ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমাদের শিক্ষাজীবনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী। শুধু আমাদের সময়ে নয়, তাঁর মতো ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক তাঁর আগেও কেউ ছিলেন না, পরে কেউ হননি, ভবিষ্যতেও হবেন কিনা সন্দেহ। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে বর্তমান অবধি বাংলা বিভাগে খ্যাতিমান শিক্ষক, গবেষক ও বিদ্বানের অভাব কখনো ঘটেনি। মুনীর চৌধুরীও খুব বড় বিদ্বান ছিলেন, পাণ্ডিত্য তাঁরও ভূষণ, কিন্তু কখনোই তিনি বিদ্যা জাহির করতেন না বরং বিষয়টিকে কৌতুকে সরস করতেন তিনি। গবেষণা তাঁর ধাতে ছিল না, যদিও গবেষণা যে তিনি করেননি তাও নয়। তিনি গবেষণাকে এমন অপূর্ব সৃষ্টিশীলতায় মণ্ডিত করতেন যে মনেই হতো না এটি গবেষণা। এ কথা তাঁর মীর মানস, তুলনামূলক সমালোচনা, বাংলা গদ্যরীতি ইত্যাদি গ্রন্থ সম্বন্ধে প্রযোজ্য। তাঁর উপস্থাপনরীতি, ভাষাভঙ্গি ও শৈলী সাহিত্যের রমণীয় রস প্রাণতার দিকে নিয়ে যায়। সাহিত্য, সমালোচনা, ভাষা, মাতৃভাষা, ভাষাতত্ত্ব ও সংখ্যাতত্ত্ব, ভাষা সংস্কার, নবনাট্য, গ্রন্থবিচার ইত্যাদি গুরুতর বিবিধ বিষয়ে তিনি যে ছোট ছোট প্রবন্ধ লিখেছেন, সেগুলোও ভঙ্গিতে বিশিষ্ট এবং রসে আবিষ্ট। মুনীর চৌধুরী বাংলাদেশি গদ্যসাহিত্যের এক অনুপম শিল্পী।
মুনীর চৌধুরীর সৃষ্টিশীলতার উজ্জ্বলতম এলাকা সবার সুবিদিত। বাংলাদেশি নাটকেরও প্রথম পুরুষ তিনি। ভারত বিভাগোত্তরকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নাট্যরচনা ও নাট্যচর্চার ভিত্তি তৈরিতে তাঁর অবদান ব্যাপক, সর্বপ্রধানও। তাঁর সময়ে আরও দুজন নাট্যকারের নাম তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতো—নুরুল মোমেন ও আসকার ইবনে শাইখ। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর নাট্যবোধ, পড়াশোনা ও সৃষ্টিকর্ম ওঁদের চেয়ে অনেক বেশি গভীর ও ব্যাপক ছিল। আধুনিক বিশ্ব নাটকের সঙ্গে তিনিই আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। পাশ্চাত্য আধুনিক নিরীক্ষাধর্মী নাটকগুলো নিয়ে আলোচনা করেন তিনিই। তৎকালীন বাংলাদেশি নাটকের বিষয়-আশয়, গতি-প্রকৃতি, বর্তমান রূপ ও ভবিষ্যৎ যাত্রা নিয়ে গুরুতর আলোচনাও করেন তিনি। নাটক বিষয়ে আলোচনাসভায় ও সেমিনারে তিনিই থাকতেন বক্তা হিসেবে। সবাই তাঁকে মান্যও করত এবং তাঁর মতামতে বিপুলভাবে উপকৃত হতো। মুনীর চৌধুরীর ভাবশিষ্যরা যেমন মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার এবং আরও অনেকে তাঁর রচিত নাট্যসরণিকে আরও প্রশস্ত ও সমৃদ্ধ করেছেন। গণমানবের সংলগ্নতা, দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ, মধ্যবিত্তের জীবন কিংবা ইতিহাসের মানবিকধারার সমকালীন আবেদন সৃষ্টিতে মুনীর চৌধুরী ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মৌলিক নাটক লিখেছেন অনেকগুলো—রক্তাক্ত প্রান্তর, চিঠি, দণ্ডকারণ্য, পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য। সবাই জানেন যে একুশের ভাষা আন্দোলনের অমর নাটকের স্রষ্টা মুনীর চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জেলে পোরা হয়। বন্দী-জীবনের সেরা ফসল কবর নাটক, যা মুনীর চৌধুরীর নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনুবাদ নাটকেও মুনীর চৌধুরী তখন পর্যন্ত সবশীর্ষে। পাশ্চাত্য নাটকগুলোর সৃষ্টিশীল অনুবাদ করে তিনি অনুবাদ-নাটক রচনার যে রূপরীতি তৈরি করে দেন, সেটিও পরবর্তী নাট্যজন ও নাট্যমোদীদের অনুসরণীয়। কেউ কিছু বলতে পারে না, রূপার কৌটা, মুখরা রমণী বশীকরণ, বৈদেশিকী, ওথেলোর বেশির ভাগ অংশ (তাঁর বড় ভাই কবীর চৌধুরী অসমাপ্ত ওথেলোর অনুবাদ কাজ সমাপ্ত করেন) এবং আরও কিছু অসমাপ্ত নাট্যানুবাদ নিয়ে তাঁর অনুবাদ নাটকের রাজ্য। আশ্চর্য সফলতা দেখিয়েছেন শেক্সপিয়ারের বাংলা অনুবাদে। আমার বেশ মনে আছে, টেমিং অব দি শ্রুর বাংলা নাট্যরূপদান এবং টেলিভিশনে সে নাটকের সম্প্রচারের আয়োজনের কথা। তখন মুনীর চৌধুরী বাংলা বিভাগের সভাপ্রধান। বিভাগীয় প্রধানের কক্ষেই বেলা ১২টার দিকে কয়েকজনকে নিয়ে বসতেন তিনি। আসতেন গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, জিল্লুর রহমান খান, ফারুকুল ইসলাম, লায়লা হাসান, কখনো কখনো রেশমা। এঁরা সবাই মুখরা রমণী বশীকরণ-এর কুশীলব। আমরা তখন স্যারের তরুণ সহকর্মী। স্যার মুখরা রমণীর অনুবাদ নিয়ে আসতেন, পড়ে শোনাতেন অপূর্ব সরস ভঙ্গিতে, অভিনেতাদের নির্দেশনাও দিতেন। সবাই দারুণভাবে উপভোগ করত। পড়ার পরে স্যার আমার হাতে পাণ্ডুলিপি ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘দেখ তো বানান-টানানে ভুল আছে কি না, আমি তো বানানে অত পারদর্শী নই।’ মুনীর চৌধুরী বাংলা বানান জানবেন না তা হতেই পারে না। আসলে বানান নিয়ে নির্মল কৌতুক করে তিনি আনন্দ পেতেন।
মুনীর চৌধুরী এক সংস্কৃতিসমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান। তিনি পিতা-মাতার দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর চেয়ে বছর দুয়েকের বড় কবীর চৌধুরী পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, ইংরেজির ছাত্র, অসাধারণ মেধাবী, পরীক্ষায় কখনো দ্বিতীয় হননি, বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ ক্ষেত্রে স্মরণীয় নাম। পড়াশোনায় অতিমাত্রায় সুস্থির। মুনীর চৌধুরী রস করে বলতেন, ‘পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেতে চাইলে আমার ভাইয়ের পদ্ধতি অনুসরণ করো। উত্তরপত্রের প্রথমে একটু খালি জায়গা রাখবে মুখবন্ধ লেখার জন্য, তারপর একটি উদ্ধৃতি বসাবে, তারপর খালি জায়গা, তারপর উদ্ধৃতি। এখন তোমার কাজ তোমার লেখা শূন্যস্থান পূরণ করা। দেখবে প্রথম শ্রেণীর চমৎকার উত্তর হয়ে যাবে।’ ভাইয়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসা ছিল অগাধ, সেটি বলতেনও অকপটে। অনুজদের প্রতিও তেমনি স্নেহ, প্রীতি ও নৈকট্যবোধ—নাদেরা চৌধুরী, নাসির চৌধুরী, ফেরদৌসী, বানু, রাহেলা সবার প্রতি। বলতেন, ‘আমাদের বাড়িতে ইংরেজি পড়াব চল আছে এবং আমরা পারলে একাধিক ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হই। যেমন মুনীর চৌধুরী ইংরেজি ও বাংলা দুটোতেই এমএ, ফেরদৌসী বাংলা ও আরবিতে এমএ।’ বড় ভাইয়ের মতো মুনীর চৌধুরী পড়াশোনায় নিখাদ মনোযোগী ছিলেন না, শৈশবে অনেকটা দুরন্ত ছিলেন। ম্যাট্রিক পাসের পর তাঁকে আলীগড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সেখান থেকে আইএ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অনার্সের ছাত্র হন। এমএ পাস করে তিনি কয়েকটি কলেজে শিক্ষকতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন ইংরেজির প্রভাষক হয়ে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা জেলে যান তিনি, সেখানেই কবর নাটক লেখেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন (১৯৫৪)। তাঁর সঙ্গে আমার আরেক শিক্ষক ডক্টর আলাউদ্দিন আল আজাদও প্রথম শ্রেণী পান এবং দ্বিতীয় হন। শ্রুতি আছে, মুনীর চৌধুরীর একটা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক। উত্তরপত্র দেখতে দেখতে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘এই শালা কী লিখেছে?’ মুহাম্মদ এনামুল হক কখনো অশিষ্ট উচ্চারণ করতেন না। কিন্তু মনে হয়, উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিপুলানন্দে তিনি আত্মহারা হয়েছিলেন। ডক্টর মুহাম্মদ এনামুলের প্রতি মুনীর চৌধুরী ছিলেন ভক্তিমান। পরে যখন তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হন, তখন মুহাম্মদ এনামুল হককে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে নিয়ে আসেন।
কারামুক্ত হয়ে মুনীর চৌধুরী ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন, পরে বাংলা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ আবদুল হাই মুনীর চৌধুরীকে বাংলা বিভাগে চিরকালের জন্য নিয়ে আসেন। মুহাম্মদ আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে যে বাংলা বিভাগ গড়ে ওঠে, সে সময় ও কালকে বলা হয় ‘বাংলা বিভাগের স্বর্ণযুগ’। মুনীর চৌধুরী সেই স্বর্ণযুগের সেরা স্বর্ণপালক। তাঁর সংযোজন বাংলা বিভাগকে আধুনিকতায় মণ্ডিত করে। বাংলা বিভাগ তখন ভাষাতত্ত্ব চর্চার ও পড়াশোনার কেন্দ্র। হাই সাহেব বিখ্যাত ধ্বনিবিজ্ঞানী, মুনীর চৌধুরীও গেলেন হার্ভার্ডে (১৯৫৮) এবং সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি নিয়ে এলেন। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক চার্লস এ ফার্গুসনের সঙ্গে ‘দি ফোনিমস অব বেঙ্গলি’ নামে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ে অমূল্য একটি সন্দর্ভ রচনা করেন। সেটি সাম্প্রতিককালে ডক্টর সন্জীদা খাতুনের ছোট ভাই কাজি মাহবুব হোসেন অনুবাদ করেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক মনসুর মুসা। ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে মুনীর চৌধুরীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। ১৯৭০-এর দিকে ফার্গুসন সাহেব যখন স্টাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তখন স্টাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ মিলে সমাজ ভাষা বিজ্ঞানের একটি প্রকল্প পরিচালিত হয়। সেই প্রকল্পে সুইডেনের ভাষা বিজ্ঞানী বিয়ন ইয়ারনুড, আমেরিকান ছাত্রী কিটি হথর্ন যুক্ত হন। মুনীর চৌধুরী ছিলেন এ প্রকল্পের দেশীয় প্রধান, সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ডক্টর রফিকুল ইসলাম, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক মনসুর মুসা, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং আমি ছিলাম। আমাকে বাংলা একাডেমী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ইংরেজি বিবরণ ও প্রশ্নমালা বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হয়েছিল। প্রকল্প নিয়ে আমাদের আনন্দকর স্মৃতি আছে। প্রতি সপ্তাহে এক দিন বিকেলবেলায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের বাসায় প্রকল্প নিয়ে করণীয় ও নির্দেশনা নিয়ে বৈঠক হতো। অধ্যাপক ইসলাম প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন মিষ্টি আনাতেন ঢাকা কলেজের বিপরীতে সদ্যস্থাপিত মিষ্টির দোকান মরণ চাঁদ থেকে। ইয়ারনুড খেয়ে বেজায় তৃপ্ত। বলতেন, ‘প্রফেসর ইসলাম, আপনাদের মিষ্টি যে এত সুস্বাদু ও এত বিচিত্র, তা তো আগে কখনো পাইনি।’ এই ইয়ারনুডের সঙ্গে আমার একবার ঝগড়া লেগে গেল বৈঠকে একটা বিষয়ে। মুনীর স্যার থামিয়ে দিলেন, আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া কোরো না, ওরা অনেক কিছু জানে না, আবার মাতব্বরিও করতে চায়।’ ইয়ারনুড মনসুর মুসার ও আমার ভালো বন্ধু, এখন পর্যন্ত। সে সময়ে মুসা তাঁর কাছ থেকে হাভানা চুরুট চেয়ে নিতেন, আর ইয়ারনুড আমাকে বলতেন, ‘আই লাইক টু হ্যাভ সাম সন্দেশ।’ সাহেবকে ঢাকা শহরের বিচিত্র সন্দেশ খাইয়েছি।
ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব চর্চায় মুনীর চৌধুরীর একটা অবদান বাংলা টাইপ রাইটারের কি-বোর্ড সংস্কার। একাত্তরে মুনীর চৌধুরী শহীদ হওয়ার পরে তাঁর নামেই কি-বোর্ডটির নাম হয় ‘মুনীর অপটিমা’। এই কি-বোর্ডের কথা মনে রেখেই সম্ভবত মুনীর চৌধুরী ‘ভাষাতত্ত্ব, সংখ্যাতত্ত্ব’ নামের প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। বুড়ো আঙুল নিয়ে তাঁর সরস মন্তব্য স্মরণীয়—বেঁটে বটে, কিন্তু বেশ কর্মিষ্ঠ।
বক্তা ও শিক্ষক মুনীর চৌধুরী মহিমা এক কথায় বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর ছাত্ররা, তাঁর শ্রোতারা, টেলিভিশনের দর্শকেরা তাঁর কথা চিরদিন মনে রাখবে। সাহিত্য সভায় কিংবা আলোচনা সভায় অথবা বিতর্কে তাঁর সমতুল্য কোনো বক্তা ছিল না। তাঁর সম্পর্কে এই কথা তো প্রচলিত রয়েছে যে এক বিতর্কসভায় তিনি একই বিষয়ে একবার পক্ষে বলে সেরা হলেন, আবার বিপক্ষে বলেও সেরা হলেন। সাহিত্য সভায় মুনীর চৌধুরী থাকলে অন্যদের আলোচনা ম্লান হয়ে যেত। এটি আমরা বহুবার দেখেছি। কবি আবদুল কাদির সাহিত্য সভায় আগেই বলে রাখতেন, ‘ও মুনীর স্যার, আপনি কিন্তু পরে বলবেন, আমরা আগে বলে নিই। আপনি আগে বললে আমাদের কথা শোনার জন্য কোনো শ্রোতা থাকবে না।’ এমনই হতো, সাহিত্য সভায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, তখন চারজন শিক্ষক আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিলেন। প্রথম জন অবশ্যই মুনীর চৌধুরী, দ্বিতীয় জন আহমদ শরীফ, তৃতীয় আনিসুজ্জামান, চতুর্থ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। মুনীর চৌধুরী সাহিত্যের রস প্রাণতা ব্যাখ্যার, বিশ্লেষণের এবং উপস্থাপনার অসামান্য শিল্পী; আহমদ শরীফ ডিরোজিয়ান ঘরানার শিক্ষক, সমাজবীক্ষা করতেন এমন নৈপুণ্যের সঙ্গে যে ছাত্রদের মন হতো জিজ্ঞাসু; আনিসুজ্জামান পাঠদানে অতি শৃঙ্খলাপূর্ণ, পরিপাটি এবং একেবারেই বাহুল্যবর্জিত, তার ভেতর থেকেই রস অনুভব করতাম আমরা আর আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন রোমান্টিক, কবিমনা, নিপুণ বাকশিল্পী, বক্তৃতাকে কবিতা করে তুলতেন তিনি। এ রকম ক্ষমতা সৈয়দ আলী আহসানেরও। তবে সবার ওপরে মুনীর চৌধুরী। আমি চারজন বক্তার বক্তৃতা শুনে সবচেয়ে মোহিত হয়েছি। একজন নীহাররঞ্জন রায়, অন্যজন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তৃতীয় জন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আর আমাদের দেশে মুনীর চৌধুরী। তিনটি ভাষায় তাঁর অনর্গল দক্ষতা ছিল—বাংলা, ইংরেজি, ও উর্দু। সুইডিশ ইয়ারনুড মুনীর চৌধুরীর ইংরেজি ভাষণে এতই মুগ্ধ ছিলেন, এ রকম ইংরেজি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
এমএ ক্লাসে মুনীর চৌধুরীর কাছে আমি বঙ্কিমচন্দ্র ও বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্ব পড়েছি। তিনি একাই একটা বছর ধরে আমাদের আধুনিক ভাষাতত্ত্ব পড়িয়েছেন। ভাষাতত্ত্বে সরসতার অবকাশ কম, কিন্তু সেখানেও তিনি অনুপম। আর বঙ্কিম পড়ানোর স্মৃতি আমাদের চিরকালের, এই স্মৃতি আমাদের আমরণ থাকবে। বঙ্কিম শেক্সপিয়ার দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে উপন্যাসে নাট্যমুহূর্ত ও আবহ সৃষ্টিতে। বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা সম্বন্ধে বাংলা সাহিত্যের সুখ্যাত এক সমালোচক বলেছেন, এটি শেক্সপিয়ারের নাটকের মতোই নিখুঁত। বঙ্কিমের উপন্যাস রোমান্সে ভরপুর। সেই রোমান্স এবং ঐতিহাসিক ও কল্পিত চরিত্রগুলো নিয়ে মুনীর চৌধুরী এমন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে পড়াতেন যে ক্লাসে সম্মোহন সৃষ্টি হয়ে যেত। সেই মোহের আকর্ষণে অন্য বিষয়ের ছাত্ররাও আমাদের সঙ্গে শ্রেণীকক্ষে যুক্ত হতো। মুনীর স্যার ক্লাসে আসতেন দ্রুত পদবিক্ষেপে, দ্রুত রোল কল করে সেই যে বক্তৃতা শুরু করতেন ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত থামাতেন না। আমরা এতই মোহগ্রস্ত হয়ে থাকতাম যে, ক্লাস কখন শেষ হলো টেরই পেতাম না। তিনি একাই বঙ্কিম পড়িয়েছেন আমাদের। বাংলা শব্দ, দেশি শব্দ, আরবি-ফারসি শব্দ এবং তৎসম শব্দ ও সমাজ আড়ম্বরময় শব্দের অনর্গল স্বতঃস্ফূর্ত ভিয়েনে আমরা বুঁদ হয়ে থাকতাম সর্বক্ষণ। বঙ্কিমের উপন্যাসের নায়িকাদের রূপ বর্ণনায় আমরা পড়ুয়ারা এমনিতেই আমোদিত, তার ওপর কৌতুককর অংশে হাসির উতরোল, কখনো কখনো বিষাদিত অংশের বিষণ্নতা। স্যার আমাদের দোলাচ্ছেন এদিক-ওদিক, মাঝেমধ্যে থুতু ফেলার জন্য, সর্দি ঝাড়ার জন্য বারান্দায় যেতেন; কিন্তু কখন গেলেন কখন এলেন আমরা টেরই পেতাম না। বাকমোহ প্রবাহে আমরা মিশেই থাকতাম। সবার মূল পাঠ থেকে অনুপম ভঙ্গিতে কিছু কিছু অংশ পড়িয়ে শোনাতেন। সেগুলো পাঠদানেরই অপূর্বতা। নাট্যমুহূর্তের পাঠদানে স্যার ছিলেন অতুলনীয়। বঙ্কিমের উপন্যাসের এই বন্দী, আমার প্রাণেশ্বর, পথিক পথ হারাইয়াছ, প্রদীপ নিভিয়া গেল, ভিক্ষুক দৌড়িল কেন, চঞ্চল কুমারীর রোষ, জেবুন্নিসার হাহাকার, মতি বিবির ছিনালীপনা, বিমলার রূপের জমাটবদ্ধতা, গীতোক্তি রোমান্সের প্রফুল্লের ‘ডাকাইতের’ সর্দার হওয়া এবং এ রকম আরও অপূর্ব তাৎপর্যময় ঔপন্যাসিক অংশগুলো চিরকাল আমাদের মনে গেড়ে থাকবে। হিন্দু কলেজের ছাত্র মধুসূদন রিচার্ডসনকে পেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে, আমাদের অতীব সৌভাগ্য আমরা মুনীর চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি।
মুনীর চৌধুরী একসময় বামপন্থী ছিলেন, পরে ‘জীবনের মোহে’ সংসারী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন। বামপন্থার কারণেই তিনি খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন। একসময় প্যান্ট-শার্টও পরেছেন, কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুনীর চৌধুরীর বেশভূষা ও তাঁর বাকভঙ্গি ও উপস্থাপনা কৌশলের অনুপম সরসতা তাঁর ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করবে এইটি স্বাভাবিক। মুনীর চৌধুরীকে অনুকরণ করে কেউ কেউ ঈষৎ সাফল্য যে পাননি তা নয়; কিন্তু কেউ মুনীর চৌধুরী হতে পারেননি। মুনীর চৌধুরী একজনই। আমাদের চরম বেদনা ও দুঃখের ঘটনা এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর আলবদর, আল-শামসের ঘাতক-দালালেরা মুনীর চৌধুরীকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও সমাজের এক অমূল্য মানুষকে ঘাতকেরা এইভাবে নিঃশেষ করে দিল এবং অপূরণীয়ভাবে দীন করে দিল।
মুনীর চৌধুরীর জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৯২৫; ঘাতকদের হাতে ধৃত ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। তাঁর স্ত্রী লিলি চৌধুরী, বিয়ে হয় ১৯৪৯-এ। লিলি চৌধুরীর এখন অনেক বয়স। মুনীর চৌধুরীর তিন সন্তান—ভাষণ, মিশুক ও তন্ময়। মিশুক কিছুদিন আগে মানিকগঞ্জ এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় হত হয়। সে আমাদের দেশের শীর্ষ মিডিয়া ব্যক্তিত্বের একজন। সে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক হয়, তখন খুশি হয়ে আমি বলেছিলাম, তুমি আমার স্যারের প্রতিনিধি। আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর স্মৃতি সব সময় আমাদের মনে জ্বলজ্বলে থাকবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৫, ২০১১
Leave a Reply