আবেদীন কাদের
হাসপাতাল থেকে কফিন দেওয়া হবে, নাকি রোগীর পরিবারের নিজেদের কফিন কিনতে হবে বাইরে থেকে, এটা জানতে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। সকালে হাসপাতাল প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজে যোগ দেন নয়টার আগেই। কিন্তু আজ বৃষ্টি ও ঝাপটা বাতাস বেশ জোরে বইছে মধ্যরাত থেকে, তাই সবাই আসতে ক’মিনিট দেরি করছে। অপেক্ষা করছি কখন সবাই আসবেন, লাশ কফিনে করে এয়ারপোর্ট নেওয়া হবে। রাতে ফ্লাইট। প্লেনে কফিন বহন করতে আগে থেকে এয়ারলাইন্সকে জানাতে হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে অর্থাৎ যে মুহূর্তে সে নিজের মায়ের হাতে নিজের হাত রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল, তারপর প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা কেটে গেল ঝড়ের গতিতে। শুধু এ চৌদ্দ ঘণ্টা কেন, বলা যায় গত ছয় দিনই কেটে গেল দ্রুত। জাপানে চিকিৎসকেরা জবাব দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কেন যে তাঁর মাকে জোর করে নিউইয়র্কে নিয়ে এল সে-প্রশ্ন সবার মনেই জেগেছিল। তাঁর মাও ছিলেন অসুস্থ, গত সাড়ে নয় বছর ধরে শরীরটা দুর্বল, বেশ ভঙ্গুর। ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার পর শরীর আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। বয়সও হয়েছে। সেই দুর্বল শরীর নিয়েও মেয়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য হিরোকো মেয়েকে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে নিয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসকদেরও যমের সঙ্গে ছয় দিন বিরামহীন যুদ্ধ চলল। সবশেষে এক সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির কিছুটা পরে, সারা শহর যখন রাতের কোলাহলের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, সে বিদায় নিল।
কর্নেল মেডিকেল সেন্টারে যে ঘরটিতে তার আশ্রয় হয়েছিল, সেখানে আরেকজন রোগী ছিল। বৃদ্ধা। হরেক রকম ব্যাধির চিকিৎসা হচ্ছিল। ৯০ পেরিয়ে গেলেও মার্থার কৌতূহল ও দৃষ্টি দিল সজাগ। হিরোকোর বয়সও ৮০ পেরিয়েছে। মার্থার সঙ্গে অনেক ধরনের কথা হতো তাঁর। নিজের মেয়ের ব্যাধি সম্পর্কে মার্থাকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সবকিছুই জানিয়েছেন। দুজনের মধ্যে একধরনের মানসিক নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের চোখের দৃষ্টি ভাষার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে।
২·
প্রায় সাড়ে বারো বছর আগে, পঁচানব্বইয়ের জানুয়ারির শেষ দিকে এক সন্ধ্যায় হান্টার কলেজের নর্থ বিল্ডিংয়ের ৪৩৪ নম্বর কক্ষে জনা পনেরো তরুণ-তরুণী জড়ো হয়েছে। ডিম্বাকৃতির একটি বড় টেবিলের তিন দিকে সবাই বসা। চতুর্থ দিকে অধ্যাপক পিটার প্যারিসি বইপত্র নিয়ে মাত্র বসেছেন। সেমিস্টারের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস। একেবারে ভিন্ন ধরনের কোর্স এটা, ‘জার্নালিজম অ্যাজ লিটারেচার অ্যান্ড রেটোরিক্স’। ষাটের ও সত্তরের দশকে যেসব মার্কিন লেখক নিজের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে প্রতিবেদনের ধরণে কথাসাহিত্যে রূপ দিয়েছেন, তাঁদের লেখার সঙ্গে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের তাত্ত্বিক ধরণের লেখা অন্তর্ভুক্ত করে অধ্যাপক প্যারিসি কোর্সটিকে ডিজাইন করেছিলেন। টম উল্ফ, জোন দিদিয়ান, জন ম্যাকফি, হান্টার থমসন ও জ্যাক ক্যারুয়াকের লেখার সঙ্গে নোম চমস্কির ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ এবং ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মিডিয়া’ও পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়েছে। সংবাদ বা প্রতিবেদনের সাহিত্যিক মূল্য এবং সংবাদ তৈরির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘রাজনীতি’ বিষয়ে প্যারিসির উৎসাহ পাঠ্যসূচিতে লক্ষ করা যায়। সাংবাদিকতায় একদিকে তত্ত্ব, অন্যদিকে শিল্পমূল্য-দুটোকে খতিয়ে দেখাই ছিল প্যারিসির উদ্দেশ্য।
ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হলে অধ্যাপক প্যারিসি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলেন। কয়টা পেপার লিখতে হবে, কয়টা পরীক্ষা ইত্যাদি। ক্লাস শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে দেখা গেল একজন তরুণী অধ্যাপকের কাছে গিয়ে সবার ছবি তোলার অনুমতি চাইল। অধ্যাপক সানন্দে অনুমতি দিলেন। তরুণী এতক্ষণ আমার পাশে বসেছিল, খেয়ালই হয়নি। মেয়েটি জানাল, সেমিস্টারের শুরুতে ও শেষে সে সবার ছবি তুলবে। এতক্ষণ অধ্যাপকের সামনে ম্যাচ বাক্সের মতো একটি রেকর্ডার চলছিল। সেটিও মেয়েটি তুলে নিল। বোঝা গেল এটিও তার। কখন রেখেছিল খেয়াল করিনি। অর্থাৎ অধ্যাপকের বক্তৃতা এবং ছাত্রদের কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়েছে। পরে আমাকে সে বলেছিল যে রাতে ঘরে ফিরে রেকর্ড করা বক্তৃতা দুই-তিনবার শুনলে বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়।
হান্টার কলেজের সেই প্রথম দিনটি সত্যিই ্নরণীয়। ফুসাকো ছিল আমার ঠিক ডানপাশের চেয়ারটিতে। অধ্যাপক প্যারিসির হাতের বাম দিকে আমরা, আমাদের মুখোমুখি ও বাম দিকে আরও কজন ছাত্রছাত্রী। দ্বিতীয় সেমিস্টারে আরেকজন জাপানি তরুণী আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তার নাম মিচিকো। দুই সেমিস্টার পর মিচিকো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। মিচিকোর সঙ্গে ফুসাকোর বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। দ্বিতীয় সেমিস্টারে টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বদলি হয়ে যোগ দেয় ক্রিস্টিলিন। গ্রানাডার মেয়ে; সাংঘাতিক পরিশ্রমী, চিত্রনির্মাতা। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার আগেই কয়েকটি ছবি করে নাম করেছে। ক’মাসের মধ্যেই ফুসাকো ও ক্রিস্টিলিনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। প্রথমে ক্রিস্টিলিন ও আমার বন্ধুত্বের মধ্যে ফুসাকো নিজেকে বেমানান ভাবত। পরে অবশ্য জড়তা অনেকটা কেটে যায়। জড়তার কারণ, ইংরেজিতে কথা বলতে কিছুটা সংকোচ বোধ করত। কদিন পর ওর লেখা পেপার দেখে বুঝতে পারলাম ইংরেজি ভাষায় তার ভালই দখল রয়েছে।
প্রথম দিনের ক্লাস শেষে ছবি তোলা হলো। ফুসাকো নিজের ব্যাগ থেকে ছোট একটি ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে তাতে সময় নির্ধারক টিপে দিয়ে দৌড়ে এসে অধ্যাপক প্যারিসিকে ঘিরে থাকা আমাদের সঙ্গে দাঁড়াল। সবাই হাসল, বাতি জ্বলে উঠল। এভাবে ছবি তোলা হলো বার তিনেক। পরে সব সহপাঠীকে ফুসাকো সে ছবি দিয়েছিল। প্রত্যেকটি সেমিস্টারে একইভাবে নিয়ম করে সে ছবি তুলত।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে রাত নয়টার দিকে চারতলা থেকে সবাই হেঁটে হেঁটে সাবওয়ের দিকে যাচ্ছি। ফুসাকো আমার কাছে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আমি ম্যানহাটনে থাকি কি না। আমি ‘না’ বলতেই সে মৃদু হেসে তাকিয়ে রইল। ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’ জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘আমি ৮৪ স্ট্রিটে একটি জাপানি ছাত্র হোস্টেলে উঠেছি। নিউইয়র্কে আমি এসেছি আজ দুপুরে, সরাসরি টোকিও থেকে। তেমন কিছু চিনি না।’ ভাবলাম হয়তো একা যেতে তার ভয় করছে। বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে এক বা তিন নম্বর সাবওয়ে ধরে তোমার হোস্টেল পর্যন্ত যাব।’ শুনে ওর ছোট ছোট চোখ দুটো আনন্দে আরও ছোট হয়ে গেল। মনে হলো ওর দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। আমরা দুজনে হান্টার কলেজের বেজমেন্ট থেকে ছয় নম্বর ট্রেন ধরে গ্রান্ড সেন্ট্রাল গেলাম। সেখান থেকে সাট্ল-এ টাইমস্কয়ারে এবং সেখান থেকে তিন নম্বর ট্রেন নিয়ে ৮৬ স্ট্রিটে নেমে হেঁটে গেলাম ওর আবাসে।
ছিমছাম পরিচ্ছন্ন বড় একটি চারতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষে জাপানি ছাত্ররা থাকে। লবি, রিসেপসনিস্ট ইত্যাদি দেখে বোঝা গেল বেশ ব্যয়বহুল আবাস এটা। ফুসাকোকে পৌঁছে দিয়েই নিজের আবাসের উদ্দেশে পথে নামলাম। রাত হয়েছে। ট্রেনে উঠতেই ফুসাকোর মুখখানা মনে পড়ল। আমাকে বিদায় দিয়ে সে ঘূর্ণায়মান দরোজায় সামনে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুত্ব তেমন গড়ে ওঠেনি তখনো, কিন্তু ওর ব্যবহারে, চোখের তারায় একধরনের কৃজ্ঞতাবোধ হয়তো স্পষ্ট ফুটে উঠছিল। অথবা হতে পারে, জাপানি ঐতিহ্য অনুযায়ী একধরনের কোমলতা ওরই স্বভাবে এমনিতেই ছিল। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। সারাটা পথ সদ্য পরিচিত মেয়েটার ছবি মাথায় গেঁথে রইল। আমার ভাবনায় হাজার রকমের বর্ণিল ছবি ভেসে বেড়াতে থাকল। ভিন্ন এক চিন্তায় আমি মায়া ও বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে অচেনা রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। ঘরে ফিরে প্রতিদিনের মতো সেদিনও স্মান-আহারের পর জর্নাল লিখলাম। কত কথা যে লেখা হলো, তার কত কী কল্পনা, কত কী স্বপ্ন!
আজ, এত দিন পর জর্নালের সেসব পাতায় চোখ দিতে গিয়ে চোখ ভিজে এল।
প্রতিদিন বিকেলে ও সন্ধ্যায় ক্লাস থাকে। আমি কলেজের সাউথ বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ক্যাফেটেরিয়ায় এক কাপ কফি নিয়ে বইপত্রের পাতা উল্টাতাম। হঠাৎ দেখতাম দ্রুত পায়ে ফুসাকো ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সোজা দূরে কোণের জানালার পাশের টেবিলে আমার কাছে আসছে। একটি চেয়ারে কাঁধের ব্যাগ রেখে অন্য চেয়ার টেনে বসে পড়ত। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে বের করত আপেল বা কলা, বেগেল বা ক্রোসান্ট এবং সঙ্গে ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটায় ভরা বিভিন্ন ধরনের জ্যাম বা জেলি। কোনো কথা না বলে বেগেলে জ্যাম জড়াতে জড়াতে এগিয়ে দিত আমার দিকে। জ্যাম বা জেলি মাখানো বেগেল খেয়ে দ্বিতীয় দফা কফি হাতে নিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসের দিকে এগোতাম।
এভাবেই কয়েক মাস কেটে গেল। সামারের বন্ধ এল। ফুসাকো ওর অসুস্থ মাকে দেখার জন্য টোকিও চলে গেল। হঠাৎই বুঝতে পারলাম, কেমন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এক অভ্যাস পুরোনো জীবনের শৃঙ্খলাকে কখন যেন বদলে দিয়েছে। রাতে ঘরে ফিরে মাঝেমধ্যে ফুসাকোকে ফোন করতাম। হাজার ধরনের কথা হতো; কিন্তু দুজনেই যে দুজনকে সাংঘাতিক মিস করছি, তা বলতে গিয়েও বলা হতো না। শুরু হলো চিঠি লেখা, চিঠি বিনিময়।
সামারের তিন মাস সত্যিই দীর্ঘ ছিল সেবার।
সেপ্টেম্বরের ক্লাস শুরুর আগে ফুসাকো ফিরে এল। আমি ওকে বিমানবন্দরে আনতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে ওকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম, হাতে ধরা লাগেজের ট্রলি। বেশ কিছুক্ষণ আমরা কোনো কথা না বলে শুধু তাকিয়ে ছিলাম দুজনের দিকে।
এরপর সময় গড়িয়ে যায় অত্যন্ত দ্রুত। তৃতীয় সেমিস্টারেই আমাদের কোর্স করা শেষ হয়ে যায়, বাকি থাকে শুধু থিসিস লেখা। ফুসাকোর তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক প্যারিসি, আমার অধ্যাপক জেমস রোমান। ওর বিষয়টা সত্যিই ছিল ভিন্ন ধরনের। ম্যানহাটনের ব্রডওয়ের দুপাশের জনবসতি ও তাদের জীবন নিয়ে সে থিসিস লিখল। আমি লিখলাম ‘সামরিক শাসন ও সংবাদমাধ্যমের সমস্যা’ নিয়ে।
এমএ ডিগ্রি শেষ করে গ্রাজুয়েট সেন্টারে পিএইচডিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, ফুসাকোও পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবে। কিন্তু দেশ থেকে আসার সময় সে পরিকল্পনা করে এসেছিল, এমএ শেষ করেই ফিরে যাবে দেশে। আমার ভর্তির প্রস্তুতি দেখে সে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল। একদিকে মন চায় নিউইয়র্ক থেকে আরও কিছুটা পড়াশোনা বা গবেষণা করতে, অন্যদিকে দেশে অসুস্থ মাকে একা রেখে বেশিদিন বিদেশে থাকাটা অনুচিত হবে-এই ভাবনাও মনকে পীড়া দিচ্ছিল। আমি ওর মানসিক দোলাচলটা বুঝতে পারতাম। কিন্তু কিছুই বলিনি। একদিন সে টেলিফোন কার্ড কিনে কলেজ থেকে ওর মাকে ফোন করল এবং জানাল কদিন পর বাড়ি যাবে। কিন্তু তার আগে পিএইচডিতে ভর্তির দরখাস্ত করে যেতে চায়।
জাপানি ভাষায় মা-মেয়ের মধ্যে কী কথা হয়েছে বুঝতে পারিনি; কিন্তু ওর চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, ওর মায়ের কোনো অমত নেই। এরপর সেও আবেদনপত্র জমা দেয় এবং যথারীতি পিএইচডিতে ভর্তি হয়ে যায়। তত দিনে আমাদের দুজনের সম্পর্কটাও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। ফুসাকোর পরিবার সম্পর্কে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। এক দিন হান্টার কলেজের দ্বিতীয় সেমিস্টারে একটি কোর্সের বেশ কজন আমরা রেডিও-টেলিভিশন মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। পুরোনো দিনের ক্যামেরা ও বিভিন্ন সম্পাদনা যন্ত্র সেখানে ছিল। হঠাৎ একটি ক্যামেরা দেখিয়ে ফুসাকো বলেছিল, ‘আমার জ্নের সময় বাবা এই ক্যামেরাটা কিনেছিলেন, আমার ছেলেবেলার অনেক ্নৃতি ১৬ মিলিমিটারের এই ক্যামেরায় ধরা আছে। মা এখনো মাঝেমধ্যে প্রজেক্টরে সেসব চালিয়ে দেখেন। আমার নয় বছর বয়সে বাবা চলে যান। ক্যান্সারে বহুদিন ভুগেছিলেন। বাবাকে আমি সাংঘাতিক ভালোবাসতাম।’
ফুসাকোর চোখ ছলছল করে উঠল। আমি কোনো প্রশ্ন করিনি। ধীরে ধীরে আমরা সেই শীতের বিকেলে বাকহীন বেরিয়ে এসেছিলাম মিউজিয়াম থেকে।
পিএইচডিতে এত চাপ ছিল যে আমাদের প্রথম দুই-তিনটে সেমিস্টার অসম্ভব রকম পরিশ্রম গেল। এক দিন আমাদের প্রিয় অধ্যাপক প্যারাসি কথায় কথায় বললেন, ‘চাকরির কথা যদি ভাব, তাহলে আমি পরামর্শ দেব-দুটো ডিগ্রি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না করে ছোট প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাও পিএইচডি করতে। ভবিষ্যতে গবেষণা ও চাকরির জন্য সুবিধা হবে।’ অধ্যাপক প্যারিসির পরামর্শ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। একে তো পড়াশোনা করতে এসেছি চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে, তার ওপর কাজটাজ করে কঠোর পরিশ্রম হয় পড়াশোনা করতে, তাই এতটা পথ এসে বিশ্ববিদ্যালয় বদলানো কি উচিত হবে! এসব যখন ভাবছি, ঠিক তখনই অধ্যাপক রোমান আমাকে প্রায় জোর করে নিউ স্কুলে ট্রান্সফার হতে বাধ্য করলেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি ও ফুসাকো দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। নিউ স্কুলে আমি ভর্তি হলাম, ফুসাকো থেকে গেল গ্রাজুয়েট সেন্টারে। নিউ স্কুলের প্রথম সেমিস্টারেই সেই ভয়াবহ ৯/১১-এর ঘটনা। সেদিন বিকেলে ক্লাস ছিল অধ্যাপক অ্যারেটোর ফাউন্ডেশন-১ ক্লাস। হঠাৎ ফুসাকো ফোন করে দুঃসংবাদ দিল।
এরপর আমাদের জীবন একেবারেই বদলে গেল।
সপ্তাহান্তে আমরা প্রায়ই একসঙ্গে কাটাতাম। তাই ফুসাকো শহরের বাইরে অর্থাৎ নিউজার্সি বা কানেকটিকাটে এক বেডরুমের কনডো অ্যাপার্টমেন্ট কেনার চেষ্টা করছিল। ৯/১১-এর কদিন আগে জর্নাল স্কয়ারে খুব সুন্দর ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হলো। মাত্র সেটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে থাকা শুরু করেছে সে, সে সময়ে মার্কিন রাজনীতি একেবারে বদলে গেল। ফুসাকো কোর্সওয়ার্ক শেষ করে কম্প্রিহেনসিভের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ওর মা বারবার ওকে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন, কারণ ফুসাকোর নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি খুব ভয় পাচ্ছিলেন। ফুসাকো সিদ্ধান্ত নেয়, ফিল্ডস্টেটমেন্ট ও ডিসারটেশন সে জাপানে ও নিউইয়র্কে অর্ধেক অর্ধেক করে লিখবে।
এভাবেই ক’মাস জাপানে কমাস নিউইয়র্কে কাটাচ্ছিল সে। সম্পূর্ণ নিজের অর্থে পড়াশোনা। বিভিন্ন জাপানি কোম্পানির হয়ে অনুবাদ করে ফুসাকো যা আয় করত, মোটামুটি সচ্ছলভাবে চলে যেত। নিউইয়র্কে এলে সারাক্ষণ অসুস্থ মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকত, জাপান ফিরে গেলে নিউইয়র্কে আসার জন্য উদগ্রীব থাকত। নিউইয়র্ক তার প্রিয় শহর, ভিলেজের জাপানি রেস্তরাঁয় বসে সন্ধ্যায় বহুক্ষণ কাটিয়ে দেওয়ায় তার ছিল অপার আনন্দ।
গত পাঁচটা বছর কত দ্রুত কেটে গেল। ডিসারটেশন লেখার জন্য গত দুই বছর নিউইয়র্কে আসা সে কমিয়ে দিয়েছিল। তার অ্যাপার্টমেন্ট তালাবদ্ধ থাকত। মাঝেমধ্যে গিয়ে আমি মেইলগুলো গুছিয়ে রাখতাম, জাপান থেকেই সে অনলাইনে টেলিফোনসহ ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করত। মাঝখানে ক’বছর আগে আমার ডিফেন্সের সময় সে বেশ কিছুদিন নিউইয়র্কে ছিল একটানা। মাস তিনেক আগে সে তার ডিসারটেশনের প্রথম খসড়া অধ্যাপককে পাঠিয়ে দেয়। পরিকল্পনা ছিল সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ডিফেন্ড করবে। প্রায় প্রতিদিন লম্বা ই-মেইল করত, মাঝেমধ্যে টেলিফোন। সামারগুলোয় ক্রিস্টিলিনের বাড়িতে বা অন্যত্র বারবিকিউ করা, হইহুল্লোড়ে মেতে থাকা। আর শীতের বরফঢাকা রাতে তার জর্নাল স্কয়ারের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিংরুমে বসে আড্ডা দেওয়া। কত সন্ধ্যা গড়িয়ে মধ্যরাত, মধ্যরাত ভোর হতো, আমরা ওয়াইন খেতে খেতে নেতিয়ে পড়তাম। নিজের ছেলেবেলার হাজারটা গল্প করত সে।
ধনী পরিবারের সন্তান সে। ভালো স্কুল-কলেজে পড়েছে। জাপানের সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জর্মন সাহিত্যে স্মাতক, এমএ পড়েছে একেবারে ভিন্ন বিষয়ে-ফাইনান্সে। জাপানি একটি কোম্পানিতে কিছুদিন চাকরি করতে গিয়ে অর্থনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই এমএ করে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে। কিন্তু বেশিদিন মন টেকেনি তাতে, তাই মিডিয়াস্টাডিজ পড়তে চলে আসে নিউইয়র্কে। নিজের তরুণ বয়সের একাধিক প্রেম ও বিচ্ছেদের কথা সে বলত গভীর বেদনাভরা কণ্ঠে। বহুদিন মধ্যরাতে আমরা আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি অনেকটা সময়। মাঝেমধ্যে ক্রিস্টিলিন থাকত সে আড্ডায়। পানীয়, কবিতা ও চলচ্চিত্র প্রিয় বিষয় ক্রিস্টিলিনের। ফুসাকোর প্রিয় পানীয় এবং যেকোনো ধরনের আড্ডা। নিজে কোনো দিন সাহিত্য রচনা করেনি, কিন্তু জর্মন সাহিত্য পড়ার সময় থেকে বিভিন্ন সাহিত্যবিষয়ক লেখা বা কবিতা, উপন্যাস তার প্রিয় হয়ে উঠেছিল। হাইনের কবিতা পড়ত মাঝেমধ্যে। একজন জাপানি শিক্ষক তাকে কীভাবে হাইনে বুঝিয়ে ছিলেন, সেসব গল্প করত।
নারী-পুরুষের বন্ধুতা, প্রেম ও যৌনতা বিষয়ে এতটা পশ্চিমা ধাঁচের মন কী করে তার গড়ে উঠল, আমার কাছে তা বি্নয়ের ব্যাপার ছিল। আমার সংস্কারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল মন ওর জীবনযাপনের অনেকটা দিক বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু বন্ধুত্ব মানুষকে যেমন বহু অজানা দুর্বোধ্য বিষয়কে অতিক্রম করতে সাহায্য করে, তেমনি হয়তো বিপরীত মেরুর মানুষ হয়েও আমরা গভীর বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েছিলাম। বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানকে আমি কখনো নিজের জীবনে আরোপ করতে পারিনি, ফুসাকোর ছিল উল্টো সিদ্ধান্ত। বুড়ো বয়সে, ৭০ পেরিয়ে প্রেমিককে সে বিয়ে করবে ভেবেছিল। তার আগে পুরো জীবনটা সে গবেষণা, লেখা, অধ্যাপনা ও অসুস্থ মায়ের সেবা করে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ‘একাকিত্ব’ সে একেবারেই মেনে নিতে পারত না।
প্রেম, গভীর প্রেম তার আরাধ্য ছিল; কিন্তু নিজের জন্য, নিজের কাজের জন্য, গবেষণার জন্য কোলাহলহীন নিঃসঙ্গ আবাসও ছিল জরুরি। তাই সার্বক্ষণিক প্রেমিকসঙ্গ, বন্ধুসঙ্গ এড়িয়ে চলত। সপ্তাহান্তে বা অন্য কোনো দিন দীর্ঘ আড্ডা, পানাহার এবং প্রেমময় উষ্ণতায় নিজেকে তাপিত করে, বাকি সময় কাজে ডুবে থাকত। নিজের চরিত্রের অসাধারণ বৈপরীত্য এবং জটিল মনোজগৎ বিষয়ে সে ছিল সম্পূর্ণ সজাগ। সে সব নিয়ে দিনের পর দিন, হাজার সন্ধে কেটেছে আমাদের কথা বলে। কত স্বপ্ন ও কাঙ্ক্ষা রেণুর মতো ঝরে পড়ত তার চোখের পাতায়। আজ সে সব সত্যিই সুদূর হয়ে রইল।
৩·
বেশ কয়েক সপ্তাহ ফুসাকোর টেলিফোন পাইনি, ই-মেইল পাইনি। ব্যাপারটা একেবারেই অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাই আমি বারবার ওকে ফোন করছিলাম। অ্যান্সারিং মেশিনে চলে যাচ্ছিল, কেউ ধরছিল না। হঠাৎ কদিন আগে ওর মা হিরোকোর টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠলাম। জানালেন, ফুসাকো ভীষণ অসুস্থ ক’মাস ধরে, চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্ক আসছে ক’দিন পর। খটকা লাগল। জাপানে চিকিৎসা অত্যন্ত উন্নত মানের। তা ছাড়া হিরোকোর শরীরও ভালো নই। ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর বেশ দুর্বল শরীর। হাঁটুতে ব্যথা। কোনো কিছু বোঝার আগেই ওরা মা-মেয়ে এল। কর্নেল মেডিকেল সেন্টারে ভর্তির ব্যবস্থা করা ছিল জাপান থেকেই।
প্লেন থেকে স্ট্রেচারে যখন ফুসাকোকে নামানো হলো আমি মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারিনি। মাথা কেশশূন্য, চোখ ম্রিয়মান। শরীরটা দেখে মনে হলো ৮০ বছরের কোনো রুগ্ণ শরীর। ওর হাতটা ধরতেই ওর চোখের জলে ভিজে গেল হলুদ গাল দুটো। তেমন কোনো কথা বলতে পারছিল না। এর পরের ছয় দিন ছয় রাত কেটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। হিরোকো ও আমি হাসপাতালে পালা করে ওকে সঙ্গ দিয়েছি। বুঝেছিলাম সময় ফুরিয়ে এসেছে।
কষ্ট করে ও কিছু কথা বলেছেঃ ওর অ্যাপার্টমেন্টটা বিক্রি না করে সব বইপত্র ও জিনিসগুলো যেন গুছিয়ে রাখা হয়। অধ্যাপকদের যেন খবর দেওয়া হয়। ক্রিস্টিলিনকে যেন হাসপাতালে আসতে অনুরোধ করি ইত্যাদি। ছয় দিন পর, সেদিন বিকেলে চিকিৎসকেরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবস্থা সত্যিই খারাপ, কথা বলতে পারছিল না। হাসপাতালের বিছানার একদিকে হিরোকো অন্যদিকে আমি বসে আছি। আমাদের দুজনের হাতের মুঠোয় ফুসাকোর দুটো হাত। বারবার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছে। হিরোকো অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল।
একসময় ফুসাকোর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
এ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা! আমার হাতের মধ্যে উষ্ণ একটি হাত ধীরে ধীরে শীতল হয়ে এল। কোনো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। বাস্তব ও পরাবাস্তব জীবন ও মৃত্যু মিলেমিশে একাকার হয়ে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল ম্যানহাটনের হিমেল সন্ধ্যায়। মৃত্যু কাছে জেনেও জোর করেই সে নিউইয়র্ক এসেছিল। হিরোকোকে জানিয়েছিল, সে নিউইয়র্কে মরতে চায়। হিরোকো হয়তো বুঝেছিল এর পেছনের ইচ্ছাটুকুকে। ঠিক পরের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, অর্থাৎ আসার সাত দিন পর, জেএফকে এয়ারপোর্টে হিরোকোকে বিদায় দিতে হলো। ফুসাকোর কফিন ভিন্নপথে বিমানে উঠেছে।
প্রায় আশি বছরের এক অসুস্থ বৃদ্ধা রুগ্ণ শরীরে সন্তানের লাশভরা কফিন নিয়ে জাপানের উদ্দেশে পাড়ি জমালেন। অবিশ্বাস্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য হয়ে রইল ফুসাকোর মৃত্যু!
গত ক’সপ্তাহ প্রায় প্রতিদিনই জর্নাল স্কয়ার হয়ে কলেজে যাচ্ছি পড়াতে। মাঝেমধ্যে ফুসাকোর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে কিছুক্ষণ একাকী বসে গত কয়েক বছরের ্নৃতি নিয়ে ভেবেছি। বুকের মধ্যে কেমন এক অচেনা ভার অনুভব করেছি, করছি। জীবন, বেঁচে থাকা, মৃত্যু-সবই নিজের কাছে কখনো কখনো সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। জীবনের কোনো কিছুর ওপরই হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, এই সত্য বড় হয়ে বুকে চেপে বসছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৮।
tamjid
hi how r u
Raju
Good……..