আবুল মনসুর
আমাদের দেশে ভাস্কর্যকলার চর্চা ব্যাপক না হলেও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এটি এক ধরনের অবস্থান বজায় রেখে চলেছে। প্রতিকূলতা বলতে ভাস্কর্যচর্চার জন্য উপকরণের দুর্লভ্যতা, বড় অঙ্কের অর্থলগ্নির প্রয়োজনীয়তা, নির্মাণ ও সংরক্ষণের জন্য পরিসরের অভাব, ভাস্কর্যের প্রতি ক্রেতামহলের অনীহা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা চলে। ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা চিত্রের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য, অন্যদিকে এর বিক্রয়-সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এসব কারণে ভাস্কর্যের একক প্রদর্শনী এ দেশে আমরা কালেভদ্রেই দেখতে পাই। সম্প্রতি ঢাকায় বেঙ্গল গ্যালারির প্রদর্শকক্ষ ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের অঙ্গনজুড়ে অলক রায়ের ভাস্কর্যের বড়সড় প্রদর্শনীকে তাই আমাদের শিল্পকলার অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এর আগে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্কজুড়ে অলক রায় আয়োজন করেছিলেন তাঁর বৃহৎ ভাস্কর্যগুলোর প্রকৃতি-সন্নিহিত উ্নুক্ত প্রদর্শনী। বলা যেতে পারে, বর্তমান আয়োজনটি সেটিরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় উপস্থাপন।
বিংশ শতকের শেষ দুই দশক থেকে দৃশ্যশিল্পের জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তাতে বিশেষ করে ভাস্কর্যের জগৎটি বেশি করে নাড়া খেয়েছে; এবং বলা যেতে পারে, ভাস্কর্যশিল্পের খোলনলচেই পাল্টে গেছে। যাকে বলা হচ্ছে উত্তর-আধুনিক, তার প্রকরণে উপকরণের কোনো সীমা যেমন নেই, তেমনি নেই শুদ্ধতার বালাই; ভাস্কর্যের স্থায়িত্বের দায়ও আর নেই-রক্ত-চর্বির মতো পচনশীল বা কাগজ কিংবা তুলার মতো অস্থায়ী উপকরণ দিয়েও আজকাল ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে, উপকরণের মিশ্রণ ঘটছে দেদার। আলো, শব্দ বা গতিশীলতার প্রয়োগ তো আগেই ঘটেছে। এসব ঘনঘটার ভেতরে অলক রায় প্রায় তিন দশক ধরে মাটিকে উপজীব্য করে নির্মাণ করে চলেছেন ভাস্কর্য। ছোট থেকে ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে তাঁর ভাস্কর্য, বদলে চলেছে তার আঙ্গিক ও শিল্পভাষা। তাঁর ভাস্কর্য সমসাময়িক শিল্পচিন্তার আলোকে বদলাচ্ছে আদল, উপস্থাপনকৌশল। তবে মাটিকেই তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণের একমাত্র উপকরণ হিসেবে ব্যবহারে অবিচলিত রয়েছেন অলক। আজ যখন শিল্পীর নির্মাণ-উপকরণ হিসেবে মাটির বিশেষ কদর নেই, সে সময় অলক রায় শুধু মাটিকেই বিভিন্ন কৌশলে ব্যবহার করে নির্মাণ করছেন বর্তমান কালের শিল্পরূপ। এই দিক থেকে এ প্রদর্শনী একটি ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে-শুধু শিল্প-উপকরণ হিসেবে মাটির ঐতিহাসিকতা কিংবা ঐতিহ্যলগ্নতার প্রাসঙ্গিকতার দিক থেকে নয়, প্রাচীন ও একটি সহজলভ্য উপকরণকে সমসাময়িক শিল্পজগতের জটিল প্রকাশরীতির বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দিক থেকেও।
তবে উপকরণের বৈশিষ্ট্যময়তা ছাড়াও সম্ভবত এ প্রদর্শনীটি ভিন্নতর তাৎপর্যেও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমসাময়িক শিল্পচর্চায় প্রধান যে প্রবণতাটি চোখে পড়ে, সেটি হলো দৃষ্টিসুখের আয়োজন। শিল্পকে, সে চিত্র হোক বা ভাস্কর্য হোক, দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি আকর্ষণীয় গড়নরূপে নির্মাণই আমাদের অধিকাংশ শিল্পীর প্রধান বিবেচনা হিসেবে দেখতে পাই। শিল্পরূপটিকে বিশেষ বাণী বা চিন্তনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে গড়ে তোলার কথা তেমন ভাবা হয় না। ফলে শিল্পকর্মটি প্রায়শ দৃশ্যগতভাবে আবেদনময় হলেও অর্থময়তার দ্যোতনা অর্জন করে না; রচিত হয় না দৃষ্টি ও মননের ভারসাম্য। অলক রায় আশির দশকে পরপর তিনটি একক প্রদর্শনী করেছেন। সেগুলোতে তাঁর সচেতন মানসের প্রকাশ রয়েছে বটে, তবে বিশেষভাবে বর্ণনাত্মক আঙ্গিক থেকে আস্তে আস্তে বাহুল্য বর্জন ও ন্যূনতা অর্জনের পথে কয়েকটি ধাপ হিসেবেই এদের বিবেচনা করা শ্রেয়তর হবে। এর পর ২২ বছর নীরবতা। ২০০৭ সালে অলক আয়োজন করলেন তাঁর চতুর্থ একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী, ২০০৮-এ পঞ্চম। এ দুটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে অলক আবির্ভূত হয়েছেন অনেক পরিণত শিল্পী ও স্রষ্টারূপে। তাঁর হাতে ভাস্কর্যের অবয়ব একদিকে তার যথার্থ ন্যূনতার সন্ধানে অগ্রসরমাণ, অন্যদিকে প্রকৃতির প্রাণবীজ যে অপার রহস্য-জগৎ থেকে অবিরাম পল্লবিত হয়ে ওঠে, তাকে স্পর্শ করার অভিলাষী। প্রকৃতি ও প্রতিবেশের বিনাশ-আশঙ্কায় শিল্পীর উদ্বেগের কথা বলেন বটে অলক, কিন্তু সেটুকুর মধ্যেই তাঁর কাজ থেমে থাকে না।
অলক রায়ের সাম্প্রতিক ভাস্কর্যে আমরা একটি জীবন-দর্শনেরও অনুসন্ধান-প্রয়াস যেন লক্ষ করি। এখানে তাঁর ভাস্কর্যের অনুষঙ্গী হয়ে উঠেছে আকাশ, আলো, জল, বাতাস, শব্দ, বৃক্ষ ও বীজ-জীবনের অনিবার্য ও ন্যূনতম সব উপাদান। আকৃতির বিন্যাসের মধ্যেও সেই অনিবার্য ও ন্যূনতমর অনুসন্ধানই যেন তাঁকে তাড়িত করে। আবার অন্তর্লীন চোখ বা স্রষ্টার আঙ্গুলের মাধ্যমে তাতে যুক্ত হয় মানুষ ও প্রাণী। জীবন সম্পর্কে এক দার্শনিক নির্লিপ্তি ও সারল্যের গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রয়াস এসবের মধ্যে অনুভব করি। সৃষ্টিকে প্রদর্শগৃহের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে প্রকৃতির নিজস্ব অঙ্গনে তার মাঝখানে বিন্যস্ত করার মাধ্যমে সে সম্পর্ক সৃজনের প্রয়াস চলে। উ্নুক্ত পরিসরে স্থাপনারূপে বিন্যস্ত তাঁর নির্মাণগুলো কখনো কখনো কিছুটা আলংকারিক সজ্জার কাছাকাছি চলে গেলেও আবার কখনো কোনোটি ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় আমাদের পুলকিত করে। অলকের ভাস্কর্য-অবয়বের মাঝে জমে থাকা পানিতে যখন এসে ভাসে ঝরা পাতারা, বিশাল আকাশ প্রতিবিম্বিত হয় সেখানে; তখন প্রকৃতির সঙ্গে ভাস্কর্যগুলোর যেন এক মেলবন্ধন রচিত হয়-যেটি সম্ভবত শিল্পীরও আরাধ্য। আকৃতি, প্রাণ ও প্রকৃতির এই সম্মিলনের মধ্য দিয়ে এক বহমান সত্যের রূপ প্রতিভাত হয়ে ওঠে দর্শকের চোখে। আর এভাবেই অলক রায়ের এ ভাস্কর্য প্রদর্শনীটি বিশেষ অর্থবহ ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply