বেদে সম্প্রদায় ও বেদে-সংগীত
জাকির তালুকদার
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত জলবহুল-বিলবহুল-নদীবহুল অঞ্চলে যে যাযাবর যূথচারী মানবগোষ্ঠীগুলোকে দেখা যায়, যাদের প্রচলিত নাম বেদে, যারা আমাদের সমাজের এতই প্রান্তিক একটি অবস্থানে রয়েছে যে আমাদের জাতীয় পরিসংখ্যানে পর্যন্ত তাদের কোনো গুরুত্ব নেই, আমাদের জাতীয় নীতি-নির্ধারণী বৈঠকগুলোতে তাদের কথা কখনোই উঠে আসে না, জাতীয় সংসদে তো দূরের কথা, স্থানীয় সরকারের কোনো পরিষদেও তাদের কথা কখনো উত্থাপিত হয় না, তাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ সংগীত নিয়ে যখন বাংলাদেশের কোনো তরুণ গবেষক কাজ করতে এগিয়ে আসেন, তখন তা আমাদের উল্লসিত হওয়ার সবিশেষ কারণ অবশ্যই।
তরুণ সুমনকুমার দাশ আমাদের গবেষকদের মধ্যে এই কাজটি শুরুর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যেকোনো গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যেমন কাজটি কতখানি মানসম্পন্ন, কতখানি প্রয়োজনপূরণযোগ্য, কতখানি তথ্যবহুল এবং সর্বোপরি কতখানি অনন্য। সুমনকুমার দাশ বেদে-সংগীত গ্রন্থের জন্য এ সব প্রসঙ্গে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কৃতিত্বের সঙ্গে সঙ্গে ন্যূনতার প্রসঙ্গও উঠে আসতে পারে। তবে তাতে করে এ অনন্য গবেষণার গুরুত্ব মোটেও কমে না।
আমাদের দেশের বেদে সম্প্রদায় ও ইউরোপের জিপসিরা একই উৎসজাত কি না এই প্রশ্ন অনেক নৃতাত্ত্বিকের মনেই উঁকি দিয়েছে। পূর্ব ইউরোপের, বিশেষ করে হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার রাস্তায় জিপসিদের ক্যারাভান সব সময়ই মানুষের মনে নতুন আনন্দ ও বিনোদনের বার্তা বয়ে নদীবিরল ইউরোপের স্থলপথে জিপসিদের ক্যারাভান আর নদীবহুল বাংলা তথা ভারতবর্ষের জলপথে বেদে নৌকার বহর প্রায় সমান্তরাল দৃশ্যের অবতারণা করে নৃতাত্ত্বিকের মনে। আমাদের বেদে সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে সাঙ্কেতিক ‘থার ভাষা’য় কথা বলে। শুধু কথাই বলে না, এই ভাষাতে বিভিন্ন শ্লোক-মন্ত্র-সংগীতের উচ্চারণও তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে।
‘এই বই প্রকাশের নেপথ্যে রয়েছে আমাদের শেকড়, আমাদের উৎসের পানে ফিরে তাকানোর আকাঙ্ক্ষা’। লেখকের এই আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই মহৎ। বিশেষ করে তিনি যখন মনে করেন যে বেদে-সংগীতও হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। লেখক তাঁর বইয়ের শুরুই করেছেন তিনটি প্রশ্নবোধক বাক্য দিয়ে। বেদে-সংগীত কত প্রাচীন? বেদে-সংগীত কি আসলেই লোকসংগীত? আর তাদের নামকরণই বা হয়েছে কীভাবে? সংগত কারণেই ধারণা করা যায়, এই গ্রন্থের মধ্যে থাকবে বিভিন্ন মত-মতান্তরের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা এই প্রশ্নগুলোর সংগত উত্তর এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বেদে-সংগীতের সমৃদ্ধ সংগ্রহ। উদ্ধৃত প্রশ্ন তিনটির উত্তর দেওয়ার কিছুটা চেষ্টা গ্রন্থে রয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। সংগৃহীত ও গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট বেদে-সংগীতের সংখ্যা আরো বেশি হলে ভালো হতো।
বেদে বলতেই আমাদের দেশে সাপ-সাপুড়ে, সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র, সাপখেলা দেখানোর কথা চলে আসে। লেখক এখানে অবধারিতভাবেই সেই সব প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু অন্তত ফুটনোটে হলেও এ কথা জুড়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল যে আমাদের দেশে সাপুড়ে বা সাপের ওঁঝা মানেই বেদে নয়। বেদে-সম্প্রদায়বহিভূêত অনেক মানুষের পেশা এখন এই একই। এমনকি দেখা যাচ্ছে, একাদশ শতকে সেন আমলে বল্লাল সেন হিন্দু সমাজের যে বর্ণবিভাগ করেছিলেন, তাদের মধ্যে জল-অচল শূদ্রদের একটি অংশের পেশা ওঁঝাবৃত্তি।
লেখক বেদে সম্প্রদায়ের উৎস সন্ধানের কোনো চেষ্টা করেননি। তিনি সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, অন্য অনেক আদিবাসীর মতো বেদেরাও এই জললগ্ন ভূমিরই সন্তান। তা যে হতে পারে না এমন নয়। রাশিয়ার আলেকজান্ডার পুশকিন, চেখভ, দস্তয়ভস্কি, ইংরেজ-আইরিশ বার্নার্ড শ এমনকি সাম্প্রতিককালের গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পর্যন্ত মনে করতেন এবং করেন যে তাঁদের দেশে যে যাযাবর জিপসি সম্প্রদায়ের ক্যারাভান ঈর্ষণীয় সৌন্দর্যের সৌরভ পথের দুই ধারে ছড়িয়ে এগিয়ে চলে অলস-মন্থরতার সঙ্গে, তাঁবু খাটিয়ে মাঝে মাঝে মুখর করে তোলে প্রত্যন্ত জনপদগুলোকে, তারা আদিতে সবাই এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। পুশকিনের কাব্যনাটক যেমন জিপসিদের বন্দনায় মুখর, তেমনই মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড-এ মাকোন্দো গ্রামকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার একমাত্র প্রাথমিক মাধ্যম জিপসিরা। জিপসি-সর্দার মেলকিয়াদেসের জবানীতে লেখক মার্কেজ কোনো রাখঢাক না করেই জানান, তারা এসেছে ভারতবর্ষ থেকে, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি পাড়ি দিয়ে, পূর্ব ইউরোপের বন্ধুর পথ ধরে ধরে।
সুমনকুমার দাশ বেদে সম্প্রদায়ের আচরিত ধর্মমত নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করেননি। বেদে সম্প্রদায় কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে না। তবে লোকজ অনেক দেব-দেবী, যেমন মনসা বা বিষহরির পূজা করে থাকে। তবে সেই পূজা পদ্ধতির সঙ্গে যতটা না অর্চনার সাদৃশ্য, তার চেয়ে বেশি সাদৃশ্য লোকজ ব্রত-পার্বণের সঙ্গে।
সুমনকুমার দাশ একটি দিক খেয়াল করলে উপকৃত হতে পারতেন। এ দেশে বা বাংলা ভাষায় বেদে সম্প্রদায় নিয়ে গবেষকেরা খুব বেশি আগ্রহী না হলেও সৃজনশীল লেখকেরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই বেশ মূল্যবান কিছু কাজ করেছেন এদের উপজীব্য করে। প্রসঙ্গত বলতেই হয় অভিজিৎ সেনের রহু চণ্ডালের হাড়-এর কথা। উপন্যাসের মধ্যেই যে একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব, তা এই উপন্যাসটি আবার প্রমাণ করেছে। বেদে সম্প্রদায় নিয়ে এই উপন্যাসের সমান্তরাল কোনো গবেষণাকর্ম আমাদের চোখে পড়েনি।
সুমনকুমার দাশ অনতিতরুণ গবেষক। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক নন, তার প্রয়োজনও নেই। তবে পূর্ণাঙ্গ গবেষণামূলক গ্রন্থের ব্যাপারে আরো অভিনিবেশের প্রয়োজন হবে। আশা করি ভবিষ্যতে তিনি তাঁর শিক্ষামনস্কতার প্রমাণ রাখবেন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply