নদীর করুণা
মোকারম হোসেন
নদী প্রসঙ্গ – সম্পাদনা: শেখ রোকন, ডিসেম্বর ২০০৭,
একশনএইড, ঢাকা, ১০৩ পৃষ্ঠা, ১৫০ টাকা
ব্যাংককের একটি নদীর ধারে বেড়াতে গেছি। কিছুক্ষণ পরপরই একেকটি লঞ্চ পানিতে বিশাল তোলপাড় তুলে ছুটে যাচ্ছে। জলপথে ব্যাংকক নগরী ঘুরে দেখছেন পর্যটকেরা। হঠাৎ একজন মহিলা এলেন নদীর ঘাটে। তারপর হাতের পলিথিন থেকে কতগুলো মাছ নদীতে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। বুঝলাম, এটা উৎসর্গ বা ভোগপর্ব। কিন্তু হাতের পলিথিনটা নদীতে ফেললেন না, ভাঁজ করে ওপরে এনে ডাস্টবিনে ফেললেন। তখনই আমার বুড়িগঙ্গার কথা মনে পড়ল। দূষণ আর নাব্যতা হারিয়ে বুড়িগঙ্গা কি এখন আর নদীর পর্যায়ে আছে? শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, আমাদের কোনো নদীই এখন ভালো নেই। অথচ নদী আমাদের প্রাণ। নদী যখন গতি হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে, তখন আমরাও বিপন্ন বোধ করি। এসব উপলব্ধি থেকেই নদী প্রসঙ্গ বইটি। সম্পাদক শেখ রোকন।
চার পর্বের এই গ্রন্থে সূচিবদ্ধ হয়েছে মোট ২২টি রচনা। আমাদের সহস্র নদীর বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে এগুলোকে বেশ সংক্ষিপ্তই বলা চলে। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছেঁকে আনার চেষ্টা করেছেন সম্পাদক। আবার এও জানিয়েছেন যে লেখাগুলো একেবারেই আনকোরা, আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। প্রসঙ্গত, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার নদী সংখ্যার কথা বলা যায়। সম্ভবত বিস্তৃত কলেবরে সেটিই একমাত্র সংকলন। নদী প্রসঙ্গ গ্রন্থের নদীভাবনা অংশে মোজাফ্ফর আহমদ কিছু চমৎকার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নদী আমাদের প্রাত্যহিক চাহিদার সঙ্গে কতটা গভীরভাবে সম্পর্কিত। অথচ নদী সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। তিতাসপাড়ের পলিমাটির সন্তান আল মাহমুদ। নদী প্রসঙ্গে তিনি নিজের জীবনের গল্পই যেন শুনিয়েছেন। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বলে দিয়েছেন দরকারি কথাগুলো। এখানেও আছে মানুষের নদীমুখিনতার কথা। কী অবলীলায় বলেছেন, ‘আমরা একবারও ভাবি না এই ধোঁয়া ওড়ানো সাদা ভাতের উদ্ভব হয়েছে নদীর করুণায়।’ পানির ন্যায্য হিস্যা প্রশ্নে ভারত কতৃêক একতরফাভাবে চুক্তি লঙ্ঘনেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
কমরেড খালেকুজ্জামান তাঁর লেখায় নদীর নানামাত্রিক প্রসঙ্গ এনেছেন। তাতে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক প্রেক্ষাপট, পরিবেশ বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সুবিধাদির সঙ্গে বর্তমান নদী পরিস্থিতির কিছু তথ্য মিলবে। পাশাপাশি পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র প্রশ্নে ভারতের কিছু কূটকৌশল ও আমাদের শাসকদের নির্লিপ্ততা নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। খালেকুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘নদীগুলোর বিলুপ্তি আমাদের জন্য মহাদুর্যোগের ঘনঘটা।’ সত্যি তাই, মরা নদীগুলো আজকাল আমাদের নানাভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে-বিশেষত, প্রয়োজনে পানিশূন্য হয়ে আর অপ্রয়োজনে বান ডেকে।
কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের রচনায় কিছু বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। যৌথ নদী-ব্যবস্থাপনায় ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের কিছু নেতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন তিনি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরও আছে প্লাবন ঝুঁকি, পানি ঘাটতি, সংকটের নতুন মাত্রা, সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র, বন্যা-ব্যবস্থাপনা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ নৌযোগাযোগ, পানির গুণগত মান রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী সংযোগ প্রকল্প ইত্যাদি। দীর্ঘদিনের আলোচনা প্রক্রিয়া কেন অদ্যাবধি কোনো সুফল বয়ে আনেনি এসব প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি।
আসিফ নজরুল যৌথ নদী কমিশন প্রশ্নে নানা অসংগতির কথা তুলেছেন। জেআরসি বা যৌথ নদী কমিশনকে তিনি অকার্যকর বলেই মনে করেন। কারণ, গঠনতন্ত্রের চার নম্বর ধারার প্রত্যাশা অনুযায়ী গত ৩৫ বছরে কমিশনের কোনো বৈঠকই সফল যৌথ প্রকল্প শুরু করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শেখ রোকন আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং জেআরসি গঠনের কিছু প্রারম্ভিক গলদের কথা বলেছেন। এসব থেকে উত্তরণ কীভাবে-সে সম্পর্কেও তিনি কতিপয় সুপারিশ করেছেন। এ পর্বে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল আনোয়ার খানের একটি তথ্যবহুল সাক্ষাৎকার স্থান পেয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি দুই দশকে অর্জিত তাঁর অভিজ্ঞতার কথাগুলো বলেছেন এখানে। নদী ্নৃতি এই গ্রন্থের একটি অভিনব সংযোজন। ্নৃতিচারণা করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সোহরাব হাসান, আনিসুল হক, এম মোসাব্বের হোসেন, শুচি সৈয়দ, শাহমান মৈশান ও মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান। সবাই ছেলেবেলার সেসব ঊর্মিমুখর নদীগুলোর কথা বলেছেন। আবেগঘন এসব লেখা নদী ও জীবনের এক অন্তরঙ্গ সংলাপ যেন। মানুষের জন্য, প্রাণের জন্য নদীর করুণার শেষ নেই।
শেষ পর্বে আছে কয়েকটি প্রতিবেদন। কল্যাণ রুদ্র তিস্তা নদীর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। সবকিছুর পাশাপাশি তিনি ভৌগোলিক বিপর্যয় ও আনুষঙ্গিক সুবিধা-অসুবিধাগুলোও ব্যাখ্যা করেছেন। চট্টগ্রামের হালদা নদী আমাদের মৎস্য প্রজননের বিশাল ভাণ্ডার। তৌহিদ ইবনে ফরিদ হালদা নদীর বর্তমান সঙ্গিন পরিস্থিতি ও মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। নদীভাঙন রোধে কতিপয় কৌশলের কথা বলেছেন নাজমুল ইসলাম চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। শামীম আরফীন নানা কারণে মৃতপ্রায় ‘চড়া’ নদীর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছেন। আর টিপাইমুখ বাঁধ যে আরেক সর্বনাশ ডেকে আনছে সে সম্পর্কে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন সিরাজুল ইসলাম আবেদ।
আমাদের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যের একটি পর্ব সংযুক্ত হলে গ্রন্থটি আরও সমৃদ্ধ হতো।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
মে ০৯, ২০০৮
Leave a Reply