কর্মশালা ও প্রদর্শনী
ধারণার দৃশ্যরূপ
শাহীনুর রহমান
একটি আন্তর্জাতিক আর্টিস্টস ওয়ার্কশপ হয়ে গেল বগুড়ার নুনগোলায়। শুরু হয়েছিল ৬ জানুয়ারি। ১৮ জানুয়ারি ছিল প্রদর্শনী। প্রথাবদ্ধ সৌন্দর্যচিন্তা কিংবা উপকরণকে অগ্রাহ্য করে কনসেপ্ট বা আইডিয়াকে অবলম্বন করা হয়েছে বেশির ভাগ কাজে। অংশ নেন বাংলাদেশের শিল্পী অশোক কর্মকার, মোস্তফা শরীফ আনোয়ার, রনি আহম্মেদ, মনজুর আহমেদ, লাকী বড়ুয়া, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, মাহমুদুর রহমান ও তেজস হালদার যশ। ১০ জন শিল্পী এসেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে-সিমন টিপিং (যুক্তরাজ্য), সুশান্ত মণ্ডল (ভারত), আতিক খান (পাকিস্তান), নিশান্ত হেট্রিয়ারাচ্চি (শ্রীলঙ্কা), সুজন চিত্রকর (নেপাল), মারিয়াম ওমর (মালদ্বীপ), ইয়া-চু ক্যাং (তাইওয়ান), কৃষ্ণ লুচুমুন (মরিশাস) ও জুমান আল নিমরি (জর্ডান)।
চিন্তা বা আইডিয়া উপস্থাপনের জন্য স্থানীয় উপাদানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি মাধ্যম হিসেবে ছিল পারফরমেন্স, ফটোগ্রাফি, ভিডিও চিত্র, ইভেন্টস বডিজ, রেডিমেড-সর্বোপরি ঘাসপাতা থেকে ল্যাপটপ পর্যন্ত। চিন্তা থেকে শিল্প-এই ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে বেশির ভাগ শিল্পকর্মে। আয়োজনটা ছিল বিশাল জায়গাজুড়ে। সেই বিশালতায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা গেছে চিন্তার ঘোর ও উত্তেজনা। ঘষামাজা, নতুন ধারণা, বাতিলকরণ, নতুন চিন্তার সংমিশ্রণ, অন্য লব্ধি ইত্যাদির পাশাপাশি চলেছে মাথায় শিল্পের দৃশ্যরূপ সৃষ্টি, গঠন, ভাঙচুর, পুনর্গঠন। তারপর চিন্তা ও দৃশ্যগত ছকের বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে উপাদান সংগ্রহ প্রক্রিয়ার বদল ঘটেছে কিংবা বদলেছে স্থাপনার পরেও-এভাবেই বেশির ভাগ শিল্পের রূপকল্পের সমাধান খোঁজা হয়েছে।
দৃশ্যশিল্পের দৃশ্য-ইমেজই বড় কথা, কিন্তু যেহেতু কনসেপচুয়াল শিল্পকর্ম এগুলো, তাই বিষয় আবিষ্কারের কিংবা শিল্পকর্মটি যেভাবে দর্শককে ধাবিত করে বিষয় ভাবনায়, তা ছিল সত্যনিষ্ঠ।
নিবিড় সবুজ চিরে একদা সিলভার সোসাইটি হবে, পুকুরে পাইলিং হবে-ধাতব দালান দাঁড়াবে তাতে। হবে মাছের চেয়ে হাজার গুণ দামি স্কয়ার ফিট বাণিজ্য। মাহমুদুর রহমানের ‘ট্রান্সফরমেশন’-এ বগুড়ার এই বাগানে পানিহীন পুকুর ফুঁড়ে উঠে আসা সিলভার পাইপলাইন কি কৃষককে দাঁড় করিয়েছে বিশ্বায়নজাত রোবোটিক নগরে কিংবা তাকে পরিণত করেছে নাগরিক উপাত্তে? বিশাল পুকুরজুড়ে অশোক কর্মকারের ‘সিডর ফর সরো সিডর ফর জয়’ একটি দৃশ্যকাব্য যেন। মাঝের বড় ফর্ম ও চারপাশের ছোট ফর্মগুলো সাদা ও পানিতে পড়া প্রতিবিম্ব মিলে বেশ নাটুকে প্রতিবেশ। আশাবাদী মনোভঙ্গির প্রকাশ খুব বেশি তাঁর কাজে। তাঁর আরেকটি শিল্পকর্ম ‘টর্চার’ উল্লম্ব, সর্বদা আনুভূমিকে শাসন ও শোষণ করে, রক্তাক্ত করে। মরিশাসের শিল্পী কৃষ্ণ লুচুমুনের ‘থিঙ্ক পিঙ্ক’ শিল্পকর্মটি পুকুর পাড়ের নারকেল গাছে ঝোলানো বিশেষ একটি ফর্ম, তাতে নানা ভাষার ওলট-পালট বর্ণমালা; পুকুরের পানিতে এসবের যে প্রতিবিম্ব পড়ে সেগুলো পাঠযোগ্য বিবিধ ভাষাগোষ্ঠীর হর্ষসূচক শব্দ হয়ে ওঠে। অসাধারণ একটি স্থাপনা এটি।
শিল্পের এক দারুণ রগড় রনি আহম্মেদের ‘ওপেনিং সেরিমনি অব মাদার আর্থ অর অ্যা করপোরেট টাই’। অসম, অন্যায্য বিশ্বায়ন ক্রমেই গিলে চলেছে আমাদের জীবন-জীবিকা, প্রেম-ভালোবাসা-এমনকি ফসলের বীজ পর্যন্ত। করপোরেটের হাত ধরে বিশ্বায়ন বিপন্ন করছে উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্থানীয় পণ্য, শ্রম ও সংস্কৃতি। এলোমেলো সিটযুক্ত নীল ও সবুজ দুই খণ্ড কাপড় দড়িতে বাঁধা, যা দেখতে যুগপৎ উদ্বোধনের ফিতা ও টাইয়ের নির্দেশক। মুখোশ আঁটা একজন নারী উদ্বোধনী দড়ি কাটছে এমন ফভবাদী ড্রইং আঁটা আছে টাইয়ের মাঝখানে। কমিক ও হিউমার সহযোগে নান্দনিক আনন্দের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প অন্বেষায় তাঁর ঝোঁক দেখি ‘বিফোর ইউজিং···’ শীর্ষক শিল্পকর্মে।
ইয়াসমিন জাহান নূপুুরের ‘পেইন অব মাই মাদার’-এ আছে রেড কটন বুনটের দেহদরজা। দেহ কিংবা জননকোষের বুনন, যা আপাতত উল্লম্ব ও মাতৃকা মূর্তিবিশেষ। দেখা যাচ্ছে মায়ের রক্তক্ষরণ। ফ্লোরে রক্ত, ঝুলে থাকা স্যালাইন পাইপ, যা নারীকে নির্দেশ করে। দুটি সাদা পর্দা দড়িতে ঝোলানো-এসব ইমেজ নারীর গঠন-বন্দিত্ব, একটি হাসপাতালে জ্ন-প্রক্রিয়ার ইমেজ নারী, মা ও যন্ত্রণা-তিনকে সমার্থক করে তোলে।
মনজুর আহমেদের ‘ডিসকারেকশন অব মাইন্ড টু অবজেক্টস’-এ প্রাকৃতিক দর্শনের সঙ্গে মানবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান। মানব দেহকাণ্ডের কোমল ধানচারা-স্বভাব আর তার বাইরের খোলস কিংবা মুখোশ ইন্দ্রিয়ের তালে তালে উড্ডীয়মান ইমেজ ভাবনা উদ্রেগকারী।
তাইওয়ানের শিল্পী ইয়া-চু ক্যাং-এর ‘ক্যারিং পোল’ একটি গণিতমুখী কাজ। বেশি ও ভার একসঙ্গে চলে, আর শক্ত অথচ একক সর্বদাই হালকা। একটি গিমিক কাজ সিমন টিপিং-এর ‘দ্য ওয়াশিং লিনো’। বাগানের শেষ মাথার লাল ও সাদা পর্দা দর্শককে ডাকছে। দর্শক সেখানে গিয়ে দেখবে-‘ওয়াশিং লাইন, এটি একটি শিল্পকর্ম নয়। আমি শুধু আপনাকে এই প্রকৃতির মাঝে ততটা পথ পেরিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। প্রকৃতি হচ্ছে সত্যিকারের শিল্পী।’ মনে রাখার মতো কাজ সুশান্ত মণ্ডলের ‘অ্যাডিং ফায়ার টু ওয়াটার’, সুজন চিত্রকরের ‘জয় রিড টু দ্য প্যারাডক্স অব ক্রাফট ভিলেজ’ উল্লেখযোগ্য।
সামগ্রিকভাবে সব শিল্পকর্মের অভীষ্ট কনসেপচুয়াল হলেও করণকৌশলের ক্ষেত্রে কিছু অভাব বোধ করেছি। কিছু বিষয়-ভাবনাও গতানুগতিক। ওয়ার্কশপটি হয়েছে বগুড়ায়; শিল্পকর্মের অঙ্গগঠনে স্থানীয় উপকরণ প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে দর্শক হিসেবে মহাস্থানগড়, পরশুরাম, শাহ সুলতান সাহী সওয়ার কিংবা গোকুল মেদ; চাঁদ সওদাগর, লখিন্দর বেহুলা ভাসান ইত্যাদি স্থানিক আখ্যান, উপাখ্যান-এগুলোর ব্যবহার অর্থাৎ ন্যূনতম হলেও মিথজাত শিল্পকর্মের প্রত্যাশা জেগেছিল। তবু এত বেশিসংখ্যক চিন্তা ও ধারণাগত শিল্পকর্ম পরপর দেখার বি্নয় ও ভাবালুতায় আচ্ছন্ন থেকেছি বেশ কিছুটা সময়।
হয়তো সব শিল্পকর্মের সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায়নি। কিংবা অন্য রকম বোঝাপড়া হয়েছে তাতে। কনসেপ্টকে কমিউনিকেট করা বা না করা শেষ কথা কি? বরং বহুমাত্রিক মাধ্যম বিবেচনায় এনে, এমনকি কামার ও কামারশালা তুলে এনে শিল্পকর্মে শ্রম-ঘামের নুন আস্বাদন করানোর বিবেচনা তো অসাধারণ! বিবিধ চিন্তা বা আইডিয়া পরিস্কুটনের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ও প্রায়োগিক স্বাধীনতা শেষে যে ইমেজ দর্শক পেল তা নির্বস্তুক সুরের ইমোশন ধারণের মতো।
আয়োজক ‘বৃত্ত’কে ধন্যবাদ বহুজাতিক এই কর্মশালার জন্য।
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply