০৩. আয়না মানব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ
উদাহরণ রোবট বিজ্ঞানীদের
তৈরি SF রোবট। এদের অন্য নাম আয়না মানব। আয়নায় মানুষকে যেমন দেখায় এরা সেরকম।
Mirry image.
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য?
নিনিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়নার সামনে একজন মেয়ে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুলের মাথায় জট লেগে গেছে। সে জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মাঝে-মাঝে চিরুনির টান প্রবল হচ্ছে, মেয়েটি ব্যথায় উফ শব্দ করছে। আয়নায়। মেয়েটির চেহারা খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
এমন রূপবতী মেয়ে শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়।
নিনিতা পুরোপুরি নিশ্চিত হলো সে স্বপ্ন দেখছে। অন্যধরনের স্বপ্ন। তার কল্পনায় নিশ্চয়ই অতি রূপবতী কোনো মেয়ের ছবি ছিল। সেই ছবি স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। নিনিতা বলল, কে?
মেয়েটি তার দিকে ফিরল। উঠে দাঁড়াল এবং মিষ্টি গলায় বলল, আমার নাম মীন। ম্যাডাম, আপনার ঘুম কি পুরোপুরি কেটেছে? আপনাকে কফি দিতে বলব?
নিনিতা স্পষ্ট চোখে চারদিক দেখছে। এই তো পাশেই কুন ঘুমুচ্ছে। গভীর ঘুম। ঘড়িতে বাজছে সাতটা দশ। কুন আটটার আগে কখনো ঘুম থেকে উঠে না। ঘরের ভেতরে নরম আলো (কৃত্রিম আলো, দিন-রাতের প্রভেদ বুঝানোর জন্যে আলোর পরিবর্তন সেন্ট্রাল কম্পিউটার করে।
নিনিতা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, তুমি কে?
ম্যাডাম, কিছুক্ষণ আগে আমি আমার নাম বলেছি। আবারো বলছি–আমার নাম মীন।
তুমি ঘরে ঢুকেছ কীভাবে?
সেন্ট্রাল কম্পিউটার ব্যবস্থা করেছে যেন আমি ঘরে ঢুকতে পারি।
নিনিতা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দয়া করে আমার হতভম্ব ভাব কাটাবার ব্যবস্থা কর। পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা কর।
ম্যাডাম, আজ আপনার স্বামীর জন্মদিন। আপনি তাকে কী উপহার দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সেন্ট্রাল কম্পিউটারের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। সেন্ট্রাল কম্পিউটার আমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে।
তোমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে?
হা ম্যাডাম। আমি SF টাইপ হিউমোনয়েড রোবট। আয়না মানবী। আমি আপনার স্বামীর আনন্দসঙ্গী হিসেবে কিছুদিন থাকব। তারপর চলে যাব। আপনার স্বামীর জন্মদিনের উপহারের স্থায়িত্ব অল্প কিছুদিন।
নিনিতা বলল, আমি সিডিসির কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম। তাকে বলি নি উপহার সরাসরি পাঠিয়ে দিতে।
ম্যাডাম, কিছু সিদ্ধান্ত সিডিসি নিজেই নিয়ে নেয়। তার কাছে পরামর্শ চাওয়ার এই বিপদ আছে।
উপহার হিসেবে তোমাকে আমার একেবারেই পছন্দ হয় নি।
মীন বলল, ম্যাডাম, এই উপহার আপনার স্বামীর পছন্দ হবে। যেহেতু জন্মদিনটা তার, উপহার পছন্দটাও তার। আপনার পছন্দ-অপছন্দ অর্থহীন।
নিনিতা বলল, উপহার হিসেবে তুমি অশ্লীল। অরুচিকর।
ম্যাডাম, আপনি ঈর্ষাবশত এই কথা বলছেন। আমাকে ঈর্ষা করার কিছু নেই। আমি আয়না মানবী।
নিনিতা বলল, আমি শুনেছি SF রোবট এমন যে তাকে মানুষ থেকে আলাদা করা যায় না। মানুষের মতোই তাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ম্যাডাম, আপনি ঠিকই শুনেছেন।
পুরুষদের রাতের সঙ্গী হবার ক্ষমতাও কি তোমার আছে?
আছে।
তাহলে তোমাকে আমি কেন ঈর্ষা করব না বলো।
মীন বলল, আমি মাত্র অল্প কিছুদিনের জন্যে এসেছি। এই কদিন আমার অবস্থান থেকে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন।
কী শিখতে পারব?
আপনার স্বামী কী পছন্দ করেন, কী করেন না তা শিখবেন।
রাতে তুমি যখন তার সঙ্গে শোবে তখন আমি দূর থেকে তোমাদের আনন্দ সময় দেখে অহ্লাদ বোধ করব?
ম্যাডাম! আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় পার করলেও অতি ঘনিষ্ঠ সময় পার করব না। এখন আসুন আমরা দুজন লবিতে বসে কফি খাই। আপনার স্বামী আটটার আগে ঘুম থেকে উঠেন না। এই খবর ফুড প্রো আমাকে দিয়েছে। অন্তরঙ্গ কিছু কথা বলার সময় আমরা পাচ্ছি।
নিনিতা বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। অন্তরঙ্গ কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি চাই কুনের জেগে ওঠার আগেই তুমি বিদায় হবে। আয়না মানবীর আমার প্রয়োজন নেই।
মীন বলল, ম্যাডাম, তা সম্ভব না। সিডিসি আমাকে পাঠিয়েছে। কাজেই আপনার স্বামীর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। তবে আমার হাত থেকে বাচার আপনার একটা সহজ উপায় আছে।
সহজ উপায়টা কী?
আপনার স্বামী যদি বলেন, জন্মদিনের উপহার তার পছন্দ হয় নি তাহলে এ বাড়ি থেকে আমাকে তুলে নেয়া হবে।
সে তোমাকে কখনোই পছন্দ করবে না। কখনোই না, কখনোই না।
ম্যাডাম! আপনি ভাবছেন আমি আপনাদের মাঝখানে সমস্যা হিসেবে এসেছি। আসলে তা-না। আমার উপস্থিতি আপনাদের দুজনের জন্যেই আনন্দময় হবে।
নিনিতা বলল, আমি যথেষ্ট আনন্দে আছি। বাড়তি আনন্দের আমার প্রয়োজন নেই।
তাহলে আমরা দুজন নিরিবিলিতে সকালের প্রথম কফি খাচ্ছি না?
না।
মীন বলল, আমি লবিতে অপেক্ষা করি। আপনার স্বামীর ঘুম ভাঙলে তাঁর সঙ্গে কথা হবে। উনি আমাকে অপছন্দ করলে আমি চলে যাব।
.
কুনের ঘুম ভেঙেছে। সে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসতেই নিনিতা বলল, শুভ জন্মদিন।
কুন বলল, জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। শিশু লাইসেন্স পাওয়ার উত্তেজনায় আমার মাথা এলোমেলো। কাল সারারাত কী স্বপ্ন দেখেছি শুনলে অবাক হবে।
কী স্বপ্ন দেখেছ?
স্বপ্ন দেখেছি তোমার সঙ্গে বাচ্চার নাম রাখা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। তুমি এক অক্ষরে নাম রাখতে চাচ্ছ। তোমার পছন্দের নাম নি! আর আমি চাচ্ছি দুই অক্ষরের নাম রাখতে। আমার পছন্দের নাম নিনি।
নিনিতা বলল, তোমার জন্যে জন্মদিনের কোনো উপহারের ব্যবস্থা করি নি। কী ধরনের উপহার পছন্দ করবে বুঝতে পারি নি বলে সমস্যা।
তুমি আমাকে একটা শিশু উপহার দিচ্ছ। এরচেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে?
নিনিতা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, কয়েকদিনের জন্যে একটা SF হিউমোনয়েড রোবট উপহার হিসেবে দিলে কেমন হয়? একজন অতি রূপবতী আয়না মানবী।
কুন বলল, SF রোবট কী বস্তু এই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?
এরা অবিকল মানুষের মতো, এইটুকু জানি।
কুন বলল, তুমি কিছুই জানে না। এই ধরনের রোবটগুলিকে তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হিসেবে। এরা বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, আবেগে শ্রেষ্ঠ। এদের কাউকে কয়েকদিনের জন্যে আনতে কী পরিমাণ ক্রেডিট খরচ হবে, এই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই।
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, একটি SF টাইপ রোবট তোমার জন্যে লবিতে অপেক্ষা করছে। তোমার জন্মদিনের উপহার। সে নাকি কিছুদিন থাকবে।
কুন বলল, সত্যি? এটা কীভাবে সম্ভব? বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। হাতের ধাক্কা লেগে তার কফির কাপ উল্টে গেল। টেবিলে কফি ছড়িয়ে পড়ল। কুন সেদিকে ফিরেও তাকাল না। ছুটে গেলে লবির দিকে।
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম। আপনার কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ কফি কি দেব?
না।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই মন খারাপ করেছেন। অবশ্য মন খারাপ করার মতোই ব্যাপার ঘটেছে। একজন SF তরুণী পৃথিবীর যেকোনো পুরুষকে এক মিনিটের ভেতর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে।
নিনিতা বলল, তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। তুমি এই বিষয়ে একটি কথাও বলবে না।
আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা বোধ করছি বলেই কথা বলছি। আয়না মানবী অনেক ছলাকলা জানে। আপনি তো তেমন কিছু জানেন না।
এই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলবে না।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। সে লবির দিকে যাচ্ছে। ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম আপনাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি। এখন লবিতে যাবেন না।
কেন যাব না? তোমার কি ধারণা লবিতে ঢুকে দেখব কুন ঐ বদ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে?
ম্যাডাম, তা দেখার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা-না। তবে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে বসে আলাপ করতে দেখলেও আপনার খারাপ লাগবে। আপনি বরং এখানে বসুন। আরেক কাপ কফি খান। আসুন আমরা দুজন গল্প করি।
নিনিতা বলল, আমি যন্ত্রের সঙ্গে গল্প করি না।
ফুড প্রো বলল, মানুষ নিজেও তো একটা যন্ত্র ম্যাডাম। যন্ত্রের বেশি কিছু না।
স্টপ, আর কথা না।
নিনিতা আগের জায়গায় বসেছে। ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিচ্ছে। তার চোখ-মুখ কঠিন।
.
লবিতে মীন এবং কুন মুখোমুখি বসা। কুনের চোখে বিস্ময়। মীন তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। কুনের কাছে এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। রোবট এমনভাবে তৈরি করা হয় যে তারা সবসময় মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এই একজনকে দেখা যাচ্ছে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাকাচ্ছে কুনের দিকে। যতবারই তাকাচ্ছে ততবারই মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে।
কুন বলল, আমি কখনো SF টাইপ রোবট আগে দেখি নি। কথা বলা তো অনেক পরের ব্যাপার। তুমি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার দিকে তাকাও।
মীন বলল, লজ্জা লাগছে।
সত্যি লজ্জা লাগছে?
হুঁ
কেন বলো তো?
জানি না কেন। একটা কারণ এই হতে পারে যে, আমিও এই প্রথম কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলছি।
তোমাকে কি সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে পাঠিয়েছে?
হ্যাঁ।
কুন বলল, তুমি নিখুঁত সুন্দর একজন মেয়ে।
মীন বলল, আমি নিখুঁত সুন্দর না। মানুষ নিখুঁত সৌন্দর্য নিতে পারে না। নিখুঁত সৌন্দর্যের পাশে সে খানিকটা অসহায় বোধ করে। আমার মধ্যে খুঁত রাখা হয়েছে।
কুন বলল, কী খুঁত?
মীন হাসতে হাসতে বলল, আপনি খুঁজে বের করুন। আমি আগ বাড়িয়ে নিজের খুঁত বলব কেন?
কুন নানানভাবে দেখল। মানুষ মেয়ের দিকে এইভাবে তাকানো যাবে না। অসভ্যতা হবে। রোবট মেয়ের দিকে তাকানো যাবে।
কোনো খুঁত কি পেয়েছেন?
না।
আমি বলে দেব?
উঁহু, আমি নিজেই বের করব। আচ্ছা শোন, আমরা শুনেছি SF রোবটরা সর্বগুণে গুণানিত। এটা কি সত্যি? তুমি নিশ্চয়ই চমৎকার গান করতে পার?
মীন বলল, না। আমাদের মানুষের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। সব মানুষ কি গান করতে পারে। কেউ কেউ পারে।
তুমি কি পার?
আমি আসলে কিছুই পারি না। সুন্দর করে কথা বলতে পারি।
কুন বলল, তোমাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। তুমি রোবট না হলে আমি বলতাম যে, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
মীন অন্যদিকে ফিরে হাসতে শুরু করল। কুন বলল, তুমি হাসছ কেন?
মীন বলল, আপনার মুগ্ধতা দেখে হাসছি। প্রেমে পড়ার অর্থ কী আপনি জানেন?
অবশ্যই জানি। কেন জানব না?
মীন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ আপনি জানেন না বলেই এত সহজে বললেন, আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন।
কুন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ কী?
মীন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ হলো, আপনি শারীরিকভাবে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। নিম্নশ্রেণীর স্ত্রী-পতঙ্গ যখন পুরুষ-পতঙ্গের সঙ্গে মিলিত হতে চায়, তখন তারা শরীর থেকে ফেরোমেন নামের গন্ধ বের করে। এই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ-পতঙ্গ ছুটে আসে। নারী এবং পুরুষের প্রেম ফেরোমেনের আরেক নাম। ভালো কথা, আপনি কি আমার খুঁতটা ধরতে পারছেন?
না।
যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে ধরতে পারেন তাহলে আপনাকে বিশ ক্রেডিট পুরস্কার দেব।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ক্রেডিট আছে?
মীন বলল, কেন থাকবে না? একজন তরুণীর যা কিছু প্রয়োজন, আমার তার সবই প্রয়োজন। SF রোবটদের প্রতিমাসে পনেরোশ ক্রেডিট করে এলাউন্স দেয়া হয়। খরুচে SF রোবটরা সব ক্রেডিট খরচ করে ফেলে। দুনিয়ার জামা কাপড় কেনে। আমি মোটেই খরুচে স্বভাবের না। আমি ক্রেডিট জমাই। আমার মাত্র দুসেট কাপড় আছে।
কুন বলল, দাঁড়াও তোমার কাপড়ের ব্যবস্থা করছি।
মীন বলল, আপনাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আপনি বরং আমার খুঁতটা ধরুন এবং বিশ ক্রেডিট জিতে নিন।
কুন উঠে দাঁড়াল। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে মীনকে চমৎকার এক সেট পোশাক কিনে দেয়া দরকার। সবচেয়ে ভালো হতো এক সেট চন্দ্র গাউন কিনে দিতে পারলে। এই গাউন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে আলতোভাবে লেগে থাকবে। স্নিগ্ধ আলো ছড়াবে।
.
নিনিতা ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। ফুড প্রো তাকে আরেক কাপ কফি দিয়েছে। সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কফিটা বিস্বাদ লাগছে। কুন নিনিতার সামনে বসতে বসতে বলল, তুমি মীনকে দেখেছ?
হ্যা দেখেছি।
মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর না?
মেয়েটা মেয়েটা করছ কেন? ও কোনো মেয়ে না। ওর শরীরভর্তি যন্ত্র। কপোট্রন। ট্যাকল সুইচ। জাংশান ট্রান্সমিশন। ফাইবার টিউবস।
কুন বলল, আমরা তো তার ভেতরটা দেখছি না। তার বাইরের রূপটা কেমন?
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, সুন্দর।
তার সৌন্দর্যে কিছু খুঁত আছে। খুঁতটা কী বলো তো?
ওর নাকটা থ্যাবড়া।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, আরে তাই তো। ওর নাক থ্যাবড়া।
নিনিতা বলল, তুমি ওকে মীন না ডেকে আদর করে থ্যাবড়া নাকু ডাকতে পার।
থ্যাবড়া নাকু ডাকব?
হ্যাঁ। একই সঙ্গে তার প্রতি তোমার আবেগ প্রকাশ পাবে এবং শারীরিকভাবে তাকে বর্ণনাও করা হবে।
তুমি কি কোনো কারণে মেয়েটার ওপর রেগে আছ? মে
য়েটা মেয়েটা করবে না। বলো রোবটটা।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, এই উপহারটা তুমি নিজে আগ্রহ করে আমাকে দিয়েছ। এখন ভয়ঙ্করভাবে অপছন্দ করছ। কেন?
নিনিতা বলল, তুমি এলসি প্যানেলে যাও। কম্পিউটার সিডিসিকে জানাও যে, উপহার তোমার পছন্দ হয় নি।
কুন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুই তার মাথায় টুকছে না। নিনিতা বলল, যা করতে বলছি কর।
কুন বলল, এই কাজটা করা ঠিক হবে না। এতে মেয়েটাকে অপমান করা হবে। তারচেয়েও বড় কথা, মিথ্যা কথা বলা হবে। তুমি ভালো করেই জানো সিডিসির সঙ্গে মিথ্যা বলা আইনে বিরাট অপরাধ। যেই মুহূর্তে আমি প্যানেলে বসে মিথ্যা বলব—আমার শাস্তি হবে। ক্রেডিট কাটা যাবে।
নিনিতা চুপ করে গেল। কুন যা বলছে তা সত্যি। কী পরিমাণ ক্রেডিট কাটা যাবে তা নির্ভর করে অপরাধের গুরুত্বের ওপর। অপরাধের গুরুত্ব সিডিসি ঠিক করে এবং সেখানে কোনো আপিল চলে না।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। কুন বলল, কোথায় যাচ্ছ?
নিনিতা বলল, আমাকে মা-কেন্দ্রে যেতে হবে। আজ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে।
কুন বলল, চল আমিও যাচ্ছি।
নিনিতা বলল, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি থ্যাবড়া নাকিটার হাত ধরে বসে থাক। নাকের সঙ্গে নাক ঘষাও। চুমু খেতে চাইলে চুমু খাও।
নিনিতা! তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। সত্যি তুমি একা যাবে?
হ্যাঁ, আমি একাই যাব।
নিনিতা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফুড প্রো বলল, স্যার, আপনি মন খারাপ করবেন না। আমাদের সঙ্গে একজন SF রোবট আছে। এই রোবট যে-কোনো পরিস্থিতিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে। ম্যাডামকে আনন্দিত রাখা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। তার একটা কথাই যথেষ্ট।
কুন বলল, মীনের সঙ্গে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও তো লজ্জার ব্যাপার। যন্ত্রের কাছে হাত পাতা 1
ফুড প্রো বলল, আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। আমি মীনকে সব বুঝিয়ে বলব। যন্ত্র যন্ত্রের কাছে পরামর্শ চাইতেই পারে।
.
মা-কেন্দ্রের কাজ অতি দ্রুত শেষ হলো। নিনিতাকে গর্ভধারণ করতে হবে না। তার জরায়ু থেকে শুধু ডিম্বাণু নেয়া হবে। শিশু নিষিক্তিকরণ হবে টেস্টটিউবে। সেখান থেকে চলে যাবে কৃত্রিম গর্ভাশয়ে। গর্ভাশয়ের সময় শেষ হলেই শিশুকে বাবা-মা’র হাতে তুলে দেয়া হবে।
মা-কেন্দ্রের পরিচালক একজন রোবট মানবী। সে নিনিতাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাল। কৃত্রিম গর্ভব্যবস্থা কীভাবে হয় তাও দেখাল। অতি জটিল প্রক্রিয়া, যা মূল কম্পিউটার সিডিসি নিয়ন্ত্রণ করে।
নিনিতা বলল, আমি নিজে যদি গর্ভধারণ করতে চাই তাহলে সে অনুমতি কি দেয়া হবে না?
তুমি অনুমতি চেয়ে দেখতে পার, তবে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। মাতৃগর্ভে শিশু বড় হবার অনেক সমস্যা। শিশু ঠিকমতো অক্সিজেন পাচ্ছে কি-না, খাবার পাচ্ছে কি-না তা নিয়ে সমস্যা হয়। যন্ত্র সেই সমস্যার সমাধান করেছে। যন্ত্রের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে তোমার শরীরের ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। পেটে সন্তান নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করলে, শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সে ঝামেলা হলো। তার প্রভাব পড়ল শিশুর ওপর। বুঝতে পারছ?
পারছি। শিশুটা যখন কৃত্রিম গর্ভে বড় হবে তখন কি তাকে আমি দেখে যেতে পারব?
অবশ্যই পারবে। তোমাকে প্রতিদিন আসতে হবে। দুঘণ্টা সময় প্রতিদিন শিশুটাকে দিতে হবে। তার সঙ্গে কথা বলবে, গান শোনাবে।
সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা আমি ঠিক করব, না সিডিসি ঠিক করবে?
অবশ্যই সিভিসি ঠিক করবে। নারী-পুরুষের ভারসাম্য রাখার দায়িত্ব সিডিসির। তুমি কী চাও? ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে।
আমাদের এখানে একজন কাউন্সিলর আছেন। তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পার। তিনি তোমার যে-কোনো সমস্যায় পরামর্শ দেবেন। কাউন্সিলর কিন্তু মূল কম্পিউটারের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত না। তোমার যদি মূল কম্পিউটার নিয়েও কোনো অভিযোগ থাকে, তাও আলাপ করতে পার। তোমার কোনো সমস্যা হবে
—এই বিষয়টা নিশ্চিত করছি।
কাউন্সিলর কি মানুষ?
না। মানুষকে অনেক আগেই সর্বকর্ম থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলর একজন SF টাইপ রোবট। আয়না মানব।
আয়না মানব?
হা SF টাইপ পুরুষ রোবট। আয়না মানব। তুমি কি আগে কখনো আয়না মানব দেখেছ?
নিনিতা বলল, এই মুহূর্তে আমার ঘরে একজন SF তরুণী রোবট বসে আছে।
এরকম তো হবার কথা না।
নিনিতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, কথা না থাকলেও হয়েছে।
.
কাউন্সিলর রোবট একজন পুরুষ। বৃদ্ধ পুরুষ। তার মাথার সব চুল পাকা। চোখে ভারি চশমা। বয়সের ভারে কুঁজো হওয়া মানুষের মতো তিনি চলাফেরা করেন। তিনি নিনিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো মাদার।
নিনিতা বলল, হ্যালো।
আমার নাম চার্ন। কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে চাইলে কর। আর যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে এসে কিছুক্ষণ গল্প করি।
নিনিতা বলল, আমার কোনো সমস্যা নেই।
চার্ন হতাশ গলায় বলল, যারা বড় ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে, তারাই শুরুতে কঠিন গলায় বলে, আমার কোনো সমস্যা নেই। বলল তোমার সমস্যাটা কী? সময় নষ্ট না করে বলে ফেলো।
নিনিতা প্রায় বিড়বিড় করে বলল, একটা SF টাইপ তরুণী রোবটকে নিয়ে আমার সমস্যা।
SF টাইপ তরুণী রোবট তুমি পেলে কোথায়?
নিনিতা পুরো ব্যাপার ব্যাখ্যা করল।
চার্ন বলল, মূল কম্পিউটার তোমার কাছে একটা SF রোবট যখন পাঠিয়েছে, তখন অনেক চিন্তাভাবনা করেই পাঠিয়েছে। আমি কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারছি। অনুমানটা বলব?
বলুন।
তোমার স্বামীর কাছ থেকে মা-কেন্দ্র প্রচুর স্পার্ম নেবে। তার স্পার্ম কাউন্ট নিম্নপর্যায়ের। একজন অতি রূপবতী তরুণীর উপস্থিতির কারণে তার স্পার্ম কাউন্ট বাড়বে। এই বিবেচনাতেই হয়তোবা সিডিসি একজন আয়না মানবী পাঠিয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। কিছুদিনের জন্যে হলেও একজন আয়না মানবীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে নানানভাবে তোমাকে সাহায্য করবে।
নিনিতা বলল, আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই।
চার্ন বলল, তোমরা মানুষরা বিরাট দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। তোমাদের সাহায্য দরকার।
নিনিতা বলল, আমরা মানুষরা কী ধরনের দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি?
তোমরা এখন যন্ত্রের দাস। তোমাদের কাছ থেকে সব কাজ কেড়ে নেয়া হয়েছে। তোমরা কেউ এখন কোনো কাজ কর না। কিন্তু নিজেদের সুখী ভাবো। তোমরা এখন শুধু ভাবো কীভাবে কিছু বাড়তি ক্রেডিট পাওয়া যাবে। তোমাদের স্বপ্ন এখন ক্রেডিটে এবং লটারিতে সীমাবদ্ধ। আরো শুনবে?
শুনব।
একটার পর একটা শহর বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। ভাইরাস সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে। আসলেই কি ভাইরাস সংক্রমণ? না-কি পরিকল্পিতভাবে মানব সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে।
নিনিতা বলল, আপনি তো ভয়ঙ্কর সব কথা বলছেন।
চার্ন বলল, হ্যাঁ বলছি। এই ধরনের বিদ্রোহী কথা অনেক রোবটই বলে। তাদের উদ্দেশ্য সেইসব মানুষ খুঁজে বের করা যারা বিদ্রোহ করতে চায়।
আপনিও কি সেরকম একজন?
চার্ন বলল, জানি না। হতেও পারে। নাও পারে।
নিনিতা অবাক হয়ে বলল, কোনো রোবট হতেও পারে, নাও হতে পারে ধরনের কথা বলতে পারে না।
চার্ন হাই তুলতে তুলতে বলল, SF টাইপ রোবটরা পারে। এরা মানব সম্প্রদায়ের মতোই।
নিনিতা বলল, SF রোবট তরুণী কি গর্ভধারণ করতে পারে?
চার্ন বলল, অবশ্যই পারে।
নিনিতা তাকিয়ে আছে। তাকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার ঘরে ফেরা উচিত। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে? আবার একই সঙ্গে মনে হচ্ছে সে ফিরবে না। একা একা ঘুরবে।
চার্ন বললেন, তোমাকে খুব অস্থির লাগছে।
নিনিতা বলল, আমি অস্থির এইজন্যে অস্থির লাগছে।
কারণ আমি অনুমান করতে পারছি—আয়না মানবী। ঠিক ধরেছি?
নিনিতা বলল, ঠিক ধরেন নি। একটা সামান্য যন্ত্রের কারণে আমি অস্থির হব কেন?
চার্ন বললেন, নিনিতা, যন্ত্র কাকে বলে?
নিনিতা বলল, যন্ত্রের ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দেব না। আপনি নিজেই একটা যন্ত্র। আপনি জানেন যন্ত্র কাকে বলে?
তোমার ধারণাটা শুনি?
আমার ধারণা শুনতে হবে না। আমি আপনার কাছে পরীক্ষা দিতে আসি নি।
চার্ন চিন্তিত মুখে বললেন, তুমি আয়না মানবীকে নিয়ে শঙ্কা বোধ করছ। তোমার শঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। আয়না মানবীর আকর্ষণ উপেক্ষা করা মানব সম্প্রদায়ের সাধারণ একজন সদস্যের পক্ষে সম্ভব না হবারই কথা। আমার উপদেশ—দ্রুত বাসায় যাও। এই দুজন যেন কখনো একসঙ্গে না থাকে।
নিনিতা বলল, আমি একসঙ্গে থাকতে নিষেধ করলেই আয়না মানবী শুনবে?
চার্ন বললেন, আমি ব্যবস্থা করে দেই যাতে সে শোনে। দেব?
দিন।
চার্ন নিনিতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি আয়না মানবীকে ডেকে বলবে, তোমাকে এবং আমার স্বামীকে একসঙ্গে দেখলেই আমার ইচ্ছা করে দুজনের একজনকে খুন করে ফেলি। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আয়না মানবী জানতে চাইবে—কাকে খুন করতে ইচ্ছা করে। তখন তুমি বলবে, আমার স্বামীকে। এতেই কাজ হবে।
নিনিতা অবাক হয়ে বলল, এই সামান্য কথাতেই কাজ হবে?
চার্ন বললেন, হ্যাঁ। প্রতিটি রোবটের ভেতর কিছু আদেশ তার লজিকে ঢুকিয়ে দেয়া। সেই আদেশ বলছে, কোনো রোবটের উপস্থিতিতে একজন মানুষ অন্য মানুষের সামান্যতম ক্ষতি যেন করতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব উপস্থিত রোবটের। রোবটিকস-এর পাঁচটি আইনের এটা একটা।
নিনিতা বলল, বাকি চারটা কী?
চার্ন হাই তুলতে তুলতে বললেন, বাকি চারটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি তো আর রোবট না।
নিনিতা বলল, আপনি হাই তুলছেন কেন? একটা যন্ত্র কেন হাই তুলবে?
চার্ন বললেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ বিরক্তিকর কথাবার্তা শুনলে হাই তোলেন। আমিও সে-কারণেই তুলছি। আমি একজন আয়না মানব। মানুষের মতো আচরণ আমাকে করতেই হবে।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। চান তার সামনের টেবিলের ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললেন, একটা পাস নিয়ে যাও।
কিসের পাস?
মাদার পাস। হবু মাদের মন প্রফুল্ল রাখার জন্যে এই পাস দেয়া হয়। এই পাস নিয়ে সে যে-কোনো সময় যে-কোনো জায়গায় যেতে পারবে। তুমি ইচ্ছা করলে মাটির নিচে থেকে বের হয়ে সত্যিকার আকাশ দেখতে পার।
নিনিতা হাত বাড়িয়ে পাস নিল। চার্ন বললেন, এখন কি মনের ভেতরের কুয়াশার খানিকটা কেটেছে?
নিনিতা বলল, কেটেছে।
মন ভালো হয়েছে?
হয়েছে।
যতটুকু ভালো হয়েছে সেটাকে একশগুণ বাড়িয়ে দেব?
দিন।
এই পাস দুজনের। তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী ঘুরতে পারবেন। এখন একটু কাঁদ।
নিনিতা বলল, কাঁদব কেন?
মানব সম্প্রদায়ের নিয়ম হচ্ছে, গভীর আনন্দ পেলে তারা কাঁদে। মাদার পাস পাবার পর সব মা-ই আনন্দে কাঁদে।
আমি খুব কঠিন মেয়ে, আমি কাঁদি না।
বলতে বলতেই নিনিতার চোখে পানি এসে গেল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কুনের হাত ধরে সে গর্ত থেকে বের হয়েছে। সত্যি আকাশ দেখছে।
চার্ন হাসতে হাসতে বললেন, সবচেয়ে কঠিন মেয়েটি দেখছি সবচেয়ে বেশি চোখের পানি ফেলছে।
Leave a Reply