অমর একুশে বইমেলা ২০০৮
তরুণদের ১০ বই
বিষাদের আখ্যান
সৈয়দ আজিজুল হক
আধুনিক মনের পাঠক কোনো বই পড়তে গেলে প্রথমেই তার শ্রেণীপরিচয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়। তারপর গোত্র নির্ধারণশেষে শ্রেণীবৈশিষ্ট্যের ছক ধরে এর সাফল্য-ব্যর্থতা বিচারে নিজেকে নিয়োজিত করে। শিকোয়া নাজনীনের পৃথিবীর জল ছবি নদী আখ্যান পাঠ করতে গিয়ে এর জাতবিচার নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। এটি কি কোনো ভ্রমণকাহিনী? ব্যক্তিজীবনের কোনো গল্প? ইউরোপে থাকার অভিজ্ঞতার বিবরণ? পাশ্চাত্য শিল্পী ও তাদের ছবির বিশ্লেষণ? পশ্চিমা শিল্পের ইতিহাসের বয়ান? পরিবেশবিদ্যা? নাকি উত্তর-ঔপনিবেশিক পটভূমিতে প্রাচ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতীচ্যকে মূল্যায়ন? বইটিকে এর কোনো একটি গোত্রে অন্তভুêক্ত করা অসম্ভব। আসলে কোনো রচনার শ্রেণীকরণের বিষয়টি আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফল। এই দৃষ্টিবিন্দু নিয়ে সম্ভব নয় এ গ্রন্থের সুবিচার করা। কেননা, লেখক প্রথাগত কানুনকে ভেঙে দিতে চান। ভেঙে দিতে চান রচনার মূল থিমকে বা বিষয়ের কেন্দ্রিকতাকে। তার পরিবর্তে তিনি লেখার মধ্যে নানা রকম আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দেন। অভ্যস্ত ধারার বাইরে গিয়ে পাঠক যে অস্বস্তি অনুভব করবে, সে অবসরও তিনি তাকে দেন না। বরং গল্প বলার এক নিপুণ কৌশলে পাঠককে তিনি ভাসিয়ে নিয়ে যান।
সুইডেনে ছাত্রী হিসেবে অবস্থান এবং সেই সূত্রে ইউরোপের নানা দেশ ভ্রমণ, মিউজিয়াম পরিদর্শন প্রভৃতি তাঁকে সেখানকার ইতিহাস বা শিল্প-ইতিহাসের মধ্যে যাত্রা করতে সাহায্য করেছে। লেখক নিবিড়ভাবে শুধু অবলোকন করেননি, ওই ইতিহাস-সামগ্রীর অন্তর্ময় সত্তা ও তার নির্যাস উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন এবং গল্পচ্ছলে তা বর্ণনা করেছেন এক স্বকীয় ভঙ্গিতে। তিনি বস্তু, ঘটনা বা ইতিহাসের বহিরাবরণকে সরিয়ে চোখ রাখেন তার অন্তর্গত স্বরূপে এবং সেটা তাঁর হৃদয়ে যে অনুরণন সৃষ্টি করে যে আখ্যানের জ্ন দেয় তা-ই তিনি ব্যক্ত করেন এক কুহকী ঢঙে। তাঁর ভাষা বাস্তবকে অভিক্রম করে যায়। তিনি পাঠকের জন্য এক বিভ্রম সৃষ্টি করেন। ওই বিভ্রমের মধ্যে পাক খেতে খেতেই পাঠককে এগিয়ে যেতে হয়।
এ গ্রন্থে সংকলিত ১২টি রচনার প্রথম সাতটি শিল্পবিষয়ক। এর তিনটিতে ভ্যান গঘ, পাবলো পিকাসো ও অমৃতা শেরগিলের জীবন ও শিল্পসৃষ্টির যাত্রাকে লেখক স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন বিস্তৃত পরিসরে। বাকি চারটিতে তুলে ধরা হয়েছে পনের-ষোল শতকের ইতালির রেনেসাঁ শিল্প, উনিশ শতকীয় ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট ও উত্তর-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্প এবং ইউরোপের বিশ শতকীয় শিল্পের গতি-প্রকৃতির বয়ান। এর কোনো আলোচনাই সম্পূর্ণ নয়। পূর্ণতা সাধনের প্রবণতা থেকেই লেখক মুক্ত। মূলত দেশ-দর্শন ও মিউজিয়াম পরিদর্শনসূত্রে সতীর্থ ভ্রমণসঙ্গীর ইতিহাস-বয়ানের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে ওঠে এসব রচনার কাঠামো। অবশ্য গল্প-কথনের ওই সাবলীল ভঙ্গির মধ্যেই লেখক অনুপ্রবেশ করিয়ে দেন পাশ্চাত্য শিল্পেতিহাসের নানা বাঁক ফেরার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তি-শিল্পীর অবদানসংক্রান্ত মূল্যায়নকে। এসব মূল্যায়ন-গঠনে পূর্ববর্তী লেখকদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা থাকলেও তা চাপা পড়ে যায় লেখকের বিশিষ্ট ও গতিশীল কথনভঙ্গির অন্তরালে।
অন্য পাঁচটি রচনায় ব্যক্ত হয় পোল্যান্ড, সুইডেন, বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও স্টকহোমে একাডেমির একটি শিক্ষাটার্ম-সংক্রান্ত আখ্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বর্বরতা, আনা ফ্রাংকের করুণ কাহিনী, দেশপ্রেমিক সৎ নেতৃত্বের গুণে বিশ শতকে সুইডেনের বিপুল উন্নয়ন, পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ঘিরে ইব্রাহিম মইখলের রূপক আখ্যান, একাডেমিতে শিক্ষকের ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট ব্যাখ্যাসূত্রে জল, পাখি, নদী, মৃত্তিকার ইতিহাস প্রভৃতির মধ্যে একাত্ম হয়ে পড়ে লেখকের ব্যক্তিজীবন ও হৃদয়ানুভূতির বিচিত্র সব প্রান্ত।
মূলত ফিকশন রচনার দিকেই লেখকের ঝোঁক। গল্প বলার এক সহজাত প্রবণতা লেখককে বিশিষ্টতা দিয়েছে। স্বীকার করতে হবে যে এসব রচনায় লেখক সময়ের পরম্পরাকে ভেঙে দেন, অতিক্রম করে যান ভৌগোলিক সীমাকেও। অমৃতা শেরগিলসূত্রে হাঙ্গেরি ও ভারত যেমন একাত্ম হয়ে পড়ে তেমনি পিকাসোসূত্রে স্পেনে মুসলিম শাসন ও ইসলামি বিশ্বের এক যোগসাজশ তৈরি হয়। বান্ধবী রেবতীর মায়ের গল্পসূত্রে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশও। এর কতটা বাস্তব আর কতটা পরাবাস্তব তার হিসাব কষতে পাঠককে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এ গ্রন্থে প্রধান হয়ে উঠেছে এক করুণ বিষাদের সুর। সেই বিষাদকে লেখক আবিষ্কার করেন মোনালিসায়, মাইকেলএঞ্জেলোর পিয়েতায়, রেমব্রান্টের নিঃসঙ্গতার চিত্রে, দেলাক্রোয়ায়, মনের ছবিতে, বোদলেয়ারের কবিতায়, দস্তয়েভস্কির জীবনে ও সাহিত্যে, অমৃতা শেরগিলের বিষণ্নতায়। পুরো বইয়ে বারবার এই বিষাদের কথা লেখক বলে যান। বইয়ের শেষে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি, এই বিষাদের প্রকৃত উৎস লেখকের নিজেরই মনোভূমি। মায়ের মনোরোগগ্রস্ততা, বোনের অস্বাভাবিক অকাল মৃত্যু লেখককে করে তোলে নিঃসঙ্গ, ্নৃতিকাতর, মৃত্যুবিলাসী ও সে সূত্রে অচেতন-অবচেতনে গভীরভাবে বিষাদগ্রস্ত।
তাঁর গল্প বলার প্রবণতা রচনাকে সরস ও সুখপাঠ্য করে তুললেও এর অসুবিধার দিক হলো, তা রচনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবোধক করে তুলতে পারে। এর কারণ, এ প্রবণতা লেখককে কখনো কখনো তথ্য বিষয়ে অসতর্ক করে তোলে। কিছু কিছু তথ্যের ব্যাপারে সংশয় থেকেই যায় যখন দেখি, উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর চলে যায় উত্তর ভারতে (পৃ· ২৫), বোদলেয়ারের পরে চলে আসে মোনালিসা (পৃ· ৬১), পোল্যান্ডের গিদানিয়ায় গিয়ে আছড়ে পড়ে ভূমধ্য জলরাশি (পৃ· ২১৭-১৮), প্রজ্ঞাপারমিতায় চিত্রিত হয় জলরঙের ছবি (পৃ· ২৫২)। একই ব্যক্তির নাম ইসবান জনি (পৃ· ২৮, ৩৮), কোথাও ইরফান জনি (পৃ· ২৯), এডওয়ার্ড মানে (পৃ· ৮১) কোথাও এদোয়ার্ড মানে (পৃ· ৯৩); ইউরোপ কোথাও ইয়োরোপ (পৃ· ২৬)। ‘অমৃতার ছবিতে কোনো আনন্দ নেই’ বলেই আবার উল্লেখ করা হয়ঃ ‘ক্যামেল’ ছবিতে রয়েছে অফুরান আনন্দ (পৃ· ৩৪-৩৫)। মুদ্রণপ্রমাদ থেকে মুক্ত নয় বইটি। প্রথম রচনাটিতেই ঘটেছে বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি (পৃ· ২৫ ও ৪১)।
কল্পনার ঐশ্বর্য লেখকের আছে। এবং সেই কল্পনাকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগের দক্ষতাও তাঁর আয়ত্তে। এ সবকিছুর যৌথ সমাহারেই তাঁর ভাষা যেমন প্রাঞ্জল তেমনি গতিশীল। এ ভাষা প্রচণ্ড আবেগসম্পন্ন। শুধু তা-ই নয়, তাতে রয়েছে ভাবাবেগেরও প্রাবল্য। কবিতার মতোই লেখক তাঁর গদ্যে সৃষ্টি করেন অনুপ্রাস, উপমা, রূপক, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলংকার। ইব্রাহিম মইখলের মতো কোনো কোনো আখ্যানের পুরোটাই রূপকে পরিণত হয়। গদ্যে অলংকার সৃষ্টির গুণে লেখকের মধ্যে এক কবিসত্তার জাগরণও আমরা লক্ষ করি। এ গ্রন্থে তাঁর কবিসত্তা ও গল্পকারসত্তার এক চমৎকার সম্মিলন ঘটেছে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply