০৪. এতকিন নভেলা রড
ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সমাজে পুনর্বাসিত করতে এই রড ব্যবহার
করা হয়। এই রডের সাহায্যে
অপরাধীদের সঞ্চিত স্মৃতি মুছে ফেলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন স্মৃতি দেয়া হয়। পদার্থবিদ শেন এতকিন এতকিন নভেলা রডের জনক।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
পৃষ্ঠা ৫১৭২ (আবিষ্কার ও আবিষ্কারক)
নিনিতা ঘরে ফিরছে। ঘরে না ফিরলেও চলে। তার কাছে নীল রঙের একটা মাদার পাস আছে। শহরের যে-কোনো জায়গায় সে যেতে পারে। পাসটা পিন দিয়ে গায়ে লাগিয়ে রাখার নিয়ম। নিনিতা পাস রেখেছে হাতের মুঠোয়। কিছুক্ষণ পরপরই তাকে রক্ষী রোবটদের হাতে পড়তে হচ্ছে। এরা অস্ত্রধারী, তবে তাদের ব্যবহার ভদ্র।
ম্যাডাম, পাস?
নিনিতা হাতের মুঠো খুলে পাস দেখাল।
পাসটা গায়ে লাগিয়ে রাখলে দূর থেকে দেখতে পারি। তখন আর প্রশ্নোত্তরের ঝামেলায় আপনাকে যেতে হয় না। ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন জানতে পারি?
বিশেষ কোথাও না। এমনি ঘুরছি। কারণ ছাড়া ঘুরতে কি কোনো বাধা আছে?
কোনো বাধা নেই আপনার কাছে পাস আছে।
শহরের এমন কোথাও কি যেতে পারি যেখানে মজার কিছু হচ্ছে?
ম্যাডাম, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না বলে অত্যন্ত দুঃখিত।
নিনিতা টানেল সুপারওয়েতে উঠে পড়ল। যতদূর যাওয়া যায় সে যাবে। একা একা ঘুরবে। সে চাচ্ছে কুন তার অভাব অনুভব করুক। সে ঘরে ফিরছে না। কেন? –এই ভেবে কিছুটা অস্থির হোক। নিনিতা ঠিক করল সে ঘরে ফিরবে সন্ধ্যা মিলাবার পর।
ম্যাডাম, আপনার পাস?
নিনিতা হাতের মুঠো খুলল। আশ্চর্য তো, সেখানে পাস নেই। হ্যান্ডব্যাগে কি রেখেছে? অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিনিতা হ্যান্ডব্যাগ খুলল। সেখানেও পাস নেই।
অস্ত্রধারী রোবট শান্ত গলায় বলল, পাস সবসময় গায়ের সঙ্গে এমনভাবে লাগিয়ে রাখা উচিত যেন দূর থেকে দেখা যায়।
নিনিতা বিড়বিড় করে বলল, ভুল হয়েছে।
আপনি কি পাসটি খুঁজে পাচ্ছেন না?
না। মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে। বিশ্বাস করুন, আমার সঙ্গে পাস ছিল। মাদার পাস।
রোবট বলল, আপনার সঙ্গে পাস ছিল তা আমি অবিশ্বাস করছি না। পাস ছাড়া আপনি এতদূর আসতে পারতেন না। তার আগেই আপনাকে আটকে দিত।
এখন আমি কী করব?
আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা পাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। খুঁজে না পাওয়া গেলে কম্পিউটার সিডিসিকে জানানো হবে। কী করণীয় সেই ব্যাখ্যা সিডিসি দেবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।
কোথায় অপেক্ষা করব?
আসুন আমার সঙ্গে।
নিনিতা রোবটের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। সে যথেষ্টই চিন্তিত বোধ করছে। সে যে এখন কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে সে উপায় নেই। যারা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়, তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পাস।
ম্যাডাম, সর্বশেষ যে রোবট আপনার পাস দেখতে চেয়েছে, সে কি পাস দেখার পর আপনাকে ফেরত দিয়েছিল?
হুঁ।
এমন কি হতে পারে যে সে পাসটি ফেরত দেয় নি?
নিনিতা বলল, পাস রেখে দিয়ে তার লাভ কী?
রোবট বলল, লাভ কী আমি জানি না। তবে আমাদের বলা হয়েছে যে, প্রায়ই কিছু পাস হারিয়ে যাচ্ছে। হারানো পাসগুলির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কাছেই একটি পুর্বাসন কেন্দ্র আছে। আপনাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে অপেক্ষা করাই ভালো।
নিনিতা বলল, অন্য কোথাও কি অপেক্ষা করতে পারি?
আপনি নগরীর শেষপ্রান্তে চলে এসেছেন। এখানে অপেক্ষা করার মতো জায়গা নেই।
.
পুনর্বাসন কেন্দ্র বিষয়ে নিনিতা তেমন কিছু জানে না। শুধু এইটুকু জানে জায়গাটা ভয়াবহ অপরাধীদের জন্যে আলাদা করা। এরা বাকি জীবন এখানে কাটায়।
মানুষের জন্যে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড একমাত্র শাস্তি এমন সব অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনা হয়। এতকিন নভেলা রড দিয়ে তাদের চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসায় অপরাধী সম্পূর্ণ স্মৃতিশূন্য হয়ে যায়। তাকে নতুন করে সব শিখতে হয়। জীবন শুরু হয় শিশু অবস্থা থেকে। কিছু ভাগ্যবানদের অবশ্যি নতুন স্মৃতি দিয়ে সমাজে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের সংখ্যা সীমিত।
নিনিতা পুনর্বাসন কেন্দ্রের রিসিপশনে শুকনো মুখে বসে আছে। তাকে কফি খেতে দেয়া হয়েছে। সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে না। কফির কাপ পাশেই পড়ে আছে। রিপিসশনে বসা মেয়েটি (সেও নিশ্চয়ই রোবট বলল, ম্যাডাম, আপনি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন?
নিনিতা বলল, না।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভয় পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কফিতে একটা চুমুকও দেন নি।
কফি খেতে ইচ্ছা করছে না।
আপনি মন থেকে ভয় দূর করুন। এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভয়ঙ্কর অপরাধী হলেও মানসিকভাবে শিশু। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আপনাকে একটা কামর দেব। সেখানে নিজের মতো বিশ্রাম করতে পারবেন।
নিনিতা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, বিশ্রাম করতে পারব মানে কী? আমাকে কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে?
আজ রাত এখানেই কাটাতে হবে।
তার মানে?
রোবট হাসিমুখে বলল, আপনাকে ফুড স্লিপ দিচ্ছি। টিক মার্ক দিয়ে দিন।
নিনিতা বলল, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। তার পিন নাম্বার…
রোবট নিনিতাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল, পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করা যায় না।
তার জানা দরকার যে আমি এখানে আছি।
ম্যাডাম, অস্থির হবেন না।
রোবট নিনিতার হাতে ফুড স্লিপ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র বিষয়ে একটি বুকলেট ধরিয়ে দিল, যেখানে এই কেন্দ্রের জন্যে প্রযোজ্য নিয়মাবলি লেখা। নিনিতা বুকলেট খুলে দেখল না। ফুড স্লিপেও টিক মার্ক দিল না। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল। রোবট বলল, আগের কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ কফি কি দেব ম্যাডাম?
নিনিতা জবাব দিল না। তার মুখে থুথু জমছে। থুথু ফেলার জন্যে টয়লেটে যেতে হবে। টয়লেটে যেতে ইচ্ছা করছে না। থুথু গিলে ফেলাও যাচ্ছে না।
.
পুনর্বাসন কেন্দ্রের বত্রিশ নম্বর রুম নিনিতাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঘর ছোট, তবে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর মতো বড় বিছানা। টয়লেট ঝকঝক করছে। পুরো কামরা কাঁচের তৈরি। ঘরের ভেতরে বসে বাইরে কী হচ্ছে সবই দেখা যায়। তবে বোতাম টিপে কাঁচকে অস্বচ্ছ রাখার ব্যবস্থাও আছে।
নিনিতা কোনো খাবার খেল না। বারান্দায় রাখা পেন্সিগ্লাসের চেয়ারে বসে রইল। সামনেই খোলা মাঠ। পূনর্বাসন কেন্দ্রের বন্দিরা সেখানে কয়েকটা রঙিন ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করছে। তাদের সবার বয়সই চল্লিশের ওপর, কিন্তু এখন তারা শিশুদের মতোই হৈচৈ করছে। দুঃখজনক দৃশ্য।
হ্যালো, আমি কি তোমার পাশের চেয়ারে বসতে পারি?
নিনিতা জবাব দিল না। সে তার চেয়ার নিয়ে একটু সরে গেল। পাশের চেয়ারে কেউ বসতে চাইলে বসবে।
আমি পদার্থবিদ শেন। স্ত্রীকে হত্যার কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতে হয়েছে। তুমি কাকে খুন করেছ, তোমার স্বামীকে?
নিনিতা বলল, আমি কাউকে খুন করি নি। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন।
শেন বললেন, আমি ভাগ্যবান, দুবছর হয়ে গেছে এখানে আছি। এখনো তারা আমার ওপর এতকিন নভেলা বড় প্রয়োগ করে নি। তবে যে-কোনো একদিন নিশ্চয়ই করবে। সবুজ রঙের একটা গাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে। গাড়ির রঙ সবুজ কেন জানো?
নিনিতা বলল, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না। কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?
আগামীকাল ভোরে কিংবা তার পরদিন ভোরে তোমার জন্যেও সবুজ রঙের গাড়ি আসতে পারে। স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা তুমি আর নাও বলতে পার। সুযোগ পেয়েছ, সুযোগ কাজে লাগাও। কথা বলো।
নিনিতা বলল, আপনি ভুল করছেন। আমি কোনো অপরাধ করি নি। পাস হারিয়ে ফেলেছি বলে আমাকে এখানে আনা হয়েছে। আগামীকাল ভোরে আমি বাসায় চলে যাব।
শেন বললেন, পাস হারানো অতি তুচ্ছ ঘটনা। হারানো পাস কোথায় আছে সিডিসি সঙ্গে সঙ্গে জানবে। তার জন্যে তোমাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনতে হয় না। একটা কথা তোমাকে বলি। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কেউ এসেছে, অথচ তার ওপর এতকিন নভেলা রড প্রয়োগ করা হয় নি এমন কখনো ঘটে নি।
নিনিতা হতভম্ব গলায় বলল, আমি কী করেছি যে আমাকে এতকিন নভেলা বড় দেয়া হবে?
শেন বললেন, আমরা মানুষ রোবটদের হাতের গিনিপিগ। তারা নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের নিয়ে করছে। কেন করছে আমরা জানি না। জানার উপায়ও নেই। এখন কি বলব, সবুজ রঙের গাড়ি কেন আসে?
নিনিতা দিশাহারা চোখে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে থাকা মানুষটা কী বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
শেন বললেন, এতকিন নভেলা রডের রঙ সবুজ। এই জন্যে গাড়িটা আসে সবুজ রঙের। এক ধরনের Ritual বলতে পার। রডে তীব্র কম্পাংকের ওমিক্রন রশ্মির Pulse তৈরি করা হয়, যা ধাপে ধাপে মস্তিষ্কের সব কোষে পাঠানো হয়। অত্যন্ত কষ্টকর একটি প্রক্রিয়া, যা মৃত্যুর মতোই। কিংবা কে জানে হয়তো মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর।
আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?
এতকিন নভেলা রডের থিওরি ছাত্রজীবনে আমার আবিষ্কার। আমার নাম শেন এতকিন। এই আবিষ্কার আমার ওপরই একসময় প্রয়োগ করা হবে তা ভাবি নি। হা হা হা।
শেন হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়েছে। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক না করাটা হবে চূড়ান্ত অভদ্রতা। নিনিতা হাত বাড়াল।
তোমার হাত তুলার মতো নরম। আমার স্ত্রীর হাতও নরম ছিল। বলা হয়ে থাকে, যাদের হাত নরম তাদের হৃদয় হয় কঠিন। তোমার হৃদয় কি কঠিন?
জানি না।
আমি কীভাবে আমার স্ত্রীকে খুন করেছি সেই গল্প শুনতে চাও।
না।
যে-কোনো একটা বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
নিনিতা হতাশ গলায় বলল, আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমি আপনার সঙ্গে কোনো বিষয়েই কোনো আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না।
মানসিক বিপর্যয় কাটানোর জন্যেই আলোচনা দরকার। আচ্ছা শোন, একটা মজার বিষয় শোন। এতর্কিন নভেলা রডের সাহায্যে তোমার সঞ্চিত স্মৃতি যদি কোনো পুরুষকে দিয়ে দেয়া যায়, তাহলে কেমন হয়? সে শারীরিকভাবে পুরুষ, অথচ সমস্ত স্মৃতি একজন মহিলার। কেমন মনে হচ্ছে?
আমার কোনো কিছুই মনে হচ্ছে না! প্লিজ চুপ করুন।
শেন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এতকিন নভেলা রড দিয়ে একটা পশুর স্মৃতিও মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়। একটা মাকড়সার স্মৃতি তোমার ভেতর ঢুকিয়ে দিলে কেমন হবে! তুমি রূপবতী একজন তরুণী, অথচ তোমার সমস্ত স্মৃতি একটি মাকড়সার স্মৃতি। তুমি জানবে কবে তোমার জালে একটা পোকা ধরা পড়েছিল। কবে তুমি তোমার সঙ্গী একটি পুরুষ মাকড়সার সঙ্গে যৌনক্রিয়া করেছ। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা। আচ্ছা, তুমি কি মাকড়সার যৌনজীবন সম্পর্কে কিছু জানো?
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। অর্ধ উন্মাদ এই মানুষটার সঙ্গে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
শেন বললেন, চলে যাচ্ছ? তোমার সঙ্গে গল্প করে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছিলাম।
নিনিতার ঘরের বিছানা আরামদায়ক। সারারাত তার একফোঁটা ঘুমও হলো না। সে রাত কাটালো বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। শেষরাতের দিকে তার ঝিমুনির মতো এসেছিল। তখন সে স্বপ্নে দেখল—সে মানুষ না, প্রকাণ্ড একটা মেয়ে মাকড়সা। পেটে ডিম নিয়ে দেয়াল বেয়ে হাঁটছে।
Leave a Reply