জেফরি আর্চার
ভাষান্তরঃ কায়সার আলম
ইগনেশিয়াস আগারবি নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী হওয়ার সময় কেউ এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। নিন্দুকেরা বলেন, হাজার হলেও গত সতেরো বছরে এ নিয়ে সতেরো নম্বর অর্থমন্ত্রী হলেন তিনি।
আইনসভায় তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পলিসি বক্তৃতায় তিনি সরকারি কর্মকাণ্ডে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন এবং এমপিদের এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, নিষ্কলুষ জীবনযাপন না করলে সরকারি পদে বহাল কেউ নিজেকে নিরাপদ বোধ করতে পারবেন না। প্রথম বক্তৃতার একেবারে শেষ বাক্যে তিনি বলেনঃ ‘আমি নাইজেরিয়ার বহু বছরের জঞ্জাল সাফ করে ছাড়ব।’
মন্ত্রী সাহেবের বক্তৃতা কেউ গুরুত্বসহকারে নিল না। এটার কোনো উল্লেখই পাওয়া গেল না লেগোস থেকে প্রকাশিত ডেইলি টাইমস-এর পাতায়। সম্পাদক সাহেব হয়তো ভাবলেন, তাঁর পত্রিকা আগের ষোলো মন্ত্রীর বক্তৃতা যেহেতু বিস্তারিতভাবে কাভার করেছে, কাজেই এবার পাঠক মনে করতে পারেন, আ রে, এসব কথা তো আমরা আগেও শুনেছি।
তার ওপর আস্থার এই অভাব টের পাওয়া সত্ত্বেও ইগনেশিয়াস কিন্তু হতাশ হলেন না। পূর্ণ উদ্যমে তাঁর নতুন দায়িত্ব পালন শুরু করলেন তিনি। নিয়োগ পাওয়ার কয়েক দিনের মাথায় খাদ্যশস্য আমদানিসংক্রান্ত একটা বিষয়ে কাগজপত্র জালিয়াতির দায়ে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক অধস্তন কর্মকর্তাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়লেন। ইগনেশিয়াসের নতুন ঝাড়ুর পরবর্তী ঘা গিয়ে পড়ল শীর্ষস্থানীয় এক লেবানিজ অর্থদাতার গায়ে। বিদেশি মুদ্রা-নিয়ন্ত্রণ-নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে বিনা বিচারে তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হলো। পরের মাসে আরেকটা ঘটনা ঘটল, যেটাকে এমনকি ইগনেশিয়াসও ব্যক্তিগত এক অভ্যুত্থান বলে মনে করেনঃ ঘুষ নেওয়ার দায়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক গ্রেপ্তার হলেন। লেগোসের নাগরিকেরা ঘুষটুষকে এত দিন চাকরিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচনা করতেন। এই ঘটনার পর অবশেষে ডেইলি টাইমস-এর প্রথম পাতায় ঠাঁই পেলেন অর্থমন্ত্রী। পত্রিকার মাঝের পাতায় এক নেতা তাঁকে ‘ঝাড়ু ইগনেশিয়াস’ হিসেবে অভিহিত করলেন, এ এমনই এক নতুন ঝাড়ু, প্রত্যেক অপকর্মকারী যার ভয়ে কম্পমান। গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার চলতে থাকল আর মিস্টার ক্লিন হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকল ইগনেশিয়াসের। শেষে রাজধানীতে এমন অসমর্থিত গুজবও শোনা যেতে লাগল যে, রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ওটোবি পর্যন্ত তাঁর নিজের অর্থমন্ত্রীর তদন্তের মুখে পড়েছেন।
এখন এক শ মিলিয়ন ডলারের ওপরের সকল বিদেশি চুক্তি যাচাই, বাছাই, নিরীক্ষা ও অনুমোদনের কাজটা এককভাবে করেন ইগনেশিয়াস। তাঁর প্রতিটা কাজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজরদারি করে শত্রু শিবির, কিন্তু তাঁর মুখে কেলেঙ্কারির একটা আঁচড়ও কেউ কাটতে পারেনি।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে ইগনেশিয়াস যখন তাঁর দ্বিতীয় বছরটি শুরু করলেন, তখন এমনকি বিশ্বনিন্দুকেরাও তাঁর সাফল্য স্বীকার করতে শুরু করল। আর এ রকমই একসময় জেনারেল ওটোবি এক অনির্ধারিত বৈঠকে ডেকে পাঠালেন ইগনেশিয়াসকে।
দোদান সেনানিবাসে মন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর স্টাডি রুমের আরামদায়ক চেয়ারে তিনি বসতে দিলেন মন্ত্রীকে। এ ঘর থেকে চোখে পড়ে সামনে প্যারেড গ্রাউন্ড।
‘ইগনেশিয়াস, এইমাত্র আপনার সর্বশেষ বাজেট রিপোর্ট পড়ে শেষ করলাম। আপনি যা লিখেছেন, পড়ে সত্যি আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আপনি লিখেছেন, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির তরফ থেকে দেওয়া ঘুষের কারণে আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার এখনো প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে। আপনার কি কোনো ধারণা আছে, এই টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে? এটা জানতেই আপনাকে ডাকা।’
ইগনেশিয়াস টান টান হয়ে বসে ছিলেন। চোখ একবারের জন্যেও সরেনি রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর থেকে।
‘আমার সন্দেহ, এই অর্থের একটা বড় অংশ সুইস ব্যাংকের বিভিন্ন প্রাইভেট অ্যাকাউন্টে গিয়ে জমা হচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে এটা প্রমাণ করার কোনো পথ আমার কাছে নেই।’
‘সে ক্ষেত্রে সেটা প্রমাণের জন্যে যা যা অথরিটি আপনার দরকার, আমি আপনাকে দেব,’ বললেন জেনারেল ওটোবি। ‘এই বদমায়েশগুলোর মুখোশ উ্নোচনের জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করার এখতিয়ার আপনি রাখবেন। আমার মন্ত্রিসভার সাবেক-বর্তমান সকল মন্ত্রীর ব্যাপারে তদন্ত দিয়ে শুরু করুন। তাদের পদ বা যোগাযোগ যাই হোক না কেন, এ কাজে কাউকেই ভয় পাবেন না বা কাউকে ছাড় দেবেন না।’
‘এ কাজে সফল হতে হলে আপনার স্বাক্ষর করা একটি বিশেষ অনুমতিপত্র দরকার, জেনারেল···’
‘সে ক্ষেত্রে আজ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে সেটা আপনার টেবিলে পৌঁছে যাবে,’ রাষ্ট্রপ্রধান বললেন।
‘আর আমি বিদেশ সফরে গেলে আমাকে অ্যাম্বাসেডর প্লেনিপটেনশিয়ারির মর্যাদা দিতে হবে।’ ‘দিলাম।’
‘ধন্যবাদ,’ ইগনেশিয়াস বলেন। আলাপ শেষ হয়েছে ধরে নিয়ে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। ‘এ জিনিসটারও হয়তো প্রয়োজন দেখা দিতে পারে আপনার,’ দরজার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন জেনারেল। ইগনেশিয়াসের হাতে একটা ছোট অটোমেটিক পিস্তল তুলে দেন রাষ্ট্রপ্রধান। ‘কেননা, আমার অনুমান, এ মুহূর্ত থেকে আপনার শত্রুর সংখ্যা আমার শত্রুর সংখ্যার সমান হয়ে গেছে।’
কিছুটা বেকায়দা ভঙ্গিতে সৈনিকের হাত থেকে পিস্তলটা নেন ইগনেশিয়াস, সেটা পকেটে রেখে বিড়বিড় করে ধন্যবাদসূচক কিছু আওড়ান।
তাঁদের মধ্যে আর কোনো কথা হয় না। ইগনেশিয়াস তাঁর নেতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি চেপে নিজ মন্ত্রণালয়ে ফেরেন।
নাইজেরিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংক গভর্নরকে কিছুই জানতে না দিয়ে, প্রজাতন্ত্রের কোনো সিনিয়র কর্মকর্তার তরফ থেকে কোনো রকম বাধা ছাড়াই তাঁর এই নতুন কর্মযজ্ঞ পূর্ণ উদ্যমে শুরু করেন ইগনেশিয়াস। রাতের বেলা একা তিনি কাগজপত্র পরীক্ষা করেন, যেসব তথ্য পান, দিনের বেলা সেগুলো নিয়ে কারও সাথে কোনো আলাপ করেন না। তিন মাসের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলেন তিনি।
এক অনির্ধারিত বিদেশযাত্রায় বেরিয়ে পড়ার জন্যে আগস্ট মাসটাকেই বেছে নিলেন মন্ত্রী। কেননা বেশির ভাগ নাইজেরীয় নাগরিক এই মাসে অবকাশ কাটাতে বের হয়। ফলে এ সময়টায় গেলে তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে কোনো কথা উঠবে না।
নিজের স্থায়ী সেক্রেটারিকে তিনি নির্দেশ দিলেন অরল্যান্ডোগামী ফ্লাইটে তাঁর, তাঁর স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ের জন্য টিকেট বুক করতে। টিকেটের টাকা যাতে তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হয়, সেই নির্দেশও তিনি দিলেন।
ফ্লোরিডায় নেমে মন্ত্রীর পরিবার ম্যারিয়ট হোটেল নামে একটা সাদামাটা হোটেলে উঠল। ওঠার পর কোনো রকম ভূমিকা বা ব্যাখ্যা না দিয়ে ইগনেশিয়াস তাঁর স্ত্রীকে বললেন, দরকারি কাজে তিনি কয়েক দিন নিউইয়র্কে অবস্থান করবেন। ফিরে এসে ছুটির বাকি দিনগুলোয় তিনি যোগ দেবেন তাদের সাথে। পরদিন সকালে পরিবারকে ডিজনি ওয়ার্ল্ডের রহস্যের মধ্যে রেখে তিনি নিউইয়র্কের একটা ফ্লাইট ধরলেন। লা গুয়ারডিনা থেকে কেনেডি এয়ারপোর্ট ট্যাক্সিতে সামান্য সময় লাগে। সেখানে নেমে পোশাক পাল্টালেন তিনি। নগদ টাকায় কিনলেন রিটার্ন টিকেট। তারপর জেনেভাগামী সুইস এয়ারের একটা ফ্লাইটে চেপে বসলেন। কেউ তাঁকে লক্ষ করল না।
জেনেভা পৌঁছে খুব সাদামাটা একটা হোটেলে উঠলেন ইগনেশিয়াস। বিছানায় শুয়ে টানা আট ঘণ্টা গভীর ঘুম ঘুমালেন। পরদিন সকালের নাশতা সারতে সারতে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের একটা তালিকা পরীক্ষা করতে লাগলেন। নাইজেরিয়ায় গবেষণাকর্ম চালানোর সময় খুব সতর্কভাবে এই তালিকা তিনি বানিয়েছেন, প্রতিটা নাম তাঁর নিজ হাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। গারবার অ্যাট সিয়ে ব্যাংক দিয়েই শুরু করবেন বলে ঠিক করলেন ইগনেশিয়াস। তাঁর হোটেলের বেডরুম থেকে দেখা যায়, এভিনিউ দ্য পারচিনের প্রায় অর্ধেক রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাংকটার ভবন। ফোন করার আগে নম্বরটা তিনি চেক করে নিলেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান তাঁর সাথে দেখা করতে সম্মতি দিলেন দুপুর বারোটায়।
একটা জীর্ণ ব্রিফকেস হাতে ইগনেশিয়াস ব্যাংকে হাজির হলেন সাক্ষাতের সময়ের কয়েক মিনিট আগে। মর্মর পাথরে মোড়ানো হলরুমে তাঁর জন্যে অপেক্ষমান যুবকের গায়ে ধূসর রঙা ্নার্ট স্যুট, শাদা শার্ট, ধূসর সিল্কের টাই। যুবক মনে মনে ভাবল, নাইজেরিয়ার কোনো নাগরিকের এমন সময়ানুবর্তিতা একেবারে বেমানান। মন্ত্রীর সামনে মাথা নিচু করে স্বাগত জানাল সে, নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিল চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে।
চেয়ারম্যানের রুম পর্যন্ত সে ইগনেশিয়াসের সঙ্গে থাকবে, এটাও জানাল। যুবক এক্সিকিউটিভ মন্ত্রীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অপেক্ষমান একটি লিফটে। এগারো তলায় পৌঁছানো পর্যন্ত তাঁদের দুজনের মধ্যে একটা শব্দও বিনিময় হলো না। চেয়ারম্যানের রুমের দরজায় লেখাঃ ‘প্রবেশ’। যুবক ভেতরে প্রবেশ করল।
‘নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী, স্যার।’
নিজের ডেস্কের ওপাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ারম্যান। অতিথিকে সম্ভাষণ জানাতে এগিয়ে এলেন কয়েক পা।
ইগনেশিয়াস লক্ষ না করে পারলেন না যে, ইনিও ধূসর স্যুট, শাদা শার্ট আর ধূসর সিল্ক টাই পরেছেন।
‘গুড মর্নিং, মিনিস্টার,’ চেয়ারম্যান বললেন। ‘বসবেন না?’ ইগনেশিয়াসকে তিনি নিয়ে এলেন কক্ষের এক কোনায়, সেখানে একটা কাচের টেবিলকে ঘিরে কয়েকটি আরামদায়ক চেয়ার। ‘আমি দুজনের জন্যেই কফির অর্ডার দিয়েছি, যদি অবশ্য সেটা আপনার অপছন্দ না হয়।’
ইগনেশিয়াস মাথা নাড়েন, জরাজীর্ণ ব্রিফকেসটা চেয়ারের পাশে মেঝেতে রাখেন, তারপর সুপরিসর কাচের জানালাপথে দূরে তাকান। এখান থেকে অপরূপ ঝর্নাটা চমৎকারভাবে চোখে পড়ে। সেই প্রসঙ্গে কিছু খেজুরে আলাপ পাড়েন তিনি। এর মধ্যে একটা মেয়ে তিন জনকেই কফি দিয়ে যায়।
মেয়েটা ঘর ছেড়ে বেরুনোমাত্র ইগনেশিয়াস কাজের কথায় আসেন।
‘আমার রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে আপনার ব্যাংকে আসতে বলেছেন একটা অন্য রকম অনুরোধ নিয়ে,’ তিনি শুরু করেন। চেয়ারম্যান বা তাঁর যুবক সহকারীর মুখে বি্নয়ের লেশমাত্র ছাপ পড়ে না। ‘আপনার ব্যাংকে নাইজেরিয়ার কোন কোন নাগরিকের অ্যাকাউন্ট আছে, সেই তথ্য উদঘাটনের দায়িত্ব তিনি আমার ওপর ন্যস্ত করেছেন।’ এ কথা শোনার পর শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের ঠোঁট নড়ল। ‘সেটা প্রকাশ করার স্বাধীনতা আমার···’ ‘আমার বক্তব্যটা আমাকে বুঝিয়ে বলতে দিন,’ হাত তুলে মন্ত্রী বলেন। ‘প্রথমত, আমি আপনাকে এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, আমার সরকারের চূড়ান্ত অথরিটি নিয়েই আমি এখানে এসেছি।’ দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে তিনি ভেতরের পকেট থেকে একটা খাম বের করেন। সেটা তিনি চেয়ারম্যানের হাতে দেন। চেয়ারম্যান চিঠি বের করে ধীর গতিতে সেটা পড়েন।
পড়া শেষ করে গলা খাকারি দেন ব্যাংকার। ‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, স্যার, এই ডকুমেন্টের কোনো কার্যকারিতা আমার দেশে নেই।’ চিঠিটা আবার খামে ভরে তিনি সেটা ইগনেশিয়াসকে ফেরত দেন। তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আপনি যে আপনার রাষ্ট্রপ্রধানের পূর্ণ অনুমোদন নিয়ে এসেছেন, এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে গোপনীয়তার যে নীতি ব্যাংক মেনে চলে, তাতে কোনো পরিবর্তনই ঘটবে না। কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা আমাদের অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের নাম প্রকাশ করব না, যদি না তাঁরা অনুমতি দেন। আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারছি না বলে দুঃখিত। তবে বুঝতেই পারছেন, এগুলো ব্যাংকের নিয়ম-কানুন, এবং সব সময় এগুলো এ রকমই থাকবে।’ চেয়ারম্যান চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ান। মিটিং শেষ হয়ে গেছে বলেই ধরে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঝাড়ু ইগনেশিয়াসের সাথে তাঁর তখনো কিছু দরকষাকষি বাকি।
ইগনেশিয়াস এবার তাঁর গলা কিছুটা নরম করে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের দেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে যত আর্থিক লেনদেন ঘটবে, আপনার ব্যাংককে তাঁর সবগুলোর ইন্টারমিডিয়ারি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার কতৃêত্ব আমার রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে দিয়েছেন।’
‘আমাদের ওপর আপনার এই আস্থায় আমরা সত্যি মুগ্ধ, মিনিস্টার,’ দাঁড়িয়ে থেকেই জবাব দিলেন চেয়ারম্যান। ‘তবে আমি নিশ্চিত, এটা বুঝতে আপনার কষ্ট হবে না যে, এর ফলে আমাদের কাস্টমারদের গোপনীয়তা রক্ষার
নীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।’
ইগনেশিয়াস অনড় বসেই আছেন।
‘সে ক্ষেত্রে আমি দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি, মিস্টার গারবার, যে, জেনেভায় আমাদের রাষ্ট্রদূতকে আমরা নির্দেশ দেব, তিনি যাতে সুইস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা অফিশিয়াল চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে আমাদের নিজ দেশের নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার অনুরোধে আপনার ব্যাংক কী ধরনের অসহযোগিতা করেছে, সেটার উল্লেখ থাকবে।’ কথাগুলো থিতু হতে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন ইগনেশিয়াস। ‘এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি আপনারা সহজেই এড়াতে পারেন। আমাকে শুধু বলে দিন গারবার অ্যাট সিয়ে ব্যাংকে আমার দেশের কার কার অ্যাকাউন্ট আছে আর সেসব অ্যাকাউন্টে কত টাকা জমা আছে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এসব তথ্যের উৎস আমরা প্রকাশ করব না।’
‘সে রকম চিঠি ছাড়লে আপনারা ছাড়তে পারেন, স্যার। আমি নিশ্চিত জানি, আমাদের মন্ত্রী অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ কূটনৈতিক ভাষায় আপনার রাষ্ট্রদূতকে বুঝিয়ে বলবেন যে, সুইজারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী এ ধরনের তথ্য চাওয়ার অধিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেই।’
‘যদি তাই হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমি আমার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেব, আপনারা এসব নাম প্রকাশ না করা পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় যেকোনো সুইস নাগরিকের সাথে সকল ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করে দিতে।’‘সেটা আপনার মর্জি, মিনিস্টার,’ অনড়ভাবে বললেন চেয়ারম্যান।
‘আর এ মুহূর্তে নাইজেরিয়ায় আপনাদের দেশের যেকোনো নাগরিকের সাথে যেসব ব্যবসায়িক চুক্তি আছে, সেগুলো নতুন করে বিবেচনা করতে হতে পারে আমাদের। সেই সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখব যে, এ জন্যে কোনো জরিমানার শর্ত থেকে থাকলে, সেটাও যাতে তাদেরকে দেওয়া না হয়।’
‘আপনার কি মনে হচ্ছে না, এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?’
‘আপনাকে এটা নিশ্চিত করছি, মিস্টার গারবার, যে, এ সিদ্ধান্ত নিতে আমি আমার রাতের ঘুম থেকে একটি মুহূর্তও বিসর্জন দেব না,’ ইগনেশিয়াস বলেন। ‘এসব নাম উদ্ধার করতে গিয়ে আপনার দেশকে যদি নতজানু করতে বাধ্য হতে হয়, তবু আমি পিছপা হব না।’
‘তবে তাই হোক, মিনিস্টার,’ চেয়ারম্যান বলেন। ‘তবু গোপনীয়তার প্রশ্নে এই ব্যাংকের পলিসি বা কর্মপদ্ধতির কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।’
‘তাই যদি হয়, আজ এক্ষুনি আমি আমার রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দেব জেনেভায় আমাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার। সেই সাথে লেগোসে আপনাদের রাষ্ট্রদূতকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হবে।’
এই প্রথমবারের মতো চোখ তুললেন চেয়ারম্যান।
ইগনেশিয়াস বলে চললেন, ‘এখানেই শেষ নয়, লন্ডনে আমি একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকব, তাতে এই ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমার রাষ্ট্রপ্রধানের অসন্তোষ জানতে পারবে বিশ্বের সব পত্রপত্রিকা। এ রকম প্রচারণার পর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা আবিষ্কার করবেন, আপনাদের অনেক কাস্টমার অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিতে শুরু করেছেন। আর এত দিন ধরে যারা আপনাদের ব্যাংককে নিরাপদ স্বর্গ মনে করতেন, তারাও অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজছেন।’
এটুকু বলে মন্ত্রী অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু চেয়ারম্যান কোনো জবাব দেন না।
‘তাহলে আপনি আমার জন্যে আর কোনো পথ খোলা রাখলেন না,’ ইগনেশিয়াস আসন ছেড়ে উঠতে উঠতে বলেন।
চেয়ারম্যান তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন, তাঁর মনে হয়, যাক, এতক্ষণে মন্ত্রী মহোদয় বিদায় হচ্ছেন। কিন্তু আতঙ্কে কেঁপে উঠে তিনি দেখেন, ইগনেশিয়াস তাঁর জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে একটা ছোট পিস্তল বের করে এনেছেন। বরফের মতো জমে গেলেন দুই সুইস ব্যাংকার। নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী এগিয়ে এসে চেয়ারম্যানের কপালে চেপে ধরেন পিস্তলের নল।
‘ওই নামগুলো আমার দরকার, মিস্টার গারবার আর এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কোনো কিছুই আমাকে দমাতে পারবে না। নামগুলো আমাকে এখনই জানিয়ে না দিলে আমি আপনার ঘিলু উড়িয়ে দেব। বুঝতে পারছেন আমার কথা?’
চেয়ারম্যান মাথাটা সামান্য নাড়েন, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। ‘আর উনি হবেন দ্বিতীয় শিকার,’ যুবক অ্যাসিসটেন্টের দিকে ইশারা করে বলেন ইগনেশিয়াস। কয়েক পা দূরে বাকরুদ্ধ স্থাণু দাঁড়িয়ে আছে অ্যাসিসটেন্ট।
‘আপনার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা প্রত্যেক নাইজেরীয় নাগরিকের নাম আমাকে এনে দিন,’ যুবকের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলেন ইননেশিয়াস। ‘না হলে আপনার চেয়ারম্যানের ঘিলু আমি ছড়িয়েছিটিয়ে দেব এই নরম কার্পেটে। জলদি করুন, কথা কানে যায়?’
যুবক চেয়ারম্যানের দিকে তাকায়। চেয়ারম্যান এখন কিছুটা কাঁপছেন, তবে খুব স্পষ্ট গলায় তিনি বলেন, ‘নন, পিয়েরে, জামাইস।’ (কোরো না পিটার)।
‘ডি আকর্ড,’ (ঠিক আছে) ফিসফিস করে বলে অ্যাসিসটেন্ট।
‘আপনারা বলতে পারবেন না যে, আমি আপনাদের কোনো সুযোগ দেইনি,’ ইগনেশিয়াস পিস্তলের ঘোড়া টানেন।
চেয়ারম্যানের মুখ বেয়ে এবার দরদর করে ঘাম ঝরছে। যুবক অ্যাসিসটেন্ট চোখ বন্ধ করে। পিস্তলের আওয়াজ শোনার জন্যে আতঙ্কের প্রহর গুনতে থাকে সে।
‘দুর্দান্ত!’ চেয়ারম্যানের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে বসতে বলেন ইগনেশিয়াস। এখনো কাঁপছেন দুই ব্যাংকার। কথা ফুটছে না তাঁদের মুখে।
চেয়ারের পাশ থেকে জীর্ণ ব্রিফকেসটা তুলে নেন মন্ত্রী। সামনের কাচের টেবিলের ওপর সেটা রাখেন। ক্ল্যাপগুলোয় চাপ দিতেই ডালা খুলে যায়।
দুই ব্যাংকার নিচু হয়ে তাকান। ব্রিফকেসে এক শ ডলারের নোট থরে থরে সাজানো। প্রতিটি ইঞ্চিতে ডলার ঠেসে ভরা। চেয়ারম্যান দ্রুত হিসাব কষে ফেলেন, পাঁচ মিলিয়ন ডলারের কম হবে না।
‘আমি ভাবছি, স্যার,’ ইগনেশিয়াস বলেন। ‘আপনাদের ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুললে কেমন হয়।’
————————————-
জেফরি আর্চার (জ্ন ১৯৪০) জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখক। পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তাঁর একাধিক বই ব্রিটেন ও আমেরিকায় বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ওপরের গল্পটি তাঁর এ টুইস্ট ইন দ্য টেল গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
Leave a Reply