তরুণ কবির প্রাণশক্তি
ফিরোজ এহ্তেশাম
কবিতার বইটি পড়তে পড়তে মনে হলো প্রবর রিপনের কবিতায় একটা নিজস্ব জগৎ আছে, বিশ্ববীক্ষা রয়েছে। যে জগতে প্রবেশ করতে পাঠকের হয়তো প্রথমে অস্বস্তি ও কষ্ট হতে পারে। তবে ধীরে ধীরে সে জগতের নিয়ম ও যুক্তিশৃঙ্খলগুলো বুঝে উঠতে থাকলে, অভ্যস্ত হয়ে পড়লে পাঠক পেতে পারেন ভিন্ন অভিজ্ঞতার আস্বাদ। হয়তো তার মধ্যে জেগে উঠতে পারে শয়তানের ওপর মমতা, প্রেতের জন্য ভালোবাসা আর নরকের প্রতি প্রেম।
কবিতার একেকটি বাক্যের পেছনে এমন ব্যাপক পটভূমি থাকতে পারে আর সেই পটভূমিতে এত অজস্র রঙের বিচ্ছুরণ থাকতে পারে যে তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ সন্ধান করতে যাওয়া রীতিমতো হঠকারিতা। কবিতার মধ্যে যে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা থিম থাকতেই হবে, এমন কোনো বিধান নাই। বহু বহু বিষয়, বিষয়ের ইঙ্গিত এর মধ্যে থাকতে পারে একই সঙ্গে। যেমন পারিপার্শ্বিকের বহুমাত্রিক বর্ণনা, বৈশ্বিক ঐতিহ্য, নিজস্ব দর্শন, নতুন নতুন চিত্রকল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ছায়া, সময় ও ইতিহাসচেতনা, রাজনীতি, মিথ-পুরাণের বিনির্মাণ, ব্যঙ্গ বা স্যাটায়ার, আধ্যাত্মিক তুরীয় বি্নয়, উল্লিখন ও তার পুনর্নির্মাণ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বিষয়ের চেয়েও বেশি লালিত্য তার রসপূর্ণ রূপের। কেননা অতি সাধারণ, অতি সামান্য বিষয়কেও কল্পনা-প্রতিভার রহস্যের দ্বারা অসাধারণ, অসামান্য রূপে রূপায়িত করা যায়। আর এই রূপগত সৌন্দর্য নির্ভর করে এর আঙ্গিক বা কলাকৌশলের ওপর, উপস্থাপনের ওপর। অর্থাৎ আমরা কী বলছি তা নয় বরং কীভাবে বলছি তা-ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই বেশি মনোযোগ দাবি করে। রিপনের কিছু কবিতা ভালো লাগতে লাগতে হঠাৎ কোথাও কোথাও জট পাকিয়ে যায়, এলিয়ে পড়ে, বেসামাল হয়ে ওঠে। তাই কবিতাকে সংযতভাবে উপস্থাপনের দিকে মনোযোগী হতে হবে কবিকে। দরকার হলে মায়া ত্যাগ করে নির্মম-সম্পাদনাও করতে হবে নিজের কবিতাকে।
রিপনের কিছু কবিতা পড়তে পড়তে ‘অবাধভাবানুষঙ্গ’ শব্দবন্ধটির কথা মনে পড়ল। যখন আমরা কোনো একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি, তখন সেই ভাবনার সূত্র ধরে অন্য ভাবনার আগমন ঘটে এবং একইভাবে আবার এই পরবর্তী ভাবনার ওপর নির্ভর করে আরেক ভাবের উদয় হয়। এভাবে আমাদের ভাবনা এক থেকে আরেকে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এ কারণে একই উৎস থেকে আসার পরও প্রথম ভাবের সঙ্গে যদি সর্বশেষ ভাবের কোনো মিল নাও থাকে, এমনকি বিপরীতও হয়, তবু এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেকোনো কিছুই ঘটে যেতে পারে কিন্তু কবিতাকে শেষ পর্যন্ত তার প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের মধ্যে নিকট বা দূরগত সমন্বয়ের মাধ্যমে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে হয়।
রিপনের প্রায় কবিতাতে সুন্দর-সুন্দর কঠিন-কঠিন শব্দ-ব্যবহারের ঝোঁক লক্ষ করা যায়। শব্দের এই মায়াজাল তরুণ কবিদের যেন এক অমোঘ নিয়তির মতো জড়িয়ে রাখে, মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। আমি একে দোষ কিংবা গুণ হিসেবে দেখি না। দেখি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে, যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে একজন সত্যিকার প্রতিভাবান কবি মায়াবিনী শব্দের চোখ-ধাঁধানো ‘রূপে’র ছটা আর আগ্রাসনকে ধীরে ধীরে শনাক্ত ও অগ্রাহ্য করতে পারেন এবং এর ভেতর দিয়েই তিনি একসময় পৌঁছে যায় তার অনিবার্য শব্দের আরাধ্য ‘গুণে’র কাছে।
কবিতার শব্দ ও ভাষা ‘যথাসাধ্য’ সহজ হওয়াই শ্রেয়। এবং তারই মধ্যে ভাব-মোচড়, রহস্য-জটিলতা ও সর্বোপরি প্রাণের উপস্থিতি থাকতে হয়। এসব আমার কাছে অন্বয়ের ভাঙচুর কিংবা বাক্য-মোচড়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বের মনে হয়। কেননা এগুলোর অনুপস্থিতিতে কেবল বাক্যচর্চাই করা যায়, তা আর কাব্যচর্চা হয়ে ওঠে না। যদি শব্দ ও ভাষার জটিলতার কারণে আমরা ভাবের কাছেই না পৌঁছুতে পারি, তবে তা কবিতার জন্য মঙ্গলের তো নয়ই বরং যেটুকু পাঠকের সঙ্গে তার ভাব আছে, তারও অভাব হয়ে পড়বে। তাই একজন তরুণ কবির সাধনার একটা বড় অংশ জটিল ভাবনা-চিন্তাকে ‘যথাসাধ্য’ সহজ ভাষায় উপস্থাপনের কৌশল আবিষ্কার করা।
রিপনের কবিতায় দার্শনিকতা করার প্রবণতা আছে। কাব্যে দার্শনিকতা ততক্ষণ পর্যন্তই গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ না তা কবিতাকে ছাপিয়ে যায়, প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁর কিছু কবিতায় যেমন এই প্রকটতা আছে, তেমনি দর্শনকে কবিতার সঙ্গে মিশিয়ে একাত্ম করে ফেলার দক্ষতার আভাসও পাওয়া যায়।
অনেক বিমূর্ত বিষয়কে তিনি আরও বিমূর্ত রূপের দিকে নিয়ে যান। এটাকে বলা যায় বিমূর্তের বিমূর্তায়ন। এতে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। অধৈর্য হয়ে পড়েন তিনি, হাঁসফাঁস করেন সেই রূপকে উপলব্ধি বা অনুভব করতে না পেরে।
রিপনের কবিতা মাঝেমধ্যে বিবৃতিধর্মী। আবার ওপর থেকে ‘ঈশ্বরের চোখে দেখা’, মন্তব্য করা বা সূত্র দেওয়ার মতো বিষয়গুলোও ঘটতে দেখি তাঁর কবিতায়।
কল্পনার লাগামহীন বিস্তারের মধ্যে বিরাজ করেন কবি। আর এই কল্পনার সঙ্গে তাল মেলাতে উত্তুঙ্গ ঢেউয়ের মতো শব্দরাজি আছড়ে পড়ে তাঁর কবিতায়। সেই ঢেউয়ের তোড়ে মাঝেমধ্যে ভেসে যান নিজেও। তাই তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, সবকিছু ভাঙচুর করে এগিয়ে যাবেন তিনি, পরোয়া করবেন না কিছুরই। একজন তরুণ কবির এই প্রাণশক্তিকে আমি সপ্রশংস সমর্থন জানাই। সেই সঙ্গে এও জানাই, শুধু ভাঙচুর নয়, গড়েও তুলতে হবে নতুন কিছু, যার সামর্থø ও সম্ভাবনা দুটোই রিপনের আছে।
রিপনের প্রায় সব কবিতাই বড়। এরই মধ্যে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা ‘ফুলেল সমাধি’, তুলে দিলাম-
‘কোথাও ঘটবে একটা কিছু
তা না হলে ঘুমভাঙা মাত্রই আমাকে
কেন চালিত করো রোদ্রশক্তির ভেতরে!
আমি-তো হাড়কাঁপুনে শীতেও রোদকে দহন ছাড়া ভাবতে পারিনি কিছু।
এই হৃদস্পন্দনকে চিরকম্পনের ধারা ভেবে কি
আজ তাড়িত করেছো-এই প্রেম-রোদ্র-শক্তির নিগূঢ়ে
বিকেলের মঠে ক-দণ্ড স্থিরতার কথা ভেবে।
আকাশ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া তোমার চুলের ভেতরে
সূর্যমুখী ফুলের নির্যাস আর অর্গলমুক্ত সব মদের প্রপাতের ঘ্রাণ।
বুকে নিয়ে মরা-রতিক্লিষ্ট মশা
লাঙ্গলের ফলার দাগ মুছে দিয়ে-নির্বাক হ’য়ে আছি আমি ঊষর মৃত্তিকা।
আমার এই অনন্ত নির্বাকতাকে অসহায়ত্ব ভেবে
বাঁজা মাটির জরায়ুতে ফেলে রেখে গেলে অন্ধপ্রেমের রেণু
বোবা মাঠের নিথর কণ্ঠে আমি কি জাগাতে পারি
অস্কুট ফসলের ঝড়োগান!’
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply