০২. সভ্যতা
সভ্যতার দুটি ধারা। একটি ধারা ঊর্ধ্বমুখী। বসতি গ্রহে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তৈরি করা তার লক্ষণ। অন্য ধারা নিম্নমুখী। সেই ধারায় ভূগর্ভে প্রবেশ করা হয়। সভ্যতা গড়ে উঠে গ্রহের গভীরে। দ্বিতীয় ধারার সভ্যতা (নিম্নমুখী সভ্যতা)
শ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলে বিবেচনা করা হয়।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা, পৃষ্ঠা ১০০৩
চার হাজার নয়ের পৃথিবী অসংখ্য ছোট ছোট শহরে বিভক্ত। শহরগুলির কোনো নাম নেই। তাদের জন্যেও পিন নাম্বার। নিনিতারা যে শহরে বাস করে তার নাম
শহর ০০৩০০৭০০১/৫৫২
পিন নাম্বারগুলির একেকটির একেক অর্থ। এই অর্থ সাধারণ শহরবাসীর জানা নেই। জানার প্রয়োজনও নেই। শহরের পরিচালক একজন মেয়র। তিনি মানুষ নন, Humonoid Robot. শহরবাসীরা যে-কোনো সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শহরবাসীর সমস্যার সমাধান করেন।
শহরগুলির প্রধান বৈশিষ্ট হলো—সবই মাটির নিচে। শহরবাসীর মাটির নিচ থেকে বাইরে আসার নিয়ম নেই। আসতে হলে বিশেষ ধরনের সৌর স্যুট পরে আসতে হবে। এবং কেন বাইরে আসতে চায়, তার জন্যে মেয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনেরবেলা বাইরে আসতে না দেয়ার প্রধান কারণ সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি। পৃথিবীর আয়ানোস্ফিয়ার নষ্ট হয়ে যাবার কারণে মহাজাগতিক রশ্মি মানুষের জন্যে অতি বিপদজনক হয়ে পড়েছে।
জীবাণুমুক্ত পরিবেশ এবং অতি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে মানুষ তিনশ থেকে চারশ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মানুষকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখা শহরের জন্যে কষ্টকর। ফুড প্রো সব তৈরি করতে পারছে, বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারছে না। প্রতিটি শহরের জন্যে বরাদ্দ করা পানি শহরবাসীকে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়। একশ বছর পার হবার পর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরেও মানুষ খাবারে ব্যবহৃত পানি চা-কফি খেয়ে যত দিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারে। অনেকেই তা চায় না। তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্যে আবেদন করেন। শহরের মেয়র তা মঞ্জুর করেন।
গত তিনশ বছর ধরে মানুষকে সর্ব কর্ম থেকে মুক্ত করা হয়েছে। তাদের সব কাজ করছে রোবটরা। মানুষের প্রধান কাজ আনন্দে সময় কাটানো। মাটির নিচে অসংখ্য ফান সেন্টার আছে। কিছু কিছু যৌনপল্লী আছে। যৌনপল্লীতে পতিতা হিসেবে আছে হিউমনয়েড রোবট। এরা অপরূপ রূপবতী। মানুষের মতো ছলাকলায় সিদ্ধ। নৃত্য-গীতে পারদর্শী।
মাটির নিচে কৃত্রিম বন তৈরি করা আছে। বনে প্রাচীন পৃথিবীর প্রাণী বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা দেখতে অবিকল প্রাচীনকালের জীবজন্তুর মতো হলেও সবই রোবট। শহরবাসী ইচ্ছা করলেই এইসব প্রাণী শিকারে যেতে পারেন। তবে তাদের যথেষ্ট সাবধান হতে হয়। কারণ এইসব রোবট জন্তু হিংস্র এবং এরা রোবটের মূলনীতি মানে না। রোবটের মূলনীতি হলো—আমরা মানুষের ক্ষতি করব না। আমরা মানুষের অনিষ্ট হবে এমন কিছু হতে দেব না।
শিকারে যেতে হলে মেয়রের কাছ থেকে লাইসেন্স এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৭০.২১ ভাগ মানুষ শিকার থেকে জীবিত ফেরে না। যারা ফিরে তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে একশ ক্রেডিট দেয়া হয়।
বিনোদনের জন্যে আগ্নেয়গিরি ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তাপ নিরোধক পোশাক পরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার কাছাকাছি যাওয়া এবং ফিরে আসা। এই ভ্রমণও অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের কোনো নিয়মশৃঙ্খলা নেই। যে-কোনো সময় অগ্নৎপাত ঘটতে পারে।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৬০,৭৩ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু মানুষ জীবিত ফিরতে পারে না। যারা ফিরে তারা একশ ক্রেডিট পায়।
শহরগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। কারণ কোনো শহরের সঙ্গেই অন্য কোনো শহরের যোগাযোগ নেই। এক শহরের মানুষ জানে না অন্য শহরে কী হচ্ছে। তার পেছনেও কারণ আছে। মহাজাগতিক রশ্মির কারণে হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভাইরাসের মিউটেশন হয়। এমন এক ভাইরাসের নাম V-305, যার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা রোবট বিজ্ঞানীরা এখনো নিতে পারে নি। V-305 ভাইরাসে শহরের যে-কোনো একজন আক্রান্ত হলে অতি দ্রুত ভাইরাস পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের সব মানুষের মৃত্যু ঘটে। শহর পরিত্যক্ত হয়। নতুন শহর তৈরি করা হয়।
মোট কতগুলি শহর পরিত্যক্ত হয়েছে তার পরিসংখ্যান সরকারের কাছে আছে। কোনো মানুষের কাছে নেই। এই তথ্য মানুষের কাছে নিষিদ্ধ।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে পৃথিবীর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। যেমন মঙ্গল এবং বুধ গ্রহ। বৃহস্পতির দু’টা চাঁদ। এবং শনির বলয়ের ভেতরে তিনটি চাঁদ। এরা সেখানে কী করছে বা সেখানে কী হচ্ছে শহরবাসীর কাছে সেই তথ্যও নিষিদ্ধ।
শহরবাসী সবরকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খাঁচায় বন্দি পশুর মতোই জীবনযাপন করছে। রোগশোকহীন দীর্ঘ জীবন আনন্দে পার করে দেয়ার চেষ্টা। এই বিষয়ে মহান সুরকার আহানের একটি গান আছে—
আমাদের রোগ নেই,
জরা নেই।
ক্ষুধা কিংবা অক্ষুধা নেই।
স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন নেই।
জ্ঞান নেই, অজ্ঞানতাও নেই।
আমরা শহরবাসী,
আমাদের শহরও নেই।
শহর যে সম্পূর্ণ উত্তেজনাহীন তাও বলা যাবে না। প্রধান উত্তেজনা লটারি। বৎসরজুড়েই নানান ধরনের লটারির ব্যবস্থা আছে। যেমন
বিশেষ নাগরিক লটারি
অল্পকিছু নাগরিক প্রতিবছর বসন্ত উৎসবের দিন এই লটারিতে
জেতেন। শহরের অতি উন্নত
অংশে তারা জায়গা পান। বিশেষ
ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। সেই বিশেষ সুযোগ সুবিধা কী
তা নগরবাসীরা জানেন না।
বিশেষ নাগরিক লটারিতে জেতা
অতি সৌভাগ্যবানরাই তা জানেন।
মহান সঙ্গীতকার আহান
একজন বিশেষ নাগরিক। গুজব
প্রচলিত আছে যে, পানির
তীব্র সংকটের সময়েও বিশেষ
নাগরিকদের জলকেলির
সুবিধা আছে। মিথ্যা পানি
না, সত্যিকার পানির একটি রিজার্ভ।
তবে এই গুজব সত্যি নাও হতে পারে।
মুক্তি লটারি
এই লটারি দুবছর পরপর হয়। যারা এই লটারি জেতেন তারা
পৃথিবীর কঠিন পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করেন। মানুষের নতুন
আবাস চাঁদ বা মঙ্গলে তাদের স্থান হয়। চাঁদ বা মঙ্গলের জীবন খুব
যে আনন্দের জীবন তা-না। কঠিন পরিশ্রমের জীবন। তারপরেও
বেশির ভাগ মানুষ আশা করে, কোনো এক সময় তারা মুক্তি
লটারি জিতবে। পৃথিবীর গহ্বর
থেকে বের হয়ে আসবে। খুপড়ির
মতো ঘরে কর্মহীন জীবনযাপনের চেয়ে মুক্ত হাওয়ায় কঠিন
পরিশ্রম করাকে তারা শ্রেয় মনে করে।
সুপার লটারি
এই লটারি চার বছরে একবার হয়। একমাত্র লটারি যা ইচ্ছা করলে
কেউ গ্রহণ নাও করতে পারে। যারা সুপার লটারিতে জেতেন, তারা
সৌরমণ্ডলের বাইরের কোনো
গ্রহের দিকে যাবার সুযোগ
পান। মনুষ্য
বাসযোগ্য সম্পূর্ণ নতুন একটি গ্রহ খুঁজে বের করায় আনন্দ যেমন
আছে, কঠিন হতাশাও আছে। মহাকাশযান শত শত বৎসর পার করেও
এমন কোনো গ্রহ নাও পেতে পারে। অতি বিপদজনক সুপরি লটারি
কেউ প্রত্যাখ্যান করেছে এমন নজির নেই।
সুপার লটারি বিষয়েও আহানের একটি গান আছে—
আমি মাটির অনেক নিচের একটি গর্তে বাস করি।
আমার মাথার ওপর সীসার কঠিন পুরো ছাদ
অথচ স্বপ্ন দেখি সুপার লটারির
যা আমাকে নিয়ে যাবে আকাশের
কাছে।
সেই সময়ের পৃথিবী অপরাধমুক্ত পৃথিবী। অপরাধের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি মানুষের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে মহা কম্পিউটার সিডিসি। জন্মের পরপর সবার শরীরে একটি মনিটার চিপ চুকিয়ে দেয়া হয়। এই চিপ সারাক্ষণ সিডিসির কাছে খবর পাঠাতে থাকে। কেউ কোনো কারণে উত্তেজিত হওয়া মাত্র ঘরের থ্রিডি ক্যামেরা চালু হয়ে যায়। একজন মনোবিজ্ঞানীর (রোবর্ট) ছবি পর্দায় ভেসে ওঠে।
মনোবিজ্ঞানী হাসিমুখে প্রশ্ন করে, আপনার কী সমস্যা? কী কারণে বিচলিত বোধ করছেন? আসুন কিছুক্ষণ গল্প করি। তার আগে একটা ওষুধ খেলে কেমন হয়? আপনি ফুড প্রোর কাছে যান। সে দু’টা ওষুধ দেবে। প্রথম খাবেন নীল রঙের ট্যাবলেট। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর লাল রঙেরটা।
তারপরেও অপরাধ হয়। ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ। হত্যাকাণ্ড। স্ত্রী স্বামীকে মেরে ফেলেন কিংবা স্বামী স্ত্রীকে। দীর্ঘদিন ছোট্ট একটা ঘরে থাকার কারণে এটা ঘটে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় কেবিন ফিভার। অপরাধীকে শাস্তি দেবার বিধান নেই। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় লালকুঠিতে। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় তার স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। তার নতুন জীবন শুরু হয়। শিশু থেকে ক্রমে ক্রমে বড় হওয়া লালকুঠিতে যারা যায়, তারা আর কখনো মূল শহরে ফিরতে পারে না।
শহরের মানুষদের জন্যে প্রচুর আনন্দ উপকরণ থাকলেও তারা মূল আনন্দ পায় ক্রেডিট জমিয়ে। একশ বছর পার হবার পর যখন খাবার পানি বন্ধ করে দেয়া হবে, তখন ক্রেডিট খরচ করে পানি কেনা যাবে। এক ক্রেডিটের বিনিময়ে ত্রিশ দিনের পানি।
উপহার হিসেবেও ক্রেডিট লেনদেনের ব্যবস্থা আছে। সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ক্রেডিটের লেনদেন হয়। মূল কম্পিউটার সিডিসি প্রায়ই কিছু ক্রেডিট বিতরণ করে। কোনো কোনো ভাগ্যবানের থ্রিডি পর্দায় হঠাৎ লেখা ওঠে
অভিনন্দন!
কম্পিউটার সিডিসি আপনাদের দুজনকেই পাঁচ ক্রেডিট করে দিচ্ছে।
আপনাদের জন্যে উপহার।
অপরাধীর (যার স্থান হয়েছে লালকুঠিতে) সমস্ত ক্রেডিট সরকার নিয়ে নেয়। এইসব ক্রেডিটই পরে সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। তাও হয় লটারিতে।
চার হাজার নয়ের পৃথিবী লটারির পৃথিবী। আনন্দময় দুঃস্বপ্নের পৃথিবী। সেই পৃথিবী শাসন করে রোবটরা।
রোবট বিজ্ঞান তখন উন্নতির চরম শিখরে। রোবট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে Neno chips. যা মানুষের দৃষ্টিসীমা’র বাইরে। অসাধারণ তার ক্ষমতা।
পৃথিবীতে এসেছে SF Humonoid Robot. সিলিনিয়ামের s এবং ফ্রেনসিয়ামের F থেকে SF, এরা মুক্তবুদ্ধি রোবট। দেখতে অবিকল মানুষের মতো। আচার-ব্যবহারও সেরকম।
সাধারণ রসিকতা হিসেবে বলা হয়, একটি SF রোবটকে মানুষের কাছ থেকে আলাদা করার তিনটি উপায়
১. SF রোবট মানুষের চেয়ে বেশি ভোজনরসিক।
২. SF রোবটদের লজ্জা মানুষের চেয়ে বেশি।
৩. SF রোবটরা মানুষের চেয়ে দ্রুত প্রেমে পড়ে।
SF রোবটরা মানুষের মতোই নাগরিক সুবিধার অধিকারী। তারাও লটারিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। SF নারী রোবটরা গর্ভধারণে সক্ষম, তবে তাদেরকে সেই অধিকার এখনো দেয়া হয় নি। শোনা যাচ্ছে, পরীক্ষামূলকভাবে কিছু SF নারী রোবটকে মাতৃত্বের লাইসেন্স দেয়া হবে। সেই ক্ষেত্রে Egg এবং Sperm দুটোই নেয়া হবে মানুষের কাছ থেকে। নারী SFরোবট শুধুই গর্ভধারণ করবে।
Leave a Reply