ঐতিহাসিক ধারা
সৈয়দ বদরুল আহ্সান
একাত্তরের ২৬ মার্চঃ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, মোহাম্মদ শাহ্জাহান্, এপ্রিল ২০০৮, বাংলা প্রকাশনী, ঢাকা, প্রচ্ছদঃ পঙ্কজ পাঠক, ২৫৬ পৃষ্ঠা্ ৩৫০ টাকা
বিগত কয়েক বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদকে কেন্দ্র করে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বই লেখা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে আমাদের ইতিহাস-সচেতনতার মধ্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যে দেশে বছরের পর বছর একটি বিশেষ মহলের প্রয়াস সব সময়ই রয়েছে ইতিহাসকে একটা অসৎ পথে ঠেলে দেওয়া, সে দেশে এটাই স্বাভাবিক যে ইতিহাসের ধারাকে ধরে রাখা এবং সত্যকে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের লেখক সমাজ পালন করবে। এবং এ কাজটি তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন, ফলে আমরা সবাই এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজ্ন নিশ্চয় উপকৃত হয়েছি।
মোহাম্মদ শাহ্জাহান ওই ঐতিহাসিক ধারাকে উজ্জীবিত রাখার উদ্দেশ্যেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর সদ্য রচিত একাত্তরের ২৬ মার্চঃ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। বইটি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে এ জন্য যে অনেকের ধারণা, পঁচিশে মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু আদৌ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি না। তাঁদের ভাষায়, তাঁরা সেই আহ্বান শোনেননি বা শুনতে পারেননি। আবার এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁরা বলেছেন এবং লিখেছেন যে তাঁরা সেই গোলাগুলির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজ কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পেয়েছেন। এবং এই কথার পক্ষে যুক্তি আরও জোরালো হয় যখন তখনকার সময়ের বিভিন্ন বিদেশি কূটনৈতিক মহলের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা যায়। সেসব দলিলে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা সিদ্দিক মালেক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে মোটামুটি একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
মোহাম্মদ শাহ্জাহানের এই গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য এটাই যে তিনি বিভিন্ন ঘটনা এবং বিভিন্ন সূত্রের ওপর নির্ভর করে তাঁর কথাগুলো তুলে ধরেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কোটি কোটি বাঙালির মতো লেখক গভীরভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং সে কারণেই তিনি ছাব্বিশে মার্চ-পূর্ববর্তী এমন সব ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যাতে এই সত্যটি উঠে আসে যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। এখানে শুধু সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথাই উঠে আসছে না, বরং ৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্দেশের মাধ্যমে কীভাবে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ দেশকে প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করেছিল, সেসব সত্য লেখক তুলে ধরেছেন। অনেক ক্ষেত্রে লেখক নির্ভর করেছেন ওইসব পাকিস্তানি ব্যক্তির মন্তব্যের ওপর, যেসব ব্যক্তি তখনকার সময়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গ্রন্থে অনেকখানি জায়গা দেওয়া হয়েছে সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ডাক সরাসরি দিলেন না, সে বিষয়ের ওপর। মোহাম্মদ শাহ্জাহান বিভিন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকায় পরিবেশিত তখনকার সংবাদ তুলে ধরেছেন এবং একই সঙ্গে এও পাঠকদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতাই সেই সাতই মার্চে তাঁকে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত রেখেছে। হ্যাঁ, সেই ভাষণে স্বাধীনতার যে পথ উ্নুক্ত করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সাতই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হলে যে সেটা রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হতো না, সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা বরাবরই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ইরান ্নিথের রোডেসিয়ার কথা এবং বিয়াফরার ইতিহাস তাঁদের সামনে ছিল। ওই দুটো দেশে এককভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা যে কী গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছিল, সে বিষয়ে বাংলাদেশের নেতাদের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। এবং এ কথাগুলো ফুটে উঠেছে এই অত্যন্ত সমৃদ্ধ গ্রন্থে।
গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যে ট্রান্সমিটার থেকে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে স্থপতি ড· রাশিদুল হাসান খানের কথা এ বইয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে তখনকার মার্কিন সরকারি দলিলের কথা, যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ছাব্বিশে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। আরও রয়েছে মাসুদুল হকের স্বাধীনতার ঘোষণাঃ মিথ ও দলিল বইটির কথা। ছাব্বিশে মার্চ কীভাবে চট্টগ্রাম টিঅ্যান্ডটি স্বাধীনতার ঘোষণা করে, সেই বিষয়ের ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন।
মোহাম্মদ শাহ্জাহান যে প্রচুর গবেষণা করে তাঁর এই গ্রন্থটি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে সবাই উপকৃত হবে। তবে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি এবং তা হলো, বইয়ে যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো পৃথক চ্যাপ্টারে ভাগ করলে ভালো হতো। একই সঙ্গে সূচিপত্রেরও একটি বড় ধরনের প্রয়োজনীয়তা আছে। পরবর্তী সংস্করণে এ দিকগুলোর প্রতি লেখক নজর দেবেন-এটাই পাঠকের কাম্য।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
মে ০৯, ২০০৮
Leave a Reply