সাহিত্য সাময়িকীঃ মানুষ কেন অপেক্ষা করে-মানুষ আসলে কী খোঁজে-জীবনের এ রকম নানা দার্শনিক জিজ্ঞাসার কথা আছে আপনার গল্পে। আপনি নিজে কী খোঁজেন?
আহমাদ মোস্তফা কামালঃ এটি আমার জন্য খুবই কঠিন প্রশ্নরে ভাই। এ বইতে ‘আমাদের শহরে একজন অচেনা লোক’ শিরোনামের দুটি গল্প আছে। একজন অচেনা লোক এসে একটি শহরে একটি করে প্রশ্ন ছড়িয়ে দিয়ে যায়-‘কী খুঁজছেন’ আর ‘কার জন্য অপেক্ষা করছেন, কীসের জন্য?’ শহরবাসী প্রশ্নগুলো নিয়ে মাথা কুটে মরে। দুটো প্রশ্নেরই অনেক রকম উত্তর খোঁজা হয়েছে, কিন্তু সর্বজনসম্মত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। প্রশ্নগুলো তুলে আমি গল্পের চরিত্রদের বিপদে ফেলে দিয়েছিলাম। একই প্রশ্ন ফিরিয়ে দিয়ে আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন! কাজটা ভালো করলেন না! আমি এখন মাথা কুটে মরছি। বুঝতে পারছি না, এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায়!
মনে হচ্ছে-আমি কী খুঁজি, অথবা কার জন্য, কীসের জন্য অপেক্ষা করি, আমি আসলে তা জানি না। তবে এ মুহূর্তে, নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছে-আমি সম্ভবত একটি মনোহর জীবনের সুতো খুঁজি, অপেক্ষা করি ভালো সময়ের। আমার জন্য, অন্যদের জন্যও। চারপাশের মানুষ ভালো না থাকলে আমি ভালো থাকি কী করে। আমি খুব স্পর্শকাতর মানুষ, ছোটখাটো বিপর্যয়েও আমার ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ফুটপাতে ছিন্নমূল মানুষের সংসার, শিশুরা কাঁদছে আর কী করুণ দেহোপজীবীদের দাঁড়িয়ে থাকা। দেখি আর একটি স্বচ্ছন্দ জীবনের জন্য অপেক্ষা করি। প্রশ্নটির বোধ হয় চূড়ান্ত উত্তর এটি নয়, গল্পের এক চরিত্র যেমনটি বলেছে-সব অপেক্ষাই সাময়িক, একটি শেষ হলে আরেকটি শুরু হয়···
সাময়িকীঃ প্রেমের গল্প কম লেখেন। এ বইয়ে প্রেমের গল্প নেই। প্রেমের গল্প কি আপনি পছন্দ করেন না?
কামালঃ প্রেমের গল্প কম লিখি তা নয়। এ বইতে প্রেমের গল্প অন্তভুêক্ত করা হয়নি। আগের গল্পগ্রন্থগুলোতেও প্রেমের গল্প নেই বললেই চলে। শুরু থেকেই আমি প্রেমের গল্প লিখে আসছি। এ বইতে না দেওয়ার কারণ, শুধু প্রেমের গল্প নিয়ে একটি বই করার ইচ্ছে ছিল। গত ১৫ বছরে লেখা প্রেমের গল্পগুলো থেকে বাছাই করা নয়টি গল্প নিয়ে আমার একটি বই বেরোচ্ছে ভোর ও সন্ধ্যারা নামছে বেদনায় শিরোনামে, ঐতিহ্য থেকে। বইটিতে আমার নিয়মিত প্রেমের গল্প লেখার প্রমাণ মিলবে।
এ বইতে না দেওয়ার আর একটি কারণ আছে। আমাদের সাহিত্য সমাজে প্রবন্ধকে দ্বিতীয় সারির আর রম্যরচনাকে তৃতীয় সারির রচনা মনে করা, প্রেমের গল্প বা উপন্যাসকে ভাবা হয় হালকা ও অগভীর। কারো গায়ে একাবর সিল লেগে গেলে সেটা তোলা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। প্রেমের গল্পকে আমি অগভীর রচনা বলে মনে করি না। কিন্তু আমাদের চতুর সাহিত্য সমাজের সিল মারার প্রবণতাকে কিঞ্চিৎ ভয় পাই বলেই প্রেমের গল্পগুলোকে বইতে দিইনি।
সাময়িকীঃ তার মানে আর যে লেভেলই লাগুক, ‘প্রেমের গল্পলেখক’ লেভেলটা যাতে না লাগে?
কামালঃ আমি সব লেভেলেরই বিপক্ষে।
সাময়িকীঃ আপনার গল্পে একটা কথকতার ভঙ্গি আছে। যেন কাউকে সামনে বসিয়ে গল্প বলছেন আপনি। এই ভঙ্গিটার প্রতি পক্ষপাত কেন?
কামালঃ আমি মনে করি গদ্যচর্চার প্রথম শর্ত কমিউনিকেটিভ হওয়া, দ্বিতীয় শর্ত বিশ্বাসযোগ্য হওয়া। ইচ্ছেকৃতভাবে বর্ণনাকে ভারাক্রান্ত ও জড়তাপূর্ণ করার বিরোধী আমি। কমিউনিকেট করার জন্য কথকতা, আড্ডা, বৈঠকি ভঙ্গি-এসবকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আমার। পক্ষপাত হয়তো ওই কারণেই। এই ভঙ্গিটি থাকলে পাঠক গল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে মজার অভিজ্ঞতা হয়। যেমন, গল্পগুলোকে অধিকাংশ পাঠকই ভাবেন সত্যি ঘটনা! প্রথম পুরুষে লেখা গল্পগুলোকে পাঠক, এমনকি ঘনিষ্ঠজনেরাও আমার নিজের জীবনের ঘটনা বলে ভুল করেন! সম্ভবত ওই ভঙ্গিটি গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে, পাঠক একজন কথকের উপস্থিতি টের পান, এবং গল্পটিকে ‘সত্য’ বলে ভুল করেন। এই বিভ্রম মধুর। আমার এক গল্পের চরিত্র বলেছিলো-‘গল্প কখনো বাস্তব নয়। কল্পনার ওপর বাস্তবের প্রজেকশন মাত্র।’ এই কথা পড়ার পরও যে পাঠকরা ‘এটা গল্প, না সত্যি ঘটনা’-এই বিভ্রমে ভোগেন, ব্যাপারটিতে আনন্দ পাই। অবশ্য আমার সব গল্প কথকতার ভঙ্গিতে লেখা নয়। কমিউনিকেট করার জন্য যখন যে প্রকরণ ও ভঙ্গিকে বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেছি, সেটিই ব্যবহার করেছি।
সাময়িকীঃ গল্পের বিষয় হিসেবে একটা বড় জায়গা নিয়েছে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
কামালঃ আমরা, শিক্ষিত মানুষেরা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতিই করেছি। শুভ ও কল্যাণবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। নৈতিকতা, সততা প্রায় নির্বাসিত। সততা নিয়ে যারা বাঁচতে চায় তাদের প্রত্যাশা ও পদক্ষেপ পদে পদে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকে তাদের ব্যর্থতা ও ভুলের জন্য মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করাই এখন দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বাস্তবতা আরো ভয়াবহ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। কতদিনে এটা সামলে ওঠা যাবে বলা কঠিন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে একটানা ২৫/৩০ বছর সময় দিতে হয়, আমরা শুধু হোঁচট খেয়ে চলেছি। এখন আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে, কিন্তু সেটি সহজ হবে বলে মনে হয় না।
উৎকৃষ্ট সামরিকতন্ত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট গণতন্ত্র বহুগুণ ভালো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যত অনাচার-অবিচার-অন্যায় হোক না কেন, সেগুলো জানার একটা উপায় থাকে, খোলা থাকে প্রতিবাদের পথ। সবাই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন না, কিন্তু এই প্রতিবাদ রাস্তায় নামেন না এমন মানুষকেও সচেতন করে তোলে। সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি মূল্যবোধ তৈরি হতে থাকে তখন। সামরিকতন্ত্রে ঘটে উল্টোটি।
সাময়িকীঃ আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেন?
কামালঃ আছে। এতক্ষণ যে সমস্যার কথা বললাম সবই শিক্ষিত মানুষের সমস্যা। এত বিপর্যয়ের মধ্যেও আমি যখন দেখি, গ্রামের মানুষগুলো সমস্ত প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে তখন আশা জাগে। মনে হয়, দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যেখানে এরকম যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, যাদের দুর্নীতি করার কোনো সুযোগই নেই সেখানে একটি দেশকে দুর্নীতির চ্যাম্পিয়ন হিসেবে লেবেল এঁটে দেয়া গর্হিত অপরাধ, কারণ এতে করে এই সংগ্রামী মানুষগুলোকে অপমান করা হয়।
সাময়িকীঃ আপনার এ বইয়ের গল্পে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ আর এসবের নৃশংশতার কথা আছে। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
কামালঃ আমার দৃষ্টিভঙ্গি গল্পগুলোতেই প্রকাশিত হয়েছে বোধহয়। গত কয়েক বছরে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিপুল উত্থান দেখেছি। দেখেছি একই পরিবারের এগারোজন সদস্যকে ঘরে আটকিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, পুড়ে মারা গেছে তারা। তাদের অপরাধ-তারা হিন্দু, সংখ্যালঘু; শুনেছি ঘরের মধ্যে কিশোরী মেয়ে, দরজায় মায়ের মিনতি-বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট। জাতীয় ্নৃতিসৌধে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের তামাশা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর পাশ আল বদর বাহিনীর প্রধান। দেশজুড়ে বোমার শব্দ। হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হয়েছেন; পরে মারাই গেলেন। একের পর এক সাংবাদিক খুন হয়েছেন, সাংবাদিকের কাছে কাফনের কাপড় পাঠানো হয়েছে সত্য বলার অপরাধে, বিআরটিসি বাসে আগুন দিয়ে এগারোজন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে সেই পাকিস্তানি ভুতই ফিরে আসছে। এদিকে জিহাদ আর শ্রেণীসংগ্রাম সমার্থক বলে প্রচার করতে চাইছে কোনো কোনো ধুরন্ধর বুদ্ধিজীবী। এতকিছু দেখে কোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব? মৌলবাদ মানুষের মৌলিক প্রবণতা নয়, বরং স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার। জনগণের মধ্যে এগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। স্বভাবতই মানুষ মুক্ত হতে চায় আর মৌলবাদ চায় মানুষকে বন্দি করতে। রাষ্ট্রের সমর্থনে মৌলবাদের এই যে উত্থান, লেখক হিসেবে আমি কিভাবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারি? লিখে। আমার আর কিছু নেই। গল্পে আমি বিষয়গুলো আনতে চেয়েছি।
-রেজা হাসান
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply