোতলগুলি খোলা হবে। ঘরে ফেরার কিছুক্ষণ পরই থ্রি-ড়ি পর্দায় মহান আহানের বিষণ্ণ মুখ দেখা গেল। কুন হকচকিয়ে গেল। আহান তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। এরকম তো কখনো হবার কথা না। কোনো ভুল কি হচ্ছে? হেলুসিনেশন? দুশ্চিন্তায় এরকম হতে পারে।
আমি কি কুনের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ।
আজ আপনাকে দেখলাম আমার গানের মাঝখানে উঠে চলে যেতে। আমার সুর কি আপনার পছন্দ হচ্ছিল না?
আপনার সুর অপছন্দ করার মতো স্পর্ধা আমার নেই মহান আহান। আমি যখন জানলাম আপনি আমাদের একজন না, আপনি একটি SF রোবট, তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতই খারাপ হলো যে উঠে চলে এলাম।
মূল বিষয় হচ্ছে সুর। সেই সুর একটি যন্ত্র তৈরি করছে নাকি চন্দ্ৰবৃক্ষ তৈরি করছে তা ধর্তব্য নয়।
মহান আহান! আপনার সঙ্গে কোনো যুক্তিতে যেতে চাচ্ছি না।
মানুষ পরাজিত হতে পছন্দ করে না। কিন্তু একদিন অবশাই তাকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সবারই উচিত তার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া।
কুন বলল, মহান আহান! আপনার গানের মাঝখানে উঠে চলে এসে আপনাকে যে অপমান করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মান-অপমান বোধ থেকে আমি মুক্ত।
কুন বলল, মান-অপমান বোধ একটি মানবিক আবেগ। আপনার তা থেকে মুক্ত থাকারই কথা। বেশির ভাগ রোবটই তার থেকে মুক্ত।
আহনি বললেন, SF ধরনের রোবটের কিন্তু মান-অপমান বোধ আছে। আপনার পেছনে পেছনে যে তরুণীটি গিয়েছেন তিনি SF ধরনের রোবট। তার মান-অপমান বোধ ভালোই আছে। আমিও যে একজন SF রোবট তা কি আপনি তার কাছে জেনেছেন?
হা।
আহানের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি ঠোঁটের হাসি দ্রুত মুছে ফেলে বললেন, তিনি যে-কোনো কারণেই হোক আপনাকে বিভ্রান্ত করেছেন। আমি মানব সম্প্রদায়েরই একজন।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, প্রতিটি শহরে কি একজন করে আহান নেই? চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তাঁর নাম দ্রপার।
আহান বললেন, আমি যখন সেই শহরে যাই তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দ্রপার নামে। আমার কোনো নির্দিষ্ট শহর নেই। আমি শহরে শহরে ঘুরে চন্দ্রগীতি করি। আমি এখন বিদায় নেব। আপনার জীবন হোক চন্দ্রময়।
পর্দায় আহানের ছবি মুছে গেল। কুন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, মীন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কুন বলল, তুমি কি আহানের কথা শুনেছ?
হ্যাঁ।
উনি যা বলেছেন তা কি সত্যি?
অবশ্যই সত্যি।
তুমি আমাকে আহান বিষয়ে এই কথাটা কেন বললে?
SF রোবটরা মানুষের মতো মিথ্যা কথা বলতে পারে, এটা জানানোর জন্যে বলেছি।
তাতে তোমার লাভ?
লাভ অবশ্যই আছে। অতি দ্রুত তুমি আমাকে মানব সমাজের একজন ভাবতে শুরু করবে। কোনো একদিন হয়তো তুমি আমার প্রেমে পড়বে। এমনও হতে পারে যে, তোমার স্ত্রী নিনিতার নিষিক্ত ডিম্বাণু আমার জরায়ুতে স্থাপন করা হবে। আমাদের একটি সন্তান হবে। আমরা তার নাম দেব আহান।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? পাগলের মতো এইসব কী বলছ?
মানুষ যেমন মাঝে-মাঝে পাগলের মতো আচরণ করে, আমরাও করি। ভালো কথা, তুমি ছয় বোতল টিটান পানীয় রেখে দিয়েছ। আমার ধারণা, তোমার ইচ্ছা তোমার স্ত্রী এলে বোতলগুলি খুলে উৎসব করবে। এই ঘটনা কখনো ঘটবে না। সে ফিরে আসবে না। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে যায় সে ফেরে না।
কী বলছ তুমি?
আমি তোমাকে পরিস্থিতি স্বীকার করে নিতে বলছি। এসো, বোতলগুলি খোলা যাক। আমি একটা খাব। পাঁচটা তোমার!
নিনিতা ফিরবে না?
লজিক তাই বলে। লালকুঠিতে যারা যায় তারা ফেরে না। দুএকজন ফেরে। তবে তাদের না ফেরাই ভালো।
না ফেরাই ভালো কেন?
মীন বলল, তারা অন্যের স্মৃতি নিয়ে ফেরে। তোমার স্ত্রী যদি ফিরে সে অন্য কেউ হয়ে ফিরবে। এই প্রসঙ্গ বন্ধ থাকুক। চল অন্য প্রসঙ্গে যাই।
কুন বলল, আমি নিনিতার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। তাকে দেখতে চাচ্ছি। তার কোনো উপায় কি আছে?
মীন স্বাভাবিক গলায় বলল, আছে। খুব সহজ উপায় আছে।
সহজ উপায়টা বলো।
তোমাকে একটা খুন করতে হবে। আমাকে ধ্বংস করে ফেললেও হবে। একটা হাতুড়ি নিয়ে আমার মাথায় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাড়ি দাও। এতে কাজ হবার কথা।
কুন তাকিয়ে আছে মীনের দিকে। মীনের মুখ হাসি হাসি। যেন এইমাত্র সে দারুণ মজার কোনো কথা বলেছে।
Leave a Reply