বিভ্রম থেকে অনুধাবন
তারিক টুকু
এক রকমের অনির্দিষ্ট, আকাঙ্ক্ষাচূর্ণের বহুবর্ণিল অভিঘাতে তৈরি পথের মধ্য দিয়ে আমরা এখনকার কবিতার একটি ধারাকে যেতে দেখি, যা মূলত কবিতাকে তার গতিপথ বদলাতে, সামান্য হলেও বাধ্য করেছে। এই ধারার কবিতা যুক্তির শৃঙ্খল মানতে চায় না, তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিতে চায় না কোনো দায়িত্ব, এমনকি কোথাও কোথাও নিজেকে অস্বীকার করে নিজেই নিজেকে পুনর্মূল্যায়ন করে নিতে চায়। যিনি কবি, তিনি এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, তাও নয়; তাঁর কাজ শুধু নতুন কবিতা লেখা হলেও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়েই তাঁকে কবিতা লিখতে হয়। নতুন পথ এতে সৃষ্টি হয় না, এই ধরনের দবি করা পরোক্ষে বাতুলতার শামিল, বরং এতে বোঝা যায়, একটি যৌথ অভিজ্ঞানের মধ্যে থেকেও একজন কবি অন্য কবিদের চেয়ে কতটা আলাদা হতে পারেন। পাখি ও প্রিজম তেমনই এক গ্রন্থ।
যেকোনো ভালো কাব্যগ্রন্থেরই একটি জগৎ থাকে, থাকে কবির দৃষ্টিভঙ্গির বিশিষ্ট নমুনা। কবির স্বকীয়তা ও চারুদক্ষতা কবিকে যেমন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে, তেমনি স্বতশ্চলভাবেই গড়ে ওঠে তাঁর জগৎ। রাশেদুজ্জামানের এই গ্রন্থটিকে পাঠ করতে গিয়ে দ্বিতীয় কবিতাটিতেই লক্ষ করি-‘এইখানে / ফুল নয়, ফুটে আছে ফুলের বিভ্রম’। মনে পড়ে, প্রথম কবিতাতেই পড়েছি ‘পাখি হয়ে ওড়ে ঝরাপাতা / ঝরাপাতা হয়ে ওড়ে পাখি্নৃতি’। বুঝতে কষ্ট হয় না, এই দুটি পঙ্ক্তিই এই কবির চারিত্র্যধর্মের আভাসদাতা। ফুল নয়, ফুটে আছে ফুলের বিভ্রম-অংশটুকু পড়ে কি আমরা বুঝে নেব, এই কবির যেটুকু অভিজ্ঞতা ও অনুধাবন, তা তার বিশেষ পর্যবেক্ষণলব্ধ; কবিতা এখানে বাস্তব-অবাস্তব, যুক্তি যুক্তিহীনতা-কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব জগৎ থেকে উৎসরিত হচ্ছে, পৌঁছে যাচ্ছে এমন এক উচ্চতায়, যেখানে এর নিরেট অর্থমূল্যের দিকে পাঠক তাকিয়ে থাকতে পারেন না। এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এই প্রগাঢ়তা খোদ কবিকে কতটা জারিত করেছে। ওই সিরিজের পরবর্তী কবিতাতেই যখন কবি লিখছেন, ‘আমার গল্পের মধ্য থেকে আমি ছড়িয়ে পড়ছি··· / অন্য গল্পে, গল্পহীনতায়’, তখন রাশেদুজ্জামানের কবিব্যক্তিত্বের মুখ্য দিকগুলোর একটা ইশারা আমরা পেয়ে যাই এবং পুরো গ্রন্থ পড়ে শেষ করলে দেখতে পাব, এই ইশারা ক্রমশই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।
এর মধ্য দিয়েই চলতে থাকে স্বাদ গ্রহণের পালা, বলা যেতে পারে, সেটা বেশ বিচিত্র ও বৈভবে সমৃদ্ধ। পড়তে পড়তে ‘হাওয়া আর জল কবিতাটি’তে আসি, ‘তবু আজ জেনে নিতে চাই, কার মুখ / কার মূর্তি জেগে আছে, জলের ভেতরে কার কণ্ঠস্বর?’ এবং ঠিক তার পরের পঙ্ক্তি, ‘পড়ে আছি আমি-কোনো স্থাপত্যের ভুল, অসংলগ্ন বাহু!’ বুঝি প্রচল নস্টালজিয়ার আঙিনাকেও কবি একটা নতুন রূপ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তা যে তাঁর জন্য খুব আয়াস-সাধ্য, তাও নয়। মানে, একটা সহজাত ভাবের ছোয়া আছে তাঁর এ-জাতীয় কবিতাগুলোর মধ্যে। আরেকটি কবিতার কথা (‘জলে ভাসিয়েছে ফুল’) বিশেষভাবে বলা যায়, যেখানে পুষ্পস্রোত সুর হয়ে আসে, একটি লক্ষ্যচ্যুত মাছ কোঁচবিদ্ধ হয়ে উঠে আসে একটি কুসুম হয়ে। এভাবেই সৌন্দর্যের, অযৌক্তিক কবিতাবিশ্বের একট গাঢ় পরম্পরায় আমরা রাশেদুজ্জামানের যাত্রাপথের সাক্ষী হয়ে উঠতে থাকি।
কবিতার বৈচিত্র্যে তিনি আমাদের প্রবেশ করান, কোথাও আমরা আনন্দ পাই, কোথাও পেয়ে উঠি না। বইটির মধ্যখানে এমন অনেক কবিতাই আছে, যেখানে ছন্দকে ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু ছন্দ সেভাবে বেজে ওঠেনি। ছন্দ কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ফলে, ‘শিরোপা জয়ের ্নৃতি’ থেকে শুরু করে ‘বকুল বকুল’ পর্যন্ত কবিতাগুলো প্রগাঢ় কবিতার কোনো মূর্তি পায়নি বলেই মনে হয় (অথচ সেসবের অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষা প্রগাঢ় কবিতার দিকেই)। এর কারণ বোধহয় এই, কবিতাগুলোর যে ভাববস্তু, তাতে পয়ার বা অন্যান্য ছন্দে তারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারেনি, মূল কবিতাটার চেয়ে ছন্দের শরীরটাই বেশি বোঝা গেছে। অনেক উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি আছে ওই কবিতাগুলোর মধ্যে কিন্তু কবির যে সাবলীলতার ইঙ্গিত একটু আগে দিতে চেয়েছি, তা এখানে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ছন্দের সঙ্গে কবিতার ভাববস্তুর সম্পূর্ণ ঐকতান না ঘটলে যে অভিজ্ঞতা হয় পাঠকের, এই কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সে রকমেরই।
বইয়ের শেষ দিকের গদ্যকবিতাগুলোতে রাশেদুজ্জামানকে আবার এতটাই সাবলীলভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে দেখি যে, অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন, কল্পনা থেকে প্রজ্ঞায় পৌঁছাতে তাকে সেখানে খুব বেশি কসরত করতে হয় না। বরং এই কবিতাগুলো যেন এই কবির নিয়তি, এর ভাষা আমাদের এ রকমই বলে দেয়। ‘রূপসী হরিণীর ছদ্মবেশে মৃত্যু এসেছিলো’ কবিতায় তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘চিরকাল শূন্যপ্রবাহের মুখোমুখি হওয়ার নাম স্মান’ তখন তাঁর কবিতার যে জগতের মধ্যে আমরা বসবাস করছি, তা যেন আরও স্পষ্টভাবে আমাদের কাছে প্রতিভাত হতে শুরু করে। গদ্যকবিতাগুলোতে কবির এই যাত্রা গাঢ়তর অনুভবের দিকে আমাদের পৌঁছে দেয়, যখন আমরা এর ভাষাকে একটু বিশেষভাবে লক্ষ করি। দেখা যায়, কী এক আশ্চর্য জাদুবলে ভাষা তৈরি হচ্ছে, নীরবতা যেন তার রক্ষাকবচ। ‘আমার ্নৃতির ভেতর তোমার হিমডানা আমি টের পাই, মেঘ’ [মেঘ]-মুহূর্তেই তৈরি হয় ভাষা, এক আশ্চর্য টানে পুরো কবিতাটাই আমাদের পড়িয়ে নেয় এবং পাঠ যখন শেষ হয়, ‘যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর এমন বৃষ্টি নেমেছিলো, মনে পড়ে’-এই পঙ্ক্তিটি দিয়ে, তখন, এই ‘মনে পড়ে’ শব্দ দুটির কাছে এসে আমরা যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। এক আশ্চর্য মুহূর্ত তৈরি হয় তখন, সে মুহূর্তটি আমাদের অন্যতর স্মানে সিক্ত করে। খুব উল্লেখযোগ্য ‘ঘোড়া’ কবিতাটি, যার সুর, চারুদক্ষতা মনে রাখার মতো।
রাশেদুজ্জামানের ক্ষমতার মূল দিক প্রগাঢ়ত্বে ও বহুরৈখিকতায়, সুর সৃষ্টিতে ও চারুদক্ষতায়। কবিতার সব আয়ুধই তিনি বহন করবেন, এ তাঁর কষ্টকল্পনা। সেসব ছাড়াও যে একদম নতুনভাবে ভেবে নিয়ে কবিতা লেখা যায়, এবং তা যে গ্রহণযোগ্যও হয়ে ওঠে-এই গ্রন্থ তারই প্রমাণ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply