আমার বয়স যখন ষোলো থেকে উনিশের মধ্যে; তখন মেক্সিকো সিটির বিভিন্ন বুকস্টোর থেকে যেসব বই চুরি করেছিলাম এবং ২০ বছর বয়সে চিলিতে যাওয়ার পর সেখান থেকে যেসব বই কিনেছিলাম, সেগুলোকেই আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বই বলে মনে করি। সেই বইগুলোকেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। মেক্সিকোতে বিশাল একটা বইয়ের দোকান ছিল। আলামেদা এলাকার ওই দোকানটার নাম ছিল ‘গ্লাস বুকস্টোর’। নামের সঙ্গে মিল রেখে এই দোকানের দেয়াল, এমনকি সিলিংও ছিল কাচের তৈরি। লোহার থাম ও কাচ দিয়ে বানানো বিশাল একটা বুকস্টোর। বাইরে থেকে মনে হতো, এখান থেকে বই চুরি করা একেবারে অসম্ভব। কিন্তু আমার লোভের কাছে পরিণতির চিন্তা হার মানল। একপর্যায়ে আমি চুরির সিদ্ধান্ত নিলাম।
প্রথম যে বইটি আমার হাতে এল, সেটি হলো পিয়েরে লুইসের (ঊনবিংশ শতকের যৌনতাশ্রয়ী কবি) একটা ছোট বই। এটা আফ্রোদিতি নাকি সংস অব বিলিতিস, সে কথা এখন মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে, বইটির পাতাগুলো ছিল বাইবেলের পৃষ্ঠার মতো ফিনফিনে পাতলা। আমি জানি, যেহেতু তখন আমার বয়স ছিল ১৬ বছর, সেহেতু লুইস সহজেই আমাকে চুরির কাজে গাইড করা শুরু করলেন। এরপর একের পর এক চুরি করতে থাকি ম্যাক্স বিয়ারবোম (দ্য হ্যাপি হিপোক্রিট), চ্যাম্পফ্লেউরি, স্যামুয়েল পেপিস, আলফোনসে দদে এবং রুলফো ও অ্যারিওলাসহ তৎকালীন বেশ কিছু মেক্সিকান লেখকের বই।
সেই আমলের কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট স্মৃতি হাতড়ালে মনে করতে পারি, যেসব বই চুরি করেছিলাম, তার অনেকগুলোই ছিল কবিতার বই। আমাদো নেরভো, আলফানসো রেইয়েস, রেনাতো লেদাক, গিলবার্তো ওয়েন, হেরুতা ও তাবলাদা এবং ভ্যাসেল লিন্ডসের লেখা জেনারেল উইলিয়াম বুথ এন্টারস্ ইন টু দ্য হেভেনসহ বহু মার্কিন কবির কবিতার বই আমার চুরি করা বইয়ের তালিকায় ছিল। তবে একটি উপন্যাস আমাকে নরকের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল; আমাকে নতুন করে পথ দেখিয়েছিল। উপন্যাসটি হলো কাম্যুর লেখা দ্য ফল। উপন্যাসটি আমি আলামেদার একটা বেঞ্চিতে বসে তুষারশুভ্র ভোরের ঝলমলে ও সন্ধ্যার তীর্যক ভৌতিক আলোয় বসে শুধু যে পড়েছি তাই নয়, রীতিমতো গোগ্রাসে গিলেছি। পকেটে একটা কানাকড়ি নেই, অথচ পুরোটা দিন, এমনকি পুরোটা জীবন সামনে পড়ে আছে; এমন অবস্থায় বইটি আমার সঙ্গী হয়েছিল। কাম্যু পড়ার পরই আমার সবকিছু বদলে যেতে থাকল।
আমার সংগ্রহে থাকা কাম্যুর বইটির মলাট ছিল কাপড়ে বানানো, ভেতরে বড় বড় অক্ষরের ছাপা। বইটি এত মোটা এবং এর পৃষ্ঠা এত শক্ত ছিল যে সেটা শরীরের কোথাও লুকিয়ে আনার উপায় ছিল না। ওই অবস্থায় আমি গ্লাস বুকস্টোরের সব কর্মচারীর সামনে দিয়েই বইটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। এডগার এলান পোর একটা গল্প থেকে ওই কায়দাটা শিখেছিলাম।
এর আরও কিছুদিন পর আমি সুনির্বাচন করে বই পড়া পাঠক থেকে গোগ্রাসী পাঠক এবং বইচোর থেকে ‘বই হাইজ্যাকারে’ পরিণত হলাম। বই হাইজ্যাকার হিসেবে আমার ক্যারিয়ার বেশ লম্বা এবং ‘সাফল্যজনক’ ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত একদিন ধরা পড়তেই হলো। তবে ভাগ্য ভালো, ঘটনাটা গ্লাস বুকস্টোরে ঘটেনি। আলামেদা থেকে বেশ দূরে আভেনিদা হুয়ারেজ এলাকায় একটা বুকস্টোরে বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম। দোকানটির তাকে সারি সারি বুয়েনস আয়ারস ও বার্সেলোনা থেকে আনা অজস্র বই সাজানো ছিল। এ ছাড়া গাদা গাদা বই পাশে পড়ে ছিল। আমি লোভ সামলাতে পারিনি।
ধরা পড়ার বিষয়টি ছিল চরম অপমানজনক। মনে হলো দোকানমালিক অপমানের সামুরাইয়-তলোয়ার আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিল। তারা আমাকে দেশছাড়া করার এমনকি দোকানে আটকে বেদম পেটানোর হুমকিও দিল। মনে হলো, নব্য দার্শনিকেরা ধ্বংসযজ্ঞকেও ধ্বংস করে ফেলতে যেভাবে উদ্যত হয়, তারাও আমার ওপর একইভাবে চড়াও হলো। অনেকক্ষণ আমাকে যারপরনাই হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা আমাকে দোকান থেকে বের করে দিল। তবে আমার সঙ্গে থাকা বাকি বইগুলো, যেগুলো তাদের দোকান থেকে চুরি করিনি, সেগুলোও রেখে দিল। এর মধ্যে আমার প্রিয় বই দ্য ফলও ছিল। এরপর আর মেক্সিকোতে আমি চুরি করিনি।
ধরা পড়ার ঘটনার কিছুদিন বাদেই আমি চিলি চলে যাই। এর কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে অভ্যুত্থান হয়। এই সময়টাতে আমি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ ছিলাম। একা একা সান্তিয়েগোর বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখতাম। মেক্সিকোর মতো এখানে বুকস্টোরগুলোতে এত কর্মী ছিল না। সাধারণত একজন লোকই দোকান চালাতেন এবং তিনিই ছিলেন দোকানের মালিক। এখান থেকে আমি কিনানোর পাররার লেখা ওবরা গ্রুয়েসা ও আর্তেফ্যাকতোস; এনরিক লাইন ও জর্জ টিলিয়ারের লেখা বিভিন্ন বই কিনি। এখানে এই বইগুলো আমাকে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করেছিল।
এসব বুকস্টোরের যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, সেটি হলো দোকানিদের তাকানোর ধরন। মাঝেমধ্যে মনে হতো, ফাঁসিতে ঝোলানো মানুষের বস্ফািরিত চোখে, কখনো ঘুমে কাতর ঢুলু ঢুলু চোখে তারা চেয়ে থাকত। তবে সান্তিয়েগোর এসব দোকান থেকে আমি কখনো বই চুরি করিনি। এখানে বই খুবই সস্তা ছিল। এগুলো গাঁটের পয়সায় কিনেছি।
সান্তিয়েগোর একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একটা বুকস্টোরে গেছি। দোকানের মালিক একটা বইয়ের তাকের পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর বয়স হবে চল্লিশের কোঠায়। দেহের গড়ন একবারেই পাতলা গোছের। ভদ্রলোকের জামার হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। কচকচ করে হাতে থাকা একটা আপেল খাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো লেখক যদি মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তির নামে তাঁর বই উৎসর্গ করেন, সেই কাজটা নৈতিকভাবে ঠিক না বেঠিক? আমি বললাম, আমি আসলে ঠিক জানি না। তিনি বললেন, আমার ধারণা, এটা খুবই খারাপ কাজ হবে। একা একা নিজেই বলতে লাগলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা এ ধরনের লোকের পড়ার ঘর কেমন হতে পারে? আমি বললাম, এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। তিনি বললেন, আমার চেনা একাধিক এ ধরনের কুখ্যাত লেখক আছেন। আমি কিছু না বলে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলাম। বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম, লোকটা বিড়বিড় করে বলছেন, কী ধরনের বেজন্মা হলে এমন ভয়ানক কাজ করা যায়? লোকটা আরও কি সব বিড়বিড় করছিলেন। কিন্তু আমি সবটা শুনতে পাইনি।
রবের্তো বোলাইয়োঁ: চিলিয়ান কবি ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে আছে স্যাভেজ ডিডেকটিভ, অ্যামুলেট, লাস্ট ইভিনিং অন আর্থ।
ইংরেজি থেকে বাংলায় তরজমা: সারফুদ্দিন আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০১১
Leave a Reply