সহজের চরণচিহ্ন, এসো
নির্লিপ্ত নয়ন
সহজ কথা সহজ করে বলতে গেলেও প্রয়োজন হয় একটা পথ। বলতে পারি অনেকভাবেই পথের বিস্তার। আর সহজিয়া ওই সব পথে কবিতা কীভাবে হাঁটে, কীরূপে নির্মিত হয় কাব্যকণ্ঠি শরীর? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর ঘোরাল-যথেষ্ট জটিল। কেউ একবাক্যে অবলীলায় উত্তর দাখিল করবেন বিষয়টি আদৌও তেমন নয়। ‘কেহ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী আমি বহে আনি’-কবিতা অর্থাৎ বাণী বয়ে আনার স্তরে স্তরে যে সহজতা, সহজ করে বলার চেষ্টা-তার পরিপ্রেক্ষিত রচনার্থেই এত কথা, আয়োজন। আয়োজন এই কারণে যে শিহরিত শস্যদানার কবি
মাসুম মোকাররমের কবিতাগুলোর গন্তব্য শেষ অবধি সহজতার দিকে। সহজ করে বলার চেষ্টায় বিভিন্ন পথে যেনবা বারবার ‘শব্দ বাতাসে ভিজে যায়’।
শিহরিত শস্যদানা মাসুম মোকাররমের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কখনো ছন্দাবদ্ধ পথে কখনোবা ছন্দের বাঁধন খানিকটা এলিয়ে কবি নির্মাণ করেছেন তাঁর কাব্যবাকভুবন। ৫৩টি কবিতার ডানাসংযুক্ত গ্রন্থটিতে কবি যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন সেখানে পাড়াপড়শিসহ আরও যারা থাকে-তার মধ্যে মানুষের ক্রমাগত বয়ে যাওয়া এবং বয়ে যেতে যেতে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে থাকা, ্নৃতিবিহ্বলতা এবং ্নৃতির আয়না খুঁড়তে খুঁড়তে দেবী চরিতার্থতা, প্রেম, অনুভূতির স্পর্শদোলায় দীপ্যমান। যদিও সহজ করে বলার প্রবণতার কারণে কবিতার প্রচল শরীরগঠন ‘সঘন সংঘাতে’ তৈরি করে ভিন্ন আত্মার আকার, তবুও বলা যায়, মাসুম মোকাররমের উদ্দীষ্ট সহজ ও সাবলীল প্রেক্ষাপটের পানে স্পষ্ট হতে পারার জন্য তিনি আকুল-
‘আসুন কথিত জনতা আসুন উদিত আঁধার
দেখুন
টেরাকোটা হয়ে যাচ্ছে শরীর
রেখার ফিগারে ভেসে উঠছে ইঙ্গমার্কিন
সঙ সাজা রাজা শহীদের হাড় ও আঁধার
কালিক জমানা-জগৎ’। (‘টেরাকোটা’)
স্পষ্টতার লণ্ঠন জ্বেলে পথ দেখিয়ে মাসুম এক নিঃশ্বাসেই বলে ফেলছেন কথাগুচ্ছ। কোনো পর্দার মায়া ও গুণ্ঠনের অবকাশ নেই। শিহরিত শস্যদানার প্রায় সর্বত্রই যেন এক মায়া বিরুদ্ধতার প্রেক্ষাপট। এ ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্নও আসে-কবিতার স্বভাব-নিয়মেই তো রয়েছে আড়াল অভিসার, তাহলে? মাসুমের কবিতায় আড়ালও উপস্থিত; কিন্তু ব্যক্ত আড়ালের মধ্যে আলতো আলোর ঝিলিক রেখাও দেখা যায়-‘আমরা। আমি সে তিনি। তীর আঁকা সড়কের মধ্য রেখায় দাঁড়িয়ে প্রথমে উত্তরে। উত্তরে ভাঙা ইটের স্তূপ। তালগাছলম্বা ছায়ার ডেরা। ভেজা ঘাস। ধরি, এখানে কোথাও ওড়নাটা রয়েছে। হারানো ওড়না খোঁজার এ পালায় আমরা ক্লান্ত হই না। ক্লান্তিকর যেসব কাজ আমাদের ছিল তা ছেড়ে ওড়নার খুলে পড়া শেষরাত পেরিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ানোর পর পুবমুখো। আমরা নামকরণের সার্থকতা বা গদ্যশৈলী বা দুর্নীতি আর অবৈধ বনজপ্রাণীর কথা বলি। আমি সে ও তিনি অবশ্যই দূরতম এসব কথা শুরু হলে অল্পক্ষণমাত্র।’ (‘ওড়নায় জোছনা অথবা জলপাই রাজা’) পরম্পরাহীনতার মাঝ নদীতেও একধরনের বিকল্প পরম্পরার ঢেউ জাগিয়ে কথা-বাক্যের পর কথা-বাক্য উত্থিত হচ্ছে। বিনিময়ে এর জন্য তেমন কোনো কৃৎকৌশল নেই, আয়োজনও যথাসম্ভব নিরাভরণ।
তো, শস্যদানার শিহরণে চমকে ওঠার পর পাঠক মাসুমের কবিতা এবং বলনভঙ্গির প্রবণতা যদি খুঁজতে যান-এ বিষয়টি হয়তো বুঁদবুঁদ তুলতে পারে। আরও কিছু দৃষ্টান্ত মেলে ধরি-
১· ‘দেখা হলে কথা হতো। চা ঘরে চা হতো। কথা বলতেন। বলতে ছেলেটার জন্য একটা লাল ফ্ল্যানেলের শার্ট কিনবেন। এনজিওটায় লেগে থাকলে শেষমেশ দাঁড়ানো হয়তো যাবে। ফেলে আসা ঢাকার কথাও বলতেন। কলেজে পড়ার কথা প্রেসে চাকরির কথা যে মেয়েটি তাকে দেখে হেসেছিল মিরপুর দুই নম্বরে সে কথাও এসে যেত।’ (‘দেখা হলে’)
২· ‘বৃত্তের বাইরে রেখা নেই। ফলবাগানের মাঝে রেকর্ড করা গান পাঁচজনের ভেতর এক দ্যোতনায় বাজে। সবারই বৃত্তের কথা মনে হয়। বলাবলি করে চিন্তাধারা বিষয়কেন্দ্রিক শব্দবন্ধ আসলে বৃত্তের কথা। পাখির এক বৃত্ত। পাখিরই ভিন্ন। মানুষে মানুষে নানামুখী। গোপনে কেউ ঢেউ ভাঙে।’ (‘বৃত্ত’)
গোপনে ঢেউ ভেঙে ভেঙে একধরনের গল্প-গড়নকে জ্বালিয়ে রাখা গদ্যধর্মী এই কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হতে পারে-সবকিছু তো স্বাভাবিক। স্বাভাবিকতার চলনেই বলে যাওয়া, এর মধ্যে কোথায় সুষমিত কাব্যের হীরা-মাণিক্য? মজার বিষয় হলো-শিহরিত শস্যদানা নাম কাব্যে যাত্রাধ্বনি তুলে কবি মাসুম মোকাররম বোধকরি আড়ম্বরহীন কিন্তু অন্তর্বর্তী এক কাব্যঘরানার দিকে সরল তীর নিয়ে ছুটে যেতে চান। ফলে ‘এনজিওটায় লেগে থাকলে শেষমেশ হয়তো দাঁড়ানো যাবে’-এর সঙ্গে ‘মিরপুর দুই নম্বরে’র কথাও একই ধনুকে এসে জায়গা করে নেয়। একে যদি বলি গল্পের মতো বলে যাওয়া, তবুও চোখের চারপাশে জিজ্ঞাসা নাচে। কেননা গল্পের তো ঘনিষ্ঠ একটা আয়োজন থাকে। তবে কি কবিতার প্রবাহে প্রবাহে মাসুম ছড়িয়ে দিলেন গল্পবেশী গল্পের প্রতারণা? মাসুমের সার্থকতা এখানেই। কবিতার অটুট বৃত্তপটে গল্পের রং মিশিয়ে দিতে পারেন তিনি আততায়ী মধুর হাতে, অস্পষ্টতার কালো নোলক আঁধারে রেখেই। এ ক্ষেত্রে শিহরিত শস্যদানার কবিতাতেই মাসুম খণ্ড বা অখণ্ড প্রেক্ষাপট সৃজনে প্রয়াসী। দেখা যাচ্ছে, কবি কথা শুরু করলেন-খণ্ড বা অখণ্ড প্রেক্ষাপট কিংবা প্রেক্ষাপটের ভগ্নাংশ তৈরি হলো। অতঃপর কবি লিখলেন কবিতার অন্তিম স্তবক, যে চরণটি লিখিত হওয়ার জন্য হয়তো পুরো কবিতাটি উ্নুখ ছিল এতক্ষণ-
‘গ্রামের মানুষ বলে, আকাশকে লাথি দিয়ে
কথা বলো না। মানে অহঙ্কার করো না।
কেননা অসীম শূন্য শূন্য থাকে না।
পূর্ণ করে আরেক আলো।’
‘অন্ধকারে আঁধার রেখে মানুষ সরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়।
এই মিথলজি ভাইঝিদের ভাসায়।’
‘ভাইঝিদের একা রেখে আরো আরো বাবারা তারা হয়ে যায়।’
(‘বাবারা তারা হয়ে যায়’)
খুব ছেলেবেলায় শোনা রূপকথাটি ব্যক্তিক অনুভবের রং মিশেলে পলাশ হলো। আর কবিতার শেষ বাক্যে পৌঁছে চোখের আলোয় দেখলাম ফুলটি ফুটে আছে। আছে সহজ স্পষ্টরূপেই! ‘নগ্ন মধুর ্নৃতি নেই’, ‘ক্রান্তিকাল’, ‘ফিরে দেখা’, ‘মুগ্ধতা’, ‘অন্ধকার বারান্দা’ প্রভৃতি কবিতা সম্পর্কে এ রকম বলা যাবে। তবে সহজের শ্যামলিমায় বিপদের ঘনঘোর, কোনো ক্ষেত্রে কবি সেই বিপদকে এড়াতে পারেননি; বরং বিপদচক্রেই দণ্ডায়মান। ফলত, নির্দিষ্ট ক্রমবিন্যাসকে অনুসরণ করে স্পষ্ট হতে গিয়ে কখনোবা কবিতা হয়ে পড়েছে বৃত্তাবদ্ধ। তার নিঃশ্বাস যেন এক নিগড়ে বাঁধা পড়ে গেছে তখন। যে কারণে এই গ্রন্থের কোনো কোনো কবিতা তার অন্তর্লীন অনুভূতির মর্মরতাকে মৃতবৎ করে তুলেছে তৎক্ষণাৎ-স্পর্শের পরিবর্তে অধিকতর স্পষ্ট আকাশ খোঁজার দোলাচলে।
শিহরিত শস্যদানা কুড়োতে কুড়োতে মাসুম মোকাররম আমাদের বুঝিয়ে দেন যে ছন্দ তার মুঠোভর্তি। কিন্তু নিপাট ছন্দ মেনে কবিতাকে নির্মাণ করতে গিয়ে মাসুম কি কবিতার অন্তরের প্রাণ ভ্রোমরাকে সর্বাংশে অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছেন-‘বিরান ভূমিরও প্রকাশ থাকে নীরবতার তো বটেই/পাশ ফিরতেই বঙ্কিমপ্রভা কুৎসা তো কিছু রটেই’। ‘ভিন্নক্রিয়া’র মতো এ ধরনের আরও বেশ কটি কবিতায় যেখানে ছন্দসংহতি দৃশ্যমান, কবিতা কি সেখানে ছন্দের বন্ধনে স্পষ্ট হতে গিয়ে একটু-আধটু হাঁস-ফাঁস করছে না? শব্দসৌধের পাশাপাশি নীরবতার যে প্রকাশ, এই পঙ্ক্তিতরঙ্গে সেই নৈশব্দের তর্জনীর দেখা মিলেছে কি?
প্রেমে-অপ্রেমে এবং রাজনীতি ও সমাজের মধ্যে ব্যক্তির অবস্থানগত দহনে জর্জর কবি মাসুম মোকাররম সহজের দিকে হাঁটছেন। স্পষ্টতা উঁচিয়ে ‘খেলা’ কবিতায় বলছেন, ‘কাঁথামুড়ি দিয়ে আমি আর লিমি ভুতুম ভুতুম খেলি।/সন্ধ্যার তুমুল সুন্দর মনে থাকে না। সময় মনে থাকে না।’ সময়হীনতার মধ্যে কিছু মনে না থাক। মাসুম মোকাররমের শিহরিত শস্যদানাকে তবু ‘এসো সরলা’ বলে ডেকে যাই আজ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
পূর্ববর্তী:
« সমুদ্র তার ভাই – পিয়াস মজিদ
« সমুদ্র তার ভাই – পিয়াস মজিদ
পরবর্তী:
সাহিত্যের অমীমাংসিত ইতিহাস চেতনা »
সাহিত্যের অমীমাংসিত ইতিহাস চেতনা »
Leave a Reply