আহমদ কবির
সাধারণত কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা প্রলয় দিয়ে নন্দনতত্ত্ব রচনা করেন না; কেননা প্রলয়-সুন্দরের বিপরীত। প্রলয় ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক, তার মূর্তি ভয়াবহ, বিপর্যয়কর, উ্নত্ত, ভীতিপ্রদ, মহানিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর করালবদন। এবং তা কোনোভাবেই আনন্দের বিষয় হতে পারে না। ধর্মপুস্তকে ও পুরাণকথায় প্রলয়-প্রসঙ্গ বারবারই আসে। বাইবেল-কোরআন-এ আছে নুহের কিশতির কথা, কোরআন-এ আছে কেয়ামত অর্থাৎ শেষ প্রলয়ের বৃত্তান্ত। এদিকে পুরাণকথা বহু প্রলয়ে সৃষ্টির বিনাশের ভয়াবহ বর্ণনাকীর্ণ। পুরাণকথা আর ধর্মকথার দূরত্ব বেশি নয়। কোটি কোটি বছর নিয়ে কল্প, কল্পান্তে প্রলয়-এ হলো ভারতীয় পুরাণের কথা। ধর্মপুস্তকে পাপ-পুণ্যের কথা আছে, কোনো কোনো পুরাণকথা বিশেষ করে প্রাচ্য পুরাণকাহিনী ধর্ম-অধর্মের ও শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ভরপুর। ধর্মকথা ও পুরাণকথায় বলা হয়েছে, সৃষ্টির বহমানতায় একসময় অশুভের কালো মেঘ পুঞ্জপুঞ্জ নিকষ রূপ ধারণ করে, সেই মসিবর্ণ মহান্ধকারের বিকট দৈত্য পুরো সৃষ্টিটাকেই যখন গিলে ফেলতে চায় তখন প্রলয়কর্তার কর্তব্য এসে পড়ে। বহু অপকর্ম ও পাপেভরা অশুভ শক্তিকবলিত পুরোনো পৃথিবীটাকে লয় করে দিতে হবে-এই হলো প্রলয়ের মর্মকথা। পুরাণ এক প্রলয়ে পৃথিবীর বিনাশের কথা বলেনি। প্রলয় শেষে আবার নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি-এটিই হলো পৌরাণিক প্রত্যাশা।
ভারতীয় পুরাণমতে শিব হলো প্রলয়কর্তা। শিব মহাদেব, রুদ্র, ভৈরব, শঙ্কর ইত্যাদি কত নামেই-না পরিচিত! শিবকে নিয়ে অজস্র কাহিনী ছড়িয়ে আছে ভারতীয় ভাষাগুলোয়, বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষায়। এদিকে শিব বাংলা সাহিত্যেরও সুপরিচিত পৌরাণিক চরিত্র, প্রাচীনকাল থেকে একাল অবধি। হিন্দু কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের কবিতায়, নাটকে এবং কথা-কাহিনীতে শিবকে সমাদর করবেন সেটি স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত, কিন্তু মুসলমান লেখকের রচনায় শিবের উপস্থাপনা ব্যতিক্রমী; এবং সেটিই ঘটেছে নজরুলের রচনায় আশ্চর্য স্বতঃস্কূর্ততায়। শিব প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তিতে ভরে আছে নজরুলের প্রথম পর্যায়ের কবিতা, কিছু গদ্য ভাষ্য ও কিছু গান। এটা এ নয় যে নজরুল হিন্দু রমণী বিয়ে করেছিলেন বলে তিনি হিন্দু পুরাণে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কেননা প্রমীলার সঙ্গে বিয়ের আগেই তিনি অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী ও ভাঙার গান-এর কবিতাগুলো লিখেছেন এবং নিঃসন্দেহে এ তিনটি কাব্যেই প্রধানত শিবের প্রমত্ত পদচারণ, অন্যত্রও আছে অবশ্য, প্রথম যুগের সম্পাদকীয় গদ্যে তো বটেই। কোনো বিশেষ ধর্মানুভূতি থেকেও যে নজরুল শিবের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন তা মোটেও নয়। কারণ, নজরুল আস্তিক হলেও ধর্মের মানুষ নন। ধর্মের এবং সম্প্রদায়গত চেতনার ঊর্ধ্বের মানুষ নজরুল সব সময়, সব জাতপাত-ধর্মের ঊর্ধ্বের মানুষ নজরুল ধর্ম-পরিচয়ে মুসলমান হলেও সব সম্প্রদায়ের কবি; মুসলমানেরও, হিন্দুরও, সব বাঙালির, সব মানুষের। সুতরাং শিবের প্রতি নজরুলের বেশি মনোযোগের কারণ সম্পূর্ণত ভিন্ন-তা সবটাই সাহিত্যিক, সবটাই মানবিক, সবটাই সামাজিক। সামাজিক বলা হচ্ছে এ কারণে যে নজরুলের কবিতা যত না আত্মগত, তার চেয়ে বেশি সমাজগত। মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্যই তিনি কবিতা লিখেছেন মূলত।
বাল্য বয়স থেকেই নজরুল পুরাণকথা ও ধর্মকথার নিবিষ্ট পাঠক। শিক্ষায়তনে যত না শিখেছেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শিখেছেন নিজের সহজাত অনুরাগ ও অনুসন্ধিৎসায়। চিরকাল পাশাপাশি বাস করে মুসলমান ও হিন্দু। মুসলমান হিন্দুর আর হিন্দু মুসলমানের ধর্মকথা ও পুরাণকাহিনী জানবে না, তা তো হতেই পারে না। নজরুল এসব জেনে নিয়েছিলেন শৈশব থেকেই। লেটোর দলের গানের আখড়ায়, যাত্রার কথকতার কীর্তনের আসরের কিংবা মক্তবে কোরআন পাঠের ভাব-বিহ্বলতার এবং ফকির-দরবেশ ও সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মেশার শুভ ফলও হতে পারে নানা শাস্ত্রের ও পুরাণ বৃত্তান্তের অধিগম্যতা। এভাবেই সহজাত ভঙ্গিতে তাঁর আয়ত্তে এল নানা শাস্ত্র, ভারতীয় পুরাণ, গ্রিক পুরাণ এবং অবশ্যই মুসলমানের ধর্মীয় প্রসঙ্গগুলো। মুসলমানের ছেলে নজরুল মুসলমানের ধর্মকথা জানবেন সেটি স্বাভাবিক, কিন্তু এটি অধিকন্তু নয় যে ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণবৃত্তান্তের অবহিতি। বাংলার ভাব-সাধনায় শৈব, শাক্ত, সুফি, বৈষ্ণব, বাউল ইত্যাদি ধারা নিয়ে যে মিলন-প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নজরুল অবগাহন করলেন অকাতরে, অফুরন্ত আবেগে এবং সর্বসংস্কারমুক্ত সম্পূর্ণ উদার মনোভাবে।
কাব্য-সাহিত্যে পুরাণকথার ব্যবহার নতুন কালের আবহে নতুন ভাবচিন্তা বহন করে। যুগানুগ তাৎপর্যমণ্ডিত না হলে পুরাণ কেবল পুরাণই থেকে যায়, তাকে নতুন করে পাওয়া হয় না। বিশ্বসাহিত্যে এবং অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে পুরাণের নবভাবব্যঞ্জনা নতুন কোনো প্রসঙ্গ নয়। নজরুলের আগে বাংলার শীর্ষস্থানীয় কবিরা এ কাজটি নৈপুণ্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। নজরুলও পুরাণকে তাঁর যুগের আবহেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন এবং প্রধানভাবে ভারতীয় পুরাণের এক শীর্ষপুরুষ শিবকেই অবলম্বন করেছেন তাঁর নান্দনিক অভিপ্রায় জ্ঞাপনের জন্য। তাঁর শিল্প-অভিজ্ঞানে অর্থাৎ সুন্দরের আসরে শিব বসে আছেন প্রবলভাবে, মধ্যমণি হয়ে। শিব ধ্বংসকারী হলেও অশুভের প্রতীক নয়। ইংরেজি সাহিত্যের ‘এভিল’কে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছেন অমঙ্গল; শিব সেই অমঙ্গলও নন। তবে নিশ্চয়ই শিব প্রলয়কর্তা, ধ্বংসের ও বিনাশের হোতা। অনিবার্য প্রয়োজনেই মাঝেমধ্যে সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে হয়, আবার জেগে ওঠে নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষের ধরিত্রী। নজরুলও তাঁর সময়ের পৃথিবীর ধ্বংসাভিলাষী। কেননা এ পৃথিবী জরাগ্রস্ত, জীর্ণদীর্ণ, ঘুণেধরা, নানা অপব্যবস্থায় আবিল, শোষণ-পীড়ন আর অত্যাচারভরা এবং সর্বাংশে মানবতাবিরোধী। নজরুল তাই প্রলয়কর্তা, শিবের মতো। জটাজটধারী প্রচণ্ড শিবের সঙ্গে ঝাঁকড়া চুলের প্রমত্ত নজরুলের তুলনা কেউ করলেও করতে পারেন, তবে তার প্রয়োজন নেই; নজরুল শিবকে গ্রহণ করেছিলেন মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে। শিবের বীর্যমন্ততা, প্রমত্ততা ও বলিষ্ঠতা নজরুলের কাঙ্ক্ষিত, আরাধ্যও-ওই প্রতীকেই নজরুলের মহাবিদ্রোহ, ক্ষোভ, রোষ ও প্রতিবাদ অনুধাবনযোগ্য। এদিকে শিব কেবল ধ্বংসের নয়, মঙ্গলেরও। ধ্বংস কেবল চূড়ান্ত বিনাশী ব্যবস্থা নয়, তা কল্যাণপ্রদ শুভ পৃথিবীর আবাহনও। একদিকে ধ্বংস, অন্যদিকে সৃষ্টি। নজরুলের কাব্যসাধনায় নজরুলের সংস্থিতি এই তাৎপর্যেই বিচার্য। তাই বুঝে নিতে কোনো অসুবিধে নেই যে নজরুলই প্রলয়-সুন্দর।
কাব্যজীবনের সূচনালগ্ন থেকেই নজরুল প্রচণ্ড বিদ্রোহী। দেশের পরাধীনতা তাঁকে বেজায় ক্ষুব্ধ করেছিল। নজরুলের সমকালে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে যত আন্দোলন হয়েছিল, তা নিয়মতান্ত্রিক হোক বা অনিয়মতান্ত্রিক হোক, সবগুলোতে নজরুলের সমর্থন কিংবা অংশগ্রহণ ছিল একেবারেই নিরঙ্কুশ। দেশের মানুষের মুক্তিকামনায় তিনি অধীর হয়ে পড়েছিলেন। কবি নজরুলের এটিই প্রথম ও প্রধান কামনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান, লুটেরা, মহাজন, শোষক ও ধনিক শ্রেণীর দুবৃêত্তির প্রতি চরম তীব্র ঘৃণা, সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সাম্যচেতনা, সব বৈষম্যের অবসান কামনা, এবং সর্বোপরি নিখিল মানবতার জয় ঘোষণা। নজরুল অসামান্য বলদৃপ্ত ভঙ্গিতে সব অপব্যবস্থার অবসান চাইলেন এবং এ শুভ কামনায় তিনি পৌরাণিক শিবের প্রতীকে প্রলয়ের শাঁখ বাজালেন। প্রলয় নিয়ে উ্নত্ত উল্লাসের কারণও তাই।
‘প্রলয়োল্লাস’ নামের কবিতাটিই বাংলা কবিতায় প্রলয়-সুন্দর নজরুলের মহাবীর্যমন্ত আগমন ঘোষণা করে। নজরুল চিরকাল তারুণ্যশক্তির ওপরে প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন বলেই প্রথম থেকে তাদেরই প্রলয় আহ্বানে সাড়া দিতে ও জয়ধ্বনি করতে বললেন। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’-এই পুনরাবৃত্ত আহ্বানে প্রলয়ের বিপুল সর্বনাশের মধ্যেও আসন্ন বিজয়ের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়। কালবৈশাখীর ঝড় আসে ঈশান কোণ থেকে। এটি প্রলয়সূচক হলেও মঙ্গল-ঝড়, নতুনের কেতনরূপে তা সব পুরাতন ও জীর্ণতাকে, সব অপব্যবস্থা ও পরশাসনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে; সৃষ্টি করবে নতুন পৃথিবী, মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশ। বৈশাখের ঝড় শিব প্রসঙ্গে একটি পরিচিত রূপকল্প। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের সবচেয়ে সুপরিচিত গানটিতে এটিই অসামান্য তাৎপর্যে ব্যবহার করেছেন। ‘তাপসনিশ্বাসবায়ে/মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’-রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মবাণী পুরাতনের বিদায় আর নতুনের আবাহন। বৈশাখের রাবিন্দ্রিক অভিব্যক্তি প্রচণ্ড তীব্রতায় পরাধীন দেশের মুক্তিকামনায় রূপকল্পে নজরুলের কল্পনায়ও ধরা দিয়েছে। বিশ্বধ্বংসকালে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের পুরাণোক্ত বর্ণনার পুরো ছবিটিই পাওয়া যায় ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায়। শব্দধ্বনি, ছন্দতালে, অর্থব্যঞ্জনায়, চিত্রনির্মাণে এবং সামগ্রিক আবহে পুরো কবিতাটিই মহাপ্রলয়ের মহারূপকল্প। নিঃসন্দেহে, এটি বিদ্রোহী কবি নজরুলের একটি তুলনাহীন মহাসৃষ্টি। এতে প্রলয়কালের শিবরূপের বর্ণনা ও অভিব্যক্তি তো আছেই, তদুপরি কবিতাটি প্রদীপ্ত আশাবাদে সুন্দরের সাধনাকে প্রত্যাশায় ভরিয়ে দেয় কয়েকটি উল্লাসময় উচ্চারণে-
ক· ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।
খ· আসবে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল।
গ· বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর।
ঘ· দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,
আলো তার ভরবে এবার ঘর।
ঙ· ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?-প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন-জীবনহারা অসুন্দরে করতে ছেদন।
চ· ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর।
ছ· কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার আসে ঐ সুন্দর।
বোঝাই যাচ্ছে, প্রলয় সৃষ্টি বেদনারই নবরূপ এবং তা কেবল সর্বতোভাবে সুন্দরের আয়োজনেই নিয়োজিত। বারবার সুন্দরের প্রসঙ্গ-উত্থাপন প্রলয়-সুন্দরেরই অভিপ্রকাশ।
কবি নজরুলকে যে একটি মাত্র কবিতা দিয়ে শনাক্ত করা যায়, সেটি নিশ্চয়ই তাঁর ‘বিদ্রোহী’, এটিই তাঁর স্বরূপের সন্ধান, বাংলা কবিতার একটি অমর সৃষ্টি। এ কবিতায় বিদ্রোহী প্রতীকে যেসব পুরাণ-প্রসঙ্গ, উপমা, তুলনা, দৃষ্টান্ত, নাম, চিত্রপ্রতিমা রয়েছে সেগুলো প্রলয়ের অভিব্যঞ্জনাকে প্রচণ্ড গতিময় করে তুলেছে কবিসত্তার ‘আমিত্ব’র তীব্র দৃঢ় ও সংশয়হীন উপলব্ধিতে। ওই সব দৃষ্টান্ত ও প্রসঙ্গও প্রলয়ের সঙ্গে মানিয়ে যায় অনায়াসে এবং সেগুলোও বিদ্রোহী কবির নন্দনভাবনার ও সুন্দরের বিপুল আয়োজন। সৃষ্টিশীলতা ও কবিত্ব ব্যক্তি-আমির গভীর ও অনপনেয় অস্তিত্বের তীব্র বজ্র নির্ঘোষ। এ কবিতাতেও শিব এসে যায় বারে বারে। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় শিবকে নানা নামে ডাকা হয়েছে, যেমন-নৃত্য-পাগল, মহাকাল, মহাকালের চণ্ড, ভয়ঙ্কর, বিশ্বপাতা, দিগম্বর ইত্যাদি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাও তেমনি শিবশক্তির নানা অভিপ্রকাশে বীর্যমন্ত ও প্রবল হয়ে ওঠে। যেমন-মহাপ্রলয়ের নটরাজ, ধূর্জটি, নৃত্য-পাগল ছন্দ, কৃষ্ণকণ্ঠ, ব্যোমকেশ, পিনাকপাণি এবং এসব পৌরাণিক রূপকল্পের আরও বহুমাত্রিক ও বহুপ্রান্তিক অনুষঙ্গ-ধ্বংস, মহাভয়, এলোকেশে জড়, মহামারি, শাসন-ত্রাসন, সংহার, যজ্ঞ, অগ্নি, শ্মশান, ইন্দ্রানী-সুত, বজ্র, ঈশান বিষাণে ওঙ্কার, ডমরু, ত্রিশুল, চণ্ড ও মহাশঙ্খ, প্রণবনাদ-প্রচণ্ড, মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহুগ্রাস, ধর্মরাজের দণ্ড, প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, বারিধির মহাকল্লোল, বসুধাবক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি কালানল, ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী, ছিন্নমস্তা চণ্ডী, রণদা সর্বনাশী, মৃণ্ময়, চি্নয়, অজর অমর অক্ষয় অব্যয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর, উ্নাদ ইত্যাদি। এসবই প্রলয়ের ভয়ানক রূপাবহকে ঘনিয়ে তোলে। এখানেও প্রলয়-সুন্দরের সেই কাজ-পুরোনো পৃথিবীর ধ্বংস, নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি-‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।’ সৃষ্টিধর্মী প্রলয় শেষে শিব যেমন হতে চায় সুস্থির ও প্রশান্ত, তেমনি কবি-বিদ্রোহীরও শেষ বাসনা অত্যাচার ও উৎপীড়নের চির অবসান এবং তাতেই পূর্ণ প্রশান্তি-‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত।’
শিবশক্তির নারীস্বরূপা দুর্গা, শশী, চণ্ডী ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্রে নজরুলের প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী কবিতাতে স্থান করে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে ও সমান গুরুত্বে পীড়ন-মারণের অবসান এবং অশুভের দমন ও প্রশমন শেষে স্বাধীন বিচরণভূমির প্রতিষ্ঠায় এবং উজ্জীবনে ও প্রেরণায় এরাও শিবকল্প প্রলয়ঙ্করী। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙার গান-এই তিনটি কাব্যই শিবপ্রসঙ্গ ভরা। শিবের প্রলয়রূপ, প্রচণ্ডতা, ভয়ঙ্করতা, মহিমা-মাহাত্ম্য, শিবের অনুচরবৃন্দ, শিবের অস্ত্রশস্ত্র, বাদ্যবিষাণ, ডমরু ত্রিশুল ইত্যাদি রূপকল্প এ কাব্যগুলোর কবিতাগুলোতে স্থান পায় এবং প্রলয়-সুন্দর কবি নজরুলের সৃষ্টি তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়। প্রলয়প্রসঙ্গে অন্য উপমাও আসে, যেমন-ইস্রাফিলের শিঙ্গা। কবিতায় মুসলিন প্রসঙ্গের তাৎপর্যময় ব্যবহার নিশ্চয়ই রয়েছে, তবু বলা যাবে শিবশক্তিই প্রধান। ‘প্রলয়োল্লাস’ ও ‘ভাঙার গান’ এক জাতীয় কবিতা। ‘ভাঙার গান’-এ আছে বিদ্রোহের সংক্ষুব্ধ ধ্বনি, জমাট অনুপ্রাসে সেই ধ্বনি অতি উচ্চকিত। ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট/ভেঙে ফেল্ কর্রে লোপাট/রক্ত-জমাট শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী।’ এখানেও তরুণের প্রতি আহ্বান মুক্তিকামনায় সম্পূর্ণ নিবেদিতপ্রাণ হতে ‘ওরে ও তরুণ ঈশান!/বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ।’ এখানেও শিবের প্রলয়প্রসঙ্গ। প্রলয় ধ্বংস করে দেয় বটে, কিন্তু পরিণামে তা সুন্দরকেই নবসৃষ্টির প্রেরণা জোগায়। নজরুলের আরও আরও কবিতায় প্রলয় এই অপূর্ব তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়-কতভাবে কতরূপে তা অভিব্যক্ত হয়! এ-প্রলয় সৃষ্টিশীল, গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পরাধীন দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্দীদশা থেকে গণমানবের মুক্তির লক্ষ্যে এ প্রলয়ের বড় প্রয়োজন ছিল। এখনো আছে, থাকবেও আগামী দিনগুলোতে বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী কাব্যগুলোতে, যুগবাণী ও রুদ্রমঙ্গল-এর গদ্যরচনাগুলোতে প্রলয়-সুন্দর নজরুল তাঁর সৃষ্টি-বেদনার গভীর তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply