প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৩ : সৃজনশীল শাখা
মুখের সামনে আয়না
মারুফুল ইসলাম
সর্বব্যাপী বিশ্বায়নের এই যুগে বিপুলা পৃথিবী যখন ছোট হয়ে আসতে আসতে পরিণত হয়েছে এক গ্লোবাল ভিলেজে, তখন আমাদের নিজেদের দিকে ফিরে তাকানোটা কখনো কখনো খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। নিজেদের দিকে-ব্যষ্টি-আমার থেকে সমষ্টি-আমাদের দিকে, আমাদের ভেতর ও বাইরের দিকে, অতীত ও বর্তমানের দিকে, সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার দিকে; এবং অবশ্যই ভবিষ্যতের দিকেও। এই দেশে, এই সমাজ-প্রতিবেশে, এই সময়ে কী আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান? কী আমাদের দার্শনিক অবস্থানের স্বরূপ? কী আমাদের চেহারা? কী আমাদের চেতনা? আর এই-যে আমাদের অস্তিত্ব-এটা কি আপাত, না কি প্রকৃত-এসব প্রশ্ন ক্রমাগত উঠে আসে একে একে মীমাংসার মুখাপেক্ষী হয়ে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকতার দাবি নিয়ে উপস্থিত আহমাদ মোস্তফা কামালের ছোটগল্পগ্রন্থ ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ। নয়টা ছোটগল্প-‘মধুবাবুর আশ্চর্য কান্না’, ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতার ভেতরকার দেয়ালটি ভেঙে যাওয়ার পর’, ‘বিজ্ঞাপন ও মানুষের গল্প’, ‘ঘুমোবার সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর’, ‘কনফেশন’, ‘তারা তখন পবিত্রতা রক্ষা করছিল’, ‘আমাদের শহরে একজন অচেনা লোক ১’, ‘আমাদের শহরে একজন অচেনা লোক ২’ ও ‘উ্নোচনে’র সমবায়ে গ্রন্থিত এই গল্পগ্রন্থ।
দুই
যুগে-যুগান্তরে বদলে যায় সমাজ-অর্থনীতি। নদীপথের মতো বাঁকে বাঁকে পরিবর্তিত হয় সমাজের গতিপথ। সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সাহিত্যের তটে। সামাজিক পরিবর্তনের অভিঘাতে আলোড়িত ও আন্দোলিত হয় শিল্পসাহিত্য। সংগত কারণেই আহমাদ মোস্তফা কামালের ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয় না। ‘মধুবাবুর আশ্চর্য কান্না’য় ভাষারূপ লাভ করেছে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্প ও এই শিল্পের কুশীলবদের বর্তমান করুণ ও মর্মন্তুদ পরিণাম-‘নিজের হাতে গড়া দলডা চোখের সামনে শ্যাষ অইয়া গ্যালো, শো না করলে দল টিকায়া রাখা যায় নাকি, কন? দলের লোকজন খাইবো কী? আমার তো আর অফুরান পয়সা নাই যে বছরের পর বছর ধইরা পুরা দলডারে টানতে পারমু! শিল্পীরা কে যে কোথায় গ্যাছে গা, মাইয়াগুলা মনে অয় বাড়ি ফিরা যাইতে পারে নাই, যাত্রাদলের মাইয়াগো তো সমাজ গ্রহণ করে না, মনে অয় পাড়ায় নাম লেখাইছে, নাইলে নিশিরানী সাজছে, আর বাড়িই বা আছিল কয়জনের, কন! হা ভগবান, তুমি আমারে এই শ্যাষ বয়সে এ কেমন শাস্তি দিলা? কী পাপ করছিলাম আমি? সরকারে যারা থাকে, তারা না অয় আমাগো কষ্ট বোজে না, এক কলমের খোঁচায় শো বন্ধ কইরা দ্যায়, বোঝে না যে শো না করলে যাত্রাদলের টিকা থাকনের কোনো পথ নাই, কিন্তু তুমি তো সব বোজো, বুইজা-শুইনাও তুমি কিছুই করতে পারলা না?’
‘স্বপ্ন ও বাস্তবতার দেয়ালটি ভেঙে যাবার পর’ গল্পে দেখতে পাই নিজের বাসাতেই “নাহার তার স্বামীর গান শোনা ও কবিতা পড়া ও চাঁদ দেখা ও বাংলার রূপে মুগ্ধ হওয়ার ‘অপরাধে’ ধর্ষিত হয়।” ‘বিজ্ঞাপন ও মানুষের গল্প’-এ উঠে এসেছে ‘চোখ ধাঁধানো আর জৌলুশপূর্ণ বিজ্ঞাপন-জগতের কথা’, এবং মধ্যবিত্তের মনোজগত ও মানসিক যন্ত্রণা। ‘ঘুমোবার সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবার পর’ গল্পে একজন লেখক ‘এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে প্রায় অমানবিক আর বীভৎস জীবন যাপন করে’ সেই চিত্র তাঁর লেখায় তুলে ধরে বোঝাতে চান যে ‘এই জীবন আমাদের কাম্য হতে পারে না।’ এই লেখকের জীবন-যন্ত্রণা শব্দরূপ পেয়েছে গল্পটিতে সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে-‘জাতীয় ্নৃতিসৌধে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের তামাশা, মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রী নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দলে আল বদর বাহিনীর প্রধান, বীভৎস দাড়িগোঁফের আড়ালে তার উপহাসের হাসিটি বোঝা যায় কি যায় না, আকাশে শহীদদের আত্মারা ভিড় করেছে, চিৎকার করছে-এই সম্মান আমরা চাই না।’ ‘কনফেশন’-এর উপজীব্য আমাদের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থান্ধতা। ‘তারা তখন পবিত্রতা রক্ষা করছিল’ ছোটগল্পে উগ্রপন্থী জঙ্গি মৌলবাদীদের অমানবিক অত্যাচার মূর্তরূপ পরিগ্রহ করেছে-“তারা প্রথমে রোজীকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, হাজার হোক নারী জাতি, কঠিন শাস্তি দেওয়া ঠিক হবে না। আলোচনা করে রোজীকে তেত্রিশবার কান ধরে ওঠবস করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মামুন এর প্রতিবাদে চেঁচিয়ে উঠলে রোজীর শাস্তিটা কার্যকর না করেই তারা একযোগে মামুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাথাড়ি চড়কিলঘুষিলাথিতে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। স্বামীর এই দুরবস্থা দেখে রোজী চেঁচাতে থাকলে তারা এবার মামুনকে ছেড়ে রোজীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ তার শাড়ির আঁচল ধরে টানে, কেউ ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে, কেউ ব্রার হুক খুলে দেয়, কেউ পেটিকোটের ফিতে কেটে ফেলে-তার সারা শরীরে অসংখ্য ‘পবিত্র’ হাত ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। অনেকক্ষণ পর তাকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন দেখা যায় তার শরীরে একটি সুতোও আর অবশিষ্ট নেই।” ‘আমাদের শহরে একজন অচেনা লোক’ শিরোনামের গল্প দুটির প্রতিপাদ্য লেখকের দুটি দার্শনিক জীবন-জিজ্ঞাসা-মানুষ তার জীবনজুড়ে প্রকৃতপক্ষে কী খোঁজে এবং মানুষ তার সারা জীবন আসলে কার জন্য অপেক্ষা করে, কিসের জন্য? ‘উ্নোচন’-এ আছে হয়েছে বিশ্বজগত ও বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্র-‘আমি তবু হাঁটতেই থাকি, শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে অনির্দিষ্টভাবে হেঁটে যাই···হেঁটে যাই-হঠাৎ মনে হয়, আমি তো একা নই, মনে হয়-আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সামনে উ্নোচিত হবে এক অশ্রুত ভাষার জগৎ, মনে হয়-এই বিপুল সৃষ্টিজগত, এই দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্ত কিছু-আমি এদেরই একজন, আলাদা কোনো অস্তিত্বই নেই আমার, বরং আমি যেন এদেরই এক নগণ্য সদস্য মাত্র।’
তিন
আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর ছোট গল্পগুলোতে এঁকেছেন প্রত্যক্ষ বাস্তবের অন্তরঙ্গ চিত্র। প্রথম ছয়টা ছোটগল্প সমাজ-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের একটা বিশেষ সময়ের প্রামাণ্য দলিলের গুরুত্ব পেতে পারে। চারপাশে যা ঘটেছে, যা তিনি দেখেছেন তারই শিল্পরূপ দিয়েছেন এসব ছোটগল্পে। ‘মিথ্যার শূন্যকে মনোরম করে উপভোগ করার নেশায়’ তিনি ছোটগল্প রচনায় ব্রতী হননি। তাঁর লেখায় মিথ্যা নেই, ফাঁকফোকর নেই, কোনো ফাঁকি নেই। বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের জীবন-প্রয়াসের আবর্তন-উদ্বর্তন-বিবর্তনের বিচিত্র প্রাণময় চিত্রাবলি তিনি অঙ্কন করেছেন স্বকীয় তুলির স্পর্শে নিজস্ব রঙের ও রেখার বৈভবে। জীবনের নানা অন্ধিসন্ধিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার আত্যন্তিক প্রবণতা বিদ্যমান তাঁর লেখায়।
ছোটগল্পকে সহজ ও সস্তা আবেগানুভূতির শিকারে পরিণত করেননি তিনি; অধিকন্তু স্থূল ও জোলো বিষয়বস্তু থেকে ছোটগল্পকে মুক্ত করার ও মুক্ত রাখার দুর্মর ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তাঁর রচনার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে। গতানুগতিক পথে পা বাড়াননি তিনি, নতুন নতুন চিন্তার চাঞ্চল্যে তিনি নতুন পথের অভিযাত্রী। ‘নিজের অসংখ্য বিকারের মোহে মূর্ছাহত মধ্যবিত্ত সমাজ’, জটিল জীবনোৎকণ্ঠা, মানবজীবনে ভাবের ঐশ্বর্য, মানুষের বিচিত্র মনোবাসনা ও অসীমের তৃষ্ণা শিল্পিত হয়ে উঠেছে তাঁর ছোটগল্পগুলোয়। তাঁর ছোটগল্পের প্রধান প্রতিবাদ্য মানুষের বাস্তবজীবন। বৃহত্তর জীবনের ভাবনা নিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-দার্শনিক ব্যবস্থার জটাজালে বিজড়িত সংকট-সংঘাতমুখর মানুষের যে-জীবন তা-ই বাস্তবজীবন। কথকতার ভঙ্গিতে তিনি বয়ন করে চলেন এই বাস্তবজীবনের বৈচিত্র্যময় রূপ-স্বরূপ। তাই বলে তাঁর ছোটগল্প জীবনের আলোকচিত্র মাত্র নয়, বরং চিত্রশিল্প। আর সাহিত্য যেহেতু কেবল মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি নয়, সেহেতু তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষের বৃহত্তর জীবনের ইঙ্গিত।
আহমাদ মোস্তফা কামালের বাস্তব কখনো কখনো অতিবাস্তব নির্মিতির মধ্য দিয়ে পাঠককে নিয়ে যায় এক পরাবাস্তব জগতে-‘তখন বিকেল। ঘণ্টাখানেক পর সূর্য ডুবে গিয়ে রোজাদারদের সামনে পবিত্র ইফতারির ক্ষণ উপস্থিত হবার কথা, অথচ সেদিন হঠাৎ করে তারা আবিষ্কার করে-ঘণ্টাখানেক আগেই সূর্য ডুবে গেছে এবং গোধূলিক্ষণ একটুও স্থায়ী না হয়ে দ্রুত রাতের আঁধার নেমে এসেছে। সেদিন আকাশে কোনো চাঁদ ওঠে না, নক্ষত্রগুলোও ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, ন্যাশনাল গ্রিডে হঠাৎ অচেনা বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় সারা শহরে আর বাতি জ্বলে না, যেসব বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে জেনারেটর ছিল সেগুলোও কী এক অজানা কারণে একযোগে নষ্ট হয়ে যায়, এমনকি ঘরে ঘরে মোমবাতি বা হারিকেন জ্বালানোর চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেয় কোত্থেকে এক দমকা হাওয়া এসে, চার্জার, টর্চলাইট, গাড়ির হেডলাইট বা ইনডিকেটর এমনকি মোবাইল ফোনের ব্যাক লাইট জ্বালাবার চেষ্টা করেও কোনো এক অজানা কারণে সবাই ব্যর্থ হয়।
‘এক অভূতপূর্ব ঘন অন্ধকারে রোজী তার উন্মুক্ত শরীর নিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।’
‘ক্ষতে ভরা নিজের মুখখানাকে অতিসুন্দর মনে করার ভ্রান্তিটা’ অপনোদনের অভিপ্রায়ে আহমাদ মোস্তফা কামাল ‘নিষ্ঠুরের মত মুখের সামনে আয়না’ ধরেছেন। সেই আয়না তাঁর ছোটগল্পের আয়না, সাহিত্যশিল্পের দর্পণ।
ঘরভরতি মানুষ অথবা নৈঃশব্দ-আহমাদ মোস্তফা কামাল; ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পাঠসূত্র, ঢাকা
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply