কমরেড
চেয়ারম্যান কাসেম
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশের পূর্ব দিকের পাহাড়ি অঞ্চলে অভিলাষপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের বৈশিষ্ট্য, এখানকার স্থানীয় শাসনে কমিউনিস্টরা আছে কয়েক দশক ধরে। এর কারণ বলা মুশকিল। এখানে কমিউনিস্টরা শ্রেণীসংগ্রাম নিয়ে তত ব্যস্ত নয়, মস্কো-বেইজিং নিয়ে তেমন বাহাসও হয় না। তারা কিন্তু ইউনিয়নটিকে মোটামুটি একটা শান্তির লোকালয় হিসেবে গড়ে তুলেছে। সেই অভিলাষপুর ইউনিয়নের ফুলতলী গ্রামে আমার জন্ম।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা অনূপ সরকারের চিঠি পেয়ে গ্রামে গেলাম।
অনূপ আমার বয়সী, হালকা-পাতলা গড়নের যুবক। যুদ্ধের সময় সে দারুণ রেকি করতে পারত। এমন সব তথ্য ও নিয়ে আসত, যা সহজে পাওয়া ছিল মুশকিল। ওর গোবেচারা ও মিনেমিনে চেহারার জন্য শত্রুপক্ষ ভাবতেও পারত না কত কী সে দেখে নিয়েছে, কত তথ্য জেনে নিয়েছে।
অনূপ গ্রামেই ছিল। ওর জ্যাঠা ভারতে মারা যাওয়ার পর স্থানীয় তহসিলদার অবিভক্ত হিন্দু সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নানা রকম তেরিমেরি করছে।
আমি যুদ্ধের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করি। গবেষণার জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে পিএইচডি করে দেশে ফিরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি। অনূপকে সাহায্য করার জন্য ওর কাছ থেকে ওদের সম্পত্তির ব্যাপারে মোটামুটি জেনে-শুনে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে দেখা করি। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে জানান দিলাম আমি একজন পিএইচডিধারী অধ্যাপক এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু কোনো জল গলল না। ভবী ভোলানো বড়ই কঠিন। উনি পরিষ্কার বলে দিলেন, ‘এসব জটিল আইনি ব্যাপার। জট খুলতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।’
আমি নিরুৎসাহ হয়ে আমার কর্মস্থলে ফিরে এলাম। অনূপকে বললাম, ‘ইউএনও ব্যাটা তো কোনো সাহায্য করতে চায় না। কাসেম থাকলে সাহায্য করতে পারত। সে তো আবার কোরিয়া গেছে শ্রমিকদের কী একটা ব্যাপার নিয়ে। শুনলাম মাসখানেক পরে আসবে। এলেই আমাকে খবর দিবি।’
মাসখানেকের মধ্যে কাসেম ফেরেনি। ইতিমধ্যে একটা বছর পেরিয়ে গেছে। আমার অসুস্থ ফুফুকে দেখার জন্য আবার ফুলতলী গেলাম। ফুফু বিধবা, ছেলেমেয়েও নেই। আব্বা-আম্মা যত দিন ছিলেন ঈদের কদিন দেশেই কাটাতাম। এখন ফুফুই আমার বাপের ভিটায় চেরাগ জ্বালিয়ে চলেছেন।
ট্রেন, বাস, নৌকা ও পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় ফুলতলী পৌঁছালাম। পরদিন সকালে কাসেম এসে হাজির। কার কাছে যেন শুনেছে আমি গ্রামে এসেছি।
কাসেমের সঙ্গে একই ট্রেঞ্চে যুদ্ধ করেছি। গ্রেনেড ছোড়ায় দারুণ কারদানি ছিল ওর। একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্য! ওর ছোড়া একটা গ্রেনেডও অজায়গায় পড়েনি।
কাসেম আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘তুই আমার খোঁজ করেছিলি। এই এসে গেছি। কাল তুই আমার অফিসে আসবি। জানিস তো, আমি এখন অভিলাষপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আমি কেমন চেয়ারম্যানগিরি করছি তুই দেখবি না!’
আমি মিটিমিটি হাসছি।
একটু থামল কাসেম। তারপর আবার শুরু করল, ‘নিয়োগীদার বয়স হয়েছিল। উনি জোর করে আমাকে ইলেকশানে দাঁড় করিয়ে ও পাস করিয়ে অবসর নিয়েছেন। আমি চেয়ারম্যান হলাম, দু মাস পরে তিনি চলে গেলেন। নিয়োগীদার কাছে আমাদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। এ রকম মানুষ এখন পাওয়া যাবে? কারও সঙ্গে তাঁর শত্রুতা ছিল না। কাজকর্মে তাঁকে যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হতো তারাও সমীহ করত।’
অনেক কথা। কথা কি আর শেষ হয়?
এককালে নিয়োগীদার ডানহাত কমরেড কাসেম এখন অভিলাষপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তার নিমন্ত্রণ অবশ্যই রাখতে হবে। অফিসে তাকে দেখতে যেতে হবে।
ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে দেখি নানা ধরনের লোক বিভিন্ন জায়গায় জটলা করছে। কর্মচারীরা আমাকে চিনত। আমাকে ওরা সোজা কাসেমের ঘরে নিয়ে গেল।
ঘরটা বেশ সুন্দর করে গোছানো। দেয়ালে সরকারি ক্যালেন্ডার আর বেশ কিছু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ছবি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রিন্ট টাঙানো। কাসেমের চেয়ারটা একটু উঁচু। চেয়ারম্যানের চেয়ার। চেয়ারে একটা সুদৃশ্য তোয়ালে শোভা পাচ্ছে। কাসেম কবে যে দাড়ি রেখেছিল! তাকে ওই চেয়ারে বসে থাকতে দেখে মনে হলো বাদশাহ শাহজাহান ময়ূর সিংহাসনে বসে আছেন।
ঘরে ঢুকতেই ও সোজা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। মনে হলো, তার চেয়ারম্যান হওয়াটা ঠিকই হয়েছে। আমাকে তার অফিস দেখিয়ে তাকে বড় তৃপ্ত মনে হলো।
এরমধ্যে বেশ বয়স্ক এক লোক ঘরে ঢুকে সোজা একটা চেয়ার দখল করে পা তুলে বসল। বসেই গলা খাকারি দিল, ‘কাসেম, আমার কাজটার কী হলো?’
সমীহ করে উঠে দাঁড়াল কাসেম, বলল, ‘চাচা এক কাপ রং চা খান। আমি দেখছি কী হয়েছে।’
বেল টিপে বেয়ারা ডাকল। চাচার ফাইলটা আনতে বলল তাকে। ফাইল দেখে তারপর চাচাকে বলল কাসেম, ‘আর দুই দিন সবুর করেন চাচা। আপনার কাজের সামান্য একটু বাকি আছে।’
‘আমি আর তোমার চা খাব না। বাড়িতে কারা যেন আমার জন্য বসে আছে।’ চাচা বিদায় হলেন।
আমার কৌতূহল হলো। বললাম, ‘ইনি কে, খুব মানিস মনে হয়?’
‘তরফদার চাচাকে মনে হয় ভুলেই গেছিস।’ একটু অবাক হলো কাসেম। ‘যুদ্ধের সময় আমাদের বড় সহায় ছিলেন। এখনো লোকে মানে। বিপদ-আপদে তাঁর কাছে যায়। ছোটখাটো বিরোধ তিনি মিটিয়ে দেন। তিনি তাঁর মতো সালিস করেন। লোকে তাঁর সালিসে খুশি। খুশি হয়ে কেউ কিছু সালিসি দেয়, কেউ দেয় না। বাধ্যবাধকতা নেই। তারচেয়ে বড় কথা, চাচা ছাক্কা পাঁচশ ভোট কন্ট্রোল করেন। তাঁকে না মেনে পারি?’
আমি বললাম, ‘তুই যে এইসব ঝামেলা করছিস, মনে হচ্ছে এসব নিয়ে মজাতেই আছিস। দুর্নীতি-টুর্নীতির ফ্যারে পড়লে তো তোকে অযথা দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’
কাসেম বলল, ‘আমার গায়ে তোদের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক কোনো দাঁত ফুটাতে পারবে না। পারলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে নিয়ে আসুক। আমার চাঁদা যারা তোলে, তারাই হিসাব রাখে। ওরা জানে গরমিল হলে একেবারে গিলোটিন, গলায় গামছা পড়লে উপরি লাভটাভ উগড়ে দিতে হবে। তবে আমার মেলা কষ্ট, জনপ্রতিনিধি হিসেবে কষ্ট সহ্য করতে হয়।’
‘কষ্ট আবার কিসের?’ আমি বললাম।
‘জানাজা, সৎকার ছাড়াও নানা দাওয়াত-নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হয়। সয়েম, চল্লিশা, শ্রাদ্ধ, বিয়ে, আকিকায় যেতে হয়। খালি হাতে যাই না। খরচ আছে। তবে স্থানীয় সরকারের বড় কর্তাদের আমি ঘুষ দিই না। ওরা আমাকে জানে লাল চেয়ারম্যান হিসেবে। একটু এড়িয়ে চলে। চেয়ারম্যান কাসেমকে দশ তল্লাটে সবাই চেনে। লোকে জানে এই চেয়ারম্যান সংসদে যাবে না, এই ইউনিয়নেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে।’
আমি বললাম, ‘জনপ্রতিনিধিদের হিসাবদিহির ক্ষেত্রে কিছু গরমিল থাকলে লাখ পাঁচেক টাকার মতো তাদের রেয়াত দেওয়ার বিধান থাকা উচিত।’
কাসেম আমার পিঠে এক থাবড়ি মারে, ‘আমাদের জন্য তোর মতো আইন প্রণেতা থাকা উচিত।’
আমাদের কমরেড চেয়ারম্যান কাসেম চেয়ারম্যান মাওয়ের চেয়ে কিছু কম যায় না। আমি বললাম, ‘তুই আমাদের ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মাও। কমরেড চেয়ারম্যান কাসেম, লাল সালাম!’
কাসেমও আমাকে লাল সালাম জানাল এবং জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। বহুদিন আমার এত ভালো লাগেনি। আমি একসঙ্গে হাসলাম ও কাঁদলাম।
বেরিয়ে দেখলাম এর মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশে রামধনু উঠেছে
১৬ জানুয়ারি, ২০০৮
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply