বিষাদ আর মুগ্ধতা অঙ্কনের কবিতা
ফেরদৌস মাহমুদ
কবির সুমনের গানের কিছু লাইন এ রকমঃ ‘প্রথমবার লুকিয়ে টানা/প্রথম সিগারেট/প্রথমবার নিজামে গিয়ে/কাবাব ভরপেট/এই শহর জানে আমার/প্রথম সবকিছু/পালাতে চাই যতো, সে আসে/আমার পিছু পিছু।’ গানটা কবে প্রথম শুনেছি ঠিক মনে করতে পারি না। তবে এটুকু বলতে পারি গানটা শুনে যেকোনো শ্রোতাই হয়তো ্নৃতিকাতর হয়ে ভাববেন তাঁর ব্যক্তিগত অনেক অভিজ্ঞতার প্রথম মুহূর্তের কথা।
কারও প্রথম বই প্রকাশের কথা শুনলেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমার এই গানটির কথা মনে পড়ে।
এ বছরই প্রকাশিত হয়েছে কবি বিজয় আহমেদের প্রথম কবিতার বই সার্কাস-তাঁবুর গান। নিশ্চয়ই এই বইটা তাঁর জীবনে ্নরণীয় এক শুভ অনিশ্চয়তার সূচনা। নতুনের অনিশ্চিত সুন্দরের দিকে যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ। দেশি-বিদেশি মহা ও মহান প্রায় সব কবিকেই এই যাত্রায় অংশ নিতে হয়েছে অলৌকিক চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে। প্রথম বইতেই হয়তো কেউ কেউ তাঁরা প্রতিভার পূর্ণ স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন, কেউ আবার দেখিয়ে গেছেন কেবল সম্ভাবনার ইঙ্গিত, যা পরবর্তী বইগুলোতে গিয়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছে, কেউ আবার প্রথম দিকে ভালো লাগা অগ্রজদের ছায়ায় ঢেকে রেখেছিলেন নিজেদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবারই ছিল কবিতায় আলাদা কণ্ঠস্বর তৈরি করে, নিজস্বতা অর্জনের তাগিদ।
বিজয় আহমেদেরও হয়তো চেষ্টা মহত্তম অগ্রজদের মতোই কবিতায় নিজস্বতা অর্জনের, নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার। এ চেষ্টায় তিনি কতখানি সফল হয়েছেন বা পরবর্তী সময়ে হবেন তা হয়তোবা তাঁর প্রকাশভঙ্গির নতুনত্বকে লক্ষ করলেই পাঠক টের পাবেন। বুঝবেন কবিতায়, কবিত্বশক্তির কোন জাদুবলে তিনি আচ্ছন্ন করতে চাচ্ছেন পাঠককে!
সার্কাস-তাঁবুর গান বইটিতে মোট কবিতার সংখ্যা ৪৮। এই বইতে বিজয়ের কবিতার যে মূল প্রবণতা তা হচ্ছে, কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের কাঠিন্য এড়িয়ে চেনা-জানা সহজ নাগরিক শব্দের ্নার্ট বুননে কেবল দৃশ্যকল্প অঙ্কন করা; এই দৃশ্যকল্পে কখনো গভীর অর্থ থাকে আবার কখনো কোনো অর্থই থাকে না। এই অর্থ থাকা না-থাকার মাঝে যে জিনিসটা অবশ্যই থাকে তা হলো-চারপাশের প্রতি শিশুর ড্রয়িং খাতার মতো এক ধরনের রংভর্তি মুগ্ধতা। সহজভাবে বললে বিজয়ের মূল প্রবণতাই সব কিছুকে মুগ্ধতার চোখ দিয়ে দেখা। এ ক্ষেত্রে তাঁর দেখার চোখ যেন কিছুটা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমলের চোখ। অমল যেমন একজন দইওয়ালার দই বিক্রির মধ্যেও দেখে আনন্দ কিংবা সৌন্দর্য, তেমনি বিজয়ও কখনো কখনো দেখেন ওইভাবে তাঁর শৈশবের আশপাশটাকে। তবে এই মুগ্ধতার শেষটা যেন মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে এক ধরনের নস্টালজিক বিষাদগ্রস্ততায় আচ্ছন্ন। যেমন-
‘আমি আসলে ফড়িং পছন্দ করি;
ছোট্টবেলায় অনেকগুলো দুপুর ও সূর্য কাটিয়েছি আমি
ফড়িংয়ের পিছু দৌড়ে
কিন্তু কেন যেন ওরা আমাকে একদম পছন্দ করতো না
ওরা কথা বলতো ঝোপঝাড়ের সাথে,
ফলে আমি, ঈর্ষা করতাম ফড়িং ও তার বন্ধুদের!
‘আর ভাবতাম বড় হয়ে যখন আমি
লাল রঙের টাইমফেল রেলগাড়ি হবো
তখন ওদের পাত্তাই দেবো না।’
(‘আমার কবিতাঃ ফড়িং ও আমি’)
কিন্তু বিজয় আহমেদের কবিতার সৌন্দর্যশিকারি চোখ কখনোই আধুনিক নাগরিক জীবনের জটিল অলিগলি দেখা বা অনুভব করা থেকে বিরত নয়; বরং খুব সাবলীলভাবে তাঁর কবিতায় উঠে আসে জীবনের অনেক অবিশ্বস্ততার ছায়াচিত্রও। তাঁর কবিতার যে বিষাদ তা কখনোই আরোপিত নয়, যেন নিজস্ব ভাবনা আর অভিজ্ঞতারই শস্য। ফলে তিনি অনায়াসে আনন্দ-হাসির ইঙ্গিতময় ভাষায় কবিতাঘন বাক্যে বলে ফেলতে পারেন বন্ধুর প্রেমিকা বা স্ত্রীর কামুক চাহনিতে বিশ্বস্ত বন্ধুরই হঠাৎ বন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা। যা আমাদের শরীরী আবেদন কিংবা সাংসারিক বন্ধনকেও করে ফেলে প্রশ্নবিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে আমাদের হয়তো কারও কারও মনে পড়ে যেতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের আদিম প্রবৃত্তিতাড়িত ভিখু চরিত্রটির কথা, যেখানে ভিখু শরীরী কামনায় আচ্ছন্ন হয়ে খুনি হয়ে ওঠে। বিজয়ের কবিতাটি হচ্ছে-‘আর তার বউ চোরাচোখে, আমাকে মেরে ফেলতে চায়/দিনদুপুরেই, শহুরে রাস্তার উপর?/বুঝি না সে তো নতুন বউ, এখনো মা হয়ে ওঠেনি!/তাহলে কিভাবে সে বাৎসল্যের এমন রহস্যময় ছলাকলায়/আমাকে বারবার সুপারম্যান হয়ে উঠতে বলে?/···/তারা কেন বোঝে না, আমি তো বন্দুক, বন্ধুত্ব ভুলে,/একগাল হেসে দিয়ে/মুহূর্তেই আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারি’ (‘বন্ধু ও বন্দুক’)।
বিজয়ের কবিতার একটা প্রিয় অনুষঙ্গই হচ্ছে শরীর। এই শরীরকে তিনি নানা মাত্রায়, নানা স্তর থেকে দেখেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় শরীরকে কখনো যেমন খুব পরকীয়ায় কামুক কিংবা নিষিদ্ধ মনে হয়, আবার কখনো মনে হয় শরীর যেন এক মরমী অস্তিত্ব। তেমনই একটি বহুমাত্রিক অনুভূতির কবিতা হচ্ছে তার ‘শরীর’ শিরোনামের কবিতাটি-
‘আমার শরীর-ভর্তি হলুদ পাখি/তুই যেভাবে পারিস, ধরে ফ্যাল ওকে;/ও ভয়ানক ডাকাত, মাঝরাতে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এসে/হেঁটে যায়, আগন্তুকের পোশাকে!/আমি ওকে পায়রা ও গমের বৃষ্টি দেখাতে যাই, যদিও;/তবু সে পছন্দ করে, রঙিন যাদু, উড়ন্ত জিপ।/‘তুইও মৃত-বন্ধুর রুমাল ছুঁয়েছিলি, তাই আমি তোকে/মেয়র বানাবো;/আজ রাতে শরীর খুলে দাঁড়াবো সেলুনের পাশে/পারলে, তুই, হলুদ পাখিটাকে হত্যা করিস?’/ (‘শরীর’)
২·
এই বইতে রয়েছে ‘ধান’ শিরোনামে বিজয় আহমেদের ভিন্ন স্বাদের পাঁচটি কবিতা। যার মধ্যে তিনি ‘দাদা, এই হচ্ছে ধান, এই আমার কবিতা’ বলে নিজের কবিতাকে ধানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবিতার এই জাতীয় প্রকাশভঙ্গিকে আমরা হয়তো নতুনই বলতে পারি!
বিজয় আহমেদের কবিতার অপর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, কবিতায় তিনি আমাদের চেনা-জানা বিষয়কে কবিতায় স্বপ্নের মতো করে উপস্থাপন করেন; মোহনীয় ভাষায় শব্দে শব্দে অঙ্কন করেন চেনা গ্রাম, রাজধানী শহর কিংবা মফস্বল ছাড়িয়ে দূরবিশ্বের ওয়েস্টার্ন পরিবেশকেও। ফলে এই চেনা অনুষঙ্গগুলোর দিকেও প্রকাশভঙ্গির কিছুটা অভিনবত্বের কারণে পাঠকের মনে হয়তো আগ্রহের সৃষ্টি হতে পারে অতি নতুন করে তাকিয়ে দেখার। যেখানে ঘুরে-ফিরে আমরা দেখা পাব-দুপুরের নির্জনতা, কাফ্রি যুবক, শীত শহরের রাস্তা, সমুদ্র, মায়াবী পাহাড়, সিনেমার ভিলেন, রাগী পুলিশ, গ্রাম-পুলিশ, কলোনির জীবন, বাইসাইকেল, সার্কাস, কামারশালা, ধান, নদী, ঘাসফুল, খনিশহর কিংবা জিপসিদের গানের প্রসঙ্গ।
মাহবুবুল হকের চমৎকার প্রচ্ছদ ও টিমওয়ার্কের দৃষ্টিনন্দন ছাপায় বিজয় আহমেদের সার্কাস-তাঁবুর গান-এর কবিতাগুলো পাঠে পাঠকেরা নিশ্চয়ই মায়াবী এক জগতে ভ্রমণের আমোদই বোধ করবেন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply