সাহিত্য সাময়িকীঃ কুরচি তোমার লাগি বইয়ের বেশির ভাগ রচনাই দেশি-বিদেশি উদ্যান নিয়ে। বাঙালির উদ্যানচিন্তা সম্পর্কে বলুন।
দ্বিজেন শর্মাঃ বাঙালির উদ্যানচিন্তা সম্পর্কিত কোনো ইতিহাস আমি খুঁজে পাইনি। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে প্রাচীন বাংলায় ফুলের কিছু ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়; উদ্যানের নয়। এটা সম্ভবত এ জন্য যে গোটা বাংলাদেশ প্রকৃতির আনুকূল্যে নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যান। যেসব দেশে প্রকৃতি কঠোর, সেই সব দেশের মানুষ আনন্দ সৃষ্টি ও উপভোগের জন্য প্রকৃতির অনুকরণে নিজ আবেষ্টনীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও উপভোগ্য করার জন্য গাছপালা লাগিয়ে উদ্যান বানায়। প্রাচীন ভারতে হিন্দু ও বৌদ্ধযুগে আরণ্যক উদ্যানের নজির খুঁজে পাওয়া যায়। তৎকালীন তপোবনগুলো আসলে এক ধরনের উদ্যান। বৌদ্ধরা ছিল উদ্ভিদপ্রেমিক, তারাও বৌদ্ধমঠ ও বিহারগুলোতে বৃক্ষাদি রোপণ করেছিলেন। অনুমান করা যায়, এসব সভ্যতা বঙ্গভূমিতেও তাদের উদ্যানের নমুনা নিয়ে এসেছিল।
সাময়িকীঃ আধুনিক ভারতের উদ্যান সম্পর্কে বলুন।
দ্বিজেন শর্মাঃ ভারতে আধুনিক উদ্যানের প্রবর্তক মুঘলেরা। আদি উদ্যান পরিকল্পনার রূপ হিসেবে স্বভাবতই এগুলো ছিল রীতিবদ্ধ বা ফরমাল। এখানে তৃণাঙ্গন, গাছপালা, কেয়ারি সবই ছিল জ্যামিতিক কাঠামোয় আবদ্ধ-চৌকো বা আয়তাকার। এসব উদ্যানে গ্রী্নের তাপ নিরসনের জন্য জল ও ছায়ার বিবিধ ব্যবস্থা থাকত। বাংলাদেশেও মুঘলেরা তাঁদের শাসনকালে এ ধারার উদ্যান সৃষ্টি করেন, যার কোনোটাই আজ আর টিকে নেই। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য ধারার উদ্যানশৈলী এ দেশে আমদানি করা হয়। জমিদারেরা মূলত সেগুলোরই অনুকরণ করতেন। কিন্তু আমাদের নিজস্ব মুঘল উদ্যানের বিলুপ্তি ও পাশ্চাত্য ধারার উদ্যান আমদানিকৃত বলে এ দেশে আর অন্য কোনো রীতির উদ্যানের বিকাশ ঘটেনি। বাঙালির নিজস্ব উদ্যানশৈলীর উদ্ভাবন অবশ্যই প্রয়োজন। কাজটির দায়িত্ব স্থপতি, শিল্পী ও নিসর্গীদের ওপর বর্তায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অমনোযোগিতা একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের পার্ক ও উদ্যানগুলো প্রায় সর্বত্রই আজ যদৃচ্ছা বৃক্ষ ও লতাগুল্ম রোপণে বিশৃঙ্খল ও হতশ্রী।
সাময়িকীঃ আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বৃক্ষ ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা শেখায় না। আপনার মন্তব্য কী?
দ্বিজেন শর্মাঃ বৃক্ষ ও পরিবেশের প্রতি আমাদের সংবেদনহীনতার কারণ প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই বলা হয়েছে। তাই বলে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে কিন্তু সংবেদনহীন বলা যাবে না। কেননা, মধ্যযুগের কাব্য থেকে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা ব্যাপক হারে প্রকৃতির মাধুর্যের উপস্থিতি লক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথ এ ক্ষেত্রে একটি সমৃদ্ধ খনিবিশেষ। তাঁর লেখায় প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণ আমাদের বি্নিত করে, যা সমকালীন পাশ্চাত্যের তুলনায় যথেষ্ট প্রাগ্রসর। ইদানীং আমাদের পাঠ্য বইয়ে সর্বস্তরে পরিবেশপাঠ চালু হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পাঠ্য বিষয়ে পাঠদানের দুর্বলতাহেতু শিক্ষার্থীদের মনে কোনো দাগ কাটে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
সাময়িকীঃ উন্নত পশ্চিমা বিশ্বনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির দাপটে কি প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে না?
দ্বিজেন শর্মাঃ মুক্তবাজার আমাদের দুর্বল অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং আমরা সেই চাপ মোকাবিলায় ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। এ প্রক্রিয়া পরোক্ষভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশকেও প্রভাবিত করছে এবং আমরা দীর্ঘস্থায়ী লাভের দিকে না তাকিয়ে আশু লাভের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হচ্ছি।
সাময়িকীঃ আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দারিদ্র্য ও অশিক্ষাক্লিষ্ট দেশে নাগরিক জীবনকে গাছ ও পরিবেশবান্ধব করার উপায় কী?
দ্বিজেন শর্মাঃ উপায় খুবই সহজ। প্রয়োজন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। আমরা এই প্রথম কোনো নতুন শহর গড়ছি না; এবং নগর পরিকল্পনাও নতুন কোনো বিষয় নয়। কীভাবে শহরে গাছ লাগিয়ে শহরকে সবুজ ও বহুলাংশে দূষণমুক্ত করা যায়, আমাদের নগরস্থপতিরা তা ভালোই জানেন। কিন্তু প্রকৃত সংকট দেশশাসকদের দুর্বলতার মধ্যেই নিহিত।
সাময়িকীঃ পরিবেশ ও গাছরক্ষার ব্যাপারে সরকারের কী ধরনের ভূমিকা প্রত্যাশা করেন?
দ্বিজেন শর্মাঃ উন্নয়নশীল দেশে পরিবেশ সমস্যা নানা কারণেই জটিল। আমরা দূষণমুক্ত প্রযুক্তি কলকারখানায় ব্যবহার করলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় ও বহির্বিশ্বের বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। এসব সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যথাকর্তব্য সম্পাদন অত্যাবশ্যক। এককভাবে বনধ্বংসের কথা ধরলে তাতে মুখ্য ভূমিকাসীন হলো সংঘবদ্ধ বনদস্যুচক্র; আদিবাসী বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী নয়। বর্তমান সরকারের আমলে বনধ্বংসের যে চিত্র উদঘাটিত হয়েছে, তাতে তার সমাধানও খুব কঠিন মনে হয় না। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য ব্যাপক বৃক্ষরোপণ অপরিহার্য এবং এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। আমাদের বৃক্ষসম্পদ সরকারি বনাঞ্চল পেরিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে বিস্তৃত হয়ে পড়ছে। এ উদ্যোগের আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সমভূমি ও নি্নভূমিপ্রধান এলাকা, ফলে এখানে জলসহিষ্ণু উদ্ভিদের বনাঞ্চল গড়ে তোলার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে-যে দিকটিকে এখনো যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের একটিমাত্র প্রধান বোটানিক্যাল গার্ডেন ঢাকায় অবস্থিত। পরিবেশ ও উদ্ভিদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আরও কয়েকটি ছোট ছোট আঞ্চলিক বোটানিক গার্ডেন গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেগুলো জনসাধারণকে, বিশেষত বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীদের, প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট করবে এবং তাদের জীবজগতের প্রতি সংবেদনশীল হতে সাহায্য করবে।
সাময়িকীঃ আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার প্রত্যাশা কী?
দ্বিজেন শর্মাঃ নতুন প্রজ্নের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাদের বৈশ্বিক ও দৈশিক দূষণের অভিঘাতগুলো মোকাবিলা করতে হবে। ইতিমধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশে কী ঘটবে, তা আমরা জানতে শুরু করেছি। বাস্তব অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে, তা এখনো সঠিক জানি না। তাই নব প্রজ্নকে গভীর পড়াশোনা এবং এসব সমস্যা মোকাবিলার পথ উদ্ভাবন করতে হবে। তবে এসব করতে গেলে শুরুতেই প্রয়োজন প্রকৃতি ও মানুষ-সবাইকে নির্বিশেষে ভালোবাসা। ভালোবাসাই সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এবং এই গ্রহকে বাঁচিয়ে রাখার প্রধান অবলম্বন।
সাময়িকীঃ পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে?
দ্বিজেন শর্মাঃ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি সম্পর্কে নির্বিশেষ নির্মোহ লেখক জগতে দুর্লভ। প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধরনের স্বীকৃতির প্রত্যাশী। আমিও এই দলভুক্ত। স্বীকৃতি লেখকের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির সহায়ক। পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আমি আনন্দিত।
-মোকারম হোসেন
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৫, ২০০৮।
Leave a Reply